দেখতে দেখতে লোকজনে ঘর ভরে উঠতে লাগলো, গোল করে পাকানো ডায়াগ্রামের তাড়া নিয়ে সেমিনার দেনেওয়ালারা, সঙ্গে তাদের গাইড শিক্ষকরা বা শিক্ষিকারা, তাছাড়া এমনি দর্শক শ্রোতা ছাত্রছাত্রীরাও আসছে। জাজেরাও শোনা গেল এসে গিয়েছেন, তবে তাঁরা তখন অন্য ঘরে বিশ্রাম করছেন আর টিফিন খাচ্ছেন।
অন্বেষার মুখ আরো খানিক ভয়-ভয় হয়ে গিয়েছে, আমি কিছু জোকস বলে খানিকটা হাসি হাসি করে দিলাম ওকে।
ঘরে লোক আরো বাড়ছে, ঘরের একদিকে একটা উঁচু জায়গা, হয়তো ডায়াসের মতন কিছু ওটা। ঐখানেই ফুলদিয়ে সাজানো টেবিলে আর চেয়ার, ঐগুলোতে জাজেরা বসবেন। মঞ্চের একপাশে একটা তিনপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের মতন, ঐখানে ছবি ঝুলিয়ে মনে হয় বলতে হবে।
বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপার, আমাদের মেয়েদের স্কুল, এখানে মেয়েদের স্কুল ছেলেদের স্কুল সহশিক্ষা স্কুল সব থেকেই এসেছে প্রতিযোগী ছাত্রছাত্রীরা। হঠাৎ মনে হলো আমাদের স্কুলটা সহশিক্ষার হলে মন্দ হতো না ।
টাউনের এক নামকরা স্কুল থেকে এসেছে দুই ছাত্রী, তাদের সঙ্গে তাদের দুই শিক্ষিকা। ওদের হাবভাব আর সাজপোশাক সবই দারুণ আত্মবিশ্বাসী। দেখে মনে হয় আহ, এইরকমই বুঝি হয় তাহলে বড় শহরের ছেলেপুলেরা!
যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ে তো শুরু হয়ে গেল সেমিনার। একে একে নাম ডাকা হচ্ছে আর ছাত্র বা ছাত্রী মঞ্চে গিয়ে উঠছে আর বক্তৃতা দিচ্ছে ছবি টবি লেখা টেখা দেখিয়ে, মাত্র পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ প্রত্যেকের। ভেবেছিলাম প্রত্যেক পরিবেশনের পরে হয়তো ছোট্টো প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকবে, সেসব দেখলাম কিছুই থাকলো না।
অন্বেষার পালা এলে সে গিয়ে বললো আর ঝোলানো ছবির পাতা উল্টে উল্টে দেখালো ডায়াগ্রামগুলো। ভালোই বলেছিল সে, বেশ গোছানো পরিবেশন, মিলারের পরীক্ষার সেই মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন আর জলীয় বাষ্প থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী হওয়ার জায়্গাটা বেশ দারুণ বুঝিয়ে বললো, কিন্তু ডায়াগ্রাম ছিল হাতে আঁকা, জাস্ট চলনসই।
সেই টাউনের নামকরা স্কুলের ছাত্রী দুজনের বক্তব্য ইত্যাদি আর বলার কায়্দাও মোটামুটি একইরকম গোছানো ছিলো কিন্তু ওদের ডায়াগ্রামগুলো ছিল অতি চমৎকার, একেবারে প্রফেশনাল। ওরাই ফার্স্ট আর সেকেন্ড হলো সঙ্গত কারণেই। অন্বেষা হয়েছিল থার্ড।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পুরো ব্যাপার সমাপ্ত হয়ে একেবারে প্রাইজ ইত্যাদিও দেওয়া হয়ে গেল, তারপরে সবাই বাড়ীর দিকে রওনা হলো।
আমাদের এক দিদিমণি পরে সব শুনে বলেছিলেন ঐ নামকরা স্কুলের ছাত্রীরা এইসব ব্যাপারে ট্রেনিং অনেক ভালো পায়, ওদের সঙ্গে এইসব ব্যাপারে তৈরী করে দেবার জন্য ডেডিকেটেড টিচার থাকেন। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যে আমাদের গাঁ-মফস্বলের স্কুলে সেই কালচারই তৈরী হয়নি যা এইসব এক্স্ট্রা ব্যাপার স্পেশাল ব্যাপারগুলোতে আমাদের ট্রেনিং দিয়ে যুগোপযোগী করে তুলবে। তাছাড়া ভালো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তো এইসব জিনিসের আগ্রহ নেই, উটকো উৎপাত এইসব। কারণ তারা ছকে দেওয়া পথে চার পাঁচজন প্রাইভেট টিউটর এর কাছে তালিম নিয়ে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেয়ে গেলেই খুশি। জয়েন্টের উত্তীর্ণতালিকায় ভালো জায়্গায় থাকতে পারলেই তাদের পাথরে পাঁচ কিল, কোনো না কোনো শিওর শট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকে পড়তে পারলে মার দিয়া কেল্লা, পড়ার শেষেই লাখবেলাখের চাকরি।
তো সে আর কে না জানে! খুব বেশী বিকল্প রাস্তাও তো চোখে দেখতে পেতাম না আমরা। সব কিছুই যেন বিশাল উঁচু একটা পাঁচিলের অন্যপারে, আমরা শুধু তার ভাসা ভাসা আওয়াজ শুনি মাত্র, এই আবিষ্কার হয়ে গেল টপ কোয়ার্ক, এই এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে কোয়ান্টাম এনট্যাংগলমেন্ট নিয়ে, এই হিউম্যান জিনোম সিকোয়েন্স বার করার জন্য বিশাল প্রোজেক্ট শুরু হচ্ছে, সেই সব কিছুই আমাদের কাছে যেন এক কল্পনার জগৎ, কিছুতেই সেই জগৎটা আমাদের কাছে সত্যি হয়ে আসতো না।
আমরা সেই সকালে উঠে প্রাইভেট কোচিং যাত্রা, ফিরেই তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে স্কুল, স্কুল থেকে ফিরেই আবার আরেক প্রস্থ প্রাইভেট কোচিং যাত্রা কোনো কোনো দিন, নয়তো হয়তো পরেরদিনের কোনো ইউনিট টেস্টের পড়া-এইসব চক্করে পড়ে থাকতাম। পড়াশোনার প্রায় সবটাই একধরণের ব্লাইন্ড মুখস্থবিদ্যা- প্রশ্ন নেই, নিজে নিজে ভাবার স্পেস নেই, নতুন প্রশ্নের উদয় নেই, সেই প্রশ্নের সমাধানের অভিযান নেই, ভুল করার কোনো স্বাধীনতা নেই বলে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও এক্সপেরিমেন্টের কোনো অবকাশ নেই। থোড় বড়ি খাড়ার এক অদ্ভুত অসহায় অন্ধকার চক্র।
তবু তার মধ্যেও কেউ কেউ বুকের ভিতর আলোর স্বপ্ন লালন করতো ঠিকই।
(চলবে)
Wednesday, August 6, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment