ক্লাস এইটে বদলি হয়ে বড় শহর থেকে একজন এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো। চন্দ্রাণী চট্টরাজ। খুব নামডাক তার, পড়াশোনায় নাকি দারুণ সে। বড় শহরের পালিশ তার, সবাই বলতে লাগলো, আমাদের মতন গাঁ-মফস্বলের মেয়েদের সে তুড়ি মেরে হারিয়ে দেবে। আমাদের সেকশানে এসে বিশেষ করে আমাদের সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ব্যতিক্রমহীন ভাবে ফার্স্ট হয়ে আসা অন্বেষাকে কায়দা করে শুনিয়ে
যেতে লাগলো অন্য সেকশনের মেয়েরা। চন্দ্রাণী বদলি হয়ে ভর্তি হয়েছিল বলে এ সেকশনেই প্রথমবার পারে নি আসতে, ক্লাস এইটে ও ছিল বি সেকশনে।
প্রথমবার চন্দ্রাণীকে দেখে তো আমরা অবাক! ছোট্টোখাট্টো ফর্সা গোলগাল মেয়েটি, মাথায় লম্বা চুল পিঠ ছাপিয়ে, সেই বিশাল চুলের রাশি মোটা একটা বেণীতে বাঁধা। অমরা তো ভেবেছিলাম শহরের মেয়ে, খুব চোখেমুখে কথা বলা টাইপ বুঝি হবে, চুল ছোটো করে ছাঁটা হবে, ছেনিকাটা চোখমুখ হবে। এ তো একেবারে ধ্রুপদী বঙ্গবালা টাইপ শান্ত নরম একটা মেয়ে।
আমাদের অন্বেষা, শুভাশ্রী, শ্রীতমা, চন্দ্রিমা, সুগোপারা তো স্বস্তির শ্বাস ফেললো ওকে দেখে। বন্ধুত্ব হতেও খুব একটা দেরি হলো না।
ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় চন্দ্রাণী ভালো করেছিল ঠিকই, তবে প্রথম তিনজনের মধ্যে আসতে পারে নি। অন্বেষা তো একইরকম প্রায় সব সাবজেক্টে হায়েস্ট পাওয়াই রয়ে গেল, সে ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়েছিল মনে হয় শ্রীতমা আর থার্ড হয়েছিল সম্ভবত শুভাশ্রী। তার পরে চন্দ্রাণী।
অনেক পরে, মাধ্যমিকেরও পরে যখন চন্দ্রাণী আবার ওর বড় শহরে ফিরে গেল, তখন শ্রীতমা বলেছিল, "আমাদের গাঁ-মফস্বলেও কিন্তু চট্টরাজ ভালো কম্পিটিশনই পেয়েছিল, বলতে পারবে না যে একেবারেই কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে পায় নি।" কেন জানি শ্রীতমা ওর নাম না ধরে পদবী ধরে উল্লেখ করতো সবসময়, হয়তো পদবীটা বেশ আনকমন ছিলো বলে।
এখন ভেবে দেখলে মনে হয় চন্দ্রাণীরও কতটাই না মানিয়ে নিতে হয়েছিল হঠাৎ করে নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে উপড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় উপস্থিত হয়ে।
বহুকাল আর যোগ নেই ওর সঙ্গে, এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে কোথায় আছে ও, কেমন আছে ও? এইট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা অবধি ঐ তিনটে বছরের কথা মনে আছে কি ওর?
ক্লাস এইটে আরেকটা বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আমাদের। হঠাৎ শোনা গেল একটা ইন্টার-স্কুল স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনার হবে, তাতে হোস্ট আমাদের স্কুল। ক্লাস নাইন আর টেনের ছাত্র- ছাত্রীরাই অংশগ্রহণ করবে, তবে ক্লাস এইটের কেউ যদি আগ্রহী হয় আর আত্মবিশ্বাসী হয়, তবে সে বা তারাও অংশগ্রহণ করতে পারে।
আরে অংশগ্রহণ তো পরের কথা, জিনিসটা কী সেটাই তো তখন আমরা জানি না। সেমিনার আবার কী? এটা কি কোনোরকম প্রতিযোগিতা? তার আগে কোনোদিন আমরা সেমিনার বলে কোনো ব্যাপারের নামও শুনি নি। বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা-এসব ব্যাপার তবু ভাসা ভাসা কিছু কিছু জানতাম, কিন্তু সেমিনার কী জিনিস?
অল্পবয়সী দিদিমণিরা যারা নতুন নতুন ব্যাপারের অনেক খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা এসে আমাদের এই ব্যাপারে ধারণা দিতে চেষ্টা করলেন।
জেলাসদরের একটি সংস্থা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। সেখান থেকে একটি বিষয়বস্তু দেওয়া হয়েছে আর নির্দেশাবলিও দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে বক্তৃতার মতন করে বলতে হবে আর সঙ্গে স্লাইডে ডায়াগ্রাম চার্ট ইত্যাদিও দেখানো যেতে পারে, দেখালেই সুবিধে। সময় পাঁচ মিনিট।
এই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের যুগে দাঁড়িয়ে সেই আমাদের প্রথম স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনারকে অদ্ভুত আদিযুগের জিনিস মনে হয়। তখন তো কম্পিউটার কী জিনিস তাই জানতাম না আমরা কেউ, দেখা তো দূরের কথা। কেউ কেউ টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছিল কম্পিউটার, বলেছিল টিভি আর টাইপ রাইটারকে একসাথে জুড়লে যেমন হয় সেরকম জিনিস ওটা।
তো আমাদের সেই প্রি-কম্পিউটার সেমিনারে চার্ট ডায়াগ্রাম ইত্যাদি দেখানোর জন্য দিদিমণিরা সাজেশন দিলেন অনেকপাতার ক্যালেন্ডারের মতন করে বানানো একটা বস্তু, তার পাতায় পাতায় ডায়গ্রাম চার্ট ইত্যাদি। সেমিনারে বলতে বলতে পাতা উল্টে উল্টে দেখাতে হবে।
আমরা সব বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগলাম। ক্লাস এইটের আমরা দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম নাইনের দিদিরা কীভাবে সব বানাচ্ছে। যদিও আসল প্রতিযোগিতার দিন ভালো ভালো স্কুল থেকে তুখোর তুখোর সব সেমিনার দেনেওয়ালারা এসে বলে টলে একেবারে মাতিয়ে দিল, জাজরা ওদের মধ্য থেকেই ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড বেছে নিলেন। তখনই আমরা বেশ স্পষ্ট করে বুঝেছিলাম ভালো স্কুলের ব্যাপার স্যাপার আমাদের নিতান্ত সাধারণ মধ্যমানের স্কুলের থেকে কতটাই আলাদা।
পরের বছর অন্য একটা স্কুল হোস্ট করলো এই কম্পিটিশন। আর আমাদের মধ্য থেকে অন্বেষা তৈরী হলো অংশ নেবার জন্য। অন্য কারুর তেমন আগ্রহ ছিল না অথবা হয়তো মনে করেছিল সময় নষ্ট করে লাভ কী? এসব করে তো পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো পজিটিভ এফেক্ট পড়বে না!
সেই বছরের টপিক ছিল ওরিজিন অব লাইফ, জীবনের উৎপত্তি।
(চলবে)
Wednesday, July 16, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment