ট্রেন চলেছে কুউ উ উ ঝিকঝিকঝিক করে। শীতের কাবেরী নদীর স্বল্পতোয়া দেহ, রেললাইনের দুইপাশে যেমন হয়- অজস্র মাঠ, ধানক্ষেত। শীতে সোনালী ফসল তোলার মরশুম, মাঠে মাঠে স্তুপ করে রাখা কাটা ধানের গোছা। দেখতে দেখতে একেবারে দক্ষিণতম অংশে চলে এসেছি। অন্তরীপে। সম্মুখে শুধু মহাসমুদ্র। সাগরবেলায় তিনরঙা বালি, হলদেটে সাদা, লাল, কালো--পায়ে পায়ে শিরশিরে জলবালি পেরিয়ে জলের দিকে এগিয়ে যাওয়া, মহাসমুদ্রের হাওয়া চুলগুলি ওড়ায়, সমুদ্র কী গভীর নীল, ঢেউয়ের মাথায় ফেনারা কী দুধেল!
কী আশ্চর্য এই দুনিয়া! কী অপূর্ব এইসব গাছেরা, ঐ মহাসমুদ্র, ঐ রঙীন বালুবেলা, ঐ সমুদ্রদিগন্তে ভোরের বেলা গোল একটা লাল বলের মতন সূর্যের লাফিয়ে ওঠা!!!
ঢেউ আসে, ঢেউ যায়, বালিতে ঝিনুক পড়ে থাকে। বালিতে অদ্ভুত নকশা তৈরী হয় জলের টানে, দেখতে দেখতে অবাক আর খুশী হয়ে ওঠে নতুন কিশোরী, যার আকাশী ফ্রকে সমুদ্র আর আকাশ জেগে থাকে একই সঙ্গে। ঐ তো দেখতে পাচ্ছি সে নীচু হয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে নেয়, ঝিনুকের গায়ে চিত্রবিচিত্র নকশা!!!
একটি দুটি শিলায় বহির্সমুদ্রের ঢেউআটকানো ছোটো অংশে ভোরেরবেলা স্নান করতে এসেছি। জলে লাল-সবুজ ছোট্টো ছোট্টো মাছ সাঁতরে বেড়ায়। এত বোকা মাছগুলো, ওদের গামছায় ছাঁকা দিয়ে ধরে ফেলা যায়। ভাই সমুদ্রের মাছ পুষতে চায় বাড়ীতে, বাবা হাসে, বলে পাগল নাকি? কিন্তু ভাই কাঁদে, সে ছোটো প্লাসটিকের কৌটায় জল ভরে তাতে করে মাছ নিয়ে যেতে চায় বাড়ীতে। জলের মগে নেওয়া হয় দু'খানা মাছ। নিয়ে আসা হয় গেস্ট হাউসে। কিন্তু দুপুরে মাছগুলো মরে যায়, ভাইয়ের কান্না থামাতে বাবা কিনে আনে ক্যালাইডোস্কোপ!
চোখের সামনে সেই ম্যাজিক নল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাজার হাজার নক্সা দেখি ভাইবোনে! চৌকো গোল ছয়কোণা আটকোণা সোজা বাঁকা লাল নীল সবুজ জ্বলজ্বলে চকমকে ম্যাড়মেড়ে কত কত অজস্ররকমের প্যাটার্ণ! কান্না ভুলে গিয়ে মস্ত মস্ত চোখ করে দেখে ভাই। ছোট্টো ভাইটা, সুন্দর নরম ওর শিশুমুখ, মাত্র নার্সারিতে পড়ে ও। ওর গালে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মা যদি বকে? দেওয়া হয় না, ক্যালাইডোস্কোপ ওর হাতে দিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই নিচে ছোটো ছোটো নারকেল গছের বাগানে, বিকেলে এখানে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হয়।
নারকেলকুঞ্জে একা একা জলের মতন ঘুরে ঘুরে কথা কইতে ইচ্ছে করে, রোদ্দুরে ছায়ায় হাল্কা মেঘের ওড়াউড়ির খেলায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে! আচ্ছা, কেমন হয় আমি যদি একলা একলা কোথাও হারিয়ে যাই? কেউ আর না খুঁজে পায় আমায় কোনোদিন? খুব মনে পড়ে অনিকে, অনিলিখা- ছোট্টো থেকে আমার খেলার সাথী সে। মনে পড়ে উলের ডিজাইনের মতন কুঁচকানো গালের, পাকা চুলের এক প্রিয় মানুষকে, জ্ঞান হওয়া থেকে যার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘোরাফেরা- আমার ঠাকুমা। আচ্ছা, আমি যদি না থাকি, ওদের কি মনে পড়বে আমায়?
মনে পড়ে একটা দুপুর, সে কবেকার দুপুরবেলা....
নম্র ধূপকাঠি জ্বলেছে সে দুপুরে বাইরে ছিলো রোদ ঝিলমিল
স্মৃতির নীলখাম- সেখানে গান ছিলো, সঙ্গে ছিলো হাসি খিল্ খিল্।
হিজল বনে ছিলো লুকানো ডাহুকেরা, শিমূল ডেকেছিলো বুলবুল-
হঠাৎ জলপরীর একমুঠো হাসি পেয়ে খুশীতে মাথা নাড়ে ঘাসফুল।
Saturday, January 30, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment