সে অনেকদিন আগের কথা। দূর দক্ষিণের এক ছোট্টো সবুজ শহরে তখন থাকতাম। আপনদেশের মাঠের থেকে শিকড়সমেত উপড়ে নেওয়া একলা একটা গাছের মতন গিয়ে সেখানে যখন প্রথম নামলাম, তখন ঘোর শীত। গাছপালা বেশীরভাগই পাতাহীন বিবর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু চিরসবুজ পাইনেরা সবুজ করে রেখেছে শহরের আকাশরেখা। তারপরে প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সূর্য সরে গেল উত্তরে, হয়তো কোনো দূর কাননের কুন্দকলি করুণ চোখে শেষ চাওয়া চেয়ে নিয়ে ঝরে গেল ধূলায়। শীত বিদায় নিল পুরোপুরি। কিশলয়বর্ণ জয়পতাকায় দিকদিগন্ত আচ্ছন্ন করে এসে পড়লো ঋতুরাজ বসন্ত।
বসন্ত এসে গেল, কিন্তু আমাদের রুটিনবাঁধা কাজকর্ম-নেটওয়ার্ক-ডেডলাইন-দূরভাষ-বাড়ী-আপিস দিয়ে আঁট করে বাঁধা জীবনে কিন্তু বিশেষ পরিবর্তন হল না। হরেক রকম ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি আর কম্পুটারে ঠাসা সব ঘর। গভীর রাতে সব বড়ো বড়ো আলো যখন নিভে যায়, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ আলো জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে। অন্ধকার ঘরে ভারী অদ্ভুত লাগে, আমার এক বন্ধু এদের ইলেকট্রনিক ফায়ারফ্লাই বলে। বৈদ্যুতিন জোনাকি। জ্বলে জ্বলে উঠে সবুজ আলো ছড়ায়।
চুপ করে শুয়ে থাকি রাত্রির ঘুমের জন্য, ঘুমের জলে ডুবে যাবার আগে বহুদূরে ফেলে আসা ঘরবাড়ী মাঠ বাগান ঝোপঝাড় সব মনে পড়ে, সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলতো সন্ধ্যার পরের থেকে শুরু করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উড়ন্ত আলো। মনে হতো আহা ওরা কেন সবাই একরঙের আলো দেয়? কেন কেউ নীল আলো, কেউ সবুজ আলো, কেউ বেগুনী আলো, কেউ লাল আলো দেয় না? ঘরের ওই সবুজ আলো দেওয়া বৈদ্যুতিজোনাকিরা জ্বলতো নিভতো জ্বলতো নিভতো, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতো।
মাঠবনবাগান তখন সবুজে সবুজ, ফুলে ফুলে ছয়লাপ চারিদিক। ঘাসফুলেদের বেগুনীহলদে পেরিয়ে গোলাপী আজেলিয়ার ঝাড়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়তো সোনালীরোদ। আজেলিয়ার ফুল গোলাপী, কমলা, লাল, সাদা-নানা রঙের হয়। আমার দোপাটির কথা মনে পড়তো, "তোমার নীলদোপাটি চোখ, তোমার শ্বেতদোপাটি হাসি..."। দক্ষিণের জোরালো হাওয়ায় আজেলিয়া ঝোপেরা এলোমেলো হয়ে হাসতো, ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে উড়তে থাকতো, রেণু ঝরতো পথের ধূলায়। পথের দু'পাশে ওক গাছেরা অজস্র নতুন সবুজ পাতায় ভরে গেছে তখন, শুধু তাই না, গাছ ভরে মঞ্জরী ধরেছে, রাস্তা ভরে গেছে সেই ঝরা মঞ্জরীতে।
স্প্রিং ব্রেকের ছুটি শুরু হলো তারপর, সপ্তাহখানেকের কিছু বেশী (আগের সপ্তাহের শনিরবি ধরে নিয়ে নয়দিন)। ব্রেকের আগের সেই শুক্রবারে যখন সব শুনশান হয়ে এলো, ধৈর্যশীল বাহনেরা যখন মালিকদের নিয়ে সব পাড়ি দিলো উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে, খুব ইচ্ছে হলো বন্ধুকে নিয়ে হারিয়ে যাই নতুন বসন্তের সবুজ জঙ্গলে, তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করি, মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে বেরিয়ে আসি বনজ্যোৎস্নায়, দেখি কথা কয়ে ওঠে কিনা রহস্যময় বনস্থলীর কোনো আত্মা, যেমন কইতো বহু বহু বছর আগে, যখন এদেশে শ্বেতকায়রা প্রবেশ করেনি, গোটা ভূখন্ড ছিলো লালমানুষদের, যারা পৃথিবীকে তাদের মা বলে জানতো, তারা শুনতে পেতো পাতার কুঁড়ি খোলার শব্দ, তারা শুনতে পেতো জলের ঘূর্ণীর শব্দ, তারা দেখতে পেতো অনেক অনেক দূর, বৃষ্টির পরে কেমন পরিষ্কার হয়ে যায় আকাশবাতাস-অনুভব করতো তারা। আমি কতকাল পরে এসেছি এখানে, ওরা তো আর নেই এখানে, হয়তো আছে কোনো রিজার্ভে, হয়তো ভুলে গেছে সবকিছু।
লালমানুষদের এখন সবাই বলে" ইন্ডিয়ান", আমিও আরেক ইন্ডিয়ান, বহুদূরের ইন্ডিয়া বলে দেশটির মানুষ, আমাদের বলে এশিয়ান, নেটীভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে আলাদা করার জন্য। কী অদ্ভুত, না? কলম্বাসের ভুলই "সত্য" হয়ে গেলো, সে কিনা ভেবেছিলো ইউরোপের থেকে ক্রমাগত পশ্চিমের দিকে জাহাজ চালিয়ে এসে ইন্ডিয়াতে পৌঁছেছে, কারণ পৃথিবী যে গোলকাকার! তীরে নেমে সে অধিবাসীদের ইন্ডিয়ান বলে স্থির করলো। বোঝো কান্ড! পৃথিবী যে কত বড়ো গোলক, হয়তো ঠিকঠাক জানতো না ওরা, জানলে হয়তো টাকাকড়ি যোগাড় করে পাড়ি দিতে পারতো না। পশ্চিমের পথে পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছাতে ওদের আরো বহুদিন চলতে হতো, ততদিনে সব ফুরিয়ে যেতো, খাবারদাবার, জল, সব। ঝড়টড় হলে তো আরো সোনায় সোহাগা। মাঝে বিরাট ঐ মহাদেশ না থাকলে কী হতো কেজানে!
উনি তো ইতিহাসে ঢুকে গেলেন, কিন্তু ওঁর ভুলটিও ইতিহাসে ঢুকে গেলো, আদি-অধিবাসীরা হয়ে গেলো ইন্ডিয়ান। কী গেরো! দ্বীপগুলো হয়ে গেলো ইন্ডিজ, পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলে কোনোভাবে একটা রফা করেছে, কিন্তু এই লালমানুষদের বেলায় তাও করেনি। "রেড ইন্ডিয়ান" কথাটা শুনলে এরা ভুরু কপালে তুলে তাকায়! আবার জিজ্ঞেস করে,"হোয়াই আর ইউ সেইং রেড?"
যাকগে, হচ্ছিলো সেই বসন্তের ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যানের কথা। আমরা প্ল্যান করতে থাকি ক্যাম্পিং এর, নানারকম প্রস্তাব উঠতে থাকে,পড়তে থাকে, কখনো একমত হয়ে জোরালো হয়, কখনো দ্বিমত হয়ে ভেঙে পড়ে। প্ল্যান করে ক্লান্ত তৃপ্ত মনে চলে যাই যে যার বাড়ী।
*******
"বিজন ঘরে, নিশীথ রাতে আসবে যদি
আমি তাইতে কি ভয় মানি?
জানি বন্ধু জানি---
তোমার আছে তো হাতখানি...."
এয়ারকন্ডিশনারের হাল্কা চাপা শব্দের গুম গুম শোঁ শোঁ, অসংখ্য সবুজ জ্বলানেভা আলোর মধ্যে অনুভব করি তাকে, যে ছিলো অনেক অনেক অনেক দিন আগে, যে আছে এখনো, যে থাকবে আরো অনেক অনেক দিন পরেও। সে জানে আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের অতীত, জানে আমাদের কৃপণ বর্তমান, প্রতি মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়া ক্ষণগুলির জন্য আমাদের দুঃখ ও অশ্রুকণিকা, জানে আমাদের প্রসারিত অনন্তস্পর্শী ভবিষ্যৎ। সভ্যতার এই পরতের পর পরত খোলসগুলো আমাদের ঢেকে রেখেছে পোশাকের মতন, ঘরের মতন, যানবাহনের মতন, ডেডলাইনের মতন,আরো আরো অনেক ছোটো-বড়ো কনস্ট্রেইন্ট আমাদের চোখের সামনের জিনিস চোখের থেকে মুছে দিয়েছে। আমাদের ব্যথিত আত্মা যখন কেঁদে ওঠে সেইসব হারানো জিনিসগুলোর জন্য, হারানো সম্পর্কগুলোর জন্য, তখন কোনো আশ্চর্য কৌশলে সে ছুঁয়ে ফেলে আমাদের ভিতরমন, আমাদের আত্মা, এমন করে ছোঁয় যেন ছিলোই সে আমাদের একদম ভেতরে, কোনো খোলোস না পেরিয়েই কেমন করে যেন পৌঁছে গেছে সেখানে।ঐ সেই ফ্ল্যাটল্যান্ডের উপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ত্রিমাত্রিক আপেল যেমন সোজাসুজি পৌঁছে গেছিলো বৃত্তের কেন্দ্রে, পরিধি না পার হয়েই! ঠিক তেমনি করে।
নানা কারণে ক্যাম্পিং হলো না, এমনিই আমরা ঘুরতে গেলাম বাইসিক্ল ট্রেইল ধরে, বসন্তের সবুজ গাছগাছালি, সুরমুখর পাখপাখালি আমাদের অভ্যর্থনা করলো নীরবে সরবে। হরবোলা পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমার হারানো দুপুরগুলো মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল শালিক চড়ুই কাক কোকিল সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আমার দেশেও, উষ্ণদিনের মোহন আলোর ঝর্ণাধারা যখন চরাচর ধুইয়ে দেয় তখন তা তো ওদের ভিতর বাহিরও ধুইয়ে দিয়েছে। আমরা মানুষেরাই শুধু এত এত জালের পর জালে আটকানো।
অর্ধেক দিন ধরে ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে শেষে গড়িয়ে-যাওয়া দুপুরে আমরা বিশ্রাম নিতে আর আহার গ্রহণ করতে বসি স্টেট পার্কের কৃত্রিম সরোবরের ধারে, পল্লবিত ওয়াটার ওকের ছায়ায়। আকাশ সেদিন এক্কেবারে নীল, দূরে চিল পাক খায়, হ্রদের জলে সরু পাতলা মোটরচালিত নৌকায় লোকেরা জলবিহার করছে, নৌকার অতি দ্রুতগতি আর পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে উল্টোমুখে বেরিয়ে যাওয়া হাওয়ার স্পর্শ নিশ্চয় ওদের খুব আনন্দ দিচ্ছে, ওরা চিৎকার করছে খুশীতে।
সকাল বেলাতেই দোকান থেকে খাবার দাবার কেনা হয়েছিলো, সেই সেদ্ধ টার্কীর ফালি আর চীজের ফালি মাঝখানে দেওয়া দুই স্লাইস পাউরুটিই অমৃত মনে হয়। ক্ষুধাই হলো সুধা, যদিও দেশের লুচি-আলুরদমের কথা মনে পড়ে যায়। সে যেন গতজন্মের স্বাদ, এত মধুর সেই স্মৃতি।
কচি সবুজ ঘাসের উপরে কাত শুয়ে পড়ি, ঘাসের সুড়সুড়ি লাগে কানে, বেশ লাগে।
"তোমার দেশ এত সুন্দর!" মুগ্ধ হয়ে বন্ধুকে বলি।
সে ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে,"না না, এর চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর জায়গা আছে, আছে রেড উডের বন, ওখানে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো গাছ আছে, গত গ্রীষ্মে গেছিলাম, সে এক অদ্ভুত জিনিস। তুমি ঐ গাছ ছুঁলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে চলে গেছো সেই তত হাজার বছর আগে...মিশরে তখন পিরামিডগুলো তৈরী হচ্ছে।"
আমি হেসে ফেলি, পাছে এই দুটো গাছপালা ঘাসফুল পাখপাখালি দেখে একেই দেশের সেরা সৌন্দর্য ভেবে বসি, এই ভয়ে কেমন ব্যস্ত হয়ে আশ্চর্য সুন্দর জায়গার কথা বলছে! আরে, বিখ্যাত জায়গা তো আছেই, আশ্চর্য সব জিনিস তো আছেই পৃথিবীতে, কিন্তু তার জন্য এই হাতের ছোঁয়ার মধ্যের, এই বুকের কাছের, এই চোখের সম্মুখের অপরূপ আশ্চর্য সৌন্দর্য কি বৃথা হয়ে গেলো? অপরূপ এই জগৎ, জগতের প্রতিটি কোণাতেই অফুরন্ত আনন্দের উৎস লুকিয়ে আছে। নিজেদের বাঁধা জালগুলো ছিন্ন করতে পারলেই রূপকথার সোনার পালক আপনিই উড়ে এসে পড়ে হাতে, মাথায়, চোখেমুখে।
আমরা গল্প করতে থাকি, কোথা থেকে কোথায় চলে যায় গল্পের বিষয়বস্তু, ছোটোবেলার কথা, সেকেন্ডারি ইস্কুলের কথা, নানাসময়ের বেড়ানোর গল্প, এখনকার কাজের কথা ---সব মিলেমিশে জগাখিচুড়ী হয়ে যায় গল্পের মধ্যে।
বেলা পড়ে আসে, ঢলে পড়া সূর্যের কিরণে কোমলতা, পশ্চিমের মেঘগুলি আরেকটু পরেই অরুণরঙে রাঙা হয়ে সন্ধ্যাকে মায়াবতী করে তুলবে। আমরা ঘরে ফিরতে থাকি, ক্লান্ত দেহে, তৃপ্ত হৃদয়ে। একটি মুক্তির দিনের স্মৃতি অবিনশ্বর হয়ে থাকে মনের মণিকোঠায়।
Thursday, October 24, 2013
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment