Saturday, March 29, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১১)

আমাদের একদম ছোটোবেলার স্কুলটা মানে যে স্কুলে কেজি ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর অবধি পড়েছিলাম, সেটা ছিল বেশ বিচিত্র। তিনটি স্কুলের সমাহার বলা যায় সেটাকে।

একটা মস্ত চৌকো উঠানের পুবের দিকে ছোটো একতলা একটা দালানে ছিলো কিন্ডারগার্টেন স্কুল, সেখানে কেজি-ওয়ান আর কেজি-টু এর ক্লাস হতো। উঠানের পশ্চিমের দিকে দোতলা দালান, সেদিকে প্রাইমারি স্কুল, ক্লাস থ্রী, ফোর।

আর উঠানের উত্তর দিকে ছিল সেই বিচিত্র সমাহার, একটা বিশাল দোতলা বিল্ডিং এর একতলায় কয়েকটা ঘরে ক্লাস ওয়ান আর টুএর ক্লাস হতো, আর দোতলায় ছিল মাধ্যমিক ক্লাস, ফাইভ সিক্স ইত্যাদি। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ছিলো আমাদের অধরা, বিল্ডিং এর উত্তরদিকে, সেদিকে আমাদের যাওয়া হতো না। ওয়ানের ক্লাসঘরের উত্তরদিকের জানালা খুললেই দেখা যেত একটা মাঠ, সেটা মাধ্যমিক স্কুলের মাঠ। এই প্রাথমিক আর মাধ্যমিক অংশের শিক্ষকশিক্ষিকাগোষ্ঠী আর পরিচালনা-সমিতিও পৃথক ছিল।

কিন্ডারগার্টেন অংশটা প্রাথমিকেরই অংশ ছিল যদিও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকারা কেউ প্রাথমিক ক্লাসে পড়াতেন না, কিন্তু শিক্ষিকাদের বসার ঘরটি একই ছিল। মাধ্যমিক স্কুলটি কিন্তু একেবারেই আলাদা করা ছিল, ঐ অংশের শিক্ষক শিক্ষিকাদের বসার ব্যবস্থাও ছিলো ঐ উত্তরের অংশে যে দিকটায় আমরা যেতাম না কখনো। হয়তো গেলে কেউ আমাদের বারণ করতো না, কিন্তু অকারণে কেনই বা কেউ যাবে ওদিকে?মাঝে মাঝে কেউ কেউ যেত, হয়তো বা গন্ডী ভাঙার আনন্দ পেতে বা হয়তো নিতান্তই কৌতূহলে।

আমাদের পড়াশোনা সবই ছিলো এদিককার ঘরগুলোতে আর দুপুরের টিফিনের ছুটিতে খেলাধূলা সবই ছিলো এইদিকের মাঝের উঠানে। দক্ষিণের দিকে ছিল একজোড়া আমগাছ আর তারপরেই মস্ত গেট। পুব দক্ষিণের কোণার অংশে মস্ত স্লিপ আর লোহার দোলনা। ওখানেও খেলতাম আমরা একেবারে ছোটোবেলা, তবে ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কাকজোড়া জেলেমাছ কুমীরডাঙা এইসব দলগত খেলায়। টিফিনের আধঘন্টার ছুটিতে সেরকম আর তেমন খেলার সুযোগই বা কোথায়? সামান্য একটু ছোটাছুটি খেলতে না খেলতেই ঘন্টা পড়ে যায় টিফিন শেষের। ব্যস, দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে যে যার ক্লাসে।

ক্লাস ওয়ানের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ একটা দারুণ ব্যাপার হলো। শোনা গেল স্কুল ম্যাগাজিন বেরোবে, সেটা হবে কিন্ডারগার্টেন আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সম্মিলিত প্রয়াস। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকশিক্ষিকা সবাই নাকি লিখবেন। একসময়ে বেরোলো সেই ম্যাগাজিন, নাম "প্রত্যূষ।" আহা, সেই নামের ঝঙ্কার যে কানে বেজেছিলো, আর ফুরায় নি। পরের বছর থেকে "প্রত্যূষ" হয়ে গেল মাধ্যমিকের ম্যাগাজিন আর আমাদের নতুন স্কুল ম্যাগাজিন বেরোলো "অঙ্কুর" নামে। কারণ শিক্ষিকারা মনে করেছিলেন প্রাথমিকের ছেলেমেয়েরা তত বেশী লেখা টেখা দিতে পারে নি ওতে, আসলে খুবই অল্পই দিতে পেরেছিলো, ঠিকঠাক প্রতিনিধিত্ব হয় নি। তাই পরের বছর থেকে বেরোলো আমাদের "অঙ্কুর"। এতে শুধু লেখা না, তার সঙ্গে আঁকা ছবি, আল্পনা এসবও থাকতো।

কিন্তু সেই প্রথম "প্রত্যূষ" যে কী মায়া অঞ্জন টেনে দিয়েছিল আমার চোখে, কেজানে! গল্পগুলো, ক্লাস সেভেন এইট নাইনের ছেলেমেয়েদের লেখা ছোটো ছোটো সব গল্প, কী অদ্ভুত শিহরণ যে তুলেছিল আমার নতুন অবাক চোখের সামনে, সে আজও ভুলতে পারি না। খুব অদ্ভুত লাগে ভাবলে, আজো কোনো কোনো গল্পের কিছু কিছু অংশ মনে আছে। মনে আছে একটা গল্পে ছিলো এক কিশোরী মেয়ে পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হসপিটালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে তার দিদিমণির মুখে খবর শুনলো যে সে রেকর্ড নম্বর পেয়ে মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান পেয়েছে। আরেকটা গল্প ছিলো খনি অঞ্চলের এক দুঃখী গল্প, এক খনিশ্রমিকের ফুসফুসের অসুখ, যাতে সে মারা যাবে কয়েকমাস পরেই, বাড়ীর লোকেদের কিছু জানায় নি, শুধু ব্যবস্থা করেছে যাতে তার সমস্ত সঞ্চয় ও পাওনা টাকা তারা পায়। লেখকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে যখন সে একটি চিঠি লেখাতে এসেছে, সে ঐ চিঠিতেই নিজের লোকেদের সব জানাবে। এখন ফিরে ভাবলে অবাক লাগে, বেশ পরিণত ধরণের ছিলো ঐ কিশোর কিশোরীদের লেখা গল্পগুলো, কেজানে হয়তো তারা কোনোখান থেকে "অনুপ্রাণিত" হয়েছিলো ওগুলো লেখার সময় কিন্তু আমার কাছে তখন তা নিখাঁদ একেকটা বিস্ময়। এমনও হয়? মানুষে নিজেরাই লিখে ফেলতে পারে এমন সব গল্প?

রবীন্দ্রনাথ নজরুল বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র ---এইসব যে বড় বড় লেখক কবিদের কথা তখন শুনেছিলাম তারা তো ছবির মানুষ, তাঁদের মস্ত মস্ত ছবি ঝোলে দেওয়ালে, তাঁদের জন্মতিথি পালিত হয় প্যান্ডেল বেঁধে অনুষ্ঠান করে, তখন তাঁদের ছবিতে ফুলের মালা ঝোলে। ওঁদের খুব দূরের, খুব অন্যরকম, অসাধারণ ও অতি-মানুষ মনে হতো, সেই তাঁরা গল্প কবিতা লিখতে পারেন, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু এই চোখের সামনে চলে ফিরে বেড়ানো উঁচু ক্লাসের দিদি দাদারা, এরা তো আমার মতন মানুষই, সেই তারা এরকম সব গল্প লিখতে পারে?

লেখালিখি সম্পর্কে ক্লাস ওয়ানের সেই শিরশিরে অনুভূতিটা রয়ে গেল অনেক অনেক বছর, লেখালিখি যেন একটা ম্যাজিক জগৎ, একটা নিষিদ্ধ ফলের বাগান, ঐখানে আনন্দের পসরা আছে কিন্তু তার সঙ্গে আছে বাধা, আছে নানা বিপদ, কিন্তু একদিন হয়তো ওখানে পৌঁছতে পারবো। তখনই এইসব ভাবনা জাগে নি বটে, কিন্তু ওর সূচনা হয়েছিল সেই সামান্য স্কুল ম্যাগাজিনটি পড়েই, সেই প্রথম "প্রত্যূষ"।

পরের বছর থেকে আর প্রত্যূষ পেলাম না, হয়তো ওটা বেরোতো মাধ্যমিক স্কুলের অংশে, বা হয়তো বেরোতো না, তার কোনো খবর আমাদের দিকে আসতো না। আমাদের দিক থেকে বেরোলো "অঙ্কুর", আমার কোনো লেখা ওখানে কোনো বছর বেরোয় নি। লেখা দিতাম, কিন্তু নির্বাচিত হতো না। হয়তো লেখাগুলো ভালো হতো না বা হয়তো মাপসই হতো না, কেজানে! কিংবা হয়তো অন্য কোনো কারণ।

শুধু প্রথমবারের "অঙ্কুর" এ আমার একটা ন্যালাখ্যাপা টাইপের আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রথাগত আঁকা শিখতাম না তখন, তাই আঁকাটা ছিলো বাচ্চাদের কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাংএর মতন আনাড়ী আঁকা, একটা কুটির, তার পাশে বাঁশঝাড় আর একটা ঝুপসি গাছ, পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে, কাগজের উপরের থেকে নিচে মোটা রাস্তা নেমে গেছে, যেন মোটা একটা দড়ি ঝুলছে। পারস্পেক্টিভ বোঝানোর কৌশল জানা ছিলো না, আরে ঐ বাচ্চা বয়সে জানবো বা কী করে দ্বিমাত্রিক ছবির মধ্যে কেমন করে কাছে আর দূরে বোঝাতে হয়? তৃতীয় মাত্রা কি সোজা কথা নাকি? পরে বড় হয়ে ঐ ছবি দেখে খুব হাসতাম সবার সঙ্গে, ছবিতে সব কিছু কেমন ল্যাপ্টানো দুই মাত্রার।

পরে, অনেক পরে, প্রথাগত আঁকা শিখতে শুরু করে প্রথম কায়দা শিখেছিলাম ছবির মধ্যে দূরত্ব বোঝানোর, আকার আকৃতির বড় ছোটো আর গোল গোল আঁকাবাঁকা রেখার কৌশলে দেখানো এই বাড়ীটা কাছে আর ঐ দূরে অনুভূমিক লাইনটানা দিগন্ত, আকাবাঁকা ঢেউ খেলানো রেখায় দিগন্তের বৃক্ষরাজি একসাথে মিলেমিশে একাকার, তার মধ্য থেকে খাড়া খাড়া ছোটো ছোটো সরু সরু সব রেখা, মাথায় গুণচিহ্নের মতন, সেগুলো হলো দূরের দিগন্তের লম্বা গাছেরা, "তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে"। তাদের সামনে পুরোটা জুড়ে নদী, সেই জলে সূর্যাস্তের আভা, সূর্য ডুবে যাচ্ছে দিগন্তে। একেবারে কাছে নদীর এপারে একটা কুটির, পাশে গাছ। তো, এসব অনেক পরের কথা। প্রাইমারির অনেকদিন পরের।

"প্রত্যূষ" ছিল বড় সড় এ-ফোর সাইজের মতন বই, কিন্তু "অঙ্কুর" ছোটো, ডাইরির মতন। প্রথম ছাপা অঙ্কুর যেবার হাতে পেলাম যেটায় ঐ ছবিটা ছিলো, সেই দিনটাও মনে আছে, হঠাৎ সেদিন দুটো ক্লাসের পরেই ছুটি হয়ে গেল, কারণ হঠাৎ সংবাদ এসেছে রাজধানী শহরে প্রধানমন্ত্রী নিজের দেহরক্ষীদের হাতে খুন হয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, নিজের দেহরক্ষীরাই কি কখনো----ওসব বোঝার বয়স তখনো হয় নি আমাদের, শুধু মনে পড়ে আমি আর ভাই ফিরে আসছি বাড়ীতে, ভাই সেই বছর কেজি-ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলো। হঠাৎ ছুটি হয়ে গেল বলে মা বা অন্য কেউ আমাদের আনতে যায় নি, তখন ফোন টোন ও ছিলো না কারুর বাড়ীতে, দ্রুত খবর টবর দেবার ও নেবার একমাত্র উপায় ছিলো লোক পাঠানো। অনেক ছেলেমেয়ে ইস্কুলেই অপেক্ষা করে রইলো তাই। যাদের বাড়ী স্কুলের খুব কাছে, তারা ফিরে গেল বাড়ীতে।

আমি বাড়ী ফেরার রাস্তা চিনতাম, তাই ভাইকে নিয়ে ফিরে এলাম বাড়ীতে। সেদিন দুইজনের টিনের সুটকেসে দুটো "অঙ্কুর",আর একটা নতুন গন্ধ, নতুন বইয়ের একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে না? বাড়ী ফিরে আসার পরে মা আর ঠাকুমা তো অবাক, "সে কী রে, তোরা? স্কুল ছুটি হয়ে গেল? কী করে এলি?" আমার বেশ অবাক লাগলো, মা আমাদের স্কুলে দিয়ে আসে নিয়ে আসে বটে, কিন্তু এতদিন যাই আসি, রাস্তা চিনতে তো শিখে গেছি, নাকি?

ক্লাস ফোর অবধি আমরা টিনের সুটকেসে বইপত্র নিয়ে স্কুলে যেতাম, সবাই। পরে নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়ে সব বদলে গেছিল, সেখানে ব্যাগে করে বই নিতে হতো। আর যোগ হয়েছিলো টিফিন বাক্স। বাড়ী থেকে টিফিন নিয়ে যেতে হতো তখন। বাড়ী থেকে টিফিন নিয়ে যাবার ব্যাপারটাও বেশ নতুন ছিল আমার কাছে।

কিন্ডারগার্টেনে আর প্রাইমারিতে আমাদের স্কুল থেকে দুপুরে টিফিন দিতো। এসব মিড-ডে মীল স্কীম চালু হবার অনেক আগের কথা, এটা স্কুল নিজেই ব্যবস্থা করতো। অভিভাবকদের থেকে মাইনের সঙ্গে এই দুপুরের খাবার খরচটাও নিয়ে নিতো স্কুল কর্তৃপক্ষ। কী কারণে এই ব্যবস্থা, কেজানে! হয়তো ওঁদের যুক্তি ছিলো একসাথে লেখাপড়া আর খেলাধূলা করে বড় হচ্ছে যে কুচোকাঁচারা, তারা একসঙ্গে একরকম খাবার খেলে নিজেদের মধ্যে একাত্মতা তৈরী হবে। ছোটো ছোটো গোল গোল কানা উঁচু বাটিতে দিতো টিফিন, কোনোদিন মুড়ি আর চীনাবাদামভাজা, কোনোদিন মাখনচিনি মাখানো দুই স্লাইস পাউরুটী, কোনোদিন খই আর পাটালিগুড়, কোনোদিন বা আর কিছু। খইগুলোতে কোণায় কোণায় ধানের শক্ত খোসা লেগে থাকতো, আর হেসে হেসে আমাদের নিধিরদা( স্কুলের কর্মচারী ) বলতেন," ধান থেকেই তো খই হয়, জানো না তোমরা? " কী আশ্চর্য, ধান থেকে খই হয় ভালো কথা, ধানের খোসাগুলো ছাড়িয়ে বেছে দেবে তো? কিন্তু ঠেলার নাম বাবাজী, আমরা নিজেরাই খই থেকে ধান বাছতে শিখে ফেলি ঐ ধান্যখচিত খই টিফিন পেয়ে পেয়ে। দুপুরে স্কুল থেকে টিফিন দেওয়া আরো একটা উপকার করেছিল, অনেক ছেলেমেয়ে বাড়ীতে নিজের হাতে খেতে পারতো না, মা-দিদিমারা গরস পাকিয়ে পাকিয়ে মুখে দিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিতেন, কিন্তু ইস্কুলের টিফিনের ঠেলায় পড়ে সবাই নিজের হাতে খাওয়া শিখে ফেললো।

ক্লাস থ্রীতে উঠেই শুনি সাংঘাতিক এক ব্যাপার নাকি আসন্ন। চার বছরের আটকে থাকা পুরস্কার বিতরণী আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাকি অনুষ্ঠিত হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভালো ভালো গান আর নাচ জানা ছেলেমেয়েদের নির্বাচন করা শুরু হবে খুব শীগগীর।

ক্লাস থ্রীর ক্লাসরুম ছিল দোতলায়, ভারী অন্যরকম আর রহস্যময় সেই তলা। খোলা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে লোহার গেট, তার নিচে খুব বিপজ্জনক একটা ঢালু মেঝে, সেই মেঝের উপর দিয়ে ওঠার সময় পায়ের তলা শিরশির করে এই বুঝি হড়কে গেলাম। বৃষ্টি হলে আরো বেশি পিছলে পড়ার ভয় বেড়ে যায়। সেই অংশ পার হয়েই ক্লাস থ্রীর ঘর। সেই ঘরের পরেই একটা রহস্যময় বন্ধ ঘর, পরে জেনেছিলাম ওটা নাকি আমাদের লাইব্রেরী। ওখান থেকে কস্মিনকালেও বই দিতো না যদিও, তবে ক্লাস ফোরে একবার কী এক মহাশুভক্ষণে এক শনিবারে কয়েকঘন্টার জন্য কিছু গল্পের বই ওখান থেকে পড়তে দিয়েছিলো আমাদের। সে গল্প পরে কখনো হবে। গল্পের বই ছাড়াও ঐ ঘরে হাতের কাজের জিনিসপত্রও জমা রাখা হতো, সেও জেনেছিলাম পরে। সেই ঘর পার হয়ে একটা ছোটো ঢাকা বারান্দার ডাইনে ও বাঁয়ে ক্লাস ফোরের দুটো সেকশানের ক্লাসঘর।

ক্লাস থ্রীতে ওঠার কয়েকদিনের মধ্যেই শিল্পী নির্বাচন হয়ে গেল দিদিমণিদের। আমরা যারা নাচগান কিছু শিখতাম না তারা অবাক হয়ে দেখতাম কী জোর কদমেই না রিহার্সাল চলছে। তখন বছর শুরুর দিক, পড়াশুনো নামেমাত্র হয়ে টিফিনের পর থেকেই শুরু হতো রিহার্সাল। দিদিমণিদের নাচ ও গানের ব্যাপারে উৎসাহ দেখলে নির্ঘাৎ বাইরের লোকেরা মনে করতেন ওটা নাচ-গানেরই স্কুল!

সুদীপা সুগোপা পিউলী চন্দ্রাণী অলিপ্রিয়া শিবাণী মৌপিয়া সবাই নাচের ও গানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ওরা আলাদা করে নাচের ও গানের স্কুলে ও যেত বাড়ী থেকে। খুব সাংস্কৃতিক কিনা! মৌপিয়া আবার ছিলো একজন দিদিমণির মেয়ে, তাকে তো ক্লাসের মধ্যেই এক দিদিমণি গান তোলাতেন "আমি যার নূপুরের ছন্দ / কে সেই সুন্দর কে এ এ এ এ"

আমরা যারা কিনা অ-সুর ও ছন্দোহীন, তারা টিফিনের পর রিহার্সাল দেখতে যেতাম। একটা রূপকথার গল্পকে নাচগানওয়ালা নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে, সেখানে পরীদের নাচ হবে, লাল পরী নীল পরী সবুজ পরী হলুদ পরী আর সাদা পরী রাজকুমারীর চারধারে সিমেট্রি রেখে নাচবে গানের সঙ্গে সঙ্গে, রাজকুমারী হলো সেই পারুলকন্যা, যে কিনা সাতটি ভাইকে উদ্ধার করবে চাঁপা ফুল অবস্থা থেকে। এই রাজকুমারীর নাচ সবচেয়ে বেশী, এই রোল পেয়েছিলো অলিপ্রিয়া। সে খুব ভালো নাচতো। গর্বে তো তার আর পা মাটিতে পড়ে না। সে আবার সেই বছরই ভর্তি হয়েছিলো আমাদের স্কুলে, আগে ঐ স্কুলে পড়তো না, অন্য ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো, সেখানে নাকি সবকিছুতে "এক্সেলেন্ট" পেতো। সবাই নাকি তাকে ব্রাইটেস্ট গার্ল অব এশিয়া বলতো। সাংঘাতিক অবস্থা!

দারুণ জোরকদমে রিহার্সাল চলছে একদিকে, রিহার্সাল হতো একতলায়, দিদিমণিদের বসার কমনরুমের সামনে ছিলো অনেকখানি খোলা জায়্গা, সেখানে। সেই দিকে নাচ ও গানে পটীয়সী পাঞ্চালী, শিউলি আর দেবীকা দিদিমণি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কমনরুমের আরেকদিকে অন্যকিছু দিদিমণি মিলে আর্কাইভ থেকে উদ্ধার করছেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীদের নাকি পুরস্কার দেওয়ার প্রথা। আমাদের ব্যাচের তো কেজি ওয়ান থেকে সেই পর্যন্ত সব পুরস্কারই পেন্ডিং, সেই প্রথম অনুষ্ঠান হতে চলেছে।

দিনের পরে দিন যত যায়, ততই ব্যাপার আরো বেশী উত্তেজক হয়ে ওঠে। যেন এক অলিম্পিক টাইপ কিছু আসন্ন। হু হু বাবা, আমরা ছোটো হলে কী হবে, তখন ছোটো ছোটো সাদা কালো টিভি এসে গেছে পাড়ায় কারু কারু বাড়ীতে, ওসব অলিম্পিক এশিয়াড বিশ্বকাপ এইধরণের জিনিসগুলোর বিষয়ে আমরাও কিছু কিছু জেনে গেছি, একেবারে অজপাড়াগেঁয়ে আর তখন না আমরা! নিজেরা জল্পনা করি পুরস্কার দেবার সময় মঞ্চে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডের মতন কিছু থাকবে কিনা যেখানে ফার্স্ট, সেকেন্ড আর থার্ড দাঁড়াবে? কেউ কেউ বলে ওরকম কিছু থাকবে না, এটা তো অলিম্পিক বা এশিয়াড না, আবার কেউ কেউ বলে থাকবে, কেন থাকবে না?

বাঁশ টাঁশ আসতে শুরু করে স্কুলের উঠানে, প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হবে। আমাদের কী আনন্দ, টিফিনে খেলার সময় ঐ বাঁশের পাঁজায় গিয়ে খেলি আর দিদিমণিদের বকুনি খাই। তাতে কী? এইরকম সুযোগ তো আর বেশী আসে না? একবার ওখানে হুটোপাটি করতে করতে নামকরা দুরন্ত ছেলে প্রসূন পড়ে গিয়ে হাঁটু ছড়ে ফেললো, কিন্তু তাতেও সে দমে নি।

অনুষ্ঠানের দিনের কয়েকদিন আগে ক্লাস ফোরের একটা সেকশানের গোটা ক্লাসটাই হয়ে গেল গ্রীনরুম, পড়াশুনো একেবারে বন্ধ সেইসময়। পুরো সময় ধরে রিহার্সাল চলছে, যারা করছে তাদের তো উত্তেজিত ব্যস্ততায়, আনন্দে ও ঠিকমত পারফর্ম করতে পারবে কিনা এই টেনশনে একেবারে প্রায় দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য অবস্থা। আর আমরা যারা এই নাট্যোৎসবের দর্শক, তারাও উত্তেজনার আগুন পোহাচ্ছি। ঐ ঘরে তো আমাদের যেতে দিচ্ছে না, বাইরে থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছি। ক্লাসে তো কোনো দিদিমণি নেই, গল্পগাছা গন্ডগোলে ক্লাসঘর একেবারে গুলজার যাকে বলে।

পরীর নাচে সুদীপা হয়েছিল শ্বেতপরী, কিন্তু মূল অনুষ্ঠানের আগে আগে তার হলো মাম্পস, গলার অবস্থা খারাপ এদিকে জ্বরও। কিন্তু সে দমেনি, ওষুধের জোরে অবস্থা আয়ত্ত্বের মধ্যেই ছিল, ঐ অবস্থাতেই সে নেচেছিলো সাদা রেশমী রুপোজরিওয়ালা চুড়িদার আর ওড়নায় নিয়মমতন সেজে। প্রত্যেক রঙের পরীকে সেই রঙের জরিদার সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরে সাজতে হয়েছিল, রাজকুমারীর দুইধারে একজোড়া করে একই রঙের পরী ছিলো।

স্টেজ বাঁধা হয়ে গেল, প্যান্ডেলে ছেয়ে গেল গোটা উঠান। অন্যরকম হয়ে গেল চেনা স্কুলটা, যেন রূপকথার মায়াপুরী। অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যেবেলা, প্রথমে তো সভাপতি প্রধান অতিথি--এঁদের বক্তৃতা ইত্যাদি, তারপরে পুরস্কার বিতরণী।

কেজি-ওয়ানের জন্য প্রায় সবাইকেই সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিলো একটা ভারী মজার ছবিওয়ালা বই, "ছড়ার দেশে টুলটুলি"। বিভিন্ন ছড়ার অংশ ব্যবহার করে করে একটা বড় গল্প, টুলটুলি নামের এক ছোট্টো মেয়ের আশ্চর্য ছড়ার দেশে হারিয়ে যাওয়া আর সেখান থেকে ফিরে আসা নিয়ে। অনেকটা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতন, কিন্তু ঠিক তাও নয়। শৈল চক্রবর্তীর অসাধারণ আঁকা আর লেখা। একেকটা জায়্গা আজও মনে আছে, একজায়্গায় নদীর ধারে একটা গাছে অনেক নোটন নোটন পায়রা দেখে ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায় বলছেন "দেখেছ, আমার পোষা পায়রাগুলো পালিয়ে পালিয়ে সব এইখানে এসে পড়েছে!" আরেক জায়্গায় কমলাফুলির বাড়ী গিয়ে টুলটুলি অতিথি, সেখানে ওকে খেতে দিয়েছে মধুমাখা সবরিকলা। শেষে রাণীহাঁসের পিঠে চড়ে টুলটুলি ফিরে এলো আপনদেশে। সবটা মিলিয়ে খুব সুন্দর বই।

নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে তারপরে, তখন নেমে গিয়ে বসেছি মা-বাবার সঙ্গে, ঐ অনুষ্ঠানে সব অভিভাবকেরা দর্শক হিসাবে নিমন্ত্রিত ছিলেন।একেবারে শেষে সেই নৃত্যসঙ্গীতবহুল নাটক। কী আশ্চর্য সুন্দর লাগছিল সবাইকে, সত্যিই যেন আর একসাথে পড়া সামান্য মানুষ আর নয় তারা, সত্যি যেন রূপকথারাজ্যের লাল পরী নীল পরী সবুজ পরী হয়ে তারা বেষ্টন করেছে রাজকুমারীকে, ঝলমলে জরিপাড়ের উজ্জ্বল বাসন্তী রেশমী শাড়ীতে অলিপ্রিয়াকে দেখাচ্ছিল সত্যিই যেন সেই রাজকন্যা পারুল, অভিশপ্ত সাতভাইকে যে উদ্ধার করে মানুষরূপে ফিরিয়ে আনে।

তখন ডিজিটাল ক্যামেরার নামও শোনেনি কেউ, সাধারণত ফোটো তোলা হতো স্টুডিওতে গিয়ে। কোনো কোনো করিতকর্মা লোক বড়ো বড়ো কালো কালো ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে ফোটো তুলতেন, পরে সেগুলো ওয়াশ করে তবে ফোটো দ্যাখা যেতো। অলিপ্রিয়ার বাবা একটা সেইরকমই বড়ো ক্যামেরা হাতে উত্তেজিত অবস্থায় একবার প্যান্ডেলের এক কোণ থেকে, আরেকবার আরেক কোণ থেকে ছবি তুলছিলেন। হয়তো ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রেকর্ড করে রাখতে চাইছিলেন মেয়ের অক্ষয় কীর্তি।

অনুষ্ঠান শেষ হলো একসময়ে, ক্লান্ত ও পরিতৃপ্ত মনে ছড়ার দেশে টুলটুলি বুকে নিয়ে ফিরে চললাম বাড়ীর দিকে, আকাশে তখন ফুটকি ফুটকি তারা আর গাছে গাছে জ্বলছে নিভছে হাজারে হাজারে জোনাকি।

(চলবে)

2 comments:

Shuchismita said...

eto sundor laaglo ei porboTa!! pather paa`nchalir moto...

Mallika Dhar said...

eitaa valo laaglo eto? thank you Shuchismita. :-)