Thursday, July 3, 2014

নীল বৃষ্টির ভিতরে

১।

নীলমেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিকণারা নেমে আসছিল, একের পর এক। টুপ টাপ টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছিল রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানের গভীর দিঘির কালো জলে। মস্ত মস্ত নীল মুক্তোর মতন জলবিন্দু। কালো জলে ডুবে যাচ্ছিলো। ওরা কোথায় যায়?

ওই দিঘি কত গভীর কেউ জানে না, ঘাট থেকে জলে নেমে একটু এগোলেই আর থই পাওয়া যায় না, তখন সাঁতার দিতে হয়। আমি সাঁতার জানি না, তাই পাথরের ঘাটের কাছ থেকে বেশী দূরে যাই নি। লোকে গল্প বলে নাকি দিঘির গভীর তলদেশে আছে মণিমুক্তাসাজানো জলগুহা, তা হলো পাতালের দরজা। ঐ গুহাপথে পাতালে পৌঁছলে নাকি দেখা যাবে পাতালের রাজ্য, তাতে হীরা, মুক্তা, মণি, মাণিক্য ছড়াছড়ি যায়।

আহা, পাতালে পৌঁছতে পারলে বেশ হতো! তাহলে এই ছেঁড়া কালো জামা পরতে হতো না আর, পেট ভরে খেতেও পেতাম দু'বেলা। যেখানে এত ধনদৌলত ছড়াছড়ি যায়, সেখানে ভালো ভালো খাবারও নিশ্চয় অনেক। মা ও এত মারতো না তাহলে, পেতই বা কোথায় আমাকে? আমি তো তখন সে-এ-এ-এ-ই পাতালের রাজ্যে! বা:, বেশ মজা হতো!

" টুনি, ও টুনি, কই গেলি তুই? " মা ডাকে, আমি দিবাস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি। কোথায় বৃষ্টি? খটখট করছে দুপুর। ঘাটলার অশ্বত্থছায়া থেকে উঠে পড়ি। মা বেরোবে বিকালের কাজে, আমায় ঘরে থাকতে হবে। যাই, দেরি হলে মা আবার চুলের মুঠি ধরে এমন চড় দেবে যে গালে দাগ পড়ে যাবে। একদিন দিয়েছিল ওরকম, ঘুরে পড়ে গেছিলাম মেঝেতে।

যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলি, "যাই দিঘি, কালকে আবার আসবো। "

দিঘি কী বললো শোনা হলো না। আচ্ছা, সত্যি কি পাতালরাজ্য আছে? জলমানুষেরা আছে? থাকলে বেশ হতো কিন্তু! মা পেট ভরে খেতে দেয় না, দেবেই বা কোত্থেকে? একা একা খেটে আমাকে আর দুটো ভাইকে খেতে পরতে দেওয়া আবার নিজের জন্য ও তো লাগে, এ কি সহজ? আরেকটু বড় হলে আমিও কাজ করতে শুরু করলে তখন বেশ ভালো হবে। পেট ভরে খেতে পাবো, আস্ত কাপড় পরতে পাবো। সে কবে?

হয়তো আর কিছুদিন পরেই মা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কোনো বাসায় কাজ ঢুকিয়ে দেবে। এই তো পাশের ঝুপড়ির মালতিকে গত মাসে স্টেশনের কাছের ঐ উঁচু বিল্ডিং এর এক বাসাবাড়ীতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মা। মালতি তো আমার বয়সীই প্রায়, একটু বড়ো। সেরকম হলেও ভালো হয়, বাসাবাড়ীতে ফ্যান আছে, হাওয়া খাওয়া যায়, টিভি আছে দেখা যায়। সবসময় তো আর কাজ না, কাজ ফুরালে টিভি দ্যাখা যায়। তাছাড়া মালিকেরা জামাকাপড়ও দেয় অনেক, ওদের ছেলেমেয়েদের একটু পুরানো হয়ে যাওয়া জামা দিয়ে দেয় কাজের লোকেদের।খাবারদাবারও ভালো পায় সেখানে মালতি। বেশ মজাতেই আছে। মালতি মাঝে মাঝে আসে, ওর মাসমাইনের টাকা ওর মাকে দিয়ে যায়।

পৌঁছে গেছি, মা যথারীতি রেগে আছে। আমার দিকে তেড়ে এসে বলে, "কোন্‌খানে ছিলি এতক্ষণ?এত বড় বুড়োধাড়ি মেয়ে রাতদিন টইটই করে বেড়ানো? ঘরের কাজগুলো তো খানিক করে রাখলে পারিস, তা করার নাম নেই! তাহলে যে মা'র সুবিধা হয়! ছোটো ভাই দুটোকে দেখে রাখলেও তো কিছু কাজের কাজ হয়। তা না, ইনি পাড়া বেড়িয়ে বেড়াবেন! দাঁড়া আজকে এমন মজা দেখাবো যে আর ভুলবি না। "

বলতে না বলতেই চুলে টান আর ঠাস করে ডান গালে এক প্রচন্ড জোরে চড়, পড়ে যেতে যেতে সামলাই, চোখে অন্ধকার। সেটা সামলাতে না সামলাতেই বাঁ গালে আরেক চড়। আ:, কেন মা এত মারে! এইবারে মালতি আসলে ওকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবো ওর চেনা কোনো বাসাবাড়ীতে কাজের লোক রাখবে কিনা কেউ। ও যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে ওর সঙ্গে চলে যাবো মাকে না জানিয়ে।

লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে মাকে বলি, ""আমি ছোটন আর বুড়নকে দেখে রাখছি। তুমি কাজে যাও। "

ঘুমিয়ে থাকা ভাইদের পাশে গিয়ে বসি, তালপাতার আধাভাঙা পাখাটা দিয়ে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে থাকি। মা কিন্তু তখুনি যায় না, আমাকে একটা রুটি আর অল্প কাঁচকলাভর্তা এনে দিয়ে বলে,""খিদে পায়নি তোর? সেই তো কোন সকালে দুটি পান্তা খেয়েছিলি, তারপরে তো আর কিছু খাস নি। "

আমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলি, "আমার খিদে পায় নি। তুলে রেখে দাও, রাত্তিরে দিও। " আমার মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ে, ছেঁড়া ফ্রকের হাতায় মুছি। মা যাতে না দেখতে পায় সেই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মা দেখতে পেল।

মা খুব কেমন রকম গলায় বলে, "কী রে তোর মুখে রক্ত! এত লাগলো? "

কাছে এসে আমাকে আলতো করে ধরে, আমি চোখ বন্ধ করি, হাতের পাখাটা পড়ে যায়। নীল মেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিরা নেমে আসছে, অনেক অনেক নীল বৃষ্টিকণা। টুপ্‌ টুপ্‌ করে ডুবে যাচ্ছে দিঘির কালো জলে। আমিও ডুবে যাচ্ছি ওদের সঙ্গে, আমার সারা শরীরে ঠান্ডা জলের ছোঁয়া লাগছে, দেখতে পাচ্ছি চারপাশে মাছেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় সব মাছ।

নীল রঙের একটা মস্তবড় মাছ আমার কাছে এসে কথা বলে উঠলো, বললো, " পাতালের প্রাসাদে যাবে? এসো আমার সঙ্গে।" সে ডানা নেড়ে নেড়ে সাঁতরে চলে পথ দেখিয়ে, আমি পিছু পিছু চলি। কিন্তু আমি তো ভালো সাঁতরাতে পারি না, আমার হাত-পা সব ভারী হয়ে আসে, খুব কাশি পায়, কাশি চাপতে পারি না, কাশতে কাশতে ঝলক ঝলক রক্ত উঠে আসে, জল লাল হয়ে যায়।

আহ, আর যাওয়া হলো না প্রাসাদে। সেই যেখানে ধনরত্ন মণিমুক্তা ছড়াছড়ি, যেখানে কোনো কষ্ট নেই, যেখানে খিদে পেলেই খেতে পাওয়া যায়। যেখানে একজন খুব সুন্দর মা আছে। কেউ সেখানে মারে না। আহ, যাওয়া হলো না। মাছকে বলি, "ও মাছ, মাছ, শোনো, একটু থামবে? আমি যে পারিনা আর এগোতে। "

মাছটা পিছন ফেরে, ওর হাসিহাসি মুখটা বদলে যায়, বদলে যায় আরো। চেনা কার মুখের মতন হয়ে যায়।

আমি চোখ মেলি, চোখে মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল, মা ঝুঁকে পড়েছে আমার মুখের দিকে। জলের ঝাপটা দিচ্ছিলো বোধহয়। আমার চেতন হয়েছে দেখে সোজা হয়ে বসে। আমি উঠে বসতে গেলে মা বলে, " শুয়ে থাক, শুয়ে থাক, উঠতে হবে না। "

আমি তবু উঠে বসি, কোনোরকমে বলি, "আহ, আ-আমাকে একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা। "

মা গেলাসে করে জল এনে গেলাস আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।

আমি মাকে জিগ্গেস করি , "কাজে যাও নি? "

"তোকে এই অবস্থায় রেখে যাবো? এখন একটু ভালো লাগে রে টুনি? "

"এখন ভালো। তুমি কাজে যাও। আমি ভাইদের কাছে শুয়ে শুয়ে হাওয়া করি। "

মা কাছে এসে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, "বুঝতে পারিনি টুনি, তোর এত লাগবে। আমি তোকে রুটিভর্তা খাইয়ে দিই? তারপরে কাজে যাবো। "

রুটি-ভর্তা মা খাওয়ায়, আমি নিজেই খেতে পারতাম, কিন্তু মা নিজে হাতে করে খাওয়ায়, আমি খেয়ে যাই। মুখের ভিতরে কোথাও কেটে গেছে হয়তো, জ্বালাজ্বালা করে, কিছু বলি না। কী হবে বলে? দু'দিন গেলে সেরে যাবে।

মা কেমন কোমল গলায় বলে, " আমার কথা শুনে চললেই তো আমার রাগ হয় না। একা একা ঘুরে বেড়াস, জানিস কত বিপদ আপদ চারপাশে? কথা না শুনলেই আমার রাগ ওঠে। আমার কথা শুনবি তো টুনি? আর এমন ঘুরবি না তো? "

আমি মাথা কাত করে জানাই শুনবো। মা বিপদ-আপদের কথা বলে প্রায়ই, কিসের বিপদ? কিজানি হয়তো ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যেতে পারে, সেই বিপদ।

(চলবে)

No comments: