কত বছর হয়ে গেল, এখন পিছন ফিরে দেখলে মনে হয় যেন গতজন্ম ৷ অথচ সেরকম ততবেশী কি ? হ্যাঁ, আমাদের মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরুনোর দিন৷ তখন না ছিল এত কম্পুটার, না ছিল ইন্টার্নেটের এমন রমরমা ৷ দিদিমণিরা মাস্টারমশায়েরা নিজেরা গিয়ে বড় চটের ব্যাগে ভরে নিয়ে আসতেন ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের কাগজপত্তর ৷ প্রথম দিন শুধু মুখে মুখে জানিয়ে দিতেন, পরের দিন হাতে পাওয়া যেতো ৷
উ:, সে কি টেনশান, সে কি টেনশান ৷ পাড়াগেঁয়ে ইস্কুল হলে হবে কি, মুখে মুখে কাগজে কাগজে রেডিও টিভিতে গরম আবহাওয়া তৈরীর টেকনিক তখনি তৈরী হয়ে গেছিল৷ তাই টেনশান ৷
সেদিন সকাল থেকে যতবার টেনশান হাল্কা করার কোনো গপ্পের বই পড়ার জন্য হাতে নিচ্ছি কেবল খুলে যাচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশফেল৷ সে কি যন্ত্রণা রে বাপু! কেন যে ও বইটাই উঠছে হাতে কে জানে, আর ও পাতাটাই বা খুলছে কেন?
মাধ্যমিকের প্রায় তিনমাস পরে তখন বেরুতো ফল, সেই সময়টায় অনেকেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে হায়ারের জন্য পড়তে লেগে যেতো, বইপত্তরও কেনা হয়ে যেতো৷ আসলে ঐ গপ্পোটা হায়ারের সহায়ক পাঠে পাঠসঙ্কলনে ছিল ৷ বেশ ভালো ভালো ছোটোগল্পের কালেকশান ছিল ঐ বইটা। হায়ার সেকেন্ডারিতে বেশ বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ভালো বাংলা ছোটোগল্প পড়া হয়েছিলো অনেকের ঐ বইটার সৌজন্যে।
তো পাশফেলের গপ্পোটায় ছিল দুইজন বন্ধুর মধ্যে একজন ভালো রেজাল্ট করে অন্যজন পাশ করতে পারে নি৷ ভালো ফলের ছাত্রটির নাম ছিলো নীরেন, ওর বাবা যখন তাকে জানালেন তিনি আর পড়াতে পারবেন না, নীরেন যেন কাজের চেষ্টা করে, এই শুনে নীরেন বিষ খেলো৷ মানেবইয়ে আবার ব্যখ্যা ছিলো নীরেনই আসল বীর, সে জীবনকে আছড়ে ভেঙে জীবনকে ছাপিয়ে গেছে, আহা মধু মধু!!!! কী ব্যাখ্যাই না শোনালেন! এমন আর হয়?
আজকে এই সাদাকালো সাহেবেরা যদি এসব শোনে অবাক হয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে নির্ঘাৎ ! ভাগ্যিস এসব এরা জানে না, মানে বিশেষ তো এসব বাজে খবর আসে না বাইরে, ভালোগুলোই আসে, তাই আসার কথা৷
তো আমরা অকুতোভয়, টেনশানে সেঁকা হলেও, আমাদের সামনে অক্ষয় নীরেন ৷ কমন রুমে সবাই মিলে ছিটিয়ে-ভিটিয়ে বসে আছি, গানের লড়াই চলছে, খবর এলো এক দিদিমণির মেয়ে, সে কলকাতার ইস্কুলে পড়ে, দিদিমণিও কলকাতার, তো সেই মেয়ে ও মাধ্যমিক দিয়েছিলো, সে সাতশো চব্বিশ না কত পেয়েছে, শুনে গান থামিয়ে তিড়িং করে উঠে পড়লো সবাই, চললো দিদিমণির খোঁজে ৷
নাতিদীর্ঘ ফুটফুটে ফর্সা পুতুল-পুতুল গড়নের ছিলেন সেই দিদিমণি, বোর্ডের পাশে চেয়ারে বসে বসে কী অপূর্ব কৌশলে যে তিনি বোর্ডে লিখতেন সেই টেকনিক আজও অজানা৷ তো পরে এগারো-বারোতে ঐ কৌশলের নাম দেয়া হয়েছিলো কৌণিক আক্রমণ, অবলীলায় বসে বসে ছোটো চেহারার উনি বোর্ডের এককোণে কেমিস্ট্রির সমীকরণ ইত্যাদি লিখতেন ৷
তো সেদিন সবাই খুব করে প্রণাম করা হচ্ছে, যেন উনি ওনার মেয়ের ভালো রেজাল্টের পুন্যফল কোনো না কোনোভাবে এই আমাদের খানিকটা টাচ টেকনিকের দ্বারা দিয়ে দিতে পারেন!
তো আরেকটু বেলা গড়ালো, এসে পড়লেন রুবীদি, উনি আর পাঞ্চালীদি একসঙ্গে গিয়ে ব্যাগে পুরে এনেছেন আমাদের জীবন অথবা মৃত্যু ৷ এতখানি ক্ষমতা যে যিনি সেদিন ধরেছিলেন তা কি তিনি নিজেও জানতেন?
আমরা সংশপ্তক বাহিনী, চোখের পাতা না ফেলে চুপ করে থাকি অপেক্ষায়, ঐ টিচার্স রুম থেকে কী সংবাদ আসে, কে থাকবে আর কে থাকবে না ৷ মহাভারত আমাদের জানিয়েছিলো কাকে বলে সংশপ্তক, যুদ্ধে যারা নিজেদের শ্রাদ্ধ করে নিয়ে তারপরে লড়তে যায়, লড়াইয়ের ময়দান থেকে বাড়ী ফিরবে না যারা আর ৷ নিজেদের আমরা তাদের সঙ্গে আইডেনটিফাই করতে পারতাম কি অনায়াসে, না মহাভারত দিয়ে নয়, তার আধুনিক ভার্সন সুইসাইড বম্বারদের দিয়ে ৷ ততদিনে রাজীব হত্যার ঘটনায় সবাই জেনে গেছে কাদের বলে সুইসাইড বম্বার, তার আগেও হয়তো লোকে জানতো ততটা প্রচার পায় নি৷ শান্ত ঠান্ডা নিজকেন্দ্রিক অযথা বড়ো করে দেখানো কম্পিটিশানপ্রবণ জীবনে আসলে যুদ্ধটা যে কোথায় তা কি সত্যি আমরা জানতাম? অথচ কি অনায়াসে ঐসব বুনে গেছিলো আমাদের মনে, প্রত্যেকে কি সাংঘাতিক সমাধান ভেতরে পুরে নিয়ে বেড়াচ্ছিলো! শিক্ষিকারা আমাদের পড়াতেন রবীন্দ্রনাথের এত এত দার্শনিক কথাওলা লেখা, এত সব পজিটিভ আউটলুকওলা নানাধরনের লেখা,অথচ কেমন করে কেজানে আমরা বড়ো হয়ে উঠলাম মরণের মুখে মুখ ঘষাঘষি করে!!!
এক ভারী চটপটে বলিয়ে কইয়ে বন্ধুনী ছিলো, শ্রীতমা ৷ সে তো আরেক বন্ধুনীর পটাশিয়াম সায়ানাইডপ্রিয়তা দেখে এককথায় পরামর্শ দিয়ে দিলো এল টি টি ই তে গিয়ে যোগ দিতে ৷ সে বন্ধুনী তো অবাক, হঠাৎ সেখানে কেন? শ্রীতমা কইলে, "না অন্য কিছুর জন্য না, ওরা ফ্রীতে পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয় !" বোঝো কান্ড!
এই শ্রীতমা যে সে মেয়ে ছিলো না, খুবই চমৎকার মেয়ে ছিলো৷ একেবারে নার্সারী থেকে কী নিটোল গুল দিতে যে পারতো সে না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না৷ শুনে প্রায় মেঝেতে পড়ার উপক্রম হতো৷ বলতো," হ্যাঁ রে তোর মা কি বি এ পাশ? হ্যাঁ শুনে বলতো," জানিস, আমার মা বি এ এমএ আর ল পাশ৷"
বন্ধুবান্ধবসহ আমি চোখ গোল গোল করে," ল পাশ, তোর মা ল পাশ?"
চোখমুখ অত্যন্ত চোখা করে শ্রীতমা," শুধু ল না, সঙ্গে ব আর ধ টাও পড়েছিলো ৷"
ভাবা যায়, তখন আমাদের পাঁচ বছর বয়স!!!!
আরেক বন্ধুনী ছিলো শুভাশ্রী৷ সে গুলটুল দিতো না, সে স্বপ্ন-দেখা দুর্বল মেয়েও ছিলো না, খুব শাণিত বুদ্ধির মেয়ে ছিলো, তেজে জ্বলজ্বলানো চেহারা ছিলো শুভাশ্রীর৷ ওর দিদি আমাদের কয়েক ক্লাস উঁচুতে পড়তো, সেই দিদি পড়াশোনায় দারুণ ভালো, নিঁখুত সুন্দর দেখতেও৷ কোনো কোনো বছর ওর দিদি ফার্স্ট হতো বলে দিদিমণিরা শুভাকে বলতেন, "তোর দিদি ফার্স্ট হয়, তুই হতে পারবি শুভাশ্রী?"
শুভা সতেজে বলতো, "শুভাশ্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে অন্য কারুর তুলনা করতে আসবেন না দিদিমণি, এটা হয় না৷" আমরা তো শুনে থ! দিদিমণিদের সঙ্গে এমন জোরালো তক্ক!
শুভাশ্রীর কথা বলতে গেলে ফুরাবে না কোনোদিন, অথচ মাত্র কয়েকটা বছরের জন্য একসঙ্গে ছিলাম, আরো অল্পদিনের জন্য কাছের বন্ধু ছিলাম৷ তীব্র ব্যক্তিত্ব-জ্বলজ্বল মেয়েটি মাঝে মাঝেই অপ্রিয় বাক্য বলতে পটু ছিলো, তা সত্বেও এত খাঁটি একটা কিছু ছিলো ওর মধ্যে, যে লোকে বন্ধু হয়ে যেতো সহজে, মুগ্ধ হয়ে যেতো সে বন্ধুত্বে৷
শুভাশ্রী আর শ্রীতমা একদম বনতো না, সর্বদা এ ওর লেগ পুল করতো সামান্য ফাঁক পেলেই, সাদামাঠা স্কুলদিন দিব্যি জমে থাকতো নানা চাপানে উতোরে৷প্রথম ফাইভে যখন ও স্কুলে ভর্তি হয়েছি, তখন শুভা আলাদা সেকশানে, আমার বন্ধুরা তখন সম্পূর্ণ আলাদা একটি গ্রুপ, জয়তী, কুহেলী, বিজয়া, মীনাক্ষীরা৷ শুভাশ্রীর সঙ্গে প্রথম দেখা কুইজের আসরে, শীর্ণ দীর্ঘ অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েটির এতই অন্যরকম অ্যাপিয়ারেন্স যে চোখ টেনে নেয়৷
সিক্সে একই সেকশানে চলে এলাম এই সবাই, শুভাশ্রী, শ্রীতমা, কুহেলী, মীনাক্ষী, দীপশিখা, শিবানী, সুগোপা সবাই ৷ আর ছিলো এরা৷ এর নাম নিয়ে দারুণ কনফিউশান, ও যত বলে আরে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের কথা ভেবে নাম রাখা হয়েছে এরা(Era), কে শোনে কার কথা! একে পাতি বাংলা স্কুল, তায় অজ-পাড়াগাঁ, সেখানে এরাই বা কি ঈপোকই বা কি ঈপোক-মেকারই বা কে!
বিভা দিদিমণি অংক করাতে আসতেন, বয়স্ক রাশভারী কিছুটা রাগী গোলগাল চেহারা, দিদাদিদা গোছের দিদিমণি৷ অংকটংকে জট লেগে গেলে দুইঘর দূরে টিচার্সরুমে গিয়ে এণাক্ষী দিদিমণির কাছ থেকে জেনে আসতেন কেমন করে সে জট ছড়ানো যাবে৷ উনি আসলে অংকের লোক নন, উনি সেলাইয়ের ট্রেনিং নিয়ে এসেছিলেন৷ কিন্তু এরোপ্লেনের মিস্ত্রীও যেমন কালের ফেরে এরোপ্লেন চালাতে নেমে পড়ে তেমনি উনিও অংক করাতেন, মাত্র তো ক্লাস সিক্স, এদের সামান্য কটি পাটিগণিত আর জ্যামিতি করাতে আবার কী লাগে, এই ছিলো হয়তো যুক্তি৷
তো একবার ক্লাসের পরীক্ষায় উনি প্রশ্ন দিয়েছেন সূক্ষ্ম কোণের দ্বিবিভাজন, তো পেন্সিল কম্পাস দিয়ে যেভাবে করা হয় সেইভাবে করলাম, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে বড়ো ব্যাসার্ধ নিলাম, অর্ধেকের চেয়ে বড়ো নিতে বলা ছিলো, নিলাম পুরোর চেয়ে বড়ো৷ সূক্ষ্মকোণ দিব্যি হাফাহাফি হলো, কিন্তু উনি মেথডের এই ডেভিয়েশানে অত্যন্ত ব্যথিত ও চিন্তিত হয়ে নম্বর দেবেন কি দেবেন না এই দ্বিধায় জর্জরিত হয়ে টিচার্স রুমে চলে গেলেন৷ খানিক পরে ডেকে পাঠিয়ে কইলেন এণাক্ষী বলেছে ঠিক আছে, বলে নম্বর দিলেন৷ সেদিন কেমন যেন লেগেছিলো কিন্তু পরে অনেক বড়ো বড়ো জায়গাতে বড়ো বড়ো উচ্চপর্যায়ের লোকেদের মধ্যেও এই জিনিস দেখেছি, তাই আজ আর ঐ দিদাদিদা গোছের মানুষটিকে খারাপ লাগে না৷ সামান্য চেনা পথের বাইরে যেতে পোড় খাওয়া লোকেদেরও এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব!
সিক্সে ইংরেজী পড়া শুরু, ভারী উত্তেজনা৷ ইংরিজী যে বাংলার মতই আরেকটা ভাষামাত্র, তা মনে হতো না, এটা যেন খুবই সাংঘাতিক ভয় ভক্তি করার মতন একটা জিনিস, খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার, মোটেই বাংলা ব্যাপার নয়! আরে বাংলা? ছো:? ওতে কোয়ান্টাম পড়া যাবে? স্পেস-টেকনোলোজি আয়ত্ত করা যাবে? কখনো না৷ বন্ধুনীরা ভালো করে বুঝিয়ে দিলো, ইংরেজী একমাত্র ভাষা যা কিনা আমাদের স্পেসে তুলে দেয়৷ টেলিস্কোপ মাইক্রোস্কোপের জটিল পথে আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির দিকে ঠেলে দেয়৷
তখন অজানা থাকায় আমাদের তর্ক উঠতে পারেনা, রুশরা রুশ ভাষাতে স্পেস টেকনোলোজি শিখেই তো স্পেসে চলে গেছিলো? কিংবা তেমন বেয়াড়া হয়তো কেউ ছিলো না যে এই প্রশ্ন করতে পারে৷ কৃপন বর্তমান ও নিরাপত্তার অভাব৷ কিংবা এসব কিছুই না, সত্যিই ইংরেজী ভাষাটাই এমন যা কিনা সত্য ত্রেতা দ্বাপরমে কৈ নেহি কিয়া!
সেই ভাষা আয়ত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা৷ লার্ণিং-ইংলিশ বইয়ে যে চ্যাপ্টারগুলি ছিলো, তা আমাদের খুব বেশী সাহায্য করতে পারে না, এদিকে পুরানো বইয়ের তাকে লালমলাট দেয়া উইয়ে খাওয়া মোটা ইংরেজী আরব্যরজনী৷ এইভাবে শিখতে শিখতে কবে ওটা পড়তে পারবো কে জানে! কী সুন্দর সব ছবি ছিলো! আহা ওদের গল্পও না জানি কত সুন্দর৷
সেসব হয় না, অবশ্যই না, ক্লাসের কাজগুলো উতরেরে দেয়ার জন্য ছাত্রবন্ধু থাকে, নোট থাকে, আমরা লিখতে শিখি না, টুকতে শিখি৷ মানে দেখে টোকা না, সেটা বে-আইনী, কিন্তু মুখস্থ করে পরে মেমোরির থেকে লেখাও একরকম টোকাই তো, না? আমাদের কেউ বলে দেয় না, এটা অনুচিত, বরং বড়ো বড়ো নোট দিয়ে রচনা মুখস্থ করতে উৎসাহিত করা হয়৷ যে যত ভালো পারবে সে তত ভালো! অদ্ভুত এক ব্যবস্থা!
আমরা নতুন ভাষাটা বলতে শিখি না, শুনতে পাইনা, শুধু শিখি দ্রুত পড়তে আর প্রাণপণে টুকতে! অথচ এত কড়াকড়ি হাঁসফাঁস দৌড়ের কোনো প্রয়োজন ছিলো না, বাংলার মতন এটাকেও আমাদের কাছের করে নেওয়া যেতো, এমন কিছু সাংঘাতিক বেশী দামী জিনিসের দরকার ছিলো না, শুধু ইস্কুলের লাইব্রেরীতে দু'চারটে বেশী বই, একটা টেপ আর কিছু ক্যাসেট৷ ছাত্রীরা উৎসাহীই ছিলো, ঐ বারোতেরো বয়স উৎসাহেরই সময়, সদ্য নতুন হাতে পাওয়া খেলনার মত মুচমুচে একটা ভাষা! কিছু বেশ ভালো শিক্ষিকাও ছিলেন, ঐ কাঠামোতেও৷এমন কিছু সাংঘাতিক পয়সার দরকারও ছিলো না, স্কুল ফান্ড থেকেই ও কটা বই আর টেপ হয়ে যেতো, কিন্তু কেউ ভাবেই নি!
তো, ওভাবে পড়ে টুকেই বছর কেটে যেতে যেতে নাইনে সকলেই প্রাইভেটে পড়তে ঢুকে গেলো৷ সেই দিদিমণি বেশ ভালো, যত্ন নিয়ে গ্রামারও পড়াতেন৷ বাড়ীরে বইয়ের পাহাড়৷ পড়তে দিতেনও৷ খুব ভালো সুলিখিত নোট দিতেন, কিন্তু ছাত্রছাত্রী নিজে লিখতে চাইলে দিতেন না, বলতেন রিস্ক তিনি নিতে পারবেন না, নিজে লিখতে গিয়ে যদি ছাত্রের নম্বর কম হয়, তখন?
নম্বর৷ নম্বর৷ সংখ্যা৷ স্কোর৷ মার্কস৷ পরীক্ষায় পাওয়া সংখ্যাবলী৷ এই সংখ্যাগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়, যেন তেন প্রকারেণ একটা ভালো নম্বর যেন ওঠে৷ কে কতটা শিখতে পারলো বা আত্মস্থ করতে পারলো সব গৌণ হয়ে যায়৷ স্কিল কার কত কে জানে, কিন্তু একমাত্র বিচারের উপায় পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর৷ তাই সেটা এতখানি জীবনমরণ তফাৎ গড়ে দেয়৷ যার বাপমায়ের যতটা সাধ্য, সেই অনুযায়ী প্রাইভেট টিউটর, ইংরেজী আর অংকের তো প্রায় কম্পালসারি৷ বাকীগুলোর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য, কারু কারু ইতিহাস ইত্যাদির জন্যেও৷
অথচ মাধ্যমিক স্তরে কিন্তু আমাদের ঐ বাংলা গার্লস ইস্কুলের মধ্যেও বেশ কিছু ভালো সিরিয়াস পড়াশুনো হতো, ভুগোলের এক দিদিমণি ছিলেন যিনি প্রায় হাতে ধরে ম্যাপ চিহ্নিত করা ইত্যাদি শেখাতেন৷ নিয়মিত করাতেন ক্লাসে ও বাড়ীর কাজ দিতেন৷ অংকের এণাক্ষীদি ও তেমনই ভালো শিক্ষিকা, ধরে ধরে সিরিয়াস পড়াতেন৷ জীববিদ্যার রুবীদিও খুব ভালো ছিলেন৷
ভরসা করতে পারলে হয়তো প্রাইভেট টিউটর লাগতো না, কিন্তু ব্রাত্য হয়ে যাবার ভয় থাকতো, ঠিক যেমন দুর্গাপুজায় নতুন জামা না হলে ব্রাত্য হয়ে যেতে হয়! তাছাড়া এইসব বিভিন্ন স্কুল শিক্ষক বা শিক্ষিকা যারা প্রাইভেট টুইশনি করতেন, তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অদৃশ্য পলিটিক্সের খেলা চলতো, কে কার গ্রুপে আছে, এটা অত্যন্ত ইম্পোর্ট্যান্ট ছিলো৷ পরে বহু পরে এইচ এসেরও পরে এটা টের পেয়েছিলাম৷
শুধু এই প্রাইভেট টিউটর আলাদা বলে স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ধীরে পাঁচিল উঠতে থাকে, আমরা মহাদেশ ছিলাম, ছোটো ছোটো দ্বীপে ভাগ হয়ে যেতে থাকি, সেই দ্বীপগুলো ক্রমাগত অসেতুসম্ভব হয়ে পড়তে থাকে৷ তবুও আমরা সেতু গড়ার চেষ্টা রাখি, চেষ্টা রাখি, কখনো কখনো একে অন্যের দ্বীপে পৌঁছতে পারি কোনো অল্প সময়ের জন্য৷
সেই ভাগ হয়ে যাবার শুরু৷ পরে সারাজীবন ধরে ভাগের পর ভাগ, পাঁচিলের পর পাঁচিল পরিখার পর পরিখা৷ কিসের এত যুদ্ধ, কার সঙ্গে যুদ্ধ? কে জানে! আমাদের রক্তকণিকায়ই হয়তো রয়ে গেছে এই ভাঙনপ্রবণতা, হয়তো মিলে থাকতে চাই, তবু কিছুতেই পারি না৷ আজ সেই শুভাশ্রী, শ্রীতমা, দীপান্বিতা, সুগোপা ----কোথায় ? সকলেই নিজ নিজ কক্ষপথে চলতে চলতে পৃথক পৃথক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে৷ কেউ ঘোরতর সংসারী, কেউ চাকরি করছে৷ কেউ নিজ রাজ্যেই কেউ অন্য রাজ্যে বা অন্যদেশে৷ সব স্মৃতি জলের আল্পনার মতো উবে গেছে ৷ গেছে কি?
(চলবে )
Friday, February 7, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
4 comments:
khub bhalo hoyeche...lekhata continue kor..r ekta katha..tor sei subhasree ki amader subha??
Thanks Sumit.
aami parer parbo gulo aaste aaste tulchhi.
satti apurba..ami porchi r amar dingulo mone pore jachhe...ekhanei lekhaker sarthakata...chaliye jaaaa...
shune valo laagchhe Sumit. tor school to nishchay anyorakom, hoyto tobu kichhu kichhu mil paachchhis, kothaao kothaao to kichhu universal jinis thaakei.
Post a Comment