Thursday, May 22, 2014

ঝিনুকজীবন

১ স্মৃতিলিখন

অনেকদিনের অনেক পুরানো সব লেখা, হলদে হয়ে গেছে খাতার পাতাগুলো, কেমন জীর্ণ ও হয়ে গেছে। কোণাগুলো ভেঙে ভেঙে গেছে, কাগজের গুঁড়ো জমা হয়েছে মধ্যের ভাঁজে ভাঁজে। খুব সাবধানে হাত বোলাই, আরো যেন ভেঙে না যায়। কাঁচা হাতের লেখা সব, এলোমেলো, বাঁধুনী নেই, কত বানানভুলও আছে, একদম প্রথমের দিকে অক্ষরগুলোও কেমন আঁকবাঁকা...

হাত বোলাই আস্তে আস্তে ওগুলোর উপরে। আমার চলে যাওয়া ছোটোবেলা, কিশোরবেলা, ধানগন্ধী পুজোবেলা, লঙ্কাগন্ধী গ্রীষ্মদুপুরবেলা, ইলিশগন্ধী বৃষ্টিবেলা...সব রয়ে গেছে ঐ জীর্ণপাতা খাতার মধ্যে, ঐসব কাঁচাহাতের যাখুশীতাই লেখার মধ্যে... যে দিন চলে যায়, আর তো তাকে ফিরে পাওয়া যায় না! আজ এই খাতার আর কোনো মূল্যও নেই শুধু আমার নিজের কাছে ছাড়া, স্মৃতির রেশমডুরি দিয়ে আমি এর সঙ্গে বাঁধা বলে...অন্যের কাছে এসব লেখা নিতান্ত ছেলেমানুষী।

তবু, কী করে এইসব রয়ে গেলো আজও? ধূলা ভরা ঐ বান্ডিলের মধ্যে কেন মীরা আগলে রেখেছিলো এসব? একদিন এসে খুঁজবো বলে? নাকি অন্য কেউ, অন্য তরুণ বয়সী কেউ, এই বয়সী বটের কচিবেলার সুখদুঃখের গল্পগুলো পড়বে বলে? কি জানি! কেমন করে সময়ের সাক্ষ্য রয়ে যায় এই নিরাসক্ত বালুচরে, কেজানে কিকরে! কেনই বা?

ঐ যে শীতের মাঝদুপুরে আকাশের উত্তরখিলানে উড়ছে বিন্দুর মতন চিল দুটো, এরাই কি উড়তো কুড়ি তিরিশ চল্লিশ বছর কি তারো আগে? কোথায় ছিলাম তখন আমি? এখানে না, ওখানে না, এমনকি কারুর স্বপ্নেও নয়! এই চিলেরা হয়তো তাদের নাতিপুতিদের নাতিপুতি, সেই একই দৃশ্য রচনা করে চলেছে, রচনা করে চলেছে কালের বক্ষপটে? কেনই বা? জানিনা, কিছুই জানিনা। কত বদলে গেছে দুনিয়া, কত কাছের মানুষ কত দূরে চলে গেছে, কত অচেনা দূরের মানুষ কাছের হয়েছে...

কত পাওয়া, কত হারানো, কত চাওয়া, কত চেয়ে না পাওয়া, কত না চাইতে পাওয়া... কত অশ্রু, কত হাসি...

ঐ যে আজো দেখা যায় সোমাদের চিলেকোঠা, সোমা আমাকে জিগাতো চিলেকোঠাকে চিলেকোঠা কেন বলে, ওখানে কি চিলেরা থাকে? আমরা হাসতাম। কোথায় সোমা আজকে? দুটি ছেলেমেয়ে রেখে সে চলে গেছে অচিনদেশে...চলে গেলেই কি কেউ ফুরিয়ে যায়? আজও সে অফুরাণ মধুর উৎস হয়ে আছে আমার কাছে।

সোমা রেখে দিতো সব পুরানো চিঠি, পুরানো লেখা, পুরানো জীর্ণ সব ছবি...কি হয়েছে ওসবের আজ? ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের দেখভাল কে করবে এই যুক্তিতে ওর স্বামী আরেকবার বিয়ে করে, সেই নতুন বৌ হয়ে আসা মেয়েটি কি সোমার জিনিস রেখেছিলো যত্ন করে, ওর ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে দেখবে বলে? নাকি সব জঞ্জাল ভেবে দূর করে ফেলে দিয়েছিলো? অল্পবয়সে চলে যাওয়া বন্ধুরা ছোটোবেলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় অমরত্বের দিকে, আর তো ধূলিমলীন হয়নি তারা প্রতিদিনের ব্যবহারে,আশা ও আশাভঙ্গে, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের তীব্র কষ্টে তো ওরা আর ধূসর হয় নি...

সোমাদের বাড়ীতে এখন ওর দাদাবৌদিরা থাকে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে, সোমার ছেলেমেয়েরা থাকে অনেকটা দূরে, অন্য এক শহরে, ওদের বাবা আর নতুন মায়ের সঙ্গে। ওদের নতুন মা, কিজানি কেমন চোখে দ্যাখে ওদের! বাচ্চা দুটো, ছোটোটা মেয়ে-এখন ছয় বছরের আর বড়োটা ছেলে-নয় বছরের।ওরা ওদের মাকে কতদিন দেখতে পেলো? শৈশব ও তো তখন পার হয় নি ওদের! ওদের নতুন মায়ের যদি আপন সন্তান হয়, তখনও সে কি এই অকালমৃতা সপত্নীর সন্তানদের যত্ন করতে পারবে?

সোমার ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে খুব যত্ন করে গান শেখাবে! মেয়েটা জন্মাবার পরে পরেই দেখা হয়েছিলো একবার ওর সঙ্গে, ও বাপের বাড়ী এসেছিলো, আমিও তখন দেশে এসেছি, তখন বলেছিলো ওর খুকী একটু বড়ো হলেই গান শেখাবে। সোমা খুব ভালো গান গাইতো। পরে গান নিয়ে হায়ার স্টাডিও করেছিলো, তারপরে বিয়ে হয়ে চলে গেলো দূরে, অনেক দূরে।অবাংলাভাষী এক শহরে। তবু সেখানেও নাকি নিয়মিত গানচর্চা চালু রেখেছিলো, একটা গানের স্কুলে কিছুদিন কাজও করেছিলো ছেলেপুলে হবার আগে। তারপরে সংসারে জড়িয়ে গেলো, ছেলেমেয়ে, স্বামী,আত্মীয়স্বজন, লোকলৌকিকতা ...

আর তো উপায় নেই, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, হারিয়ে যাওয়া গানের জন্য ওর কি মনকেমন করতো? চিল পাক খাওয়া শীতদুপুরের আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে আবার জীর্ণ পাতায় হাত বোলাই।বুঝতে পারি অনেকক্ষণ ধরে শুধু সোমার কথাই ভেবে চলেছি। এইসব পুরানো লেখা থেকে কখন চলে গেলাম সোমার গল্পে?

ঐ যে চেনা অচেনা জায়গায় জীবনের ঘূর্ণী আমাকে নিয়ে গেছে,কর্মসূচীতে ঠাসা সময়গুলো, কোনো ফাঁক থাকতো না, অবিচ্ছিন্ন জলপ্রবাহের মতন রুটিন, তবু কোনো কোনো বিরল রাত্রিতে আধোঘুমে অদ্ভুত অতৃপ্তি আর বালি বালি তৃষ্ণা। জলে বা অন্য পানীয়ে ও তৃষ্ণা দূর হতো না। কিসের অতৃপ্তি জিভে জড়িয়ে থাকতো তেতো-তেতো জ্বরস্বাদের মতন, আমি বুঝতে পারিনি। তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করার সময় ও ছিলো না। এখন অঢেল সময়, এখন অপেক্ষা শুধু, শান্ত অপেক্ষা। আঙুলে সতর্ক আদর মিশিয়ে আবার ছুঁই জীর্ণ খাতার পাতা,আমার চলে যাওয়া বেলা। এতকাল একবারো এদের মনে পড়ে নি কেন?



২ মীরা

এতকাল পরে সে বেদনা কি আর ফিরতে পারে? যে জাগিয়ে দেবে তাকে মৃত্যুঘুম থেকে? পনেরো বছরের সেই কিশোরীকে, যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেই সন্ধ্যায়?

নিরাসক্ত চেয়ে থাকি স্মৃতির সেই বালুকাবেলার দিকে, ও মেয়ের সঙ্গে কোনো লিংক খুঁজে পাই না, চৈত্ররাতের বাতাস এসে সে লিংক ছিঁড়ে দিয়েছে কবে! যে দগ্ধ ক্ষত সেদিন মনে হয়েছিলো সারবে না কোনোদিন, সে কোথায় লুকিয়ে গেছে সময়ের গোপণ ভাঁজে, আর অনেক ডুব দিয়েও সন্ধান পাই না। যে বহ্ন্যুৎসবের সোনালী অগ্নিশিখা তাকে ভিতরে বাহিরে পুড়িয়ে ভস্মসাৎ করেছিলো, আজ তার কোনো চিহ্ন কোথাও নেই! অন্ধকার শুধু। গভীর অন্ধকারের প্রলেপ দিয়ে সে বেদনা ঢাকা। আসলে আমি তো তার কেউ নই সত্যিই, অত অত বছর আগের সেই বোকা ভীতু মেয়েটা, সে তো কেউ না আমার!

মীরা আমার মুখে চুলে হাতে হাত বোলায়, স্পর্শের বৈদ্যুতিভাষায় আমায় কী যেন বলে, আমি বুঝতে পারিনা। কিংবা হয়তো পারি, বুঝতে চাই না। তাড়াতাড়ি তাই বলি,"মীরু, মীরু, তুই কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি এসব? ওরা সন্ধান পায় নি?"

মীরা হাসে, মুক্তোদানা হাসি, ওর চোখও হাসে, দিঘির জলে সূর্যের ঝিকিমিকির মতন হাসি। মীরার সব কিছু বড়ো স্নিগ্ধ, শান্তিময়।

আমাদের সব কিছু প্রায় বিপরীত, আমরা দেখতে আলাদা, স্বভাবেচরিত্রে আলাদা,আমাদের পছন্দ অপছন্দ ভালোলাগা মন্দলাগা সব প্রায় বিপরীত। শুধু আমরা জন্মসুতোর ডোরে এক হয়ে আছি,আমি আর মীরা যমজ। আইডেন্টিকাল টুইন না, আমরা সবেতেই আলাদা, অথচ কোথায় যেন জন্মান্তরের মতন বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত।

মাঝে মাঝে নীরব দুপুরে মীরার কোলে মাথা দিয়ে যখন শুয়ে থাকতাম, ও আমার চুলে বিলি কেটে দিতো, আমরা ভাবতাম, পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার ও আগে অন্য এক অচিন্ত্যনীয় গর্ভবিশ্বে আমরা অত কাছাকাছি ছিলাম, একইসঙ্গে বেড়ে উঠেছি, কী অদ্ভুত ব্যাপার! মীরা আমার মনের কথা বুঝতে পারতো, আমিও ওর-আমাদের সব আলাদা, অথচ মনদুটো জুড়ে রাখা ছিলো এন্ট্যাংগলড কণাদের মতন। তারপরে আমি আর মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে দূরে কত দূরে চলে গেছি...

ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্ত থেকেই তো বিচ্ছেদের শুরু, তারপরে আরো আরো ছোটোবড়ো চিড়,কত কত দূরে চলে গেছি আমরা..., কিন্তু আমরা যে এন্ট্যাঙ্গলড, অজ্ঞাত রেশমসুতোর মতন কিছু আমাদের জুড়ে রেখেছে এক পৃথিবী ব্যবধানেও।

আমি দূরে চলে গেছিলাম, মধ্যাহ্নের খরতাপে কোন্‌ দূর দূরান্তে দৌড়ে বেরিয়েছি...আর আমার ছায়া পড়ে ছিলো এইখানে এই শান্ত গাঁয়ের আমকাঁঠালের গাছের নীচে, শ্বেতজারুলের ফুলে, কলাপাতায় ভোরের শিশিরের গড়িয়ে পড়ায়, বসন্তের রাঙা শিমূলের ফুলে,গ্রীষ্মের যূথীগন্ধে, বর্ষার সবুজ ধানের উপরে বয়ে যাওয়া হাওয়ায়, শরতের শিউলি আর তুলোমেঘে দুর্গাপুজোর ঢাকের বাজনায়, হেমন্তের মনকেমনিয়া রিক্ততায়, শীতের দুপুররোদে নীল আকাশে চক্র দেওয়া ঐ চিলেদের ডানায় ...

আমি ওদের ভুলে গেছিলাম, তাই মীরা আমার হয়ে সব সঞ্চয় করে রেখেছিলো... অথচ মীরাকে ও আমি ভুলে যেতাম আমার সেই হুল্লুড়ে ছোটোবেলা, তখন সোমা, পম্পা, পিংকি, টুপাই, তানি, মৌ, মান্তু... কত বন্ধু তখন আমার, আমরা তখন খুব খেলতাম মাঠে। কত রকম খেলা ছিলো-কাকজোড়া, জেলেমাছ, নামপাতাপাতি, ছোঁয়াছুঁয়ি, বুড়ীবসন্তী, ভাইবোন... এসব ছাড়া ও মাঝে মাঝে ক্রিকেট ভলিবল ও। আবার আমাদের খেলার প্রতিযোগিতাও হতো কখনো কখনো জানুয়ারিতে, সেখানে হতো গুলিচামচ, অংকরেস, স্কিপিংদৌড় ... সেই মাঠশুদ্ধ হারিয়ে গেছে, এখন সেখানে অনেক অনেক বাড়ী আর বাড়ী।

মীরু খেলতো না, ও খেলতে পারতো না, ওর ডান পা আর বাঁ পা অসমান ছিলো, খুঁড়িয়ে হাঁটতো। তাই ও বেরুতো না বিশেষ বাড়ী থেকে, মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতো, ঘরে বসে খেলতো নিজের মনে। তখন থেকেই খুব ঠান্ডা মেয়ে ছিলো মীরু, আপনমনে প্লাস্টিকের পুতুল আর পোড়ামাটির হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে খেলতো,কোনো কোনো দিন ছুটির দুপুরে সোমাকে নিয়ে আমি এসে ওর সঙ্গে খেলায় যোগ দিতাম। আমার কেবল ভয় হতো পাছে মীরাকে কেউ কিছু বলে ওর পায়ের জন্য, তাই সোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে পারতাম না, কে কী বলে ফেলে তার ঠিক কী? একমাত্র সোমা কিছু বলতো না, অনেক ছোটো থেকেই সোমা খুব বুঝদার ছিলো।

মীরার স্কুল আর আমার স্কুল আলাদা ছিলো, তাতো হবেই। অথচ প্রথমদিকে সেই আলাদা ব্যাপারটা মেনে নিতে দুজনেরই কষ্ট হতো। আমাদের ক্লাসে দুজন যমজ মেয়ে ছিলো-সুনীতা আর সুতীর্থা। ওরা আইডেনটিকাল টুইন। কেমন দুজনে একই ক্লাসে পাশাপাশি বসে,এক টিফিনবাক্স থেকে ভাগ করে খায়,কেউ একজন কিছু আনতে ভুলে গেলে অন্য বোনে তার ব্যাগ থেকে বার করে দেয়। আমার ভারী মনকেমন করতো মীরার জন্যে। তারপরে আস্তে আস্তে সয়ে গেলো, মনে হলো একদিকে ভালোই, নইলে সবাই হয়তো মীরার পায়ের জন্য প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে দিতো!

আস্তে আস্তে বিচ্ছেদরেখা গাঢ়তর হতে থাকে, ভোর থেকে যতই বেলা গড়াতে থাকে। আমাদের সকলের জীবনেই কি তাই? যমজ হোক বা না হোক? এইভাবে আমরা দুজনেই বড়ো হতে থাকি, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, নানা ঘটনার তরঙ্গ আমাদের উপরে আছড়ে পড়ে, কখনো ভাসিয়ে নেয় খানিকটা, কখনো ডুবিয়ে দেয় আপাদমস্তক-কিন্তু আমরা আবার মাথা জাগাই।

আগেই তো বলেছি আমি আর মীরা ভিন্ন প্রকৃতি, মীরা অনেক শান্ত, ঠান্ডা। একদম ছোটো থেকেই বোধহয় সে কেমন করে বুঝতে পেরেছিলো ওর জেদী হতে নেই, ওর একগুঁয়ে হতে নেই, ওর দুরন্ত হতে নেই। ওর সবই মেনে নিতে হবে, ওকে চিরকালই মানিয়ে নিতে হবে। ওর পক্ষে দুষ্টু মেয়ে হওয়া অসম্ভব, ওকে লক্ষ্মী মেয়ে হতে হবে। ও তাই হয়েছিলো, ঘরের কাজে মাকে হাতে হাতে সাহায্য করতো খুব ছোটো থেকেই। ওর পড়াশোনা নিয়ে তেমন টেন্শন কোনোদিন করতো না মাবাবা, যেন ভালো হয়েই বা কি হবে, সেই তো প্রতিবন্ধী!

অন্য দিকে আমি জেদী, দুরন্ত। কিছুই মেনে নিতে চাই না। কিছুতেই মানিয়ে নিতে চাই না। ঘরের কাজ আমাকে দিয়ে করানো অসম্ভব বলে কখনো মা বলতোও না করতে। শুধু পড়াশোনার ভালোত্বটাই হয়তো এইসব ত্রুটি সত্বেও আমাকে তেমন কঠিন সমস্যায় ফেলেনি। মাবাবা খুব সিরিয়াস ছিলো আমার পড়াশোনা নিয়ে। বহুকাল পরে যখন বুঝতে পারলাম আমি ওদের একমাত্র বাজি ধরার মতন রেসের ঘোড়া, ততদিনে বেলা কেটে গেছে অনেক, আর ফিরে আসার পথ নেই। যাতে মীরার কোনো ছায়াও আমার উপরে না পড়ে তাই আমার নীরা নাম বদলে রাখা হলো শিখা, যাতে নামের কোনো শাব্দিক বা ছন্দগত মিলও না থাকে। শুধু নীরা লুকিয়ে রয়ে গেলো মীরার শান্ত দিঘির মতন হৃদয়ে, খুব একান্ত মুহূর্তে সে আমাকে মাঝে মাঝে নীরা বা নীরু বলে ডাকতো।আমার আগুনপোড়া জীবনের উপরে একপশলা বৃষ্টির মতন ছিলো সেই নামের ছোঁয়া। আমরা দুই বোন ছাড়া কেউ সে খবর জানতো না।

৩ নীরা

মীরা জিজ্ঞেস করে," কিরে নীরু, একটু ঘুমিয়ে নিবি না? একটু বিকেল হলেই তো আবার ছাদে যেতে চাইবি। এইবেলা একটু ঘুমিয়ে নে।"

হাল্কা ঝাঁকুনি খেয়ে বর্তমানে ফিরে আসি। মীরার গলার স্বরের এই মাতৃভাব আমার কানে চিরকাল সুধাবর্ষণ করেছে, সেই মরুভূমির দিনগুলো নইলে পারই বা হতাম কিকরে? সেই একলা জীবনে আর তো কেউ ছিলো না মনের কাছে, বিপন্ন মুহূর্তে যে পাশে দাঁড়ায়, শক্ত কাঁধ এগিয়ে দেয় ভর দেবার জন্য, গোপণ কান্না মুছে নেয় শান্ত আঁচলে।

বাবামায়ের কাছে তো সেই আশ্রয় পাওয়ার আশা ছিলো না, ওদের রেসের ঘোড়া আমি, সেই ডিসাইসিভ সন্ধ্যায় যাকে বনে পালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত করে শৃঙ্খলিত করা হয়েছিলো। তাছাড়া কৃতজ্ঞতার বন্ধন ও তো আছে, জন্মঋণ আছে...

হয়েছে কি শোধ, ঐ পিতৃমাতৃঋণ? গোটা জীবনটি বাজি ধরে? কেজানে! কেউ বলতে পারে না, কিংবা হয়তো কেউ পারে, এ পৃথিবীতে যাকে কোনোদিন দেখা যায় না অথচ মানুষের সমস্ত জীবন লাভ ক্ষতি দেওয়া নেওয়া চাওয়াপাওয়া পাপ পুণ্য ভুল ঠিকের হিসেব যার কাছে থাকে। দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, তার আর তো বেশী দেরি নেই...

মীরা আমায় শুইয়ে দেয় আলতো করে, আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়ে আমার চুলে বিলি দেয়, ওর চোখের অঝোর অশ্রু আমার চুলে ঝরে পড়ে। আমি বলি, "মীরু, কেন কাঁদছিস? বোকা মেয়ে কোথাকার! আমি চলে গেলেও আমায় ফিরে পাঠাবে, জানিস? এই জীবনব্যাপী আকুল মাতৃস্নেহাকাঙ্ক্ষা, এই শুকনো হৃদয়ের উপরে বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা, এই ভালোবাসার তৃষ্ণা...এত চাওয়া নিয়ে কেউ কি চলে যাবার অনুমতি পায়? আমায় ফিরে পাঠাবেই, তখন বলবো তোর ঘরে যেন আমাকে... হয়তো অনেক অনেক বছর পরে, অন্য সময়ে, অন্যরকম পৃথিবীতে... তোর ঘরে মেয়ে হয়ে আমি আসবো।"

মীরা আমার মুখের উপরে হাত চেপে ধরে, আর বলতে দিতে চায় না, কান্নায় মীরা ভেসে যাচ্ছে।আমি হাত বাড়িয়ে ওর চোখ মোছাই, ও এত কাঁদবে জানলে আমি আগেই থেমে যেতাম।

চোখ বুজি, ঘুমোবার ইচ্ছে হয় না, ছোটোবেলার সেই দুপুরগুলো মনে পড়ে, তখনো ঘুমাতে ইচ্ছে করতো না। ঠিক দুপুরবেলা যখন সব চুপচাপ হয়ে যায়, শুধু কোথায় যেন ঘুমেলাস্বরে ঘুঘু ডাকে ঘুগ্‌ঘু-উ-উ-উ, তখন চেনা পৃথিবী কেমন ম্যাজিকদুনিয়া হয়ে যায়, সে না দেখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় নষ্টের মানে হয় কোনো? কিন্তু তখন মা জোর করে শুইয়ে রাখতো, আমাকেও মীরাকেও,মীরা ঘুমিয়ে পড়তো, আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম আর ভাবতাম মা ঘুমিয়ে পড়লেই আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলে যাবো পুবের বারান্দায়, সেখানে গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে নীল অপরাজিতা ফুটেছে, সেগুলোর উপরে হাত বোলাবো আর খুঁজবো সেই ম্যাজিক দরজাটা ঠিক কোথায়? যেটা পার হতে পারলে আর মজার অন্ত নেই?

কিন্তু কোনোদিন সেই পরিকল্পনা রূপায়িত হতো না, মার ঘুম খুব পাতলা, আমি উঠে পড়লেই হাত বাড়িয়ে টেনে শুইয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাতচাপড়ি দিতো কাঁধের কাছটায় অথবা বালিশটার কোনা ধরে আস্তে আস্তে ঝাঁকাতো,সেই দোলদোল দুলুনির ম্যাজিক আমায় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে দিতো। যখন চোখ মেলতাম তখন বিকেল, জেগে ওঠা মানুষদের গলা শোনা যাচ্ছে, দুপুরবেলার যাদু কোথায় মিলিয়ে গেছে। উঠে মুখহাত ধুয়ে খেলতে চলে যেতাম মাঠে, সেখানে তো তখন সোমা, পম্পা, বিল্লু, বাবুন, পিংকি, মৌ, তানি সবাই জুটে গেছে। স্মৃতি কখনো কখনো কত মধুর...

ফিরে আসে সেইসব অমলীন কচিমুখের বালকবালিকারা, স্মৃতির দেশে তারা একই রয়ে গেছে, কঠিন রুক্ষ দুনিয়া ঘষে ঘষে শক্ত করতে পারে নি তাদের...

এতকাল পরে এই আসন্ন সন্ধ্যায় আবার সেই জীবনের কচিবেলার দিনগুলোর ছায়া এসে পড়েছে, এখনো দুপুরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। আর মীরা, ঠিক সেই সময়ের মায়ের মতন বালিশে দুলুনির মতন ঝাঁকুনি দিয়ে আমায় ঘুম পাড়ায়। অদ্ভুত একটা ঘুমপাড়ানি সুরের গানও ও গায়, অর্থোদ্ধার করতে পারিনা, এলিয়ে পড়ি ঘুমের মধ্যে।

বিকেলে ঠিক তেমনি উঠে মনে হয় দুপুরম্যাজিক হারিয়ে গেলো, ঈশ! এখন আর দৌড়ে খেলার মাঠে যাওয়া নেই অবশ্য,ভাবতে গিয়ে হাসি পায়, মধ্যবয়সী কেউ কি খেলার মাঠে গিয়ে কচি বাচ্চাদের মতন খেলতে পারে? অবশ্য সেই খেলার মাঠ শুধু স্মৃতির মধ্যেই রয়ে গেছে, বাড়ীর জঙ্গলে মাঠ সব হারিয়ে গেছে। রোদের তেজ কমে এসেছে, আকাশে নরম সাদা মেঘেরা সন্ধ্যারঙ মাখার জন্য তৈরী হচ্ছে, ছাদে রঙীন ছাতার নীচে বসে থাকি, মীরা চা আর পকোড়া নিয়ে এসে বসেছে।

আমরা কথা বলছিলাম, এলোমেলো পুরানো কথা, নতুন কথা,হাসির কথা,এমনি সাধারণ কথা।এইসব কথায় কথায় উঠে এলো বিদ্যুতের কথা। মেয়ের কথা বলতে বলতে কেমন করুণ হয়ে এলো মীরার মুখ,আমি ওর হাতের উপরে হাত রেখে চুপ করে রইলাম। চিরকাল আমি আমার ইমোশনাল নীডের সময় মীরার কাছে অঞ্জলি পেতেছি, ওর নিজের সুখদুঃখ চিরকাল ও গোপণ করেছে, কোনোদিন খুলে দেখায় নি। ঐ নির্জন দুপুরের রহস্যপুরীর মতন ওর মন, যা কোনোদিন আমার চোখে ধরা পড়ে নি।

বিদ্যুৎপর্ণা হোস্টেলে থাকে, মীরার প্রথমদিকে আপত্তি ছিলো, একমাত্র সন্তান এভাবে বাড়ী থেকে দূরে থাকবে! কিন্তু তাপস অনেক বুঝিয়ে ওকে রাজী করেছিলো। বলেছিলো, বাইরে থাকলে বিদ্যুৎ অনেক ভালোভাবে তৈরী হবে, ভালো শিক্ষা পাবে,ভালো সুযোগ পাবে। এখানে এই গাঁ মফস্বলে থাকলে কিকরে সে জীবনে উন্নতি করবে? মীরা মেনে নিয়েছিলো, সে চিরকাল মেনেই তো নিয়েছে,কোনো আপত্তি তো কোনোকিছুতেই সে করে নি!ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কিছুই তো সে জোর করে প্রকাশ করে নি কোনোদিন! চিরকাল শুধু মানিয়ে নিয়েছে! তাপসের কাছেও সে কেমন ঋণীর মতন, প্রতিবন্ধী তাকে বিয়ে করে সে যেন বিরাট মহত্ব দেখিয়েছে!

আমার কাছেও মীরার সঙ্কোচের শেষ নেই, আমার সমস্ত জীবন নাকি ওর জন্যেই এত রিক্ত রয়ে গেল, ওরই কারণে নাকি আমাকে অত পুশ করেছিলো বাবামা, আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপরেই নাকি নির্ভর করছিলো ওর চিকিৎসা চলতে পারবে কিনা, ওর দায়িত্ব নেবার কাউকে পাওয়া যাবে কিনা যে বাড়ীঘর ও সঞ্চিত সম্পত্তির নিরঙ্কুশ দখল পাবার বিনিময়ে পঙ্গু মীরাকে ঘাড়ে নিতে রাজী হবে। আমি যদি নিঃশর্তে সব সম্পত্তি ছেড়ে না দিতাম, যদি আমার চাকরিবাকরি না থাকতো, যদি প্রচুর পণ দিয়ে আমাকে বিয়ে দিতে হতো আর তারপরেও শ্বশুরবাড়ীর থেকে দাবীদাওয়া লেগেই থাকতো-এইসব অজস্র যদির বেড়া চাপা পড়ে মীরার হিল্লে হবার নাকি কোনো উপায়ই আর থাকতো না। ওর সুখশান্তির ঘরসংসার নাকি হয়েছে আমার প্রাপ্য আমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ায়।

আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি যে এগুলো সত্য নয়, আমাকে কেউ বাধ্য করেনি, আমার ভালোর জন্যেই বাবামা চেষ্টা করেছিলো, ওদের স্বার্থ ছিলো না অন্য কোনো-কিন্তু ও হাসে দুঃখের হাসি।ও মানে না। বলে,"নীরু, তাহলে কেন তুই সংসার করলি না চাকরিবাকরি ভালো পেয়ে যাবার পরেও?"

আমি আর কী বলবো ওকে, আর সকলের কাছ থেকে লুকাতে পারি, কিন্তু সাংঘাতিক সন্ধ্যার নীরব প্রত্যক্ষদর্শী মীরা,তার কাছে কী দিয়ে ভুজুংভাজাং দেবো? সেও তো একই বয়সের এক সংবেদনশীল ভীতু কিশোরী ছিলো, প্রেমের মৃত্যু তার কাছেও তো সমান সাংঘাতিকই ছিলো, হোক না সে প্রেম তার নিজের নয়, যমজ বোনের।

আমি জোর করে হাসি, বলি,"দূর পাগলি, আমি বিয়ে করে ঘরসংসার করলে আজ কী হতো? কার কাছে তাদের রেখে যেতাম? তোর কাছে রেখে যেতে পারতাম, কিন্তু সে যে বড়ো ভার মীরু, সে যে বড় ভার।"

দুইবোনে এইবারে একইসঙ্গে পরস্পরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকি, এ আজকের কান্না নয়, অনেক অনেকদিন আগে যে কান্না কাঁদা হয়নি, তীব্র তাপে যে কান্না শুকিয়ে গেছিলো,তা আজকে এই গোধূলিবেলায় ফিরে এসেছে। হাতধরাধরি করে আমরা ফিরে যেতে চাই সেই জলজ অন্ধকারে, সেই প্রতারণাহীন বিশ্বাসের জগতে,সেখানে আঘাত নেই অশান্তি নেই পীড়ন নেই-শুধুই চরাচরব্যাপী দুলতে থাকা জলরাশির মতন অবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা সেখানে।

৪ কথামালামেঘ

প্রিয় মীরু,

অনেক চিঠি পেয়েছি তোর কাছ থেকে, লম্বা লম্বা চিঠি, খুব সুন্দর স্নিগ্ধ চিঠি, কিন্তু আমার দিক থেকে সেভাবে বড়ো চিঠি লেখা হয় নি কেন জানি। এক দুলাইনের দায়সারা উত্তর বা তিনলাইনের শুভেচ্ছাবার্তা বা কার্ড বা ফোনকল করে সেরে ফেলেছি। আজকে ভাবছি এত এত বছর ধরে কেন একবারো দীর্ঘ চিঠি লেখার ইচ্ছে হলো না। প্রথমেই মনে পড়ছে সময়ের অভাব, কিন্তু তলিয়ে ভেবে দেখছি সেটা সত্য নয়। সময় ছিলো,সময় করে নিলেই সময় হতো চিঠি লেখার। সপ্তাহান্তের হুল্লোড় বা পার্টির কোনো একটা দুটো বাদ দিয়ে দিলেই নিটোল অনেকগুলো ঘন্টা হাতে এসে যেতো, কিন্তু কেন জানি করা হয়ে ওঠেনি। ভাবতাম যা বলার ফোনেই তো বলে দিই, অসুবিধে তো কিছু নেই। কিন্তু চিঠির আকাশে যে কথামালামেঘ উড়ে যায়, ফোনের কঠিন আর সরু কৃপণ তারে কি তা দেখা দিতে পারে?

তুই এ চিঠি পেয়ে হাসবি,ভাববি কেজো মেয়ে শিখা এত কাব্যি করতেও পারে? আমিও হাসছি, এ চিঠি শিখার লেখা নয়, এ নীরার লেখা। নীরা মরে গিয়েছিলো বলে মনে করেছিলাম দেখি সে হতভাগী মরে নি পুরোপুরি।

মীরু, তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে,অনেকদিন ধরে, অনেক মাস ধরে, আস্তে আস্তে বয়ে যাবে সকাল দুপুর সন্ধ্যে-তোর ঘরকন্নার মধ্যে তোকে দেখবো-স্নানের পরে ভেজা চুলের রাশি পিঠে মেলে তুই ছাদে চুল শুকাতে শুকাতে আমলকী মুখশুদ্ধি মুখে দিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করবি...

এত বছর বেশ অনেকবারই তো তোকে দেখেছি, কিন্তু তখন শুধু গেছি আর এসেছি, দৌড়ের মধ্যে তেমন শান্তিতে কি দেখা করা হয়? সেও ফোনে কার্ডে যোগাযোগের দায় মিটিয়ে ফেলার মতন ব্যাপার। ও নামেমাত্র দেখা। ওরকম না, অফুরাণ ছুটির মধ্যে অনেকদিন ধরে তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

জানি এ অন্যায় আবদার। আমার ছুটির খবর এসে গেছে বলে তো সকলের ছুটি হয় নি! সংসারের হাজারো কর্তব্য আছে তাদের, অনেক দায়দায়িত্ব আছে, অনেক কাজ করার আছে তাদের-এর মধ্যে উটকো ঝামেলার মতন আমার এই আবদার হয়তো তোর ভালো নাও লাগতে পারে। তবু তোকে জানি বলেই এ চিঠি লিখছি ভরসা করে, তোর কাছে প্রার্থনা জানাই,কয়েক সপ্তাহের জন্য যদি থাকতে চাই তোদের কাছে, তোদের কি খুব অসুবিধে হবে? যদি অসুবিধে হয়, নিঃসঙ্কোচে জানাস, আমি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেবো।

এখানে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার সৌজন্যে আমার অবস্থা এমনিতে ভালোই। শেষ কটা মাস অসুবিধে কিছু হবে না। তারপরের ব্যবস্থাও ভালোভাবেই করা আছে। সেই ব্যাপারে তোদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। শুধু মাঝে মাঝেই কেন জানি মনে হয় কিযেন আমার একটা করার ছিলো, কি যেন অসম্পুর্ণ রয়ে গেলো, কার সঙ্গে যেন দেখা করার কথা ছিলো...

এইসব ভাবনা স্বপ্নের মধ্যে দেখা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিতো।মাঝে মাঝে মনে হতো কে যেন আমায় ডাকছে! এখানের মনোবিদ আমায় অনেকভাবে পরীক্ষা করে বললেন আমার দেশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে হয়তো কিছুকাল কাটাতে ইচ্ছে করছে। তারপরেই ভালো করে ভেবে দেখলাম। এ চিঠি লেখার আগেও অনেক ভেবেছি। তারপরে লিখেই ফেললাম।

মীরু, তুই তো জানিস, গোড়া থেকেই আমি একটু স্বার্থপর ধরনের। একটু বেহায়াও। দেখেছিস, এখনো তাই আছি, কেমন এতকাল কিছু না, এখন দরকার হতেই কেমন এক সাতপাতা চিঠি ফেঁদে বসেছি। হী হী হী। দ্যাখ কী কান্ড, তুই কেমন আছিস সেটাই জিজ্ঞেস করিনি। আমি জানি ভালো আছিস, তুই সবসময়ে সবাইকে বলতিস ভালো আছিস। নিজের দুঃখবিষদ তুই কখনো কারুর সঙ্গে ভাগ করিস নি, এমনকি আমার সঙ্গেও নয়...

আমি চিঠি পাঠিয়েছিলাম নিদাগ, এখন চোখের জলের দাগে অনেক শব্দ মুছে গেছে চিঠির থেকে, আমি আসার কদিন পরে মীরা আমাকে ঐ চিঠি দেখিয়ে কান্নায় বিবশা হয়ে বলছিলো এরকম চিঠি কিকরে বোনকে লিখতে পারলাম, কিকরে নিজের উপরে মানুষে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? এতটাই যে এ যে কাছের জনকেও আঘাত করবে সেটুকুও বুঝতে পারে না?

ঐ চিঠি পাওয়ার পরে ফোনে মীরার গলা কান্নায় ডুবে গেছিলো, প্রথমে আমি বুঝতেই পারছিলাম না ও কী বলছে, পরে একটু সুস্থির হয়ে ও বলছিলো, "এক্ষুনি আয় নীরু এক্ষুনি আয়। তোকে আর যেতে দেবো না আর যেতে দেবো না...." তারপরে আরো অনেক কথা, যার অর্থোদ্ধার করতে পারিনি।

স্মৃতির জলধারা বয়ে যায়, পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যারক্তরাগ জেগে উঠেছে, মেঘগুলো এত রঙীন, এত রঙীন! মনে পড়ে সেইসব বিকেলসন্ধ্যেগুলোর কথা যখন আমি আর সোমা, তখন আমাদের সাত কি আট বছর, দিগন্তবিস্তৃত মাঠের উপর দিয়ে পশ্চিমের ডুবন্ত সূর্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছি আমরা দুটি বালিকা, কল্পনায় আমরা তখন সূর্যাভিযাত্রী। কোথায় চলে গেছে সোমা আজ,সাধের সংসারসন্তান সব পিছনে ফেলে...

ঐ নীল আকাশের গভীর থেকে ডাক আসলে কি সবই তুচ্ছ করা যায়?

মীরা নীচে নেমে গেছে, এখন সে জলখাবার তৈরী করবে, তাপস ফিরতে ফিরতে রাত আট কি সাড়ে আট হয়ে যায়। তাপস এসে অলখাবার খেতে খেতে টিভি দেখে মীরার সঙ্গে। ওদের রাতের ডিনার এগারোটায় কি সাড়ে এগারোটায়। বহুকালের অভ্যাসে আমি অত রাতে খেতে পারিনা, আটটার আগেই দুধ খই খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙে যায় শেষরাত্রে, তখন ছাদে উঠে এসে তারাদের দিকে চোখ মেলে বসে থাকি।

এখনও তারা ফুটে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছি ছাদেই,শুনতে পাচ্ছি সোমার গান, স্মৃতি থেকে উঠে আসছে,"নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে/আঁধার কেশভার দিয়েছে বিছায়ে..."- আমি কোনোদিন গান গাইতে পারতাম না,গানের ইস্কুলেও কখনো যাই নি, সোমা বড়ো হয়ে যখন খুব সুন্দর গাইতে পারতো, তখন তারা ফুটতে থাকা সন্ধ্যায় এই ছাদেই সে আমায় গেয়ে শোনাতো,"আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ/তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান...",

সেই গান শেষ হয়ে গেলে আরেকটা শোনাতো, "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।"

উত্তর আকাশে ফুটে উঠতো সপ্তর্ষির অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন। এই তো, সেই চেনা সপ্তর্ষি আজও তো ফুটে উঠছে, ধোঁয়াধুলোয় একটু ঝাপসা,কিন্তু সেই চিরচেনা সপ্তর্ষি। ঐ তো স্বাতী জ্বলজ্বল করছে, ঐ তো চিত্রা। সোমাকে তারা চেনাতাম আমি আর ও গান শোনাতো আরো। সে কি অনেকদিন নাকি অল্পদিন? সুন্দর সময়গুলো এত তাড়াতাড়ি চলে যায় কেন? বিরহ এত দীর্ঘ আর মিলন এত ক্ষণিকের কেন?

বিদ্যুৎপর্ণাকে দিয়ে যেতে চাই আমার সমস্ত সঞ্চয়, কিন্তু বিদ্যুৎ এখনও নাবালিকা। মীরাকে দিয়ে গেলে সে পরে মেয়েকে দিতে পারে অবশ্য, কোনো অসুবিধা নেই। তাপসও খুব ভালো ছেলে, মীরা অবশ্যই খুব ভালোমানুষকে পাবারই যোগ্য। এমন টলটলে জলের মতন হৃদয় আর কটা মেয়ের আছে?

তাপসের বাবামা ওর ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন, মামার বাড়ীতে অবহেলায় মানুষ হয়েছে,নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে নানা ছুটকোছাটকা অস্থায়ী কাজ করছিলো, আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো ভালো কিছু একটা করার, ছোটো একটা ব্যবসা বা একটা কোনো স্থায়ী চাকরি...

সেই সময়েই কুরিয়ার সার্ভিসের অস্থায়ী কাজ করার সময় অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয় আমাদের পরিবারের সঙ্গে। তারপরেই আস্তে আস্তে যোগাযোগ গাঢ় হয়, বাবামা ওকে সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে একটা দোকান করে দেবে বলে আর বাড়ীটাও দিয়ে দেবে বলে, মীরার সঙ্গে বিয়ে হবার আর বাবামাকেও দেখাশোনা করার শর্তে। আত্মীয়স্বজনেরা ও বন্ধুরা অনেকেই এইরকম হঠকারিতার বিরোধীতা করার চেষ্টা করেছিলো,বলেছিলো এইভাবে বিশ্বাস করার ফল ভালো নাও হতে পারে।

মীরার চিকিৎসার প্রয়োজন ও খরচও দিনদিন বাড়ছিলো,আমি যথাসাধ্য টাকা পাঠাতাম কিন্তু ওদের একজন সার্বক্ষণিক কাছে থাকা মানুষের প্রয়োজন ছিলো যে শক্ত কাঁধে আগলে ধরবে দুর্বল প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে ও তার প্রৌঢ় বাবামাকে। আত্মীয়স্বজনেরা কাছে দূরে অনেকেই ছিলো, কিন্তু কেউই সেরকমভাবে আগ্রহী ছিলো না সাহায্য করতে শুধু শুকনো উপদেশ দেওয়া ছাড়া। জানিনা, হয়তো কিছু ঈর্ষাও ছিলো। অথবা হয়তো আজকালকার দিনে আত্মীয়তার বন্ধন সর্বত্রই দুর্বল হয়ে গেছে, প্রায় সবাই হয়তো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে,পরের জন্য ভাবার, পাশে দাঁড়াবার ও সাহায্যের হাত বাড়াবার মানুষ হয়তো বিরল প্রজাতি হয়ে গেছে। কেজানে!

তাপস দায়িত্ব নিতে রাজী হলো, সমস্ত শর্ত ও পূরণ হলো। তারপরে বাবামা আরো সাত আট বছর ছিলেন, ওদের ঐকটা বছর খুব নিশ্চিন্ত শান্তিতে কেটেছে। তাপসের ছোটো ব্যাবসাটিও ভালো চলছিলো, আস্তে আস্তে উন্নতিও হচ্ছিলো। চিকিৎসায় মীরারও উন্নতি হচ্ছিলো, দুর্বলতা কমছিলো, ক্লান্তি কমছিলো, উৎসাহ বাড়ছিলো। সেইসব বছরে যে তিন-চারবার বেড়াতে এসেছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য, দেখে ভালো লাগতো সুখী ওদের। শুধু মীরাতাপসের ঘর আলো করে একটি সন্তানের আগমণের জন্য অপেক্ষা ছিলো ওদের। সাত বছর কেটে গেলো। বাবামা চোখ বুজলো একবছর এদিক ওদিক। বিয়ের দশ বছর পরে জন্মায় বিদ্যুৎপর্ণা। ওদের আলোর রাজকন্যা।

বিদ্যুৎপর্ণার জন্য সঞ্চয় দিয়ে যাবার কথা মীরাকে বলাই সবচেয়ে কঠিন, সে শুনলে কি করবে কেজানে! সামান্য চিঠিতেই যে ওভাবে কেঁদেকেটে...

কিন্তু কাউকে দিতেও তো হবে, যে ভবিষ্যতে আশার স্বপন ফলাতে পারবে সোনার ফলে, নইলে সব অর্থই তো অর্থহীন।

শেষরাত্রির অদ্ভুত আঁধারে তারাগুলো পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েছে, সন্ধ্যায় ওদের পুবের আকাশে ফুটে উঠতে দেখেছি। চন্দ্রাস্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন শুক্লপক্ষের শুরুর দিক। শেষরাত্রির বাতাসে কেঁপে উঠি, সঙ্গে আনা হাল্কা চাদরটা জড়িয়ে নিই। ঐ পশ্চিমদিগন্তের কুহেলিতে টুপ করে ডুবে গেলো একটা তারা, ওর আলোর ঝলকে মনে পড়ে গেলো হারানো একটা কথা। পুবের দিকে তাকালাম, হাল্কা একটা আলোর আভাস ফুটে উঠেছে, সকাল হতে আর দেরি নেই। সামনের যা কিছু পথ এখনো বাকী, সে পথে কিভাবে চলবো,হঠাৎ দেখতে পেয়েছি যেন।

৫ সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজা

এখানে সাদা বালি ভোরের সোনালী আলোয় সোনার বরণ লাগে, রঙীন ছাতার নীচে এলানো চেয়ারে বসে থাকি, হাতে পাতলা সাদা কাগজের ডাইরি, হাল্কা একটা ডটপেন দিয়ে লিখে যাই সাদা পাতায়। মীরার এই শর্ত। প্রত্যেকদিন লিখতে হবে ওকে। যা খুশী। আমি শর্ত মেনে প্রত্যেকদিন লিখে পাঠাই মীরাকে।

সকাল থেকে লিখি,দুপুরে ফিরে যাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার জন্য নির্ধারিত ঘরে, স্নানখাওয়া করে আবার আসি বিকেলে। আসার আগে লেখা পোস্ট করে দিই। এখানে এসব ব্যবস্থা খুব চমৎকার রকম সুবিধাজনক। বিকেলেও লিখি যতক্ষণ না আলো একেবারে কমে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত। গ্রীষ্মের সন্ধ্যাগুলো খুব দীর্ঘ, রাত সাড়ে আটটা/নটা পর্যন্ত আলো থাকে।

ক্রিসও ঘটনাচক্রে এখানে,সে বিকালে আসে সমুদ্রতীরে। সে আমার পুরানো জীবনের খুব ভালো বন্ধু। এখন সেও এখানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছে। মাস দুই পরে সে ফিরে যাবে ওর কর্মস্থানে। ক্রিসের পুরো নাম ক্রিস্টোফার। কিন্তু ওকে কোনোদিন কেউ ক্রিস্টোফার ডাকে নি, সবাইকে নিজের পরিচয় দিতে ও সবসময় বলে হ্যালো,আমি ক্রিস। প্রথম প্রথম আমার অবাক লাগতো। তারপরে দেখি অনেকেই ছোট্টো নামে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করে। আমার নামটাই এত ছোটো যে আর ছোটো করতে হতো না। ক্রিস জানে না আমার ছুটির নোটিশ আসার কথা, আমিও তো জানতাম না ওর ছুটির কথাও...

আমার এই পুরানো স্টাইলে লেখা দেখে ক্রিস হাসে, বলে আজকাল কেউ আবার এভাবে চিঠি লেখে নাকি, প্রায় সবাই তো ইমেল করে, কত তাড়াতাড়ি হয়। ওকে কিভাবে বোঝাই সেই চিঠির আকাশে ভেসে যাওয়া কথামালামেঘের কথা? নিজেই ভালো বুঝি না আর ওকে বোঝাবো!

মাত্র এই মাসটাই হয়তো বাইরে আসার অনুমতি পাবো, পরের মাসে হয়তো আসার মতন অবস্থাই থাকবে না। তাই প্রত্যেকটা দিনকে নিংড়ে নিতে চাই সমস্ত সূর্যালোক, নীল আকাশ, ভেসে যাওয়া মেঘমালা,সমুদ্রচিল, নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের উপরে ঐ যে বিন্দুর মতন জেলেডিঙি দেখা যায়-সব সমেত। বহুদিন পরে মনে হচ্ছে আহা জীবন জীবন জীবন কী মধুর! আহা বেঁচে থাকা কত সুন্দর!

এরকম আগে কখনো মনে হয়নি,মনে হতো কষ্টের ভারী বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জীবননামক এই মরুর মধ্য দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুট, কী ক্রীতদাসত্ব! কোন্‌ মন্ত্রবলে মরু উধাও,কোন্‌ মন্ত্রবলে বোঝা উধাও-এখন সবুজ উদ্যানে পাখির গান, জলের শব্দ,স্বপ্নের মতন জলতরঙ্গ বাজনা ভেসে আসে কোন্‌ অলক্ষ্য বাতায়ন থেকে। কী অসম্ভবের সম্ভাবনা অপেক্ষা করে ছিলো এই বাঁকে, তার বিন্দুমাত্র আভাস আগে ছিলোনা আমার কাছে!

ছোটোবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম "দিগন্তপ্রিয়"। এক পাখির গল্প। সে পাখি থাকে উত্তর মেরুতে, এক আর্কটিক টার্ন। সেই ছোট্টো পাখি প্রতি বছর শীতের সময় উড়ে যায় সোজা দক্ষিণ মেরুতে। আবার উত্তরে যখন গ্রীষ্ম আসে তখন তারা উড়তে উড়তে ফিরে আসে উত্তর মেরুঘেঁষা ওদের ঘর-গেরস্থালীতে। এই গোষ্ঠীর একটি ছোট্টো পাখিকে নিয়ে গল্প ফেঁদেছিলেন লেখক। সে পাখি বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে যখন উড়ে আসছিল তার বাবামায়ের সঙ্গে, তখন একটি দুর্ঘটনায় সে আটকে পড়ে বিদ্যুতবাহী তারের মধ্যে,কিন্তু শুধু পা আটকে গেছিলো আর অন্য তারটা ছোঁয় নি বলে সে মরে নি। সেখন থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়, প্রধানত জিম বলে একটি ছেলের উদ্যোগে। তারপর আহত পক্ষীশাবকের যথাসাধ্য সেবাশুশ্রুষা করে জিম আর ওর মা মিলে। সুস্থ হয়ে উঠলে পাখিটিকে ছেড়ে দেয় তারা, জিম পাখিটার নাম দিয়েছিল দিগন্তপ্রিয়। ছেড়ে দেবার আগে দিগন্তপ্রিয়ের পায়ে পরিয়ে দেয় চিহ্নিত আংটি। যাতে ফিরে আসার পথে যদি আবার সে আসে তবে সেই আংটি খুলে স্মারক হিসেবে রেখে দিতে পারবে। কী সুন্দর লেগেছিল যে নামটা! দিগন্তপ্রিয়! মেরু থেকে মেরুতে অবিশ্রাম উড়ে চলার কল্পনা মনকে যে কী এক আশ্চর্য দোলায় দুলিয়ে দিত!

তখন কি জানতাম যে আমাকেও অমনি করে চেনা অচেনা দেশে ঘুরে বেড়াতে হবে সারাজীবন? তারপরে আরো অনেক দূরের এক যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এক সমুদ্রের তীরে?

দূরে বালির উপরে একদম জলরেখার কাছটিতে একটি ছোট্টো মেয়ে খেলা করে বেড়ায়,রঙীন ফ্রক পরা মেয়ে,একমাথা ঝামর ঝামর কালো চুলে রঙীন ফিতে। ওকে এতদিন লক্ষ করিনি,হয়তো বেশ কিছুদিন ধরেই আসে। ঐ জলের কাছে বালিতে ছোটো ছোটো পা ফেলে দৌড়ে বেড়ানো ছোট্টো মেয়েটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় অন্য কারুর কথা,কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না আসলে কার কথা সেটা।

ডায়েরির পাতায় কলম চলতে থাকে, আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে থাকে হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন,রাত, সকাল, সন্ধ্যা-হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা আর তাদের চলে যাওয়া শৈশব কৈশোর। সেই অনেক অনেক আগের এক বিষন্ন হেমন্ত সন্ধ্যায় যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিলো মৃত্যুঘুমে সে জেগে উঠতে থাকে, আস্তে আস্তে নরম ভীরু ভীরু পা ফেলে সে আসতে থাকে বালি পার হয়ে,বাতাস তার খোলা চুল ওড়ায়,ওড়ায়-ওড়ায় তার নীল চুড়িদারের প্রান্ত,সাদা ওড়না...

মীরা শেষপর্যন্ত রাজী হয়েছিলো নিতে,ওদের ওখান থেকে ফিরেই সেই সব ব্যবস্থা করে তারপরে এখানে এসেছি। সেই ধূসর হয়ে যাওয়া লেখাগুলো যত্ন করে ফাইলে মুড়ে আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলো মীরা আর কড়ার করিয়ে নিয়েছিলো প্রতিদিন যেন ওকে লিখি।

এই পেনগুলো চমৎকার,আলতো ছোঁয়াতেই সুন্দর লেখা হয়। কতকাল পরে আবার এইভাবে কাগজকলমে লেখা, ভাবতেই কেমন শিরশির করে। ভেবেছিলাম সব ভুলে গেছি,কিন্তু দেখি মনের তলার স্তরে সবই সঞ্চিত হয়ে ছিলো,আস্তে আস্তে জল সরিয়ে ডলফিনের উঠে আসার মতন সব উঠে আসছে।

ঐ তো লাবণিকে দেখতে পাচ্ছি-লাবণি বসে আছে তেতলার বারান্দায়। তিনতলায় একটাই ঘর আর সামনে বারান্দা, বাকীটা ছাদ। এই ঘর লাবণির পড়ার ঘর, শোয়ার ঘর, বসে বসে ভাবার ঘর--সব। ছাদের চারপাশ ঘিরে গাছেদের মাথা শুধু, আর উপরে বিরাট একটা আকাশ। চেনা কবিতার লাইন একটু বদলে ও বলতো "অনন্ত এ আকাশের কোলে/টলটল নীলের মাঝার/ এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর/তোর তরে তারা রে আমার।"

লাবণি তারাদের চিনতো, সে সারারাত তারা দেখতো। একদিন ঐ ঘর থেকেই লাবণি তারাদের দেশে চলে গেল...

লিখতে লিখতে ডুবে গেছিলাম, পায়ে কি যেন লাগলো-একটা বল গড়িয়ে এসেছে পায়ের কাছে,লাল বলটা। ডাইরি রেখে উঠে দাঁড়াই, বলটা তুলে নিই, কার বল এটা? ওমা, এতো সেই ঝামরঝামর চুল ফ্রকপরা মেয়ে, দৌড়ে আসছে-ওর বল নাকি? হেসে ছুঁড়ে দিই, লুফে নিলো মেয়েটা, বাহ, দারুণ তো! সে থ্যাংস দেয়, আমি ওকে কাছে ডাকি, জিজ্ঞাসা করি, কী নাম তোমার? সে বলে রিটা। আমার মনে হয় বলছে রীতা। ওর সঙ্গে আরো একটু গল্প হয়, ও থ্রীতে পড়ে, এখানে মায়ের সঙ্গে এসেছে, ওর মা ঐ কটেজে আছে, একটু পরেই ওকে নিতে আসবে।

ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো সেদিনই, অবাক হলাম। রিটার মা মানসী, সে আমার দেশের মেয়ে,আমাদের নিজের ভাষাও এক। আর তেমন লেখা হলো না, মানসীর সঙ্গে গল্প হলো। রিটার বাবা ডেভ আসেনি, সে নিজের শহরে ব্যস্ত। মানসী স্কুলে পড়ায়, এখন সামার ভ্যাকেশান চলছে, মেয়েকে নিয়ে একাই এসেছে মানসী,ডেভ ডিভোর্স চাইছে, রিটাকে মানসীই রাখতে পারবে কাছে-কত কথা কত কথাই জানা হয়ে যায়।

মানসী কথা কইতে ভালোবাসে, নিজের ভাষার তো কাউকে পায় না! রিটার ছুটির নোটিশের খবর কিন্তু পাইনি, পেয়েছিলাম আরো বেশ কয়েকদিন পরে...

সবাই সাগরবেলায় বসে আছি, কবে নৌকা আসবে! কারুর নৌকা এই এলো বলে, কারুর অনেক বাকী...

ঢেউ আসে, ঢেউ যায়, বালিতে বুনে যায় আশ্চর্য প্যাটার্ণ। ফেলে যায় শতশত আধমরা মাছ। এক পাগল ওদের তুলে তুলে ছুঁড়ে দেয় দূরের জলে। অবিরাম।

ঢেউ সরে যাওয়া বালিতে পড়ে থাকে শত শত ঝিনুকের খোলা। ছোট্টো রিটা ছুটে ছুটে সেইগুলো কুড়ায়...আমার পাশে বসে থাকে মানসী... আমি লিখে চলি,লিখে চলি...অনন্ত বালুকণার গল্প,ছোট্টো ছোট্টো বালির কণা,জ্যান্ত ঝিনুকের ফাঁক করা খোলার মধ্যে ঢুকে গেছিলো যারা, নরম ঝিনুকের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নিটোল নীল মুক্তো হতে চেয়েছিলো যারা...

No comments: