সকালের কোমল নীল আকাশ থেকে হাল্কা বাতাস বেয়ে টুসটুসে কমলাসোনালী আলোর দানা ঝরে পড়ে টুপটাপ। আমলকী গাছের ছায়ায় জংলাপ্রিন্টের শাড়ীর মতন রোদ্দুর, তুরতুর করে শিশিরভেজা আলোছায়ার উপর দিয়ে দৌড়ে যায় কাঠবিড়ালি, ভোমরা গভীর গুঞ্জন করে উড়ে বেড়ায় আমের বোলে বোলে, শীত ফুরিয়ে আবার এলো নতুন প্রাণের দিন।
এইসব দিনগুলোতে অনুরাধার মনকেমন করে, উনুন ধরাতে ধরাতে, আনাজ কুটতে কুটতে, রাঁধতে রাঁধতে মনে পড়ে কতদিন সেই তাড়াহুড়া নেই, তখন অভি আর অঝোরা স্কুলে যেতো, ওদের বাবা যেতো অফিসে-সকালগুলোয তখন অনুরাধার নি:শ্বাস ফেলার সময় থাকতো না। এদিক থেকে অভি-"মা, কোথায় রাখলে জুতো?" ওদিকে থেকে অঝোরা, "মা, সেফটিপিনগুলো রাখো কোথায়, দরকারের সময় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না!" অনুরাধা তো একজন, দশজন তো না, কতদিক সামলাবে সে? তবু সে না গেলে কিছুই খুঁজে পেতো না কেউ, না ছেলেমেয়ে না তাদের বাবা-কেউ ই কিছু খুঁজে পেতো না। অনুরাধা তরকারির কড়াই আগুন থেকে নামিয়ে দৌড়ে গিয়ে খুঁজে দিয়ে ফিরে আসার সময় বলতো "দুই আঙুলের বেশী কেন দেখ না তোমরা?" কোথায় গেলো সেইসব দিন?
রান্নাঘরের জানালার বাইরে রোদ্দুরছায়ার খেলা চলতো এরকমই। মনকেমন করা বসন্তদিনগুলো এসেছে আর চলে গেছে, কাজের ভীড়ে ওদের দিকে চোখ পড়লেও মনে আসন দেবার সময় ছিলো না। সকলে ইস্কুলে আপিসে চলে গেলে আস্তে আস্তে বাড়ীটা শান্ত হয়ে আসতো। তবু ঘরদোর ধুয়েমুছে কাপড় কাচাকুচি সব করে স্নানটান সেরে উঠতে উঠতে বেলা হয়ে যেতো অনেক। পুজো দেওয়া সেরে দুপুরের খাওয়া খেতে খেতে আরো দেরি। চুল শুকাতে ছাদে গিয়ে চোখে পড়তো চারিদিকে গাছে গাছে নতুন পাতা, সজনের ফুল ছাদ থেকে হাত বাড়িয়েই পাড়তো সে, অঝোরা সজনেফুলের বড়া খেতে ভালোবাসতো, বিকালে সে ফিরলে ভেজে দিতো বেসন দিয়ে।
তার সব কিছু ভাবনা ছিলো সংসারকে ঘিরে-প্রিয়জনেদের ভালোলাগা না লাগা নিয়ে। নিজের মনের মধ্যে যে ফুলগুলো ফুটতো, মনের বাগানের মাটিতেই ঝরে গেছে তারা, কাব্যমালায় গাঁথা হয় নি তাদের। অঝোরা বা অভি বা তাদের বাবা-কেউ কি জানতো অনুরাধা ডাইরি লিখতো একসময়? কবিতাও কিছু সে লিখেছিলো বিয়ের আগে, মামারবাড়ী থেকে আনা সুটকেসের মধ্যে কাপড়ের রাশির নীচে রয়ে গেছে আজও তাদের হলদে হয়ে যাওয়া পাতা। কেউ কি কোনোদিন খুঁজে পাবে তাদের?
বুকের কাছের সন্তানেরা কত দূরে আজ! একজন দূর সাগরপাড়ে নিজের মতো আছে, অন্যজন হাজার মাইল দূরে পাহাড়ী শহরে চলে গেছে চাকরি নিয়ে। যাক, যাক, জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে তো চলে যেতেই হয়, তাদের কেন আটকাতে চাওয়া?
স্বামী এখন রিটায়ার করে অবসরজীবন যাপন করতে করতে পরিকল্পনা করছে একবার গ্রামে নিজেদের ভিটেমাটি যেখানে ছিলো দেখতে যাবে। অনুরাধা ও যাবে সাথে। কিন্তু তার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি নেই, অতি শৈশবে সে পিতৃহীনা হয়, তখনই গ্রাম ছেড়ে মা-দিদিমা-দাদামশায়ের সংগে চলে এসেছিলো, গ্রামের স্মৃতি তার কাছে গতজন্মের মতন আবছা।
কি যেন নাম ছিলো নদীটার? তেরাই না ভোগাই? গাঁয়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণাঙ্গী নদীটি বর্ষায় প্রমত্তা হয়ে উঠতো, তখন তাকে দেখে কে বলবে বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল পার হয়ে তারা পাঠশালে যেতো? সেখানে ফিরে গেলে কি কিছু মনে পড়বে অনুরাধার? সেইসব চলে যাওয়া বেলা সব, সেই সব শৈশবদিন? সেইসব ব্রতকথা---মাঘমন্ডল সোনার কুন্ডল?
(Cont.)
Sunday, April 19, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment