Tuesday, February 24, 2015

উশীরস্রোতা

১।
সৃঞ্জয় বললো, " কী, কেমন লাগছে এখন ? "
ভোরের হাওয়া ঠান্ডা বেশ, আমি স্কার্ফটা গলায় ভালো করে জড়াতে জড়াতে হেসে বলি, " ভালো লাগছে। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসলে কালকে একটু বেশী আবেগের পাল্লায় পড়ে গেছিলাম। এখানে আসা যেন একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার, কে জানতো এভাবে এখানে আসা হবে? "
সৃঞ্জয় হাসে, আমি আরো চওড়া করে হাসি। কী আর করার আছে এখন? বিস্ময় এত বেশী যে কোনো কথা দিয়েই তা প্রকাশ করা সম্ভব না।নিজের বাচ্চাবয়সের কথা মনে হয়, তখন প্রত্যেকটা দিন এমন অমলীন বিস্ময়ে ভরে থাকতো, কী পালকের মতন হাল্কা ছিলো সেই জীবন!
এখানে দুপুরবেলাগুলো খুব গরম। তাই খুব ভোরবেলাতেই আমরা সেতু পার হয়ে এসেছি নদীর পশ্চিমে। এই নদীর বর্তমান নাম উশীত্থা। সুপ্রাচীনকালে এর নাম ছিল উশীরস্রোতা। সুগন্ধি উশীর তৃণ জন্মাতো এর তীরে। এখন নদীটা প্রায় শুকনো, বালি-বালি খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে সরু একটা জলস্রোত ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষায় উত্তরে ঢল নামলে নাকি জল অনেক বাড়ে, তখন গোটা নদীখাতটাই ভরে ওঠে। নদীর উপরে পাকাপোক্ত ব্রীজ, গাড়ী চলতে পারে। ও পথেই এসেছি আমরা। আমাদের সারথী এখানকার স্থানীয় একজন লোক, হোটেল থেকেই আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছে এই গাড়ী আর ড্রাইভারকে।
এখন আমরা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি নদীর পশ্চিমপারে। সামনেই নীল আকাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বাদামী, কালো, ধূসর বা বালিরঙ পাহাড়। ঋজু, উদ্ধত, কঠিন, শিলাময়, বৃক্ষবিরল পাহাড়ের সারি। এখানে জমিও খুব শুকনো, গাছপালা প্রায় নেই, মাঝে মাঝে একরকম কর্কশ ঘাস আর কন্টকগুল্ম দেখতে পাই।
কাছেই একটা ছোটো বাজারমতন, সেখানে পথের পাশের চায়ের দোকানে সবে উনুনে আগুন দিয়েছে। চা আর কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসি আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই এসে যায় চা, খাবার। সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছিল, চা খেতে খেতেই দেখি পাহাড়ের চূড়াগুলো সকালের আবীরলাল আলোয় রঙীন হয়ে উঠে উঠে তারপরে গোলাপী থেকে সোনালী হয়ে উঠলো।
খাওয়া শেষ হলে আমরা রওনা হই সমাধি-পাহাড়ের দিকে। সম্রাজ্ঞীর খোঁজে যেতে হলে ঐখানেই তো যেতে হবে। সমাধি পাহাড়েই পরজীবনের প্রাসাদ। কয়েক হাজার বছর আগে রাণী সপ্তাশ্বসুতা তৈরী করিয়েছিলেন নিজের আর প্রিয়জনেদের জন্য। পার্থিব জীবনের সামান্য সময়টুকুর পরে বিস্তৃত যে অনন্ত জীবনকে তাঁরা জানতেন, সেই জীবনের জন্য।
সেখানে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সেই সুপ্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সামনে। সপ্তাশ্বসুতা! মহারাণী, সম্রাজ্ঞী! সম্রাজ্ঞী নিজেকে বলতেন সূর্যসম্ভূতা। স্বয়ং সূর্যদেব নাকি নেমে এসে তাঁর পিতার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর জননীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে সৃজন করেছিলেন। প্রাচীরের চিত্রমালায় সেই মহাপবিত্র ঘটনার কিছু কিছু ব্যাপার নাকি খোদাই করে রাখা হয়েছে।
আসলে কেমন ছিল সে? কেমন করে সে ভাবতো, হাঁটতো, সাজতো, কথা বলতো? কেমন করে কাটতো তার গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত? কোনোদিন, সেই হাজার বছর আগে, তার কিশোরী বয়সে এইরকম কোনো সকালে সে কি তার কোনো চাহনেওয়ালার কথা ভাবছিলো? পুরানো পাথরের টুকরোয় কিংবা প্রাচীরে বা মেঝেয় আঁকা ছবিতে অথবা লেখা কাহিনিতে কি সময় আটকে থাকতে পারে? ধরা দিতে পারে পূর্ণ, সজীব, স্পন্দিত সেই হারানো জীবন? সেই মেয়েটিকে দেখতে চাই, সেই সূর্যসম্ভূতাকে। খুবই কি আশ্চর্য আর অন্যরকম ছিলো সে? একদম শৈশব থেকে ? নাকি সেই শৈশবে কৈশোরে আর পাঁচটা মেয়ের মতই সাধারণ ছিলো, পরে রাজত্বের দায়িত্ব আর রাজনৈতিক কূটকৌশল তাকে বদলে দিলো?
"শ্রমণা, কী হোলো? এতক্ষণ ধরে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছ না যে! " মনের ভুলভুলাইয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসি সৃঞ্জয়ের ডাকে।
বলি, "ডাকছিলে নাকি? আরে আমিও যেমন! কী যেন ভাবতে ভাবতে..... ডাকছিলে কেন? "
সৃঞ্জয় আমার হাত ধরে নিয়ে যায় পাথরের সিঁড়ির দিকে, প্রাসাদে ঢুকতে গেলে আমাদের উঠতে হবে সেদিক দিয়েই।
সৃঞ্জয় বলতে থাকে, " কেন এরকম বারে বারে বেসামাল হয়ে যাও? তুমি নিজে ইতিহাসের ছাত্রী, তোমার গাইড ডঃ প্রসাদ কতবার বলেছেন আবেগ মিশিয়ে ফেললে আর নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয় না? তুমি তবু কেন এরকম হয়ে যাও? এখানে এসে এইসব এলাহী কান্ড দেখে বেসামাল হবার কথা তো আমার! আমি তো ইতিহাসে পোড়খাওয়া লোক না। " সৃঞ্জয় হাসে, ওর হাসির সঙ্গে তাল দিতে আমিও হেসে উঠি।
সিঁড়ির কাছে এসে অদ্ভুত একটা ভয়ে আমার ভিতর-বাহির শিরশির করতে থাকে, অসহায় জ্বরগ্রস্তের মতন সৃঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলি, " আজ থাক। আমার শরীর কেমন করছে, মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো। "
সৃঞ্জয় আমাকে সাবধানে ধরে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে সিঁড়ির কাছ থেকে, বলে, "থাক তবে। কী হোলো তোমার? মুখচোখ একদম ছাইয়ের মতন দেখাচ্ছে। চলো, আজ ফিরেই যাই।"

আমরা এ শহরে এসেছি গতকাল। এখানে তিনদিন, তারপরে অন্য শহরে যাত্রা। পুরো ঘোরাঘুরির জন্য হাতে মোট পনেরোদিন আছে । অথচ কী তীব্র অস্থিরতা আমার ভিতরে ঘূর্ণী তুলছে ! মনে হচ্ছে যথেষ্ট সময় নেই। কোনোদিন আগে যে দেশ দেখিনি, কেন সেখানে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হয়? কেন পথের এক-একটা বাঁকে এসে চমকে উঠি, এ যেন চেনা!
কিন্তু তাতো হতে পারে না! সৃঞ্জয় বলে যে আমি খুব বেশীরকম কল্পনাপ্রবণ। ছোটোবেলা থেকে গল্প আর ইতিহাস পড়ে পড়ে সব মিলিয়েমিশিয়ে নাকি ঘেঁটে ফেলেছি! এরকম হলেই নাকি এরকম অচেনা জায়গা চেনাচেনা ঠেকে !
ফিরে আসি নদীর অন্য পাড়ে, ছোটো একটা দোকানে ঢুকে ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে জুড়াতে থাকি ক্লান্ত শরীর আর আলোড়িত অনুভবকে গুছিয়ে আনতে থাকি যথাসম্ভব। তারপরে মিউজিয়ামে যাই, আমাদের পরিচিত বন্ধু একজন আছেন সেখানে।
সন্ধ্যাবেলা রওনা হই সরাইয়ে ফেরার জন্য, তখন অন্ধকার বেশ গাঢ়। আকাশের দিকে চেয়ে আবার কেমন হয়ে যাই। মরুভূমির রাত্রি অপরূপ! একসাথে এত তারা, এত তারা! একেবারে ঝকঝক করছে! হাল্কা ওড়নার মতন দেখা যাচ্ছে ছায়াপথ। এরকম কবে দেখেছিলাম, কোনোদিন দেখেছিলাম কি? হয়তো দেখেছিলাম কোনোদিন।
হয়তো সে এ জন্মে নয়, হয়তো বহুজন্ম আগে যখন এই বালির টিলাগুলোর পাশ দিয়ে যে পথ চলে গেছে পাথরের সীমানা দেওয়া গাঁয়ের দিকে, সেই পথে হাঁটতাম। রঙীন ঘাঘরা-চোলি থাকতো আমার অঙ্গে, কাঁখে থাকতো কলস, সখীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে জল নিয়ে ফিরতাম ঘরে। মরুগোলাপের ঘ্রাণ আমাদের মনকে উচাটন করতো!
সৃঞ্জয়কে এসব বলা বৃথা, আমি নিজের ডাইরিতে এইসব লিখে রাখবো। বহু হাজার বছরের যবনিকা কি খুলবে? জ্ঞান উন্মেষের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষটাকে খুঁজছি আমি, তাকে কি পাবো?
বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে, একটা ছোট্টো বাড়ী, তার ছাদে উঠে চেয়ে আছি পশ্চিমের দিকে, পশ্চিমে খোলা ধানক্ষেত, আদিগন্ত আকাশ তার উপরে উপুড় হয়ে পড়েছে, সূর্যাস্তকালের রঙীন মেঘেরা চারিদিক রঙীন করে দিয়েছে, সন্ধ্যাতারাটি সবে চোখ মেলেছে। সেইসব সময়ে আমার মনে আসতো এক আশ্চর্য মানুষের কথা, কত হাজার মাইল ব্যবধান আর কত হাজার বছরের দূরত্ব থেকে আমার দিকে চেয়ে থাকতো তার দুটি গভীর কালো চোখ। রাতের স্বপ্নেও ফিরে ফিরে আসতো সে। কাউকে বলতে পারিনি তার কথা, কাউকে না। কী করে বলবো, আমিই কি জানতাম সে আসলে কে?
সৃঞ্জয় এসব বুঝবে না বা হয়তো ভুল বুঝবে, সেই আশঙ্কায় ওকে কিছু বলতেও পারছি না। সে এমনিতে আমার খুব ভালো বন্ধু, বন্ধুরও বেশি কি? বুঝতে পারি না। সে নিজে কী মনে করে আমাকে? বন্ধু? নাকি তার অনেক বেশী?

২।
রাতে হোটেলে ফিরে সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত সৃঞ্জয় অঘোরে ঘুমোচ্ছিলো। আমি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে ভাবছিলাম! ভাবনাগুলো যেন শত শত রঙীন সুতো, একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে ভয়ানক জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
তারপরে নিজেও শুয়ে পড়লাম । ঘুম আসে না। মনে পড়ে সৃঞ্জয়ের পাগলের মতন ভালোবাসার মুহূর্তগুলো। কিন্তু সেইসব মুহূর্তেও কেন আমার মন আলগা হয়ে যায়? কেন অজানা বিষাদ এসে জমে বুকের খুব ভিতরে?
আমার জীবনটা আর পাঁচজন মানুষের মতন সহজ সরল হলে কত ভালো হতো! কিন্তু তা নয় কেন? কেন ভিতরে বারে বারে জেগে ওঠে সেই রহস্যময় সত্তা? ভিতর থেকে ফিসফিস করে কী যেন বলে। একটা কী যেন সমাধান হওয়া বাকী আছে, সেটা সমাধান না হলে কিছুই হবে না।
নাইট ল্যাম্পের নরম হাল্কা আলো ঘরে, রুম ফ্রেশনারের মৃদু সুগন্ধ ভেসে বেড়ায় ঘরের বাতাসে। এইসবের মধ্যে চুপ করে চোখে চেয়ে শুয়ে থাকি, মনের ভিতরে কে যেন ডাকতে থাকে, আয় আয়। কে সে? কে ডাকে? কোথায় যেতে ডাকে? সপ্তাশ্বসুতার পরজীবনের প্রাসাদে? ক্লান্তি একসময় জয়ী হয়, দু'চোখ লেগে আসে।
চার ঘোড়ার রথে বসে আছেন এক তেজদীপ্তা মধ্যবয়সিনী নারী, সুশোভন বেশ তার, কিন্তু বস্ত্র রঙীন নয়, শুভ্র। দীর্ঘ গ্রীবায় মহার্ঘ্য রত্নহার। দুই কান থেকে দুলছে হীরকখচিত কর্ণাভরণ। মাথার দীর্ঘ কেশ জড়িয়ে তুলে চূড়া করে মাথার উপরে বাঁধা, চূড়া ঘিরে রত্নমুকুট। চোখে দীর্ঘ করে টানা কাজলরেখা। কিন্তু এইসব সাজসজ্জা অলংকার সব ছাপিয়ে উপচে পড়ছে সেই আশ্চর্য নারীর অকুন্ঠিত তেজের দীপ্তি, বোঝা যায় অনেক ক্ষমতার অধিকারিনী।
রথে এঁর পাশে বসে আছে এক কিশোরী, অদ্ভুত মায়া-মায়া মুখ তার, চোখে স্বপ্ন। এর বস্ত্রালঙ্কারের তত বাহুল্য নেই, শ্বেত বসন আর নীলাভ সাদা উত্তরীয়। গলায় ফুলের মালা। চুলগুলি জড়িয়ে তুলে ফুলের মালা দিয়ে বেষ্টন করে রাখা। এর হাতে পূজার থালি, সম্ভবত কোনো মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন এঁরা।
রথ চালাচ্ছে এক তরুণ, এর পরনে শ্বেতবসন, উর্ধাঙ্গে শুভ্র উত্তরীয়। এর মাথার চুলগুলো ক্ষুদ্র, সারা গায়ে কোনো অলংকার নেই দেখে মনে হয় বুঝি খুব সাধারণ সামান্য অবস্থার মানুষ। কিন্তু মুখচোখ দেখে তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধার মতন মনে হয়। এর চোখের মণি গভীর, যেন কীসের রহস্য সেখানে। এরই দিকে কেমন অদ্ভুত কোমল চোখে চেয়ে আছে কিশোরী মেয়েটি।
ভোরের নরম হাওয়া এসে লাগে গালে কপালে, ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নেদেখা কিশোরী মেয়েটি আর রথচালক তরুণ কিন্তু স্মৃতিতে তাজা হয়ে থাকে তখনো। কে ঐ মেয়েটি আর ছেলেটি? ওদের কেন চিনি চিনি মনে হয়? ওদেরই খোঁজে কি আসলে এসেছি এখানে? যা আমার সচেতন মন জানে না কিন্তু ভিতরের মন জানে? কোথায় পাবো ওদের? এই হাজার হাজার বছরের বিস্মৃতির ধূলা সরিয়ে কেমন করে বার করবো ওদের? আর বার করেই বা কী হবে? কোনো সার্থকতা কি আর থাকতে পারে এই এত হাজার বছর পরে?

৩।
আজ সপ্তাশ্বসুতার প্রাসাদ ঘুরে দেখে এসেছি সৃঞ্জয় আর আমি। এখনো আমাদের বিস্ময়ের রেশ ফুরায় নি। ফেরার পথে পুরোটা সময় ধরেই কেবল সেই হাজার বছর আগের মানুষের অতিমানুষিক কীর্তির কথাই বলাবলি করছিলাম দু'জনে। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সাহায্য ছাড়া ঐসব বিশাল বিশাল স্থাপত্য আর অতি উঁচুদরের ভাস্কর্য কী করে তারা করলো? এ আজও এক রহস্য আমাদের কাছে। আমাদের অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে যেন এক অনতিক্রম্য শূন্যতা, কোথায় যেন যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
বেলা তখনো ছিল অনেক। হোটেলে ফিরতে ভালো লাগলো না, বসলাম গিয়ে নদীর পাশে গাছের ছায়ায়। অনেক কথা বলার পরে আর অনেক বিস্ময়ের ঝলসানির পরে যেন ছায়ার নিচে একটুকরো শান্তি। ওপারে দেখা যাচ্ছিল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, মাঝে মাঝে টিলা। আমরা আর কথা বলছিলাম না, নদীর কলধ্বনি শুনছিলাম, নদীটা যেন আমাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছিল। সেই গানের মধ্যে করুণ এক সুপ্রাচীন কাহিনি শুনছিলাম আমি। নিজের অজান্তে কখন চোখ ভরে উঠলো জলে।
গাছের ছায়ায় ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো সৃঞ্জয়, মাথার নিচে নিজের ব্যাগখানা বালিশের মতন করে দিয়েছে। দিব্যি চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমি নিজেও গাছের কান্ডে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
হঠাৎ শুনি মধ্যরাত্রির প্রহর বাজলো কোথায় যেন, আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ উঠবে একেবারে শেষরাত্রে। অন্ধকারের ভিতর থেকে শুনি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, তার সঙ্গে মাটির উপরে কাঠের চাকার ঘর্ষণের শব্দ। একটা অশ্ববাহিত রথ আসছে, বেশ আস্তে আস্তে, চুপিচুপি। নদীর কিনারে ঝুপসি একটা গাছের নিচে এসে থামলো রথ, রথারোহী ও চালক বলতে একজনই ছিল। সে নামলো। নিবিড় নীল উত্তরীয়ে মাথা থেকে পা অবধি আবৃত তার। ঘোড়াটাকে রথ থেকে খুলে ঘোড়ার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে কী যেন বললো, মুক্ত ঘোড়াটা নদীতীরের তৃণভূমিতে নেমে গেল।
নিবিড় নীল উত্তরীয়ে আবৃত মানুষটি এইবার নদীতীর বরাবর চলতে শুরু করলো। বাদামী পাহাড়ের পায়ের কাছে নদী যেখানে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর-পূর্বে, সেইখানে এসে সে থামলো। পাহাড়ের গায়ের খাঁজগুলো সিঁড়ির মতন, খাঁজে খাঁজে সাবধানে পা রেখে সে উঠলো খানিকটা, এসে পৌঁছলো একটা পাথুরে চাতালে। চাতাল পেরোলেই একটা গুহামুখ, আলগা একটা পাথর গড়িয়ে এনে গুহামুখ বন্ধ করা হয়েছে।
মুখ ও মাথা থেকে উত্তরীয়ের আবরণ সরালো মানুষটা। এইবারে তাকে চিনতে পারলাম, সে ঐ কিশোরী মেয়েটি, আগে যাকে পূজা দিতে যেতে দেখেছিলাম। মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে সে এক অদ্ভুত শব্দ করলো, রাতপাখির ডাকের মতন সে আওয়াজ কিন্তু তার মধ্যে যেন মিশে আছে সাংকেতিক আহ্বান। একবার, দুইবার, তিনবার ডাক দিল সে। তিনবারের পর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ। উত্তর এলো তখন। ঠিক ওরকম আওয়াজ। পাহাড়ের অন্যদিক থেকে উঠে এলো আরেক মানুষ, মুখের ঢাকা সরাতেই চিনতে পারলাম, আগেরবারে দেখা সেই রথচালক তরুণ।
কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটিকে, তাদের সম্মিলিত মিষ্টি হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল রাত্রির বাতাসে। তারা গুহামুখের পাথর ঠেলে সরিয়ে গুহায় ঢুকে গেল। অন্ধকারে তারা দেখতে পায় নি শ্বাপদের মতন তীক্ষ্ণ দুটি চোখ তাদের লক্ষ করেছে, রাজার নিয়োগ করা গুপ্তচর। অন্ধকারে মিশে থেকে সে অনুসরণ করেছে একদম শুরু থেকে। নিঃশব্দ দ্রুতগতিতে পাহাড়ের কাছ থেকে রাজবাড়ীর দিকে দৌড়ে চলে গেল সেই গুপ্তচর।
" শ্রমণা, শ্রমণা! " – কে যেন কাঁধে নাড়া দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখি সৃঞ্জয়, সে জেগে গেছে। আমায় জাগাচ্ছে। সবটাই স্বপ্ন ছিল। মাথা তুলে দেখি বেলা পড়ে আসছে, ছায়া দীর্ঘ হয়েছে। এবারে হোটেলে ফিরতে হবে আমাদের।
উশীরস্রোতার দিকে এগিয়ে গেলাম, জলে হাত ডুবিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, "আসি।" নদী কলস্বরে কী বললো কেজানে! এমন কত মানুষ এসেছে, কত গেছে, নদী কাকেই বা মনে রেখেছে !
আমরা ফিরে চললাম পান্থনিবাসের দিকে। আগামীকাল দুপুরে আমাদের অন্য শহরের দিকে যাত্রা। নদীটাকে হয়তো আর ছোঁয়া হবে না। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালাম, কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ ডাকছিল। মনের ভুল নিশ্চয়। সেই রহস্যময় মানুষটাকে কোথাও কি খুঁজে পাবো কোনোদিন? নাকি সে আমার নিজের মনের বানানো গল্প একটা? সবটাই কল্পনা?

৪।
হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছিল কিন্তু আমার একটুও খিদে ছিল না। খানিকক্ষণ সাধাসাধি করে সৃঞ্জয় একাই গেল ডিনার খেতে। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম এক গেলাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে।
আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন। ওদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে দু'চোখ। আবার দেখি সেই কিশোরীকে, আজকে সে সাদাসিধে পোশাকে না, আজকে তার জমকালো রাজকীয় পোশাক, সর্বাঙ্গে হীরামণিমুক্তার অলঙ্কার ঝলকাচ্ছে। আজ তার রাজ্যাভিষেক। তার নাম ছিল হেমা, কিন্তু আজ থেকে সে আর হেমা নয়, তার পূর্বজীবন মুছে গেছে, আজ থেকে সে সূর্যসম্ভূতা সপ্তাশ্বসুতা। কিন্তু ওর দীপ্ত কালো চোখের মণির গভীরে দেখি টলটলে জল, যেন উশীরস্রোতা বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সেখানে আগুনও জ্বলে ওঠে।
স্বপ্নের মধ্যে ছুঁতে পারি হেমার বেদনাস্পন্দিত হৃদয়, সেখানে থেমে আছে আছে সেই তরুণের নিথর মুখ, বুকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। হেমা সেই রাত্রে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরে নিজের শয্যায় ঘুমিয়েছিল। সকালে পরিচারিকা ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিল। রথচালক সুষীম নিহত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ পৌঁছালো রাজবাড়ীতে, রাজ আদেশে আর সকলের সঙ্গে হেমাকেও দেখতে হলো সুষীমের মৃত মুখ।
হেমা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু, কাউকে কিছু বলতে পারলো না, কাঁদতে পারলো না, কোনোরকম শোকপ্রকাশ করতে পারলো না। সামান্য রথচালকের মৃত্যুর জন্য রাজকুমারীর শোকপ্রকাশ কীসের? শুধু তার বুকের ভিতর সব ভেঙে পড়ছিল, সে বুঝেছিল রাজা নিজেই লোক লাগিয়ে হত্যা করেছেন সুষীমকে, হয়তো রাজকুমারীর সঙ্গে ওর গুপ্তপ্রণয় জানতে পেরে গেছিলেন। কিন্তু কন্যাকে কেন অব্যাহতি দিলেন? কেন তাকেও হত্যা করলেন না?
তারপরে রাজকীয় মর্যাদায় অন্তেষ্ট্যিও হয়ে গেল সুষীমের। সুষীমের শোকাহত বাবা-মা চলে গেলেন তীর্থযাত্রায়, রাজকোষ থেকেই নাকি খরচ দেওয়া হয়েছিল।
সেইসব এই অভিষেকের আটদিন আগের কথা। আজ সপ্তাশ্বসুতা যৌবরাজ্যে অভিষিক্তা হচ্ছে। কিন্তু সে জানে হেমা এখানে নেই। হেমাকে এরা স্বর্ণশিকলে বাঁধতে পারে নি। সে একা একা একা চলে গেছে, দূর থেকে আরো দূরে, জন্মজন্মান্তর ধরে সে সুষীমকেই খুঁজবে। "সুষীম, সুষী-ঈ -ঈ ম!"
কলিং বেল বাজছে, আচ্ছন্ন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। শ্লথ পায়ে এগিয়ে যাই দরজা খুলতে, সৃঞ্জয় ফিরলো বুঝি।

৫।
হাতে একটা ছোট্টো আলো, চাবির রিঙ এ আটকানো আলো। সুইচ অন করতে উৎস থেকে আলো বেরিয়ে পাথুরে দেয়ালে একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছে, আলোকবৃত্তটি ঘিরে ছায়াবৃত্ত, তাকে ঘিরে আবার একটা হাল্কা আভার বৃত্ত, এইভাবে পর পর কয়েকটা আলো আর ছায়ার রিঙ এর পরে আবারো নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।
অদ্ভুত একটা পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, চারিদিকে পাথরের রুক্ষ দেয়াল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরের পৃথিবীতে এখন দিন না রাত্রি? কেজানে! কখন এসেছি এখানে? তাও মনে নেই। আর কত পথ বাকী? কেজানে!
শুধু মনে পড়ে শেষরাত্রির ঠান্ডা বাতাসের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি নদীর দিকে, তারাগুলো দপদপ করছে মাথার উপরে। চলতে চলতে একসময় নদী পেলাম, নদীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলাম, কে যেন ফিসফিস করে আমায় পথনির্দেশ দিচ্ছিল। আমার কোনো ভয় ছিল না, কোনো দ্বিধা ছিল না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব শেষ হবার পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।
বেরিয়ে পড়ার আগে একটা ছোটো চিঠিতে সৃঞ্জয়কে জানিয়েছি যে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় সজ্ঞানে নিরুদ্দেশে যাচ্ছি, সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। চিঠিটা টেবিলে রেখেছি গেলাস চাপা দিয়ে। সকালে উঠেই দেখতে পাবে ও।
মনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো ক্লান্ত হয়ে এলো, তারপরে দেখি নদীটা একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে আর সামনে সেই পাহাড়, ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম। পাহাড়ের গায়ের খাঁজে হাত পা রেখে রেখে উঠলাম চাতালে, সত্যিই একটা পাথুরে চাতাল ছিল আর তার সামনে ছিল সেই গুহা। গুহামুখে পাথর চাপা ছিল না।
মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করে আলোটি জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখলাম ধাপে ধাপে সিঁড়ি চলে গেছে, কখনো নামছে কখনো উঠছে। কখনো ঘুরে ঘুরে চলছে পাথুরে সিঁড়ি আর সিঁড়ি। চারিপাশে পাথরের দেওয়ালে কোথাও আর্দ্র জলধারা কোথাও রঙীন ক্রিস্টাল জ্বলজ্বল করে উঠছে আলো পড়ে, কোথাও অদ্ভুত সব নীল লাল সবুজ চিত্রমালা।
কোথা থেকে কে যেন ডাকে আমায়, ভাষাহীন, শব্দহীন সেই অমোঘ আহ্বান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার। আমি চলতে থাকি, চলতে থাকি। হাজার হাজার বছরের বিরাট শূন্যতা, অতলস্পর্শী বিরহ-হাহাকার আমার পায়ের নিচে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে। সময়হীন এক অমৃতলোকে দাঁড়িয়ে আছে জরাহীন, মৃত্যুহীন, বেদনাহীন এক তরুণ, অপূর্ব বিভা ঘিরে আছে তাকে।
চলতে চলতে নির্মোকের মতন খসে পড়ে যায় আমার সমস্ত বসন-ভূষণ-পরিচয়-ভাবনা-ঘরদুয়ারস্মৃতি। অদ্ভুত ফুলের গন্ধ এসে লাগে নাকে, অনুভব করি আমার অভূতপূর্ব কুন্ডলিত কেশভার বিচিত্র কবরীতে বাঁধা, তার উপরে জড়িয়ে আছে সুগন্ধী পুষ্পমালা। আমার পরনে সুবর্ণখচিত বস্ত্র, উর্ধাঙ্গে কঞ্চুলী ও উত্তরীয়। সেই সহস্র বৎসর আগে যেমন ছিল।
হাতের আলো কখন খসে গেছে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, সব দেখতে পাচ্ছি বিচিত্র এক আলোতে। অক্লান্ত চরণে চলতে থাকি, চলতে থাকি, মনে মনে বলি, " আমি আসছি, আমি আসছি, সুষীম, আমি আসছি। "

*******