"জানেন, আমার একটা ছেলে ছিল, প্রথম পক্ষের। ওর মা মারা যাবার পর আমি ছাড়া আর কেই বা ছিল ওর? তারপরে বড়লোক ঘরের মেয়ে বিয়ে করি, তখন এই স্ত্রী আর এই পক্ষের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার আগের পক্ষের ঐ অসহায় ছেলেটাকে দেখতো আমাদের এক পুরনো বিশ্বস্ত পরিচারিকা। আমি ঐ ছেলের উপরে কেন যেন রেগে থাকতাম, অকারণে খুব মারতাম। ও চুপচাপ মার খেত, কোনো কোনোদিন রক্তাক্ত হয়ে যেত, ছেড়ে দিলে চলে যেত। কোনোদিন কিছু বলতো না, বেশি লাগলে আস্তে আস্তে কাতরাতো, একদিন আমার পায়ের উপরে মুখ রেখে বলেছিল, "আজকে মেরো না, ছেড়ে দাও, আজকে বড্ড জ্বর।" পায়ের পাতার উপরে ছোঁয়া পেয়েছিলাম বলে বুঝতে পারলাম জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন বুঝতে পারলাম স্রেফ অত্যাচার করছি দুর্বলের উপরে। ওকে দু'হাতে করে তুলে নিয়ে ওর ঘরে পৌঁছে দিলাম, বিছানায় শুইয়ে দিলাম। চিকিৎসার ব্যব্স্থা করলাম। কিন্তু সেরে উঠলো না। বেশী জ্বর সেরে গেল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অসুখ ছিল, দুর্বলতা ছিল, সারলো না। ও বিছানার সঙ্গে মিশে শুয়ে থাকতো, আমি ওর পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। আমায় একদিন কেমন কাতর গলায় বললো, "তোমায় একটা কথা বলি বাবা?" আমি বললাম, "বল্।" আস্তে আস্তে বললো, "আগে কোনোদিন বলতে পারিনি, ভয় লাগতো। আজকে বলি। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, জানো? আগেও বাসতাম। তুমি অত মারতে, কিন্তু তাও আমি তোমায় ভালোবাসতাম। কোনোদিন বলতে পারিনি, তুমি যদি রাগ কর? আজকে বললাম, কিছু মনে করো না।" এই বলে চোখ বুজে অন্যদিকে ফিরলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। কিছুই বলতে পারিনি। শুধু ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়ল, আর সে ঘুম ভাঙলো না। ওর মায়ের কাছে চলে গেল। আমি তারপর সংসার ছেড়ে চলে এসেছি, পথে পথে ঘুরে বেড়াই, ভিক্ষে করে বেড়াই আর এই কাহিনি সবাইকে বলি। আমিও তো ওকে ভালোবাসতাম, বাসি এখনও, আগে বুঝতেই পারিনি। এখন আর ওকে কোথায় পাবো? তাই ভালোবাসা ভরা হৃদয় নিয়ে পথে পথে ঘুরি। একটু প্রার্থনা করবেন যেন সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে।"
অকালবৃদ্ধ ভদ্রলোক কাঁদছিলেন, দেখে কেমন অদ্ভুত মায়ায় আর দুঃখে ভরে গেল মৃন্ময়ীর মনটা। সন্তান হারানোর দুঃখ সে জানে, যদিও প্রকাশ করে না কোথাও।
Tuesday, March 15, 2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment