Saturday, April 5, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৬)

তখন আমরা নতুন উঠেছি ক্লাস নাইনে। তখন রাজ্যের শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষাবর্ষ একটু বদলে গেছে, বার্ষিক পরীক্ষা আর নভেম্বরে হয় না, হয় মার্চ-এপ্রিলে, রেজাল্ট বেরোয় মে মাসে। তারপরে নতুন ক্লাসে ওঠা।

ভরা গরমের দিনে নতুন ক্লাস, আগেকার দিনের সেই জানুয়ারীর নরম শীতে নতুন ক্লাসে ওঠার মজা আর নেই। নতুন ক্লাসে কিছুদিন পড়াশোনা হয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লো। ছুটি ফুরালে যখন স্কুল খুললো তখন ক্লাসে এসে দেখা গেল বোর্ডে বড় বড় করে লেখা "গবিস্‌"।

গবিস্‌!!!! এর মানে কী? কে লিখলো এটা? এটা কি বাংলাভাষার কোনো শব্দ? আমাদের রসিক বন্ধু শ্রীতমা বললো এটা হলো গবেটের বহুবচন। সম্মিলিত হাসাহাসির পরে দ্রুত ঝোলানো বোর্ডটা উল্টে দেওয়া হলো। বোর্ডের পিছনের দিকে গবিস রয়ে গেল, সামনের দিকে দিদিমণিদের বোর্ডওয়ার্ক (অথবা কখনো ছাত্রীদের বোর্ডওয়ার্ক) চলতে থাকলো।

ক্লাস নাইন ছিল আমাদের বহু-আকাঙ্ক্ষিত ক্লাস, কারণ ঐ ক্লাসে ক্লাস-টিচার ছিলেন বনবাণীদি। এই দিদিমণির কাছে পড়ার জন্য আমরা অল্পবিস্তর সকলেই আগ্রহী ছিলাম। বনবাণীদি ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী আর বাংলাসাহিত্যের নানাদিকে বেশ ভালোরকম পড়াশোনা ছিল ওঁর। পড়াতেনও চমৎকার। শুধু ক্লাস নাইনেই তো না, ক্লাস সিক্সে যখন প্রথম ইংরেজী পড়া শুরু হলো আমাদের, সেই ক্লাসেও বনবাণীদি ইংরেজীর ক্লাস নিতেন আমাদের সেকশনে।

আমাদের সময়ে রাজ্যের শিক্ষানীতি অনুসারে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজীর কোনো পাট ছিল না সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বাংলামাধ্যমের স্কুলে স্কুলে। অবশ্য অনেক ইংরেজী-মাধ্যম প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল ছিল, সেখানে যারা পড়েছে তারা ইংরেজীতেই পড়েছে বটে। কিন্তু সে আবার ছিল আরেক মেরু। সেখানে সব বিষয়ই ইংরেজীতে পড়ানো হতো, শুধু বাংলার একটা ক্লাসে বাংলা। এ থেকে যারা পরে এসে সেকেন্ডারি স্কুলে ঢুকলো তাদের মানসিক অবস্থা কী হলো সে আমরাই বা বুঝবো কী করে?

আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের, তারা প্রথম ইংরেজী বই পেলাম ক্লাস সিক্সে, বইয়ের নাম লার্নিং ইংলিশ। কিন্ডারগার্টেনে শেষ ইংরেজী পড়ে আসার পরে এই প্রথম। কী অদ্ভুত প্রহসনের মতন ব্যাপার! এই লার্নিং ইংলিশ বইয়ে গ্রামার টামার কিছুই ছিল না, কিছু কিছু ইংরেজী গল্পের অংশ আর কথোপকথন এইসব ছিল। বহুলোকে খুব খাপ্পা হয়ে গেছিলেন, এইভাবে আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে বলে। ঐ বইকে তারা বলতেন বার্নিং ইংলিশ। এইভাবে আমরা কিছুতেই ঐ নতুন ভাষা শিখতে পারবো না ভালো করে লিখতে পারবো না-এই আশংকা ছিল। আশংকার কারণ ও ছিল, সত্যিই আমাদের ইংরেজী তেমন কিছুই শেখা হচ্ছিল না। আসলে যে পদ্ধতিতে শেখানোর কথা ছিল, সেটা অনুসরণ করা হচ্ছিল না প্রায় কোথাওই। শিক্ষিকারা সবাই আগের ব্যাকরণ-নির্ভর ভাষাশিক্ষার আমলের মানুষ, তাই এই নতুন পদ্ধতি তাঁদেরও বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছিল না।

আসলে ঐ বইয়ের নেপথ্যে ধারণা ছিল সরাসরি কথা শোনা আর বলার মধ্য দিয়ে ভাষাটা শেখা, শুকনো ব্যাকরণ পড়ে পড়ে নয়, বা শুধু লিখিত গদ্য পড়ে পড়ে নয়। ক্লাস সিক্সেই এটা আমাদের বনবাণীদি বুঝিয়েছিলেন, ক্লাসে ছোটো ছোটো গ্রুপ তৈরী করে ইংরেজী বলানোর চেষ্টাও উনি করিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি আর ঐ সৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয় নি। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা আর পরীক্ষার তাড়নার মধ্যে সমস্ত নতুন ধরণের চেষ্টাই বন্যায় ভেসে যায়।

তাই নাইনে উঠে আমরা দেখতে পাই ঐ নোট নিয়ে নিয়ে মুখস্থ করা টাইপ জিনিসই চলছে, এমনকি গোটা রচনা অবধি মুখস্থ করানোর ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে। নিজে নিজে কিছু লেখার চেষ্টা একেবারে নো নো। কারণ ঐ করতে গিয়ে যদি নম্বর কম হয় মাধ্যমিকে? তখন তো টিউটরদের ঘাড়ে দোষ পড়বে।

ক্লাস নাইন থেকেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে যাওয়া প্রায় মাস্ট হয়ে গেল, অন্য বিষয়ে না হলেও ইংরেজী আর অংকের জন্য প্রায় স্বতঃসিদ্ধের মতন হয়ে গেল। অনেকে স্কুল ছুটির পরে স্কুল থেকেই সোজা প্রাইভেট পড়তে চলে যেত দল বেঁধে। কাছাকাছি বাংলা বয়েজ স্কুলের একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানো ছিল খুবই বিখ্যাত, তাঁর নোট আর সাজেশন নাকি একেবারে মোক্ষম, তাই বহু ছেলেমেয়ে ওঁর কাছে পড়তে যেত।

"অন্বেষা, তোর মনে আছে সেই বিকেলের ব্যাচে আমাদের ঐ বায়োলজি স্যর এর কাছে পড়তে যাওয়ার কথা? তুই অবশ্য ওঁর কাছে পড়তিস না। তেমাথা মোড়ে তুই সাইকেল চালিয়ে তোর বাড়ীর দিকে চলে যেতিস আর আমরা সব ঐ স্যরের বাড়ীর দিকে।" আমি পকোড়ায় কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে বলি।

অন্বেষার ওখানে সেদিনের গেট-টুগেদারের পরে আবার এই দেখা, আজ অবশ্য আমি একাই। পুরানো স্কুলের জন্য সেই ফান্ড রেইজিং এর ব্যাপারটা আর খুব বেশী এগোয় নি এখন অবধি। তবে ভবিষ্যতে হতেও পারে, আশা ছাড়া কখনোই উচিত না।

আজকে সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে এমনিই দেখা করতে নেমন্তন্ন করেছিল অন্বেষা। আসলে সামনেই আমাদের একটা ছোটো ট্রিপ নেবার পরিকল্পনা আছে কিনা! ওর বানানো পকোড়া আর গরম চা খেতে খেতে গল্প করতে করতে অবধারিতভাবে উঠেছে স্কুলবেলার কথা, দুইজনেই আবার ডুবে গেছি স্মৃতিচারণে। পরদিন আর তারপরদিনও ছুটি, আজ অনেক রাত অবধি আড্ডা দিলেও ক্ষতি নেই। সেই কলেজের দিনগুলোর আড্ডাস্মৃতি মনে পড়ে, অবশ্য তখন অন্বেষাকে পাই নি।

অন্বেষা এখনো আগের মতনই আছে প্রায়, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, কিশোরীর মতন মুখ। ওর কথা যখন শুনি, তখন সেই ইস্কুলবেলার কন্ঠস্বর মনে পড়ে। অন্বেষা বলছিল, "মুখস্থ করে করে রচনা লেখার ব্যাপার বিপজ্জনক, কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভয়ের ব্যাপার কোন্‌টা জানিস তুলি? ঐ মুখস্থ করার যে সংস্কৃতিটা তৈরী হয়ে গিয়েছিল, সেটা গ্রাস করে ফেলেছিলো আমাদের ভাষাশিক্ষা আর সাহিত্যকেই শুধু না, গ্রাস করে ফেলেছিল গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ণ, জীববিজ্ঞানকেও। অথচ এইসব বিষয়গুলো হলো বিজ্ঞান, যাচাই করে দেখার বিদ্যা, চিন্তাকে মুক্ত করতে শেখার বিদ্যা, নতুন প্রশ্ন করতে শেখার বিদ্যা। বইয়ে যা পড়লাম সেসব সত্যি সত্যি হয় কিনা তা যাচিয়ে বাজিয়ে দেখার বিদ্যা। এটাই ছিল না আমাদের কোথাও। গোটা সমাজে এক অদ্ভুত বাধ্যতার সংস্কৃতি-মেনে নাও মেনে নাও,প্রশ্ন নয়, কোনো প্রশ্ন নয়।" অথচ তাহলে তো এইগুলো শেখার কোনো অর্থই আর থাকে না! তোতাপাখির মতন বুলি তুলে যাওয়া শুধু!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও হেসে ফেলি, বলি, "তুই আগের মতই আছিস।আগেও এইসব আদর্শবাদী কথাবার্তা বলতিস আর বাকীসব বুদ্ধিমতী চৌকোশ মেয়েরা রেগে যেত শুনে। ওরা বলতো অত যাচাই বাছই করে দেখে কোন ডঙ্কাটা বাজবে আমার কেরিয়ারে? আরে বাবা মুখস্থ করে উগরে দিয়ে যদি কোনোক্রমে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বেড়াটা টপকাতে পারি, তাহলেই কাফি। একবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে গেলে মার দিয়া কেল্লা, ও একেবারে শিওর শট লাইন। ক্যাম্পাস থেকেই রিক্রুট করে নিয়ে যায় বড়ো বড়ো কোম্পানি। তারপরেই লাখ বেলাখ মাইনে। "

অন্বেষা হাসতে থাকে, বলে, "ঐ লাখ বেলাখই ছিল মূল আকর্ষণ। কী কাজ যে করতে হবে, কী ধরণের স্কিল যে শিখতে হবে, সেই ব্যাপারে কারুর তেমন হেলদোল দেখিনি, যেন সেটা নিতান্ত বাইরের ব্যাপার। যেন কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা বা নতুন কিছু উদ্ভাবন সব করবে "অন্য কেউ বা কারা" আর আমরা শুধু লাখ বেলাখ কামাবো। এরকম হয় কখনো? হয়েছে জগতের কোথাও? "

আমি নিমতেতো মুখে বলি, "সেই লাখ বেলাখ প্রত্যাশিনীরা এখন অনেকেই গৃহবধূ, এখন অবশ্য নতুন শব্দ আছে একটা এর জন্য, "হোম মেকার ", ওদের স্বামীরা চাকরি করে, ওরা সংসার সামলায়, বাচ্চা মানুষ করে। আমাদের মা কাকীমা বা তারও আগের ঠাকুমাদিদিমাদের আমলের থেকে তাহলে কোথায়ই বা তেমন তফাৎ হলো?"

অন্বেষা বলে, " অনেকে তো রীতিমতন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়েছিল, চাকরি শুরুও করেছিল। তারপরে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা নাকি চান না। আর ব্যস, অমনি ওরাও ছেড়ে দিল। অবাক লাগে! তাহলে এতকিছুর কী প্রয়োজন ছিল বা? "

আমি বলি, "আর সেইসব প্রমিসিং ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছেলেরাও তো সেই কোনো বড়ো বা ছোটো কোম্পানীর কর্মচারী। তাদের অনেকেই তো শুনি নিজের কাজে নিজেই সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু নিরুপায়, একটা উপার্জনের পথ তো চাই।"

অন্বেষা বলে, "জানিস, অনেকের মধ্যে নানারকম ন্যাচেরাল ট্যালেন্ট ছিল। এই তো আমি যাদের চিনতাম, তাদের মধ্যেই আশিস, সুনন্দা, ঋভু, তাপসী ভালো ছবি আঁকতো, হয়তো আর্ট কলেজে ভর্তি হলে এর সেখানে শাইন করতে পারতো, কাজেও শান্তি পেত। হাজার হোক মানুষ তো শুধু টাকা কামানোর যন্ত্র না, একটা মনের শান্তিও তো চাই। কিন্তু তখন এই পড়াশোনায় ভালো ছেলেমেয়েরা যদি বলে বসতো আর্ট কলেজে ভর্তি হবো, শিল্পী হতে চাই-তাহলে হয়তো বাড়ীতে কুরুক্ষেত্র লঙ্কাকান্ড টাইপ কিছু বেঁধে যেত। মারধোর কান্নাকাটি দরজা বন্ধ করে রেখে দেওয়া, সবই হতে পারতো। ভেবে দ্যাখ, কী প্রচন্ড সামাজিক চাপ ছিল এইসব ছেলেমেয়েদের উপরে। "

আমার মনে পড়ে যায় গৌরব বলে ছেলেটির কথা, আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়তো, পড়াশোনায় ভালো বলে এমন চাপেই তাকে রাখলো তার অভিভাবকরা যে ওর আসল যে আকর্ষণ ছিল সাহিত্য, সেটার কথা কাউকে বলতেই পারলো না ও। এখন মানসিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে, চাকরি ছেড়ে এখন বাড়ীতেই আছে, মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি হলে রিহ্যাবে নিয়ে যান ওর বাবা।

অন্বেষাকে ওর কথা বলতে সে বলে, "আমাদের ঐ এগারো বারো ক্লাসে যখন আমাদের নিজস্বতা, সৃজনশীলতা, মৌলিক ক্ষমতা এগুলোর গুরুত্ব পাবার কথা, ঠিক তখনই ওগুলোকে একটা বিরাট গ্রাইন্ডিং মেশিনে গুঁড়িয়ে দিয়ে বাছা বাছা সব ছেলেপুলেকে ডাক্তারি আর ইনজিনিয়ারিং এর লাইনে জোর করে ঠেলে দিয়ে কী মারাত্মক ক্ষতি যে করেছে সমাজ, সে আর বলার না। তুলনায় যারা সো-কলড মাঝারি মানের ছাত্রছাত্রী ছিল, তারা কেউ কেউ বেঁচে গিয়েছিল ঐ চাপ থেকে। যদিও ওদের অনেকভাবেই আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতো চারপাশের লোকেরা, "ওরে তোর আর কিছু হবে না" বলে বলে, কিন্তু তবু কেউ কেউ সেসব পার হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পেরেছে। আমাদের ক্লাসের সঞ্চিতাকে মনে আছে কি তোর? হয়তো মনে নেই, ও তো একেবারে সাধারণ মানের ছাত্রী ছিল। কিন্তু ও ভালো ছবি আঁকতো, পরে তো আর্ট কলেজে পড়েছে, এখন ওর নিজের আঁকার স্কুল আছে একটা , ছোটো বাচ্চাদের আঁকা শেখায়। নিজেও ছবি আঁকে আগের মতন। নানা জায়গায় নিজের ছবির প্রদর্শনী করে। খুব ভালো লাগে আমার।"

আমার মনে পড়লো সঞ্চিতাকে, কিশোরীবেলার সঞ্চিতা। গোলগাল মুখ, চশমা পরা, ফরসা মেয়েটা চুপ করে বসে থাকতো পিছনের দিকের বেঞ্চিতে। ও ছবি আঁকতো ? কখনো জানতে পারিনি তখন।

(চলবে)

1 comment:

Shuchismita said...

hu`n... pratyasha-r chaap boite boite kromoshoi aaro aaro ku`njo hoye jaoya!!!
notun jinis janar anando nei, achena pothe ha`nTar romancho nei, akaal-bardhakyo gras korte laglo chhele-meyeguloke.