মাঠের মধ্যে চৌকোনা একটা বড় জায়গায় খানিকটা মাটি তুলে ফেলে সাদা বালি দিয়ে ভরাট করা, সেই বালিটুকুর একটু আগে চুন দিয়ে একটা সাদা মোটা দাগ দিলেন সুচরিতাদি, উনি ছিলেন আমাদের স্পোর্টসের দিদিমণি। বললেন, ঐ দূর থেকে দৌড়ে এসে এই দাগের আগে থেকে লাফ দিয়ে উঠে উড়ে গিয়ে পড়তে হবে ঐ বালিতে।
তখন আমরা ক্লাস সেভেনে, যারা যারা ট্রায়াল দিতে ইচ্ছুক, চলে গেলাম দূরে। তারপরে একে একে দৌড়ে দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে পড়ছে মেয়েরা, সুচরিতাদি আর আরো দু'জন দিদিমণি কে কতটা লাফালো মেপে দেখে দেখে নির্বাচন করছেন ফাইনালের জন্য। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে গেছে বলে দিদিমণিরা তাড়া দিতে থাকায় আমরা করলাম কেলেঙ্কারি, দুর্গা বেশ ভালো লাফিয়েছিলো, কিন্তু ও ওঠার আগেই আমি গিয়ে লাফিয়ে পড়েছি প্রায় ওর ঘাড়েই বলা যায়, আর দেখতে না দেখতে আমার ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়েছে সুশোভনা ! তিনজনকেই অবশ্য সিলেক্ট করলেন সুচরিতাদি। আর আমাদের তিনজনকে কী বকুনি, এভাবে ঘাড়ে ঘাড়ে লাফানোর জন্য!
তখন শীতকালে হতো স্কুল-স্পোর্টস। জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীর মধ্যেই করে ফেলতে চেষ্টা করতেন দিদিমণিরা, কারণ তার পরেই চড়া হয়ে উঠতো রোদ। ঐ সুবাদে কয়েকদিন বেশ খোলা মাঠে অন্যরকম দিন কাটতো আমাদের। ট্রায়ালের দিনগুলোতে সার বেঁধে সবাই সেই বড়মাঠের দিকে যাওয়া, সেখানে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড় বা সাইকেল রেস বা হাই জাম্প লং জাম্পের ট্রায়াল আর যারা যারা সিলেক্টেড হলো তাদের নাম তুলে নিতেন সুচরিতাদি তাঁর বড় খাতায়।
ওসব দিনগুলো বেশ মজার, শুরুর একটা ক্লাস হয়েই দিদিমণিদের সঙ্গে মাঠে যাওয়া, বেশ কয়েকঘন্টা খোলা আকাশের নিচে ঝকমকে শীতের রোদে মাঠে কাটতো। বেশ চনচনে ফূর্তির দিন। ভূগোলের ক্লাসে দাঁড় করিয়ে দিদিমণি কোথাকার কোন গ্রেট বেরিয়ার রীফের প্রশ্ন ধরছেন না, ইতিহাসের ক্লাসে কোথায় কোন বিম্বিসার অজাতশত্রু চন্দ্রগুপ্ত বখতিয়ার খিলজী বাবর আকবর কে কী করেছিলেন বলতে হচ্ছে না, বেশ খোলামাঠে দৌড়োদৌড়ি আর সুযোগ পেলে মাঠের পাশের দিকে গিয়ে ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে ফুচকা খাওয়া হচ্ছে। এমনিতে ফুচকা আলুকাবলিওয়ালারা স্কুলের সামনের রাস্তায় ফুচকা-আলুকাবলি নিয়ে দাঁড়াতো, কিন্তু ট্রায়ালের দিনগুলোতে ওরাও মাঠের পাশে।
কাছের বয়েজ স্কুলের বেশ কিছু ছেলে কেমন করে জানি ক্লাস কেটে মাঠে এসে আমাদের ট্রায়ালগুলো দেখতো। তা দ্যাখ বাপু, দিদিমণিরাও কিছু বলতেন না। এমনিতে ফাইনাল তো রবিবারে হয়, সেদিন তো জনসাধারণ সকলেই দেখতে আসতে পারে, ক্লাস পালানোরও কোনো দরকার হয় না। কিন্তু ওরা ট্রায়াল ও ছাড়তে রাজি না, সেসব দিনেও দেখতে আসতো।
তারপর এক রবিবারে ফাইনাল, সেই বড়মাঠেই। সকাল থেকে সেদিন হৈ চৈ, মাঠের একপাশে প্যান্ডেল, প্যান্ডেলের উপরে লাল নীল কাগজের টুকরোর সাজ, শীতের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, সেখানে দিদিমণিরা সব মাড় দিয়ে ইস্ত্রী করা ফরমাল পোশাকে, ওঁদের পোশাক ছিলো লালপাড় সাদা শাড়ী। কারুর কারুর কাঁধে ভাঁজ করা শাল। প্যান্ডেলে মাইক-টাইকের ব্যবস্থাও থাকতো। ইভেন্ট ঘোষণা, নামঘোষণার ব্যাপার ছিলো তো! তারপরে বিজয়ীরা ভিকটরি স্ট্যান্ডে উঠলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর ব্যাপারও ও ছিলো।
সকালসকাল মার্চ পাস্ট, তারপরে প্রতিযোগীরা লাইন করে এসে ব্যাজ লাগিয়ে নিতো বাঁ-কাঁধের সামনের দিকে। কারণ দুপুরের প্যাকেট লাঞ্চ তো কেবল অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরাই পাবে, সেটা নেবার সময় ব্যাজটা থাকতে হবে। একে একে স্পোর্টস ইভেন্টগুলো হতে থাকতো, আর প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় এই বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। ওরা তিনজনে দাঁড়াতো ভিকটরি স্ট্যান্ডে, আর মাইকে তখন গান বাজতো, জাতীয় সংগীত।
তখন ফটোর এত চল ছিলো না, প্রি-ডিজিটাল যুগ, ফটো তখন অনেক হ্যাপা হাঙ্গামার ব্যাপার। আহা কত বন্ধুদের ঘামে ভেজা ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত বিজয়োল্লাসভরা মুখ মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল, ফটোতে বাঁধা রইলো না। আমাদের ছোটো সেই গাঁ-মফস্বলে সেই সামান্য স্পোর্টসই তো যেন টিভিতে দেখা অলিম্পিকের স্বপ্নরাজ্য। আসল জিনিস তো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু যা পাওয়া যায় তাই না কম কী? আর সেই কৈশোরকালের স্পিরিট, সেই তো সমস্ত বাস্তবতাকে পার হয়ে স্বপ্ন দেখতে শক্তি দেয়, তাই না?
স্কুল স্পোর্টসের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে হাসিকে। প্রাণবন্ত সতেজ কিশোরী ছিলো হাসি, খুব ভালো দৌড়তো ও। ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড়ে ওর ফার্স্ট প্রাইজ নিশ্চিত ছিলো। সারাবছর ক্লাসের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতো যে মেয়ে, অঙ্কের ব্যাপারে যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো, পড়ার যেকোনো বিষয়ই যার কাছে ভীতিকর ছিলো, তার ঝকঝকে উজ্জ্বলতা ফেটে পড়তো এই স্পোর্টসের দিনগুলোতে। স্কুল স্পোর্টসের বাইরেও সিরিয়াসলি খেলাধূলা করতো হাসি, জেলাস্তরের প্রতিনিধিত্ব করতে শুনেছি নানা প্রতিযোগিতায় যেত। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলো না, ক্লাস এইটেই পড়াটড়া ছাড়িয়ে ওর বাড়ীর লোক ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললো। তারপরে খেলাধূলার কথা ভাবা তো স্বপ্নেরও অগোচর। অথচ এইসব মেয়ে সুযোগ পেলে হয়তো একদিন অলিম্পিক অবধি পৌঁছতে পারতো।
আজ ফিরে দেখলে তাই বারে বারে আমাদের ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইচ্ছে হয়, এই যে খেলায় ভালো মেয়েটি, ওকে খেলার জন্যই তো আলাদা করে সুযোগ করে দিয়ে রাজ্যস্তরে নির্বাচিত হবার ব্যবস্থা করতে পারতো স্কুল লেভেল থেকেই, যদি স্পোর্টস ব্যাপারটা শুধু কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে সারাবছরের ব্যাপার হতো। কিংবা যদি সাধারণ স্কুল থেকে খেলায় ভালো এইসব মেয়েদের বেছে নিয়ে স্পোর্টস স্কুলে ঢোকানোর ব্যবস্থা থাকতো। সেরকম স্কুলই বা কোথায় ছিলো তেমন? "কোনি" সিনেমাটা যতবার দেখি ততবার মনে পড়ে হাসিকে। দেখি খাঁ খাঁ ধূ ধূ অলিম্পিক রেকর্ড আমাদের, আর মনে পড়ে হাসিকে, শুকনো মুখে স্কুল ছেড়ে খেলাধূলো ছেড়ে ঘোমটা মাথায় সংসারে ঢুকে পড়ছে চোদ্দো পনেরো বছর বয়সে। হয়তো এরকম হবার ছিলো না। বাস্তববাদীরা ধমক দিয়ে বলে, আরে আগে তো পড়াশুনো, যাতে একটা চাকরিবাকরি জোটে, থাকা খাওয়ার সুসার হয়, তারপরে না খেলা! ওসব লাটসাহেবী কি আমাদের চলে!
তারপরে তো আমাদের খেলাধূলাও বন্ধই হয়ে গেল প্রায়, নাইনে টেনে স্কুল স্পোর্টসেও অংশ নেওয়া বিলাসিতা, তখন তো মাধ্যমিকের রেস শুরু হয়ে গেছে কিনা! এখন ফিরে দেখলে সেই সিক্স সেভেন এইটের সেই সব ক্লান্ত পরিতৃপ্ত রবিবারের বিকেল মনে পড়ে, স্পোর্টস ফাইনালের শেষের দিক, গো অ্যাজ ইউ লাইক হচ্ছে, নানারাকম সেজে গেছে প্রতিযোগীরা, কেউ পা হারিয়ে ফেলা সৈনিক, কেউ পাগল ভিখারি, কেউ মেলার যাদুকর। শেষ মুহূর্তের আনন্দ। চেনা মানুষেরা কেমন অচেনা হয়ে গেছে! সেই ইভেন্টের বিচার হয়ে গেলেই ফাইনাল শেষ সেই বছরের মতন। তারপরে সারাদিনের সব ইভেন্টের প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে, পরদিন ছুটি ঘোষণা হয়ে গেছে। কেমন আশ্চর্য একটা শীতের বিকেল, খোলা আকাশের নিচে একটি দিনের কার্নিভাল যেন আমাদের। সেই তখন, যখন আমরা জীবন্ত ছিলাম!
(চলবে)
Friday, March 28, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment