অ্যামট্র্যাকের রেলওয়ে স্টেশানটি ছোটো, অপেক্ষমান যাত্রীসংখ্যা একদম হাতেগোনা, দুই সাদাচুল প্রৌঢ়া হাতে দুটি ব্যাগ,পরিপাটী গোছানো ঝোলা স্কার্ট আর টপ পরা,জিনস-টিশার্ট পরা নীলচোখ যুবতী পিঠে ব্যাকপ্যাক, একটি ছোট্টো পরিবার-মাবাবা আর দুটি ছেলেমেয়ে,অজস্র লটবহর সঙ্গে, একজন উদাসীন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক-একহাতে ছোট্টো একটি ব্যাগ আর আরেকহাতে একটি বই,আর এই পিঠে ব্যাকপ্যাক আর লাগেজ ব্যাগ হাতে আমি।
ভাবা যায়, দিনের মধ্যে এই একখানা ট্রেন, তার জন্য যাত্রী এখান থেকে মাত্র এই কজন? এদেশে ট্রেনের জনপ্রিয়তা যে একদমই নেই, তা স্টেশানে এলেই টের পাওয়া যায়। সকলেই নিজের নিজের গাড়ীতে চড়ে ঘোরে,তাই ইন্টারস্টেট রাস্তাগুলো অসাধারণ ভালো,মেইন্টেনান্সও তেমনি।সেই পথসমূহই সকলে ব্যবহার করে। খুব বেশী দূর যাবার দরকার হলে লোকে প্লেনে করে যায়।
অ্যামট্র্যাক এখনো কিছু কিছু ট্রেন চালায়, আস্তে আস্তে এগুলোও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তবু বাসের কিছুটা বেশী জনপ্রিয়তা আছে, গ্রেহাউন্ড বাস সার্ভিসে অনেক লোক দেশের রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে যায়।
আমাদের ছোটো শহর থেকে ট্রেনযাত্রাটি বেশ মনোরম, সকাল নটায় ট্রেনে উঠে পড়া, আস্তে আস্তে পুবের সবুজ বনভূমি আর ঢেউখেলানো পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে ছোটো ছোটো শহর ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যায় ট্রেন।
পুবের রাজ্যের গন্তব্যশহরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে পড়ে, ঘড়ি বদলে ফাস্ট করে নিতে হয় একঘন্টা, এপথে এলে এক টাইম জোন থেকে চলে আসতে হয় আরেক টাইমজোনে। প্রথমবার খুব মজা লেগেছিলো।
দুপুরবেলা পাশের সহযাত্রিণীর সঙ্গে গেলাম সাজানো ডাইনিংকারে,সেখানে খাবারের দাম এমনি জায়গার থেকে বেশী,কিন্তু খাবার ভালো। খেয়ে দেয়ে ফেরৎ এসে সিট এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম। এই ট্রেনের সিট ইনক্লাইনড করা যায়, ফুটরেস্টে পা রেখে আরামে ঘুমানো যায়। জানালার বাইরে বেলা পড়ে আসে, গ্রীষ্মের ঘন সবুজের উপরে পড়ন্ত রোদ্দুরের খেলা কাব্যময় হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ছন্দময় দোলানিতে চোখদুটো জড়িয়ে আসে।
ট্রেনের দেশের মানুষ আমি। ট্রেন আমাদের শৈশব কৈশোর প্রথম যৌবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রেশমী সুতোর বুনুনির মতন। শীতের ভোরে ট্রেনের ভোঁ একরকম আর গ্রীষ্মের ভোরে আরেকরকম। মাঝরাত্রির দুরপাল্লার ট্রেনের হুইসেলের দ্রুতচ্ছন্দ চলে যাওয়া আরেকরকম। একটা সময় ছিলো, যখন আমরা কান পেতে থাকতাম,সকালের গাড়ীর শব্দের জন্য। বাড়ী থেকে কত দূরে রেলস্টেশান,তবু শোনা যেতো স্পষ্ট। তখন বাড়ীঘর অনেক অনেক কম ছিলো। সে আমাদের ছোটোবেলা।
ছোটো স্টেশানটি ছিলো আমাদের, দূরপাল্লার ট্রেনগুলো দাঁড়াতো না,এখনো দাঁড়ায় না। তবে এখন বড়ো হয়েছে প্লাটফর্ম, প্রতিদিনের লোকাল ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক অনেক। সকলের যেতে হয় বড়ো শহরে,ট্রেন ছাড়া অন্য উপায় খুব একটা নেই সাধারণ লোকের কাছে। বাসের ব্যবস্থা ইদানীং আছে বটে, কিন্তু খুব সুবিধাজনক নয়।
শীতের ভোরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ট্রেনের আলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতো,ছোটো স্টেশানের প্লাটফর্মে অসংখ্য মানুষ সোয়েটার মাফলার চাদরে আবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো অপেক্ষায়-এনারা নিত্যযাত্রী।
লোকাল ট্রেনগুলো চলমান সমাজদর্পণ,প্রতি কামরায় নানা পেশার মানুষজন,প্রায় সকলেই চলেছেন কাজে,সকালের ট্রেনগুলোতে বিরাট বিরাট বস্তা,ঝুড়ি,দুধের বড়ো বড়ো ড্রামওলা অনেক লোকজনও থাকতো,এরা নিত্য এইসব দ্রব্যাদি শহরে পৌঁছে দেন। আর অবধারিত অসংখ্য হকার-ঝালমুড়ি,লজেন্স,ছোলাভাজা,বাদামভাজা, গয়না, পোষাক, মলম, থালাবাটি, ফলমূল তেলেভাজা-কি যে নেই সেই হকারদের পসরায়--তা বলা কঠিন। আর গানশোনানোর ছোটো ছোটো দল-এনারা খুব ভোরে থাকতেন না,একটু বেলা হলে উঠতেন।
স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে-হয়তো তাই হয়। হয়তো আস্তে আস্তে ফিরে আসে ছবি,দেশকালের দূরত্বে ধরা পড়ে সুন্দর হয়ে, যেসব ছোটোখাটো সুন্দর এড়িয়ে গেছিলো তা অনেক পরে স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যায়। কে যেন বলেছিলো, চলে যাওয়া বেলাকে ফিরে পেতে হয় শুধু স্মৃতির মধ্যেই, স্বপ্নের মধ্যেই।
"উঠে পড়ো,উঠে পড়ো,এসে গেছি,এসে গেছি। পৌঁছে গেছি। "-সহযাত্রিণী প্রৌঢ়া আস্তে আস্তে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছেন। ঈশ, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি?
চোখ থেকে ঘুম মুছে ফেলে সোজা হয়ে বসি, সিট খাড়া করে দিই। ট্রেনের গতি মন্দীভূত হচ্ছে, গন্তব্য শহরের বড়ো প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে আমাদের ট্রেন।কেমন যেন দূরপাল্লার ট্রেনের হাওড়া স্টেশানে ঢোকার সময়ের মতন একটা অনুভূতি হয়, আস্তে আস্তে ট্রেন থামে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য এগিয়ে আসে স্বয়ংক্রিয় চেয়ার, প্রথমে ওনারা নামেন, তারপরে আমরা আস্তে আস্তে নামি। নীট ইউনিফর্ম পরা গার্ড ট্রেনের পাশে হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় দেন আমাদের।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখতে পাই অপেক্ষমান বন্ধুদের হাসিমুখ, আমাকে নিতে এসেছে ওরা। সহযাত্রিনী বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শুভকামনা করে চলে যান নিজের পথে, আমি আমার শুভেচ্ছা দিয়ে দিই ওঁর সঙ্গে।
তারপরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলনমুহূর্তের উষ্ণতা-তা বর্ণনা করতে পারি এমন শব্দ তো নেই আমার ঝুলিতে!অনূক্ত থাক তাই সেসব,ভাষাহীন ভাষা হয়ে পৌঁছাক সুধী পাঠকের হৃদয়ে।
ঐ দূরে,কুউউউ ঝিকঝিকঝিক করে চলেছে স্মৃতি ও স্বপ্নের মায়াময় সবুজ ট্রেন, সময় তাকে ধরতে পারেনি, ক্ষয় করতে পারেনি...কোনো এক ভালোবাসার স্টেশানে পৌঁছানোর জন্য একদিন সবাই ঐ ট্রেনে যাত্রী হয়েছিলাম, যাত্রী হবো আবারও,বারে বারে... সবুজ ধানের খেতের পাশ দিয়ে, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদীর পাশ দিয়ে, ফার্নের পাতায় কুচোজল লেগে হীরার মতন জ্বলজ্বল করতে থাকা আলোছায়া বনভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে ট্রেন...
কুউউউ...ঝিক্ঝিক্ করে....
Monday, June 2, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment