একদিন ফোনে অন্বেষাকে কনট্যাক্ট করি। এত উত্তেজিত যে কথা বলতে বলতে হাঁপাই, "টেঁপি রে, মারাত্মক কান্ড হয়েছে।"
অন্বেষা কিন্তু ধীরস্থিরই থাকে। ভারিক্কী গলায় বলে, "হয়েছেটা কী? আর, কী কুক্ষণেই যে আমার ডাকনামটা বলেছিলাম তোকে। "
আমি আরো বেশী হাঁপিয়ে টাপিয়ে একশা হয়ে বলি, " আরে তোর ডাকনাম তো ভালোই! কিন্তু কী কুক্ষণে না সুক্ষণে যে ইস্কুলবেলা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম! এতদিন কিছু না, না কোনো খোঁজ না কোনো পাত্তা, এই সিরিজ লিখতে শুরু করার পরেই মুখবইয়ে ভুচ্চুর ভাচ্চুর করে ইস্কুলবেলার ডজনখানেক বন্ধু ভেসে উঠেছে।"
"তাতে কী? তুই কি ওদের নামে বানিয়ে বানিয়ে লিখছিলি নাকি? উল্টাপাল্টা কথা?"
"না না তা না। এমনিতেও সব নামটাম বদলানো আছে, ইস্কুলের নামটাও কোথাও বলা নেই। সেসব ঠিক আছে। কিন্তু তবুও তো! যারা জানে তারা তো ধরে ফেলছেই। "
"ফেলুক না, নামযশ হচ্ছে জেনে তারাও আপ্লুত হবে।"
" নামযশ? আহা তা আর তেমন কোথায়? আমি তো কেবল তোর যশের জমিটি নিড়াতেছিলাম চষিতেছিলাম মই দিয়ে কষে ঘষিতেছিলাম---"
"এই এই এই! লেগপুল করতে চাস নাকি? আমিও কিন্তু তাইলে তোর নামে কেস আনবো।"
"আনিস, সে আনিস তোর যদি মন চায়। কিন্তু এই উইকেন্ডে আয়, সকাল সকাল বের হয়ে আমরা হাইকিং এ যাবো। আসবি? "
ও রাজি হলে আমি কানেকশান কেটে দিয়ে এগোতে থাকি টিউলিপের গোছার দিকে, কয়েকটা ফটো তোলা যাক। দুপুরের রোদে লাল ফুলগুলো একদম পুরো ফুটে গেছে, অগণিত বড় বড় চকচকে কালো কালো ভোমরা যাতায়াত করছে ফুলে ফুলে। আহ, বসন্ত পুরোপুরি আসতে আর দেরিই বা কত?
"আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো সকালবেলার মল্লিকা--আমায় চেনো কি? " বসন্ত পথভোলা পথিক, ফাগুনপ্রাতের উতলা চৈত্ররাতের উদাসী।
কবে শুনেছিলাম এ গান সুগোপার গলায়? আমার বেসুরো গলায় গুণ গুণ করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমাদের ক্লাস ফোরের গল্প, আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী! মনে পড়ে দিতিপ্রিয়া আর পিয়ালীকে।
ওরা এই গানের সাথে নাচ করেছিলো সেই ফাংশানে। কবেকার কথা এসব? গতজন্মের? মনে পড়ছে আবীর লাল দিগন্ত, লাল লাল লাল। অত লাল ফুল ছিলো কোন গাছে? পলাশে শিমূলে না কৃষ্ণচূড়ায়?
সপ্তাহান্তে আমরা সত্যিই পাহাড়ে যাই, সঙ্গে দুপুরের খাবার আর জল। অনেকটা উঠে আমরা জিরাতে বসি, সিঙারা আর জল খাই। চারিপাশের ফুটন্ত কিশলয় পুষ্পমঞ্জরী অগণিত মৌমাছি ভোমরা পাখি আর দিব্যলোকের হেমপ্রভ সুরার মতন টলটলে রোদের বসন্তসৌন্দর্য অন্বেষার মতন আধা-ভালকানকেও কাত করে ফেলেছে নইলে হঠাৎ সে কেন বলে, " ক্লাস নাইনে আমাদের সেই অনুষ্ঠান মনে আছে তোর ? চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য ? কণকচম্পা চন্ডালিকা চরিত্রে নেচেছিলো আর দিতিপ্রিয়া আনন্দ? "
আমি হেসে ফেলি, বলি, "মনে থাকবে না? আমাদের উন্মাদিনী স্টেজ রিহার্সালের দিন কী করেছিলেন মনে আছে তোর?"
এবারে ও ও হেসে ফেলে, গলার স্বর পালটে ফেলে বলে, "এই এই "হে ভৈরব শক্তি দাও" গানটা কোথায়? ওটা হচ্ছে না? তা চলবে না, এখুনি তোলো।" কী অবস্থা, শেষ মুহূর্তে এতজন মিলে কোরাস গান তোলা সোজা নাকি! উন্মাদিনীকে বোঝায় কে!"
আমাদের সম্মিলিত হাসিতে চারপাশের পাখিগুলো ফটফট করে উড়ে যায়।
*****
ইস্কুলবেলা লিখতে গিয়ে অনেক পাওয়া হলো আমার, কতকালের পুরানো বন্ধুরা উঠে এলো স্মৃতির জলরাশি সরিয়ে। মুখবইয়ে সত্যি করে উঁকি দিলো ছোটোবেলার বন্ধুরা। কাউকে চিনতাম প্রাইমারি স্কুলে, কাউকে পেয়েছিলাম সেকেন্ডারির বছর ছয়েক কাউকে বা এগারো-বারোতে।
তারপরে সময়ের স্রোতে জীবনের খরধারে কে কোথায় ভেসে গেছি নিজের নিজের কক্ষপথে। সেইসব ধূমকেতুরা যাদের কক্ষপথ অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্তের মতন, যারা একবারই কাছে আসে তারপর চিরকাল দূরে সরে যায়, সেইরকম দেখা হয়েছিলো কতজনের সাথে। আবার কারুর কারুর পথ যেন উপবৃত্তের মতন, ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর পর। লিখতে গিয়ে যেন সময়ের স্রোতে উলটোবাগে নাও বাইছি, মনে পড়ে যাচ্ছে আগের থেকেও আগের কথা।
পাহাড়ে আমাদের সেই পিকনিকে ঘুরে ফিরে ইস্কুলবেলার কথাই আসছিলো শুধু। বারে বারে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো আগে আর পরে। কিছুতেই যেন ফাইভ থেকে টেন এই ছয় বছরের গন্ডীতে তারা থাকবে না, বারে বারে গড়িয়ে যাচ্ছিলো আগের স্কুলে, সেই কেজি-ওয়ান কেজি-টু থেকে শুরু করে ক্লাস ফোর পর্যন্ত যেখানে ছিলাম সে স্কুলে, সেখানেও আমি আর অন্বেষা দু'জনেই ছিলাম কিন্তু তখন ওকে খুব ভালো করে চিনতে পারি নি। তাই সেখানে আমাদের স্মৃতিটুকরোগুলো আলাদা আলাদা।
অন্বেষা বলে কেজি ওয়ানের সেই প্রথম স্পোর্টসের কথা, বিস্কুট দৌড়। সুতোয় বাঁধা বিস্কুট ঝুলছে, দু'পাশ থেকে দিদিমণিরা দোলাচ্ছে আর দু'হাত পিছনে নিয়ে রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় প্রতিযোগীরা কামড়ে বিস্কুট খুলে নেবার জন্য লাফঝাঁপ করছে। আমার নিজের স্মৃতিতে সেই খেলার কিছুই নেই, কিন্তু কল্পনায় দেখতে পাই ঠিকই। শীতের রোদে ঝকঝকানো সবুজ মাঠ, সাদা সবুজ ইউনিফর্ম পরা একঝাঁক উজ্জ্বল শিশু। সত্যি কি আমরাই ছিলাম অমন?
আমার আবার মনে পড়ে কেজি-টু তে সেই ইঞ্জেকশান দেবার দিন। কী একটা ভ্যাকসিন যেন দেওয়া হবে ক্লাসের সব বাচ্চাকে। সবাই ভয়ে জড়োসড়ো আর ধীরস্থির ভারিক্কী চেহারার দীপাবলি দিদিমণি বলছেন, "কিছুই না, সামান্য পিঁপড়ের কামড়ের মতন লাগবে একটু।" এক এক করে বলির পাঁঠার মতন এক একজন এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়াচ্ছে, ওখানে তুলো স্পিরিট আর সিরিঞ্জ নিয়ে এক ভদ্রলোক রেডি আর দীপাবলি দিদিমণি ডানপাশ থেকে নানারকম মজার কথা বলে বলে বেচারা বাচ্চাটির মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষন করছেন। এর কথা অন্বেষার কিছু মনে নেই, কিন্তু তাতে আমাদের উপভোগে অসুবিধে হচ্ছে না, দুজনেই দিব্যি হাসছি।
হাসির ভিতরে হঠাৎ হানা দেয় অন্ধকার, কাহিনি ছড়িয়ে যেতে চায় অন্যদিকে, উৎসবময় মাধ্যমিকের পরেরদিকে। মাতাল কবির মতন তখন আমরা বাকীর খাতায় শূন্য রেখে পুরস্কারের সাকীর হাতে আপাতসাফল্যের সুরা পান করছি। জানি না সামনে কী আছে, সুদেআসলে কী ভয়ানক দাম দিতে হবে।
" টেঁপি, মাধ্যমিকের পরে আমাদের স্কুল বদলানো উচিত ছিলো, তাই না রে? "
এবারে আর ও ডাকনামে ডেকেছি বলে প্রতিবাদ করে না, ওর চোখ দূরে চেয়ে আছে, দেখছে তবু দেখছে না। আস্তে আস্তে যেন অনেক দূর থেকে শব্দ খুঁজে খুঁজে এনে কথা বললো, " টাউনের ভালো স্কুলে কেন তোরা গেলি না? আমার বাড়ীর লোকেরা না হয় আমাকে ডিসকারেজ করলো, সময় নিয়ে নাকি টানাটানি পড়বে অতটা জার্নি করলে, আরো কত হ্যানো হবে ত্যানো হবে, কিন্তু তোরা কেন কেউ গেলি না?"
আমি বলি, "তা কি হয় রে? তুই ছিলি আমাদের দৃষ্টান্ত, তোর মাধ্যমিকের রেজাল্টের জন্য দুইদিন ছুটি দিয়েছিলো স্কুল, সব অভিভাবকেরা তোর উদাহরণই দেখাতো। সেই তুই যখন রয়ে গেলি ওখানেই এগারো-বারোতে, তখন আমরা কেমন করে যাই? "
ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলে, " বাড়ীর লোকের দোহাই দিলেও এতদিন পরে বুঝতে পারি আসলে আমারি দোষ। যে আমি এর আগে সব কিছুতে লড়াই করেছি, সেই আমি কেন ওরা বাড়ী থেকে যা বললো শুনে রয়ে গেলাম? আসলে নতুন জায়গা, নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাইলাম না। বিজয়ের সুরা তারিয়ে তারিয়ে খাবার জন্য রয়ে গেলাম। তার দামও দিতে হলো দু'বছর পরে, ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে। তার পরেও বেহায়ার মতন বেঁচে রইলাম। তখনই ক্লিওপেট্রার শরণ নেওয়া আমার উচিত ছিলো।"
"অন্বেষা!!!" আমি শকড, ওর চোখে জল টলটল করছে। এর আগে আমি ওকে কোনোদিন কোনো অবস্থাতে কাঁদতে দেখিনি।
আমাদের চারপাশে অবারিত বসন্তসৌন্দর্যের মাঝখানে সময়ের ঋণশোধ করতে থাকি আমরা দু'জন। কবেকার- সেই কত বছর আগের আটকে থাকা কান্না, মিলিয়ে যেতে থাকে বাতাসে, কতদূরের এক অচেনা ভূমির করুণাভরা বাতাসে। সূর্যের উপরে উড়ে আসে একখন্ড মেঘ, স্নিগ্ধ ছায়া পড়ে। পৃথিবী তার কোমল হাত বাড়িয়ে আমাদের মনের অন্ধকার ছাড়িয়ে নিতে থাকে।
(চলবে )
Tuesday, February 25, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment