Saturday, October 10, 2009

আকাশপরী

প্রথম ওকে দেখেছিলাম খুব ছোটোবেলা। একদিন যখন দুষ্টুমীর শাস্তি দিতে মা গুমগুম করে আমার পিঠে জোরে জোরে কিল মেরে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রাখলো, তখন ভয়ে আর ব্যথায় ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে আকাশপরীকে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, পরীর আকাশীনীল রঙের পাখা দুখানা কি নরম, আমার কাঁধের কাছে ওর পাখার ছোঁয়া লাগছিলো। পরী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, "এই রিখু, এই বোকা, কেন কাঁদছিস? অন্ধকার বলে ভয় পাচ্ছিস? কই অন্ধকার, এই দ্যাখ কেমন আলো।"
মাখনের মতন নরম গাল, গভীর দু'খানা কালো চোখ, নরম পাতলা ঠোঁটে স্নিগ্ধ কোমল হাসি, মিষ্টি এক মেয়ে, আকাশপরী। আমি কান্নাটান্না সব ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখেছিলাম পরীর ডানা দু'খানা থেকে কোমল নীল আলো বেরিয়ে আসছে। পরী বলেছিলো, "কাঁদিস না, আয় আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুই ঘুমিয়ে পড়।" আমি সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরীর ঘুমপাড়ানি গানে আর নরম হাতবুলানোয়। পরে মা বলেছিলো আধাঘন্টা পরে দরজা খুলে মা নাকি দেখেছিলো আমি মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছি আরামে। ঐ ঘটনার উল্লেখ করে মা পরে সবাইকে বলতো," রিখুর খুব সাহস, অন্ধকারে ভয় পায় না। একদিন ওকে শাস্তি দিতে অন্ধকার ঘরে ... " বলে সেই গল্প শুরু করতো। আমার কেমন একটা মজা লাগতো,ও গল্পের আসল অংশটাই তো মা জানে না!
আমি কখনো মাকে আকাশপরীর কথা বলিনি, বাবাকেও না, অন্য কাউকে না, এমনকি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাউকেও না। অবশ্য সেরকম ঘনিষ্ট বন্ধুই বা কোথায় ছিলো আমার! শুধু মোহর ... থাক, মোহরের কথা পরে।
যখনই কোনো ভয়ের বা দু:খকষ্টের মুহূর্ত এসেছে, তখনি আকাশপরীকে দেখতাম। পড়া না পেরে বাবার হাতে মার খেয়ে যখন নিজের ঘরে গিয়ে মনখারাপ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতাম, তখন পরী এসে নরম হাত বুলিয়ে দিতো। একবার অঙ্কে খুব কম নম্বর পাওয়ায় বাবা আমায় খুব মেরেছিলো। পিঠে বেতের পর বেত মেরে ডোরা ডোরা করে দিয়েছিলো, সেই রাত্রে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমি নিজের ঘরে ব্যথায় আর খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে দেখতে পেয়েছিলাম পরী এসে শিয়রের কাছে বসেছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার ব্যথাদাগগুলোয়, বলছে,"ঈশ, এমন করে কেউ মারে নাকি? ছি ছি ছি।" আমি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
"ঋজুরেখ বসু"---নাম ঘোষনা হতেই দিবাস্বপ্ন কেটে যায়, এগিয়ে গেলাম, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ হচ্ছে আজ, আমি প্রথম পুরস্কার পাবো। মঞ্চে ওঠার সময় পা কাঁপে আমার, মুখ ফিরিয়ে একবার পিছনে দেখি, পরী হাসছে। হাতের অভয়-ভঙ্গী করে এগিয়ে যেতে বলছে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার দিনও ছিলো পরী, এমনি করেই সাহস দিয়েছিলো।


***
সে বড়ো গরম দেশ, আমাদের দেশের বাড়ীর গাঁ। রোদ্দুর চড়ে উঠতো ফাল্গুনের শেষেই, মাঘের শেষ থেকেই রাগী হয়ে উঠতো, তারপরে চৈত্র বৈশাখে একেবারে তপতপে অবস্থা। গ্রীষ্ম কত দীর্ঘ হয়ে গেছিলো, বর্ষা গড়িয়ে যেতো শরতের বুকের উপর দিয়ে হেমন্ত ছেয়ে। তারপরে খুব সংক্ষিপ্ত শীত আর বসন্তের এক ঝলক শেষেই আবার চড়া গ্রীষ্ম।
শীতে মোড়া বিভুঁইয়ে এখনো কত ঠান্ডা, কত বরফ, তুলোর মতন তুষার ঝরে ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে, আমাদের বিস্মৃত শ্বেতপ্রভুদের দ্বীপে বিষন্ন সকাল সন্ধ্যা বয়ে যায়,এখন উল্টোযাত্রায় আমরাই সেখানে গিয়ে থাকি, কাজ করি, সুতো জড়াই আর সুতো খুলি আর ভুলে যাওয়া শিশুকালের কথায় দু:খবিলাস করি।
শুকিয়ে আসা খালের পারে ক্ষীর-কাঁঠালের গুঁড়িতে বাঁধা নৌকার কাছি খুলে ফেলি, পার থেকে লাফ দিয়ে নৌকার খোলে নামে মোহর, খিল খিল করে হাসে। বলে, " রিখু, আজকে বংশীকাকা জানতে পারলে তোর রক্ষা থাকবে না।" কাকার মুখ মনে পড়ে, রাগী রাগী চোয়াড়ে মুখ, শক্ত শক্ত হাত, কালকে চড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গেছিলো নুটুদা, কাকার ছেলে। গালে কাকার পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছিলো নুটুদার। অথচ একটু পরেই কাকা বেরিয়ে যেতে দিব্যি গিয়ে পেয়ারা গাছে চড়লো, এরকম মারধোর খাওয়া নাকি অভ্যেস আছে এদের।
কাকার কথায় কেন জানি বাবার মুখ মনে পড়ে, এমনি সময়ের মুখ না, শুক্কুরবারের সন্ধ্যেবেলার গুমোট মুখ, লাল লাল চোখ, উস্কো চুল, ভয় লাগে ঐরকম মুখ দেখলে। সেদিন ওদের ঘরে যাই না আমি, শুধু একদিন মায়ের কান্না শুনে ছুটে গিয়ে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম ... থাক, সে না বলাই ভালো।
মোহরের দিকে চেয়ে হাসি, তারপরে শক্ত গলায় বলি, " কিছু হবে না, চল। মোহর, তুই যে বলেছিলি আমায় ইন্দিরবিলের কচুরিপানাফুল দেখাবি?"
মোহর লগি নিয়ে জলে টান দেয়, নৌকা দুলে ওঠে, জলের উপর দিয়ে এই ছোট্টো ডিঙি এগিয়ে চলে। ডিঙা বায় মোহর, ওর চুলে খেলা করে হাওয়া, ওর চোখের তারায় পশ্চিমের রাঙামেঘগুলোর ছায়া পড়ে, ওর গলায় অচেনা মোচড় লাগে যখন ও বলে, "রিখু, কদিনের জন্য দেশের বাড়ী বেড়াতে আসিস, আবার চলে যাস, অনেক বড়ো হয়ে গেলে হয়তো আর আসবিই না, নারে?"
কি অপূর্ব রঙ কচুরিপানা ফুলের! সাদার উপরে অতি হাল্কা বেগুনী একটা আভা। বাঁশের লগি জলের নীচে মাটিতে ঠক করে ঠেকিয়ে নাও থামাই, হাত বাড়িয়ে ফুল তুলে নিই বেশ কয়েক থোকা। মোহরের বেণীর গোড়ায় গুঁজে দেবার সময় দুষ্টু মেয়েটা চুপ করে বড়ো বড়ো চোখ মেলে চেয়ে থাকে দূরে, কেন এত উদাস হয়ে গেলো? দূরে অনেক দূরে ঐ পশ্চিমদিগন্তে রাঙা সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে থাকে,ওর কালো চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে লাল রঙ। শুভ্র ও হাল্কা বেগুনী মেশানো ফুলগুলি কি দারুণ মানিয়েছে ওর গোছা ধরা কালো চুলে।
আমার বুকের ভিতরে কেমন মোচড় লাগে, মনটা কেমন আনচান করে ওঠে, কেজানে কি হবে ভবিষ্যতে। ভাসা-ভাসা আলগা আলগা মেঘের ছায়ার মতন দূর দূর দূর কোনো দেশের গল্প মনে পড়ে, বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, ওখানে পরিচিত কেউ নেই, কোনো শাসন নেই, অত্যাচার নেই, ওখানে খুব মিঠা হাওয়া, ওখানে খুব নরম অমলতাসের ফুলের মতন দিন, ওখানে আমি আর মোহর ...
জোর করে দিবাস্বপ্ন থেকে মন ছাড়িয়ে আনি, মোহরের কালো চোখের তারায় আকাশের বিচিত্র আলো ... গরম রক্ত আমার মুখচোখকান হাত ভরিয়ে তোলে, ডিঙা এসেছে হিজলের ছায়ায়, আমি মোহরের দিকে তাকাই, দেখতে পাই আকাশপরীকে, ওর দু'খানা ডানা থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে, ওর ঠোঁটে অভয়হাসি, সেই হাসিতে কাছে যাবার আহ্বান, আমি এগিয়ে যাই, ঝুঁকে পড়ি পরীর দিকে, আমার দুখানা বাহু পরীর শরীর ঘিরে ধরে নিবিড় করে, আমার মুখ নেমে আসে পরীর হাসির উপরে ...
কতক্ষণ কেটেছিলো জানিনা, সম্বিত ফিরে পাই মোহরের ফুঁপিয়ে কান্নায়, পোশাক গোছাতে গোছাতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মোহর , কিছু বলছে না। নাড়া লাগা ফুলের ভেতর থেকে ঝরঝর করে জল পড়ে যেমন, তেমনি করে ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। পরী কোথায় গেলো, আমার আকাশপরী? উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে তাকাই অস্থির হয়ে, নেই, নেই, আকাশপরী নেই। কোত্থাও নেই, কোথাও না। দূরে দূরে যতদূর পারি দূরে চেয়ে দেখি, নেই কেউ কোথাও নেই, নেই সেই আকাশীনীল ডানার আলো, নেই সেই স্বপ্নভরা চোখের সস্নেহ প্রশ্রয়, পরী উড়ে গেছে আমাকে কাদায় ফেলে রেখে।
এলোমেলো চুল, এলোমেলো ওড়না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা মোহরের দিকে তাকাই, ঝড়বৃষ্টির পরের ফুলবাগানের মতন বিধস্ত লাগে ওকে। কখন এমন হলো? কেন হলো? কেমন করে হলো?
আমরা ফিরে আসি, সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো বেশ, ভয়ে ভয়ে বাড়ী ফিরি। খুড়তুতো দাদা নুটুর সঙ্গে দেখা, সে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো, বললো সামলে দেবে। সামলে দিলো সত্যি, রাতের খাওয়াদাওয়া নির্বিঘ্নে হয়ে যাবার পরে নুটুদার ঘরেই শুয়ে পড়লাম যেমন শুতাম। ক্লান্তি চোখের পাতা আঠার মতন জুড়ে দেয় কিন্তু কেন জানি ভালো করে ঘুম আসে না। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম, ছেঁড়া ছেঁড়া জাগরণ। একবার উঠে কলসী থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে খাই, ভিতরে কী যে বালি বালি তৃষ্ণা!
অবশ করা বেদনা শরীরে, ঘুমের তৃষ্ণা চোখেমুখে। মনে হলো জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হলো যেন আকাশ দিয়ে শত শত কালো কালো ডানা উড়ে যাচ্ছে, আলো ঢেকে যাচ্ছে। অচেনা একটা ভয়ের ছমছমি আমাকে আমূল কাঁপিয়ে তুলছে। গলা চিরে চিৎকার করতে চাইছি কিন্তু কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে।
"কি হয়েছে রিখু, কি হয়েছে? বোবায় ধরলো নাকি? উঠে বস রিখু, উঠে বস।" চোখ মেলি, নুটুদা আমার হাতে নাড়া দিয়ে ডাকছে। স্বপ্ন ছিলো সব। আমি উঠে বসি, ঘামে মাথা গলা পিঠ বালিশ বিছানা ভিজে গেছে।
বিছানা থেকে নামি, নুটুদা গামছা এগিয়ে দেয়। ঘাম মুছে ফেলি। জলভরা গেলাস দেয়, জল খাই। তারপরে দরজা খুলে বাইরে খোলা হাওয়ায় দাড়াই দু'জনে।
"কি হয়েছে তোর, রিখু?" নরম গলায় জিজ্ঞেস করে নুটুদা।
আমি দু'দিকে নাড়াই মাথা, না কিছু তো হয় নি!
পরদিন ওবাড়ী থেকে চলে আসি, যদিও গ্রীষ্মের ছুটি তখনো অনেকদিন বাকী ছিলো। বিদায় নেবার সময় মোহরের সঙ্গেও দেখা হয় নি আর। তারপর কেটে গেছে কতকাল, সে যে কতকাল ...
আকাশপরীকে আর দেখতে পাই নি। আর কোনোদিন না। কাউকে কিছুই বলা হয় নি কোনোদিন, দেশের বাড়ীতে আর যাওয়াও হয়নি। পরের বছর থেকে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো যে! মাধ্যমিক কাছিয়ে এলো। বাবামায়ের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েই চললো, কিসের যে এক না বলতে পারা অভিমান ছিল! কোনোদিন আর ঘুচলো না আমাদের ব্যবধান!
যে দিন ভিন দেশে পাড়ি দিতে হলো পড়ার জন্যে, সেদিন ও তেমন কোনো বেদনা ছিল না আমার নিজের দিক থেকে। এক চাবড়া ঘাস যেমন সহজে উঠে আসে, তেমনি সহজ সাবলীল চলে যাওয়া আমার। যেন কিছুদিন অতিথি ছিলাম, ফিরে যাচ্ছি। এই বেদনাহীনতার দু:খ ও একধরনের ভোঁতা বেদনা তৈরী করে মনের ভিতরে। চলে যাবার আগের রাতে সবকিছু গোছানো হয়ে যাবার পরে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করতে করতে ভাবছিলাম আমার শৈশব-কৈশোরের কথাই। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যাদের আপন বলে পেয়েছি ঘরের মাঝে, তাদের সঙ্গে কোথায় যেন একটা সংযোগহীনতা! এ কি আমারই ত্রুটি? আমারই তীব্র অভিমান ছুরি দিয়ে কেটে দিয়েছে বাঁধন? নাকি ওদের দিক থেকেও ছিলো অবহেলা আর অত্যাচার? আমার স্নেহ-আকাঙ্ক্ষী মন কি ওরাও বুঝতে চায় নি?
আমি যা আশাই করিনি, সেই রাতে তাও হলো। আমার ঘরে একলা এসে অপ্রত্যাশিত কোমল গলায় বাবা বলেছিলো, "রিখু, তোর উপরে হয়তো অনেক অন্যায় করেছি, যদি পারিস, মাফ করে দিস। আর .. আর যদি কোনোদিন ইচ্ছে করে কোনো সুখদু:খের কথা শেয়ার করতে, বলিস আমায় খোকা। আমায় বলিস। "
আগে কোনোদিন খোকা বলে নি, সেদিন বললো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো, আমার একেবার ইচ্ছে হচ্ছিলো ওঁর কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে খুব কাঁদি, অনেক কেঁদে বুকের পাথর সবটুকু গলে গেলে তারপরে বলে দিই সব। আমার সমস্ত দু:খকষ্ট আমার ভুল ঠিক, আমার সমস্ত পাপপুণ্য সব। আকাশপরীর কথাও, আকাশপরী যে আর আসে না, সে কথাও। কিন্তু পারলাম না। কঠিন অভিমান আমার দু:খকে আগলে দাঁড়িয়ে রইলো প্রহরীর মতন।


***
ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে অদ্ভুত বিষন্ন বৃষ্টি পড়ছে, অবিচ্ছিন্ন অশ্রুর মতন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে থাকি পথবাতিগুলির জ্বলে ওঠা, একের পর এক। এইখানে কয়েক মাস হলো এসেছি, এই দ্বীপরাজ্যের আবহাওয়া নাকি প্রায় সারাবছরই এমন ছিঁচকাদুনে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বন্ধুবান্ধব যারা থেকেছে সকলেই এই নিয়ে বিতৃষ্ণ। কী জানি আমার থাকতে হয় কতবছর।
মনে পড়ে রৌদ্রতপ্ত দিনের শেষে কালবৈশাখী, জটামেলা মেঘেভরা আশ্চর্য আকাশ, সেখান থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। আমি আর মোহর ... মোহর..... এখন কোথায় সে? কোনো খোঁজ আর রাখা হয় নি, দেশের বাড়ীতেই তো আর যাই নি সেই ক্লাস এইটের পরে।
তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে কত কত বছর-সময়ের ঘূর্ণীজল সরিয়ে দেখতে চাই, মোহরকে। দেখতে চাই সেই কবে যেন চিরকালের মতন হারিয়ে ফেলা আমার সেই আকাশপরীকে! ওর সেই দুখানা আকাশীনীল রঙের নরম ডানা ... আর কি কোনোদিন সে আসবে না?
কোনো রূপবতী বৃষ্টির বিকেলে আমি আর মোহর যদি একসঙ্গে ভিজতে পারি ...
চোখ বন্ধ করে ধূসর আকাশের বিষন্ন বৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে যাই, মনে পড়ে দীর্ঘ এক উড়ান। হাওয়াই জাহাজ রানওয়ে দিয়ে ছুটছে আর ছুটছে ... একসময় মাটি ছেড়ে উঠে পড়লো। পাশের সীটে মোহর, মোহরের নরম হাতখানা শ্বেতকপোতীর মতন আমার কোলে আশ্রয় নিলো ... চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিই। কোথায় বা মোহর ? হয়তো দূরে কোনো শান্ত জনপদে একটি সুলক্ষণ সুন্দর ঘরকন্যা পেতেছে-হয়তো উঠোনে খেলা করে বেড়ায় চুন্নিমণি শিশুরা।
ক্যারোলিন এসে কাঁধে টোকা দেয়, "রিখু, কি হলো ডিনারে যাবে না? নাকি আজকে বাড়ী যাবে?"
আমি বলি, "চলো তবে যাই। বাড়ীতে তো যাবো সেই মাঝরাতে।"
ক্যারোলিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটাও বেশ আশ্চর্য। আমার মতন স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, লাজুক মানুষের এত তাড়াতাড়ি বিদেশিনী বান্ধবী হয়ে যাবার কথা নয়, ক্যারোলিন নিজে উদ্যোগী হয়েই বলা যায় বন্ধুত্বটার সূচনা ও প্রস্ফুটন দুইই করে চলেছে।
একদিনের কথা মনে হয়। তখন আমি নতুনই বলতে গেলে। ক্যারোলিনের সঙ্গে ক্লাসে আলাপ হয়েছে, কিছুদিন কথাবার্তাও হয়েছে। একদিন ওকে দেখলাম বাইরে পাথরের বেদীতে বসে আছে। ওর কোমল তরুণীমুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। হাওয়ায় ওর সোনালী চুলের গোছাও উড়ছে আলতো আলতো করে।
ক্যারোলিনকে ছেঁড়া পুরানো পোশাকে এলোমেলো চুলে কল্পনা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু তাতেও ওর রূপ এতটুকু কমে না। এমন সাদাতে গোলাপীতে মেশানো মুখের রঙ! এমন নিঁখুত করে গড়া নাক মুখ চোখ! নীল চোখের ভিতরে আলো জ্বলছে। ওকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষ্ঞার্ত কল্পনা করি, তাতেও রূপ কমে না ওর। ও বলেছিলো একসময় নাকি খুব কঠিন অবস্থা গেছে ওর, রোজ খেতে পেতো না, ছেঁড়া পোশাক পরতে হোতো। কিন্তু এই আকাশচ্যুত বিদ্যুতের মতন সুন্দরী কি তাতে ম্লান হয়? আমার দু:স্বপ্ন যত দূর যেতে পারে, চেষ্টা করি ততদূর খারাপ অবস্থায় ওকে কল্পনা করতে, কিন্তু সামনে ফুলে ছাওয়া শ্বেতপাথরের বেদীটিতে এলিয়ে বসা হাসিমুখ তরুণীটির চেয়ে কোনো মতেই বেশী ম্লান হয় না আমার কষ্টকল্পনার ক্যারোলিন। এত সৌন্দর্য দর্শকের বুকের ভিতরে একধরনের কষ্ট তৈরী করে। অচেনা কষ্ট। পৌষের ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় জেগে উঠে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ি পড়ি করেও যখন পড়ে না, তখনকার মতন কষ্ট।

আমরা চলতে থাকি, ক্যারোলিন কথা বলতে থাকে, আমি চুপ করে শুনতে থাকি। ক্যারোলিন ওর নিজের কত কথা আমাকে বলেছে, আমি নিজের কিছুই বলতে পারিনি। ক্যারোলিনের মা ওকে আর ওর ভাইকে একা-একা মানুষ করেছেন অমানুষিক পরিশ্রম করে। দিনেরবেলা একখানা কাজ আর সন্ধ্যাবেলা আরেকখানা কাজ করতেন উনি। ওদের বাবা নাকি ছিলেন খুব অদ্ভুত চরিত্রের লোক, আগে হাসিখুশী ছিলেন, ছেলেমেয়ে জন্মাতেই মেজাজ তিরিক্কি হয়ে গেল ভদ্রলোকের। ডিভোর্স করে ছেলেমেয়েকে ফেলে সবরকম দায়িত্ব এড়িয়ে একদিন চলে গেলেন দূরদেশে, আরেক মহিলাকে তার পূর্বতন সন্তানসমেত বিবাহ করে। সে বিয়েও টিঁকলো না অবশ্য বেশীদিন, পরে এক ধনী নি:সন্তান বিধবাকে বিবাহ করে এখন তাতেই নাকি সুখে আছেন।
অচেনা দূরের সংস্কৃতির গল্প সব, এদেরই মধ্যে থাকি কিন্তু বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না। হয়তো সারাজীবন থাকলেও চিনতে পারবো না। ক্যারোলিন কত অনায়াসে বলে যায় তার মায়ের নতুন স্বামীর কথা, অনেক কষ্টের পরে এখন সুখে আছেন মা। "ডেভিড খুব চমৎকার লোক", সৎ বাবা সম্পর্কে বলে ক্যারোলিন।
আমি প্রথম শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, "স্টেপড্যাডকে নাম ধরে বলছো?"
ক্যারোলিন বিশুদ্ধ অবাক হয়ে বলেছিল, " আরে নাম ধরে ছাড়া কিভাবে বলবো? নাম তো ডাকার জন্যই, তাই না?"
ওর ছোটোবেলার আর কৈশোরের গল্প শুনি, আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে আমার কথা, আমি একটা দুটো কথা বলে চুপ করে যাই, তেমন কিছু বলতে পারি না। একদিন হয়তো আমিও -- বুকের ভিতরের কষ্টপাথরটা নড়ি নড়ি করে ওঠে যেন।
***
ধূসর আকাশ থেকে একটানা তুষার ঝরছে, রাস্তাগুলো সাদা হয়ে গেছে। গাছগুলো সব ন্যাড়া, কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণহীন প্রত্নপ্রস্তর যেন। অদ্ভুত বিষন্নতা বর্ণহীন চাদরের মতন ছড়িয়ে আছে সবটুকু জুড়ে, বাইরে আর ভেতরে। সূর্যহীন ধূসর মেটে তুষারাচ্ছন্ন দিন যে কি প্রচন্ড বিষাদের! আহ,উষ্ণতা যে কি ভীষণ আকাঙ্ক্ষার, সে কী এই অবস্থায় না পড়লে কোনোদিন বুঝতে পারতাম?
প্রবল সূর্যের দাবদাহের দেশ থেকে আসা আমি, আগুন আবিষ্কার নিয়ে এদের এই আদিখ্যেতার অর্থ অস্পষ্টভাবে বুঝতে শুরু করি। মস্ত মস্ত গাম্বাট পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত লোকেরা পথ চলেছে,আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না কখন বাসায় ফিরবো, এখন না আরো অনেক পরে?
হুতুমথুমের মতন দিন, ধোঁয়া ধোঁয়া সব কিছু। জোর করে পিছিয়ে যাই সময়ের মধ্যে, স্মৃতির সরণী ধরে অতীতের উদ্যানে ঢুকে পড়ি। মোহর, মোহর, মোহর। ওকে দেখবো, ওকে দেখতে চাই। থুতনি ঠেকাই মোহরের গালে, বলি," কিরে, কেন কাঁদছিস ছিঁচকাঁদুনির মতন?" মোহর দু'হাত দিয়ে গাল চোখ মুছতে মুছতে হাসে, বলে, " চোখে আঞ্জনি না খঞ্জনি কি হয়েছে কে জানে।"
প্রবল হাওয়ায় উড়ছে মোহরের চুল, সন্ধ্যার রঙ গড়িয়ে পড়ছে আকাশ বেয়ে, কাকেরা দল বেঁধে উড়ে চলে আসছে পুবের দিকে, ওরা সর্বদা বাসায় ফেরার সময় পুবে উড়ে আসে। সকালে বেরোবার সময় সূর্যের বিপরীতে ওড়ে আবার ফেরার সময়ও। আচ্ছা, ওরাও কি জানে জ্যামিতি, অংক, গোল জ্যামিতি? ওরা নিশ্চয় আমাদের থেকে অন্যরকম জানে, কত উপরে ওড়ে ওরা, জন্মকাল থেকে।
সারি বেঁধে ওড়া কাকের দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে একটি কাক, তাছাড়া অন্য কাকেরা উড়ে যাচ্ছে নিঁখুত একটি গতিময় প্যাটার্নের মতন, ওদের ডানায় আলো থেকে ছায়া পড়ে আসছে। পিছিয়ে পড়া কাকটিকে মোহর বললো,"তাড়াতাড়ি যা,এই তাড়াতাড়ি যা। হারিয়ে যাবি নইলে।"
মোহরের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠলাম আমি, "তুই একটা পাগলি রে মোহর।"
দুধসাদা ক্যারোলিনের মুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ও, বললো," হ্যালো রিখু, কোথায় চললে? "
"ক্যারোলিন, চলো, লাইব্রেরী যাবে না?" আমি ওর হাত ধরতে হাত বাড়িয়ে দিই। ক্যারোলিন ওঠে, একটি আলোর হিল্লোলের মতন এগিয়ে আসে। কোথা থেকে খিলখিল একটা হাসি শুনতে পাই, একদম মোহরের গলা।
আহ, যতবার ক্যারোলিনের দিকে তাকাই, কেন মোহরকেই শুধু মনে পড়ে? তবু কিছুতেই মন খুলতে পারিনা কেন? ত্রুটি কি তবে আমারই মধ্যে? আমারই ভুল অভিমানে হারিয়ে ফেলছি সব? আকাশপরীকে কি তাই আর দেখতে পাই না?


***
শীত শেষ হয়ে বসন্ত এসে গেল। বসন্ত ও চলে গেল, এখন গ্রীষ্ম। আমাদের কাজ পড়লো অনেক দূরে, ক্যারোলিনকে আর আমাকে পাড়ি দিতে হলো আরেকটা মহাসাগর। ক্যারোলিন আগেও বেশ কয়েকবার গেছে সে পথে, একটুও নার্ভাস না। আমার তো টেনশনে আধাসেঁকা অবস্থা। সে বারেবারে আমায় সাহস দেয়, খুব ভালো সময় কাটবে আমাদের।
এখন আমরা আবার এক গরম দেশে, ধোঁয়াটে আকাশ আবারও নীল। বদলে যেতে থাকা সবকিছু, এই যে আকাশ, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল, ঝকঝকে সূর্য বুকে নিয়ে-আবার জোরালো দক্ষিণের হাওয়ায় এই উড়ে এলো সাদা তুলো-তুলো মেঘেরা, ধূসর ভারী মেঘেরা এলো তার পরে। ছায়া পড়ে এলো, হয়তো বৃষ্টি নামবে।
বাড়ীতে ফোন করি, জিজ্ঞেস করি কেমন আছে ওরা। মা বলে, ওরা ভালোই আছে, খুব গরম, লোডশেডিং চলছে লাগাতার, আকাশভরা মেঘ, গুমোট হয়ে আছে সকালবেলা, খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে গত সন্ধ্যায়-আশ্চর্য, সেই সন্ধ্যাটা এখনো চলছে এখানে! দুনিয়া এত অবাক করা জায়গা!
জন্মান্তরের মতন বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত হয়ে আছি সবাই, লিখে কিছুই বোঝানো যায় না, শুধু একটা আকুলতা, একটা অস্থিরতা ধাক্কা দিতে থাকে! বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট এর কথা বলেন, সেও কি অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার! নিকট ও দূর সত্যিই কি জুড়ে আছে অমন নিবিড় হয়ে ?
মানুষের জীবনটা আসলে কিরকম? বিষাদের নাকি আনন্দের? নাকি যে যেভাবে চায় সেভাবেই পায় জীবনকে? এই যে ক্যারোলিন, সুখদু:খের স্রোতের ভিতর দিয়ে কেমন নতুন গড়া নৌকার মতন অনায়াস গতিতে অবলীলায় ভেসে যাচ্ছে, আমি তো তেমন পারি না! কেন পারি না? কীসে আমাকে টেনে ধরে পিছন থেকে? সকলের সঙ্গে কেন মন খুলে মিশতে পারি না? এ কি আমার জন্মগত কোনো অসহায়তা? নাকি পূর্ণবয়স্ক এই আমার ভিতরের মানুষটা আজো অভিমানী এক শিশুর মতন ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে?
বারে বারে মনে পড়ে প্রবঞ্চিত শৈশবের দিনগুলো যখন বাবা বা মা কেউ আমাকে বুঝতে চাইলো না, শুধু কঠোর শাসন করে গেল কারণে অকারণে। মনে পড়ে সেই কৈশোরের একাকীত্ব, যখন খুব কাছের বন্ধু কেউ ছিলো না, যখন বাবামায়ের সঙ্গে বন্ধুর মতন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তা হলো না। এইসব কথা মনে মনে তোলাপড়া করে নিজের সপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করাই আবার নিজেই ভেঙে ফেলি। আরও কত মানুষের শৈশব-কৈশোর আরো কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে, কই তারা তো সবাই এরকম হয়ে যায় নি?
ক্যারোলিন গুণ্‌ গুণ্‌ করে গান গাইতে গাইতে আসছে, দু'হাতে দুখানা আইসক্রিম কোণ, আমাকে একটা দিলো। নিজে ঠোঁটে মুখে আইসক্রিম মাখামাখি করে খেতে খেতে বাচ্চাদের মতন হাসছে। বলছে, "চলো না বেড়িয়ে আসি, উইকেন্ডে ঘরে বসে থেকে কি হবে?"
আমার ওকে দেখে অবাক লাগে, এত প্রাণশক্তি এত আনন্দ এত মজা করার ক্ষমতা এই ক্ষীণকায়া মেয়েটির মধ্যে কিকরে থাকে? আইসক্রিমের ঠান্ডা শিরশিরে দুধালো মিষ্টতা মুখের ভিতরে গলে যায়, আমি ক্যারোলিনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করে মনে পড়ে আমার খয়েরী মলাটের ডাইরিটাকে, ডাইরিটার পাতাগুলো ঘিয়ে রঙের, কেমন একটা হালকা ধূপের গন্ধ ছিলো পাতাগুলোতে।
পাতাগুলো ভরে উঠছিলো এলোমেলো কবিতায়। একলা একজন মানুষের গভীর সঙ্গোপনের সাথী। কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি আমার কলেজবেলার কবিতাদের, খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতাম ডাইরিটা। দেশ থেকে চলে আসার সময় সেটা আনা হয় নি সঙ্গে করে আর।সেই খুব যত্নে লুকিয়ে রাখা ডাইরিটা কি কেউ খুঁজে পেয়ে গেছে? মা অথবা বাবা? নাকি এখনো ওটা লুকানোই আছে? লুকিয়ে থেকে থেকেই হয়তো একদিন পুরানো, জীর্ণ হয়ে যাবে, লেখার কালি আবছা হয়ে হারিয়ে যাবে। আজ থেকে একশো বছর পরে কোথায় থাকবে আমাদের চেনা এই বর্তমানের জিনিসগুলো সব?
সন্ধ্যাবেলার কমলা পালকমেঘের মতন একটা কবেকার লেখা অনামিক কবিতা ভেসে এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেমন করে স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে চলে এসেছে সে?

" আঁকেবাঁকে পাথরের চুলগুছি আল্পনা-
ঘুরে ঘুরে এলোমেলো ঢেউকথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিজের মতন পথ চলে নদী।
মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেফুল
ফেনায় ফেনায় ফুটে উঠে পাড়পাহাড়ে মিলিয়ে যায়।
গাঢ় যুবতী রোদ ঢেকে দিয়ে বিকেল আসে জলকল্যাণী।

কলাবতীরঙের শাড়ী পরে মায়াবতী সন্ধ্যা গেছে এই পথেই
বৃষ্টিভেজা হিমচম্পার গন্ধ ছিলো বাতাসে।
চিরঞ্জীব সৌরভের ছোঁয়ায় থমকে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে,
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ধূলিপথে আরক্ত ছাপ রেখে-
জন্মবেলার আলোআঁধারি ডাকে- আয় আয়।


কে যেন ডেকেছিলো? মনে পড়ে না তার নাম -
শুভ্র শঙ্খমালা ছিলো তার গরীম গ্রীবায়
ভোর হয়-হয় রাতের মতন চোখ, আলোয়-কালোয় জড়াজড়ি,
সবুজ আঁচলে ছিলো ধান্যদুর্বামঞ্জরী।
ধূপছায়াবেলায় সে বলতো সাতভাই তারার গল্প।
কোন্‌ একশিলা নগরীতে হারিয়ে গেল সে,
আকাশ তখন মুহুর্মুহু বিদ্যুৎস্নানে আবিষ্ট। .....”


আমি জোর করে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই। বলি, "বেশ তো, চলো না কোথাও ঘুরেই আসি। সমুদ্র তো মাত্র দুইঘন্টার দূরত্বে। যাবে?"
ক্যারোলিনের আইসক্রীমমাখা মুখ খুশীতে আলো-আলো হয়ে ওঠে, বিশ্বাস করতে পারছে না যেন এমন গলায় বলে, "সত্যি যাবে ?"
" হ্যাঁ, সত্যিই তো। চলো বেরিয়ে পড়ি এখনই। কোনো গোছগাছের কিছু নেই, সন্ধ্যেবেলায় ফিরে আসবো। দুপুরে ওখানেই কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। এসো, যাই।"
" আরে! পোষাকটা অন্তত পাল্টে আসতে দাও। আর সানস্ক্রীন লোশন, ক্যামেরা...." কথা বলতে বলতে ক্যারোলিন পাশের ঘরের দিকে চলে যায়, আমি হেসে জুতোমোজা পরতে শুরু করি। আমার সানস্ক্রীন লাগবে না। সূর্যক্ষুধায় আমার ভিতরটা আনচান করছে, পুড়ে কালচে হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।


ভালোবাসার নীল আলো একদিন আকাশভরে ফুটে উঠবে, ঐ আকাশপরীর ডানা দু'খানির মতন। ততদিন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আমরা অপেক্ষা করতে চাই না, তবু অপেক্ষা করতে হয় কেবলই অপেক্ষা করতে হয়। আরোগ্যের অপেক্ষা, শান্তির অপেক্ষা, ভালোবাসার অপেক্ষা ...

***

Sunday, August 23, 2009

আকাশ

1.

সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির -মাঝে মাঝে কেমন হয় যেন হয় আশমানির। এক একটা শব্দ সারাদিন রিনরিন করে মনের মধ্যে বাজতে থাকে। আজকে যেমন এই সূর্যশিশির! কি সুন্দর কথাটা। অথচ এর মানেটা তেমন কিছু ভালো নয়, একরকমের পতঙ্গভুক উদ্ভিদ, কলসপত্রীর মতন। কলসপত্রী নামটাও কী চমৎকার ! এইসব গাছেদের এরকম সুন্দর নাম দেওয়ার পিছনে মানুষের কি কোনো বিশেষ মানসিকতা আছে?
সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির-আশমানি হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলো পার্কিং লট, পলিমার-সায়েন্সের বিশাল সুন্দর বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে চলার সময় সারিবাঁধা পাইনের দিকে চাইলো , তারপরে ক্রস করলো চওড়া লিংকন রোড-পুরো সময়টা মনের মধ্যে রিনরিন করে বাজছে সূর্যশিশির। গ্রীন হাউসের সামনে এসে হঠাৎ ওর মনে হলো, "আরে ফোন করার কথা ছিলো তো! এখন কি পাওয়া যাবে?"
মুঠাফোন বের করে ফোন করতে করতেই কুয়াশা কেটে একঝলক রোদ পায়ের কাছে, হালকা একটু হাওয়া, আকাশে এক ফালি নীলও। রিং হচ্ছে, কেউ একজন ধরেছে, কথা বলছে। আশমানি অল্প কেঁপে যাওয়া গলায় বললো," হ্যালো, সূর্য আছে? ”

2.
সবাই যখন ব্যস্ত থাকে নানা কাজে, তখনই কি কুঁড়িরা ফুল হয়ে ফুটে যায়? টুপ টুপ করে তারাগুলো কি তখন নেমে পড়ে সমুদ্দুরে?কেউ যখন দ্যাখে না ওদের? ছোট্টো মিমি চুপ করে ভাবে করবীগাছের তলায় দাঁড়িয়ে, এখান থেকে কতদূর দেখা যায়!
ঝুরিনামা বটের পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা, একটু এগোলেই রমাদিদের বাড়ি, তারপরে জোড়া মাঠ পেরিয়ে জোড়া পুকুর, তারপরে ঝুনিদিদের বাড়ী। ঝুনিদিদের পাশেই অনুদের বাড়ী, ওর ভালোনাম অনুব্রতা।
ঐ তো ওরা গানের ক্লাসে চলে যাচ্ছে খাতা নিয়ে, শনিবারের বিকেলমাঠ একলা পড়ে আছে চুপ, কেউ খেলবে না চু-কিৎকিৎ, বুড়ী বসন্তী, কাকজোড়া, নামপাতাপাতি বা বানানো কোনো খেলা আজ এখানে। তাই বুঝি মাঠের মনখারাপ? মিমির চোখে শিশির জমে ওঠে, সে একা একা খেলতে যেতে পারে না। সে দাঁড়িয়ে থাকে করবীতলায়, কেউ যদি ফিরে আসে? কারুর যদি গানের ক্লাস আজ না হয়?

3.
"কালপুরুষ চেনা খুব সোজা। ওই যে দ্যাখ তিনখানা তারা জ্বলজ্বল করছে একলাইনে, কালপুরুষের কোমরবন্ধ ওটা।" বসন্তের সন্ধ্যা, বাতাস বইছে ধীরে। ভারী মধুর এইসময়টা। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আশমানিকে তারা চেনায় হিন্দোল।
অবাক হয়ে জ্বলজ্বলে কালপুরুষের দিকে চেয়ে থাকে আশমানি, সামনে অন্তহীন ঢেউ আসে ঢেউ যায়। অতলান্তিক মহাসাগরের ঢেউ। নতুন খইয়ের মতন অগনন তারা ছড়ানো নির্মল বাসন্তী সন্ধ্যায় কী এক তরঙ্গ এসে লাগে তার প্রাণের গভীর গোপণ নিশীথবীণায়, সেখানে মঞ্জরিত স্বর্ণপলাশের নিচে কে যেন বসে আছে স্তব্ধ অপেক্ষায় তার জন্য।
কে সে? অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না। এই কি সেই গানের মানুষ-"ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন/তলাতল খুঁজলে পাতাল পাবিরে সেই কৃষ্ণধন" ? সেই? আশমানি ঠিক বুঝতে পারে না। দু'চোখ জলে ভরে ওঠে তার! কেন সে এমন? সাথীদের সাথে থেকেও এত একা? তীব্র দলছুট হৃদয় তার নির্জন বনে অশ্বত্থগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখুনি কোথা থেকে উড়ে আসবে লোককথার সেই অলৌকিক নীলপাখি, একটি পালক এসে পড়বে তার সামনে।

4.
"সময় আমাদের ঘিরে রাখে মৃদু বৃষ্টির মতন
অশেষ সময়
সুখদুখমন্থন সময়
মেঘপালকের মতন ঘরের মতন উড়ে যায় জীবন----"

কথাগুলো গুণ গুণ করতে করতে আশমানি মনে করতে চেষ্টা করে কার লেখা লাইনগুলো। মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। ছাদের উপরে স্নিগ্ধ ঠান্ডা রাত, ঘুমেলা চোখে এসে লাগে তারাদের বিস্ময়, কতকাল হয়ে গেলো সে দেখছে ওদের, অথচ পুরানো হয় না, একই প্রথমদিনের ঝিমঝিম শিরশিরানি চারিয়ে যায় ওর চোখের ভিতর দিয়ে আরো ঘন গহণে।
"বাণী নাহি তবু কানে কানে/কী যে শুনি----" কে গাইতো? আশমানির গলায় সুর নেই, ওকে গেয়ে শোনাতো অন্য কেউ। কে সে? কোথায় সে? কবে গাইতো? তাকে মনে পড়ে না কেন আশমানির? কী অদ্ভুত! সে স্পষ্ট শুনছে সে গাইছে, সুন্দর সুরময় কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেঘপালকের ঘর পর্যন্ত-
"আকাশ জুড়ে শুনিনু ঐ বাজে
তোমারি নাম সকল তারার মাঝে
সে নামখানি নেমে এলো ভুঁয়ে
কখন আমার ললাট গেলো ছুঁয়ে---",
অথচ মুখ মনে পড়ে না, চোখ মনে পড়ে না, নাম মনে পড়ে না!সে যেন শুধু সুর, শুধু গান। তারাগুলি যেন ঘিরে এসেছে গান শুনতে।

5.
চারিদিকে জল, ছলছল জল। এই দ্বীপ খুব ছোটো। যেকোনো দিকে একটুখানি গেলেই নীল সমুদ্র। অথৈ সমুদ্র। গোলমরিচের লতাজড়ানো নারিকেলকান্ডে ঠেস দিয়ে বসে থাকে সে। তার কী যেন একটা করার ছিলো, কিছুতেই মনে পড়ে না। কী তার নাম সেও মনে নেই। সে কোথা থেকে এলো এখানে সেও সে জানে না। আনমনে সে লতায় হাত রাখে, ভাবে কী যেন একটা করার ছিলো! মনে পড়ে না কেন?
সে ভাবে কী নাম না খুঁজে নিজেই নিজেকে একটা নাম দিয়ে দিলে কেমন হয়? মনে হতেই উঠে দাঁড়ায় সে, চলতে থাকে, জলরেখার একদম কাছে এসে থামে। হেসে ওঠে অকারণে।
দূরে আকাশ যেখানে নত হয়ে পড়েছে জলে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে লাল সূর্য, লাল হৃৎপিন্ডের মত, স্পন্দিত আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। প্রথম মানবীর মতন একলা মেয়েটি আবার হেসে ওঠে, আবরণমুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় জলের দিকে, অবগাহণপ্রত্যাশায়।
ওর খোলা চুলের ঢালে জড়িয়ে যায় সাদা ফেনা, চিকচিক করে ওঠে ভোরের আলো। স্নান করতে করতে সে হাসছে, তার কিচ্ছু মনে নেই সে কে, অথচ মনে আছে আকাশ, জল, সূর্য, আগুন, মাটি, বালি, ঝিনুক। দু'হাতের মুঠায় নোনাপানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে চেঁচিয়ে বলে, "শোনো শোনো তোমরা শোনো, আমি আমার নাম দিলাম আকাশ।"

Monday, July 13, 2009

ঊষাসন্ততি

আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথটার উপর দিয়ে সাবধানে গুহার সামনের পাথুরে চাতালে উঠে এলাম। মস্ত সেই ধূসর পাথরটা! দুখন্ড হয়ে ভেঙে আছে। পাথরটার সামনে গিয়ে বসে পড়লাম, ঝুঁকে পড়ে আমার লোমশ হাত বাড়ালাম ওটার দিকে। এখনো ওটার গায়ে লালচে-বাদামী দাগগুলো জেগে আছে। কুশ আর খুমানের গতকালের লড়াইয়ের চিহ্ন!

আমি ওদের যুদ্ধের সাক্ষী। আবছাভাবে মনে করতে পারি খুমানকে কুশ এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো, খুমান হুমড়ি খেয়ে পড়লো পাথরটায়। কুশের পাথরের হাতুড়ী খুমানের মাথা গুঁড়িয়ে দিতে লাফিয়ে উঠল, ঠিক সময়ে খুমান মাথা সরিয়ে নিল, পাথর দুখন্ড হয়ে গেল হাতুড়ীর ঘায়ে। কী অদ্ভুত সেই পাথরভাঙার আওয়াজ! তারপরে কি হলো? কখন খুমান মরে গেল? নাকি সে পালিয়ে গেল?

আমাদের স্মৃতিশক্তি অল্প, খুব স্পষ্ট করে সবকিছু মনে করতে পারি না আমরা। কোনো কিছু হারানোর দু:খে দীর্ঘ শোক করার ক্ষমতা নেই আমাদের, আমাদের দুর্বল স্মৃতি দ্রুত সব ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছি।

কখনও কখনও আমরা শান্ত হয়ে দল বাঁধতে পারি, দলপতির নির্দেশে একসঙ্গে মিলে কাজ করতে পারি। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে আমাদের কেউ বিদ্রোহী হয়ে সব উলটপালট করে দিতে পারে। এরকম প্রায়ই হয়, বিদ্রোহী হয় অরণ্যে পালায়, নয় দলপতির হাতে মরে। কদাচিৎ জিতেও যায়, তখন সে নতুন দলপতি হয়।

আমাদের আবেগ তীব্র আর দ্রুত। পশুর মতন আমরা চিৎকার করি, লাফাই ঝাঁপাই, হাসি কাঁদি, মাটিতে গড়াগড়ি দিই। আমাদের বন্য আবেগ দেখাই একেবারে খোলাখুলি। আমাদের দয়া-করুণা এখনো জাগে নি ভালো করে, আমরা অনায়াসে দেখি রক্তাক্ত আহত মৃতপ্রায় শত্রু মাটিতে পড়ে কাতরায় আর বিজয়ী তীব্র হিংস্র আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচে আর শত্রুকে খোঁচা দেয়।

আমাদের প্রাণ পোষ মানেনি, কেউ জানে না কে হবে পরবর্তী বিদ্রোহী। হয়তো আমাদের স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি ও এর জন্য কিছুটা দায়ী। আমরা নিজেদের অবাধ্য হবার পরিণতি কি হবে ভেবে ভয় পাবো কি, মনেই তো রাখতে পারিনা যে কারুর কোনো ভয়ানক পরিণতি হয়েছিল! কিন্তু আমরা বদলাচ্ছি, আস্তে আস্তে, দিনে রাতে বাদলাচ্ছি। সরু চাঁদের রাত থেকে গোলচাঁদের রাত ঘুরে ঘুরে আসে, আমরা বদলে যেতে থাকি। আমাদের দীর্ঘ স্মৃতি পরিস্ফুট হতে থাকে।

ভাঙা পাথরের লালচে বাদামী দাগে হাত রাখি। খুমানের রক্তের দাগ! আমার সারা শরীর কেমন ঝিনঝিন করে ওঠে। কি হলো? ভিতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট, যেন ছোটো ছোটো নুড়িপাথর গুলতি থেকে ছিটকে ছিটকে এসে লাগছে! আমি চুপ করে বসে থাকি। এমন তো আগে কখনো হয় নি! ঊপত্যকার নদীটার উথলে উথলে ওঠা ফেনাফেনা ঢেউগুলো যেন আমার বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে ঠেলা দিচ্ছে! অজানা বেদনা। অচেনা চিনচিনে বেদনা। কোথায় এর শুরু? কোথায় এর শেষ? সবকিছুর কি শুরু কোথায় আর শেষ কোথায় তা জানা যায়?

যেমন আমাদের নদীটা! শুনিয়া নদী। ওর শুরু আর শেষ তো আমরা কেউ জানিনা! শুনিয়া অজানা দেশ থেকে এসে আমাদের উপত্যকায় ঢুকেছে আবার কোথায় কোন্‌ অজানায় চলে গেছে কেজানে! আমরা শুধু দেখি যেদিকে জমি উঁচু, ঘন সবুজ অরণ্যের আড়ালে সেদিকে কোথায় লুকিয়ে আছে সব ধূসর সিংহেরা, খড়গনাসা গন্ডারেরা, চকরবকরা চিতাবাঘেরা-সেইদিক থেকেই কলকল করতে করতে আমাদের জমিনে ঢুকেছে শুনিয়া। আর যেদিকে মাটি নিচু, এবড়োখেবড়ো ছোটো বড় পাথর যেদিকে ছড়িয়ে আছে-ওরা আসলে পাথর না, আগের মানুষদের ঘুমন্ত আত্মা- তাদের ঘিরে সবুজ ঝোপে নীল আর হলুদরঙের ফুল ফোটে আর ফড়িং উড়ে উড়ে আসে-সেইসব পাথরের পাশ দিয়ে নামতে নামতে ঝাঁপ দিয়ে ঝর্ণা হয়ে নিচে অন্ধকারে কোথায় পড়েছে শুনিয়া! ওদিকে আমাদের যাওয়া বারণ, ওদিকে মানুষের জগতের শেষ, আত্মার জগৎ শুরু।

শুনিয়া শুধু নদীই না, আমাদের মাতৃকাদেবী। সেই তো আমাদের জল দেয়, কে না জানে জল না থাকলে আমাদের জীবন বাঁচে না। আমরা শুনিয়াকে পূজা করি, ফুল-পাতা দিয়ে পূজা করি, রক্ত দিয়ে পূজা করি। আমাদের মেয়েরা যখন মা হয়, শুনিয়ার জলেই তো ধুয়ে দেওয়া হয় মা ও শিশুকে। আমাদের শিশুরা যখন বড় হয়, শুনিয়ার কিনারেই তো খেলা করে তারা! আমরা জানি, শুনিয়ার জল আসলে মায়ের দুধ! আমরা কল্পনা করি, মস্ত মস্ত জটাওয়ালা কুঁচকানো মুখের যাদুকর-যাদুকরীরা আমাদের কল্পনা করতে শিখিয়েছে, শুনিয়া আসলে দেখতে মানুষের মতন কিন্তু পিঠে মস্ত সাদা উজল দুটি ডানা, প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে শুনিয়া তার আসল রূপে এসে আমাদের দেখে যায়। আমি দেখার জন্য কতদিন শেষরাত্রে এসে শুনিয়ার পারে বসে থেকেছি। কিন্তু কিছু দেখিনি। যাদুকর-যাদুকরীদের ছাড়া হয়তো সে দেখা দেয় না।

আমাদের উপত্যকা পাহাড়ে ঘেরা, চারিদিকে সবুজনীলবাদামী পাহাড় আর ঘন অরণ্যে ঘেরা সবুজ ভূমিটুকুই আমাদের জগৎ। এর বাইরে কি আছে আমরা জানি না। বুড়ো যাদুকর নিষাত বলতো বাইরে আছে দেবতা আর দৈত্যদের দেশ, দৈত্যরা বিরাট বিরাট চেহারার, তাদের দেহ লম্বা লম্বা কালো লোমে ভরা, তারা খুবই শক্তিশালী আর বদখত। আর দেবতারা ভারী সুন্দর, তাদের ঝলমলে ডানা আছে, তারা উড়ে বেড়ায়। শুনিয়া তো দেবতাদের মেয়ে, তাই তার ডানা আছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি অনেককাল আগে বিদ্রোহী খুম্বা যখন দলপতি তিমান্থের সঙ্গে ঝগড়া করে অরণ্যে পালিয়ে গেল, তখন সে কোথায় গিয়ে পড়েছিল? দেবতাদের দেশে নাকি দৈত্যদের দেশে?

পাথুরে চাতালের প্রান্তে এসে দাঁড়াই। এত উঁচু থেকে কতখানি দেখা যায় একসঙ্গে! ঐ যে মস্ত ওকুমে গাছটা, ওরই নিচে বসে তো আমাদের উপদেশ দিতো নিষাত! নিষাত মরে গেলে ওকে মাটির গভীরে শুইয়ে দেওয়া হলো তো ঐ গাছেরই কাছে! নিষাত মরে কোথায় গেল, দেবতাদের দেশে?

ওকুমে গাছের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেলে দিই খোলা সবুজ জমিনের উপরে, শুনিয়ার জলধারা চিকচিক করছে সবুজের মধ্যে। দেখতে পাই একদল ছেলেমেয়ে খেলছে নদীর পারে, আমার আবছা মনে পড়ে আমি আর খুমান, তখন আমরা ছোটো, আমরা ও খেলতাম। আরো কতজন ছিল, কুশ....

তীরবিদ্ধের মতন ঘুরে তাকাই, এই গুহা কাল অবধি খুমানের ছিল, এখন কুশের। কুশ এখন আমাদের নতুন দলপতি। কাল খুমানকে হত্যা করে সে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! খুমান কি সত্যি মরে গেছে? আর কোনোদিন সে ফিরবে না? আমি চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাই, শকুন উড়ছে। সবই কি খেয়ে ফেলবে ওরা? কাল খুমান ছিল সাহসী, শক্তিশালী যুবক, আমাদের যূথের যূথপতি, আজ তার চিহ্ন কোথাও নেই! যন্ত্রণায় আমি তীরবিদ্ধের মতন ছিটকে উঠি, কোথা থেকে আসে এ যন্ত্রণা? কোনো তীর তো কেউ ছোঁড়েনি, লাল রক্ত তো বেরিয়ে আসছে না! তবু কিসের এ বেদনা?

কুশ এগিয়ে এলো, তার সবল বাহু ঘিরে ধরলো আমায়। খুমানের সবই এখন তার, প্রাক্তন সঙ্গিনীও তার। আমি স্থির হয়ে থাকি, বাধা দিয়ে কি হবে? কুশের নেতৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছে, তাকে বাধা দেওয়া বিদ্রোহের সামিল। তবু ইচ্ছে করলেই আমি পারি, ছিটকে উঠে দাঁড়াতে পারি, পাথর দিয়ে লড়াই করতে পারি, হারিয়ে যেতে পারি অরণ্যে বা একেবারেই হারিয়ে গিয়ে খুমানের কাছে উপস্থিত হতে পারি। তাই কি? মরে গেলে কোথায় যাবো? খুমানের কাছে ? নাকি শুনিয়ার কাছে ? নাকি লোমশ দৈত্যদের দেশে?

দুর্বল আর ক্লান্ত লাগে, আদিম বন্য বিদ্রোহিনী ঘুমিয়ে পড়ে। কুশ প্রাণপণে চেষ্টা করে চলে উপভোগের, আমি লুটিয়ে পড়ে থাকি খুমানের কোমল রোমভরা বুকে। খুমান মরে নি, সে মরতে পারে না, সে ফিরে আসবে। অসহ্যরকমের দাপাদাপি শেষ হলে ক্লান্ত কুশ ঘুমিয়ে পড়ে, আমি এলিয়ে পড়ে থাকি আধাঘুমে আধা জাগনে। মনে পড়ে শেষরাতের শুনিয়ার কলকল শব্দ, সে কবে, কবে? খুমান আমায় ওখানে দেখে অবাক হয়ে বলেছিল, " তিবা, তুমি এখানে এসে বসে আছো এত রাতে?" কবে, সে কবে?

উষ্ণ লবণজল আমার গাল ভিজিয়ে দিতে থাকে, খুমান খুমান খুমান, তুমি কোথায় তুমি কোথায়? আমি বুঝতে পারি না, খুমান সাড়া দেয় আমার ভিতরে, হালকা কোমল একটা ধাক্কা। খুমান নতুন জন্ম নিয়ে ফিরে আসবে, শুধু সে না, আমিও তার সঙ্গে নতুন হয়ে জন্মাবো। জীবনের ভিতরে জীবন গড়ে ওঠার সেই তীব্র বেদনার আনন্দ আমায় ঘিরে ফেলে শুনিয়ার জলের মত।

***

"কি হলো, ট্রিণা?" যেন বহুযুগ পার হয়ে গলাটা ভেসে এলো। সত্যিই বহুযুগ পার হয়ে। অ্যডামের গলা। আমার কাঁধে হাত রেখে অ্যাডাম ঝাঁকানি দিয়ে আবার বললো, "তোমার কি হলো ট্রিণা?" অ্যাডাম তৃণা বলতে পারে না, বলে ট্রিণা।

ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠলাম জাগরস্বপ্ন ভেঙে। স্বপ্ন? আমার চোখের সামনে যে বহুশত শতাব্দী পূর্বের জীবন অভিনীত হচ্ছিল, তা কি শুধুই আমার স্বপ্ন?

"আরে আমাদের আজকের ফিল্ডওয়ার্ক এখুনি শুরু করতে হবে। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে! তুমি ঠিক আছো তো? "

আমার চোখ তখনো ঝাপসা, মাথা তখনো স্বপ্নটলমল। আমি দু'হাতের পাতা দিয়ে চোখের উপরে হালকা ঘষা দিই, উঠে দাঁড়াই। জিনসের প্যান্টের হাঁটুর কাছে ধূলা, ঝাড়তে ঝাড়তে বলি, "আমি একদম ঠিক আছি অ্যাডাম। ধন্যবাদ। চলো, কাজ শুরু করি।"

আমরা কাজ শুরু করলাম। আমরা, একবিংশ শতকের দুই মানবমানবী অ্যাডাম ও তৃণা, সেই বহুপুরাতন ঊষাযুগের সন্ততিদের জীবনরহস্য সন্ধানে উৎখনন শুরু করলাম। কী গভীর গোপণ সূত্রে আমরা যে তাদের সঙ্গে যুক্ত, সেই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায়। সে কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া, সেখানে স্বপ্নের উৎপাত বরদাস্ত করা হয় না। খুব সাবধানে আমি লুকিয়ে ফেলি দীর্ঘশ্বাস, কেউ যেন কিছু না বুঝতে পারে।

শুধু দু'খন্ড হয়ে ভাঙা পাথরটি আমার দিকে চেয়ে থাকে, গুহার সামনের চাতালে একই জায়গায় সেটি পড়ে আছে, একইরকম ভাঙা। শুধু সেটার গায়ে লালচেবাদামী দাগগুলো আর নেই, কবেই সে দাগ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে।

(শেষ)

হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ

সময়ের স্রোতে নিত্য আলোড়িত হতে হতে কত দূরের মানুষ কাছে আসে, আলো হয়ে যায় মনের ঘর। আবার কত কাছের মানুষ দূরে চলে যায়, বেদনার মতো বাজে চলে যাওয়া। কিন্তু আসলেই কি চলে যায় তারা? বাহিরে যে চলে গেলো, তার অশ্রুঝলোমলো মুখখানি ধরা থাকে স্মৃতিতে। বেদনার অর্ঘ্যে তার চিরদিনের অভিষেক। তাকে মুছবে কে?

"ভুলে যা" "ভুলে যা" "ভুলে যা" বললেই কি কিছু ভোলা যায়? কোন্‌ বহুদূরের পাহাড়ের চূড়া থেকে উৎপন্ন হয়ে, কত মাঠবন পার হয়ে, কোন্‌ সুখউঠানের পাশ দিয়ে কলকলিয়ে, কোন্‌ দুখপাথরের গায়ে জলহাত বুলিয়ে বুলিয়ে বয়ে যেতে থাকা জলছলছল নদীকে কি উৎসে ফিরে যা বললেই সে ফিরতে পারে?

ভুলে যাওয়া যায় না কিছুই। মনের স্তরে স্তরে আলোআঁধারির খেলা, ধাপে ধাপে নেমে গেছে সিঁড়ি, ও ও ও ই কত নিচে, শেষ দেখা যায় না। ধাপে ধাপে উঠেও গেছে সিঁড়ি, ও ও ও ও কত উপরে, ঝকমকে নীল যেখানে গভীর মধ্যরাত্রিনীলে মিলিয়ে গিয়ে তারার মণিকণায় হেসে উঠেছে, সেই দিকে, উপরের দিকেও শেষ দেখা যায় না। এই সব সিঁড়িরা কত সব রহস্যপুরীতে গিয়ে থেমেছে, কেজানে!

জীবনানন্দ চিরকাল সেই গভীর রহস্যলোকের গল্প বলেছে আমায়, মহীনের ঘোড়ারা সেখানে কার্তিকের জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে ঘাস খেয়ে চলেছে, সেখানে বিলুপ্ত নগরীর মর্মরপ্রাসাদে আজও অপেক্ষায় আছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেম, ধানসিঁড়ি তীরে চেনা কাশফুলমাঠ ফিরিয়ে আনে গতজন্মস্মৃতি, হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে থাকে, হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে থাকে.....

হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ

ভিক্ষাপাত্র ধুয়ে নিয়ে বহে গেছে জল
স্মৃতিতে ক্ষুদের গন্ধ তবু লেগে থাকে,
কুয়াশার মাঠশেষে বাঁশপাতাবনে
যেমন মায়াবী চাঁদ একা জেগে থাকে।

বাসনার ধূলাবালি ধুয়ে নেবো ভেবে
নির্বাসনস্নানে নামি নীবারার স্রোতে,
আকাঙ্ক্ষা-পাখিরা তবু ঝাপটায় ডানা
দুইচোখে জলছবি ছায়াতে আলোতে।

ভেবেছি তো নি:শেষে ভুলে যাবো সব
আগুনের শিখা জ্বেলে করেছি শপথ,
তপ্ত হাওয়ায় তবু উড়ে আসে বালি
ছুঁয়ে যায় শিলাঢাকা হৃদয়ের পথ।

এখনো সে পুরাতন জল বয়ে চলে
এখনো জমে নি সব কঠিন বরফে-
এখনো তো পাখামেলা মেঘ ভালোবেসে
আলো লিখে যায় গান অচেনা হরফে।

ভিক্ষাপাত্র ধুয়ে নিয়ে বহে গেছে জল
হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ তবু লেগে থাকে.....
হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ তবু লেগে থাকে.....

***

Friday, June 19, 2009

অগ্নিজাতক

1
অগ্নি ছিলো সূর্যে, আকাশে বিদ্যুতে, জীবন্ত আগ্নেয়শৈলের জ্বালামুখে, অরণ্যে দাবানলে ও সমুদ্রে বাড়বানলে। কিন্তু সে ছিলো না হিমকন্থা প্রস্তরগুহায়, ছিলো না বৃক্ষচারী প্রায়মানবের সন্নিধানে। তীব্র শীতপ্রবল উত্তরী অক্ষের দেশে ছিলো কুয়াশা, ছিলো নিষ্ঠুর তুষারঝঞ্ঝা ও হিমজমাট প্রান্তর। হিমকন্থা প্রায়মানবেরা অগ্নিকে আহ্বান করেছিলো ভাষাহীন চিত্কৃত প্রার্থনায়।

সুদূরে দক্ষিণ সমুদ্রের দেশের ধীবরী, তরল অন্ধকার ছড়িয়ে আসা সন্ধ্যায়, সাগরবেলায় চেয়ে আছে পশ্চিমে, সেখানে জল লোহিতবর্ণ হয়ে ছলচ্ছল করছে। ঐ তীব্র লোহিত বর্ণ, জননী গর্ভোত্সারিত রক্তধারার মত জীবন্ত মনে হয়। ঐ অমৃতের সমুদ্রে অবগাহন করেই কিনা সূর্য প্রতিদিন নবজাত হন!

হে দ্যুলোকের দেবগণ, ঐ দিক দিগন্তরে ছড়ানো অসংখ্য দ্বীপমালার কোনটিতে হবে আমার গন্তব্য? কোথায় আছে সেই লোহিত সমুদ্রের দুয়ার? অনন্ত জীবনের ঝর্ণা?

অনুকূল সমুদ্রস্রোতে তরী নিয়ে এসে পড়ে ধীবরেরা,তাদের জালে মত্সের ও কূর্মের ভীড়। সমুদ্রবেলায় দ্রুত বন্টনের শেষে ওদের ফিরে যেতে হবে ঘরে।

এখানে পর্বতসানুতেও বেলা পড়ে আসছে, নদীতীরের বালুচর স্বর্ণপ্রভ। শিকারজীবীরা দিনের শেষজল পান করে ফিরে যাবে মৌচাকের মতন গুহাসমূহে। ইন্দ্রনীলপ্রভ মেঘ ঘনায় এ উপত্যকা জুড়ে, সন্ধ্যা-আকাশ বয়ে আনছে কি অদ্ভুত অনাস্বাদিত বার্তা। কিছু একটা ঘটতে চলেছে, এই হলুদ বালুচরবর্তী ভাষাহীন প্রায়মানবেরা অনূভূতি দিয়ে বোঝে, কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না সেটা কি।

নারী ও পুরুষ ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গুহামুখে, শিশুরাও উন্মুখ। সিংহের মতন সুকেশর মেঘেরা আকাশে খেলা করে বেড়ায়, শোঁ শোঁ ঝড়ো বাতাসে উড়তে থাকে শুষ্ক পত্রসম্ভার। দক্ষিণ পশ্চিমে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ। আকাশের অগ্নিদেবতা। পাবক-অভিলাষী মানবকের জন্য এইবারে তিনি আসবেন, আসবেন এইখানে, এইখানে, এইখানে।

স্বেদবিজড়িত চকিত নিদ্রাভঙ্গে চমকে উঠি, কে আমার হাত ধরে আছে? এইহাতের উপর এইমাত্র ছিলো তপ্ত অগ্নিস্পর্শ, চরিতার্থকামা নারীর মরচক্ষুতে স্পষ্ট হয়েছিলো পাবকের নখবিলিখন। সে কোথায় গেল? এইখানে এইখানে এইখানেই তো ছিলো,এইমাত্র, এই মুহূর্তেই।

প্রৌঢ় হয়ে আসা সঙ্গীর বলিরেখাময় মুখে আর রূপ নাই, পরিণতিও নাই। কালের অমোঘ হস্তাবলেপে মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষয়ে যাই আমরা, ঝরে যাই, ক্ষয়ে যায় আমাদের সব স্বপ্ন ও যন্ত্রণা। সব তাপ নিভে আসে আস্তে আস্তে।

বিছানা বালিশে মেঝেতে শয্যায় ছড়িয়ে পড়ে থাকে আমাদের অগণিত মর্ষনজাত ও ধর্ষণজাত সন্তানেরা। নানা আকৃতির ও চেহারার নর ও নারীরা। ঘুমন্ত ও আধাঘুমন্ত। কেউ কেউ জাগ্রতও। কেউ শুয়ে থাকে শিথিল একটি দীর্ঘ দন্ডের মতন, কেউ গুটিয়ে গোল হয়ে গর্ভস্থ শিশুর মতন, কেউ এলোমেলো একগোছা খড়ের মতন।

কিন্তু ঐ অনন্ত অগ্নি? ঐ অন্তহীন জ্বালামুখ? কোথায় প্রচ্ছন্ন হয়ে আছো ছদ্মবেশী? কোথায় কিসের আবরণে ঢেকেছ লেলিহজিহ্বা তোমার? কামার্তা মানবীকে এইমাত্র লেহন করে গেছ যা দ্বারা?


2
একটি উচ্চ ঢিবির মতো এখানে। ক্লান্ত যোদ্ধা সেই ঢিবিতে উঠলেন। কেন যে এখনো ভারী অস্ত্রটি তিনি সঙ্গেই নিয়ে যাচ্ছেন কে জানে! কোনোক্রমে টানতে টানতে তিনি ঢিবির উল্টাদিক দিয়ে নেমে গেলেন। তারপরে প্রায় ছুটতে লাগলেন। আ:, এত তৃষ্ণা কেন? কেন এখনো এইসব বোধগুলি তাকে ছেড়ে যায় না?

উপত্যকা অতর্কিতে নেমে গেছে নীচে। সেখানে টলটল করছে হ্রদের জল। ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত যোদ্ধা তাকিয়ে থাকেন সেইদিকে। তারপরে প্রথমে তার অস্ত্রটি ফেলে দেন জলের কিনারে, পরে নিজে নেমে আসেন পাথরে সাবধানে পা রেখে। তারপরে জলের মধ্যে প্রায় লুটিয়ে পড়ে আকন্ঠ পান করেন সেই ঠান্ডা, স্নিগ্ধ জল। আ:।

বৌ ষট্ বৌ ষট্ বৌ ষট্ --অসংখ্য ঘোড়ার পায়ের শব্দ পাই, ধূসর ও গৈরিক প্রান্তর জুড়ে তাদের হিল্লোলিত দেহভঙ্গী, শস্যময় হরিত্ দুধমধুর দেশের দিকে আরোহীদের যাত্রা, তাদের জ্বলজ্বলে কঠিন চক্ষে বিপুল তৃষ্ণা। অল্পস্তন্যে পৃথিবী তাদের ক্ষুধার্ত করে রেখেছে। তাই তারা খুঁড়ে নিয়ে আসবে পাতালের ধনরত্ন, আকাশের রৌদ্রজল, বাতাসের গতি ও প্রাণের লাবণ্য। বিপুল প্রস্তরস্তূপ অতি জটিল ও সূক্ষ্ণ হিসাবের দ্বারা একটির উপর আরেকটি চাপিয়ে মন্দির তৈরী হবে মরুবালুরাশির উপরে, কৃত্রিম পর্বতের মতন এর উচ্চশীর্ষ ভেদ করে যাবে আকাশে ভাসমান মেঘসমূহ।

3
কত নক্ষত্র নিভিয়া গিয়াছে, কত নক্ষত্র জ্বলিয়াছে নূতন! পৃথিবীর প্রেমনত চক্ষে দূর দূরান্তের আলো এসে লাগে, ক্রমশ আরো আরো কল্পপূর্বের আলো, যখন পৃথিবী ছিলো না, সূর্য ছিলো না, বিপুলা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ স্বপ্নবৎ লুকাইয়া ছিলো কোন্ জটিল গণিতের গোলোকধাঁধায়, সেই আদিযুগের আলো এসে পরশ করিয়া যায় পৃথিবীকে। সেই আদি অগ্নির তাপ ফুরাইয়া যায় নাই, রহিয়া গিয়াছে আজও।

হে পাবক, হে পবিত্র অগ্নি, জাতবেদা হুতাশন, আমার জন্মমরণ চরিতার্থ করিয়া বাজিয়া ওঠো,ঐ ফুলের আগুন যে নীল দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে, ঐ তীব্র আকাংক্ষার সন্তানেরা যে প্রশান্ত সমুদ্রের কিনারে নামিয়া গিয়াছে তটপঙ্ক অতিক্রম করিতে করিতে, সেইখানে একই বিন্দুতে যখন তুমি আমি ও এই মহাজগৎ একীভূত হইয়া ছিলো, সেইখানে, ঠিক সেইখানে। এতটুকুও কি সরিয়াছে সেই ব্রাহ্মবিন্দু ও সেই অনাদ্যন্ত ব্রাহ্মমুহূর্ত? অনি:শেষ ও অনবরত অনাবৃত অথচ চিরকাল দূরে সরিয়া যায়?

জ্বলুক জ্বলুক তোমার দীপ্তিঢালা সুধা, ঐ শিখায় ধন্য হৌক এই নশ্বরতার সমস্ত আর্তি বেদনা দু:খ ও সুখ। এসো, সর্বাঙ্গ লেহন করো, চির চরিতার্থ হৌক এই পৃথিবীবদ্ধ হিয়া।

আমারা একে অপরে নিহিত ছিলাম আদি অগ্নির স্বপ্নে, তখনো সে তাপ তীব্রভাবে অস্তিত্ববান, প্রথম তিন মিনিটের সমস্ত আলোড়ন বিদারণ শরণ ও বিশরণ এর পরে সৃষ্টিমুখী মথিত সমুদ্রের মতন শান্ত ও পরিপ্লুত।

সুবোধ্য দুর্বোধ্যতার সীমা পেরিয়ে যাও ধ্যানের মধ্যে, হে শুদ্ধশীল। দেখতে পাচ্ছ কি নীল স্নিগ্ধতা? বুঝতে পারছ কি সীমাহীন অন্তহীন রাত্রির গভীর প্রসন্ন মণিময় আহ্বান? পদ্মের পাপড়িগুলি অদৃশ্য, নিহিত মণিগুলি ঝলমল করছে জ্যোতিকণিকার মতন। "ওম্ মণিপদ্মে হুম।"

গভীর স্বরে বেজে উঠছে সুরেলা ঘন্টা, পার্বত্য বিহারটির হৃদয়োত্সারিত মন্ত্রাঞ্জলির মতন। শুদ্ধশীল, এসো আমরা ওখানে যাই। এখন ঊষালগ্ন, ভারী পবিত্র এখন সবকিছু, প্রকৃতি এখন গায়ত্রীগান গাইছে।

ঐ দ্যাখো উচ্চশীর্ষ সরল গাছগুলি পর্বতগাত্রে, উর্ধমুখ মৌন। গভীর ধ্যানরাত্রির শেষে চক্ষু মেলে উদয়দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে। ভূলোক ভূবলোক ও স্বর্লোকে আলোর শঙ্খ বাজছে, শুনতে পাচ্ছ কি?

হে বরেণ্য সবিতা, সেই আলোর রথ আসুক এইখানে এইখানে এইখানে। ঠিক এই হৃদয়ের মাঝখানটিতে, এই চেতনার পদ্মকোষে, এই মর্মরিত মন-অরণ্যের লুক্কায়িত বৃক্ষবাটিকায়।



4

সেই মাতৃস্বরূপা স্তন্যদায়িনী তটিনী। তীরবর্তী হলুদ বালুচরে, সেই পর্বত কন্দরবাসী মানবের ত্রস্ত অস্তিত্বের সম্মুখে তিনি এসেছিলেন। আজও যেমন আসেন, মুহূর্তে মুহূর্তে। অনভিজ্ঞ অপ্রস্তুত প্রায়মানবের সম্মুখে অতর্কিতে এসেছিলেন তিনি।
বজ্রপাতে জ্বলে উঠলো শুষ্কমৃত বৃক্ষ। অট্টহাস্যে আকাশ কাঁপিয়ে দিলো তীব্র রক্তরঙ অনল। লেলিহজিহ্বা পাবক আকাশ লেহন করতে উঠলো। শুদ্ধশীল, আমরা এগিয়ে গেলাম। অগণিত সময়খন্ডকে পার হতে হতে। উত্তপ্ত হলকা আমাদের ললাট নেত্র নাসা মুখ বাহু হদৃয় উদর জননেন্দ্রিয় উরু ও চরণ স্পর্শ করে করে থামতে বললো, সহজাত ভয়ানুভূতি আমাদের পায়ে পায়ে বাধার মত জড়িয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু আমরা তথাপি থামলাম না। অগণিত অতীত-আত্মা কানফাটানো অভিশাপে জর্জরিত করতে লাগলো আমাদের শ্রবণাতীত শ্রবনেন্দ্রিয়, কিন্তু তাও আমরা থামলাম না। ঐ পাবকশিখা হয় আমাদের দগ্ধ করে দিক, নাহয় আমরা ওকে নিয়ে আসি আমাদের প্রাণের দক্ষিণ বাতায়নে। অগণিত দৈত্যদানব বাধা দিলো, অসংখ্য আমরা মরে মরে ছাই হয়ে যেতে লাগলাম। ভস্মসাৎ হয়ে যেতে লাগলাম । ফের জন্ম নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাদের হাতের শুদ্ধ বৃক্ষশাখায় তাকে আনবোই আনবোই আনবোই আমরা।

সে এলো, দক্ষিণাগ্নি হয়ে জ্বলে উঠলো অগ্নিমন্দিরে, যজ্ঞস্থলীতে। আমরা সমিধ ও ঘৃত দ্বারা উপাসনা অব্যহত রাখলাম। সে প্রদীপ হয়ে দূর করে দিলো অন্ধকার, প্রথমে বাইরের, ক্রমে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরের।

কিন্তু শুদ্ধশীল, শেষ পর্যন্ত এ কোথায় এলাম? মঞ্জরিত বোধি দেখতে প্রার্থনা করেছিলাম আমরা,আলোর তরু, পরম আলো।
তাই কি দেখলাম? হে আলোর ঈশ্বর, এ কি দেখলাম?

দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত মহা বালুরাশি। মহাবিস্তৃত মরুভূ। এই মরুতে শ্বেতবালুকা। এই নির্জন মরুতেই আমাদের অগ্নিবৃক্ষ পাতাল ও গভীর অতল হইতে উত্থিত হইয়া সপ্তস্বর্গ লেহিতে জিহ্বা প্রসারিত করিল। রোষরক্তিম প্রলয়মেঘের ছত্রাককুন্ডলী দেখিয়া আমাদের চেতনা স্থবির হইয়া গেলো। অসহনীয় উত্তপে মরুবালুকা স্ফটিক হইয়া গেলো।

সুদূর অতীতের সেই প্রথমাগ্নির পবিত্রলগ্নে যে অন্ধকার জলীয় দানব আমাদের অগ্নিসম্মুখে ভয়হীন হইতে দেখিয়া অভিশাপ দিয়াছিলো, প্রচন্ড নিষ্ঠুর বাধা দিয়াছিলো, সে উচ্চন্ড হাসিতে হাসিতে সহসা কান্নায় শতধা হইয়া গেলো। মিহিন বৃষ্টি নামিলো আকাশ হইতে।

জ্বলিয়া উঠিলো প্রলয় অগ্নিবৃক্ষ বারে বারে,উত্তরে দক্ষিণে, পুবে পশ্চিমে। অসংখ্য সমুদ্রবেলা স্ফটিক হইয়া গেলো। অসংখ্য মরু অপেক্ষা করিতে লাগিলো স্ফটিক হইবে বলিয়া।

অনন্ত জীবনের ঝর্ণার রক্তিম উত্স আবিষ্কার করিতে চাহিয়াছিলো যে ধীবরী, তাহার পথ নির্দেশক নক্ষত্র শত টুকরায় ভাঙিয়া জলরাশির নিম্নে ডুবিয়া গেলো। অগ্নিবৃক্ষ থামিলো না, ক্রমশ আরো আরো সবুজ গ্রাস করিতে লাগিলো ক্ষুধার্ত ব্যয়ত আননে। বারে বারে তাহার নির্মম করোটিচিহ্নিত পতাকা জ্বলিয়া উঠিলো সাগরে ভূধরে দ্বীপে দ্বীপান্তরে।

5
শুদ্ধশীল, সুদূর কপোতকূট গিরিবাস হইতে কবে অসিবে সেই শ্বেতপক্ষী, ডানায় নতুন আলো লইয়া? আমাদের মুক্ত করিবে অন্তহীন মৃত্যু হইতে?

পর্বতারোহণে ক্লান্তি আমার দু'পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শৈবালের মতন। শুদ্ধশীল হাত বাড়িয়ে আমার হাতটি ধরলেন। ঘন্টার শব্দ শান্ত হয়ে গিয়েছে, পর্বতে নতুন সূর্যের অলো ঝলমল করছে। একটি অফুরান চুম্বনের মধ্যে মিলে যেতে যেতে আমরা অনুভব করলাম, অগ্নি, জল, মৃত্তিকা,শিলারাশি, অনিল ও ব্যোম, বিঘূর্নিত মথিত আলোড়িত হতে হতেও এক এক একই।

অভ্যন্তরে সেই শুদ্ধ অগ্নির তাপ অনুভবই আমাদের শেষ সসংজ্ঞ স্মৃতি।

Sunday, April 19, 2009

রোদ্দুরমহল

সকালের কোমল নীল আকাশ থেকে হাল্কা বাতাস বেয়ে টুসটুসে কমলাসোনালী আলোর দানা ঝরে পড়ে টুপটাপ। আমলকী গাছের ছায়ায় জংলাপ্রিন্টের শাড়ীর মতন রোদ্দুর, তুরতুর করে শিশিরভেজা আলোছায়ার উপর দিয়ে দৌড়ে যায় কাঠবিড়ালি, ভোমরা গভীর গুঞ্জন করে উড়ে বেড়ায় আমের বোলে বোলে, শীত ফুরিয়ে আবার এলো নতুন প্রাণের দিন।
এইসব দিনগুলোতে অনুরাধার মনকেমন করে, উনুন ধরাতে ধরাতে, আনাজ কুটতে কুটতে, রাঁধতে রাঁধতে মনে পড়ে কতদিন সেই তাড়াহুড়া নেই, তখন অভি আর অঝোরা স্কুলে যেতো, ওদের বাবা যেতো অফিসে-সকালগুলোয তখন অনুরাধার নি:শ্বাস ফেলার সময় থাকতো না। এদিক থেকে অভি-"মা, কোথায় রাখলে জুতো?" ওদিকে থেকে অঝোরা, "মা, সেফটিপিনগুলো রাখো কোথায়, দরকারের সময় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না!" অনুরাধা তো একজন, দশজন তো না, কতদিক সামলাবে সে? তবু সে না গেলে কিছুই খুঁজে পেতো না কেউ, না ছেলেমেয়ে না তাদের বাবা-কেউ ই কিছু খুঁজে পেতো না। অনুরাধা তরকারির কড়াই আগুন থেকে নামিয়ে দৌড়ে গিয়ে খুঁজে দিয়ে ফিরে আসার সময় বলতো "দুই আঙুলের বেশী কেন দেখ না তোমরা?" কোথায় গেলো সেইসব দিন?
রান্নাঘরের জানালার বাইরে রোদ্দুরছায়ার খেলা চলতো এরকমই। মনকেমন করা বসন্তদিনগুলো এসেছে আর চলে গেছে, কাজের ভীড়ে ওদের দিকে চোখ পড়লেও মনে আসন দেবার সময় ছিলো না। সকলে ইস্কুলে আপিসে চলে গেলে আস্তে আস্তে বাড়ীটা শান্ত হয়ে আসতো। তবু ঘরদোর ধুয়েমুছে কাপড় কাচাকুচি সব করে স্নানটান সেরে উঠতে উঠতে বেলা হয়ে যেতো অনেক। পুজো দেওয়া সেরে দুপুরের খাওয়া খেতে খেতে আরো দেরি। চুল শুকাতে ছাদে গিয়ে চোখে পড়তো চারিদিকে গাছে গাছে নতুন পাতা, সজনের ফুল ছাদ থেকে হাত বাড়িয়েই পাড়তো সে, অঝোরা সজনেফুলের বড়া খেতে ভালোবাসতো, বিকালে সে ফিরলে ভেজে দিতো বেসন দিয়ে।
তার সব কিছু ভাবনা ছিলো সংসারকে ঘিরে-প্রিয়জনেদের ভালোলাগা না লাগা নিয়ে। নিজের মনের মধ্যে যে ফুলগুলো ফুটতো, মনের বাগানের মাটিতেই ঝরে গেছে তারা, কাব্যমালায় গাঁথা হয় নি তাদের। অঝোরা বা অভি বা তাদের বাবা-কেউ কি জানতো অনুরাধা ডাইরি লিখতো একসময়? কবিতাও কিছু সে লিখেছিলো বিয়ের আগে, মামারবাড়ী থেকে আনা সুটকেসের মধ্যে কাপড়ের রাশির নীচে রয়ে গেছে আজও তাদের হলদে হয়ে যাওয়া পাতা। কেউ কি কোনোদিন খুঁজে পাবে তাদের?

বুকের কাছের সন্তানেরা কত দূরে আজ! একজন দূর সাগরপাড়ে নিজের মতো আছে, অন্যজন হাজার মাইল দূরে পাহাড়ী শহরে চলে গেছে চাকরি নিয়ে। যাক, যাক, জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে তো চলে যেতেই হয়, তাদের কেন আটকাতে চাওয়া?
স্বামী এখন রিটায়ার করে অবসরজীবন যাপন করতে করতে পরিকল্পনা করছে একবার গ্রামে নিজেদের ভিটেমাটি যেখানে ছিলো দেখতে যাবে। অনুরাধা ও যাবে সাথে। কিন্তু তার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি নেই, অতি শৈশবে সে পিতৃহীনা হয়, তখনই গ্রাম ছেড়ে মা-দিদিমা-দাদামশায়ের সংগে চলে এসেছিলো, গ্রামের স্মৃতি তার কাছে গতজন্মের মতন আবছা।
কি যেন নাম ছিলো নদীটার? তেরাই না ভোগাই? গাঁয়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণাঙ্গী নদীটি বর্ষায় প্রমত্তা হয়ে উঠতো, তখন তাকে দেখে কে বলবে বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল পার হয়ে তারা পাঠশালে যেতো? সেখানে ফিরে গেলে কি কিছু মনে পড়বে অনুরাধার? সেইসব চলে যাওয়া বেলা সব, সেই সব শৈশবদিন? সেইসব ব্রতকথা---মাঘমন্ডল সোনার কুন্ডল?
(Cont.)

Sunday, March 8, 2009

জন্মজমিন

ওরে বাবা, ওরা !! ওরা!!!!

তিয়া আর তিশা গল্প শোনে বুড়ামানুষটার কাছে বসে, ঐ দূরে নীল-সবুজ গাছের রেখা টানা গাঁয়ের সীমা, তার বাইরে তারা দেখেছে বাজারের কাছে ইস্টিশান আর সেইখানে আসে লক্করঝক্কর ট্রেন। সেই ট্রেনে চেপে বাবাকাকারা রোজ যায় কাজে। তারা ইস্কুলে যায় রিকশা করে, সে ইস্কুল গাঁয়েই। কখনো কখনো তারা বাজারের কাছের বাসে চড়ার জায়গা থেকে বাসে উঠে বেড়াতে যায় মামাবাড়ি।

কিন্তু এইসবের বাইরে অনেক দূরে, অনেকবার ট্রেন বাস নৌকাবদল করে যাওয়া যায় এত দূরে নাকি ছিলো তাদের দেশ। বুড়ামানুষটা বলে সেই দেশ থেকে তারা সবাই চলে আসলো নৌকা বাস ট্রেনে করে। তিয়াতিশারা তখন জন্মায় নি। চলে আসলো তাদের মাবাপদাদাপরদাদারা।

চলে আসলো কেন? বড় বড় চোখ করে জানতে চায় তিয়া। বুড়ামানুষটা চোখেমুখে ভয় ফুটিয়ে বলে,"ওরে বাবা, ওরা!" ওরা কারা?

তিয়াতিশারা ঠিক মতন বুঝতে পারে না। শোনে ওরা নাকি খুব ভয়ানক, ওরা নাকি ধারালো অস্তর নিয়ে ছুটে আসতো অদ্ভুত সব শব্দ বলতে বলতে,ওরা নাকি কত মানুষ মেরে ফেলেছে, দাউদাউ আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরবাড়ী। তিয়া ভাবে তাহলে কি ওরা মানুষ নয়, অন্যকিছু? তাদের ভয়েই কি মানুষেরা পালিয়ে আসছিলো? মনের চোখে সে দেখে দলে দলে মানুষ খালিপায়ে দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে,ছোটোদের নরম হাতগুলো বড়দের গিঁঠেপড়া হাতের মধ্যে আটকে আছে,যত জোরে সাধ্য ততজোরেই তারা দৌড়ায়। চারিদিকে ভয়ের ছবি। ওদের পিছনে যারা তাড়া করে আসছে সেই "ওরা"দের মনে মনে দেখার চেষ্টা করে ভয়ে ভয়ে থেমে যায় সে। ওরে বাবা, ওরা!! দরকার নেই দেখে।

তিয়ারা বড় হয় আস্তে আস্তে, গাছগাছালির গন্ডীটানা গাঁয়ের ইস্কুল আর তাদের ধরে রাখতে পারে না। আগে যে ট্রেনে তারা বাবাকাকাদের রোজ যেতে দেখতো, তাদের সেই ট্রেনেই চড়ে রোজ যেতে হয় তিন স্টেশান পার হয়ে।

(Cont.)