উল্টোদিক থেকে আবার আরেক গেরো বাঁধিয়ে বসলেন কয়েকজন এক্সপেরিমেন্টালিস্ট৷ তাঁরা ইলেকট্রনের এমন এক ডিফ্রাকশন প্যাটার্ণ পেলেন যে লোকে তাজ্জব! ইলেকট্রনকে এতকাল কণা বলেই বোঝা যাচ্ছিলো, অথচ কিনা শেষে তার এই চিত্র! ডিফ্রাকশন শুধু তরঙ্গের হতে পারে, কণার ক্ষেত্রে হয় না৷ কণা একই সময়ে একটিমাত্র বিন্দুতেই থাকতে পারে, তাই তার বিন্দুচিত্রই পাবার কথা, কিন্তু তরঙ্গ স্পেসে ছড়িয়ে থাকে, তার ডিফ্রাকশন পাওয়া যায়৷যেমন আলোর বা এক্সরের ডিফ্রাকশন হয়৷ কিন্তু ইলেকট্রনের পাওয়া গেলো, পরে অন্য কোয়ান্টাম পার্টিকলেরও৷
তখন লুই দ্য ব্রগলী এক হাইপোথিসিস দিলেন, বললেন সমস্ত ভরবেগসম্পন্ন পার্টিকলের মধ্যেই আছে তরঙ্গধর্মীতা, নেহাত বড়ো বড়ো পার্টিকলের ক্ষেত্রে এটা বুঝতে পারা যায় না,কারণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য খু-উ-উব কম৷ তিনি সমীকরনও দিলেন,ওয়েভলেংথ = প্লাংক ধ্রুবক/ মোমেন্টাম৷
আস্তে আস্তে নানা পরীক্ষায় ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেলো৷ বোঝা গেলো ক্ষুদ্র জগত্টা আমাদের দেখা জগতের মতন নয়, সেখানে কণা ও তরঙ্গ আলাদা করে সুসংজ্ঞিত করা যায় না৷ ডুয়ালিটি ধারনাটা তখনি এলো৷ সমস্ত ইলেক্টোম্যাগ্নেটিক ওয়েভ যেমন তরঙ্গ তেমনি কণাও৷ তেমনি প্রতিটি কোয়ান্টাম পার্টিকল একাধারে কণা ও তরঙ্গ৷
পরে এই ব্যাপারটা হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিংগার আরো ভালো করে গণিতের ফ্রেমে বসান৷হাইজেনবার্গ আবিষ্কার করেন অনিশ্চয়তা তত্ব৷ কোনো একটি কোয়ান্টাম পার্টিকলের ভরবেগ যত নিখুঁত জানতে চেষ্টা করা হবে,তত তার অবস্থান সম্পর্কে ধারনা কমবে৷ যত নিখুঁত মাপতে চেষ্টা করা হবে একটি প্রপার্টি, তার কনজুগেটটি সম্পর্কে ততই কম নিখুঁত হবে মাপ৷ দুটোর গুণফল হবে একটি নির্দিষ্ট মানের বেশী, সেই মানটি প্লাংক ধ্রুবকের সঙ্গে তুলনীয়৷
আর এই মাপা বা পর্যবেক্ষণ কোয়ান্টামে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ যতক্ষণ না মাপা হচ্ছে বা কোনোরকম পর্যবক্ষণের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে কি তার এনার্জী বা মোমেন্টাম বা পোজিশন, ততক্ষণ পর্যন্ত নাকি সেই সেই অবস্থাগুলো নির্দিষ্ট থাকে না,থাকে অনেকগুলো সম্ভাবনার সমষ্টি হয়ে যাকে কিনা এরা বলেন সুপারপোজিশন অব স্টেটস৷
এই ধারনা জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা প্রচন্ড চ্যালেঞ্জের ব্যাপার৷ আমাদের মাপার বা পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতাটাকেই একটা নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তার উপরে একটা হার্ডকোর জ্ঞানের ক্ষেত্র তৈরী, রীতিমতো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার৷ কিন্তু মজা হলো সব পরীক্ষায় সমর্থন পাওয়া যেতে লাগলো৷ আরো আরো সূক্ষ্ম যন্ত্র আরো আরো সূক্ষ্ম পরীক্ষা, আরো আরো সমর্থন৷ না মেনে উপায়? কাজে লেগে যেতে লাগলো যে! আইনস্টাইন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অদ্ভুত্ বিজ্ঞানকে মেনে নিতে পারেন নি৷ তিনি চিরকাল বলেছেন এ সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নয়, একটা অসম্পূর্ণ তত্ত্ব৷ এটা আরো গভীরতর সত্যের বাইরের ঢাকনা শুধু৷ কিন্তু পরীক্ষায় যদি ক্রমাগত সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে কি আর করা যাবে?
আইনস্টাইন ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্টের ব্যাখার জন্য নোবেল পান বটে,কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী চমকে দিয়েছিলেন রিলেটিভিটি দিয়ে৷ এখন প্রায় শতখানেক বছর হয়ে গেলো তিনি আবিষ্কার করেন প্রথমে বিশেষ আপেক্ষিকতা পরে সাধারণ আপেক্ষিকতা৷ এই দুটো আমাদের জানার জগত্টাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলো প্রচন্ড৷
ম্যাক্সোয়েলের ইলেকট্রিসিটি আর ম্যাগনেটিজমকে মিলিয়ে দেয়া চারটে সূত্র জানা যাবার পর থেকেই জানা ছিলো ইলেক্টোম্যাগনেটিক ওয়েভেরা সব কোনো মিডিয়া ছাড়াই ভেক্টর ফিল্ডের ওঠানামার তরঙ্গ হিসাবে স্পেসে ছড়িয়ে পড়ে৷ আর শূন্যে এদের গতিবেগ সবসময় সমান,সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, আলোর বেগ৷ সর্বদা এই গতি৷
আইনস্টাইন তরুণ বয়স থেকে এই নিয়ে ভাবতেন৷ তিনি ভাবতেন যদি তিনি একটা গাড়ীতে চড়ে অন্য গাড়ীর পাশাপাশি চলেন তাহলে নিজের সাপেক্ষে অন্য গাড়ীটার গতি কমতে বা বাড়তে দেখেন৷ আলোর ক্ষেত্রেও কি তাই দেখবেন? উনি যদি আলোর সঙ্গে তুলনীয় প্রচন্ড গতিতে ছুটতে থাকেন, তাহলে কি হবে? নিজের সাপেক্ষে আলোর বেগ কি অনেক অনেক কম দেখবেন? এটা আবার ম্যাক্স-ওয়েলের ধারনার বিরোধী, ইএম ওয়েভের গতিবেগ একই থাকবে বলছে ম্যাক্সোয়েলের সূত্র৷
এই পাজল থেকে দুনিয়া উদ্ধার করতে বহুলোকে চেষ্টা করেছেন,তাত্বিকভাবে যারা চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে লোরেঞ্জ আর ফিটজেরাল্ড প্রথম সারির৷ লোরেঞ্জ কতগুলো সঠিক ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন, স্পেসের তিনখানা কো-অরডিনেট আর টাইমের একখানা -এই চারটের ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন৷ সেগুলো পরে আইনস্টাইন ব্যবহার করেন সঠিক ধারনার ফ্রেমের উপরে৷ মাইকেলসন আর মর্লির পরীক্ষাতেও প্রমান হয় আলোর গতি সর্বদা একই থাকে,আমরা তার দিকে ছুটে যেতে যেতেও তার বেগ ঐ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইলই দেখি৷ বেশী দেখি না৷
এই পাজলকে বিশেষ আপেক্ষিকতা দিয়ে সলভ করেন আইনস্টাইন৷ তিনি উলটোদিক থেকে আসতে শুরু করেন, ঐ থিওরি শুরুই করেন দুখানা স্বত:সিদ্ধ নিয়ে, ১ হলো আলোর বেগ সবসময় সেকেন্ডে তিন লাখ কিমিই থাকবে, কোন রেফারেন্স ফ্রেম থেকে দেখা হচ্ছে তার উপরে কোনোভাবেই নির্ভর করবে না৷ ২ হলো সমস্ত ত্বরনহীন রেফারেন্স ফ্রেমে ফিজিক্সের সূত্রসমূহ একই থাকবে৷
মাত্র এই দুখানা সরলসহজ ধারনা দিয়ে শুরু হয়ে গড়ে উঠলো স্পেশাল রিলেটিভিটি৷ এই তত্বে ভর করে জানা গেলো সময়ের মাপ অন্যরকম হয়ে যাওয়া, যাকে বলে টাইম ডাইলেশন, গতির সমান্তরালে রাখা দন্ড বেঁটে হয়ে যাওয়া যাকে বলে লেংথ কন্ট্রাকশন৷ তাই থেকে সেই যমজ ধাঁধার ব্যাপার এলো, আমার ঘড়ির এক সেকেন্ড যদি আমার মহাকাশযাত্রী যমজ ভায়ের ঘড়ির আধা সেকেন্ড মাত্র হয়, তাহলে আমার যখন চল্লিশ বছর কেটেছে,ওর মাত্র কুড়ি৷ সে ফিরে এলো আমার ষাট বছর বয়সে, নিজে মাত্র চল্লিশ!!! ওদিকে আবার ব্যাপারটা আপেক্ষিক! মানে সেই ভাইও মনে করেছে আমার ঘড়ি আস্তে চলেছে ওর তুলনায়৷ জবর ধাঁধা! পরে স্পেশালের বছর দশেক বাদে জেনারেল রিলেটিভিটি দিয়ে সমাধান করা হলো এর৷ সেই গলপ পরের কিস্তিতে।
Tuesday, March 25, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment