1
এই ঘরগুলো আশ্চর্য, ভারী অদ্ভুত। এরা নিজেদের আকার বদলায়, রঙ বদলায়। গোটা বাড়ীটাই নিজের আকার আকৃতি বদলায়। কখনো মুহুর্মুহু বদলায়, কখনো ধীরে। গতকাল আমার ঘরটা ছিলো চৌকো, ছাদটা ছিলো বর্গাকার। এখন ঘরটা চতু:স্তলকীয়, ত্রিভূজাকার দেয়ালগুলো ঐ উপরে একটা বিন্দুতে মিশে গেছে, কোনো ছাদের প্রয়োজন হয়নি আর। দেয়ালগুলোর রঙও বদলে গেছে, গতকাল ছিলো হালকা সবুজ, ভিতর থেকে স্বচ্ছ আর বাইরে থেকে অস্বচ্ছ। আজ তারা নীলকান্তমণির মতন নীল, দুপাশ থেকেই অস্বচ্ছ।
সবকিছু নিজেদের বদলে ফেলে এখানে, ভারী অবাক লাগে আমার। হয়তো অবাক হওয়া উচিত না। আমার অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই, আমার মাঝে মাঝে মজারই লাগে। এত বৈচিত্র!
শুধু দেয়ালের রঙ বা আকারই তো না, জানালা দরোজাও বদলায়। কোনো কোনো দিন কোনো দরোজাজানালাই দেখতে পাই না, ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, ক্লসট্রোফোবিক লাগে। তখুনি ছোট্টো একটা দরোজা দেখা দেখা দেয় কোনো এক দেয়ালে, আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি। হালকা সুগন্ধী হাওয়া বয়ে যায় আমার মুখচুল ছুঁয়ে, বেলীফুলের গন্ধ হাওয়ায়। আমার মন হালকা হয়ে যায়, আনন্দের বৈদ্যুতি বয়ে যায় আমার ভিতর দিয়ে।
যেন ঘরগুলো বুঝতে পারে আমার মন, আমার সাথে খেলতে চায়। কখনো কখনো আমার ভালোই লাগে খেলতে, কখনো কখনো চাপা টেনশনে কিছুই ভালো লাগে না। তখুনি এরা খেলা বন্ধ করে দেয়, আমার মন শান্ত করে দেবার কিছু একটা করে। এরা কি আমার জন্য ভাবে?
আজকের নেপথ্যসুর ভারী নরম একটা সুর, বুঝতে পারিনা কি বাজনার সুর, ভারী ভালো লাগে। কখনো মনে হয় বেহালা, কখনো বাঁশী, কখনো জলতরঙ্গ। বাতাসে আজ জুঁই ফুলের গন্ধ।
এখানে অনেক সার্ভিস রোবট, এরা আমার সমস্ত প্রয়োজনের সময় সক্রিয়। মায়াও এদের মাধমেই আমার সাথে যোগাযোগ করেন। রোবটদের কেউ কেউ দেখতে একেবারে মানুষের মতন, কেউ কেউ আবার খুব যান্ত্রিক চেহারার। ধাতব চেহারার রোবট আছে, ক্রিস্টালাইন রোবট আছে।
মায়ার বার্তা নিয়ে আজকে এলো কিরা, কিরা দেখতে মানুষের মতন, মিষ্টি নরম চেহারার একটি মেয়ে, হালকা বাদামী চুলগুলো এলোমেলো, মুখে একটা নরম হাসি। কিরার হাসিটা কেন জানি খুব চেনা লাগে। কোথায় দেখেছিলাম এই হাসি? মনে পড়ে না, আগের অনেক কথাই ভুলে গেছি। তবু মনেও তো আছে অনেক কথা! যা ভুলতে চাই তা ভুলতে পারিনা, অথচ যা ভুলতে চাই না তা গেছি ভুলে।
কিরা আমাকে মায়ার বার্তা জানালো। মায়া আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, ঠিক ন'টার সময় আমার যেতে হবে মায়ার কাছে। মায়ার সামনে কেন জানি সবসময় আমি কেমন অস্বস্তি বোধ করি। আমি জানি না কেন এমন হয়। মায়া খুব স্নিগ্ধ, শান্ত চেহারার, যতবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রত্যেকবার ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছুতেই আমি মায়ার সামনে সহজ হতে পারিনা, অদ্ভুত এক টেনশন আমার মনটাকে পেঁচিয়ে ধরে।
মায়ার উপস্থিতির তাপ আবছাভবে আমাকে মনে করিয়ে দেয় কোনো একজনের কথা, একজন যাকে আমি খুব ভয় পেতাম, যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম, যাকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করতাম, যাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতাম, যাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আবার যাকে একমুহূর্ত সহ্য করতে পারতাম না। এইসব বিপরীত আবেগের অসম মিশ্রণ আমার মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠে, আমার মাথা ঘুরায়, সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগে। মায়ার কাছে যেতে ইচ্ছে করেনা, কিন্তু তবু তৈরী হতে থাকি। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু এসে যায় না, মায়ার যেকোনো নির্দেশই এখানে শেষকথা।
তৈরী হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমার ভাবনা বুঝতে পেরে স্বচ্ছ হয়ে যায় জানালা। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুরে হাসছে লাল পাতাওয়ালা গাছের বাগান। পৃথিবীর হেমন্তের কথা মনে পড়ে, যদিও এইসব গাছের পাতারা সবসময়েই লাল।
রাতে অজস্র তারাওয়ালা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রথম যেদিন আমাদের সূর্যকে দেখেছিলাম ক্ষুদ্র টিমটিমে একটি আলোকবিন্দুর মত, সেদিন কেমন একটা আশ্চর্য অনুভব হয়েছিলো! বুঝতে পারিনি সেটা কী। সে কি অভিমান, সে কি দুঃখ, নাকি সে অনাসক্তি?
পৃথিবীতে আমরা সংগ্রাম করেছিলাম স্বৈরতন্ত্রের বিরূদ্ধে, টোটালিটারিয়ান সমাজব্যবস্থা আমরা চাই নি। আমরা জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত দিতে তৈরী ছিলাম সে সংগ্রামে। সমান অধিকার আর চিন্তার স্বাধীনতা ছিলো আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস।
এখানে সবকিছু অন্যরকম লাগে, মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা শীতে ভেতর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। মানুষ এখানে প্রযুক্তিতে এত অগ্রসর আর এত দ্রুত আরো আরো অগ্রসর হয়ে চলেছে যে আমার পক্ষে বুঝতে পারাও সম্ভব না সবটা। আমি সবটা বুঝতে চেষ্টাও করি না। শুধু একটা জিনিস কাঁটার মতন খচখচ করে ভিতরে। কিছুতেই বুঝতে পারিনা, কেন এই মানুষেরা এত শান্ত, এত বাধ্য, এত নি:শব্দ আজ্ঞাবাহী? কেন তারা একটাও প্রশ্ন করে না, কেন তারা একটাও নতুন সাজেশান দেয় না?
যত পার্টিতে সভাসমিতিতে আনন্দোৎসবে গেলাম, সর্বত্র একই জিনিস দেখলাম। ঠান্ডা বাধ্যতা, শান্ত আনুগত্য। বিদ্রোহের একটা ছোট্টো ঝিলিক কারুর চোখের ভিতরে দেখার জন্য কী যে তৃষার্ত হয়ে থাকে আমার সারাদেহমন! একটা ছোট্টো সোনালি ঝিলিক শুধু যা এই নীরব মাথাকাত করা আনুগত্যের শৈত্য দূর করে দেবে। কোথাও দেখিনি। শুধু আরো আরো আরো শীতে কেপে উঠেছে আমার মেরুশিরা।
মায়ার কাছে যাবার সময় এগিয়ে আসছে, সেই অদ্ভুত শীত আবার আমার ভিতরে ফিরে আসছে। একটা নাম না জানা অস্বস্তি, ভয়। যেতে ইচ্ছে করে না, একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে। মায়ার কথার নড়চড় হয় না এখানে, হবে না কখনো। আহ, কতদিন আমিই বা মায়ার মায়াজালের বাইরে থাকতে পারবো? একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে।
এবারে ঘরে মায়া একাই ছিলেন। অন্য যেসব দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, সেসব সময়ে সবসময়েই আরো লোক ছিলো ঘরে। এবারে মায়া একা আর আমি তার সামনে। দু'জন একা, মুখোমুখি।
মায়ার ঘর আমার কাছে সবসময়ই ম্যাজিকম্যাজিক লাগে। কখনোই ও ঘরে কোনো দেয়াল দরজা জানালা কিছু চোখে পড়ে নি, শূন্যতার অনুভুতিও হয় নি কিন্তু। একধরনের আশ্চর্য আলো আর সঙ্গীতে পূর্ণ সে ঘর। বুঝতে পারিনা দাঁড়িয়ে আছি না ভেসে আছি। যেন ভিন্ন মাত্রা, যেন চেনা জগতের কিছু না সে, যেন একটা ভিন্ন বাস্তবতা যার সঙ্গে আমার সীমাবদ্ধ ত্রিমাত্রিক অনুভূতি পাল্লা দিতে পারে না।
সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ভালোবাসা-ঘৃণা তিতিক্ষা-জিঘাংসার বন্যায় ডুবে যাবার আগে কুটোর মতন হাত বাড়িয়ে ধরি স্মৃতি। কী হয়েছিলো মায়ার কাছে আসার আগের পথটুকু? হাসিমুখ কিরা আমাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলছিলো, একটা সবুজ দরজা খুলে গেল, আমরা একটা আলোছায়া ঝিলমিল করিডর ধরে যাচ্ছিলাম। চারিপাশে কী ছিলো, সবুজ দেওয়াল নাকি খোলা আকাশ?
আমি শিউলির গন্ধ পাচ্ছিলাম, অনেককাল আগের এক ভুলে যাওয়া শরতের ভোরের হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি যেন অনন্তকাল পথ চলছি, চলছি, চলছি। দিন আসছে, রাত আসছে, বাঁকা চাঁদ পূর্ণ থালার মতন গোল হয়ে উঠছে, আবার ক্ষইতে ক্ষইতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
একটা বাঁক ঘুরে দৃশ্য বদলে যায়। এগিয়ে আসে ইলক আর সেডিনা- ওদের চিনি। ওরা ক্রিস্টালাইন চেহারার রোবট। ইলক পুরুষ, সেডিনা মহিলা, মানে সেরকম দেখতে। মূর্তির মতন চেহারা হলেও দুজনেই হাসিখুশী, ভারী আন্তরিক মনে হয় ওদের। এখানে কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা যে অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারিনা। ইলক আর সেডিনার হাতে আমাকে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল কিরা।
(To Be Continued)
Tuesday, June 24, 2014
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment