এমনিতে ঘুমের  ক্লাসে মোটেই ঘুমাতাম  না, একদিন কীজানি কী হলো  ঘুমের ক্লাসে খুব  ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের  আগে শেষ যেটা  মনে আছে, চিত্রালী আর আমি পাশাপাশি শুয়ে ফিসফিস করে গাইছিলাম, "আমরা  দুটি ভাই, শিবের গাজন  গাই/ ঠাকমা গেল গয়া কাশী  ডুগডুগি বাজাই।" বারে বারে ঘুরিয়েফিরিয়ে এই  লাইন দুটো গাইছিলাম আর  ফিরফির করে  হাসছিলাম। তারপরে আর  কিছু মনে নেই।
   
যখন ঘুম  ভাঙলো তখন দেখি  নিধিরামদা(আমাদের  নার্শারী বিভাগের  স্কুল কর্মচারী) ডাকছে, "এই ওঠ, ওঠ। ছুটি হয়ে  গেছে।"  উঠে দেখি আরে  হ্যাঁ, তাই তো। ঘর প্রায় ফাঁকা, একদুইজন ছাড়া  সবাই চলে গেছে। 
 
 আমি তো ঘাবড়ে  গেলাম, তাহলে কি  বিশালদা আমাকে রেখেই অন্যদের নিয়ে রিকশা  চালিয়ে চলে গেল? সেটা যে  হতে পারে না, তা তো আর  সেই ছোটোবেলা  বুঝতাম না।
 
 যাই হোক, চোখ  টোখ ডলে ঘুম তাড়িয়ে  সুটকেশ জলের বোতল নিয়ে  বাইরে এলাম, জুতোর তাক  থেকে জুতো নিয়ে পরে  বারান্দা থেকে নেমে  একেবারে খোলা রোদে আসতেই যেন চোখ জ্বলে গেল। রোদ এরকম তেতো লাগে নাকি দুপুরে ঘুমিয়ে উঠলে? 
 
  
দেখি বাইরে  বিশালদার রিক্শায় বাকী সবাই উঠে পড়েছে, খালি  আমি বাকী। সবাই বেশ চটে আছে মনে হলো এত দেরি হয়েছে বলে।  আমি তো উঠে পড়লাম, একপাশে গুঁজেমুজে বসেও পড়লাম। রিকশাও চলতে চলতে পরিচিত সব দৃশ্যের পাশ দিয়ে বাড়ীর দিকে চললো। 
 গন্তব্যে পৌঁছে নেমে পড়ে আরেক কেলো করলাম। দিব্যি জলের বোতল নিয়ে বাড়ী চলে গেলাম, সুটকেস রয়ে  গেল বিশালদার  রিকশাতেই।  ঘুমিয়ে পড়ার  ফলেই হোক কিংবা অন্য  কোনো কারণে, কোনোকিছুই  ঠিকঠাক  খেয়াল ছিল না। সুটকেস ফেলে যাবার ব্যাপারটা ধরা পড়লো যখন হাতমুখ ধুয়ে স্কুলের পোশাক বদলে খেতে বসেছি তখন। 
 আরে  সর্বনাশ! পরের দিন আবার কীসের যেন ছুটি! এদিকে সুটকেসে বইপত্র তো আছেই, স্কুল ডাইরিটাও যে আছে! সেটা খোয়া গেলে কেলেংকারী।  তারপরে খানিক কান্নাকাটির পর রফা হলো বিশালদার বাড়ীতে যাবো আমি আর  ঠাকুমা।
 আমাদের পাড়া  থেকে একটা বড়ো মাঠ আর  তারপরে একটা ছোট্টো  খোলা সব্জিবাজার পার হলেই নাকি বিশালদাদের পাড়া, কাউকে  জিজ্ঞেস করলেই বাড়ী  দেখিয়ে দেবে। ঠাকুমা কোমরের ব্যথার জন্য  হাঁটতে পারবে না তো  বেশী, সব্জিবাজারের এই পারে ঠাকুমা দাঁড়াবে, আমি দৌড়ে গিয়ে সুটকেস উদ্ধার করে আনবো-এই রকম ঠিক হলো। 
এরপরে শুরু হলো আমার জীবনের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার। সেই বিকেলে এক কচি আর এক বৃদ্ধা মিলে হাঁটতে হাঁটতে চললাম মাঠ পেরিয়ে। সব্জিবাজারের কাছে চলে এলাম। তখন সব্জিবাজার ফাঁকা, চালাগুলো খালি পড়ে আছে, বাজার বসে সকালে, দুপুর অবধি চলে, তারপরে সবাই পশরা গুটিয়ে চলে যায়। তো, সেখানে এসে আমরা একটু দাঁড়ালাম। একজন লোক হেঁটে আসছিল পাশের রাস্তা দিয়ে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো বিশালদাদের বাড়ীর হদিশ। সে চিনতো। আমাদের দেখিয়ে দিল বাড়ীটা। ঐ যে মাটির রাস্তার ঐপাশে রাংচিতার বেড়ায় ঘেরা টালির চালের বাড়ীটা, ঐটা।
 
ঠাকুমার কোমরে ব্যথা তো, আর হাঁটতে পারছিল না। তাই ঠাকুমা দাঁড়ালো একটা দোকানের চালার ছায়ায় আর আমি এগিয়ে গেলাম বিশালদাদের পাড়ার দিকে। 
রাংচিতা গাছের বেড়া বেশ উঁচু, প্রয় দেড়মানুষ প্রমাণ। সেই বেড়ায় বাঁশের কঞ্চির গেট, নারকোলের দড়ির ফাঁসে গেটের একটা দিক বেড়ায় আটকানো। আস্তে আস্তে সেটা খুলে ঠেলা দিতেই গেট খুলে গেল। আমি ঢুকে পড়ে একেবারে অবাক আর মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
মাটিলেপা একটা উঠোন, নারকেল গাছের ছায়া তাতে। সেই ছায়ায় পুরানো একটা মাদুর পেতে বসে বিশালদা এক বছরখানেক বয়সের ছোট্টো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চামচে করে সুজিদুধ খাওয়াচ্ছে। মনে হয় গরম দুধে সুজি ফুটিয়ে বানানো, কারণ বাটি থেকে চামচ দিয়ে তুলে ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে জুড়িয়ে বাচ্চাটার মুখে দিচ্ছে। আর বাচ্চাটার ঠোঁট মুখ গাল সুজিতে মাখামাখি কিন্তু ও খুব খুশি হয়ে হাত পা নাড়াতে নাড়াতে নানা খুশির আওয়াজ করছে।
আমি এত অবাক আর এত খুশি যে চুপ করে চেয়ে শুধু দেখছি আর দেখছি। আসলে আমার পাড়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যে অথবা এমনিতে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও দেখেছি একেবারে ছোটো বাচ্চাদের কোলে নিয়ে খাওয়ানো দাওয়ানো এসব মা কাকীমা জ্যেঠিমা ঠাকুমা দিদিমারা করেন, বাবাকাকাজ্যেঠাদাদুদের কখনোই দেখিনি করতে। তাই এত অবাক।
এদিকে বিশালদাও মুখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছে। আমি কেন ওখানে কীসের জন্যই বা? বিশালদার এতখানি বড়ো বড়ো হয়ে যাওয়া চোখেই মনে হয় ও প্রশ্ন লেখা ছিল।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, "আমার সুটকেসটা তোমার রিকশাতে ফেলে গেছি। ওটা নিতে এসেছি।" 
"ও তাই নাকি? " বলে বাচ্চাটাকে কোল থেকে মাদুরে যেই না নামিয়েছে বিশালদা, অমনি সে চিৎকার করে কান্না। এখন ওকে কোলের থেকে নামানো চলবে না।
বিশালদা বিব্রতভাবে বলে, " ওর মা কাজে গেছে তো, আর এখন ওর খিদে পেয়ে গেছে। ঐ যে রিকশা ঐখানে, তোমার সুটকেস রিকশাতেই আছে যদি থাকে, আমি এসে ঐখানে রিকশা রেখেছি।"
উঠানের অন্য কিনারে রিকশাটা রাখা, সেখানে গিয়ে দেখি, হ্যাঁ, এই তো আমার সেই হারানিধি, কাঠের বেঞ্চির তলায়, এই তো উপরে পিন খুদে খুদে লেখা আমার নাম, যেমন বাবা করে দিয়েছিল। খুলে দেখলাম ভিতরে বইপত্তর ডাইরি সব যেমন যেমন থাকার সব আছে।
 
সুটকেসটা বার করে নিলাম, বিশালদার কাছ এসে দেখালাম এটা আমার সুটকেস, উপরে নাম লেখা, ভিতরে সব ঠিক আছে।
 
বিশালদা হাসলো, বললো, "তুমি কোথা থেকে এলে এখানে? আমার বাড়ী চিনলে কী করে? একাই এসেছ?"
 
আমি সব বললাম, তারপরে সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এলাম। গেটের কাছে এসে পিছন ফিরে দেখলাম বিশালদা যত্ন করে খাওয়াচ্ছে বাচ্চাকে। 
পিতৃত্বের এই আশ্চর্য কোমল ছবিটি মনে রয়ে গেল। আজ স্মৃতির ভিতরে এইটি দেখলে মন অবাক সুখে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এক জীর্ণবসন দরিদ্র পিতা পরম যত্নে সন্তানকে কোলে নিয়ে সুজিদুধ খাওয়াচ্ছেন। বিপুল ধনীর রত্নখচিত খাবার টেবিলের অজস্র দামী খাদ্য পানীয় তুচ্ছ হয়ে মিলিয়ে যায়। বিদুরের খুদ কি ঐ দুধসুজির চেয়ে বেশী মহান ছিল? 
আজ যখনই কোনো কষ্টের দুঃখের সংবাদ শুনি-অভাবের তাড়নায় পিতামাতা সন্তানকে অত্যাচার করেছে , ভালোবাসার মানুষকে মানুষ অত্যাচার করে মেরেছে-এইসব দুখঃকথার বিপরীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাচ্চা কোলে সেই রিকশাচালক বিশালদা,ঐখানে সে আর সামান্য মানুষ নয়, সে বিরাট বিশাল হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে আকাশ ভরে, বিশ্বপিতার সঙ্গে একাকার। 
(চলবে)    
Monday, May 5, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)

No comments:
Post a Comment