Thursday, May 22, 2014

পালিয়ে যাবার মাঠ

ছোটোবেলা ভাবতাম একদিন পঞ্চাশ টাকা চুরি করে পালিয়ে যাবো। তখন এই সাত-আট বছর বয়স আমার, কেন জানি কেবলই বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করতো। বাড়ীতে সেরকম যে কোনো ঝামেলা ছিল বা অত্যাচার টত্যাচার হতো, তা কিন্তু না। তবু কেবলই মনে হতো পালানোর কথা। হয়তো মনে হতো বাইরে অনেক মজা, অনেক স্বাধীনতা। কোনো নিয়মের বাঁধাবাধি নাই, পদে পদে নানা নিষেধ নাই, শাসন টাসন নাই। কিংবা হয়তো অন্য কিছু ভাবতাম, আজ আর সেইসব মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে পালিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষাটাকে ।

ভাবা যায়, মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বাকী জীবন নির্বাহ হয়ে যাবে ভেবেছিলাম ছোটোবেলা ! যেন শের শাহের আমল! তবে আমাদের ছোটোবেলা জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল, দশ পয়সা কি কুড়ি পয়সাতে বেশ অনেকটা চানাচুর কি বেশ কয়েকটা লজেন্স পাওয়া যেত। একটা সিঙ্গারার দাম ছিল পঁচিশ পয়সা। দুই টাকায় এক বাক্স সন্দেশ মিলতো। একটা ডিমের দাম ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ পয়সা। চড়ুইভাতি করার সময় নিজেদের বাজার করতে হতো কিনা, সেইজন্য জানতাম। তাই হয়তো ভেবেছিলাম, পঞ্চাশটাকা! বাপরে সে যে অনেক টাকা। বাকী জীবন হেসে খেলে কেটে যাবে।

কোথায় থাকবো সেও ঠিক করে রেখেছিলাম, দেখতাম রাস্তা তৈরীর কাজ করতে আসতো লোকেরা, তারা থাকতো বাঁশবাগানের কাছে অস্থায়ী কুটিরে। ইস্কুলে আসতে যেতে ওদের নির্জনে ঐসব কুটিরগুলো দেখে কলপনাপ্রবণ হয়ে উঠতাম। কল্পনায় দেখতে পেতাম অনেক দূরের কোনো জায়্গায় ওরকম ঘরে থাকবো, রাস্তা তৈরীর কাজের শেষে ওরা যখন ফিরবে তখন ওদের সঙ্গে বসে সন্ধ্যেবেলা আগুন-ঝাল তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাবো। ওরকম তরকারি নাকি ওরা রান্না করে কার কাছে যেন শুনেছিলাম।

কিন্তু তখন পঞ্চাশ টাকা মানে আমাদের কাছে ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। অত টাকা কীভাবে চুরি করবো, খেপে খেপে চুরি করে করে একজায়্গায় জমাবো কিনা, জমানোর মাঝরাস্তায় ধরা পড়ে গেলে কী হবে এইসব জটিল চিন্তায় আর এগোলো না ঐ চুরি প্রোজেক্ট।

নেহাৎ ঘটলো না, নাহলে তখন আমার মধ্যে বেশ কাব্যভাবনাও ছিল। ঐ যে বাঁশবাগানের কাছে কুটির, ওখানে তো দুপুরে কেউ থাকে না, কাজ করতে চলে যায় সবাই। দূরের দেশে ওরকম নির্জন কুটিরে যখন থাকবো তখন কবিতা লিখব, এইও ভেবে রেখেছিলাম। মধুর দখিনা হাওয়া বইবে, বাঁশবনে সরসর করে আওয়াজ হবে, একটা সবুজ মাঠের ধারে গিয়ে বসবো আমগাছের ছায়ায়। আকাশটা হবে চমৎকার নীল, একটা একলা চিল চক্কর কাটবে, সেখানে স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে কবিতা লিখবো, "আকাশে চিল/ বাতাসে নীল/ রোদ ঝিলমিল/ রোদ ঝিলমিল।"

কেন জানি সাজানোর একটা চাকরির কথাও ভাবতাম। পাড়া থেকে একটু দূরে এক খুব বড়োলোকের বাড়ী ছিল, সেইকালেই দোতলা। সেই বাড়ীতে একটা ছোটো মেয়ে ছিল, আমার থেকে এই বছর দুই কি তিন এর ছোটো। ওকে কখনো বাইরে দেখিনি, খেলতে বা স্থানীয় স্কুলে যেতে। ও দূরের কনভেন্ট স্কুলে পড়তে চলে যেত গাড়ী করে। ভেবেছিলাম বাড়ী থেকে পালিয়ে কিছুদিন ওকে সাজানোর চাকরি নেবো। ওরা অত বড়লোক যখন, নিশ্চয় মেয়েকে সাজানোর জন্য লোক রাখে! মুখে ক্রীম মাখিয়ে দিতে, চোখে কাজল দিতে, রুজ টুজ দিতে! চুলে ফিতে টিতে লাগিয়ে দিতে। কেন যে ঐ কাজ কল্পনা করতাম কেজানে, হয়তো অন্যান্য সম্ভাব্য সব কায়িক পরিশ্রমের কাজের মধ্যে ওটাই সবচেয়ে কম ঝামেলার আর বেশ শৌখীন শৌখীন, তাই।

তবে না চুরি করেও পঞ্চাশ টাকা পাবার একটা উপায় আমার এক বন্ধুর ছিল, ওর জন্মদিন হতো বেশ নিয়ম মেনে। সেখানে পরিচিত কাকা বা মামাস্থানীয়রা দেখতাম নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। ওঁরা ওকে গিফট দিতেন, দশ টাকা কিংবা কুড়ি টাকা এরকম। ভাবতাম, আহা, ওর তো এগুলো জমিয়েই পঞ্চাশ টাকা হয়ে যাবে, নিজের টাকা নিয়েই এবারে ও পালাতে পারবে। কিন্তু ও পালাতো না।

তারপরে সেই বন্ধুই একদিন আমাকে চাঁদমামার কথা বললো। ছোটোদের পত্রিকা। সেখানে দুটো ছবি থাকে, সেই ছবি দুটোর জন্য অন্ত্যমিলওয়ালা দুটো লাইন লিখে পাঠিয়ে দিলেই ওরা নাকি পঞ্চাশ টাকা প্রাইজ দেয়। কিন্তু ও আর এটা বলে নি যে সেটা একটা কম্পিটিশান, তাতে জিতলে তবে দেবে। এদিকে খাম লাগবে, স্ট্যাম্প লাগবে, ঠিক করে ঠিকানা লিখতে হবে, ভিতরে কাগজে ঐ লাইন দুটোর সঙ্গে আরো নানাবিধ ইনফো দিতে হবে---এইসব হ্যাপায় পড়ে আর পাঠানো হলো না। তাছাড়া ওরা পঞ্চাশ টাকা দিলেও তো সেটা বাড়ীর লোকে জেনে ফেলবে।

এইভাবে নানাবিধ চৌর ও অচৌর সম্ভাব্য পঞ্চাশ টাকা চারিপাশ দিয়ে ভেসে গেল, কিন্তু ঐ নিষিদ্ধ ফল আর আমার দাঁতের নাগালে এলো না। তারপরে কবে যেন মনের অনেক অনেক পরতের তলায় চাপা পড়ে গেল পালিয়ে যাবার সেই বাসনা। কঠোর বাস্তব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। ডাইনে বাঁয়ে নানারকম লড়াই লড়তে লড়তে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল।

পরত পরত স্মৃতি সরিয়ে দেখি পালিয়ে যাবার সেই মাঠখানা আজও খুঁজছি।

No comments: