১
সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির -মাঝে মাঝে কেমন যেন হয় আশমানির। এক একটা শব্দ সারাদিন রিনরিন করে মনের মধ্যে বাজতে থাকে। আজকে যেমন এই সূর্যশিশির! কী সুন্দর কথাটা। অথচ এর মানেটা তেমন কিছু ভালো নয়, একরকমের পতঙ্গভুক উদ্ভিদ, কলসপত্রীর মতন। কলসপত্রী নামটাও কী চমৎকার ! এইসব গাছেদের এরকম সুন্দর নাম দেওয়ার পিছনে মানুষের কি কোনো বিশেষ মানসিকতা আছে?
সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির-আশমানি হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলো পার্কিং লট, পলিমার-সায়েন্সের বিশাল সুন্দর বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে চলার সময় সারিবাঁধা পাইনের দিকে তাকালো, তারপরে পার হলো চওড়া লিংকন রোড-পুরো সময়টা মনের মধ্যে রিনরিন করে বাজছে সূর্যশিশির। আর মনে পড়ছে সূর্য নামটা, সবলে সেই নামটা সে মন থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে, কিন্তু ফিরে আসছে বার বার। কেন মনে পড়ে ঐ নাম? তাহলে আশমানি কি আজও অপেক্ষায় আছে মনে মনে?
অফিসঘরের চাবিটা বার করে সে দরজা খোলে, পিছনে করিডর থেকে পিটারের " গুডমর্নিং, অ্যাশমানি " শুনে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে চেয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে, " গুডমর্নিং পিটার।"
আগে আগে ওর অ্যাশমানি শুধরে আশমানি করে দিতে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পিটারের উচ্চারণ কিছুতেই ঠিক হয় না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে আশমানির, আর কিছু বলে না। প্রায় সকলেই ওকে অ্যাশমানি ডাকে, সে মানিয়ে নিয়েছে। তবু তো তাকে নাম বদলে ইংলিশ ধরনের নাম নিতে হয় নি, একরকম মন্দের ভালো। চাইনিজদের তো অনেককেই দেখেছে ইংলিশ নাম নিতে, এই তো শেহাই বলে মেয়েটি জেনি হয়ে গেছে, হুয়াংমিং হয়ে গেছে জোয়ানা। আশমানি অনায়াসে অ্যাশলি হয়ে যেতে পারতো, এখানের সবার সুবিধে হতো। কিন্তু নিজের নামটা পর্যন্ত ছাড়তে হলে আর কী রইলো?
যান্ত্রিক দক্ষতায় ইমেলগুলো চেক করে আশমানি। বেশ কিছু দরকারি ফাইল ডাউনলোড করে, কিছু প্রিন্টআউট নেয়। আগের রাতে যে প্রোগ্রামটা রান করতে দেওয়া ছিলো, সেটার প্রোগ্রেস চেক করে। এখনো প্রায় সিকিভাগ বাকি। লাঞ্চের পরে পাওয়া যাবে ভ্যালুগুলো। একদিকে ভালোই, ততক্ষণে ল্যাবে নতুন ডেটা নেওয়া যাবে। কাজগুলো হয়ে গেলে লগাউট করে ল্যাবের দিকে রওনা দেয় সে। এতক্ষণে ডোয়ানা, সারা, রুহান, অব্রিরা নিশ্চয় কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ল্যাবে ঢুকে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্যাম্পল বানানো আর অসিলোস্কোপ নিয়ে। একটানা কাজ করে চলে বেশ ক' ঘন্টা। এক এক করে অন্যরা লাঞ্চে গেল, আশমানির খিদে পাচ্ছিলো না।
লাঞ্চ থেকে ফিরে এসে ডোয়ানা বললো, "অ্যাশমানি, আমি ডেটা নিই, তুমি এবারে লাঞ্চে যাও।" ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আশমানি বললো, "আমি মিনিট কুড়ির মধ্যেই চলে আসছি। "
ল্যাব থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে কাফেটেরিয়ার দিকে আশমানি। চলে আশমানি, কেমন যেন ক্লান্তি সর্বাঙ্গে, সে কী এতক্ষণ না খেয়ে আছে বলে?
কাফেতে দেখা হিন্দোলের সঙ্গে, সে এসেছে লাঞ্চ করতে। আশমানি তো অবাক-খুশি। স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর স্প্রাইট নিয়ে কাফের একপাশের টেবিলে বসে দু'জন। এত বেলায় কাফে প্রায় ফাঁকাই বলা যায়, দুপুরের খাওয়া আর বাকী নেই কারুর।
হিন্দোল জিজ্ঞেস করে কাজকর্ম কেমন চলছে। আশমানি একটা আধাক্লান্ত হাসি হেসে স্যান্ডউইচে কামড় বসায় আর ঝালের চোটে স্প্রাইটে চুমুক দেয়। সে নিজেই বেশী করে হ্যালোপিনো দিতে বলে আর নিজেই ঝালে হুশহাশ করে। তারপরে সংক্ষেপে বলে নিজের কাজকর্মের কথা। হিন্দোলকেও জিজ্ঞাসা করে তার খবর।
হিন্দোলের সঙ্গে দেশে থাকতেই পরিচয় ছিলো আশমানির। শুধু পরিচয়ই না, ভালোরকম বন্ধুত্ব ও ছিলো। একই কলেজে আশমানি, সুর্য, হিন্দোল- সবাই পড়তো। আলাদা আলাদা বিষয়ে পড়লেও ওদের ক্লোজ গ্রুপ ছিলো একটা। সেই গ্রুপে ছিলো হিয়া, তিষান, আশমানি, সূর্য, হিন্দোল আর উপমা। স্বভাবে কারুর সঙ্গে কারুর মিল ছিলো না, অথচ বন্ধুত্ব গাঢ় ছিলো সেইসময়।
পরবর্তী জীবনে যে যার পথে চলে গেছে, সেই সময়ের পরিকল্পনা কিছুই পরে আর টেঁকে নি। হিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে ওর বাড়ী থেকে ঠিক করে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে, অথচ হিয়া চাকরিবাকরি করে স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। হিয়ার সঙ্গে প্রেম ছিলো তিষানের। অভিমানী তিষান একটা কথাও না বলে ফরেস্ট সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে চলে গেছে হিমালয়ের পায়ের কাছে, সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছে।
সূর্য চাকরি নিয়ে থিতু হয়ে গেলো, নিজের শহরেই চাকরি পেয়ে যাওয়ায় বেশ খুশীই ছিলো সে। বাবামায়ের কাছে থাকা জরুরী মনে হয়েছিলো ওর। অথচ কলেজজীবনে সূর্যকেই সবচেয়ে সুদূরের পিয়াসী মনে হতো, সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ মনে হতো। সময় মানুষকে কতই না বদলে দেয়! নইলে--থাক। মনে করতে চায় না আশমানি।
হিন্দোল কিছুদিন ভালো চাকরি করেছে বহুজাতিকে। এখন আবার সে পথ পালটিয়ে নেমে পড়েছে ব্যবসায়, এখানে সেই ব্যাপারেই নাকি এসেছে একটা কাজে। হিন্দোলের মধ্যে একটা অস্থিরতা আশমানি লক্ষ করেছে একেবারে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে। কোনো কিছু নিয়েই বেশীদিন আটকে থাকা যেন ওর ধাতে ছিলো না।
আশমানির হঠাৎ খেয়াল হয় সে নিজেও কত বদলে গেছে! তার ক্লোজ গ্রুপের একজন এতদূরে এতদিন পরে এসেছে জেনেও তার তেমন কোনো হেলদোল নেই। অভিমান কি এত তীব্র হয়? হয়তো শুধু অভিমান না, হয়তো বিষাদ, ক্ষোভ, যন্ত্রণাও।
লাঞ্চ সেরে দু'জনে দু'পথে চলে যাবার আগে তুলে নিলো দু'জনের ফোননম্বর। বিদায় জানিয়ে ল্যাবের দিকে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ আশমানির মনে পড়ে পুরানো দিনে হিন্দোল খুব হাসাতো নানারকম জোকস বলে আর মজার অভিনয় করে। এখন সেই হিন্দোল কত সিরিয়াস হয়ে গেছে! সব মানুষই ক্রমাগত বদলায়, পরিস্থিতি মানুষকে দিনেরাতে সকালেসন্ধ্যায় কেবলই বদলে দিতে থাকে।
তবু কি কিছু থেকে যায় যা অপরিবর্তনীয়? যা অজর, অমর, অক্ষয়? তেমন কিছু কি সে কোনোদিন অনুভব করে কোনো বিরল অবসর-প্রহরে?
দিনের বাকী সময়টা টানা কাজ করছিলো আশমানি, বিকেল পৌনে পাঁচটায় ডোয়ানা এসে বললো তার কাজ আজকের মতন শেষ, আগে আগে চলে যাবে। ডোয়ানার মুখে লেগে আছে লাজুক হাসি, তাতে উত্তেজনার রঙ। তার বয়ফ্রেন্ড আজকে দেখা করতে আসবে, সপ্তাহের এইদিনটাতেই সন্ধ্যাবেলা তারা দেখা করে।
আশমানির খেয়াল হলো দিনটা শুক্রবার, এই সন্ধ্যা মানুষের আনন্দ করার সন্ধ্যা। পরের দু'দিন ছুটি কিনা! হাসিমুখে ডোয়ানাকে বিদায় জানিয়ে সেও কাগজপত্র গোছাতে শুরু করে। যদিও আজকে সন্ধ্যায় তার বিশেষ কোনো প্ল্যান কিছু নেই, কারুর সঙ্গে দেখা করারও নেই, তবু তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে একা কিছুটা সময় বিশ্রাম করতে ইচ্ছে করছে, শুয়ে শুয়ে কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চারওয়ালা গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করছে সেই কিশোরীবেলায় যেমন পড়তো।
ঘরে পৌঁছে ব্যাগ ট্যাগ সব রেখে আগে তার দীর্ঘ স্নানবিলাস, তারপরে কফি বানানো, টোস্ট বানানো, কফির সঙ্গে মাখন লাগানো টোস্ট খেতে খেতে টিভি দেখা- এই প্ল্যান। খুব নতুন কিছু না, আগের শুক্রসন্ধ্যায়ও তো প্রায় এই করেছে।
স্নান আর খাবার বানানো হয়ে গেলে সে চিঠির বাক্সো দেখতে যায়। খোলে রুটিন কাজের মতন। ভিতরে একটা খাম, উপরে ঠিকানা লেখা। ইংরেজী ক্যাপিটাল লেটারে লেখা ঠিকানা, হাতের লেখাটা পরিচিত ঠেকে। খুব পরিচিত। স্মৃতির ভিতর থেকে উকি দেয় কী যেন একটা, সেটা কি অভিমান? নাকি অন্য কিছু? কোনো স্পন্দিত অপেক্ষা?
খামটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আশমানি। তারপরে চিঠির খাম না ছিঁড়েই রেখে দেয়। বসার ঘরে সোফার উপরে খাম রেখে কিচেনে যায়, কফি টোস্ট আনতে। অবাক হয়ে লক্ষ করে তার হাত মাঝে মাঝে কাঁপছে।
খাবার নিয়ে গিয়ে বসে বসার ঘরে সোফায়, সামনের নিচু টেবিলে রাখে ওসব। পাশেই খামটা, টোস্টে কামড় দিতে দিতে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে খামটার দিকে, আস্তে আস্তে খাওয়া সারে, আয়েশ করে কফিতে চুমুক দেয়। একসময় সে বুঝতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে আজ সময় নিচ্ছে বেশী। নিজের অজান্তেই প্লেট সরিয়ে রেখে খামটা ছেঁড়ে আশমানি, চিঠির ভাঁজ খোলে।
সূর্য চিরকাল বড় চিঠি লেখে, এই চিঠিও বেশ বড়। তবে আগে অনেক কবিতা টবিতার কোটেশন দিয়ে দিয়ে লিখতো, এই চিঠিতে তা নেই। ওর নিজের বক্তব্যই শুধু। আশমানির কাছে ক্ষমা চেয়েছে সে, সে লিখেছে আশমানির মতন আকাশের উচ্চতার মানুষকে সে মাটির মানুষ হয়ে একদিন চেয়েছিল, আশমানিও রাজী ছিল- সেই নাকি পরম সৌভাগ্য। কিন্তু যা হবার নয়, তা কেমন করে হবে?
আশমানি যদি এই ভুল ভালোবাসায় দু:খ পেয়ে থাকে তাহলে সে যেন এটুকু অন্তত বোঝে যে সূর্যও কম দু:খ পায় নি। মনে মনে সে আশমানিরই রইলো, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় তো তাকে বাঁচতে হবে, তাই সে বাবামায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করতে চলেছে কিছুদিন পরে। মেয়েটি ভালো, ঘরোয়া, শান্ত। আশমানি যেন ভুল না বোঝে তাকে। আশমানির জন্য তার অনেক শুভকামনা রইল। সাহসী ও হৃদয়বান কোনো মানুষের সঙ্গে একদিন আশমানির মিল হবে, হবেই। সুখী হবে সে, তখন আর তার পুরানোদিনের দু:খ মনে থাকবে না।
চিঠিটা ডানহাতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে আশমানি, তারপরে নির্জন ঘরের একাকীত্বে খোলাখুলি কান্নায় ডুবে যায় নিশ্চিন্তে। এখানে তাকে দেখে ফেলার কেউ নেই, কারুর সামনে অপ্রস্তুত হবার ভয়ে সমুদ্রসমান কান্না গিলে ফেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেদিনের মতন ফিরতে হবে না তার।
সূর্য সেদিন ভীরু কাপুরুষের মতন পিছিয়ে গেছিল আশমানিকে তীব্র একলা করে দিয়ে। আশমানির তবু স্বপ্নভঙ্গ হয় নি, সমস্ত অপমানের আঁচড় নিজের উপরে নিয়েও তার ভালোবাসা বেঁচে ছিলো, সে ভেবেছিলো কোনো না কোনোদিন সূর্য তার কাছে আসবেই, সত্য সে বুঝতে পারবেই, অন্ধকারের বেড়া ভেঙে সে আসবেই তার ভালোবাসার কাছে। মানুষের বানানো ধর্ম ও তার ভুল বিভেদবোধ কি কোনোদিন মানবধর্মের চেয়ে বড়ো হয়?
একা ঘরে হৃদয় উজার করে কাঁদছে আশমানি, এ কান্না খানিকটা মুক্তির কান্নাও। আর তার কোনো দায় রইলো না অপেক্ষার, সূর্য নামের মানুষটাকে ভুলে গেলেও কিছু আর আসে যায় না তার।
একসময় কান্না ফুরিয়ে যায়। গভীর এক ক্লান্তির ঘোর নেমে আসে সর্বাঙ্গ জুড়ে। দু'চোখের পাতা আঠার মতন জুড়ে যায় ঘুমে। আহ, এসো ঘুম, এসো সর্বতাপহরণ ঘুম, তুমি এসো।
২
মুঠাফোনটা বাজছে, ঘুমের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শিথিল হাত বাড়ায় আশমানি। বালিশের পাশেই ফোন, ঘুমঝাপসা চোখ খুলে দেখে হিন্দোলের নম্বর। স্বপ্নভাঙা এলোমেলো মাথার মধ্যে সূর্য, সূযের চিঠি, হিন্দোল সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
মুঠাফোন হাতে নিয়ে উঠে বসে আশমানি, দেয়ালে ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যায়, না বেশী রাত না, মাত্র সাড়ে নয়। আরো একবার রিংটোন বাজা শেষ হলে ফোন কানে দিয়ে আশমানি সাড়া দেয়।
ওপাশে হিন্দোলের ছটফটে গলা, "কতক্ষণ ধরে করছি, কী করছিলে?"
আশমানি আলগা গলায় বলে, "আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"
"সরি, সরি। তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। নিশ্চয় খুব ক্লান্ত ছিলে।"
"তা একটু ছিলাম। কোনো দরকার?"
"আগামীকাল কি তোমার কোনো বিশেষ প্রোগ্রাম আছে?"
"কেন বলো তো?"
"আমি ভাবছিলাম যদি কোথাও যাওয়া যায় কাছেপিঠে। মাত্র ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভেই তো চমৎকার সিবীচ। যাবে, আশমানি?"
"এমন হঠাৎ করে বললে হয় নাকি? কালকে সকালে আমার অন্য কাজ আছে।"
হিন্দোলের গলা একটু মুষড়ে গেছে ওদিকে, কিন্তু সে এমন অল্পে ছেড়ে দেবার বান্দা যে নয় আশমানি ভালো জানে। হিন্দোল বলে, " দুপুরের পরে বা বিকালের দিকে রওনা হলে কেমন হয়? রাতের সমুদ্র দিনের চেয়ে বেশী চমৎকার। "
আশমানি হেসে ফেলে, "তুমি যা মানুষ, হয়তো বলবে সারারাত সমুদ্রের পারে ঘোরা আরো চমৎকার।"
খোলা গলায় হিন্দোল হাসছে। একেবারে সেই কলেজবেলার মতন। আশমানির ভিতরে কেমন যেন শিরশির করে উঠছে। মাঝে মাঝে সে ভাবে সেইসব দিনে আসলে কি সে হিন্দোলকেও ....
" আশমানি, না বোলো না, বলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।"
ওর বলার ভঙ্গীতে আবারও হেসে ফেলে আশমানি, পাগলাটাকে থামানো যাবে না জেনে বলে, "ঠিক আছে, যাবো। "
ফোন রেখে দিয়ে উঠে বসে আশমানি, ঘুমটা কেটে গেছে, ক্লান্তিও। হঠাৎ কিসের যেন একটা অস্বস্তি, কোথায় আশমানি বোঝে না। সে দরজা খুলে করিডরে দাঁড়ায়, দোতলার এই করিডরে অনেক খোলা হাওয়া। এখান থেকে আকাশের অনেকখানি দেখা যায়।
হঠাৎ জলে ভরে যায় তার চোখ, মুছে নেয় জামার হাতায়। ভাবে, কী হবে সেসব পুরানো কথা ভেবে? যে আসছিলো, সে তো ফিরে গেছে। সেদিনের দুর্বল ভীতু আশমানি তাকে আসতে দিতে পারে নি। কোল জুড়ে এলে সে কেমন হতো, সেকথা ভেবে আজ আর কী লাভ? মনে পড়ে সূর্যের সঙ্গে সেইসব মুহূর্তগুলো, নিবিড় ভালোবাসায় বাকী পৃথিবী যখন মিলিয়ে গেছিলো দু'জনের মাঝ থেকে। গেছিলো কি? তাহলে কীকরে পারলো সূর্য ওভাবে সরে যেতে?
সূর্য যদি সেদিন পাশে দাঁড়াতো...যদি আরেকটু সাহস সে করতে পারতো সেদিন ... থাক, যা হয়ে গেছে তাতো হয়েই গেছে! আর তাকে সংশোধনের কোনো উপায় নেই। রাতের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিয়ে আশমানি ঘরে ফিরে আসে।
৩
সন্ধ্যার আকাশ ভরে তারারা জেগে উঠছে। নির্জন দ্বীপের বাতিঘরে আলো জ্বলছে। আশমানি জলের ধারের পাথরে বসে আছে চুপ করে। সমুদ্রের ধারে কী প্রবল হাওয়া! ঐ যে দূরে জলদিগন্ত, পশ্চিমের সেই জলরেখার উপরে আকাশ, সেখানে আশ্চর্য রঙীন সূর্যাস্তের রেশ রয়ে গেছে এখনো।
দিনের আলো যতক্ষণ ছিলো আশমানি কথা বলেছে অনেক। ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে রেখেছে রুমালে জড়িয়ে। এখন সে চুপ, পাথরের উপরে বসে আছে একেবারে পাথরটারই মতন স্তব্ধ। সমব্যথীর মতন হিন্দোল আশমানির হাত ধরে চুপ করে থাকে।
কতক্ষণ তারা চুপ করে বসে ছিলো হাতে হাত রেখে তা বুঝি জানে শুধু সমুদ্রের হাওয়া, ফিসফিস করে হাওয়া কানে কানে কী সব বলে যায় তারা অনবরত। আকাশের তারারা নির্বিকার, এমন হাসিকান্না আসা যাওয়া হারানো পাওয়া কত দেখেছে ওরা, কতকাল ধরে দেখছে! মানুষের কত আনন্দবেদনার ইতিহাসের পাশ দিয়ে নিজের মতন করে চলে গেছে তাদের অপলক আলো।
আশমানি বলে, " জানো হিন্দোল, সূর্যের চিঠি পেলাম কাল। সে বিয়ে করতে চলেছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। হিন্দোল, ঠিক মানুষকে আমরা চিনতে পারি না কেন? আমরা কেন ভুল মানুষকে ভালোবাসি আর সে ভুলের খেসারত দিতে দিতে জীবনটাই কেটে যায় ? "
হিন্দোলের হাতটা শক্ত করে চাপ দেয় আশমানির হাতে, স্পর্শের বৈদ্যুতি ভাষায় সাহস দিতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায়। আরো কিছু বলতে চায় কিনা কেজানে! আরো একটা ভুলের জালে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না আশমানির। তার চেয়ে এই তো সে বেশ ভালো আছে, ঝাড়া হাতপা। বিদেশে বিভুঁইয়ে চেনাজানা মানুষদের হাজারো প্রশ্ন থেকে অনেক দূরে-
আশমানি উঠে পড়ে, পোশাক থেকে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে," চলো, কাছের কোনো মোটেলে উঠি, এত রাতে এতটা লম্বা ড্রাইভ করে না ফিরে কালকে সকালে ফিরবো না হয়। "
হিন্দোল বলে, " চলো। "
মোটেলটা কাছেই ছিলো, ব্রীজ পার হয়ে দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডে ঢোকার পরেই খানিক এগিয়ে সুন্দর মোটেল। তারা চেক ইন করলো রাতের জন্য। দুই বেডের ঘর। ছিমছাম সাজানো।
খুব ঘুম পায়, দু'চোখের পাতা জড়িয়ে আসে, সোফা থেকে কোনোরকমে বিছানায় কাছে এসে বালিশে মাথা ঢেলে দেয় আশমানি।
৪
দূরে আকাশ যেখানে নত হয়ে পড়েছে জলে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে লাল সূর্য, লাল হৃৎপিন্ডের মত, স্পন্দিত আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। কোথা থেকে ভোরের সমুদ্রতীরে এসে পড়ে একলা একটা মেয়ে, আবরণমুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় জলের দিকে, অবগাহণপ্রত্যাশায়।
ওর খোলা চুলের ঢালে জড়িয়ে যায় সাদা ফেনা, চিকচিক করে ওঠে ভোরের আলো। স্নান করতে করতে সে হাসছে, দু'হাতের মুঠায় নোনাপানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে চেঁচিয়ে বলে, "শোনো, শোনো, আমি আমার নাম দিলাম আকাশ।" একটা চমৎকার নীল মেঘ উড়ে আসে তার মাথার উপরে, টুপটাপ ঝরতে শুরু করে নীল বৃষ্টিকণা।
ঘুম ভাঙে আশমানির, স্নিগ্ধ শান্তি। এই স্বপ্ন তার চেনা, অনেকবার দেখেছে সে। এইটা তার খুব সুন্দর একটা হালকা পালকের মতন স্বপ্ন, একটা অলৌকিক মুক্তির স্বাদ। স্বপ্নের ভিতরের মেয়েটাকে কখনো মনে হয় খুব চেনা, আবার কখনো একদম অচেনা। কখনো মেয়েটা সে নিজেই, আবার কখনো বা তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়মুখ।
ভোর হয়ে গেছে, পুবের জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায় আশমানি। টলটলে জলের ভিতর দিয়ে দেখে উঠে আসছে লাল সূর্য, মেঘগুলো সব কমলা। হিন্দোল গভীর ঘুমে, ওর ঘুমন্ত মুখটা শিশুর মতন, মায়ায় ভরে যায় আশমানির বুকের ভিতরটা। বহুদিনের শুখা জমিনের উপরে সেখানে তখন নেমেছে বৃষ্টি, নীল রঙের বৃষ্টি, ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন।
******
Friday, August 15, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment