ধূপছায়া রঙের পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ায় সে। তাই ওকে স্পষ্ট করে দেখতে পাই নি কোনোদিন। শুধু ওর সজল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে অস্তসূর্যের আলোয়। মুখের বাকীটা ভালো করে বোঝা যায় না। কেন জানি মনে হয় ওর অল্প-স্ফীত ঠোঁটে, এলোমেলো হাওয়াওড়া চুলে, করুণ হাতের ছন্দে অচেনা অভিমানের আভাস থাকে। কেজানে! বোঝা যায় না ভালো করে কিছুই। ও যে কে, তাও বুঝতে পারিনা।
দূর দিগন্তে হীরকধূলি ওড়ে, অস্ত-আভায় জ্বলজ্বল করে উঠে ডুবে যায় নীল বনরেখায়। ধূপছায়া পর্দার ওপারেও নামে আঁধারের নীলধারা। ওর চেহারা মিলিয়ে যায় ঝিল্লীর রাত্রিস্বরে। ও তো কথা বলে না, তাই বুঝি না কেন আসে, কী বলতে চায়! নীরবতার কারুণ্য দিয়ে গড়া হিরন্ময় ভাষা ভুলে গেছি সেই কবে!
আমাদের একখানি বাড়ী ছিলো, বড়ো ভালোবাসার বাড়ী। তিলতিল করে গড়ে উঠতে দেখেছিলাম তাকে। বাড়ীটায় ছিলো এক খোলা বারান্দা। বারান্দা ঘিরে ছিলো কনকচাঁপা, শিউলি, দোপাটি, টগর, বকুল, মাধবীলতা, জুঁই, বেলী, চামেলীরা । সারাবছর জুড়ে ঘুরে ঘুরে গানের আসর বসতো সেই বারান্দায়। সুখের গান দুখের গান উঠতো ভালোবাসার মানুষগুলির হৃদয় থেকে। বাড়ী ঘিরে ছিলো অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে ফল আর ফুলের গাছেরা বেড়ে উঠেছিলো নিজেদের মতন। বাড়ীর বড়দাদা কইতেন ফুলের কেয়ারী, লতার বাহারী দেওয়া সাজানো বাগান কৃত্রিম, তারচেয়ে গাছেরা বেড়ে উঠুক এমনি এমনি, পাখিরা উড়ে আসুক, উড়ে যাক। কথাটা সবার ভারী মনে ধরেছিলো।
তারপরে সময়ের ধারা বয়ে গেলো, দেখতে দেখতে কত চেনা অচেনা হয়ে গেল, কত পর হলো আপন, কত আপন সরে গেলো দূরে। বাড়ী ও বদলে গেলো কত! নিজের মতন বেড়ে ওঠা বাগানটাও বদলে গেলো। ক্ষুরের মতন ধারালো হাওয়া খসিয়ে দিলো কত নতুন ফোটা ফুলের পাপড়ি! বৃথা রক্তঝরানো যুদ্ধে হারিয়ে গেলো কত কাছেরজন। কত চেনামুখ একে একে হারিয়ে গেলো সেই হৃদয়নিংড়ানো সঙ্গীতসভা থেকে। অনেক বেদনাপ্রহর পার হয়ে একদিন আমারও পালা এলো, চলে যাবার পালা। একাকী স্টেশনে গিয়ে বিদায়ের ট্রেনে উঠে বসলাম। আর কি দেখা হবে? আর কি ফেরা হবে? এতদিনের এত টান কি সব মিথ্যা ছিলো? নাহলে কিছুই রইলো না কেন? সব ভোজবাজির মতন মিলিয়ে গেলো? নাকি মেলায় নি? কোথাও রয়ে গেছে গোপণে?
এলোমেলো ভাবনা জড়িয়ে যাচ্ছিলো রেশমী সুতার গোছার মতন। আশা-নিরাশার দোলা। কখনো জানালা আয়না হয়ে যায়, সরোবরতীরে নুয়ে পড়া মায়াবী নার্গিস ফুল দুলে ওঠে আয়নায়। চমকে উঠে মুখ ঢাকি--না না না না, এভাবে প্রতারিত কোরো না। আবার দেখি জানালা ফিরে এসেছে, বাইরে দূর দিগন্ত। কেউ সাথে নেই বলে মনে করেছিলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চললো সেই ধূপছায়ালীন অভিমানী। কে সে? কেন তাকে চিনতে পারি না?
"মৃদু বৃষ্টির ভিতর দিয়ে
এগিয়ে চলেছে পথ পাহাড় উপত্যকা-
পিছনে গতজন্মের বাড়ী কখন ঝাপসা হয়ে গেছে।
কোন্ দূর সন্ধ্যানামা মাঠে,
এলোমেলো জলরঙ মেখে-
দাঁড়িয়ে আছে হয়তো বা!
কেজানে!
অবিশ্রান্ত লবণাক্ত বৃষ্টি -
আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে,
দূরের আশ্চর্য সূর্যাস্ত দেখতে দেয় না।
ক্রমে অন্ধকারে ঢেকে যায় বিশ্বচরাচর
এখন শুধু চাকার একঘেয়ে আওয়াজ-
রক্তস্পন্দিত হৃৎপিন্ডের শব্দের মতন
ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ ....
জানালা দিয়ে বাইরে চোখ ফেলি
বৃষ্টিমেঘজল কখন পিছনে চলে গেছে
নি:সীম কালো আকাশে জ্বলছে
অগণন নক্ষত্রের অফুরাণ বিস্ময়।
তারাদের পাশ দিয়ে
উড়ে যেতে দেখি সেই পাখিকে-
ছায়াপথের হৃদয়ের দিকে উড়ে যায়
সেই শুভ্রডানার অলীক পাখি।
যেতে যেতে একবার ফিরে তাকায়।
আবার বৃষ্টি নামে ঝরঝর-
এবারে ভিতরের আকাশে।
***
Sunday, May 25, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment