পথের দু'ধারে আর পার্কিং-লটের চারপাশ ঘিরে অসংখ্য জারুলগাছ। সাদা আর হাল্কা গোলাপী থোকা থোকা ফুলে ভরে উঠেছে। বেশীরভাগই সাদা। জোরালো হাওয়ায় খইয়ের মতন উড়ে যায় শত শত, হাজার হাজার ফুল।
একদিন মেঘ করে আসে,আকাশ ভরে জটামেলা মেঘ আর দূর সমুদ্র থেকে আসা পরাক্রান্ত হাওয়া---সেই হাওয়ায় ওড়ে অসংখ্য জারুল ফুল। মনে পড়ে যায় আমাদের পাড়ার মাঠের ধার ঘেঁষেও অমন জারুলগাছে ফুলের মঞ্জরী, মৌসুমীমেঘের নীচে ওড়াও উড়ছে জোরালো বাতাসে। আহা উড়ুক, উড়ুক ওরা, মৌসুমী হাওয়ায় আনন্দে উড়ুক। এখানে আমি হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়ে নীচু হই, হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিই উড়ে পড়া জারুলের হাল্কা পাপড়িগুলো, হাতের তালু থেকে উড়ে যায় ওরা সামান্য শ্বাসবাতাসে। এদিক ওদিক তাকাই,কেউ দেখলো না তো? এইবয়সী মানুষকে এরকম ছেলেমানুষী করতে দেখলে কি ভাববে কেজানে! ভোরবেলায় নির্জন অবশ্য চারিধার,লোকজন আসতে থাকবে আরেকটু বেলা হলে।
পরদিন বাদলশেষের সোনালী রোদ্দুরের সকাল, গাছগুলোর কাছ দিয়ে আসতে গেলেই শোনা যায় গুণ্গুণ্গুণ্-ভোমরার ডানার শব্দ-আরো কাছে গেলে দেখা যায় অসংখ্য চকচকে সোনালী পিঠওলা কালো ভ্রমর খুব ব্যস্ত মধু খেতে, ওদের ডানায় লেগে লেগে ঝরে পড়ে হলদে পরাগ, বাতাসে উড়ে যায় স্বর্ণরেণুর মতন।ওদের কাছ দিয়ে কেউ চলে যাচ্ছে এ হয়তো ওরা লক্ষ্যও করে না,এত ব্যস্ত! অদ্ভুত প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘাই দেয়, গোটা শীতকাল---যখন গাছপালা রিক্তপর্ণ হয়ে ধূসর তপস্বীর মতন পড়ে ছিলো শুকনো কাঠের মত হয়ে,তখন এরা, এই মৌমাছি ভোমরা--এরা কোথায় ছিলো?
ক্যাম্পাস বিস্তৃত হচ্ছে, নতুন নতুন সব বিল্ডিঙ তৈরী হচ্ছে। আহা সেই উজ্জল খয়েরীবুক সূর্যরঙের ফুলেঢাকা টিঁ-ই-ই-ই করে ডাকা পাখিদের মাঠখানা বুঝি আর রইবে না, দেখি বালি সিমেন্ট এইসব জমা করছে, বিরাট বিরাট রোবট আর্মওলা কন্সট্রাকশনের গাড়ী কেবলই মাটিখোঁড়ে, জঞ্জাল সরায় আর কংক্রীটের চৌকো চৌকো স্ল্যাব এনে জড়ো করে।
ঐ মাঠ যখনি পার হই দিনে বা রাতে,সকালে বা সন্ধ্যায় ---যখনি পার হই দেখি ঐ কখানা পাখিকে,গলা বেষ্টন করে দুখানা গোল কালো দাগওয়ালা ধূসর রঙের লম্বা লেজ ছোটো পাখি, অক্লান্ত দৌড়ে বেড়ায় ওরা মাটির উপর দিয়ে, ওড়ে খুব কম। টিঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ তীক্ষ্ণ চড়া স্বর এই পাখির ডাকে।আমার খুব অবাক লাগে,এই পাখি ঘুমায় কখন? ছোট্টোবেলার ছড়া কেন জানি মনে পড়ে এদের দেখে--"হাট্টিমাটিম্টিম্/ তারা মাঠে পাড়ে ডিম/তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম্টিম্।"
কে জানে এরা সেই হাট্টীমা পাখির কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় কিনা! এই মাঠখানি ঘুচে গিয়ে কংক্রীটের স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে গেলে এরা কোথায় যাবে? টিঁ -ইঁ-ইঁ-ইঁ করে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে যাবে কোনো অভয়প্রান্তরে, যেখানে ওদের মাঠের বাসাখানি কেউ কেড়ে নেয় না?
বিভিন্ন প্রকৃতিবন্ধু ক্লাব, অর্গানাইজেশান এসব আছে এদেশে, তারা চেষ্টা করছে এইসব তৃণভূমি জলাভূমি বনাঞ্চল,বিশুদ্ধ নদীধারা এইসব বাঁচিয়ে রাখতে, মাঝে মাঝে ওরা দিয়ে যায় আবেদনপত্র, পোস্টে ও পাঠায়। কিন্তু কতটুকুই বা ওরাও করতে পারবে এই সর্বগ্রাসী লৌহসভ্যতার সঙ্গে লড়ে?
কত কত বন্য পশুপাখি চিরদিনের মতন লুপ্ত হয়ে গেছে দেশে দেশে-বামীর হাতের প্রদীপ শিখাটির মতন। কেজানে হয়তো কিছুই হারায় না,সবই রয়ে যায় কোথাও না কোথাও-কোনো নির্জন হৃদয়ের গভীর গোপণ কোনো কুঠুরিতে। ডোডো পাখি, সলিটেয়ার পাখি, নিনি হাঁস---সবই হয়তো রয়ে গেছে সেই অভয় দেশের সবুজ বনে,সোনালী বালুচরে,নীল সমুদ্রে।
একটা মকিং বার্ড সুর করে ডাকছে,এই পাখি একদম আমাদের দোয়েলের মতন দেখতে-কেন এত সুর করে ডাকে রিকিউ রিকিউ টীইন্না রিকিউ রিকিউ টিইন্না-দূর থেকে আরেকটা পাখি সাড়া দেয় ঠিক একই সুরে-কেবল মনে পড়ে যায় সব, অজস্র পাখির পৃথিবী ছিলো আমাদের শৈশবে বাল্যে কৈশোরে---মৌটুসী পাখিরা--মাথায় বাহারী ঝুঁটি ওদের, কী ব্যস্ত হয়ে পোকা খুঁজতো ঘাসবনে, মা-ডাহুক কী দ্রুত লিকলিকে সরু ঠ্যাং নিয়ে দৌড়ে যেতো সদ্যবোনা ধানচারাদের মধ্য দিয়ে,কদিন পরে ওর ক্ষুদে ক্ষুদে ছানাগুলো ওর পেছনে,বড়ো বড়ো শামুকখোল পাখি আসতো বর্ষার শস্যক্ষেত্রে, সবুজ টিয়ার ঝাঁক নামতো সবুজ বাগানে...আর সেসব নেই,অজস্র বাড়ীঘরে ইঁটকাঠের জঙ্গলে ঢেকে গেছে প্রায় সবটুকু সবুজ,ওরা কোথায় চলে গেছে!
একদিন কি মানুষ বুঝবে না, এইভাবে একাকী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না শুধু সভ্যতার অহংকার নিয়ে, সে একা বিচ্ছিন্ন নয়, সে এইসবের-এই সবুজের, এই পাখিদের, এই আকাশের,এই বাতাসের... অজস্র গাড়ী চলে পথে পথে,অসংখ্য কলকারখানা ধোঁয়া উগড়ে দেয়, আরো আরো আরো, গরম হয়ে ওঠে পৃথিবীর বাতাবরণ, গরমে আইস ক্যাপ গলে যেতে থাকে পৃথিবীর মেরুতে, অনেক সাদা ভালুকের শব উঠে আসে ধীবরের জালে, অপুষ্ট ক্লান্ত মৃতদেহ সব...
প্রকৃতিবন্ধু সংগঠন থেকে আসা কার্ডটির উপর থেকে একটি সাদা মেরুভল্লুক আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকে শুধু...আরেকটি কার্ডে মায়ের কোলের ওমে চুপ করে ঘুমিয়ে থাকা একটি সাদা শিশুভল্লুক। ওদের কোনোদিন দেখিনি আমি, কোনোদিন হয়তো দেখবোও না..."তবু আশা জেগে থাকে অয়ি অবন্ধনে/তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে..."
হাট্টিমা পাখিরা দৌড়ে বেড়ায় মাঠ জুড়ে, তীক্ষ্ণ চড়াসুরে টিঁ-ই-ই-ই-ই করে ডাকে, এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, আমি ঘরে ফিরে আসছি। কোথা থেকে একঝলক হাল্কা ফুলের গন্ধ ভেসে আসে, বেলফুলের গন্ধের মতন মনোরম...
কে যেন বলেছিলো, বাঁচো ও বাঁচতে দাও? কে যেন বলেছিলো প্রাণের চারণভূমিটি কেড়ে নিও না? কে যেন বলেছিলো রক্ষা করতে, যত্ন করতে, ভালোবাসতে? কে সে, কবে বলেছিলো? কিছুই মনে পড়ে না, আমি আনমনে পথ হাঁটি। তীক্ষ্ণ টিঁ-ই-ই-ই আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়, মনের পর্দায় যায় কি?
Monday, June 2, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment