সেটা ছিলো ২০০৮ এর মে মাস। গ্রীষ্ম এসেছে বেশ জাঁকিয়ে। তপতপে দুপুরগুলো। সোনাগলানো রোদ যে আসলেই কী জিনিস তা বোঝা যায় বাইরে বেরুতে হলে। রোদ একেবারে সারা গায়ে চিড়বিড়িয়ে লাগে যেন সত্যিই গলন্ত ধাতু। এমন সুন্দর নীলকান্তমণিপ্রভ আকাশকেও তখন মনে হয় শত্রু, মনে হয় মেঘেরা এসে দখল করে নিক আকাশের ঐ নীল খিলান। এখানের লোকে অবশ্য কেয়ার করে না, ফুরফুরে হালকা জামাকাপড়ে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে, ব্যস্ত সামার ক্যাম্পাস। রেগুলার স্টুডেন্টরা এসময় বেশী থাকেনা বলে স্পেশাল সামার স্টুডেন্টরা অনেক এসেছে।
লাইব্রেরীর ভিতরে চমৎকার ঠান্ডায় দেয়ালজোড়া ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একটা নিরিবিলি বেঞ্চি দখল করে বইপত্রের গোছা আর ল্যাপটপ রেখে গুছিয়ে বসি। বাইরে বড় বড় ওক গাছের ছায়া আর রোদ্দুরে মিলমিশ হয়ে দিব্যি জটিল নকশা হয়েছে। মানুষের দল চলেছে, বাইরের শব্দ কিছু আসে না বলে নি:শব্দ চলচ্চিত্র মনে হয়। বাইরে দেখি ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের তিনজনের দল চলেছে এখন, ক্লাসে যাচ্ছে নিশ্চয়। ওরা প্রত্যেক গ্রীষ্মে আসে। কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি ঝোলাঝালা সাদা পোষাক, মাথায় কালো সিল্কের লম্বা ভেল। ওদের দেখে সহসা মনে পড়লো মণিদীপাকে।
মণিদীপার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিলো এইরকমই এক গ্রীষ্মে, বাংলার এক ছোটো শহরে। অসংখ্য কাজুবাদামের গাছে ঘেরা ছোট্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সে ক্যাম্পাস তখন গ্রীষ্মকালীন ওয়ার্কশপের জন্য খোলা ছিলো কয়েক সপ্তাহ। তারপরেই গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। গরম পড়েছিলো খুবই। তার উপরে জায়গাটাও রুখু লালমাটির দেশ।
সেইখানের ওয়ার্কশপেই মণিদীপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রথমবারের দেখাতেই বাকীদের থেকে ওকে অন্যরকম লাগে। ওর স্বাভাবিক পোশাকের উপরে একটি ঘীয়া রঙের রেশমের হালকা চাদর উর্ধাঙ্গে জড়ানো। ওর চুলগুলোও কেমন অন্যরকমভাবে চূড়া করে বাঁধা। প্রথম পরিচয় হয়েই তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না কেন ঐ বিশেষ চাদর আর চুলবাঁধা, তাই অপেক্ষা করে রইলাম আলাপ আরো কিছুদূর গড়ানোর।
মণিদীপার সঙ্গে ওর বাবামা ও এসেছিলেন সে শহরে, ওরা সকলে উঠেছিল শহরের মাঝের যে বাজার তার পুবের দিকে এক হোটেলে। আমার হোটেলও ঐদিকেই ছিলো। সারাদিন চলতো ওয়ার্কশপ, সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল অবধি, গোটাদিন। সেভাবেই তৈরী হয়ে আসতাম আমরা। কিন্তু একদিন ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে হঠাৎ শুনি সেদিনের ওয়ার্কশপ বাতিল।
একটা রিকশা ঠিক করে আমি আর মণিদীপা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে। দীর্ঘ পথ, ঐ দুপুর রোদে আরো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। পথের পাশে পাশে কোথাও ছায়ামেলা গাছের সারি, কোথাও ধূ ধূ মাঠ।
রিকশা চলছে, আমরা দু'জনে টুকটাক কথা বলছি। তখন আমাদের বেশ ভালোরকম আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞেস করি ওর বিশেষ পোশাকের কারণ। মণিদীপা বলে যে ও এক বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে ঐ চাদর পরতে হয় আর চুল চূড়া করে বাঁধতে হয়। এখনও ও বাড়ীতেই থাকে বাবামায়ের সঙ্গে, আর কিছুদিন পরে আশ্রমে চলে যাবে। আশ্রম নাকি ওদের পাড়াতেই। এখন ও স্কুলে চাকরি করছে, আশ্রমে গিয়ে থাকলেও সেই চাকরি করতে পারবে কিন্তু সংসারধর্ম আর করতে পারবে না। ও বলে, সংসার যাতে করতে না হয় তার জন্যই তো মনে ঈশ্বরপ্রীতি জেগেছে, সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছা জেগেছে, বাবামা যে এই সামান্য কথাটা কেন বুঝতে চান না ও বোঝে না।
আমি চুপ করে শুনি। ধর্মের এত সবল রূপ আমি নিজেদের চেনা-পরিচিতের মধ্যে দেখিনি। ধর্মচর্চা প্রায় ব্যক্তিগত ছিল সেখানে। পরিচিত জনের মধ্যে বড়োজোর দেখেছি কোনো গুরুর কাছে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দীক্ষা নেওয়া আর গৃহী উপাসক হিসাবে তা পালন করা। একেবারে সংসার ছেড়ে আশ্রমে চলে যাবার মতন উচ্চকিত ধর্মচর্চা দেখিনি। শুনেছি কারুর কারুর বৈরাগ্য জাগার গল্প, সেও পুরানো কালের গল্প। কোনো বিশেষ কারণ নেই তবু কেন জানি মণিদীপার দিকে তাকিয়ে মনে হয় বৈরাগ্য নয়, কোনো গভীর অভিমান ওকে সংসার থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। কী সেই অভিমান? কোনোদিন কি জানা যাবে? সামান্য সময়ের মধ্যে ওকে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছে মেয়েটা খুব চাপা, অন্তর্মুখী। ওর গভীর অভিমানের কথা উজার করার মতন উদার মন না পেলে ও কখনোই কাউকে বলবে না।
আমাদের কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে যায় এবারে, মণিদীপার দাদা বিদেশে থাকে, সেখানেই স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে। বিদেশেই তাদের নাকি সেটল করার ইচ্ছে, কিন্তু পরে কি হয় বলা যায় না। চাকরির উপরে নির্ভর, কোম্পানি যদি দেশে ফিরিয়ে আনে, তবে ফিরে আসতে হতেও পারে।
" দাদাবৌদি ফিরে এলেই ভালো, বাবামার তো বয়স হচ্ছে! আমি আশ্রমে চলে গেলে আর তো বেশী দেখাশোনা করতেও আসতে পারবো না। " মণিদীপা কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলে।
" তোমার বাবামা তোমার সন্ন্যাস নেওয়ার ব্যাপারে কি খুশীমনে মত দিয়েছেন?" আমি আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলি।
" না। ওরা প্রথমে মত দিতেই চায় নি। পরে যখন বুঝতে পারলো আমার আর অন্য কোনো পথ নেই, আমার মন একেবারে প্রস্তুত, বাধা দিলে আমার মৃত্যু ছাড়া অন্য পরিণতি নেই, তখন বাধ্য হয়ে মত দিয়েছে। এখনো ওরা আশা করে কোনোদিন আমার মতি ফিরবে, আমি বিয়ে থা করে সংসার করবো। মানুষের আশা যে কী অদ্ভুত!"
"কিছু যদি মনে না করো মণিদীপা, সংসার করতে বাধা কি? সন্ন্যাস তো রইলোই, যখনই মনে হবে সংসারধর্ম কর্তব্যকর্ম শেষ হয়েছে, তখন যাবে সন্ন্যাসে। এখন মাবাবাকে দু:খ দিয়ে আশ্রমে চলে যাবে কেন? "
"বিয়ে? সংসার? না, কখনো না, কখনো না। " অদ্ভুত কাঠিন্যে শক্ত হয়ে উঠেছে শান্ত, কোমল মেয়েটির চোয়াল দু'খানা, হঠাৎ যেন কথাগুলো ধাতব হয়ে গেছে, চোখের মণিতে অন্যরকম আলো, মুখ পাঁশুটে হয়ে গেছে। মনে হয় আমার অনুমান সত্যি, হয়তো খুব জটিল কারণ আছে এসবের নেপথ্যে।
আমার খুব অপ্রস্তুত লাগে, দ্রুত কথা ঘুরিয়ে আমাদের ওয়ার্কশপের প্রসঙ্গে চলে আসি। ঘটমান বর্তমান আমাদের আর্ত অতীত আর অজানা ভবিষ্যৎ থেকে মুক্ত করে চেনা মাটিতে পা রাখতে সাহায্য করে।
পরেরদিন আমার চলে আসতে হয়েছিলো, আর কথা হয় নি। জানাও হয় নি কি ছিলো ওর ঐ তীব্র বিতৃষ্ণার নেপথ্যে। নানা কাজের ব্যস্ততায় আস্তে আস্তে ঘটনার স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। মণিদীপার কথা কিন্তু ভুলি নি।
Friday, March 11, 2011
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment