Friday, March 11, 2011

মণিদীপা(১)

সেটা ছিলো ২০০৮ এর মে মাস। গ্রীষ্ম এসেছে বেশ জাঁকিয়ে। তপতপে দুপুরগুলো। সোনাগলানো রোদ যে আসলেই কী জিনিস তা বোঝা যায় বাইরে বেরুতে হলে। রোদ একেবারে সারা গায়ে চিড়বিড়িয়ে লাগে যেন সত্যিই গলন্ত ধাতু। এমন সুন্দর নীলকান্তমণিপ্রভ আকাশকেও তখন মনে হয় শত্রু, মনে হয় মেঘেরা এসে দখল করে নিক আকাশের ঐ নীল খিলান। এখানের লোকে অবশ্য কেয়ার করে না, ফুরফুরে হালকা জামাকাপড়ে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে, ব্যস্ত সামার ক্যাম্পাস। রেগুলার স্টুডেন্টরা এসময় বেশী থাকেনা বলে স্পেশাল সামার স্টুডেন্টরা অনেক এসেছে।

লাইব্রেরীর ভিতরে চমৎকার ঠান্ডায় দেয়ালজোড়া ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একটা নিরিবিলি বেঞ্চি দখল করে বইপত্রের গোছা আর ল্যাপটপ রেখে গুছিয়ে বসি। বাইরে বড় বড় ওক গাছের ছায়া আর রোদ্দুরে মিলমিশ হয়ে দিব্যি জটিল নকশা হয়েছে। মানুষের দল চলেছে, বাইরের শব্দ কিছু আসে না বলে নি:শব্দ চলচ্চিত্র মনে হয়। বাইরে দেখি ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের তিনজনের দল চলেছে এখন, ক্লাসে যাচ্ছে নিশ্চয়। ওরা প্রত্যেক গ্রীষ্মে আসে। কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি ঝোলাঝালা সাদা পোষাক, মাথায় কালো সিল্কের লম্বা ভেল। ওদের দেখে সহসা মনে পড়লো মণিদীপাকে।

মণিদীপার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিলো এইরকমই এক গ্রীষ্মে, বাংলার এক ছোটো শহরে। অসংখ্য কাজুবাদামের গাছে ঘেরা ছোট্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সে ক্যাম্পাস তখন গ্রীষ্মকালীন ওয়ার্কশপের জন্য খোলা ছিলো কয়েক সপ্তাহ। তারপরেই গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। গরম পড়েছিলো খুবই। তার উপরে জায়গাটাও রুখু লালমাটির দেশ।

সেইখানের ওয়ার্কশপেই মণিদীপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রথমবারের দেখাতেই বাকীদের থেকে ওকে অন্যরকম লাগে। ওর স্বাভাবিক পোশাকের উপরে একটি ঘীয়া রঙের রেশমের হালকা চাদর উর্ধাঙ্গে জড়ানো। ওর চুলগুলোও কেমন অন্যরকমভাবে চূড়া করে বাঁধা। প্রথম পরিচয় হয়েই তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না কেন ঐ বিশেষ চাদর আর চুলবাঁধা, তাই অপেক্ষা করে রইলাম আলাপ আরো কিছুদূর গড়ানোর।

মণিদীপার সঙ্গে ওর বাবামা ও এসেছিলেন সে শহরে, ওরা সকলে উঠেছিল শহরের মাঝের যে বাজার তার পুবের দিকে এক হোটেলে। আমার হোটেলও ঐদিকেই ছিলো। সারাদিন চলতো ওয়ার্কশপ, সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল অবধি, গোটাদিন। সেভাবেই তৈরী হয়ে আসতাম আমরা। কিন্তু একদিন ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে হঠাৎ শুনি সেদিনের ওয়ার্কশপ বাতিল।

একটা রিকশা ঠিক করে আমি আর মণিদীপা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে। দীর্ঘ পথ, ঐ দুপুর রোদে আরো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। পথের পাশে পাশে কোথাও ছায়ামেলা গাছের সারি, কোথাও ধূ ধূ মাঠ।

রিকশা চলছে, আমরা দু'জনে টুকটাক কথা বলছি। তখন আমাদের বেশ ভালোরকম আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞেস করি ওর বিশেষ পোশাকের কারণ। মণিদীপা বলে যে ও এক বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে ঐ চাদর পরতে হয় আর চুল চূড়া করে বাঁধতে হয়। এখনও ও বাড়ীতেই থাকে বাবামায়ের সঙ্গে, আর কিছুদিন পরে আশ্রমে চলে যাবে। আশ্রম নাকি ওদের পাড়াতেই। এখন ও স্কুলে চাকরি করছে, আশ্রমে গিয়ে থাকলেও সেই চাকরি করতে পারবে কিন্তু সংসারধর্ম আর করতে পারবে না। ও বলে, সংসার যাতে করতে না হয় তার জন্যই তো মনে ঈশ্বরপ্রীতি জেগেছে, সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছা জেগেছে, বাবামা যে এই সামান্য কথাটা কেন বুঝতে চান না ও বোঝে না।

আমি চুপ করে শুনি। ধর্মের এত সবল রূপ আমি নিজেদের চেনা-পরিচিতের মধ্যে দেখিনি। ধর্মচর্চা প্রায় ব্যক্তিগত ছিল সেখানে। পরিচিত জনের মধ্যে বড়োজোর দেখেছি কোনো গুরুর কাছে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দীক্ষা নেওয়া আর গৃহী উপাসক হিসাবে তা পালন করা। একেবারে সংসার ছেড়ে আশ্রমে চলে যাবার মতন উচ্চকিত ধর্মচর্চা দেখিনি। শুনেছি কারুর কারুর বৈরাগ্য জাগার গল্প, সেও পুরানো কালের গল্প। কোনো বিশেষ কারণ নেই তবু কেন জানি মণিদীপার দিকে তাকিয়ে মনে হয় বৈরাগ্য নয়, কোনো গভীর অভিমান ওকে সংসার থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। কী সেই অভিমান? কোনোদিন কি জানা যাবে? সামান্য সময়ের মধ্যে ওকে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছে মেয়েটা খুব চাপা, অন্তর্মুখী। ওর গভীর অভিমানের কথা উজার করার মতন উদার মন না পেলে ও কখনোই কাউকে বলবে না।

আমাদের কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে যায় এবারে, মণিদীপার দাদা বিদেশে থাকে, সেখানেই স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে। বিদেশেই তাদের নাকি সেটল করার ইচ্ছে, কিন্তু পরে কি হয় বলা যায় না। চাকরির উপরে নির্ভর, কোম্পানি যদি দেশে ফিরিয়ে আনে, তবে ফিরে আসতে হতেও পারে।

" দাদাবৌদি ফিরে এলেই ভালো, বাবামার তো বয়স হচ্ছে! আমি আশ্রমে চলে গেলে আর তো বেশী দেখাশোনা করতেও আসতে পারবো না। " মণিদীপা কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলে।

" তোমার বাবামা তোমার সন্ন্যাস নেওয়ার ব্যাপারে কি খুশীমনে মত দিয়েছেন?" আমি আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলি।

" না। ওরা প্রথমে মত দিতেই চায় নি। পরে যখন বুঝতে পারলো আমার আর অন্য কোনো পথ নেই, আমার মন একেবারে প্রস্তুত, বাধা দিলে আমার মৃত্যু ছাড়া অন্য পরিণতি নেই, তখন বাধ্য হয়ে মত দিয়েছে। এখনো ওরা আশা করে কোনোদিন আমার মতি ফিরবে, আমি বিয়ে থা করে সংসার করবো। মানুষের আশা যে কী অদ্ভুত!"

"কিছু যদি মনে না করো মণিদীপা, সংসার করতে বাধা কি? সন্ন্যাস তো রইলোই, যখনই মনে হবে সংসারধর্ম কর্তব্যকর্ম শেষ হয়েছে, তখন যাবে সন্ন্যাসে। এখন মাবাবাকে দু:খ দিয়ে আশ্রমে চলে যাবে কেন? "

"বিয়ে? সংসার? না, কখনো না, কখনো না। " অদ্ভুত কাঠিন্যে শক্ত হয়ে উঠেছে শান্ত, কোমল মেয়েটির চোয়াল দু'খানা, হঠাৎ যেন কথাগুলো ধাতব হয়ে গেছে, চোখের মণিতে অন্যরকম আলো, মুখ পাঁশুটে হয়ে গেছে। মনে হয় আমার অনুমান সত্যি, হয়তো খুব জটিল কারণ আছে এসবের নেপথ্যে।

আমার খুব অপ্রস্তুত লাগে, দ্রুত কথা ঘুরিয়ে আমাদের ওয়ার্কশপের প্রসঙ্গে চলে আসি। ঘটমান বর্তমান আমাদের আর্ত অতীত আর অজানা ভবিষ্যৎ থেকে মুক্ত করে চেনা মাটিতে পা রাখতে সাহায্য করে।

পরেরদিন আমার চলে আসতে হয়েছিলো, আর কথা হয় নি। জানাও হয় নি কি ছিলো ওর ঐ তীব্র বিতৃষ্ণার নেপথ্যে। নানা কাজের ব্যস্ততায় আস্তে আস্তে ঘটনার স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। মণিদীপার কথা কিন্তু ভুলি নি।

Tuesday, March 8, 2011

দেশবিদেশের উপকথা-মালয়েশিয়া

সে এক ধনধান্যে ভরা দেশ, দুধমধুর দেশ। দেশের নদীতে নদীতে হ্রদে সরোবরে মিঠাজল, মাঠে মাঠে সোনার ফসল। বিশাল জমকালো রাজপ্রাসাদে লোকলশকর নিয়ে থাকেন রাজারাণী। তাদের একটিমাত্র সন্তান, একটি ছেলে।

সেই রাজপুত্র একদিন এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে বসলো, ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। সে দেখলো সে মাটিতে পড়ে আছে, তার বুক চিরে হাঁ হয়ে আছে, সেখান থেকে তার জ্যান্ত হৃৎপিন্ডটা ছিঁড়ে তুলে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পরমাসুন্দরী তরুণী, হৃৎপিন্ডটা তখনো দপদপ করছে আর তা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা তার গায়ের উপরে।

বাকী রাত আর ঘুম হলো না রাজপুত্রের। জানালার কাছে এসে বাইরে জ্যোৎস্নাশিহরিত উদ্যানের দিকে চেয়ে সে চুপ করে রইলো। মণিমাণিক্য ছড়ানো এই সুখপ্রাসাদের বুকের ভিতর থেকে অশ্রুত যে আর্তনাদ উপরে তারাদের দেশের দিকে চলে যাচ্ছে সে যেন চুপ করে শুনতে লাগলো সেই কান্না।

খুব ছোটোবেলার কথা রাজপুত্রের মনে নেই ভালো, আবছা মনে পড়ে অনেক দূরের এক অন্যরকম দেখতে দেশে ছিলো তারা। তারপরে বাবা এ দেশ জয় করে এই প্রাসাদে এসে উঠলেন। মাঝে মাঝে তার মনে হয় আগে এ প্রাসাদে যারা থাকতো তারা কোথায় গেল? কেমন ছিলো তারা? তারা কি কেউ আজও বেঁচে আছে? সে বুঝতো এসব জিগ্গেস করা মানা, কেউ কিছু বলবে না।

প্রথাগত নীতিতে শস্ত্র আর শাস্ত্রশিক্ষা করতো রাজপুত্র। কৈশোর পেরিয়ে মাত্র প্রথম যৌবনে পড়েছে সে এখন। আর কিছুদিন পরে তার যৌবরাজ্যে অভিষেক হবে। তারপরে বিবাহ। বাবামা সব ব্যবস্থা করছেন নিয়মনীতি মেনে।

রাজপুত্রকে শাস্ত্রশিক্ষা দিতেন যে বৃদ্ধ পুরোহিত, তাকে পরদিন সকালে সব খুলে বললো রাজপুত্র। পুরোহিত শুনে অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন তরুণ রাজপুত্রের মুখের দিকে, এরকমও হয়?

তারপরে তিনি বললেন রহস্যময় সেই কাহিনি, যে কাহিনি কানাকানি করে বেড়ায় দেশের আনাচেকানাচে। আগেকার রাজারাণীর সাতটি ফুলের মতন সাতটি শিশুকন্যা ছিলো। শত্রুর আক্রমণে যখন দেশ লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে তখন এক ডাকিনী যাদুবলে মেয়ে সাতটিকে সাতটি ময়ূরী করে দেয়। তারা গহন বনে উড়ে চলে যায়। তাদের বাবা যুদ্ধে মারা যায়, মা স্বামীর সঙ্গে মরণ বরণ করে স্বেচ্ছায়। সাতটি রাজকন্যা আজো ময়ূরী হয়ে আছে বনে, তাদের শাপমুক্তি বড় কঠিন। যদি সাতময়ূরীর মধ্যে একজন এক ঠোক্করে বুক চিরে ছিঁড়ে তুলে আনতে পারে নতুন রাজপুত্তুরের হৃৎপিন্ড তবে তারা শাপমুক্ত হয়ে আবার মানুষ হতে পারবে। তবে এসব বিশ্বাস না করাই ভালো, গল্পকথার কি আর কোনো মাথামুন্ডু থাকে?

সব শুনে তরুণ রাজপুত্রের হৃদয় কেমন যে করতে থাকে তা বলে বোঝানো যাবে না। সে কিছুই কিন্তু তখন বলে না বুড়ো পুরোহিতকে। শুধু চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে বসে থাকে।

তারপরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "ঠিকই তো, গল্পকথার কি কোনো মাথামুন্ডু থাকে? আর স্বপ্ন ও তো আসলে ছায়ার মতন, মায়া-মরীচিকার মতন, সত্যি করে তো কিছুই থাকে না তাতে। আসুন, শুরু করি আজকের পাঠ। "

সারাদিনমান নানা কাজে ব্যস্ত রাজপুত্র, সকালে শাস্ত্রশিক্ষার পরে মল্লযুদ্ধের আখড়ায় দুপুর পর্যন্ত। তারপরে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। তারপরে বিকালে আবার তীরন্দাজি।

সামনেই যৌবরাজ্যে অভিষেক, সেই আয়োজন চলছে পুরাদমে। রাজা নিজে তদারকি করছেন সেসবের। তীরন্দাজির খেলা থেকে ফিরে রাজপুত্র দেখলো তার জন্য পোশাকের মাপ নিতে এসেছে পোশাকনির্মাতারা, একধারে আবার মণিমুক্তা নিয়ে বসে আছে মণিকারেরা, অলঙ্কার তৈরীর আগে রত্ন পছন্দ করে দিতে হবে। রাণীমা নিজে তলব করে এনেছেন তাদের।

এতসব করে টরে বড়ই ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যাস্নান করে রাতের আহার করেই শয্যায় এসে ঘুমে এলিয়ে পড়লো সে। মনে মনে সে বুঝি বলছিলো --- আহা এসো, আমার মায়াময়ী এসো, "দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়, তোমার আপন হাতের দোলে।"

শেষরাতে আবার সেই স্বপ্ন, সেই ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত স্বপ্নের মধ্যেও রাজপুত্র দেখতে চেষ্টা করে মেয়েটার মুখ, সে মুখে কি উল্লাস না বিষাদ? কেমন ও চোখ, চোখের তারা? সে চোখে কি জল না হাসি? কে তুমি রাজকন্যা বনের ভিতর ময়ূরী হয়ে আছো তোমার বোনেদের সঙ্গে? এ জীবন্ত হৃৎপিন্ড উৎপাটিত করে না দিলে হবে না তোমাদের শাপমুক্তি? এ তুচ্ছ জীবনের বিনিময়ে যদি তোমরা সাতজনে বাঁচো, তাহলে---- কিন্তু কোথায় তোমরা, কেমন করে খোঁজ পাবো তোমাদের?

কিছু দেখা যায় না, সবকিছু নীল কুয়াশায় ঢাকা, ছায়া এসে ঢেকে দেয় রাজপুত্রের দৃষ্টি। স্বপ্ন ভেঙে যায়, বিছানা ছেড়ে উঠে রাজপুত্র বাগানে নেমে পড়ে। আকাশে অপার্থিব হাসি নিয়ে ভেসে আছে কৃষ্ণা প্রতিপদের চাঁদ।

পরদিন সকালে রাজপুত্র বললো সে অভিষেকের আগে সঙ্গীসাথী নিয়ে মৃগয়ায় যেতে যায়। অভিষেক হয়ে গেলে রাজ্যশাসনের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে তখন আর এভাবে তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

রাজা অনুমতি দিলেন, বন্ধুবান্ধবেরা উত্তেজিত, চারিদিকে মৃগয়ার সাজোসাজো আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আজ রাতেই জঙ্গলমহল কেল্লায় যাওয়া হবে, সেখানে রাত্রিবাস। পরদিন সকালে সেখান থেকে মৃগয়া শুরু হবে।

শিকারের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিজের নিজের প্রিয় ঘোড়ায় উঠে রাজপুত্তুর আর তার সঙ্গীসাথীরা রওনা দিলো, অন্যান্য মালপত্র নিয়ে লোকলশকর ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে কেল্লার দিকে।

সেই রাতে সঙ্গীসাথীরা সবাই মিলে একসাথে রাত কাটাচ্ছে কেল্লায়। কথা কি আর শেষ হয়? খানাপিনা কথাবার্তা হচ্ছে আর রাজপুত্তুর উসখুশ করছে আর ভাবছে আর বুঝি ঘুমানোই হলো না। না ঘুমালে মায়াময়ী তোমায় কোথায় পাবো? "ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে / বাঁশির ডাকে সকল বাধা খোলাও খোলাও খোলাও ---"

পরদিন সকালেই মৃগয়া শুরু। শিকারীবেশে রাজপুত্র তার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে, শিকারের পিছনে তাড়া করতে করতে ঘোড়া তাকে নিয়ে গভীর অরণ্যের দিকে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দলছাড়া হয়ে গেল তারা।

এখন শুধু অশ্বারোহী রাজপুত্র আর তাকে ঘিরে আদিম অরণ্যানী ফিসফিস করে কীযেন কইছে। আহা সুখপ্রাসাদের রাজপুত্র, কেন তুই ও ভাষা বুঝিস না? ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে, তার পায়ের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে দূরত্বের বাধা। রাজপুত্র মনে মনে বলে, স্বপ্নের মৃত্যুদেবতা আমার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?

সূর্য যখন প্রায় মধ্যাকাশে তখন ক্লান্ত ঘোড়া রাজপুত্রকে নিয়ে এলো এক পাহাড়ের পায়ের কাছে মস্ত এক সরোবরের তীরে। ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো রাজপুত্র, অঞ্জলি পুরে সরোবরের জল পান করে তৃষ্ণা দূর করলো।তার ঘোড়া ততক্ষণে কোমল ঘাসে মুখ নামিয়েছে।

সরোবরতীরে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ঝুরির পর ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। তারই উচ্চ সাতটি শাখায় বাস করে সাতটি ময়ূরী। প্রতিদিন ঠিক যখন সূর্য মাথার উপরে আসে তখন ময়ূরীরা কিছুক্ষণের জন্য মানুষমন ফিরে পায়। তারা সকলে যে যেখানে ছিলো সেখান থেকে উড়ে এসে বটের নিচের ডালে বসে, তাদের আর্ত মন সন্ধান করে সেই মানুষটির যার মৃত্যু তাদের শাপমুক্তি ঘটাবে। প্রতিদিন তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় কিন্তু তারা জানে একদিন সে আসবেই।

আজ সেই দিন এসেছে। জলপানে স্নিগ্ধ হয়ে বটের ছায়ায় এলিয়ে শুয়েছে রাজপুত্র, কোমরবন্ধ তরবারি ছুরি তীরধনুক সব খুলে রেখেছে বেশ দূরে। ঘুমের ভান করে রাজপুত্র দেখছে সাতময়ূরী নিচের ডালে এসে বসেছে। ঘুমের ঘোরের ভান করে সে বুকের উত্তরীয় সরিয়ে দেয়, তাহলে ঠোক্কর দিতে সুবিধা হবে ওদের। মনে মনে সে অস্থির হয়ে বলে, আরে তাড়াতাড়ি নামো না, দেখছো কী?

প্রথমে বড় বোন নামলো, কিন্তু ঠোক্কর দিতে পারলো না, চোখের জলে ভেসে গেল। ঘুমন্ত নিষ্পাপ তরুণের জীবনদীপ নিভিয়ে দিতে সে পারবে না। ফিরে গিয়ে সে পালকে ঠোঁট গুঁজে বসে রইলো।

একে একে দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া নামলো, দুজনেরই এক অবস্থা। পারবে না ওর বুকে তীক্ষ্ণ চঞ্চু বসিয়ে হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে আনতে, ও যে নিরপরাধ! এভাবে ওকে মারতে তারা পারবে না। তবে শাপমুক্তি? সে কি হবে না?

এবারে চতুর্থীর পালা। তার দিকে আশা নিয়ে চেয়ে আছে বাকীরা। সে আগে থেকেই কান্নায় একেবারে ঢেকে আছে, ডাল ছেড়ে এক পা নামবে না। কিছুক্ষণ তাকে সাধ্যসাধনা করে একে একে গেল পঞ্চম ষষ্ঠ সপ্তম ময়ূরী। কেউই পারলো না কাজ সমাধা করতে।

এবারে বারে বারে চোখ মুছে মন শক্ত করে চতুর্থী নামছে, এই শেষ আশা। ও না পারলে চিরকালের মতন শাপমুক্তির আশা শেষ। সকলের জন্য তাকেই নিষ্পাপের রক্তে কলুষিত করতে হবে নিজেকে।

নামতে নামতে সে নিজেকে বলে, তাই হোক। তাই হোক। হতভাগিনী, পারতেই হবে তোকে। অন্য উপায় নেই। দিদিরা বোনেরা অভিশাপ দিয়ে বলবে ওহ পাষাণী ওহ ডাইনী, কী করে পারলি তুই? তার আগে তুই মরলিনে কেন? চিন্তা নেই, মরা তো হাতেই রইলো। নিষ্পাপের জীবন শেষ করে এই কলুষিত জীবনের কী আর প্রয়োজন থাকবে? থাক, সকলে ভালো থাক।

ঠোক্কর দেবার আগে সে ভালো করে দেখে নেয়, স্বপ্নে কতবার এই তরুণ রাজকুমারকে সে দেখেছে, কোনোবার ভালো করে দেখতে পায় নি। এখনো দেখতে পায় না ভালো, চোখের জলে চোখ ঢাকা।

একটু দূরে রাজপুত্রের খুলে রাখা অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ধারালো ছুরিখানা রোদ পড়ে চকচক করছে। সেদিকে চেয়ে মনে মনে একটু হাসে মানুষমন পাওয়া ময়ূরী, মৃত্যুলোকের ওপারে দেখবো তোমায় রাজপুত্র, প্রাণ ভরে দেখবো, সেখানে অভিশাপ নেই প্রতিশোধ নেই বিরহ নেই প্রিয়বিচ্ছেদ নেই।

এক ঠোক্করে রাজপুত্রের বুক চিরে ফেললো সে, তীক্ষ্ণ চঞ্চু বসিয়ে হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে আনলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘটলো শাপমুক্তি সকলের, ময়ূরী চেহারা ছেড়ে তারা সাত রাজকন্যা হয়ে গেলো।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি, মৃত্যুছায়ায় চোখ ঢেকে যাবার আগে রাজপুত্র দেখলো অরণ্যজ্যোৎস্নার মতন অলৌকিক সুন্দরী রাজকন্যা, চোখের তারা মধ্যরাত্রির আকাশের মত নীল, চুল যেন তার রাতের মহাসমুদ্র, সেই পরমার হাতে দুলছে তার জীবন্ত হৃদয়। প্রায়শ্চিত্ত তবে হলো কি? আহা তুমি কেন কাঁদো রাজকুমারী, পিতার করা ঋণ তো পুত্রকেই পরিশোধ করতে হয়।

সাত রাজকুমারী অঝোরে কাঁদছে, রক্তে মুখ হাত ঢাকা মেয়েটি ছুটে গিয়ে রাজপুত্রের ছুরি তুলে নিয়ে নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিয়ে ঘ্যাঁচ করে টেনে দিলো খানিকটা। ওর হৃৎপিন্ডও ছিঁড়ে পড়লো বাইরে। নাও, এবারে শোধবোধ। খুনি হয়ে আমারও আর বেঁচে থাকতে হলো না আর বাকীদেরও শাপমুক্তি ঘটলো। এখন রাজকুমার আর রাজকুমারীর দেহ পাশাপাশি পড়ে আছে, আর ঘাসের উপরে পাশাপাশি পড়ে আছে দু'খানা দেহবিছিন্ন হৃৎপিন্ড, তখনও দপদপ করছে।

জীবনদেবতা সব দেখছিলেন, তিনি এই আশ্চর্য ছেলেময়ে দুটিকে দেখে একেবারে অবাক! তার সব হিসাবনিকাশ ওলোটপালোট করে দিলো এরা! মানবজাতির তবে তো এখনো আশা আছে!

তিনি এসে এদের পুনর্জীবন দিলেন, তবে বাঁচাবার সময় একটা ওলোটপালোট হয়ে গেল। রাজকুমারীর হৃৎপিন্ড রাজপুত্রের বুকে আর রাজপুত্রেরটা রাজকুমারীর বুকে বসিয়ে দিলেন জীবনদেবতা।

তারপরে আর কী? শুভদিনে শুভক্ষণে এই আক্ষরিক অর্থেই হৃদয়বদল হওয়া রাজপুত্তুর রাজকন্যায় বিয়ে হয়ে গেল, বাকী ছয় রাজকুমারীরও পাশের পাশের রাজ্যের ভালো ভালো রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।

সকলে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।

(শেষ)