Thursday, April 3, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৪)

"হ্যালো, তুলি?" ফোনের ওপাশ থেকে অন্বেষার গলা।

হেসে বলি, "হ্যাঁ রে টেঁপি, আমি। বল।"

অন্বেষা বেশ অনেকদিন টেঁপিতে আপত্তি করতো না, ভেবেছিলাম বুঝি ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু আজকে ওপাশে সে রেগে ফায়ার, বলে, "তোকে বলেছিলাম টেঁপি বলে না ডাকতে। বন্ধুর একটা কথা রাখতে পারিস না?"

আমি হি হি করে হেসে বলি, "টেঁপি নামটা আমার বেশ ভালো লাগে রে। কেন এই নামে ডাকতে বারণ করিস? তোর নাম তো আর ভন্তুরি না? আমার ছোটোবেলার আঁকার ক্লাসের এক বন্ধুনি ছিল, ওর ডাক নাম ছিল ভন্তুরি। কেমন করে জানি নামটা জানাজানি হয়ে যায় ক্লাসে, আর যায় কোথা? সবাই ঐ নামে ডেকে ওকে ক্ষ্যাপাতো। সেই তুলনায় তোর ডাকনাম তো দারুণ চমৎকার।"

ওপাশে অন্বেষার রাগী মুখ না দেখেও বুঝতে পারি, হয়তো মুখ ভ্যাঙাচ্ছে, কেজানে! রাগ ভাঙানোর জন্য নানা ভুজুং ভাজাং দিলাম খানিকক্ষণ। কিন্তু ও ওপাশে চুপ। হয়তো বেশী রেগে গেছে।

যাইহোক খানিক পরে ওর গলা এলো আবার, এবারে সিরিয়াস। বললো, "শোন তুলি, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় আমার এখানে আমাদের পুরানো স্কুলের কয়েকজন বন্ধু আসছে, স্কুলের ব্যাপারে ফান্ড-রেইজিং এর একটা প্ল্যান হবে। তুই আসতে পারবি?"

টকটক করে মাথার ভিতর হিসেব চালু হয়, আগামীকাল বিকেল পাঁচটা? তার মানে সাড়ে চারটের মধ্যে কাজকর্ম গুটিয়ে যেতে হবে। বিকেল পাঁচটায় বন্ধুদের পুনর্মিলন উৎসব চালু হলে কত রাত গড়াবে ঠিক নেই। সেসব সেরে-

"কী রে, পারবি আসতে?" ওপাশ থেকে অন্বেষা আবার প্রশ্ন করে।

আমি নরম গলায় বলি, "আগামীকাল বিকেল ছটায় শুরু করতে পারিস? তখন হলে নিশ্চিন্তে যেতে পারি। নইলে একটু হাঁসফাঁস হয়ে যায় আরকি।"

"ঠিক আছে, তুই ছটায় আসিস। বাকীরা যারা পারবে পাঁচটায় আসবে, এক ঘন্টার জন্য আর তেমন কী?"

"থ্যাংক ইউ। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো ঐ সময়ে। পট লাক পার্টি করছিস নাকি? তাহলে একটা কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে পারি।"

" আরে না না, পটলাক না। তোর কিছু আনতে হবে না। মাত্র তো তুই আমি আর আরো পাঁচজন মত। চায়ের পার্টি। "

"ঠিক আছে, আমি যাবো। আর কে আসছে রে? বিদিশা, কাবেরী আসছে?"

"বিদিশার থেকেই তো এইসব প্ল্যান শুরু। ও আসবে তো বটেই। কাবেরী আসতে পারে, তবে ওর মেয়েটার নাকি জ্বর, ভালোর দিকে গেলে আসবে। আর আসছে তিয়াসা, মনামী আর মৌপিয়া।"

"আচ্ছা, দারুণ। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। এখন রাখি, হ্যাঁ?"

ফোন বন্ধ করে জানালার কাছে যাই। বাইরে ঝকঝকে মধ্যগ্রীষ্মের বিকেল। ছায়ামেলা বিরাট বিরাট গাছ, ঘন সবুজ পাতায় ভর্তি। বৃষ্টি এলে এরা কী উল্লসিত হয়ে ওঠে! দেশে এখন ভরা বর্ষা, বৃষ্টি নাকি হয়েই চলেছে প্রতিদিন। এক বেলা শুকনো থাকে তো পরের বেলাতেই ঢালে।

রোদভরা দুপুরটা মিলিয়ে গিয়ে অনেক আগের সেই ইস্কুলবেলার বর্ষা মনে পড়ে। মনে পড়ে অন্বেষা, মনামী, কাবেরী, বিদিশার কিশোরীবেলার মুখগুলো।

বৃষ্টি নামার সময়গুলো কখনো স্কুলে আসার সময়ের সঙ্গে মিলে যেত সেসব দিনে। সবাই স্কুলে আসতাম বেশ দূর দূর থেকে, সাইকেল চালিয়ে। ছাতা নিয়ে সাইকেল চালানো বেশ কৌশলের ব্যাপার, সবাই পারতো না। তাই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে কেউ কেউ পৌঁছতো। মাঝে মাঝে অবশ্য রেনি ডে হয়ে ছুটিও হয়ে যেত।

একবার অন্বেষা খুব ভিজেছিল। ওর সেদিনের বৃষ্টিভেজা চুপ্পুস মুখ মনে পড়ে, চুলগুলোর প্রান্ত বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল, হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্ছো করে এমন হাঁচি দিচ্ছে যে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বড়দি (তখন বড়দি ছিলেন ভাস্বতীদি) ছুটি দিয়ে দিলেন। সেইবার বেশ ভুগেছিল অন্বেষা, সপ্তাহখানেক ইস্কুলে আসতে পারে নি। তখন ক্লাসে কী হলো, কদ্দুর পড়া এগোলো সেসব ওকে দেখিয়ে দিয়ে আসতো ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু লীনা।

লীনা এখন কোথায়? অন্বেষাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই লীনার বিয়ে হয়ে গেছিল ওর পরিবারের ঠিক করে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে, লীনার ইচ্ছে ছিল না, ও আরো পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু ওর উপায় ছিল না। ওদের পরিবার বেশ দরিদ্র ছিল, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েকে পড়াতেই নাকি অনেক কষ্ট গেছে, আর সাধ্য নেই। যদিও লীনা ক্লাস নাইন থেকেই ছাত্র-ছাত্রী পড়াতো, কিন্তু সেই ভরসায় ভালো পাত্র হাতছাড়া করে মেয়েকে কলেজে পড়ানোর ইচ্ছা নাকি ছিল না ওর বাবামায়ের।

অন্বেষার সঙ্গে সেই সময়েই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় আমার, শুধু ও একাই না, বাকী আরো অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তাই বহু কথাই অজানা রয়ে গেছে। ওর সঙ্গে মনে হয় কারুর কারুর যোগাযোগ রয়েই গেছিল, তাই এতদিন পরে ঐ পুরানো ইস্কুলের জন্য কিছু করার একটা প্রোজেক্ট হাতে নিতে চাইছে ওরা।

এই ব্যাপারের শুরুটা হয়েছিল কয়েকমাস আগে। তখন বিদিশা দেশে গেছিল, নানা ব্যস্ততার মধ্যে সময় বার করে আমাদের পুরানো স্কুলে গেছিল ও। এখন স্কুলের শিক্ষিকারা প্রায় সবাই নতুন, আমাদের আমলেররা দুই চারজন ছাড়া প্রায় সকলেই অবসরে। নতুন প্রধানা শিক্ষিকা লাবণ্যপ্রভাদির সঙ্গে দেখা করে বিদিশা অনেক কথা আলোচনা করে। ওর প্রধান আগ্রহ ছিল ছাত্রীদের কেরিয়ার কাউন্সেলিং এর ব্যাপারে সাহায্য করার যদি কোনো আয়োজন করা যায়, এইটার খুব অভাব ওখানে আজও।

আমাদের সময়ে তো চিহ্নমাত্র ছিল না এর, যে ক'জন হিসেব নিকেশ করে ভালো কেরিয়ার বানাতে পেরেছে, সবই ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা নিজের পরিবারের সহায়তায়। কিন্তু বহু মেয়ে যারা নানা ধরনের স্কিলে সমৃদ্ধ ছিল, ভাবনাচিন্তায় সমর্থ ছিল, জীবনে ভালো পেশাগত কাজ করতেও ইচ্ছুক ছিল, স্রেফ সাহায্য না পেয়ে, গাইডেন্সের অভাবে সেসব করতে পারে নি। সমাজ এমনিতেই মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়াকে মান্যতা দেয় না, নানাভাবে আটকাবার চেষ্টা করে, তার উপরে আমাদের গাঁয়ে মফস্বলে তো মেয়ের কোনোরকমে আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলেই ঘটকালি করে সম্বন্ধ-বিয়ে দিয়ে দেয়। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে তারপরে পেশাগত জীবনে আসা একরকম আকাশকুসুম কল্পনা।

সেইজন্যেই বিদিশার একটা প্ল্যান ছিল স্কুলের লাইব্রেরীটাকে একটু সম্প্রসারিত করে সেখানে হাই স্পিড ইন্টারনেট ওয়ালা কিছু কম্পুটার বসিয়ে দিলে আর এর সুপারভিশনে কোনো অল্পবয়সী দিদিমণি থাকলে, যিনি নানাধরনের চাকরির খোঁজ খবর রাখেন, তিনি আগ্রহী ছাত্রীদের দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে পারবেন স্কুলের পরে কী ধরনের কাজের জন্য কী ধরনের ট্রেনিং নিতে হয়---এইসব। এখন, এই আন্তর্জালের যুগে তথ্য পাওয়া খুব অসুবিধের হওয়ার কথা তো না। সেই নিয়েই নাকি আলোচনা হয় লাবণ্যপ্রভার সঙ্গে, ও অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্রীদের থেকে আর্থিক সাহায্য যোগ করে একটা ফান্ড তৈরীর প্রাথমিক প্রস্তাব দেয়।

বিদিশা দেশ থেকে ফেরার পরে তখনও অন্বেষার বাড়ীতেই একটা গেট টুগেদার হয়েছিল, সেখানেই এইসব নিয়ে একটা ছোটোখাটো আলোচনা হয়, তবে চূড়ান্ত কিছু স্থির হয় নি। তারপরে এতদিন আর সাড়াশব্দ পাইনি ওদের। এখন অন্বেষার ফোন আগামীকালের পার্টির। দেখা যাক কী হয়।

(চলবে)

No comments: