Friday, March 28, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৯)

টেবিলজুড়ে ছড়ানো এলোমেলো বইপত্তরের উপরে ঝিঁ ঝিঁর কাঁপন। তুলে নিই মুঠাফোনটা, ওপারে অন্বেষা। " কী রে তুলি, এই উইকেন্ডে ফ্রী আছিস? একজায়গায় যেতাম তাহলে।"

" প্রথমদিন ফ্রী, সেদিন হলে যেতে পারি।"

"ঠিক আছে। আমি তাহলে সকালে এসে তোকে পিকাপ করে নেবো। এই নটা নাগাদ। রেডি থাকবি।"

"কোথায় নিয়ে যাবি রে? "

"সে দেখবি তখন, এখন বলবো না। " ওর হাসি শুনতে পাই।

শনিবারে ও এসে পড়ে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নটায়। আকাশ ভরে রোদ ঝলমল করছে তখন। আমি তৈরী ছিলাম, ওর কল পেয়েই বেরিয়ে এসে উঠে পড়ি ওর বাহনে। টলটলে নীল আকাশ, সোনালি চুমকি লাগানো ওড়নার মতন রোদ। এইরকম দিন আসলে বেড়ানোর জন্যই আসে। এই রোদ কি ঘরে থাকতে দেয়? হাত বাড়িয়ে ডাকে।

ঘন্টা দুই পরেই আমরা পৌঁছে যাই, সত্যিই অপূর্ব। একপাশে নদী, তার পারে বিরাট বাগান। সেখানে একটু পরে পরেই লতাগৃহের মতন। লতাগৃহ মানে আটকোণা পাথরের বেদী, উপরে ঢালু গোল ছাদ, কিন্তু চারিপাশে দেয়াল নেই, কয়েকটা থাম। থামগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে পল্লবিত লতা, কোনো কোনো লতায় ফুল ও ফুটেছে। এরকম ঘরের স্বপ্ন দেখতাম অবুঝবেলায়।

বিরাট বিরাট সব মহীরুহ চারিদিকে, পাতায় পাতায় লাল হলুদ কমলা রঙ সবে ধরতে শুরু করেছে। হেমন্তে ঝরে পড়ার আগে সব একেবারে লালে লাল হয়ে যাবে। আমরা দু'জনেই একমত হই যে তখন আবার একবার আসতে হবে।

সারাদিন এখানে থাকবো, আসার পথে দোকান থেকে খাবার আর পানীয় কিনে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং সেদিক দিয়েও নিশ্চিন্ত।

"দেশে আমরা প্রকৃতির এই দিকটা দেখতে পাই নি, নারে টেঁপি? এভাবে এমন তুমুল ফল কালার ধরে এত এত গাছ পাতাহারা হয়ে যায় আবার অফুরাণ শক্তি নিয়ে সব পাতা ফিরে আসে মার্চের শেষাশেষি বা এপ্রিলের শুরুতে , এ জিনিস দেখিনি। সেখানে তো প্রায় সবই চিরহরিৎ গাছ। "

"আবার টেঁপি? এই নামটা এমন করে তোকে চেপে ধরলো? " অন্বেষা রাগ-রাগ গলায় বলতে চেষ্টা করেও হেসে ফেললো।

আমরা বাগান থেকে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়ে একেবারে নদীর কাছে গিয়ে পাথরের উপরে বসি। ঝুঁকে নদীকে ছুঁই, নদীর জল স্বচ্ছ আর ঠান্ডা। এত স্বচ্ছ যে নিচে নুড়িপাথর আর বালি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

অন্বেষা বলে, " তুলি, ভাবতেও অবাক লাগে, এত বছর পরে এই সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আবার আমাদের দেখা হলো আর আবার বন্ধুত্ব হলো। আসলে এখনকারটাই মনে হয় বেশি সত্যি, এত বছর স্কুলে পাশাপাশি পড়েছি বটে কিন্তু তখন মনে হয় তোরা কেউ আমার খুব কাছের ছিলি না কোনোদিনই। ছিলি কি? "

জিনস-জ্যাকেট পরা ববছাঁট চুলের অন্বেষা মিলিয়ে গিয়ে আমার সামনে ম্যাজিকের মতন ফুটে ওঠে সেই ক্লাস সিক্স সেভেনের অন্বেষা, দুইবেণী করা চুল, বেণীর ডগায় সাদা রেশমী ফিতে ফুলের মতন করে বাঁধা। সাদা শার্টের উপরে সবুজ টিউনিক পরা অন্বেষা। আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম ছিলো ওরকম ক্লাস এইট পর্যন্ত মেয়েদের জন্য, তার পরে নাইনে টেনে পরতে হতো সবুজ পাড় সাদা শাড়ী। শাড়ী পরা একবেণীর অন্বেষাকেও মনে পড়ে, তবে বেশী গাঢ় হয়ে মনে আসে সেই সাদা শার্ট সবুজ টিউনিক পরা কিশোরীই।

ক্লাস ফাইভে-সিক্সে সে ছিলো আমাদের রাইজিং স্টার, প্রাইমারি স্কুলে যাকে চোখেই পড়তো না, সে কিনা এরকম আউট অব দ্য ব্লু ফার্স্ট হয়ে জ্বলে উঠলো নতুন স্কুলে এসে? পুরনো স্কুলে যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হতো, তারা তো রীতিমত আহত, তারপরে ঈর্ষান্বিত। প্রথমে মনে হয়েছিলো অঘটন ঘটে গেছে ক্লাস ফাইভের ষান্মাসিকের আর বাৎসরিকের রেজাল্টে, পরে আর এরকম হবে না। কিন্তু তা না, এরপরে প্রতিটা পরীক্ষায় অন্বেষা প্রথম, শুধু তাই না, প্রতিটা সাবজেক্টে ওরই নম্বর সর্বোচ্চ। ক্লাসের যেসব মেয়েরা পরীক্ষাগুলোর পরে পরেই থ্রিলিং প্রেডিকশান করতো কার কী স্থান হবে তা নিয়ে, তারা হতাশ হয়ে সেকেন্ড থেকে শুরু করতে লাগলো।

সেভেন পর্যন্ত তবু একটা কী-হয় কী-হয় ভাব ছিলো, সেভেনের পরের ক্লাসগুলোতে মনে হয় ব্যাপারটা গৃহীত সত্যের মতন বোরিং হয়ে গেল। তাছাড়া তখন নানা রকম প্রাইভেট কোচিং, এই স্যরের গ্রুপ ওই স্যরের গ্রুপ--এইসব নানা অতিরিক্ত জটিলতাও দেখা দিতে লাগলো। অন্বেষা অবশ্য ঐ বিখ্যাত টিউটরদের কারুর কাছেই পড়তো না, তবু তাতেও ওর রেজাল্টে কোনো পরিবর্তন আসে নি, সেই বোরিং হায়েস্ট স্কোর।

আমি ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলি, " সেই সময় স্কুলে কেউই আমরা কারুর খুব কাছের বন্ধু ছিলাম না। প্রতিযোগিতার আবহাওয়ার মধ্যে, রেষারেষির আবহাওয়ার মধ্যে কি আসলেই কোনো সত্যিকার বন্ধুত্ব হয়? অভিভাবকেরাও তো তেমন, "দেখেছিস ও কত ভালো পড়াশোনায়, ওর পা ধোয়া জল খাওয়া উচিত", এরকম সব বাক্য হরহামেশা বাচ্চাদের বলে আমাদের দেশগুলোতে। এসব তো রীতিমতন বেআইনি হওয়া উচিত সভ্যদেশে। নিজেরা বাবামা হয়ে নিজের বাচ্চাদের মনকে দমিয়ে দেওয়া!"

ও নদীর দিকে চোখ মেলে কেমন বেদনাবিহীন অথচ বিষন্ন গলায় বলে, " আমাদেরই দুর্ভাগ্য, আমাদের মূল্যায়ণব্যবস্থা এত সংকীর্ণ! যেন মুখস্থ করে উগরে দেয়া পরীক্ষায় ভালো করা মানেই ভালো মেয়ে বা ভালো ছেলে আর তা না হলে একেবারেই এলেবেলে। কী ভুল ব্যবস্থা! আমার বন্ধু পাবার ক্ষেত্র তো ছিলো আরো কন্টকাকীর্ণ। কেবল স্থানাধিকারের জন্যই কারুর প্রত্যক্ষ ক্ষতি না করেও সকলের কমন শত্রু। " এখানে এসে অন্বেষা হেসে ফেলে।

"তোকে তখন ক্লাসের ভালো মেয়েরা সবাই ঈর্ষা করতো, কারণ সবাই তো পোটেনশিয়াল টপার! যে মেয়ে প্রত্যেক পরীক্ষায় তাদের সবার আশা নস্যাৎ করে দেয় তাকে ঈর্ষা না করে থাকবে কী করে কেউ? অনেকে তো "শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু" এই যুক্তিতে বন্ধু হতো পরস্পরের! তারপরে আবার পরীক্ষার সময় উত্তর দেখানো বা ফিসফিস করে বলে দেওয়া এসব নিয়ে ঝগড়া বেঁধে সেই বন্ধুতাও চটকে যেতে দেরি হতো না। এক বিষময় অলাতচক্র। তোর সীট তো পড়তো সামনের বেঞ্চে, অর্জুনের মতন পাখির চোখের দিকে মানে প্রশ্নপত্রের দিকে তাকিয়ে লিখতে শুরু করে দিতিস, বাকী দুনিয়া মুছে যেতো। পিছনের দিকের হল-কালেকশান আর বলাবলি-দেখাদেখির রাজনীতি তো তুই জানতিস না।" এখানে এসে আমিও হেসে ফেলি এবারে।

ও বলে, " ভাবলে অবাক লাগে, এতগুলো বছরের স্কুলজীবন আমাদের, কিন্তু সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, টীম এফোর্ট, কমন প্রোজেক্ট এইসবের মানেই শিখতে পারলাম না আমরা। সেরকম সদর্থক কিছু তো ছিলোই না আমাদের কোর্সের মধ্যে যেখানে অনেকে মিলে একটা অজানা সমস্যাকে সমাধান করার জন্য নানাভাবে নানাদিক দিয়ে চিন্তা করতে হবে, তারপরে সবার চিন্তাগুলো মিলিয়ে উপযোগীগুলো নিয়ে আবার সেটাকে রূপায়িত করার জন্য একসাথে কাজ করতে হবে। এরকম কিছু থাকলে কত ভালো হতো। জীবনের সবচেয়ে সক্রিয় সবচেয়ে আনন্দময় সবচেয়ে ফ্লেক্সিবল সময়টা কেটে গেল নীরব রেষারেষিতে। তাও ক্লাস এইট পর্যন্ত যখন বেশীরভাগকে প্রাইভেট টিউটরদের গোয়ালে ঢুকে পড়তে হয় নি, তখন তবু কিছু কিছু খাঁটি মনোভাব, স্বাধীন স্পিরিট বেঁচে ছিলো, টিউটররাজ শুরু হবার পরে তো তাও খতম। একেবারে হরিঘোষের গোয়ালের মতন অবস্থা হয়ে গেল। কোনো কিছু ভালোভাবে শিখবারই আর উপায় রইলো না, সব নোটের স্রোতে ঝাঁপ। টিউটররা নোট দ্যান, গাঁতিয়ে সেই নোট মুখস্থ করে খাতায় উগড়ানো, কারণ সামনে মাধ্যমিক, মাধ্যমিকে ভালো করতে হলে ঐ ছাড়া গতি নেই। আমাদের মধ্যে যে উৎসুক অনুসন্ধিৎসু মন বেঁচে ছিলো সামান্য, সেটুকুও বিনাশ করার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।"

টলটলে নীল আকাশের দিকে চেয়ে আমি ফিসফিস করে বলি " তবু কিন্তু সবটুকু মেরে ফেলা যায় না, কিছু রয়েই যায় খুব ভিতরে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বেরিয়ে আসে যেমন তুষারঢাকা শীত চলে গিয়ে বসন্ত এলে জেগে ওঠে কিশলয়।"

( চলবে )

No comments: