Thursday, April 3, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৫)

তখন আমরা ক্লাস সেভেনে। সেইবার পুজোর ছুটি পড়ার আগে আগে একটা সাংস্কৃতিক সংস্থা থেকে ছাত্রীদের মধ্যে যারা ছবি ভালো আঁকে তাদের কাছে আঁকার প্রস্তাব এলো। সেগুলো থেকে নির্বাচিত ছবিগুলো প্রদর্শনীরও নাকি ব্যবস্থা হবে স্কুলে, পুজোর ছুটির সময়। দর্শকেরা সেই ছবি কিনতে চাইলে তাদের সেই ছবি বিক্রি করে শিল্পীকে সেই অর্থের তিন-চতুর্থাংশ দেওয়া হবে। আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ, এরকম আগে কখনো দেখিনি বা শুনিনি আমরা। ছবির বিষয়বস্তু বলে দেওয়া হলো ঐ সংস্থার তরফ থেকেই, বিষয় ছিল "ভবিষ্যতের পৃথিবী"।

আমাদের ক্লাসের ইমা ভালো ছবি আঁকতো, ফর্মালি আঁকা শিখতোও ও, ঐ বয়সেই বেশ পাকা হাত ছিলো, একবার এমন সুন্দর এক মা-পাখি আর ছানা-পাখি এঁকেছিল যে আমাদের চোখ গোল্লা গোল্লা। মা-পাখি শিশির টুপটুপে লতা পা দিয়ে ঝাঁকিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল খাওয়াচ্ছিল মুখ হাঁ করে বসে থাকা ছানাকে, আর ওদের দুইজনের উপরে পড়েছিল কেমন এক সোনালি আলো, নতুন সকালের। "মা ও শিশু" শিরোনামে ছিল ওই ছবি। ও জিনিস ভুলতে পারিনি, এত সুন্দর ছিল।

তো এই "ভবিষ্যতের পৃথিবী" থীমে ছবি আঁকার বরাত এসেছে শুনে আমি আর শুভমিতা গিয়ে ইমাকে খোঁচাচ্ছি, "ইমা, তুই এই টপিকে দারুণ একটা ছবি আঁক। আচ্ছা, কী আঁকবি? আকাশে ভাসা শহর, সবাই ছোট্টো ছোট্টো উড়নযানে করে যাচ্ছে-এরকম?"

ইমা হেসে বললো, "না, ওসব না, আমি আঁকবো তিনটে কঙ্কাল হাত ধরাধরি করে নাচছে, এক পাশে তুলির, মাঝে শুভমিতার আর তৃতীয়টা হলো এই আমার কঙ্কাল।"

এই জবাব শুনে আমাদের সম্মিলিত হি হি হো হো শুনে আশপাশ থেকে অন্যরা এসে যোগ দিল আলোচনায়। আহা, সত্যিই তো বলেছে ইমা, অনেক দূর ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আমরা তো আর থাকবো না, তখন আমরা কঙ্কালমাত্র, তাও যদি দাহ না করে এমনি কফিনে পুরে সমাধি দেয় তাহলেই ! নাহলে পুড়িয়ে দিলে তো ছাই হয়ে জলে মাটিতে আগুনে আকাশে বাতাসে মিশে একেবারে একাকার হয়ে যাবো।

আমাদের আলোচনা হাসাহাসি থেকে যখন এরকম গুরুগম্ভীর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তখন ঢং ঢং ঢং পাগলাঘন্টি টাইপের ঘন্টা, ছুটির ঘন্টা। কী ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি কেন? শোনা গেল আজ দুই পিরিয়্ড আগেই ছুটি হয়ে যাচ্ছে, কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মীটিং নাকি আছে দিদিমণিদের।

আমাদের আর পায় কে! ছুটি মানেই মজা। ভূগোলের একটা ক্লাস ছিল পরের দিকে, বাতিল হয়ে গেল, বাঁচা গেল। ভূগোলের দিদিমণি সিরিয়াস টাইপের, ক্লাসে এসে জনে জনে দাঁড় করিয়ে পড়া ধরেন, অনেকেই তার জন্য এই ক্লাসটা বিষয়ে একধরণের ভয় বিরক্তিমিশ্রিত মনোভাব পোষণ করে।

পুজোর ছুটির আগের ক্লাসগুলো করতে এমনিতেই ইচ্ছে করে না আমাদের, আর ক'টাদিন পরেই বড় উৎসব, দিন গোণা শুরু হয়ে যায়। বাইরে তখন পুজো পুজো গন্ধের রোদ্দুর, ঝুম বর্ষা শেষ, মাঝে মাঝেই সাদা মেঘ সরে সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশের চাঁদোয়া, সবুজ মাঠ জুড়ে খুশিয়াল মাথা নাড়াচ্ছে কাশফুলেরা। এরকম সময়ে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে নাকি কারুর?

পুজোর ছুটির পরে স্কুল খুলেই বার্ষিক পরীক্ষা হতো সেইসব দিনে, সেইটা ছিল একটা উদ্বেগের বিষয় বটেই। তবে উৎসবের মধ্যে সেই নিয়ে মাথা ঘামাতে কেউ রাজী ছিল না। অনেকের সারাবছরে এই সময়্টাই কেবল নতুন জামাকাপড় হতো, সেই জামা গায়ে দিয়ে সেজেগুজে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বিকেল থেকে সন্ধ্যে পার করে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা আর মোগলাই বা এগরোল খাওয়া আর তারপরে কোল্ড ড্রিংক খাওয়া।

চারিদিকে আলোয় আলো, লোকে লোকারণ্য, মাইকে মাইকে নন-স্টপ নানা গান বাজছে অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাণ কিছু হচ্ছে বা কোনো ঘোষণা হচ্ছে। তিনটে দিন, সপ্তমী অষ্টমী আর নবমী। এই তো। তারপরেই দশমীতে সব সমাপ্ত। বই নিয়ে পড়তে বসা, পরীক্ষার পড়া তৈরী, আগের রুটিন। মাঝে মাঝে অবশ্য লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, ভাইফোঁটা উৎসব থাকে, তবে সেসব ঐ তিনদিনের মতন না। এই ছুটি ফুরালে স্কুল খুলেই বার্ষিক পরীক্ষা, এই ব্যাপারটা পরে অবশ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছিল। পরবর্তীকালে বার্ষিক পরীক্ষা সরে গেছিল মার্চ-এপ্রিল মাসে। তবে আমাদের ততদিনে আমরা বড় হয়ে গেছিলাম, মাধ্যমিক পরীক্ষা কাছিয়ে এসেছিল।

স্মৃতি থেকে জোর করে ছিঁড়ে এসে সামনে বসা এখনকার ইমার দিকে চেয়ে থাকি, কত বদলে গেছে সে। গিন্নিবান্নি চেহারার মহিলা হয়ে গেছে সেইদিনের পালকের মতন হালকা সেই কিশোরী। এখন নাকি আঁকাআঁকি একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। কাজকর্ম সামলাতে, সংসার সামলাতে আর দুরন্ত বাচ্চা সামলাতে একেবারে যাকে বলে সদাই শশব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়।

অন্বেষার বাড়ীর গেট টুগেদারে গিয়ে সেদিন একেবারে সারপ্রাইজড হয়ে গেছিলাম। দেখলাম ইমা এসেছে। ওর এদেশে আসার কথা কিছুই জানতাম না, অন্বেষাও কিছু জানায় নি। মাত্র নাকি মাসখানেক হলো এসেছে ওরা। ইমা, ওর স্বামী সায়ন আর দুই বছরের ছেলে প্লাবন। সে নাকি এত দুরন্ত যে ইমার একদন্ড শান্তিতে বসার উপায় নেই। এখন মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য স্বামীর হেফাজতে ছেলেকে দিয়ে বন্ধুর বাড়ী নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছে।

গেট-টুগেদার অনেক বদল হয়ে গেছিল, বিদিশা আসে নি, কাবেরী আসে নি। যাদের আসার কথা ছিলো তাদের মধ্যে কেবল তিয়াসা আর মনামী এসেছিল। আর সারপ্রাইজের মতন এই ইমা। শেষ অবধি ঐ পুরানো স্কুলের জন্য ফান্ড রেইজিং প্রোজেক্ট এর আলোচনা না হয়ে এমনি সাধারণ সামাজিক পুনর্মিলন পার্টিতে দাঁড়ালো সেটা। তবে মন্দ লাগছিলো না, এটা ওটা নানারকম সুস্বাদু স্ন্যাকসের সঙ্গে গরম কফি খেতে খেতে পুরানোদিনের স্মৃতি রোমন্থন। আয়োজন ভালোই ছিলো অন্বেষার।

এর মধ্যেই তিয়াসার গানও শোনা হলো। ভারী সুন্দর গলা তিয়াসার, এত সুর গলায়! কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় ও গাইছিল "নিবিড় অমা তিমির হতে বাহির হলো/বাহির হলো জোয়ারস্রোতে/ শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী"। ওর গান শুনতে শুনতে আবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম অতীতে, তখন এই গান ছিল আমাদের আরেক ক্লাসমেট রুমেলির গলায়, সেই কিশোরীবেলাতেই রুমেলি গানে নাম করেছিল। টিভির অনুষ্ঠানে গেয়েছিল কয়েকবার, তখন আমরা মোটে ক্লাস সিক্সে। কী উৎসাহ উদ্দীপনা ওকে নিয়ে তখন ওর অভিভাবকদের ! কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারের হাজারো সমস্যার যাঁতাকলে কত সহজেই চাপা পড়ে যায় স্বপ্নেরা! কতদিন থাকে ফুলের ঋতু? ক্ষুরধার শীতবাতাস এসে সব খসিয়ে দিয়ে যায়।

রুমেলি তবু পড়াশোনার পাশাপাশি গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। হয়তো ভিতরে ভিতরে স্বপ্নটাকে লালন করতো। একদিন খুব বড় গায়িকা হবার স্বপ্ন। উচ্চমাধ্যমিকের পরেই রুমেলির বিয়ে হয়ে যায়, ওর শ্বশুরবাড়ী থেকে নাকি এর পরে বলা হয় ঘরের বৌ গান করবে বাইরে জলসা ইত্যাদিতে, এ তাঁরা চান না। রুমেলি গান ছেড়ে দেয়। হয়তো স্বেচ্ছায়, হয়তো অনিচ্ছায়, কেজানে! কার কথাই বা বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায়?

তবু গান রয়ে গেছে, এখন এই যেমন তিয়াসার গলায় ফুটে ওঠেছে সেই গান, আরো সমৃদ্ধ, আরো সুরেলা হয়ে। হয়তো আমাদের স্বপ্নগুলো ও মরে না, এইভাবে কোথাও না কোথাও থেকে যায়। হয়তো অবিনাশী ফিনিক্স পাখির মতন বারে বারে পুনর্জাত হয়ে উঠে আসে মৃত্যু-অগ্নি থেকে।

(চলবে)

1 comment:

Shuchismita said...

khub bhaalo lagchhe. amar din gulo o to emoni chhilo!!