আকাশটা কী তীব্র নীল! সাদা কাপড় ঘষা দিলে যেন নীল রঙ উঠে আসবে! একটুকরো মেঘ কোথাও নেই। হেমন্তের আকাশে শিরশিরে শীত, পুরানো পাতারা ঝরে যাচ্ছে। এমনই অভিমানী হেমন্তের দিন ছিলো সেদিন। রণোর চলে যাবার দিন।
প্রিয়তোষ চুপ করে বসে থাকে বারান্দায়, সে এরকমই বসে থাকতো ও দেরি করে এলে যাতে হাতে নাতে ধরতে পারে। পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য, বেলা ফুরিয়ে এলো। চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে, সে চশমা খুলে মুছতে থাকে। নির্মলা চা নিয়ে আসে, প্রিয়তোষ চেয়ে থাকে ফাঁকা চোখে। আরো কার যেন আসার কথা ছিলো?
"চলো ভিতরে চলো, এখানে ঠান্ডায় আর থেকো না। চলো।" কে বলছে? নির্মলা? হ্যাঁ নির্মলাই তো! প্রিয়তোষ আর কার গলা শোনার জন্য কান খাড়া করে ছিলো?সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাঝে মাঝে সে কেন রণোর গলা শুনতে পায়?
রণো কুন্ঠিত গলায় আস্তে আস্তে বলছে,"ফিরতে দেরি হয়ে গেলো বাবা। মাফ করে দাও। সারাদিন কিছু খাই নি, খুব ক্লান্ত। আজকে কিছু বোলো না।"
ঠোঁট নড়ে প্রিয়তোষের, "আয় খোকা, তোর জন্য মিষ্টি এনেছি। কিছু বলবো নারে, আয়। তোর মা মিষ্টি বেড়ে দেবে আমাদের, একসাথে খাবো, আয়।"
রণজয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, একপাও এগিয়ে আসে না। প্রিয়তোষ এগিয়ে যায়, বলে,"কীরে কী হলো? সত্যি সত্যি দিচ্ছি। আর তোকে কখনো কিছু বলবো না খোকা। তুই কাছে আয়। ভয় পাস না। কিছু বলবো না তোকে।"
রণজয় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,বলে,"আমি চলে যাচ্ছি বাবা, মাকে বোলো আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসতাম। ভাইকে আর বোনকেও বোলো। তোমাদের সাথে থাকতে আমার খুব ইচ্ছে ছিলো। যদি আমায় ওরকম না করতে! তোমরা তো আমায় দেখতে পারোনা, ভাইবোনদের সাথে আমায় খেলতে দাও না। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো।"
মিলিয়ে গেল রণজয়, প্রিয়তোষ চিৎকার করে উঠতে চায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। তারপরে শোনে,"কী হলো তোমার? স্বপ্ন দেখেছ? বোবায় ধরেছে? উঠে বসো, উঠে বসো।" নির্মলার গলা। ও:, স্বপ্ন! সব স্বপ্ন! স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়?
প্রিয়তোষ উঠে বসে, গলা শুকিয়ে কাঠ। জল চায়। জল এনে দেয় নির্মলা। জল খেয়ে সে বলে,"স্পষ্ট দেখলাম খোকাকে। আমি মিষ্টি খাওয়াতে চাই, ও আসে না, ভয় পায়। তারপরে চলে গেল।"
প্রিয়তোষের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে, সে বলে,"আমাকে এত স্বপ্নে দেখা দেয় কেন বলোতো? আমি কত কষ্ট দিয়েছি বেচারাকে। তোমার ওকে মনে পড়ে না? তুমি ওকে স্বপ্নে দেখোনা? তুমি যদি ছোটো দুটোর মত ওকেও একটু আগলে রাখতে .....তাহলে হয়তো আমি ওকে বোকার মতন ওভাবে.... তুমি ওর নামে কত নালিশ করতে, আর আমিও ওকে ...ওহ, কীভাবে মারতাম..আহ, কিছু বলতো না শেষদিকে, আমার সামনে কাঁদতোও না। ওর ভাইবোনে কত আবদার করতো পুজোর সময় জামাটামার জন্য, ও কিছু চাইতো না। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিছু বিশেষ জামাটামা ওর চাই কিনা, কেমন আস্তে আস্তে বলেছিলো -"তোমার যা ইচ্ছা তাই দিও।" কেমন করে প্রণাম করতো দশমীর দিন, পায়ের পাতায় মাথা ছুঁয়ে। আমরা ওকে বুঝতে পারিনি নির্মলা...."
নির্মলা কেঁদে বলে, "তুমি এমন কোরোনা। কেন শুধু নিজের উপরে সব নিচ্ছ? আমার দোষও তো কিছু কম না। মা হয়ে ওকে কষ্টের দিকে ঠেলে দিতাম। ছোটন আর মিতিনকে একবার নাকি বলেছিলো ওর কেউ নেই। আমরা নাকি ওকে অনাথ-আশ্রম থেকে এনেছিলাম। যেইসব সন্ধ্যেবেলা শাস্তি দিতে, সেইসব রাতে খেতে দিতে তুমি বারণ করতে বলে কত রাতে ওকে খেতে দেই নি। কিছু বলতো না, চাইতোও না খেতে। মিতিন নাকি একবার লুকিয়ে খাবার নিয়ে দিয়েছিলো, ও নেয় নি, বলেছিলো বাবা তোকে বকবে বোন।" নির্মলা চোখে আঁচল দেয়।
প্রিয়তোষ বলে,"মনটা শান্তি পায় না। চলো রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি আমরা।"
নির্মলা বলে,"দিও। এখন ঘুমাও। যদি ছোটন মিতিন শোনে তুমি ঘুমাতে পারোনা, ওরা দু:খ পাবে। মিতিন বলছিলো রণো ওকে ছবি এঁকে দিতো আর ছোটনকেও দিতো। তুমি ওদের সঙ্গে খেলতে বারণ করেছিলে বলে খেলতো না ও। তারপরে তো ..... মিতিন বলছিলো, ওর সঙ্গে খেলা করতে ওদের খুব ইচ্ছে করতো। বলছিলো দাদা একা বলেই তো আমরা এসেছিলাম মা, ওর খেলার সাথী কেউ ছিলো না কিনা! এবারে আমরাও চলে যাই তাহলে?"
প্রিয়তোষ চমকে ওঠে, "এইসব বলে ওরা? তুমি ওদের বুঝিয়ে বোলো। ওদের তো কোনোদিন আমরা কিছু কষ্ট দেই নি! কোনোদিন ওদের কিছু বলবো না। চলো সবাই মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই, রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি।"
"আচ্ছা, তাই হবে। এখন তুমি ঘুমাও তো দেখি।"
প্রিয়তোষ শুয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করতেই নীল আকাশভরা সোনালী আলো, তার মধ্যে রণজয়ের অভিমানী মুখ ফুটে ওঠে, কী যেন সে বলে।
প্রিয়তোষ বিড়বিড় করে,"আহা তুই আলোর ছেলে, ভালোবেসে এসেছিলি আমার ঘরে, রাখতে পারলাম না হতভাগ্য আমি। কষ্ট পেয়ে ফিরে গেলি। মাফও চাইতে সময় পেলাম না। একদিন তো দেখা হবে, সেদিন মাফ চাইবো। মাফ করে দিস খোকা সেদিন। করবি না? "
আকাশভরা আলোয় বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ওঠে দুটি অভিমানী চোখ, তাতে শিশিরের মতন অশ্রু, টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে প্রিয়তোষের বন্ধ চোখের পাতার উপরে। কানে আসে সেই শেষ মন্ত্র, "মধুবাতা ঋতায়তে/ মধুক্ষরন্তি সিন্ধব:/ মাধ্বীর্ণ সন্তোষধী...."
ওই মধুময় বাতাসের সঙ্গে সে মিশে গেছে। সে আলোর ঘরে ফিরে গেছে।
(শেষ)
Sunday, May 25, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment