সে কথা রেখেছে। দেশ বেড়ানোর চিঠি লিখেছে। চিঠির ভাঁজ না খুলে হাত বোলাই অনেকক্ষণ। সেই স্মৃতিস্বপ্নকল্পনা দিয়ে তৈরী ভূমি আমিও চিনতাম। কতবার চৈত্ররাতের ঘুমভাঙা জ্যোৎস্নায় সে দেশ আমি দেখেছি চাঁদের আয়নায়। সাবধানে ভাঁজ খুলি, পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমিও রওনা হই চিৎপুরের নতুন টার্মিনাস "কলকাতা" থেকে, সকাল ৭ টার রোদ তেরছা হয়ে পড়েছে কামরায়, ট্রেনের নাম মৈত্রী।
দেখতে দেখতে পার হয়ে যাই নৈহাটী রাণাঘাট গেদে দর্শনা। কখন সীমান্ত পার হয়ে গেছে ট্রেন, তাদের তো চেক করেছে কাস্টমস, আমাকে তো পারে নি, সীমান্ত বলতে আমার শুধু মনে পড়ে এক মেয়ের কথা, তার নাম আঁচল, তার দু'চোখ ভরা জল, সে যে গ্রামে থাকতো সেই গ্রামের নাম ছিলো বনসীমান্ত। দু'খানা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তার অবাক হয়ে যাওয়া মা তাকে বলেছিলো, "মা আঁচল, এতদিনে তুই আমার কাছে ফিরে এলি?"
দর্শনা পার হয়ে আমিও এসে পড়ি লালন ফকির রিসার্চ সেন্টারে। সেই লালন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখির ছটফটানির গান। কেমন করে সেই পাখি আসে? কেমন করে সে যায়? ধরতে পারলে তার পায়ে মনোবেড়ী দেবার বাসনা সবারই, কিন্তু ধরতে পারলে তো!
এবারে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন, আমি শুনতে পাচ্ছি বাঁশী! কু উ উ উ ঝিকঝিকঝিকঝিক। "কে না বাঁশি বায়ে বড়াই কালিনী নই কুলে/ কে না বাঁশি বায়ে বড়াই এ গোঠগোকূলে।" বড়াই গো, ও বড়াই, কে বাঁশি বাজায় কালিন্দীর কূলে? কে বাঁশি বাজায় এ গোঠগোকূলে? এ কালিন্দী নয়, পদ্মা। ট্রেনের হুইসিল পার হয়ে রাখালি বাঁশি শুনতে চেষ্টা করি কান পেতে। ঈশ্বরদি স্টেশন থেকে বোতলে পানীয় জল ভরে নিই আমিও, সিরাজগঞ্জ ঘাট পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে চলছে ট্রেন। নিচে যমুনা, এ যমুনা রাধাকৃষ্ণের সে যমুনা না, এ বাংলার যমুনা, ব্রহ্মপুত্র।
অনেক দূরের গাছ থেকে বাতাসে উড়ে চলে গুচ্ছ গুচ্ছ শিমূলতুলা, ভিতরে ক্ষুদ্র কয়েকটি বীজ। ওরা সীমান্ত মানে না, ওরা মুক্ত। সেই অঙ্কুরসম্ভব বীজপক্ষী দেশকাল পার হয়ে উড়তে উড়তে যদি গিয়ে কখনো সে প্রাচীন মাটিতে ফেরে, মাটি কি চিনতে পারে তাকে? স্নিগ্ধ আদরে জড়িয়ে ধরে? নাকি বিস্ময় আর বেদনা মেশানো চোখে চেয়ে কেবল বলে, কে কে কে তুমি?
সে ঘোমটা সরায়, আমি তাকে দেখি
দেখি তার প্রাচীন মুখের বলিরেখা-
দেখি তার গভীর কুয়োর মত চোখ।
আরেকটু কাছে গিয়ে উঁকি দিলেই
দেখা যাবে গভীরে জল টলটল।
আমাকে ঘিরে ধরে অজস্র মুখ
শিশুমুখ তরুণমুখ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ মুখ।
কাউকে চেনা-চেনা মনে হয়
কাউকে একদম অচেনা।
সবাই জানতে চায় আমি তাদের কে!
কে আমি? কোথায় ছিলাম আমি?
কোথা থেকে এসেছিলাম?
মনসুন্দর, তুমি কোথায়-
তুমি কি আজো বেঁচে আছো?
আশ্চর্যময়ী, এসো, আমাকে ছোঁও
স্পন্দনে স্পন্দন মিলিয়ে বলে দাও
আমিও বেঁচে আছি।
Saturday, January 30, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment