মেঘগুলো একটু আগে গোলাপী ছিলো,এখন সোনালী কমলা। ওই দূরে নীল জলরেখার থেকে লাফ দিয়ে ওঠে ঝকমকে সূর্য। ফেনামাখা ঢেউগুলো আসছে আর আসছে,ভেঙে পড়ছে পায়ের কাছে। দুধসাদা ফেনার রঙ লালচেসোনালী লাগে। আকাশটা পালিশ করা নীলাপাথরের মতন নীল!
আজকে কী ঝকমকে দিন! বেশ গরম হবে দুপুরটা। আমার চিকনবেলার দেশে এমন দিন আসতো শুধু শরতের সকালে, কাশফুল দোলা ভরা মাঠের উপর দিয়ে ভেসে আসতো ঢাকের বোল-ঢ্যাম কুড়কুড় বাদ বাজে ঢাকে পড়লো কাঠি/যা দিবি মা তাই হবে আজ পরমান্নের বাটি..... কে বলতো এই ছড়া? কোথায় পড়েছিলাম ?
সূর্যের উপর মেঘ ভেসে এসে হাল্কা ছায়া পড়ে, আমার আধো স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ভেসে আসে তার মুখ। চিলেকোঠার পাশে ছাদের উপরে আমরা দুটিতে খেলছি-পুজোর ছুটির প্রথম দিন-এমনই ছায়া পড়ে এলো আমাদের উপরে, ওর মুখ মেঘলা হয়ে গেলো-যা:,বৃষ্টি হবে নাকি রে সুমী?ও শরতের দিনে বৃষ্টি ভালোবাসতো না একদম। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি হেসে উঠলাম-না:, এতো আবছায়া! জোর হাওয়ায় মেঘ উড়ে গেল, আমাদের মুখে আবার আলো! সে কবেকার পুজোর ছুটির কথা? মনে হয় যেন এই সেদিন!
লাউমাচায় ফুল ফুটেছে। আমরা নরম নরম লাউপাতা তুলছি, মা বলেছে তুলতে, কিজানি রাঁধতে লাগবে। মাচায় একপাশে ডালপালায় লুকানো একটা ছোট্টো বাসা। কী পাখির বাসা রে? টুনটুনির নাকি? আরেকটু কাছে গিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি চকচকে পুঁতির মতন চোখ মেলে আমাদের দেখছে মা-পাখি। আমরা সরে আসি, ওদের ভয় পাইয়ে দেবো কেন শুধু শুধু? কবের কথা? বহুদিন হয়ে গেলো?তারপরে কি সবুজহলুদনীললাল সেইসব ওম-ওম দিনগুলো চলে গেলো ওই উড়ে যাওয়া মেঘেদের মতন? এ কোথায় আমি? এখানে কি আমার থাকার কথা ছিলো?
লাল হয়ে যাওয়া ওর শার্ট, চোখ বন্ধ! চুলগুলোতে ওই লাল জমাট বেঁধে গেছে। না না না, আমি মনে করতে চাই না। তবু ভুলে যাওয়া সন্ধ্যার আকাশে একটা কাটা ঘুড়ি ভেসে যায়, আস্তে আস্তে আরো আরো দূরে, ওই অনেক দূরের সাঁঝতারার দিকে। আমিও আসছি শরণ্য, ফাঁকি দিয়ে কতদূরে যাবি তুই?দেখি, কখন ধরতে পারি।
চোখ মেলি, একঝাঁক সমুদ্রপাখি উড়ছে, ঢেউয়ের উপরে উপরে। একবার এক সমুদ্রতীরের শহরে দেখেছিলাম দলবেঁধে ওড়ার সময় ওরা কেমন প্যাটার্ন তৈরী করে। অজস্র পাখি ঝাঁক বেধে উড়ছে-কখনো গোল ছাতার মতন হয়ে যাচ্ছে, কখনো মস্ত বাটির মতন, কখনো অচেনা কোনো আকার! সেইবা কবেকার কথা?
পায়ের কাছে গড়িয়ে আসে একটা লাল বল, কার বল? হাতে তুলে নিয়ে তাকাই এদিক ওদিক, একটা ছোট্টো মেয়ে,কুঁচি দেওয়া ফ্রকের ঝালর উড়ছে হাওয়ায়, দৌড়ে এসে সে আমার কাছে দাঁড়ায়, বলটা চায়, বলটা ওর। পুতুল-পুতুল মুখের মেয়েটা, মাথার ঝামর-ঝামর বাদামী চুলে লালনীল পুঁতির সাজ। ওর দিকে বলটা বাড়িয়ে দিই, জিজ্ঞেস করি, "তোমার নাম কী?" সে বলে,"রিমা।" গলা শুনে কাকে যেন মনে পড়ে। বল নিয়ে চলে যাবার আগে সে বলে সে মায়ের সঙ্গে এখানে এসেছে, ওই কটেজে আছে। সুন্দর একটা ঝিনুকের খোলা সে দেখায় আমায়, কুড়িয়ে পেয়েছে।
মাত্র এই মাসটাই বাইরে আসার অবস্থা থাকবে, পরের মাসে কী হয় কেজানে। তাই প্রত্যেকটা দিনকে নিংড়ে নিতে চাই সবটুকু আলো, হাওয়া,জল, আগুন সমেত। ওই আকাশের নীলটুকু মায়া-অঞ্জনের মতন পরে নিতে পারলে কেমন হতো? আহা জীবন, জীবন, জীবন-কী মধুর এই বেঁচে থাকার স্বল্প সময়টুকু! আহা শরণ্য , আমি স্বার্থপর, তোর সময় আরো কত কম ছিলো! তুই কি জানতে পেরেছিলি?তাই অমন সবসময়ে অস্থির হয়ে থাকতিস? আর দেরি নেই, আমাকে নিয়ে যাবে যে জাহাজ, তার পাল ও দেখা দিয়েছে দিগন্তরেখার উপরে। এসো, এসো, তাড়াতাড়ি এসো।
আহা শরণ্য, তুই এখনো সেই কিশোরটিই তো আছিস, আমার চুলে ধূসরতা, আমার মুখে সময়ের কাটাকুটি! সব খসে যাবে, আর সময় আমাকে ধরতে পারবে না। সাগরবেলায় ঢেউ আসে ঢেউ যায়। অবিস্মরণীয় সূক্ষ কারুকাজ বুনে যায় বালিতে-কে বা তাদের দ্যাখে? হয়তো কেউ দ্যাখে!
একলা ঘুড়িটা ভেসে যাচ্ছে সন্ধ্যাতারার দিকে, নিচে কত শত শঙ্খ বেজে উঠেছে, শঙ্খধ্বনি ঘরে ডেকে বলছে-" ফেরার সাথীর সঙ্গ নে।" হ্যাঁ, আসছি,আসছি তো! এই তো এলাম বলে। আর একটুখানি শুধু। "হে মোর সন্ধ্যা, যাহা কিছু ছিলো সাথে/রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি/আঁধারের সাথী, তোমার করুণ হাতে/ বাঁধিয়া দিলেম আমার হাতের রাখী।"
(শেষ)
Sunday, May 25, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment