Thursday, February 20, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৩)

ইস্কুলে অনেক রুমা দিদিমণি৷ রুমা মুখার্জী, রুমা বসু, রুমা সেন,রুমা দত্ত৷ তাই এঁদের ক্ষেত্রে শুধু প্রথম নামের সঙ্গে দি বা দিদিমণি জুড়ে বোঝা যেতো না কে কোন্ জন৷ এদের নাম ও পদবী দুই লাগতো৷ কেন যেন রুমা মুখার্জীকে ওনার বিয়ের আগের পদবী ধরেই ডাকা হতো রুমা কাঞ্জিলালদি৷ হয়তো সেই পদবীটা আনকমন বলেই এত জনপ্রিয় হয়েছিলো৷

এই রুমা কাঞ্জিলালদি বাংলা পড়াতেন, অগাধ জ্ঞান বাংলায়, প্রচুর কোটেশন মুখের ডগায়, প্রচুর পড়াশুনোও ৷ অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, গ্রীক দেবীদের মতন মুখ, ফর্সা দীঘল স্বাস্থ্যবতী চেহারা৷ একটাই মুশকিল খুবই তীব্র অহংকার আর পুরানো ভিক্টোরীয় এটিকেটের ধারনা ছিলো এনার৷ মেয়েদের নাকি চলতে হবে গজেন্দ্রগমনে, তাদের কথা বলতে হবে গলা না তুলে, থাকতে হবে খুব ফিটফাট। এইরকম খোলাখুলি উপদেশ তিনি দিতেন৷

ক্লাসে পড়ানো হয়ে গেলে দেশবিভাগে ওনাদের ওপারের জমিদারি ছেড়ে আসার গল্প বলতেন, দেশবন্ধু নেতাজী সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ সকলের সঙ্গেই নাকি ওনাদের পরিবারের যোগাযোগ ছিলো, এইসব গল্প গুছিয়ে বলতেন৷ অদ্ভুত একটা রটনা ছিলো এনার বিষয়ে ইনি নাকি কেবল সুন্দরী ছাত্রীদের ভালো নম্বর দেন, অন্যেরা ভালো করলেও নাকি দেন না৷ কিন্তু রটনাটা ভুল, এটার প্রমাণ পেয়েছিলাম, তা সত্বেও কিন্তু লোকের মনে ধারনাটা রয়েই গেছিলো৷

মেয়েরা এনাকে নিয়ে আড়ালে বহু কথা বলতো, এক স্থূলবপু শ্যামাঙ্গ অধ্যাপক নাকি এনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, ইনি শিউরে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়েন শুনেই৷ পরে খুবই সুদর্শন এক ব্যক্তির সঙ্গে এনার বিয়ে হয়, কিন্তু সেই আগের অধ্যাপক আর কাউকেই বিয়ে করেন নি, চিরকুমার থেকে যান৷ কোথা থেকে যে এসব কথা জানা যেতো সে কেই বা জানে, কিন্তু দিব্যি আসতো এসব গল্প!

এনার পড়ানো বিষয়ে কোনো অভিযোগ ছিলো না, খুব যত্ন করে পড়াতেন, পরে এগারো বারোতেও প্রধানত এঁরই জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আমাদের পড়া হয়েছিলো৷নাহলে কাকে বলে দিব্যোন্মাদ, কাকে বলে ভাবোন্মাদ, কাকেই বা বলে বীভৎস উন্মাদ(আমাদের শ্রীতমা আবার বদ্ধ উন্মাদ আর মুক্ত উন্মাদ এই দু'খানা ক্যাটেগোরিও জুড়ে দিয়েছিলো)- এইসব আমাদের জানা হতো না, শ্রীকৃষ্ণবিজয় কীভাবে কেন লেখা হলো তাও না, আরাকান রাজসভার বাঙালি কবিদের কথাও না৷ লাউসেন অজানাই থেকে যেতো, লোরচন্দ্রাণীও৷ উচ্চমাধ্যমিকে বাংলাকে খুব হেলাফেলা দেখার একটা কালচার ছিলো, কারণ এর তো বিষয়কৌলীণ্য নেই! তবুও এনার ক্লাসে আমাদের সমঝে থাকতে হতো, নাহলে কী বলতে চিবিয়ে চিবিয়ে কী বলে দেবেন! বকার সময় ইনি কেন জানি প্রায়শই সকলের বাবামায়ের দেওয়া শিক্ষার উপরে অবধারিত কটাক্ষ করতেন৷ এরই শোধ হয়তো মেয়েরা তুলতো আড়ালে এনার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি চর্চা করে৷

কিন্তু মনে রাখার মতন ঘটনা ঘটলো একসময়, যখন জগতের নিয়মে আমাদের খুব দু:খ ও হতাশার দিন এলো, তখন ইনিই বলে দিলেন সেই কবির কথা, " দু:খের বরষায় চক্ষের জল যেই নামলো/বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামলো৷" দু:সময়ে ভেঙে পড়লেই এই লাইন দুটি স্মরণ করতে বললেন বীজমন্ত্রের মত৷ এঁর স্বামীর তারপরেই বদলি হয়ে যায় অন্য রাজ্যে, ইনিও চাকরি ছেড়ে চলে যান স্বামীর সঙ্গে৷ শুধু বর্ষাসন্ধ্যার ধূপের ধোঁয়ার মতন ঐ লাইনটা পাক খায় ঘরের বাতাসে৷

সেলাইয়ের নীপবীথিদি আর গৌরমোহিনীদি-এদের ক্লাস আবার একেবারেই অন্যরকম৷ দুজনেই ঘোর শ্যামাঙ্গিনী আর ছোটোখাটো চেহারা৷ নীপবীথিদি খুব রগচটা আর গৌরমোহিনীদি শান্ত, মা-মা ধরনের৷ নীপবীথিদিকে মেয়েরা নাম দিয়েছিলো কেল্টিপিসি৷ প্রয় কেউই এনার উপরে প্রসন্ন ছিলোনা আর ইনিও কারুর উপরেই প্রসন্ন ছিলেন না৷ সকলের কাজেই কোনো না কোনো খুঁত ধরতে এত দক্ষ ছিলেন যে তাক লেগে যেতো! গৌরমোহিনীদির কোনো নিকনেম ছিলো কিনা মনে পড়ছে না, তবে বাফার হয়ে তিনি আমাদের এবং নীপবীথিদির মাঝে পড়ে অবস্থা সামাল দিতেন৷

আসন বোনা, উলের হাতপাখা, টেবিলক্লথে অ্যাপ্লিকের কাজ, কুরুশকাঁটায় ঢাকনি বানানো, হাফহাতা সোয়েটার, রুমালে গুজরাতি স্টীচের নক্সা, দড়ির পাপোষ, দু'কাটার আর চারকাঁটার উলের মোজা--এইসব হ্যানোতেন আমাদের করতে হয়েছে ক্লাস এইট অবধি৷ এসবের পরীক্ষাও হোতো রীতিমতো৷ কিন্তু তবু অনুচ্চারিত কিছু চোট্টামির অভিযোগ থেকে যেতো, কেউ কেউ নাকি বাড়ীতে মাকে দিয়ে বা অন্য কোনো দক্ষ মহিলাকে দিয়ে করিয়ে আনে, তাই সেগুলো এত ভালো হয়৷

নাইনে উঠে শুরু হলো প্র্যাকটিকাল, কাপড়ে মাপে মাপে কেটে তারপরে ক্লাসে বসে সেলাই করে করে ব্লাউজ জাঙিয়া বেবীফ্রক তৈরীর ক্লাস৷ নীপবীথিদি আর গৌরমোহিনীদি দুজনেই থাকতেন সেই বিশাল ক্লাসরুমে৷ রীতিমতো ফর্মূলায় ফেলে অংক করে মাপ বের করে নিঁখুত কেটে তৈরী করতে হতো৷

পরে এগারো বারোতে বায়োলোজি প্র্যাকটিকালে এই সূক্ষ্ম কাটার জ্ঞান খুব কাজে লাগতো পাতা কান্ড মূলের প্রস্থচ্ছেদ করার সময়৷ ব্যাঙের ডিসেকশানের সময়ও৷ তবে সেসব পরের কথা৷ তখনো ঐ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়ো ল্যাব আমাদের কাছে অনেক দূরের৷ তবে বায়োলোজি ল্যাবে ঝোলানো কালো কাপড়ে ঢাকা কংকালখানা আমাদের কাছে একেবারে ফাইভ থেকে ছিলো একটা বিশেষ রহস্যেমোড়া দারুণ জিনিস৷ পরে ফটফটে দিনের আলোয় বায়োলোজি প্র্যাককটিকাল ক্লাসে যখন হাট করে খুলে রুবীদি ঐ মনুষ্যকংকালের ফ্রীজ হয়ে যাওয়া অস্থিময় হাসি দেখালেন, পুরো শিরশিরানি আগ্রহ উবে গেলো আর রহস্যই যে রইলোনা! কিন্তু সেও পরের কথা৷

তখন আমরা ব্যস্ত কর্মশিক্ষার জিনিসপত্র তৈরীতে৷ সে রীতিমতো প্র্যাকটিকাল খাতায় ছোটো ছোটো স্যাম্পেল অবধি আটকে ওগুলো সম্পর্কে লিখতে হতো৷ তার উপরে পরীক্ষাও হতো মৌখিক ও হাতেকলমে৷ এক মৌখিক পরীক্ষায় নাকি "চিকনের কাজ কোন্ অঞ্চলের লোকের পোশাকে বেশী ব্যবহার হয়?" এই প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে এক ছাত্রী বলেছিলো, " মরুভূমির লোকের পোশাকে৷" প্রশ্নকারিণী দিদিমণি ঘাবড়ে ঘ হয়ে বলেন, " মরুভূমিতে? কেন? " ছাত্রী ততক্ষণে বেশ সাহসী, সে বলেছিলো, "মরুভূমিতে খুব গরম কিনা, ফুরফুর করে যাতে হাওয়া খেলতে পারে তাই চিকনের কাজ থাকে পোশাকে৷" আবার কালচার্ড করারও ব্যবস্থা ছিলো, একটি গান অথবা আবৃত্তি করার পরীক্ষাও থাকতো৷ তারপরে ফার্স্ট এইড বাক্স তৈরীও আমরা শিখলাম সেই সম্পর্কে গুছিয়ে লিখতেও হলো৷ কর্শিদা, হানিকম্ব ইত্যাদি জীবনে নাম না শোনা স্টীচ শিখে রুমালে করতে হলো! কী অবস্থা!

সেলাই প্র্যাকটিকাল ক্লাসে ঢালা শতরঞ্চি পাতা৷তার উপরে পাশাপাশি জমিয়ে বসে টুকটুক করে গল্প করতে করতে আমরা হেম দিয়ে ফ্রকের প্রান্ত মুড়ি যথাসাধ্য যত্নে৷ এই একটি ক্লাস যেখানে আস্তে আস্তে গল্প করা যায়, খুবই দীর্ঘ সময়, প্রায় আড়াই ঘন্টা নইলে সবাই বোর হয়ে যাবে তো! শুভাশ্রী আর আমি সেদিন পাশাপাশি, ও বেশ শক্ত মুখে বলে, "এইবারে আর ওরা আমাদের কিছু বলতে পারবে না যে কাউকে দিয়ে করিয়ে আনি৷ সামনাসামনি করতে হচ্ছে, এই ভালো হয়েছে৷"

আমি সায় দিই, সুতো ফুরিয়ে গেছিলো, নতুন সুতো পরাই৷ দিনটা খুব মনে আছে, হয়তো তখনো আমাদের শেলগুলো এত শক্ত হয়ে উঠে নি, তখনো হয়তো আমরা কিছুটা জ্যান্ত ছিলাম কিছুটা সত্য ছিলাম পরস্পরের কাছে, অসেতুসম্ভব দ্বীপে চলে যাই নি৷

কবে যেন সেই সরে যাওয়া শুরু হলো, ঠিক করে মনে পড়ে না৷ সে কি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে অংকের টুইশন নিতাম বলে? নাকি শুভাশ্রী ইতিহাস পড়তে অমলেশ স্যরের কাছে ভর্তি হলো আমি হলাম না তখন থেকে? নাকি দেবু স্যরের কাছে ফিজিক্স পড়তে গেলাম আমি, ও গেলো কুমারপ্রসাদ স্যরের কাছে, তখন থেকে?

এক একজন স্যরের দ্বারা অনবরত বিষিয়ে দেওয়া চলতো অন্য স্যরেদের বা দিদিমণিদের কোচিং সম্পর্কে৷ নিজে নাকি উৎকৃষ্ট নোট দেন, অন্যে অতি নিকৃষ্ট ভুলভাল৷ প্রত্যেকেই অন্যের থেকে বেশী বুদ্ধিমান৷ নেহাত ভীড় নেই, দেবুস্যরের কিছুটা পাগলামির রেপুটেশানের জন্য, তাই সেখানে যেতাম ৷ শুধু এই কারণেই, কারণ এনার পড়ানো তেমন আহামরি কিছু না৷ তবে অন্যেরা যেমন গ্যালারি সিস্টেমে একসঙ্গে কুড়ি/ তিরিশজন ছাত্র বসিয়ে নোট দিতেন যন্ত্রের মতো, এখানে সেরকম না, বেশ গল্প গাছা করতেন৷ পরে অবশ্য অত্যন্ত মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলেছিলেন, বাইরের দেশে হলে হয়তো সাইকোলজিকাল টর্চার বলতো, কিন্তু সে প্রথম প্রথম না, বেশ অনেকদিন পরে ৷

বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোঁট্টা মানুষটি দেবুস্যর, স্থানীয় বাংলা বয়েজ স্কুলে ফিজিক্স পড়াতেন৷ কিছুটা একসেন্ট্রিক৷ আই এ এস পরীক্ষা সম্পর্কে একেবারে দারুন ভক্তি ছিলো, উনি বলছিলেন, "জানো, আমি ভেবেছিলাম আই এ এস হয়ে রাশিয়াতে রাষ্ট্রদূত হয়ে যাবো৷" শুনে আমরা অতি কষ্টে হাসি চাপতাম৷ ইনি নাকি এত বেশী এই আই এ এসের গল্প বলতেন যে সহকর্মীরা তিতিবিরক্ত হয়ে ওনার আড়ালে ওনাকে এবিএফ বলে ডাকতো৷ এবিএফ হলো অ্যাটেম্পটেড বাট ফেইলড৷ এনার সম্পর্কে রটনা ছিলো যে ইনি আই এস পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি, তাই পাগল হয়ে যান!

তো সেসব আমার কিছুই আগে জানা ছিলো না, সহজ স্বাভাবিক সরলমনে ঢুকলাম ওনার কাছে পড়তে, তুমুল ভক্তি করতেন ফিজিক্সকে, নাকি ওয়েভ মেকানিক্সের তুল্য জিনিস ত্রিভুবনে ও ত্রিকালে পাওয়া যায় নি৷ সময় আসার অনেক আগেই তিনি জানিয়ে দিলেন হাইজেনবার্গের নাম, এমন পদার্থবিদ নাকি ত্রিভুবনে ও ত্রিকালে খুব কম পাওয়া যায়!

আমরা মৃদু প্রতিবাদ করে বলতাম " কেন স্যর, আইনস্টাইন? "

আর যায় কোথা? উনি তুমুল তেজে বলতে শুরু করতেন কেন হাইজেনবার্গ আইনস্টাইনের থেকেও বেশী মেধাবী, কারণ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ কখনো কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন নি! এই ধারনাটা পরে নারায়ণ স্যানালের বইয়েও দেখেছি, কিন্তু মনে হয় না জার্মান পরীক্ষা ব্যবস্থা আমাদের চেনা পরীক্ষাব্যবস্থার মতন ছিলো৷ ওদেশে স্কুল ও তো অন্যরকম!

যাই হোক, এনার কাছে ভালো করে জানা গেলো যে সমস্ত সাবজেক্টের মধ্যে প্রকৃত কাজের জিনিস হলো গিয়ে ফিজিক্স আর যারা ফিজিক্স পড়ান তারা অবধারিতভাবে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী ট্যালেন্টেড ও স্মার্ট৷ বাকী সব সাবজেক্ট যেমন বাংলা ইতিহাস ভুগোল জীবনবিজ্ঞান এসব যারা পড়ান তাদের বুদ্ধির কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো৷ শুধু তাই না তাদের নাকি সাহস পর্যন্ত খুব কম!

কেউ কেউ একবার অংকের হয়ে কিছু বলতে গেছিলো, দেবুস্যর বিপুল বিক্রমে বললেন প্রকৃত গণিতজ্ঞের কাছে দুনিয়া নাকি হাতের তালুর মতন৷ ঘোর অন্ধকারে টর্চ জ্বাললে যেমন আলো দেখা যায়, জিনিস খোঁজা যায়, এই দুনিয়ার প্রকৃত জ্ঞানী গণিতজ্ঞেরা তেমনি ৷ প্রকৃত পদার্থবিদের সঙ্গে এদের তফাত নেই ৷ কিন্তু যেসব অঙ্কের মাষ্টার এখানে আশেপাশে আছেন তারা সেরকম নন, তাদের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো৷ প্রসঙ্গত, ইনি নিজেরই স্কুলের এক বহু প্রাইভেট ছাত্রওলা অংকশিক্ষকের উপরে হাড়ে চটা ছিলেন কারণ সেই ভদ্রলোক দেবুস্যরের নিকনেম দিয়েছিলেন বিশারদ!

কিন্তু দুনিয়া ও টর্চ এর গল্পটা আমাদের খুব ভালো লাগতো৷ অন্ধকার বিশ্ব ও আলোক-উৎস গণিতজ্ঞ/পদার্থবিদ৷ এই প্রকৃত গণিতজ্ঞ বা প্রকৃত পদার্থবিদ যে কে বা কারা সে সম্পর্কে আমাদের ধারনা ছিলো অত্যন্ত ধোঁয়াটে, হয়তো হাইজেনবার্গ, হয়তো আইনস্টাইন! হয়তো আরো অনেকে যাদের নাম আমরা তখনো জানতাম না৷

দিন চলে গেল গুণ গুণ করে, চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার চলে যেতে যেতে একসময় দেবুস্যর কেন জানি নিরুৎসাহ করতে শুরু করলেন৷ এদেশে নাকি গবেষণা খুব বড়োলোক আর খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল পরিবারের না হলে করা যায় না, তাই একটু ভালো ছাত্রেরা হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রাণপণে তৈরী হয় জয়েন্ট পরীক্ষা দেবার জন্য, যাতে ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে একটা চান্স কোনোরকমে পেয়ে যায়৷ না পেলে তখন জেনারেল লাইনে গিয়ে ভর্তির চেষ্টা করে আর কলেজে একটা সীট দখল করে সেফসাইডে থেকে পরেরবার জয়েন্ট দেবার জন্য তৈরী হয় ৷

তাক লেগে গেল, তাহলে স্যর এই যে এত ত্রিভুবনে ত্রিকালে না হওয়া ওয়েভ মেকানিক্সের কথা কইলেন? হাইজেনবার্গ শ্রোডিংগার .... উনি হাসেন, বলেন, "তারা অন্য দেশের লোক, তাদের স্মার্টনেসের সঙ্গে আমাদের তুলনা?”

আমাদের মধ্য থেকে কেউ দুর্বল স্যাঁতানো গলায় বলে, "আমাদের মেঘনাদ সাহা সত্যেন বোসও তো ....”

উনি রেগে যান, বলেন, "এই সত্যেন বোস মেঘনাদ সাহা ধরনের তুখোর ব্যক্তিরা হাতের মোয়া না, এনারা হাজার বছরে একবার জন্মান৷ এদের দেখে এইম ঠিক করলে ভুল করবি৷”

দিন যায় মাস যায় বছর ঘুরে যায়, সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে থাকি সবাই৷ একদিন কাছে এসে যায় মাধ্যমিক পরীক্ষা৷

তখন দ্রুততর দিনের গতি, সামনে প্রি-টেস্ট, প্রি-টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার সময় কান ঘেঁষে গুলি চলে গেল অন্বেষার। আমার কাছে অনেক পরে, ভিন্ন দেশেকালে বসে সে গল্প করেছিলো আমাদের ফার্স্ট গার্ল অন্বেষা। প্রিটেস্টের খাতাগুলো ফেরৎ দেওয়া হতো, টেস্টের সময় আর তা হবে না। তা একটা পর্যায়ে এমন অবস্থা হোলো যে ওর পাওয়া নম্বরগুলো যোগ করে যা হচ্ছে তা সেকেন্ড গার্ল মিঠুর চেয়ে এক না দুই কম। তখন আর মাত্র একটা খাতা বেরোনো বাকী আছে। অন্বেষা দেখছে সে নিশ্চিত খাদে পড়ে যাচ্ছে, ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত হাফ-ইয়ার্লি অ্যানুয়াল কোনো পরীক্ষায় সে সেকেন্ড হয় নি, প্রায় সব সাবজেক্টে সে পেতো হায়েস্ট মার্ক, ওকে বাদ দিয়ে সেকেন্ড থেকে হিসেব করতো দিদিমণিরাও। কিন্তু এখন?

অন্বেষাও পড়তো দেবুস্যরের কাছে। নিরাপদ সময়ের দূরত্বে বসে অন্বেষা আমায় বলছিলো সেদিনের কথা, " আমার গুরু ক্লিওপ্যাট্রার পথ প্রায় "ধরি ধরি মনে করি ধরিতে পারি না" অবস্থায় আছি, এমন সময় সেই দেবুস্যর! পাঁচ সেলের এক টর্চ নিয়ে বাঁশবাগান পার হয়ে আমাদের বাড়ীতে। ভাই বাইরে বারান্দায় ছিলো, তাকে জিগায়, "ওরে তোর দিদি টেঁপি কোথায়? আছে তো? " তা ছিলাম বটে, রয়েই গেলাম। আরো অনেক দেখতে হবে কিনা! আর তো গুলি কান ঘেঁষে যাবে না, সোজাসুজি কলিজা ফুটো করে দেবে আর তা এই স্যাডিস্টগুলো দেখবে বলেই কিনা ক্লিওপ্যাট্রা আড়ালে দাঁড়িয়ে আমায় যা মুখে আসে গালাগাল দিয়ে যাবার কালে বলে গেল, "ছি ছি অকৃতজ্ঞ, দুনিয়ার ঋণশোধ না করে দুনিয়া থেকে পালাতে চাস, লজ্জা নেই!"

আমি তো অবাক, "সে কী রে, তোর গুরু ক্লিওপ্যাট্রা নাকি রে অন্বেষা ????

অন্বেষা হাসে, বলে, " সে না হলে আর কে গুরু হবে? গোটা ইতিহাসে তো এই একজন নেত্রী মহিলাই সময়মতো ছিটকে পালাতে পারলেন।"

আগের কথার সুতো টেনে বলি, " তারপরে কী হলো সেদিন? "

সে বলে," পরদিন শেষ খাতাটা বেরোবে, তো পরদিনের জন্য অপেক্ষা করাই স্থির করলাম। তিন না পাঁচ নম্বরের জন্য কান ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে গেল। সেভড। সেবারের জন্য অন্তত। ছি ছি, কীরকম ভাবে আমাদের মন তৈরী হয়েছিলো! অর্থহীন যুক্তিহীন স্বার্থপর প্রতিযোগিতা, মিথ্যা অহংকার। "

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, "সেদিন কিন্তু ব্যাপারগুলো খুব খুব স্ট্রং ছিলো রে অন্বেষা, ভেবে দ্যাখ তখন আমাদের পনেরো-ষোলো বছর বয়স, জীবনের কতটুকুই বা জানি। যতটুকু জানি সেখানে এই প্রবল প্রত্যাশার ভার। থ্যাঙ্ক গড, যে তুই সেদিন অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি। "

প্রীটেস্টের পরে মাত্র পুজোর ছুটিটুকু ফুরিয়েই টেস্ট, তার তিনমাস পরে মাধ্যমিক৷ বনশ্রীদি আমাদের যত্নে ম্যাপ পয়েন্টিং শেখান, সমুদ্রস্রোত যেন দ্রুত এবংমোটামুটি ভালোভাবে আঁকতে পারে ছাত্রীরা সেটা নিয়ে যত্ন করে টিপস দেন৷ ইনিও বলতেন "ভুগোলে তোমাদের অনেকের বাইরে প্রাইভেটে পড়ার সুযোগ নেই, এখানেই যতটা যা পারো শিখে নাও৷"

অন্বেষা বলে, "বুঝলি তুলি, সেই পূজাতে মাইকে এত এত গান বাজে আর আমার কানে আসে খালি, "সব লাল পাথরই তো চুনি হতে পারে না " এই লাইনখান। আসলে একবার পালাবার পালার জন্য তৈরী হয়ে গেলে ফট করে তার প্রভাব থেকে বেরোনো শক্ত। "

"আহা রয়ে গেলি বলেই তো পরে আমাদের ইস্কুলে অত বড় একটা গৌরবমুহূর্ত এলো। স্মরণকালের মধ্যে ওরকম তো আর হয় নি। "

অন্বেষা চুপ করে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে থাকে, ফেলে আসা কিশোরীবেলার লবণচিনি স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বুঝি।

" সেভেনের পিকনিকের কথা মনে আছে তোর? সেই যে নন্দিনীদি নিয়ে গেল আমাদের দূরের মাঠে পিকনিকে।"

আস্তে আস্তে বলে অন্বেষা, "মনে থাকবে না? বাপরে সেকি ঝাল হয়েছিলো মাংস। চাটনি দিয়ে মেখে ঝাল কমিয়ে খেতে হলো। "

দু'জনে হেসে উঠি।

ক্লাস সেভেনে তখন আমরা, ঠিক হলো ক্লাসের সবাই মিলে পিকনিক করবো। ক্লাস টিচার নন্দিনীদি, উনি গণিতের শিক্ষিকা। চাঁদা টাদা ঠিকমতন তোলাও হয়ে গেল। পিকনিক-সাইটও দেখে এলেন দিদিমণি। উনি তো তিনজন পাচকের ব্যবস্থা করে নিজে টিফিনকৌটায় কৌটায় সবার জন্য পায়েস বানিয়ে নিয়ে গেলেন, রান্না হতে দেরি হবে, সেই সময়ে মেয়েগুলোর খিদে পেতে পারে, তখন উনি নলেন গুড়ের পায়েস সবাইকে দেবেন এই প্ল্যান।

গিয়ে তো দেখা গেল খুব রোদ, সামিয়ানা টানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।বড় বড় মোটা কাপড় ছিলো সাথে। বাঁধার জন্য একদিকে কিছু সাপোর্ট পাওয়া গেল, কিন্তু অন্যদিকে কিছু নেই। অপটিমাম একটি গর্ত করে বাঁশ পুঁততে হবেই সামিয়ানার জন্য। এদিকে শাবল থাকলেও মেয়েরা কেউ তেমন গর্ত খুঁড়তে পারে না! শেষে নন্দিনীদি নিজেই গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে বললেন, "এমন জানলে আমি আগমনীকে সঙ্গে করে আনতাম। " আগমনীদি আমাদের ফিজিক্যাল ট্রেনিং এর দিদিমণি ছিলেন, খুবই স্ট্রং।

হয়ে গেলে সবাই সুস্থির হয়ে শতরঞ্জিতে সামিয়ানার ছায়ায় বসে শান্তিতে গানের লড়াই খেলা শুরু করলো, রান্নার বহু দেরি। প্রথমদিকে দিদিমণিও যোগ দিয়ে বেশ গান টান গাইলেন, তারপরে উনি অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়লে জোশের গান গুলো শুরু হলো খুব আস্তে গলায়, যেন ওনার কানে না যায় কোনোমতে।এখন ভেবে দেখলে হাসি পায়, তেমন কিছু না, কিছু হিন্দি-সিনেমার প্রেমের গান মাত্র, সে সময় সে অঞ্চলে এগুলো নিয়েও খুব ছুৎমার্গ ছিলো।

এইভাবে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটার পরে সবার তো খিদেয় কাহিল অবস্থা। তখন দিদিমণি বার করলেন পায়েসের কৌটোগুলো। এদিকে শালপাতার প্লেটের নাম্বার লিমিটেড, সেগুলো পিকনিকের মূল খাবারের জন্য রাখা আছে। এখন উপায়?

ব্যবহারিক গণিতজ্ঞদের নিয়ে একটা সুবিধা, এরা চট করে সমাধান করতে পারে নানা সমস্যার। সবাই ভালো করে হাত ধুয়ে এলো, দু'হাত জড়ো করে অঞ্জলি করলো, তাতে উনি পায়েস দিয়ে গেলেন, সবাই মহানন্দে খেয়ে ফেললো। যাদের কুলাবে না তাদের জন্য বিস্কুটের ব্যবস্থাও উনি রেখেছিলেন তবে সে আর লাগে নি দরকারে।

" হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোর ডাকনাম যে টেঁপি, এটা তো কস্মিনকালেও জানতে পারিনি আমরা কেউ গোটা ইস্কুলবেলায়!"

অন্বেষা হাসে, বলে, " আরে ওটা তো বাড়ীর ডাকনাম, ইস্কুলে তোরা জানবি কীকরে? দেবুস্যর তো মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ী যেতেন, তাই জেনেছিলেন।"

"আরে বলিস কী? উনি তোদের বাড়ী যেতেন? "

"মাঝে মাঝে। উনি বলতেন লোকে নাকি গল্প করতো আমার ঘরে আমি মাবাবাকে পর্যন্ত নাকি ঢুকতে দিই না, বই দিয়ে ঢাকা সেই ঘরের মেঝে থেকে কড়ি অবধি। দেবুস্যর বেশ একটা গর্বের সুরে বলতেন আমি শিক্ষক, তাই ঢুকতে পেরেছি, শিক্ষকের মর্যাদাই আলাদা, শিক্ষক আর চিকিৎসক- এনারা নাকি সর্বত্র যেতে পারেন। আচ্ছা তুলি, আমি আমার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিই না, হরিলুটের মতন বই ছড়ানো ঘর, এসব গল্প লোকে কেন বানিয়ে বানিয়ে বলতো আর কেনইবা বিশ্বাস করতো?"

"সে লোকেরাই জানে। তোর সম্পর্কে আরো নানা অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প ছিলো। সেই যে তুই নাকি ঘুমের মধ্যে নানা ইকোয়েশন টিকোয়েশন বলিস আর মাঝে মাঝে নানা অদ্ভুত নাম ধরে ডেকে উঠিস।"

দু'জনে হেসে উঠি। জানালার বাইরে তাকাই। বাইরে অনর্গল শুভ্র তুষার ঝরছে, আকাশ থেকে তুলোর ফুলের মতন। বাড়ীঘর গাছপালা বাইরের গাড়ীগুলো মাঠ পথ ঢেকে যাচ্ছে সাদা চাদরে। হোয়াইট ক্রিসমাস। সেই কতদিন আগের এক উষ্ণ দেশের আমাদের ইস্কুলবেলার গল্প এই পটভূমিতে বসে ভাবতেও অবাক লাগে। যেন গতজন্মের কাহিনি।

"সেদিন দেবুস্যর পাঁচসেলের টর্চ নিয়ে তোদের বাড়ী যে গেলেন, কী করে জেনেছিলেন উনি? "

অন্বেষা বলে "সেদিন বিকেলে পড়া ছিলো, হয়ে গেলে ফিরে আসার সময় আমি একটা চিরকুট দিয়ে এলাম যে! সেটায় ছিলো, এত এত কার্বন অক্সিজেন নাইট্রোজেন হাইড্রোজেন বৃথা আটকে রেখে লাভ কী? এই দিয়ে প্রকৃতি তৈরী করতে পারবে আরো অনেক মেধাবী অনেক সাহসী অনেক বেশী এফিসিয়েন্ট মানুষ, তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে। আমি দ্রুত এসব যথাস্থানে ফিরিয়ে দিলেই মঙ্গল।"

"আরে সর্বনাশ! এসব তুই লিখেছিলি? তবে তো বাপু তোমার নাম খেপী হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু অন্বেষা, তুই এতখানি খেপীটাইপ হলে কী করে স্টিক করে রইলি তোর লক্ষ্যে? দেবুস্যর তো খোলাখুলি বলতেন পরিবারের লোকজন উঁচু পজিশানে না থাকলে গবেষণা টবেষণার আশা করা দুরাশা।"

স্মৃতিমেদুর হয়ে যায় ওর মুখ, বলে, "আমার কী যে দিন গেছে কী যে রাত গেছে! সব গুলিয়ে গেছিলো। মনে হতো এবারে কী হবে? আমাদের পরিবারে এর আগে কেউ সায়েন্স পড়েনি, বাবাজ্যেঠা কমার্সের লোক, মা-জ্যেঠিমারা আর্টসের৷ কোথাও কোনো পরিচিত পারিবারিক লোক নেই উঁচু প্রতিষ্ঠানে, অন্ধকার, অন্ধকার একেবারে ঘোর টর্চবিহীন অন্ধকার!

চাষী পরিবার থেকে উঠে আসা ক্ষণজন্মাপ্রতিভা নিউটনের গল্প পড়েও এতটুকু উষ্ণতা অনুভব করতে পারিনি, ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা লাগতো৷ নিউটনের দেশ ও কাল তো নয় আমার দেশ ও কাল! এখানে অন্যরকম মানুষ, অন্যরকম ধারণা বিশ্বাস অন্যরকম সমস্যা ও সমাধান৷ এমনকি সত্যেন্দ্রনাথ মেঘনাদও তো আমার চেনা কালের নন!

গভীর রাত্রির মধ্যে ডুবে যাবার মতন লাগতো, ঠান্ডা অন্ধকার, গ্রহতারাহীন অসহায় শূন্যতা৷ গুজরাটী/ মাড়োয়াড়ী/ সিন্ধি/ সাহেবী কোম্পানিতে মগজ চাকর হয়ে জুতে যাওয়া অথবা আড়ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়ী যাওয়া-দুটোই ঘোর অর্থহীন ও নিষ্ফল বলে মনে হতো৷

তুই জানিস আমাদের বাড়ীর খুব কাছেই গঙ্গা। সেই গঙ্গা মনের মধ্যে ছলছল করতো, মনে হতো বিয়েই যদি করতে বাধ্য করে মা-বাবা ও পরিবারের সবাই, তবে গঙ্গা তো রইলো। সে তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

তারপরে একদিন ... সেই অন্ধকারে আলো ফুটে উঠলো, প্রথমে অতি অল্প, অতি হাল্কা, ভুলে যাওয়া গানের মতন একটা দুটো হাল্কা সুর, তারপরে অন্ধকারে ফুটে ওঠে সেই দীর্ঘকেশ ভবঘুরে জ্যোতিষ্ক, অভিমানী ধূমকেতুটি, সে বলে, "তুমি ভুলে গেছ আমায়, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি৷" অমনি ঘননীল পর্দাটা সরে যায়, অসংখ্য আয়নার মধ্যে ঘূর্ণ্যমান জগৎ হেসে ওঠে ৷

তারপরে দিনের পর দিন স্যর আমার পরিবারের কমজোরিতা নিয়ে বলে যান, যতরকমে পারেন নিরুৎসাহ করেন, তারপরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ভেবে আরো জোরে ছুরি বেঁধান সবচেয়ে গভীর স্পর্শকাতরতায়, "অবশ্য তোর ছেলেকে ভালো করে শেখাতে পারবি, তখন তো তুই নিজে হবি কিনা এই লাইনের লোক, তাই৷" আমি হাসি, কথাগুলো এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বার করি, কারণ এদের কাছে কিছু বলতে গেলে কোনোভাবেই কিছু হবে না৷ আমি মনে মনে জপি If it doesn't kill us, it makes us stronger. "

অন্বেষা চুপ করে বাইরের তুষারের দিকে চেয়ে থাকে, ওর চোখ দেখতে পাই না, আস্তে করে হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরে রাখি। চুপি চুপি বলি," হ্যালির ধূমকেতু, না রে? তুই বলেছিলি ও ধূমকেতু যখন আসলো তখন থেকেই তোর মন টানলো আকাশ। একেবারে " বিষয়মধু তুচ্ছ হইলো, কী যেন কুসুমসকলে।"

ও হেসে ফেলে, বলে, "এই দ্যাখ, তুইও গল্প বানাতে শুরু করেছিস। যাকগে, গান শোনা।"

আমি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে শ্যামাসঙ্গীত চালিয়ে দিই ল্যাপীতে। পান্নালালের অপার্থিব কন্ঠসুধা বেজে ওঠে, " মায়ের পায়ের জবা হয়ে-"

গান শুনতে শুনতে বেগুনী ভাজি আর বাটিতে বাটিতে মুড়ি সাজাই, এমন দিনে মুড়ি আর বেগুনী খুব জমে। খেতে খেতে আবার ইস্কুলবেলার গল্প শুরু হয়। মাধ্যমিকের রেজাল্টে আগের সব হিসেব উলোটপালোট হয়ে গেল, অজপাড়াগাঁয়ের ঐ স্কুলে অত বেশী নম্বর স্মরণকালের মধ্যে পায় নি কেউ, অবশ্য অন্বেষা সম্পর্কে একটা এধরনের আশা দিদিমণিদের মনের মধ্যে ছিলো, সে কিনা বেশ অন্যরকম, ম্যাজিক-ম্যাজিক টাইপ, তাই একটা ম্যাজিক ধরনের কান্ড সে করে ফেলবে এই রকম আশা অনেকেই করতো।

দু'দিন ছুটি দিলো স্কুল। সেলিব্রেট করতে। আর উচ্চমাধ্যমিকের জন্য ঐ স্কুলেই অন্বেষা রয়ে গেল বলে গ্রুপের বাছা বাছা সব মেয়েই রয়ে গেল। এটাও ঐ স্কুলে অভূতপূর্ব, তার আগে ভালো ভালো সবাই উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতো পাশের টাউনের অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলে।

অন্বেষা বলে, "ওটাই ভুল হয়েছিলো রে তুলি। বাড়ীর লোকেরা যদি আমায় এটা সেটা বলে ভুজুংভাজাং দিয়ে পুরানো স্কুলেই থাকতে না বলতো, নিশ্চয় আমি থাকতাম না। তাহলে বাকীরাও থাকতো না। আমার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ওভাবে সর্বনাশ হতো না দুবছর পরে।"

বেগুনীতে কামড় দিয়ে একমুঠ মুড়ি মুখে পুরে আমি বলি, " আরে ওদের পায়ে দড়ি দিয়ে রেখেছিলো নাকি কেউ? ওরা গেল না কেন? আর সর্বনাশ আবার কী? এই না বললি নম্বর নিয়ে লাফালাফি সবই একেবারে অর্থহীন! "

"তা ঠিক, তবে কিনা ব্যবস্থা তো বদলায় না অত তাড়াতাড়ি, তার মধ্য দিয়েই লড়ে বেরুতে হয় মানুষকে। যে জায়গার যে রীতি।"

আমি হেসে ফেলি, "পথে এসো সখী, এবারে পথে এসো। নোবেল সায়েবের দোরের সামনে দিয়ে দুবেলা যাতায়াত করতে করতে তোমার এখন সেইসময়ের ব্যবস্থা বোকামো মনে হতে পারে, তবে তখন সেটা ছিলো জীবনমরণ। হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোকে মাধ্যমিকের পরে নানা জায়গা থেকে সম্বর্ধনা দিতো, কেমন লাগতো রে তোর? "

" আর বলিস না, সে যে কী সর্বনাশ! একেক জায়গায় সভাপতি প্রধান অতিথিদের কী বক্তৃতা, কী বক্তৃতা! কী মারাত্মক বক্তৃতা যে লোকে দিতে পারে!"

" আরে জুনিয়ার স্কুল থেকে যেটা দিয়েছিলো, সেটাতে তো ক্লাসের সবাই গেলাম। বাইরে মঞ্চ বেঁধে তো হয়েছিলো। তোর মনে আছে সভাপতি বক্তৃতা দিচ্ছেন আর বয়েজ স্কুলের এক স্যর যিনি আবার অঞ্চলপ্রধানও, তিনি সামনের সারিতে বসে দুহাতে কান ঢেকে ঘুমাচ্ছেন?"

হি হি করে হেসে উঠি দু'জনেই, আবার যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, স্মৃতি সত্যিই এক আশ্চর্য জগত।

(চলবে )

No comments: