একবার লিখতে লিখতে ভাবনায় পড়লাম কেন লিখি এসব? এইসব লেখার মধ্য দিয়ে কিছু কি পৌঁছে দিতে চাই? সদর্থক কিছু? তাই যদি হয় তাহলে কি সেই জিনিস, কি সেই বার্তা যা এইসব ছবিহীন গানহীন সুরহীন শুকনো কথা দিয়ে পৌঁছে দিতে চাই? কোনো উদ্দেশ্যই কি এতে পূরণ হয়?
সকলে নিজের নিজের সুন্দর দেশে নির্জনে স্বজনে প্রেমে অপ্রেমে সুখেদুঃখে বিরাগে অনুরাগে আছেন, কখনো ঝড় আসে বাসা ভাঙে, আবার দুর্যোগ থামে, রোদ ওঠে, ঝলমলে সুন্দর দিন আসে। এর মধ্যে পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র কোণার এই সামান্য একটি মানুষের ততোধিক সামান্য দিনকথনের কোনো মানে আছে কি?
ভাবতে ভাবতেই একদিন এসে যায় দীপাবলি উৎসব,দেশে বাড়ীতে বাড়ীতে মোমবাতি বা প্রদীপ বা ছোট্টো লালনীল টুনিবাল্ব দিয়ে সেদিন সাজানো হয়েছে বাড়ীর চৌহদ্দি,ছাদের রেলিং, বাড়ীর পাঁচিলের উপরে উপরে অজস্র মোমবাতির শিখা কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে।
আশ্চর্যভাবে প্রায় একই সময়ে এখানে হ্যালোউইন উৎসব,একত্রিশে অক্টোবর, মস্ত মস্ত মিষ্টিকুমড়োর ভেতরের সব কিছু বার করে নিয়ে গায়ে নানা আকারের ফুটো করে ভেতরে আলো জ্বেলে বাড়ীর দোরে দোরে বসিয়ে রাখা হয়, সেইদিন সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাড়ী বাড়ী যায় ক্যান্ডি চাইতে, তারা নানাধরনের অদ্ভুত পোশাকে সাজে, কেউ সাজে ভুত, কেউ প্রেত, কেউ দৈত্য, কেউ রাজকন্যা, কেউ দেবদূত। এসময় সব দোকানে দোকানে হ্যালো-উইন কস্টুমের হিড়িক পড়ে যায়।
এ উৎসব ভুতুড়ে একটু, আমাদের ভূতচতুর্দশীও তো ভুতুড়ে। হ্যালোউইনের পরেরদিন অবশ্য খুব উজল পবিত্র দিন, সকল সন্তের দিন-অল সেইন্ট'স ডে। আমাদের ভুতুড়ে ভূতচতুর্দশীর পরেও যেমন আসে দীপান্বিতা উৎসব, আলোর আহ্বান। এই আশ্চর্য মিলগুলো দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আগে তো দেশে দেশে এত যোগাযোগের উপায় ছিলো না, হোস্টিলিটিও অনেক বেশী ছিলো, নানা অন্য অন্তরায়ও ছিলো, কিন্তু কেমন করে উৎসবে লোকাচারে বিশ্বাসে উপকথায় গল্পে এত এত এত মিল? তাহলে কি আমরা যা ভাবি তা সর্বাংশে সত্য নয়, বহু আগেও দেশে দেশে মানুষে মানুষে অনেক যোগাযোগ ছিলো?
হ্যালোউইনের পরে থ্যাংকসগিভিং এর জন্য প্রস্তুতি চলছে, এও এখানকার আরেক উৎসব। নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পরিবারের সকলে মিলিত হয়ে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হয়, খাওয়ার আগে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। সারাবছর যেন এমনি দুধেভাতে মানে মাংসে রুটিতে রাখেন তিনি, যেন সন্তানসন্ততি সুখে থাকে। প্রধান খাবার টার্কী পাখির মাংস আর ভুট্টা সেদ্ধ। তবে পরিবারে পরিবারে খাবারে বৈচিত্র থাকে অনেক, ডেসার্ট হিসাবে কেউ করেন পেকান পাই,কেউ পামকিন পাই। কেউ টার্কীর সঙ্গে সঙ্গে রাখেন চিকেন, রাখেন ল্যাম্ব। এই সব মিলেই ধন্যবাদজ্ঞাপন অনুষ্ঠান।
থ্যাংকসগিভিং এর আগে আগেই অনেকে দেখা করতে চলে যাচ্ছে বাবামায়ের সঙ্গে, পরে সেসময় আবার যাবে, অনেকে সপ্তাহান্তে গ্রিল বের করে টার্কীর মাংস গ্রিল করতে বসিয়ে দিচ্ছে, আহা ধন্যবাদ যত বেশী হয় ততই তো ভালো।ভালো খাবারের বিকল্প আছে নাকি দুনিয়ায়?
খাবার বলতেই খাদ্যোৎসব মনে পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশের খাবার দাবার নিয়ে ছোটো করে আন্তর্জাতিক উৎসব হয় প্রত্যেক শরৎ চতুর্মাস্যে, আগে এটা হতো বসন্তে। আগে শপিং মল এ কোনো অংশ ভাড়া নিয়ে হতো, এখন ক্যাম্পাসেই হয়।
প্রত্যেক দেশের জন্য ছোটো ছোটো টেবিল,তাতে নিজের দেশের শিল্পকর্মের কিছু নমুনা,পতাকা,ছবি আর খাবার। সকলে সকলে ঘুরে দেখে,প্লাস্টিকের প্লেটে প্লেটে খাবার তুলে তুলে দেন ভলান্টিয়াররা! এত ভালো ভালো সব খাবার!
এত দেশ এই পৃথিবীতে আর প্রত্যেকের খাবারদাবার এত ভালো। মাত্র দুইঘন্টার উৎসবকে মনে হয় খুবই সংক্ষিপ্ত, বেশ হপ্তা জুড়ে খাদ্যোৎসব হলেই যেন ভালো হতো,নইলে এত খাবার চাখা যায় নাকি? কোরিয়ার খাবার খেতে খেতে ভেনিজুয়েলা বাদ পাড়ে যায়, সৌদি আরবের অপরূপ আলুবড়া আর বিরিয়ানি চাখতে গিয়ে ভারতের আলুছোলে আর ক্ষীর খাওয়াই হয় না। ইরাকে যে এত ভালো মিঠাই বানায় তাই বা কে জানতো? ভেনিজুয়েলার পায়েসসদৃশ খাবারটি একটু চেখে আসা হলো এরই মধ্যে,জাপানের সুশি, চীনের ঝালঝাল হুনানচিকেনও।
বহু দেশের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে এখানে, এমনিতে তো সবাই জিন্স টিশার্ট বা ওরকম কোনো গ্লোবাল পোশাকে ক্লাস টাস করে, আজকে অনেকে আপন দেশের রঙীন বস্ত্র পড়েছে, প্রসারিত ঘেরওয়ালা পোশাক, মাথায় পরেছে আপন দেশের শিরোশোভা। অজস্র ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে উঠছে অজস্র ছবি, বিরাট পৃথিবীটার কোণার কোণার রূপরসশব্দ একই ঘরের মধ্যে দেখতে পাবার অদ্ভুত অনুভব ধরার চেষ্টা, চলিষ্ণু সময়ধারাকে ফাঁকি দিয়ে ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা।
কী বিপুল এই পৃথিবী, অথচ কী কোমল,কী করুণ। ভালোবাসার ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে, নিজের চারপাশের পাথরের খোলস খুলে ফেলতে পারলেই বুঝি কেবল সেই ঝর্ণায় অবগাহন করা যায়। দুর্লভ মানবজীন ও সে জীবনের দুর্লভ আশীর্বাদ অনুভব করা যায়। "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ---"
Thursday, June 5, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment