শিরশিরে শরতের ভোর। হাওয়ায় কোমল শীতভাব। নীলকান্তমণিপ্রভ আকাশ, ঘাসে ঘাসে চিকমিক করছে শিশির,পুবে রাজকীয় ভোর হচ্ছে। চারটে পাখির একটা ছোট্টো দল চক্র দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, ওদের ডানায় ঝকামক করছে নতুন ভোরের আলো।
এইসব সময়গুলোতে বাতাসে শিউলির নরম সুগন্ধের জন্য মন উতলা হয়, মাঠভরা নরম কাশগুচ্ছ দেখতে সাধ হয়। আমাদের দেশে শরৎ তো শুধু ক্যালেন্ডারে আসে না, সাদা মেঘের ছবি দেওয়া আকাশের নীল খামে পুজো-পুজো গন্ধের রোদ্দুরের অক্ষরে-শব্দে ভালোবাসার চিঠি হয়ে আসে। এমন সোনারোদের ওড়না জড়ানো নীলপ্রভ আকাশের নীচে আগমণীর গান যদি না থাকে, তাহলে কি আর মন মানে? ঐ পুজো পুজো গন্ধের রোদ্দুরে যে ছুটির নিশান আঁকা! কতকাল ধরে রক্তের মধ্যে যে মিশে গেছে "পুজোর ছুটি"।
এখানে পুজোর ছুটি বলে কোনো কথা নেই, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় অগাষ্টের শেষ সপ্তাহ থেকে। অক্টোবরে একেবারে যাকে বলে পুরোদমে চলা সময়, ভরভরন্ত সেমেস্টার।ছুটি হবে সে-এ-এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, তখন সেমেস্টার শেষ হবে।
তবু আছে অন্যরকম নানাধরনের উৎসব-আয়োজন। এমন টলটলে আলোয় পরিপূর্ণ সময় মানুষের হৃদয়ের কাছে আবেদন রাখবে না, তাই হয় নাকি? সমস্ত উত্তর গোলার্ধ জুড়েই যে এখন ভরা ফসলের গান, "শেষ ফলনের ফসল এবার কেটে লও, বাঁধো আঁটি...",ওদিকে দক্ষিণ গোলার্ধ সেজে উঠছে বসন্তের সবুজ কিশলয়ে।
এই সীজন হলো ফুটবল সীজন। এই ফুটবল আমাদের চেনা ফুটবল নয়, আমি বাঙালি মানুষ এই ফুটবলের আকৃতি দেখেই তো প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম। আমাদের ফুটবল তো দিব্যি গোল, একেবারে গোলালো। এখানের ফুটবল হলো উপগোলকীয়, যেন অনেকটা বিরাট এক পটোলের মতন। ফুটবল এখানে শুধু খেলা নয়, একটা উৎসবের মতন। যেদিন ফুটবল হয়, সাধারনতঃ সপ্তাহান্তে হয়, সে এক সাজো সাজো অবস্থা।
শুক্রবার বিকেল থেকেই সব মোটর হোম এ করে সমর্থকের দল সপরিবারে এসে পৌঁছায় পতাকা টতাকা উড়িয়ে। এসে লাল নীল সাদা তাঁবু খাটিয়ে রান্না-বান্না(সাধারণ গ্রিল করা)করে এসে এক এলাহি কারবার। ফুটবল শুরুর আগে এই পিকনিক হলো মাস্ট, একে বলে টেইলগেটিং। এটা কালচারের অঙ্গ,সেদিন চেনা-অচেনা বন্ধুরা মিলে খাওয়াদাওয়া হবে,আনন্দ করা হবে, এ হলো ফুটবল-দর্শকের আবশ্যকীয় রীতি।
তবে খেলাটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় নি, একবার বন্ধুদের অনুরোধে গেছিলাম দেখতে, গ্যালারিতে জমিয়ে বসলামও বন্ধুদের সঙ্গে। দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, প্রায় মহাকাশযাত্রীর মতন পোষাক আর হেলমেট পরে অতগুলো খেলোয়াড় যে কি করছে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে, গ্যালারি থেকে দর্শকেরা যে কেন অমন মারাত্মক চিৎকার করছে, সে আর বোঝা সম্ভব হলো না। খেলার একেক পর্বের পরেই বিরতি,বিরাট বাজনার পার্টি ইয়া ইয়া ভেঁপু ড্রাম ইত্যাদি বাজাচ্ছে,মেয়েদের দল নাচ করছে-সে বিরাট উৎসব আর সেই উৎসবের স্পিরিট আমার মতন আউটসাইডারের পক্ষে লিখে বোঝাতে পারা অসম্ভব।
আমি শুধু বাইরে ঘুরতে ঘুরতে মুগ্ধ হয়ে দেখি নানারঙের তাঁবুতে ভরে গেছে সব মাঠগুলো, গাড়ীতে গাড়ীতে ছয়লাপ চারিদিক,সমর্থকেরা সব সপরিবারে তাদের প্রিয় দলের রঙের পোশাকে, কেউ কেউ মুখেও সেই রঙ করে নিয়েছেন, ছোট্টো ছোট্টো বাচ্চাদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে রঙীন ঐসব পোশাকে। দেখি বিরাট বড়ো বিজ্ঞাপন বেলুনে উড়ছে এই খেলার কথা। আমি অবাক হয়ে মুগ্ধ চোখে এই অন্য শারদোৎসব দেখি। অচেনা অন্য পৃথিবীর উৎসব যেন এক, কিন্তু হৃদয়ের আনন্দের তরঙ্গমালা চেনা যায়।
মনে পড়ে যায় আমাদের দুর্গাপূজা, ঢাকের ঢ্যামকুড়কুড়,আর মাঠভরা মাথা-দোলানো কাশেরা, ভোরের বেলা শিউলিদের টুপটুপ ঝরে পড়া।
"ঢ্যামকুড় কুড় বাদ্যি বাজে/ ঢাকে পড়লো কাঠি/ যা দিবি মা তাই হবে আজ/ পরমান্নের বাটি..." মনে পড়ে যায় সেই সপ্তমীভোর, অষ্টমীসন্ধ্যার আলো ও কোলাহল ও ভীড়, পুজোর জামায় ছেলেপুলেরা, আর নবমীর নরম দিন, নবমীরাতে সেই "নবমী নিশি গো পোহায়ো না ধরি পায়/ তুই চলে গেলে মাগো উমা মোরে ছেড়ে যায়", দশমীর বিদায়-অশ্রু আর ঘরে ফিরে বিশ্ব-মাকে ঘরের মা করে পাওয়া।
এই তো পূজা, যা অনেক বড়ো, অনেক দূরের, যাকে এই সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র হৃদয়ে ধরতে পারা যায় না, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য, শক্তি ও করুণার উৎস যে-তাকেই কাছে পাওয়ার আকুতি, তাকেই হৃদয়ে ধারণ করার আর্তি। তাই নয় কি?
উৎসবের বাঁশি তো তাই বলে, যে দূরের মানুষ, সে এলো কাছে, আকাশের মা মাটির মা হয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো, তারপরে ঘরের মা হয়ে এসে কোলে তুলে নিলো, বুকে জড়িয়ে নিলো। ঘাম ও ধুলা মুছে নিলো কোমল আঁচলে। তাই তো সবই সেদিন পরমান্ন হয়ে যায়, তুচ্ছ বলে আর সেদিন কোনোকিছুই থাকে না। "যা দিবি মা তাই হবে আজ পরমান্নের বাটি..."
আমাদের সহকার-শাখা ও মঙ্গলকলসের সঙ্গে কখন এই এদের পতাকা, তাঁবু, রঙীন বেশ, মুখে মাখা রঙ---সব এক হয়ে যায়, আনন্দের জ্যোৎস্না ভরে দেয় আকাশ ও সমুদ্রের মাঝখানের বিরাট দূরত্ব---"মগন করেছে মধ্যে তাহার আনন্দ পূর্ণিমা..."
কত দূরে প্রশান্ত অতলান্ত মহাসমুদ্র পার হয়ে আমার দেশ- গাঁয়েও তো উৎসবের বাঁশী বেজে উঠেছে.... লাল-নীল-সবুজ-হলুদ ঘুড়িতে পেটকাটি চাঁদিয়ালে মোমবাতি বগ্গায় ভরে গেছে বিশ্বকর্মা পূজার রোদ্দুরভরা দিনের নীল আকাশ...ঘুড়িতে ঘুড়িতে ঐ তো প্যাঁচ লেগে গেছে.... ঐ তো কারা সমস্বরে কোলাহল করে উঠছে ভোঁ ও ও ও কাট্টা....
Monday, June 2, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment