Thursday, April 24, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৭)

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের কথা লিখতে লিখতে বাক্সের ভিতরে বাক্সের মতন নতুন নতুন স্মৃতি বার হয়ে আসছে, রঙীন সব ছবি আঁকা বাক্স। তখন জীবন ছিল বিস্ময়ে ভরা, প্রতিটা দিন ছিল অদ্ভুত রকমের আশ্চর্য, প্রতিটা সকাল যেন হাতের মুঠোয় লুকিয়ে আনতো অচেনা উপহার। তখন তো বেশীরভাগই অচেনা আমাদের। নিজেদের পাড়ার বাড়ীঘর মাঠ রাস্তাগুলো পার হয়ে গেলেই অচেনা রূপকথার রাজ্য। আমবাগান কুলবাগান জোড়া পুকুর গাছপালায় ঘেরা অদ্ভুত অদ্ভুত বাড়ীঘর-সব যেন রূপকথার রাজ্যের এক একটা টুকরো, ছোট্টোবেলার ইস্কুলটাও যেন সেই রূপকথার রাজ্যের মধ্যেই।

মনে পড়ছে একটা মজার ঘটনা, এও নিয়তি দিদিমণির ক্লাসের গল্প। মুখে মুখে বিবেকানন্দের ছোটোবেলার গল্প বলে বলে শোনাচ্ছেন দিদিমণি, তারপরে আবার প্রশ্নও করছেন। দিদিমণি বলছেন ছোট্টো বিলের কথা, বিবেকানন্দের ছোটোবেলার ডাক নাম ছিল বিলে, সে নানা দুষ্টুমী করে বেড়াতো, আবার পড়াশোনায় ছিল তুখোর। তার বাবা বিশ্বনাথ দত্ত আর মা ভুবনেশ্বরী দেবীর কথাও বলেছিলেন দিদিমণি।

গল্প আরো খানিক এগিয়ে যাবার পরে কী মনে করে দিদিমণি থামলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, "তোমাদের মধ্যে কেউ বলোতো দেখি বিলের মায়ের নাম কী ছিল? "

অমনি ছাত্রছাত্রীর দঙ্গল থেকে তমালী পড়ি কী মরি করে এগিয়ে গিয়ে বলেছে, "জানি জানি দিদিমণি, ভুবনেশ্বর।"

সব্বাই হেসে ফেলেছে, দিদিমণি সমেত। তারপরে দিদিমণি বুঝিয়ে দিলেন, "তমালী, তোমার উত্তর প্রায় ঠিক হয়েছে। কিন্তু ভুবনেশ্বর একটা জায়্গার নাম, তাছাড়া মেয়েদের নামও নয় ওটা, বিলের মায়ের নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী। "

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসে লেখাপড়া ছিল বেশ খেলাধূলা আর গল্পের সঙ্গে মেশানো। ভারী চমৎকার ছিল সব। বাংলা অংক এইসবের পাশাপাশি হতো গল্প বলার ক্লাস।

স্কুলের গেটের দুইপাশে দুই আমগাছ আর গেটে দাঁড়িয়ে থাকে খাকি রঙের পোশাক পরা দারোয়ানজী, তাকে রতনদা বলে ডাকে সবাই। রতনদা শুধু গেট কীপারই না, সে বাচ্চাদের দেখাশোনাও করে। যেসব বাচ্চারা নতুন নতুন স্কুলে গিয়ে খুব কাঁদে, রতনদা তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করে। বলে, "কান্দিস না, কলা দিমু।"

দুপুরের টিফিন খাওয়া আর খেলা শেষ হলেই ঘুমের ক্লাস, মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানায় সবাই ঘুমের ভান করে পড়ে পড়ে পাশের জনের সঙ্গে ফিসফিস করতাম আর দিদিমণিরা দুইজন গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে, "তোমরা সবাই ঘুমিয়েছো ও ও ও?" বলে প্রশ্ন করতেন।

আমরাও সবাই যারা ঘুমাই নি, সবাই দিব্যি বলতাম, "হ্যাঁ অ্যা অ্যা " আর দিদিমণিরাও আবার নিশ্চিন্ত হয়ে গল্প করতে থাকতেন। বাচ্চারা সত্যি করে ঘুমোচ্ছে না বটে কিন্তু ঘুমের আন্তরিক চেষ্টা তো করছে-এই ভাবতেন মনে হয়।

আমাদের কয়েকজনকে রিকশা চালিয়ে স্কুলে যে পৌঁছে দিত তার নাম ছিল বিশাল নস্কর। সে তেমন বিশাল চেহারার ছিল না, রোগাটে গড়নের সাধারণ মানুষের মতনই ছিল, আমরা তাঁকে ডাকতাম বিশালদা। ঐ ছোট্টো রিকশার মধ্যে এক এক ট্রিপে পাঁচ ছ'জন করে বাচ্চা নিয়ে যে কীভাবে রিকশা চালিয়ে নিত বিশালদা, ভাবতে গেলে অবাক লাগে। রাস্তাও তো ছিল অমসৃণ, খোয়া আর ইঁটে পাথরে ভরা।

সকাল সাড়ে দশটায় স্নানখাওয়া সেরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে হাতে টিনের সুটকেস আর কাঁধে জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা কয়েকজন। বিশালদা এলেই রিকশায় ওঠা। সীটে তিনজন আর উল্টোদিকে কাঠের বেঞ্চ বসানো, সেখানে তিনজন। সুটকেশগুলো সব বেঞ্চের নিচের খোপে। এখন ভেবে দেখলে অবাক লাগে, ঐ রিকশাও তো একরকম ম্যাজিকই ছিল, এতগুলো ছেলেমেয়ে ঐটুকু জায়্গায় ধরতো কেমন করে? তার উপরে বর্ষাকালে আবার ত্রিপল ঢাকা দেবার ব্যবস্থাও ছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য।

সকলে উঠে বসলে ঝক্কর ঝক্কর রিকশা চলতে থাকতো, বড়োমাঠের পাশ দিয়ে জোড়াপুকুরের পাশ দিয়ে আমবাগানের পাশ দিয়ে কচুরিপানায় ভর্তি একটা ছোটো ডোবার পাশ দিয়ে চলতে চলতে এসে যেত ইস্কুল। কচুরিপানার ফুলগুলো ভারী সুন্দর দেখতে লাগতো, কেমন সাদার মধ্যে অতি হাল্কা বেগুনী মেশানো রঙ! পরে অনেক চেষ্টা করেছি আঁকা ছবিতে ঐ রঙ আনতে, পারিনি। ও আসে না। প্রকৃতির প্যালেটে যে রঙের ছড়াছড়ি তার সঙ্গে তো আলোর গোপণ চুক্তি আছে, সে কি করে আনবো আমার শুকনো কাগজের উপরে কেমিক্যাল রঙ দিয়ে?

ছোটোবেলার ঐ স্কুলে নানারকম নিয়ম টিয়ম ছিল, তারমধ্যে একটা হলো স্কুলের ব্যাজ লাগাতে হতো শার্টের বাঁদিকে, কাঁধের কাছে। কেন জানিনা একটা রুমালকে তেকোনা করে ভাঁজ করে ঐ ব্যাজের সঙ্গে আটকে দিতে হতো। বাড়ী থেকেই করে দিতো। দুপুরে স্কুল থেকে দেওয়া টিফিন খেয়ে হাত ধুয়ে ঐ রুমালে মুছতে হতো।

আর স্কুল থেকে একটা স্কুল ডাইরি দিতো, সেটার মধ্যে স্কুলের নিয়মাবলি, সারা বছরের ছুটির তালিকা ইত্যাদি সব জিনিস থাকতো। তখন আমরা বুঝতাম না অত, শুধু জানতাম ঐ ডাইরি প্রত্যেকদিন সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। কারণ দিদিমণি যেকোনোদিন ঐ ডাইরি চাইতে পারেন আর কিছু লিখে দিতে পারেন। সেরকম হলে বাড়ীতে দেখিয়ে বাবার থেকে বা মায়ের থেকে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেরকমও বলে দিয়েছিলেন দিদিমণিরা। আসলে ডাইরিটা মনে হয় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের যোগাযোগের একটা উপায় ছিল।

(চলবে)

No comments: