১।
 
    সুড়ঙ্গের গল্প আমি প্রথম শুনি তুসির দিদার কাছে।  তখন আমি আর তুসি  দু'জনেই ছোটো, এই সাত কি আট বছর বয়স তখন আমাদের।  খুব ছোটো থেকেই ও ছিল  আমার প্রাণের বন্ধু, গলাগলি ভাব ছিল দু'জনায়।  একই স্কুলে একই ক্লাসে  পড়তাম আমরা। স্কুল থেকে ফিরে নিজের বাড়ীতে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে  সামান্য কিছু খেয়েই  দৌড়ে যেতাম ওদের বাড়ী। একসঙ্গে খেলতাম ওদের বিশাল  বাগানে। লুকোচুরি বা রান্নাবাটি খেলার পক্ষে আদর্শ জায়গা ছিল ঐ বাগান।
 
 
   অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল বাগানটা। বিরাট বিরাট বিরাট সব আম জাম কাঁঠাল
 নারকেল গাছ ছিল সেখানে। পাতাবাহারের  গাছ ছিল কত ! নুড়ি বিছানো লম্বা
 রাস্তার দু'ধারে ছিল সারিবাঁধা দেবদারু গাছ। আর কতরকমের যে মরশুমী ফুলের
 গাছ ছিল!  বাগানের একপাশে ছিল একটা পুকুর। ছোট্টো পুকুর , বাঁধানো ঘাট।
 পাথুরে সিঁড়ির তিনধাপ নামলে তবে জল। আমাদের ঐ পুকুরের দিকে যেতে দেওয়া
 হতো না তখন, কিন্তু ভারী একটা আকর্ষণ ছিল ঐ পুকুরের। দূর থেকে দেখতাম
 শাপলা ফুটে আছে পুকুরে আর ফড়িংগুলো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সেই ফুলে ফুলে। 
 
   বাগানের গাছের তলায় আমরা খেলতাম। কোনো কোনোদিন তুসি বলতো, "আজ খেলতে
 ভালো লাগছে না রুবা। চল, আজকে গল্প শুনি দিদার কাছে।" 
 
    সেসব দিনে তুসির দিদা গল্প বলতেন ওদের বাগানমুখো গোল বারান্দায় মোড়া
 পেতে বসে। আমরা শান্ত হয়ে তাঁর দু'পাশে মেঝেতে বসে শুনতাম গল্প। একটা
 গল্প আজও মনে আছে, এক আশ্চর্য সুড়ঙ্গের গল্প। 
 
 
     গল্পটা ছিল এইরকমঃ একদল ছেলেমেয়ে পাহাড়ের ঢালে গরু আর ছাগল চরাতো।
 তাদের মধ্যে ছিল এক দুঃখী ছেলে, ওর মা ছিল না, ঘরে সৎ মা ওকে বকতো মারতো
 কোনো ভুল করে ফেললেই, মাফ চাইলেও ছাড়তো না। ওর বাবাও কেন জানি ওর হয়ে
 কিছু বলতো না। দুঃখী ছেলেটা তাই ওর বাবা আর সৎ মা দু'জনকেই ভয় করতো।
 কেবলই ওর মনে হতো আহা যদি ওর নিজের মাকে ফিরে পেতে পারতো, তাহলে সে আর
 ঘরে ফিরতো না। মায়ের সঙ্গে চলে যেত মা যেখানে নিয়ে যায়! সে জানতো তা হবার
 নয়, তবু কেবলই ওর কল্পনায় আর স্বপ্নে ফিরে ফিরে দেখা দিতো ওর মা। 
 
 
   সেই ছেলে একদিন তার গরু হারিয়ে ফেললো। দিনের শেষে সবাই ঘরে গেল তাদের
 গরু ছাগল সব নিয়ে, সে ফিরতে সাহস পেল না। গরু হারিয়ে ঘরে ফিরলে সৎ-মা আর
 বাবা মিলে হয়তো তকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে একদম। তাই সে ঐ পাহাড়ের
 ঢালেই গরু খুঁজে বেড়াতে লাগলো সাঁঝবেলার অন্ধকারে। 
 
 
    খুঁজতে খুঁজতে সে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে থাকে। পাহাড়ের দুর্গম খাঁজের
 দিকে- যেদিকে আগে সে কোনোদিন যায় নি, সেইদিকে যেতে থাকে। এদিকে সাঁঝের
 পাতলা অন্ধকার তখন গভীর হচ্ছে, রাত্রি হয়ে আসছে। ভয় করে ছেলেটার, শীত
 করে, খিদেয় আর ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চায় কিন্তু তাও সে বাড়ির দিকে
 রওনা হতে পারে না। হারানো গরুটাকে খুঁজে পেতে হবে তাকে। 
 
 
    অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসে চাঁদ, জ্যোৎস্নায় ছেলেটা চারিদিক দেখে বুঝতে
 পারে সে পথ হারিয়েছে। চারিদিকে সব অচেনা।  সে হতাশ হয়ে বসে পড়ে মাটিতে আর
 তাকে ঘিরে নেমে আসে অদ্ভুত এক কুয়াশা। ছেলেটা অচেতন হয়ে যায়। 
 
 
    বেশ কিছুক্ষণ পরে চেতনা ফিরে পেয়ে উঠে বসে ছেলেটা। উঠে দ্যাখে ঘন
 কুয়াশা তার চারিদিকে। সেই কুয়াশা ভেদ করে হাম্বা-আ আ ডাক শুনতে পায় সে।
 আরে! তার হারানো গরুটা না? কুয়াশার ভিতর দিয়েই সে শব্দ লক্ষ করে এগোতে
 থাকে। দু'হাত মুখের সামনে জড়ো করে বাটির মতন করে সে ডাকে হারানো গরুটার
 নাম ধরে- "বুধি ই ই। " 
 
 
   কোথা থেকে যেন বুধি সাড়া দেয়, " হাম্বা-আ আ। " 
 
    কুয়াশার ভিতর দিয়ে অন্ধের মতন হাতড়ে হাতড়ে চলতে চলতে হঠাৎ ছেলেটা
 দেখতে পেল একটা পরিষ্কার খোলা পথ, জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। সেই পথ দিয়ে সে
 হাঁটতে শুরু করে সম্মোহিতের মতন। জমাট কুয়াশা ভেদ করে আলোর সুড়ঙ্গের মতন
 সেই জ্যোৎস্নাপথ কেজানে কোথায় চলে গিয়েছে। কোথাও কোনো শব্দ আর শোনা যায়
 না, বুধির ডাক মিলিয়ে গিয়েছে নিঃশেষে। 
  
একবার ছেলেটা ভাবে, তাহলে কি সে  কল্পনা করেছিল বুধির ডাক? আর কিছু সে ভাবতে পারে না, কিছুতেই থামতেও পারে
 না, ফিরতেও পারে না, চলতেই থাকে।
 
 
     জ্যোৎস্নাময় সেই রাস্তা তাকে নিয়ে আসে পাহাড়ের এক গোপণ বাঁকে, একটা
 গুহামুখের সামনে। গুহামুখ খোলা, সে উঁকি দেয় ভিতরে। সে ভেবেছিল ভিতরে খুব
 অন্ধকার থাকবে, কিন্তু অবাক হয়ে সে দেখলো ভিতরে সেরকম অন্ধকার না, হাল্কা
 নরম আলো আসছে যেন কোথা থেকে। আর সেই সঙ্গে আসছে আশ্চর্য এক বাঁশির সুর। 
 
 
 ছেলেটা ঢুকে পড়ে গুহাতে। ঢুকেই বুঝতে পারে, সেটা দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গপথ,
ঢেউয়ের মতন কখনো উপরে উঠে কখনো নিচে নেমে সেই সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ পাহাড়ের
 ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে।
 
 
    আশ্চর্য ঐ সুড়ঙ্গের ভিতরে সে ঢুকে পড়তেই পিছনে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ
 বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরের সেই রহস্যময় জ্যোৎস্নার মতন নরম আলোটুকু কিন্তু
 নিভে যায় নি, বরং আস্তে আস্তে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠলো ।  বাঁশির যে সুর ভেসে
 আসছিল তা স্পষ্টতর হয়ে উঠলো। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে এলো বকুল ফুলের
 গন্ধ। 
 
 
    ছেলেটা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ভাবছিলো কোন্ দিকে যাই? সুড়ঙ্গপথে
 দূরে তারাবাজির ফুলকিগুলোর মতন কী যেন জ্বলে উঠলো, ছেলেটা সেইদিকে রওনা
 হলো। তারপরে ঐ ফুলকি তাকে পথ দেখায় আর সে চলে। পথ কোথাও সোজা-সরল, কোথাও
 ভয়ানক জটিল আর প্যাঁচালো। কিন্তু ছেলেটা অক্লান্ত চলতে থাকে। 
 
তার আর  সময়ের কোনো বোধ ছিল না, কখনো মনে হচ্ছিল সে যেন চলছে শুধু কয়েক মুহূর্ত,
কখনো মনে হচ্ছিল সে যেন হাঁটছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর
 বছর। ক্ষুধাতৃষ্ণা বা ক্লান্তির কোনো বোধই তার আর ছিল না, কেবল তার মনে
 হচ্ছিল সুড়ঙ্গের কি শেষ আছে কোথাও? কোনোদিন কি সে সেখানে পৌঁছতে পারবে?
কী আছে ওপারে? 
 
 
      একসময় সে সুড়ঙ্গের শেষ দেখতে পায়। একটা গোলমতন খোলা দরজা যেন,
সেইখান দিয়ে আসছে ঝকঝকে আলো। সে দৌড়ে গেল সেইদিকে। সুড়ঙ্গের শেষে দাঁড়িয়ে
 সে দেখলো ওপাশে অপূর্ব এক জগৎ, সবুজে সবুজ, আলোয় ঝলমলে। কতরকম নানা রঙের
 ফুল ফুটেছে আর কতসব চেনা-অচেনা ফল ধরেছে গাছে গাছে, কত না অপরূপ পাখি উড়ে
 বেড়ায় নীল আকাশে। আর সেই অপরূপ জগতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তার মা, বহুকাল
 আগে হারিয়ে যাওয়া মা তার। সে এক ছুটে বেরিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। 
 
 
    তুসির দিদার গল্প এইখানেই শেষ হয়েছিল। আমি তুসির দিকে চেয়ে দেখতে
 পেয়েছিলাম ওর দু'চোখ ভরে জল টলটল করছে। তুসিটা খুব আবেগপ্রবণ ছিল। গল্প
 শুনে কাঁদতো, গল্পগুলোকে সত্যি বলে বিশ্বাস করতো। আমি রূপকথা শুনতাম বটে,
সেই নিয়ে ভাবতামও, কিন্তু সেই বয়সেও সেগুলো আমার কাছে নিছক গল্পই ছিল।
 সেগুলোকে সত্যি ভাবতাম না কখনো।  তুসিকে রূপকথা শুনে কাঁদতে দেখে আমার
 শুকনো চোখ দুটোতে কেমন জ্বালাজ্বালা করতো, ওর মতন অত কোমল হৃদয় আমার নেই
 বলে নিজের জন্য দুঃখ হতো। 
 
 
      ২।
 
    এর অনেকদিন পরে, প্রায় বছর তিন কি চার পরে আরেকটা সুড়ঙ্গের কথা শুনি,
সেটা ঠিক রূপকথার মতন ছিল না, সেটার মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত অজানা ভয়
 লুকানো ছিল। এই সুড়ঙ্গের কথা শুনেছিলাম তুসির মায়ের কাছে। 
 
 
    তুসিদের বাড়ীর দক্ষিণের ঘরে ওর মা থাকতেন। ঐ ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে
 বাগানের দিকে চেয়ে থাকতেন। ওর মাকে ভাবলেই কেবল জানালায় দাঁড়ানো
 চেহারাটাই মনে পড়ে। মাঝে মাঝে ভদ্রমহিলা গান গাইতেন অথবা কবিতা আবৃত্তি
 করতেন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে। একজন সবসময়ের দেখাশোনার পরিচারিকা ছিল তুসির
 মায়ের জন্য। তুসি তাকে সেবন্তীমাসি বলে উল্লেখ করতো।  সেবন্তীমাসি বিশেষ
 কথাবার্তা বলতো না, বাগানে টাগানে কোনোদিন আসতেও দেখিনি। সে  শুধুই তুসির
 মায়ের ঘরে টুকটুক করে কাজ করতো। 
 
 
   তুসি ওর মায়ের কাছে বিশেষ যেত না। ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগতো,
কিন্তু সেই নিয়ে তখন তেমন ভাবতাম না। বড়দের ব্যাপারে কৌতূহল দেখানো বারণ
 ছিল আমাদের। পরে, অনেক পরে, বড় হয়ে তুসির মায়ের কথা জেনেছিলাম বিস্তারিত। 
 
 
 সেকথা পরে হবে। 
 
 
    তখনও আমরা প্রাইমারি স্কুলেই পড়ি, ক্লাস থ্রী বা ফোরে,  এক ছুটির
 দিনের বিকেলে তুসিদের বাড়ি গিয়েছি ওর সঙ্গে খেলবো বলে, গিয়ে শুনি ও বাড়ী
 নেই।  সেবন্তীমাসি বললো যে তুসি ওর দাদু-দিদার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে,
ফিরবে রাত্তিরে। সেদিন একটা জিনিস দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম, কারণ
 সেবন্তীমাসি বারান্দায় বসে বসে রুমালে সূচের কাজ করছিল।  সবসময়েই তুসির
 মায়ের ঘরে থাকতে নিশ্চয় তাহলে ওর ভালো লাগতো না, তুসির দাদু-দিদার
 নির্দেশেই হয়তো থাকতে হতো। 
 
 
    তুসি বাড়ী নেই দেখে  কেমন একটু হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম, বাগানের
 দিকের  জানালাটার থেকে আমাকে ডাকলো কে যেন। "এই , এই, এদিকে এসো না! এই
 যে আমি জানালায়। এসো না একটু।"
 
 
     আমি অবাক হয়ে দেখি তুসির মা আমায় ডাকছেন জানালা থেকে। সুন্দর একটা
 উজ্জ্বল সবুজ পাড়ওয়ালা  কমলা রেশমী শাড়ী পরা ছিল তার, লম্বা চুল মেলা ছিল
 ঘাড়ে পিঠে। সেদিন হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল তুসির মাকে এত সুন্দর দেখতে! আমার
 রূপকথা-অবিশ্বাসী হৃদয়ের পাথুরের দেওয়ালে যেন একটা গর্ত হয়ে গেল, তুসির
 মাকে মনে হলো যেন বন্দিনী এক রাজকন্যা। 
 
 
   বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার সামনেই।  বললাম, "কিছু বলবেন আমায়?"
 
    তুসির মা কেমন ঘোরলাগা গলায় বললেন,"আমাকে এই ঘরের মধ্যে থাকতে হয়
 সবসময়। ওরা আমাকে এখান থেকে বেরোতে দেয় না। " 
 
 
কথাটার মধ্যে এমন এক বিষাদ আর অসহায়তা ছিল যে আমি মূক হয়ে গেলাম। কী বলবো
 বুঝতে পারছিলাম না।
 
   জানালার শিক ঘেঁষে এসে তিনি বললেন, "তুমি আমার ঘরের দরজা খুলে দেবে?
লক্ষ্মীটি। একটু শুধু বাগানে গিয়ে আকুঞ্জিলের  পাশে দাঁড়াবো। একবার,
মাত্র একবার।" 
 
     আমি অবাক হয়ে বললাম, "আকুঞ্জিল ? সেটা কী?"
 
     খিল খিল করে হেসে উঠলেন তুসির মা, বললেন, "বোক্কা মেয়ে, আকুঞ্জিল
 জানো না? ও-ও- ই যে আকুঞ্জিল" এই বলে বাগানের পুকুরটার দিকে দেখালেন
 জানালার শিকের মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে।
 
    তারপরে বলেই চললেন, "আকুঞ্জিলে থাকে সোনা-চিকমিক আর রূপো-ঝিকঝিক।
 বুঝলে না বুঝি? ওরা আমার পোষা দুটো মাছ। আর ঐ যে ওর পাশে গাছটা, তার নাম
 দিব্যতরু। কত কত উড়ালি এসে বসে দিব্যতরুর ডালে! দ্যাখো নি বুঝি? তোমরা
 ওদের বলো পাখি। আমি বলি উড়ালি। হি হি হি। "
 
 
     আমার কেমন ভয়-ভয় লাগতে শুরু করেছিল, কিন্তু ওখান থেকে সরে যেতেও কেন
 জানি পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল তুসির  মা যেন রহস্যময় একটা অন্য জগতের কথা
 বলছেন, যে জগৎ খুবই কাছে কিন্তু আমরা ছুঁতে পারি না। 
 
    তুসির মা এবারে কেমন গোপণ কথা বলার মতন চারদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে
 বললেন, "আরো একটু কাছে এসো, তোমাকে একটা কথা বলি।"
 
     আমি জানালার আরো কাছে গেলাম সাবধানে, কিন্তু এতটাও কাছে না যে তুসির
 মা আমায় ধরতে পারেন। 
 
    তুসির মা ফিসফিস করে বললেন, "জানো, আকুঞ্জিলের তলায় একটা সুড়ঙ্গ আছে।
 অচিন দেশে যাবার পথ সেটা। যদি কোনোদিন আমি এই ঘর থেকে বেরোতে পারি তবে
 সেই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাবো অচিন দেশে। আর কেউ আমায় খুঁজে পাবে
 না, পাবে না, পাবে না। তখন মজা হবে, হি হি হি, খুব মজা হবে।"
 
      অদ্ভুত অস্বাভাবিক গলায় জোরে হেসে উঠলেন, সেই হাসির শব্দে চমক ভেঙে
 আমি দৌড়ে পালাতে শুরু করলাম। পালাতে পালাতে শুনতে পেলাম হাসতে হাসতে
 কান্নায় ভেঙে পড়ছেন  তুসির মা।
 
 
    ঐ ঘটনার কথা তুসিকে কোনোদিন বলা হয় নি। আসলে সেভাবে বলার সময়ই বা
 পেলাম কোথায়? ঐ ঘটনার কয়েক মাস পরেই তুসির  মা মারা যান, বাগানের ঐ
 পুকুরের জলে ডুবে।  কেজানে হয়তো কেউ অসাবধানে দরজা খুলে রেখেছিল তার
 ঘরের, উনি চুপিচুপি বেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাগানে।
 
 
    তুসির দাদু-দিদা ওর মায়ের মৃত্যুর  কিছুদিন পরেই ঐ বিরাট বাগান সমেত
 বাড়ী বিক্রি করে চলে যান তুসিকে নিয়ে। তুসির এক মামার কাছে, বিদেশে। ওর
 সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
 
 
 ৩।
 
    তুসির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই আমার শৈশব ও বাল্যের রূপকথা-টলটল
 প্রহরগুলোর উপরে ঢাকনা পড়ে গেল। এর পরে বড় হবার পালা। জীবন ভরে উঠতে
 লাগলো কঠোর থেকে কঠোরতর গদ্যে। 
 
 
    চারিদিক তখন প্রতিযোগিতাময়। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নানারকম বাধ্যতামূলক
 পরীক্ষা টরীক্ষা এইসবের ভিতর দিয়ে কেটে যেতে লাগলো দিনের পর দিন, মাসের
 পর মাস, বছরের পর বছর।
 
 
   স্কুলে যারা বন্ধু হয়েছিল, তারা সবাই ছিল সহ-প্রতিযোগীমাত্র। কোচিং
 ক্লাসে যারা বন্ধু হয়েছিল, তারাও তাই। তাদের কথাবার্তা ছিল সব কেজো
 কথাবার্তা, কেরিয়ার বিষয়ক কথা। ভবিষ্যৎ জীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জনের
 সম্ভাবনা যেসব পেশায়, সেসব পেশার কথা মাথায় রেখে কেরিয়ার তৈরীর ইঁদুর
 দৌড়।
 
 
    জানা-বোঝা- শেখার আনন্দ, চিন্তাভাবনার আনন্দ-সবই কেমন যেন ঝাপসা হয়ে
 মিলিয়ে যেতে লাগলো, এই দাবীটা সব ছাপিয়ে জোরালো হয়ে উঠলো, যেন তেন
 প্রকারেণ ভালো নম্বর চাই, সে না বুঝে মুখস্থ করে উগরে দিয়ে এলেও তাই সই।
 বিপুল এক তাড়নায় সবাই যেন অন্ধের মতন দৌড়চ্ছে, কোনো এক চরম ক্ষমতাশীল
 রাখাল যেন লাঠি তুলে দেখিয়ে দিয়েছে একটা দিক, সেইদিকে অনেক
 বিত্তসম্ভাবনা, অমনি সবাই ভেড়ার পালের মতন দৌড় দিয়েছে সেদিকে। 
 
 
     তুসির মায়ের কথা বিস্তারিত কবে শুনেছিলাম সে ঠিক মনে পড়ে না, হয়তো
 তখন ক্লাস এইটে বা নাইনে পড়ি।  শুনেছিলাম আমার নিজের পিসির কাছে। 
 
তুসির  মা, তার আসল নাম সোহিনী, আমার পিসির সঙ্গেই পড়তো একই স্কুলে, একই ক্লাসে।     স্কুলের শিক্ষিকারা সোহিনী বলতে অজ্ঞান ছিলেন, ও পড়াশোনায় খুব ভালো
 ছিল কিনা ! শিক্ষিকারা আশা করতেন মাধ্যমিকে আর উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো ফল
 করবে সে। মাধ্যমিকে খুব ভালো করেছিল সোহিনী, কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক  পরীক্ষার আগে থেকেই তাকে বিয়ে দেবার তোড়জোর শুরু হয় বাড়ী থেকে।
 
   কারণ ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময়ই  সোহিনী প্রেমে পড়েছিল এক 
 কোচিং-সহপাঠীর, সেটা ওর বাড়ীতে আবার জানিয়ে দিয়েছিল ওদের কোনো চেনা লোক,
সে নাকি সোহিনীকে ঐ সহপাঠী ছেলেটির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াতে
 দেখেছিল। তারপরেই বাড়ীতে কড়াকড়ি শুরু হয় সোহিনীর উপরে। আর ওর বিয়ের
 সম্বন্ধ করতে শুরু করে দেন ওর মা-বাবা। 
 
 
    প্রায়-কিশোরী সোহিনী ঐ অভিজ্ঞতায় খুবই ডিস্টার্বড হয়, তার প্রভাব পড়ে
 ওর পড়াশোনাতেও। অথচ ওটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল, অনেক
 সহানুভূতির সঙ্গে সেই ব্যাপার সমাধান করা যেত। কিন্তু তা হলো না, মেয়েটার
 জীবনটাকে পুরোপুরি বন্দীত্বের মধ্যে ফেলে দিতে চাইলেন ওর অভিভাবকেরা। 
 
 কোথাও একা বেরোনো বারণ হয়ে গেল সোহিনীর, এমনকি স্কুলে বা কোচিং এও ওর মা
 অথবা বাবা সঙ্গে যেতেন পৌঁছে দিতে। আবার বাড়ী নিয়ে আসার সময়ও গিয়ে সঙ্গে
 করে নিয়ে আসতেন।
 
 
     সোহিনী বিয়ে একেবারেই করতে চায় নি, তার ইচ্ছে ছিল
 জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়শোনা করার। সে পারতো, সে নিশ্চয় সুযোগ পেলে
 ঐ লাইনে ভালো কাজ করতে পারতো।  কিন্তু কিছুই তার ইচ্ছে অনুসারে হলো না,
উচ্চমাধ্যমিকে নিতান্ত সাধারণ মানের রেজাল্ট করার পরে পরেই তাকে বিয়ে
 দিয়ে দেওয়া হলো তার বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে। মাত্র আঠেরো বছর
 বয়স তখন সোহিনীর।
 
 
   বিয়ের বছর চারেক পরে তুসি জন্মায়, আর তার পরেই পাগল হয়ে যায় সোহিনী।
 খুব নাকি ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিল। ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা কন্যাসহ ওকে রেখে
 যায় বাপের বাড়ীতে।  চিকিৎসার পরে যখন সে মোটামুটি স্টেবল তখন ডিভোর্স হয়ে
 যায় স্বামীর সঙ্গে। তারপর থেকে তুসিকে নিয়ে বাপের বাড়ীতেই স্থিতি। 
 
 সন্তানের কাস্টডি সে  পেয়েছিল কোর্টের সহায়তায়। কিন্তু তারপর সোহিনী
 কোনোদিনই আর আগের সুস্থসবল মন ফিরে পায় নি, পরবর্তীকালে সবসময়ই নিয়মিত
 ওষুধ খেয়ে যেতে হতো ওকে।
 
 
     আমার পিসি খুব আফশোস করছিল অমন সম্ভাবনাময় একটা জীবন ওভাবে শেষ হয়ে
 গেল বলে। শুনতে শুনতে অদ্ভুত এক বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল আমার
 ভিতরটাও। কেন আমাদের সব আশা-জাগানিয়া মানুষরা এভাবে হারিয়ে যায়? আমাদের
 হাতে পায়ে কেবলই কেন অর্থহীন বন্ধন জড়িয়ে যায় পাকে পাকে? 
 
 
       তুসির সঙ্গে সেই অমলীন বন্ধুত্বের শিউলিগন্ধী সোনাঝরা প্রহরগুলো
 মনে পড়তো যখন, তখন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলতে হতো আমায়। সেইসব দিনে বরং
 আমাদের মনগুলো স্বাধীন ছিল, চিন্তাভাবনা কল্পনার অবকাশ ছিল, অনুভব করতে
 পারার পথ ছিল। কিন্তু সব বিসর্জন দিয়ে  গড্ডলিকাপ্রবাহে সামিল করে দিল
 সমাজ। মাঝে মাঝে মনে হতো তুসি হয়তো অনেক দূরে অন্য দেশে মুক্তচিন্তার
 মধ্যে বড় হচ্ছে, হয়তো আমরা যা পারবো না, ও ঠিক পেরে যাবে। 
 
 
    হয়তো ঐ গড্ডলিকাপ্রবাহেই জীবন বয়ে যেত, হঠাৎ যদি না একটা ব্যতিক্রমী
 ঘটনা ঘটতো। তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে, তুসির চিঠি এলো একদিন। প্রেরকের
 ঠিকানা আমাদেরই রাজ্যের একটা বড় শহর। চিঠি পড়ে রহস্যভেদ হলো। তুসি বিদেশে
 মামা-দাদু-দিদার কাছে থাকতে পারে নি বেশীদিন, ওর বাবা ওকে নিজের পরিবারে
 নিয়ে আসেন। দাদু-দিদাও পরলোকে, সেও হয়ে গেল অনেক বছর। 
 
 
   তুসির চিঠির একটা জায়গা আমার এখনো মনে আছে, সে লিখেছিল, " রুবা, তোর
 মনে আছে দিদা আমাদের গল্প বলতো? একটা গল্পে ছিল এক রাখালছেলের কথা? যার
 মা ছিলনা? বাড়ীতে ছিল অত্যাচারী সৎ মা আর রাগী বাবা, যাদের অত্যাচার থেকে
 পালাবার জন্য সে উশখুশ করতো? একদিন সে একটা সুড়ঙ্গপথে চলে গিয়েছিল এক
 সুন্দর জগতে? গল্পটা মনে পড়ে খুব, জানিস? 
 
 
       না, সৎ-মায়ের জন্য না, আমার সৎ-মা ভালো, সে অত্যাচার করে না। আমাকে
 নিজের মেয়ের মতনই যত্ন করে। বাবাও রাগী নয় তেমন, বেশ ভালোই। কিন্তু সেই
 ভালো ব্যবহার আমার নিঃশর্ত বাধ্যতার মূল্যে। আমি ওদের ইচ্ছার বিপরীতে
 সামান্য কিছু করলেও আমাকে চূর্ণ করে দিতে এক মুহূর্ত দেরি হবে না ওদের। এ
 বন্দীত্ব যে বোঝাবার নয় কারুকে! একমাত্র তুই হয়তো বুঝবি। 
 
 
    আমি যে কিছুদিন অন্যদেশে ছিলাম, তাই বুঝতে পারি এখানে আমার বাড়ীর
 লোক, স্কুল, বন্ধুবর্গ, গোটা সমাজ যেন আমাকে বাধ্য করছে একটা ছাঁচের
 মধ্যে পড়ে যেতে, আর আমি প্রাণপণে সেই সুড়ঙ্গটা খুঁজছি যেটা দিয়ে মুক্তিতে
 চলে যাওয়া যায়। রুবা হয়তো তুইও আমার মতই ভাবিস, কেজানে! 
 
 
    এতকাল বাদে তোকে লিখছি কেন জানিস? তোকে লিখে মনে শক্তি পাবার চেষ্টা
 করছি। হয়তো এতদিনে তুই আমার নিজের মায়ের কথা জেনেছিস। আমার মা এই বদ্ধ
 সমাজের থেকে মুক্তি চেয়েছিল, পায় নি। অবশেষে পাগল হয়ে গিয়ে বেঁচেছিল। আমি
 কিন্তু লড়াই ছাড়বো না। তুই, রুবা, তুইও লড়াই ছাড়িস না। একদিন আমরা সেই
 সুড়ঙ্গটা খুঁজে পাবোই পাবো, তার ওপারেই মুক্তি, অনেক আলো। লড়াই যত কঠিন
 হোক, ছাড়বো না আমি, তুইও ছাড়িস না রুবা। একদিন আবার আমাদের দেখা হবে। 
 
    ভালো থাকিস রুবা, আমার শুভেচ্ছা রইলো অনেক।
 
     ইতি-
 
   তোর তুসি
 
    পুনশ্চঃ এ চিঠির জবাব দিস না, আমার নামে আসা সমস্ত জিনিসপত্র খুলে
 দেখা হয় এ বাড়ীতে, আমি চাই না তোর চিঠি ওরা খুলে দেখুক। তুই মনে মনে জবাব
 দিস, মনে মনে আমি ঠিক তোর জবাব পড়ে নেবো।
 
    বিকেলের ছাদে বসে চিঠি পড়ছিলাম, পড়া হয়ে গেলে চিঠিটা হাতের মধ্যে
 মুড়ে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা হয়ে এলো, এক এক করে
 আকাশে তারা ফুটতে থাকলো, আমার মনে হচ্ছিল সামনে একটা বিরাট অজানা
 প্রান্তর, সেই পথ পাড়ি দিতে হবে আমাকে। এই স্কুল কোচিং জয়েন্টের
 প্রিপারেশন-এইসব চক্করে আমার ধ্রুবতারাটি হারিয়ে ফেলেছিলাম যে! তুসির
 চিঠি কুয়াশা সরিয়ে আবার তারাটিকে উন্মূক্ত করে দিল যেন! 
 
    সেইদিন সারারাত ছিন্ন ছিন্ন ঘুমের মধ্যে মধ্যে স্বপ্নে দেখে গেলাম
 তুসির মাকে, সে বলছে, " জানো, ঐ তারাগুলোকে জানতে চেয়েছিলাম আমি, ঐ দূরের
 তারাগুলোর ভিতরে কী আছে জানতে চেয়েছিলাম। আরো আরো দূরের জগৎ, বিশাল বিশাল
 সব গ্যালাক্সি, ওদের জানতে চেয়েছিলাম। ঐ দৈত্যাকার গ্যালাক্সিদের
 কেন্দ্রের  বিপুল শক্তির রহস্যময় উৎসকে জানতে চেয়েছিলাম। আমায় ওরা  দিল
 না সেসব জানতে। কিন্তু আমি সুড়ঙ্গটা খুঁজে পেয়েছি, ওখান দিয়ে আমি পালিয়ে
 যাবো।" 
 
     পরদিন সকালে উঠেই নিজের কর্তব্য বুঝতে পারলাম। ছাঁচে ঢালা পথে আর নয়,
যত কঠিনই হোক, আমার নিজের সুড়ঙ্গপথটি নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।
 
   তারপর থেকে এত এত বছর ধরে সেই সুড়ঙ্গটাই খুঁজে চলেছি। রুক্ষ রৌদ্রদগ্ধ
 প্রান্তর পেরিয়ে, অন্ধকার অরণ্য পেরিয়ে, ক্ষমাহীন দাবদাহ পেরিয়ে,
আশ্রয়হীন ঝঞ্ঝারাত্রি পেরিয়ে-
 
   জানি, সুড়ঙ্গটা খুঁজে পাবোই একদিন। সেটার ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারলেই
 ওপারে মুক্তির দেশ, আলোর ভুবন। 
 
   তুসিও হয়তো সমান্তরাল সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলে আসবে সেইখানেই। আবার
 আমাদের দেখা হবে, সেই আলো আর আনন্দের দেশে।
 
 
Sunday, April 3, 2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)

No comments:
Post a Comment