আমাদের স্কুলের এক কিংবদন্তী চরিত্র মণিকুন্তলা মৈত্র। তিনি নাকি বহুকাল আগে ছিলেন প্রধানাশিক্ষিকা। একেবারে শুরুর দিকের কথা সেটা। উনি নাকি স্কুলেই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তাই নিজের সংসার আর করেন নি। স্কুলই তার সংসার, ছাত্রীরাই তার সন্তান। অতি সামান্য অবস্থা থেকে তারই হাতে নাকি বড়ো হয়ে উঠেছিলো স্কুল, নাম ছড়িয়েছিলো চারদিকে, ভালো ভালো শিক্ষিকারা কাজ করতে এসেছিলেন কাছের ও দূরের শহর থেকে।
আশেপাশের মানুষের স্মৃতিতে তখনো উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন মণিকুন্তলা। আমরা তাকে দেখিনি, আমাদের জন্মের আগেই তিনি প্রায়াতা। কত গল্প বলতো লোকে, উনি নাকি সাবধানে ঘুরে ঘুরে দেখতেন কোন ক্লাসে কে কীভাবে পড়াচ্ছেন, এমনভাবে ঘুরে দেখতেন যাতে ছাত্রীরা বা শিক্ষিকা কেউ না বুঝতে পারে। পুরাণের সেই ছদ্মবেশী রাজাদের গল্পের মতন ব্যাপার। পরিদর্শন করে করে সুবিধা অসুবিধা বুঝতেন, নিজের স্কিল ও সাধ্য অনুসারে সমস্যা সমাধান করতেন আর সুবিধাগুলো বাড়িয়ে তুলতেন। কেজানে কতটা গল্প আর কতটা সত্য।
মাঝে মাঝে অবসরে কেন জানি কল্পনা করতে ভালো লাগতো চিরকুমারী এক জ্ঞানতাপসী হালকা পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে তার তপস্যার ভুবন, নিজের হাতে গড়া স্কুল, তার প্রাণের সাথে যোগ এই স্কুলের। শত শত ছাত্রী তার মানসকন্যা। স্থানকালের দূরত্ব কবিতার মতন করে ফেলে তাকে। হয়তো বাস্তবে এরকম কিছুই ছিলো না। তা না থাকুক, তাতে কিছু এসে যায় কি?
আমাদের সময়ে ছিলো যাকে বলে যুদ্ধ। প্রধানাশিক্ষিকা আর উপপ্রধানাশিক্ষিকার লড়াই, ক্ষমতাদখলের লড়াই। ভাবা যায়? ঘটনাচক্রে সেই প্রধানাশিক্ষিকাও ছিলেন অবিবাহিতা, স্কুলে নিবেদিতপ্রাণা। খুব অল্পদিনই আমরা ওনাকে দেখেছি, সকালের সমবেতপ্রার্থনাসঙ্গীতের সময় এসে দাঁড়াতেন নির্দিষ্ট জায়গাটিতে। কমলাপাড় সাদা রেশমী শাড়ী পরা, খুব বিনীত সুন্দর চেহারা। দিদিমণিদের ইউনিফর্ম ছিলো লালপাড় সাদা শাড়ী। কমলা লালের খুব কাছ ঘেষে বলে বুদ্ধিমতী প্রধানাশিক্ষিকা কমলাপাড় সাদা শাড়ী পরতেন। সামাজিকতাও রক্ষা হলো (সে মফস্বলী সমাজের নিয়মে লালপাড় সাদা শাড়ী এয়োস্ত্রীদের জন্য রিজার্ভড) ইউনিফর্মও মেন্টেন করা হলো। ছাত্রীদের ইউনিফর্ম ছিলো নাইন-টেন সবুজপাড় সাদা শাড়ী, ইলেভেন টুয়েলভ নীলপাড় সাদা শাড়ী। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট সবুজ টিউনিক।
ক্লাস ফাইভে কিছুদিন যেতে না যেতেই শুনি প্রধানাশিক্ষিকা খুব অসুস্থ। তারপরে উনি সিক লীভে চলে গেলেন আর তখন উপপ্রধানাশিক্ষিকা দ্রুত হয়ে গেলেন ভারপ্রাপ্তা প্রধানা। এই উপপ্রধানাশিক্ষিকা ভদ্রমহিলাকে সবাই আড়ালে ডাকতো উন্মাদিনী। একেবারে আলুথালু বেশবাশ, যখন তখন চেঁচিয়ে ওঠেন। বেশ উচ্চশিক্ষিতা কিন্তু পাগলাটে। শোনা যেতো উনি নাকি গাছের সঙ্গে অবধি ঝগড়া করেন।
কয়েকমাস এভাবে গেল। তারপরে পুরানো প্রধানাশিক্ষিকা ভালো হয়ে ফিরে এলেন। এদিকে ভারপ্রাপ্তা উন্মাদিনী রেগে চটে ক্ষেপে কুরুক্ষেত্র। এ ভার তিনি নামাবেন না। এ ভার তো যেন তেন নয়, এ এমনই ভার যাহা নামাইয়া রাখিতে ব্যথা বেশী।
তারপরে লেগে যা নারদ নারদ। তার উপরে আবার নানা সূক্ষ্ম লোকাল পলিটিকস ছিলো। এভাবে ওঠা আর নামা করতে করতেই কেটে গেল কয়েক বছর। তারপরে আর টিঁকতে না পেরে প্রধানাশিক্ষিকা চলে গেলেন অন্য স্কুলে শিক্ষিকা হয়ে, কমলাপাড় শাড়ী আর আমরা দেখতে পেলাম না। তখন এই উন্মাদিনীও কিন্তু আর সেই চেয়ারটিতে বসলেন না, অ্যাড দিয়ে অন্য জায়গা থেকে আরেকজনকে এনে প্রধানাশিক্ষিকা করলো স্কুলের ম্যানেজমেন্ট।
আমরা এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠছিলাম, সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছিল, টেকনোলজি বদলে যাচ্ছিলো। সবচেয়ে আগে বড় বড় শহরে। তারপরে সেই বদলের ঝাপটা এসে এসে লাগছিলো আমাদের ঐ গাঁঘেষা মফস্বলেও।
মুড়ি খেতে খেতে বললাম, "হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোর মনে আছে উন্মাদিনীর ক্লাস? "
অন্বেষাও একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে চিবোচ্ছিলো, হাসতে গিয়ে বিষম খেয়ে টেয়ে একশা। কোনোরকমে শেষ করে বললো, "ওরে এখন এসব বলিস না, হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে যাবো। আরে একবার ইংরেজী ক্লাসে টিচার আসেন নি, সাবস্টিটিউট হিসাবে এসেছেন উন্মাদিনী। এসে পড়া ধরছেন, পোয়েট্রি মুখস্থ বলতে হবে। তো বলার আগে একজন বলেছে দিদিমণি, কবির নাম বলবো কি? আর যায় কোথা, উনি চটিতং হয়ে বললেন, থাপ্পড় দিয়ে তোমার সবকটা সব দাঁত ফেলে দেবো। আমার সংগে ইয়ার্কি? "
এবারে হাসতে গিয়ে দু'জনেরই বিষম লাগে। সামলে নিয়ে অন্বেষা বলে, "আরে মাঝে মাঝে খুশমেজাজেও থাকতেন। উনি গয়না হীরেপান্নাচুনি খুব পছন্দ করতেন।কেউ ওনার হাতের আংটি বা গলার হার নিয়ে জানতে চাইলে খুব খুশী হয়ে সেসব কোথা থেকে কত দামে কিনেছেন সব বলতেন। "
" জানিস অন্বেষা, ইস্কুলের পুরানো কত বন্ধু যাদের হারিয়ে ফেলেছিলাম বা যাদের কাছ থেকে আমিই হারিয়ে গেছিলাম এখন তাদেরকে আবার ফিরে ফিরে পাচ্ছি যুগ পার হয়ে। মুখবইয়ের কল্যাণে। কথা বলতে গেলেই ফিরে আসে ইস্কুলবেলার গল্প।"
" আমিও কয়েকজন বন্ধুকে পেয়েছি খুঁজে। তোর অলিপ্রিয়াকে মনে আছে তুলি? ক'দিন আগে তাকে পেলাম খুঁজে। কী ভালো গান গাইতো ও, তাই না? কী জানি একদিন হয়তো কোনো রি-ইউনিয়নে আবার দেখা হবে সবার। "
" কিংবা উপরে গিয়ে দেখা হবে। "
দু'জনে হেসে ফেলি, মনে পড়ে যায় সেই কোড। " উপরে গিয়ে দেখা হবে। "
সেই রেলস্টেশন আর ভীড়। সাবওয়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে উপরে প্ল্যাটফর্মে উঠতে হতো। সবাই হয়তো ভীড়ের চোটে এক গলিতে ঢোকা গেল না, যে যার সুবিধামতো দৌড় দিলো, ছাড়াছাড়ি হবার সময়ে বলা হতো "উপরে গিয়ে দেখা হবে। " উপরে প্ল্যাটফর্মে এসে দেখা হতো। হেসে ফেলতাম সবাই। কথাটা খুবই সার্বজনীন, আমাদের এই নশ্বর জীবন যে যার মতন কাটিয়ে শেষে উপরে গিয়ে তো দেখা হবেই।
(চলবে )
Friday, February 21, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment