ক্লাস থ্রীতে শুরু হলো "হাতের কাজ" বলে একটা বিষয়ের ক্লাস। নানারকম কান্ড করতে হতো সেখানে, নারকেল দড়ি দিয়ে পাপোষ বানাতে হতো, রুমালে ফুল-লতা-পাতার সূচীকর্ম করতে হতো, রঙীন কাগজ বিশেষভাবে কুচি দিয়ে দিয়ে বাহারী মালা বানাতে হতো, মাটির আপেল কলা কমলালেবু আম--এইসব বানাতে হতো, সেগুলোর উপরে আবার রঙও লাগাতে হতো। কমলালেবুতে কমলা রঙ, সরলসোজা খানিকটা। কিন্তু সিঁদুরে আমে ঘন সবুজ আর বোঁটার কাছে লালের ছোঁয়া-এটা বেশ একটু জটিলরকম। আপেলে দিতে হতো কালচে লাল(তখন আমরা সবুজ আপেল বা হলুদ আপেলের নামও শুনি নি, দেখা তো দূরের কথা), পাকা কলায় হলুদ আর কাঁচকলায় সবুজ।
উলের কাজও করতে হতো, দুই কাঁটার সোজাসরল কাজ, ঘর তোলা আর উল্টো সোজা বুনতে পারলেই হতো, দুই ঘর সোজা দুই ঘর উল্টো এই প্যাটার্নে বুনে যেতে হতো, বেশ লম্বা হয়ে মাফলার হয়ে গেলেই ঘর মেরে দিতে হতো। এই মাফলারের দুই প্রান্তে ঝুলুর ঝুলুর উলের গুছি বেঁধে বেঁধে জিনিসটার মধ্যে একটা স্পেশাল এফেক্ট দেওয়া হতো।
এ ছাড়াও অন্যরকম কাজও করতে হতো, একবার মাটির ছোট্টো কুটির বানাতে হয়েছিলো, ঘরের চৌচালাটা পিচবোর্ড দিয়ে বানিয়ে ব্রাউন পেপার দিয়ে মুড়ে একটা বেশ খড়ের চালের এফেক্ট আনতে হয়েছিল। সেই কুটিরে ছিলো ছোট্টো দরজা আর ছোটো ছোটো দুই জানালা। দরজার ঠিক সামনে মাটিতে আল্পনা, সেটা করা হয়েছিলো সাদা কাগজ নকশা করে কেটে তারপরে আঠা দিয়ে মাটির উপরে জুড়ে। চালের উপরে সবুজ কাগজ দিয়ে বানানো হয়েছিলো লাউগাছ।
এই হাতের কাজের ক্লাস ছিলো একটা হুল্লোড়বিশেষ, দিদিমণি কেউ এই ক্লাসে বেশীরভাগ দিনই থাকতেন না, সবাই ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে উচ্চগ্রামে গল্প করতো। কে আর বসে বসে সেলাই করে কিংবা নারকোল দড়ি দিয়ে পাপোষ বানায় ক্লাসে? বিশেষ করে শিক্ষিকা যখন শেখাচ্ছেন না? আর, এসব সূক্ষ্ম জিনিস ক্লাসে বসে ঠিক হয়ও না, এগুলো তো বিরাট খোলা মেঝেতে বসে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে করতে হয়, তাই না? মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে বাঘের মতন হুংকার দিয়ে ঢুকে পড়তেন "হাতের কাজ" এর দিদিমণি, "এত গন্ডগোল কীসের? কই, দেখি কী হাতের কাজ করছো তোমরা?" বাঘের মতন গলায় জিজ্ঞেস করতেন। তখন সবাই চুপ, পিন পড়লে শোনা যায়। এমন সময় ঢং ঢং ঢং, ছুটির ঘন্টা। আর আমাদের পায় কে? ঐ ক্লাসটাই শেষ ক্লাস কিনা!
এই "হাতের কাজ" এর কোনো পরীক্ষা হতো না, শুধু কাজগুলো জমা দিতে হতো নির্দিষ্ট সময়ে। বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই এসব কারু না কারুকে দিয়ে করিয়ে আনতো, শুনেছিলাম সামান্য কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এসব করে দেবার মতন "প্রফেশনাল" লোকেরাও নাকি আছেন। তবে অনেকেই কিছু কিছু জিনিস নিজের আগ্রহে শিখতো, যেমন উলবোনা বা মাটির জিনিস বানানো--যা পরবর্তীকালে মাধ্যমিক পর্যায়ে খুব কাজে লেগেছিলো।
সেকালে মা-কাকীমারা উলবোনা নিয়ে কেন যেন খুব উৎসাহী ছিলেন। নানা জায়গা থেকে উলের নানা বিচিত্র ডিজাইন তুলে আনতেন, তারপর সেইসব ডিজাইন লাগিয়ে ফুলহাতা গলাবন্ধ সোয়েটার, ভি গলা হাতকাটা সোয়েটার, ভেস্ট, জাম্পার, জ্যাকেট এসব বুনতেন। বিকালের দিকে মাঠে আমরা যখন খেলতাম, মাঠের একধারে পাড়ার কাকীমাদের উলবোনার আসর বসতো, খোলা হাওয়ায় বসাও হলো, আবার উলবোনাও হলো।
উলবোনা জিনিসটার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিলো যে আমরা খুব ছোটোবেলাতেই নারকোল শলা নিয়ে উলের কাটা বানিয়ে সামান্য কিছু ফেলে দেওয়া উল নিয়ে ঘর তুলতে শিখতাম, কী করে সোজা বোনে কী করে উল্টো বোনে সেসব শিখতাম, তাই উলের কাজে আমাদের অনেকেরই সেরকম অসুবিধা হয় নি। মাঝে মাঝে ঘর পড়ে গেলে মুশকিল হতো, হয়তো খেয়াল না করে পরের পর বুনে গেছি অনেকবার, তারপরে ধরা পড়লো নিচে ঘর পড়ে গেছিলো, ওখানে ডেঞ্জারাস এক গ্যাপ ব্ল্যাক হোলের মতন রয়ে গেছে, যেটা থাকলে পুরো বোনাটাই বৃথা। সব খুলে যাবে। তখন হড়াশ করে কাঁটা খুলে ফেলে হড়হড় করে সবটা বোনা খুলে ফেলতে হতো ঐ পড়ে যাওয়া ঘর অবধি, তারপরে আবার নতুন করে বুনতে হতো। পরে, অনেক পরে বড় হয়ে শিখেছিলাম কী করে পড়ে যাওয়া ঘরও সামাল দেওয়া যায় উপরের বোনা সব না খুলে ফেলেও, কিন্তু সেসব অনেক পরের কথা।
প্রাইমারি স্কুলে যে সরলসোজা উল্টোসোজা উলবোনা শেখার শুরু সেটা মাধ্যমিক স্তরে অনেক বেড়ে গেছিলো, তখন নানা ধরনের ডিজাইন ও বুনতে হতো। ক্লাস সেভেনে লজেন্স প্যাটার্নের এক থ্রী কোয়ার্টার হাতা জ্যাকেট বুনতে হয়েছিলো। লজেন্স প্যাটার্ণ আমার দেওয়া নাম, কিন্তু জিনিসটা একেবারে সেই সেকালের লজেন্স মোড়ানো থাকতো যেই কায়্দায় সেরকম দেখতে। পরপর সারি সারি লজেন্স। প্রতিটা লজেন্সের উপরের আর নীচে ঐ লম্বা লম্বা তিন স্ট্রিং এদিকে আর তিনস্ট্রিং ওদিকে কীকরে যে ক্রস করবে সেটা শেখার আগে ভারী রহস্যময় লাগতো, শেখার পরে বড়ই আনন্দ হয়েছিলো। গণিতজ্ঞ দেখলে বলতেন তৃতীয় মাত্রার ব্যবহার।
যাইহোক যেজন্য এই "হাতের কাজ" ক্লাসটার কথা এত সাতকাহন করে বলা, সেটা হলো "সংগ্রহ পুস্তিকা", ক্লাস ফোরে হাতের কাজ এর ক্লাসে একেবারে শুরুতেই আমাদের বলে দেওয়া হলো যে আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের সারা বছর ধরে অন্যান্য রেগুলার হাতের কাজ এর পাশাপাশি একটি "সংগ্রহ পুস্তিকা" বানাতে হবে।
একটি মোটাসোটা খাতায় একেকপাতায় পাখির পালক, নানা গাছের পাতা, খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া আশ্চর্য কোনো কিছুর ছবি---এইসব আটকাতে হবে। বাঁদিকের পাতায় থাকবে জিনিসটা আর ডানদিকের সাদা পাতায় জিনিসটা সম্পর্কে লিখতে হবে, জিনিসটা কী, কোথায় পাওয়া গেল, এর গুরুত্বই বা কী, কোনো কাজে লাগে কিনা এইসব। ছোটোখাটো একটা পরিচয় আরকী। পরে, অনেক পরে জেনেছিলাম স্যাম্পল ওভাবে আটকায় আর পাশে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও ওভাবে দেয়। কিন্তু ক্লাস ফোরে ওসব জানতাম না। তখন ওটা ছিল ভারী অদ্ভুত আর অন্যরকম এক "হাতের কাজ" এর অ্যাসাইনমেন্ট যা কিনা সারাবছর চলবে, শেষে বার্ষিক পরীক্ষার আগে ওটা জমা দিতে হবে "হাতের কাজ" এর দিদিমণিকে।
বক, কাক, পায়রা, টিয়া, শালিক, ময়ূর--- এসব পাখির পালক তো সহজেই পেলাম, ময়ূরের পালক একটা শো-পীস থেকে পেয়েছিলাম, কিন্তু নীলকন্ঠ ইষ্টিকুটুম মৌটুসী বউকথাকও হরিয়াল মুনিয়া এদের পালক তো আর পাই না! এইসব পাখি এমনিতেই কালেভদ্রে দেখা যেত, তো আবার তার পালক! শেষে মুর্গীর পালক নীল হলুদ লাল এইসব নানা রঙে ডুবিয়ে নীলকন্ঠ ইত্যাদির বলে চালিয়ে দেবার একটা প্ল্যান করেছিলাম, কিন্তু শেষে আর করা হয় নি। গাছের পাতার সেকশনটা ভালোই উতরে গেল, আম জাম কাঁঠাল স্বরূপা আমলকী সজনে শিউলি রিঠা টগর বকুল দোপাটি গোলাপ জবা নয়নতারা কাঞ্চন তুলসী এইসব গাছের পাতা বেশ সুবিধাজনক সাইজের আর বিচিত্র আকারের বলে খাতার পাতায় বেশ ভালো করে ধরেও গেল আর বেশীরভাগ গাছই ছিলো বাড়ীর চারিপাশেই।
এসব তো বেশ চলছিল, হঠাৎ মনে হলো আরে একটা স্পেশাল সেকশন করলে কেমন হয়? অদ্ভুত প্রাণীদের সেকশন? তখন আবার চারিদিকে বেশ একটা আলোড়ন পড়েছে লকলেসের দৈত্য নেসি নিয়ে। তো, তাই করলাম, অদ্ভুত প্রাণীদের সেই সেকশনে কাগজে বেরোনো লকলেসের দৈত্যের লম্বা গলা ছবিটা দিলাম।(এখন সবাই জানেন যে ওটা ফেক ছবি ছিলো, যারা দাবীটা করেছিলো তারাই ওটা কায়দা করে বানিয়েছিলো ) যাইহোক সংগ্রহ পুস্তিকা জমা পড়ার পরে ঐ লকনেসের নেসি নিয়ে কী কেলেংকারি হয়েছিলো সেকথা পরে কখনো বলবো।
(চলবে)
Monday, March 31, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
1 comment:
amrao baniyechhilam dori-r paposh. narkel-er mala diye wall hanging. khub cholto shampoo-r shishi diye banano putul aar parachute narkel tel-er kouTo te ek dhoroner nylon-er phite keTe bosano aanaros. wool bunte shekha aaro pore. ashatto pata-r jali baniye taar opor chhobi e`nke greetings card banano hoto. babla gachher daal jogar kore taar kaa`nTaay bhuTTa-r dana ge`nthe gaachh. dhu`ndhul-er chhobRa kete banano paakhir basa o bhari sundor hoyechhilo.
Post a Comment