Saturday, October 26, 2013

হেমন্তদিনের পথযাত্রা

সে অনেকদিন আগের কথা। আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু হয়েছিলো এক অক্টোবরের শেষদিনের দুপুরে। মোবাইলে আবার সব সবক'জনে মিলে "রোড ট্রিইইইইপ" বলে একজনকে শোনানো হচ্ছিলো আর উনি মোবাইলের মধ্য থেকে অভূতপূর্ব শব্দ শুনে হাসছিলেন।

যাইহোক, পালা করে চালানো হবে ঠিক হয়েছিলো আর যদ্দূর যাওয়া যায় গিয়ে গভীর রাতে কোনো সরাইয়ে ওঠার কথা ছিলো। হাজার মাইলের পথযাত্রা, একটানা তো সম্ভব না। থামতেই হবে। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হলো না, বিকালে এক ইটালিয়ান রেস্তরাঁয় খেতে থামা হলো, সেখানে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো এক সঙ্গী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়।

পরে রাত্রে গাড়ী চলছে, যিনি চালাচ্ছেন তার ঘুম এসে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে দৈত্যের মতন সব ট্রাক... ভয়ে উদ্বেগে বাকীরা অস্থির। রাত একটায় থামা হলো পথের ধারের কম্ফর্ট ইন এ। দোতলায় দুই ঘর মিললো,সব কজনে দুই ঘরে ভাগ হয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, সকালে উঠে ফের নতুন করে পথে, হিট দ্য রোড এগেইন...

এসব দীর্ঘ যাত্রায় অডিও-বই খুব ভালো জিনিস, যন্ত্রের মধ্য থেকে শান্ত ধীরগতি গলাটি পড়ে যায় গল্প, শুনতে শুনতে চালাতে থাকে চালক, শুনতে থাকে অরোহীরা, পথের একঘেয়েমি কেটে যায়। সেই বেতালের গপ্পো শুনতে শুনতে রাজা বিক্রমের পথচলার মতন, তবে গল্পের শেষে প্রশ্ন নেই, এইটা অনেক সুবিধে।

বনপাহাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেছে আন্তঃরাজ্যমহাসড়ক। চারিপাশে ছড়ানো হেমন্ত সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের গা ভরে সমস্ত গাছপালার পাতাগুলো রঙীন হয়ে গেছে-লাল, বাদামী, কমলা, হলুদ-ঝরে যাবার আগে ওরা এত রঙীন হয়ে যায়, তারপরে গাছেরা ন্যাড়া বৈরাগী হয়ে যাবে গোটা শীতকালের জন্য, এ ক্ষণিক রাঙাবাস খসে যাবে ধারালো শীতবাতাসে, তারপরে নামবে তুষার। এখন এই অপূর্ব ফল-কালারের উপরে ঝলমল করছে হেমন্তের সোনালী রোদ,নেশা ধরানো সৌন্দর্য্য। মনে পড়ে যায় এই সময়েই তো আমার দেশে ধানের উপরে কোমল উজল রোদ ছড়িয়ে গেছে দূর কতদূর...

এরপরে তো ধান পাকবে, ধানকাটা হবে, তুলে আঁটি বেধে নিয়ে যাবে, গাঁয়ের পথ ভরে যাবে ধান্যসুবাসে...

দেখতে দেখতে পাহাড়নদীর পাশ দিয়ে ভুটাক্ষেতের দেশে চলে আসি আমরা। যে ছোট্টো শান্ত শহরটিতে আমরা অতিথি, সেখানে গিয়ে মুগ্ধ। বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমস্ত গাছেরা ফল কালারে সেজেছে, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য। ছবিতে এর শতাংশে একাংশও ফুটবে না, তবু ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বহমান সময়ধরাকে দু'হাতের অঞ্জলিতে একটুখানি ধরে রাখার চেষ্টা। চিরবৃদ্ধ অথচ চিরতরুণ কাল হাসে মানবশিশুদের ব্যর্থ এ চেষ্টা দেখে।

গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিলো, হোস্ট ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন ডিনারে। এঁরই ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কনফারেন্স, আয়োজন করছেন প্রাক্তন ছাত্রশিষ্যেরা।

ডিনারের জন্য বুক করা ছিলো ঝর্ণাধারার কাছ ঘেঁষে হোটেল, ঝর্ণার উপরে মুখ বাড়ানো একটি ঘর, চারিধারে স্বচ্ছ কাঁচ আবরণী ঘেরা, সেখানেই আয়েশ করে বসে অতিথিদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা।তখন সূর্য পশ্চিমে একদম দিগন্তে ঢলে গেছে, আলো আঁধারি জলধারার উঁচু পাড়ির উপরে একটি গাছ হেমন্তে সোনালী হয়ে যাওয়া পত্রসম্ভার নিয়ে ঝরঝর করে কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে---কী অপূর্ব অনুভবী দৃশ্য। পৃথিবী কী আশ্চর্য সুন্দরী! ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে কী অপরূপ তার সাজবদল রঙবদল সুরভিবদল সুরবদল। অবন ঠাকুরের ছবিকলমখানি থাকলে হয়তো বর্ণনা করতে পারতাম, কিন্তু আমার ছবিহীন এই রুখু কলমে সে বর্ণনা অসম্ভব।

তবু কেন লিখি? কেন এই অস্থির আকাঙ্ক্ষা? মনে হয় আকাশ-বাতাস জল-পাহাড়-গাছপালা-মানুষজন সব কিছু নিয়ে সমস্ত দৃশ্যখানি নকশীকাঁথার মতন মুড়ে উপহার পাঠিয়ে দিই সেই প্রিয়জনকে যে প্রান্তটুকু ছুঁয়েই বুঝে ফেলবে গোটাগুটি সবটাই, যা দেখা যায় তাও যা না দেখা যায় তাও-যা কিছু রয়েছে আঁকা আর যা কিছু পাওয়া গেলো অনুভবে-তার এতটুকুও বাদ যাবে না ওর বুঝতে। কিন্তু সেতো হবার নয়, এ যে জলচারী মীনের আকাশ ছোঁয়ার সাধ! তাই বুঝি দেখতে গিয়ে সব ঝাপসা হয়ে যায় নোনতা অশ্রুতে?

দু'দিন থাকা হলো সেখানে, সদ্যপরিচিত মানুষগুলোর আন্তরিক আতিথেয়তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পৃথিবীতে কত ঋণ থেকে যায়, কোনো কোনো ঋণে ঋণী থেকেই সুখ। "তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ..."

ফেরার পথ আবার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে-পথে বেরুলেই কেমন একটা লাগে, বোধহয় সেই বিস্মৃত পূর্বজদের যাযাবর রক্ত বুকের মধ্যে কোলাহল করে ওঠে, সেই যে এক কবি বলেছিলো- "তারাই যথার্থ যাত্রী যারা চলে যায়

কেবল যাবারই জন্য-

হাল্কা মন, বেলুনের মতন

নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়

কেন তা জানে না,তবু চলো চলো বলে অবিরত

তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস

স্বপ্নে হানা দিয়ে যায় সৈনিকেরে যেমন কামান

অপরিবর্তনীয় দেশ, মহাশূন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস

যার নাম কখনো জানে নি কোনো মানবসন্তান..."

বনপাহাড়ীর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় বারে বারে ফিরে আসে কবেকার এই লাইনগুলো, উড়ন্ত রঙীন পালকের মতন ভেসে যায় যেন, আকাশে তখন রঙীন মেঘ, বেলা ঢলে এলো, আরেকটু পরেই রাতবাতিরা জ্বলে জ্বলে উঠবে। রাত্রির সরাই এ বিশ্রামের পরে আবার পরদিন সকালে চলা শুরু, একসময় এসে গেল চেনা শহর, ক্লান্ত আমরা ফিরে যাবো যে যার নীড়ে।

কিন্তু পথ ফুরাবে না, সে অনিঃশেষ বয়ে গেছে, এক সূর্যোদয় থেকে নতুন সূর্যোদয়ের দিকে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে ... সেই পথযাত্রার আনন্দতিলক কি পড়বে এসে এই কপালে, পরিব্রজনপ্রিয় পা দু'টি যে পথের ডাকে খুশী হয়ে ওঠে?

"এই পথ যদি না শেষ হয়..."

No comments: