1.
আমাদের ছোট্টো নদীটার চরে চখাচখীর মেলা বসতো। শুনেছি তারা নাকি প্রেমের পাখি। নদীতটের মাখনরঙের বালিতে রূপোরঙের ভোর থেকে কমলা সাঁঝ অবধি দিনজুড়ে ঠোঁট ঠোঁট মেলানো সখ্য! সাঁঝের তারা উঠলে তারা আলাদা হয়ে উড়ে যায় বিরহের রাত জুড়ে প্রেমের কঠিন তপস্যায়। কেজানে, এসব সত্যি না গল্পকথা!
তপতপে রোদ্দুরের চৈত্রদিনের শেষে মনকেমনিয়া দখিণা হাওয়া বয় শান্ত স্নিগ্ধ সন্ধ্যায়, ক্লান্ত শরীর এলিয়ে ছাদে বসে থাকি। থাম বেয়ে বেয়ে ছাদের পাঁচিলে উঠে আসা জুঁইফুলের লতায় ফুটেছে একটা দুটো তিনটে ফুল, হাওয়া তার সৌরভ চুরি করে নিতে নিতে ফেলে যায় কিছু। আকাশে তাকিয়ে দেখি শ্যামলী কিশোরীর টলটলে অশ্রুর মতন ফুটে উঠেছে সাঁঝের একলা তারাটি। মনে পড়ে, তখনই মনে পড়ে তোর কথা।
সেদিনও এমন চৈত্রসন্ধ্যা ছিলো। তুই আমাকে বলেছিলি " নীলা, নীলা, সেই কোন ছোটোবেলা থেকে একসাথে খেলাধূলা করে বড় হচ্ছিলাম আমরা! তুই, আমি কত কাছে কাছে ছিলাম। তারপরে....তারপরে কখন আমরা দূরে চলে গেলাম নীলা? কাছে থেকেও কত দূরে!" তোর গলায় অপার্থিব বিষাদ এসে জড়ো হয়েছিলো। আমি শুধু চেয়ে দেখছিলাম তোর মাথার পিছনে দূরে গাছের মাথায় জ্বলছে নিভছে একঝাঁক জোনাকি।
আমি জানতাম সৌম্যকে তুই মিথ্যা কথা বলে বিষিয়ে দিয়েছিলি আমার সম্পর্কে! তুই পাগলের মতন প্রেমে পড়েছিলি, কিছুতেই ভাবতে পারছিলি না সৌম্য অন্য কাউকে ভালোবাসবে। তুই দিশাহারা উন্মাদিনী হয়ে গেছিলি সেই সময়। সব জেনেও আমি তোকে ক্ষমা করেছিলাম, সৌম্যর ভুল ভাঙাই নি।
সে যখন সর্বস্বান্তের মতন এসে আমার কাছে বললো, "তুমি একবার বলো নীলা, একবার শুধু বলো ওকথা ভুল, তুমি ও কাজ করো নি, করতে পারো না।" আমি একটি কথাও বলিনি তখন, না। পাথরের বাঁধ দিয়ে আটকে ফেললাম আমার অশ্রুসমুদ্র। তুই যে আমার বড় প্রিয় ছিলি রে শুক্তি, নিজের বোন থাকলেও সে বুঝি আমার এত প্রিয় হতো না। তাই তোকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে তোর ভালোবাসাকে চূর্ণ করা আমার স্বপ্নের অগোচর ছিলো। আমি চেয়েছিলাম তুই সুখী হ, তাতে আমার যা হয় হোক। এমনিতেও তো জীবনের কাছে আমার পাবার কিছু ছিলো না।
আজ কি বুঝতে পারিস শুক্তি? তোরা বাইরে চলে যাবার আগে সেই সন্ধ্যায় যখন আমার কাছে বিদায় নিতে এসেছিলি সেদিনও কি বুঝতে পেরেছিলি? তাই কি আকাশভরা বিষাদ ছিলো তোর গলায়? আমিই কি তাহলে ভুল ছিলাম? মিথ্যার ভিতের উপরে ভালোবাসার প্রাসাদ যে গড়া যায় না সেকথা কি জানিয়ে দেওয়াই উচিত ছিলো? তিন তিনটে জীবন কি তাহলে এমন নিরর্থক হয়ে যেতো না?
টলটলে সন্ধ্যাতারা ঝাপসা হয়ে যায় জলে, সব মুছে দিয়ে জেগে ওঠে তোর নীল হয়ে যাওয়া মুখ, ঠোঁট, চোখের পাতা। কেন কেন কেন শুক্তি? এমন কী ভাঙাচোরা কাটাছেঁড়া হয়েছিলো ভালোবাসার মলম দিয়ে যা জুড়ে দেওয়া যেতো না? নাকি তুই বুঝতে পেরেছিলি যাকে ভালোবাসা ভেবেছিলি তা ছিলো উন্মাদ মোহ?
না, সৌম্য আসে নি আমার কাছে। হয়তো সে বুঝেছে, হয়তো বা বোঝে নি। কী আসে যায়! আমিও তো তাকে সত্যি করে চাই নি! চাইলে কি অত নির্বিকারে সরিয়ে দিতে পারতাম? নির্বিকারেই কি? কেজানে!
দিনের পরে দিন যাবে, রাতের পরে রাত। এমনি করে মোহনা আসবে একদিন আমারও। আবার একদিন দেখা হবে রে শুক্তি, সেদিন তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। জানি, সেদিন তুই ঠিক উত্তর দিতে পারবি। আমারও যে ক্ষমা চাইবার আছে তোর কাছে! জানি তুই করবি, পৃথিবীর ছোট্টো পাথরঘরে যে ক্ষমা ধরে না, আকাশের ওপারে আকাশ সেই ক্ষমায় ভরে আছে।
রাত হলো, আসি এবার। ভালো থাকিস রে।
2.
এই পথ পাকদন্ডীর মত, ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়কে বেড় দিয়ে চূড়ার দিকে উঠছে। সেখানে কী আছে? সেই গল্পের মিনার, সেই অলৌকিক জ্যোৎস্নাপক্ষী, লৌকিক গল্পে যার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা উত্তাল হয়ে উঠেছে? জানি না।
ঘুর ঘুর ঘূরণপথে চলতে চলতে কুয়াশা সরে গিয়ে চমকে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ গাঢ় কমলা ফুল! সেই ফুল ছোঁয়ার আর্তি আঙুলের ডগায় নিয়ে বাতাস মাখা। কবে যেন এমন ফুলেদের দেখেছিলাম? সে কি কোনো শরতে নাকি বসন্তে? মনের কথাগুলো কি গুণগুণি পাখি হয়ে যায়, ছটরফটর করতে করতে পাখা ঝাপটে আকাশে পাড়ি দেয়? "পাগল বসন্তদিন এসেছিলো আমার আঙিনায় ....." সে কেমন পাগল? যে পাগল কেবল পাগল করে বেড়ায়?
ক্লান্তি জড়িয়ে ধরে নরম আদরে। চিকরিচিকরি পাতাওয়ালা গাছটার ছায়ায় বসি। ঐ একটু দূরের ঝর্ণাটা এখানে এক উচ্ছল কিশোরী নদী হয়েছে, পাথরে পাথরে খুশি খুশি ফেনা মাখিয়ে মাখিয়ে খেলতে খেলতে এগিয়ে যাচ্ছে নিচের মাঠের দিকে। শত শত মাইল পার হয়ে ও কি সমুদ্রে পৌঁছাতে পেরেছিলো? নাকি মাঝপথেই কোনো আশ্চর্য নীলনদ তাকে বুকে টেনে নিয়ে বিলুপ্ত করে দিয়েছিলো গভীর একাকারতায়? নাকি কোনো মরুভূমি শুষে নিয়েছিলো ওর সুধা? কেজানে! কিন্তু সব নদীই আসলে সাগরে পৌঁছায় ঠিকই। জলের সাগর বা আকাশের অদেখা সাগর! নইলে নতুন হবে কিকরে সে? আমার এই ব্যবহৃত জীর্ণ জীবনও যেমন একদিন মরণতীর্থে পৌঁছাবে।
নাহ, আর বিশ্রামে কাজ নেই, উঠে দাঁড়াই, ধুলাবালি কুটোকাটা ঝেড়ে ফেলি পোশাক থেকে। উপরে তাকাতেই রোদ্দুরের এক টুকরো সোনালী বাতাসা এসে পড়ে চিবুকে। চিরল-চিরল পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে সূর্য বলছে টুকি টুকি টুকি!
রুমী হাসছে, বলছে, " হয়ে গেল বিশ্রাম? চল তবে আবার রওনা হই।"
আমার গলায় আগ্রহ, "রুমী, কী আছে ওখানে?"
রুমীর চোখে দুষ্টু হাসির একটা ঝিলিক খেলে যায়, জবাব না দিয়ে সে গান শুরু করে, " কী ঈ ঈ আছে পথের শেষে"।
রাগ করে একটা ধাক্কা দেবার জন্য হাত তুলি, হাত শুধু ছুঁয়ে যায় একমুঠো বাতাস। আস্তে আস্তে আলগা মুঠো থেকে উড়ে যায় চিরকুটটা! রুমীর লেখা প্রথম চিঠি, কত বছর আগের সেই বসন্তোৎসবের সন্ধ্যা-উড়ে গেল সেই সব আকাশ রাঙানো পলাশ শিমূল অমলতাস, মনকেমনিয়া হাওয়ায় ভেসে আসা কুহু কুহু, সেই লাল সবুজ গোলাপী নীল আবীর, উড়ছে উড়ছে ঐ তো আমাদের কৈশোর উড়ে গেল চিরকুটের ডানায়। এ চিরকুটের কথা জানতো শুধু দু'টি মানুষ, আজ জানলো বাতাস, আকাশ, বনের ছায়াসবুজ।
রুমীর গানের গলা চমৎকার ছিলো, সে ছবিও আঁকতো খুব সুন্দর। কিন্তু ওর বাবামা তাকে চালচুলোহীন গায়ক বা ভবঘুরে চিত্রশিল্পী হিসাবে দেখতে চাইলো না। রুমী ও অভিমান করে ছেড়ে দিলো সব। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, এমনকি কবিতা পড়াও। কারিগরী বিদ্যা শিখতে যখন সে গেল দেশের অন্য প্রান্তে তখন তার পরিবারের সবার খুশি আর গর্ব দ্যাখে কে! ছেলে পড়েশুনে পাশ করে বড় চাকরি করবে, টাকাপয়সায় থৈ থৈ করবে তার দুনিয়া।
আরো একপাক ঘুরে গেছি এখন। রুমীর সঙ্গে তাল রাখতে পারি না। এরা এত তাড়াতাড়ি হাঁটে কেমন করে আর কেনই বা? আরেকটু আস্তেধীরে চললে কী এমন মহাশাস্ত্র অশুদ্ধ হয়? হাওয়া এখন হালকা, রোদ আরেকটু কড়া। আকাশ আরো নীল লাগে। হাতের মুঠো আলগা করে বাতাসে ভাসাই ওর দ্বিতীয় আর শেষ চিঠিটা। দূরের শহর থেকে লিখেছিলো আমাকে, অনেক কায়দা করে ওর বোনকে লেখা চিঠির খামের মধ্যে আরেকটা ছোটো খামে ভরে দিয়েছিলো। ওর বোন আমাকে লুকিয়ে এনে দিয়েছিলো চিঠিটা। চিঠির সমস্তটা জুড়ে বন্দী পাখির ডানা ঝাপটানি। সেই চিঠি কানের কাছে নিয়ে চুপটি শুয়ে শুয়ে সেই ডানার আর্তি শুনেছিলাম সারারাত। আমার আর কী করার ছিলো? কিছু কী করতে পারতাম? আজ এতদিন পরে সেই পাখি খাঁচা খুলে উড়ে গেল।
পৌঁছে গেছি চূড়ায়, একদিকে ভয় ধরানো খাদ, অনেক নিচে চিকচিক করে নদীটা। কিন্তু উপরে শুধু নীল, নীল, আরো নীল। অপরাজিতার মত নীল। আকাশ ছড়ায়ে গেছে কোথায় আকাশে....পালকের মতন সাদা মেঘেরা ভাসে ঐ নীল সমুদ্রে। আহ, কী সুন্দর!
রুমী, রুমীঈঈঈই, আমি বুঝতে পেরেছি, আমি দেখতে পেয়েছি সেই ম্যাজিক দরজাটা। খুলে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে দরজাটা। পালকের মতন হালকা লাগছে। চিঠি দু'খানা পেলি তুই? ও দুটোর মতন এবার আমিও...
Thursday, March 20, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment