Friday, June 19, 2009

অগ্নিজাতক

1
অগ্নি ছিলো সূর্যে, আকাশে বিদ্যুতে, জীবন্ত আগ্নেয়শৈলের জ্বালামুখে, অরণ্যে দাবানলে ও সমুদ্রে বাড়বানলে। কিন্তু সে ছিলো না হিমকন্থা প্রস্তরগুহায়, ছিলো না বৃক্ষচারী প্রায়মানবের সন্নিধানে। তীব্র শীতপ্রবল উত্তরী অক্ষের দেশে ছিলো কুয়াশা, ছিলো নিষ্ঠুর তুষারঝঞ্ঝা ও হিমজমাট প্রান্তর। হিমকন্থা প্রায়মানবেরা অগ্নিকে আহ্বান করেছিলো ভাষাহীন চিত্কৃত প্রার্থনায়।

সুদূরে দক্ষিণ সমুদ্রের দেশের ধীবরী, তরল অন্ধকার ছড়িয়ে আসা সন্ধ্যায়, সাগরবেলায় চেয়ে আছে পশ্চিমে, সেখানে জল লোহিতবর্ণ হয়ে ছলচ্ছল করছে। ঐ তীব্র লোহিত বর্ণ, জননী গর্ভোত্সারিত রক্তধারার মত জীবন্ত মনে হয়। ঐ অমৃতের সমুদ্রে অবগাহন করেই কিনা সূর্য প্রতিদিন নবজাত হন!

হে দ্যুলোকের দেবগণ, ঐ দিক দিগন্তরে ছড়ানো অসংখ্য দ্বীপমালার কোনটিতে হবে আমার গন্তব্য? কোথায় আছে সেই লোহিত সমুদ্রের দুয়ার? অনন্ত জীবনের ঝর্ণা?

অনুকূল সমুদ্রস্রোতে তরী নিয়ে এসে পড়ে ধীবরেরা,তাদের জালে মত্সের ও কূর্মের ভীড়। সমুদ্রবেলায় দ্রুত বন্টনের শেষে ওদের ফিরে যেতে হবে ঘরে।

এখানে পর্বতসানুতেও বেলা পড়ে আসছে, নদীতীরের বালুচর স্বর্ণপ্রভ। শিকারজীবীরা দিনের শেষজল পান করে ফিরে যাবে মৌচাকের মতন গুহাসমূহে। ইন্দ্রনীলপ্রভ মেঘ ঘনায় এ উপত্যকা জুড়ে, সন্ধ্যা-আকাশ বয়ে আনছে কি অদ্ভুত অনাস্বাদিত বার্তা। কিছু একটা ঘটতে চলেছে, এই হলুদ বালুচরবর্তী ভাষাহীন প্রায়মানবেরা অনূভূতি দিয়ে বোঝে, কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না সেটা কি।

নারী ও পুরুষ ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গুহামুখে, শিশুরাও উন্মুখ। সিংহের মতন সুকেশর মেঘেরা আকাশে খেলা করে বেড়ায়, শোঁ শোঁ ঝড়ো বাতাসে উড়তে থাকে শুষ্ক পত্রসম্ভার। দক্ষিণ পশ্চিমে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ। আকাশের অগ্নিদেবতা। পাবক-অভিলাষী মানবকের জন্য এইবারে তিনি আসবেন, আসবেন এইখানে, এইখানে, এইখানে।

স্বেদবিজড়িত চকিত নিদ্রাভঙ্গে চমকে উঠি, কে আমার হাত ধরে আছে? এইহাতের উপর এইমাত্র ছিলো তপ্ত অগ্নিস্পর্শ, চরিতার্থকামা নারীর মরচক্ষুতে স্পষ্ট হয়েছিলো পাবকের নখবিলিখন। সে কোথায় গেল? এইখানে এইখানে এইখানেই তো ছিলো,এইমাত্র, এই মুহূর্তেই।

প্রৌঢ় হয়ে আসা সঙ্গীর বলিরেখাময় মুখে আর রূপ নাই, পরিণতিও নাই। কালের অমোঘ হস্তাবলেপে মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষয়ে যাই আমরা, ঝরে যাই, ক্ষয়ে যায় আমাদের সব স্বপ্ন ও যন্ত্রণা। সব তাপ নিভে আসে আস্তে আস্তে।

বিছানা বালিশে মেঝেতে শয্যায় ছড়িয়ে পড়ে থাকে আমাদের অগণিত মর্ষনজাত ও ধর্ষণজাত সন্তানেরা। নানা আকৃতির ও চেহারার নর ও নারীরা। ঘুমন্ত ও আধাঘুমন্ত। কেউ কেউ জাগ্রতও। কেউ শুয়ে থাকে শিথিল একটি দীর্ঘ দন্ডের মতন, কেউ গুটিয়ে গোল হয়ে গর্ভস্থ শিশুর মতন, কেউ এলোমেলো একগোছা খড়ের মতন।

কিন্তু ঐ অনন্ত অগ্নি? ঐ অন্তহীন জ্বালামুখ? কোথায় প্রচ্ছন্ন হয়ে আছো ছদ্মবেশী? কোথায় কিসের আবরণে ঢেকেছ লেলিহজিহ্বা তোমার? কামার্তা মানবীকে এইমাত্র লেহন করে গেছ যা দ্বারা?


2
একটি উচ্চ ঢিবির মতো এখানে। ক্লান্ত যোদ্ধা সেই ঢিবিতে উঠলেন। কেন যে এখনো ভারী অস্ত্রটি তিনি সঙ্গেই নিয়ে যাচ্ছেন কে জানে! কোনোক্রমে টানতে টানতে তিনি ঢিবির উল্টাদিক দিয়ে নেমে গেলেন। তারপরে প্রায় ছুটতে লাগলেন। আ:, এত তৃষ্ণা কেন? কেন এখনো এইসব বোধগুলি তাকে ছেড়ে যায় না?

উপত্যকা অতর্কিতে নেমে গেছে নীচে। সেখানে টলটল করছে হ্রদের জল। ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত যোদ্ধা তাকিয়ে থাকেন সেইদিকে। তারপরে প্রথমে তার অস্ত্রটি ফেলে দেন জলের কিনারে, পরে নিজে নেমে আসেন পাথরে সাবধানে পা রেখে। তারপরে জলের মধ্যে প্রায় লুটিয়ে পড়ে আকন্ঠ পান করেন সেই ঠান্ডা, স্নিগ্ধ জল। আ:।

বৌ ষট্ বৌ ষট্ বৌ ষট্ --অসংখ্য ঘোড়ার পায়ের শব্দ পাই, ধূসর ও গৈরিক প্রান্তর জুড়ে তাদের হিল্লোলিত দেহভঙ্গী, শস্যময় হরিত্ দুধমধুর দেশের দিকে আরোহীদের যাত্রা, তাদের জ্বলজ্বলে কঠিন চক্ষে বিপুল তৃষ্ণা। অল্পস্তন্যে পৃথিবী তাদের ক্ষুধার্ত করে রেখেছে। তাই তারা খুঁড়ে নিয়ে আসবে পাতালের ধনরত্ন, আকাশের রৌদ্রজল, বাতাসের গতি ও প্রাণের লাবণ্য। বিপুল প্রস্তরস্তূপ অতি জটিল ও সূক্ষ্ণ হিসাবের দ্বারা একটির উপর আরেকটি চাপিয়ে মন্দির তৈরী হবে মরুবালুরাশির উপরে, কৃত্রিম পর্বতের মতন এর উচ্চশীর্ষ ভেদ করে যাবে আকাশে ভাসমান মেঘসমূহ।

3
কত নক্ষত্র নিভিয়া গিয়াছে, কত নক্ষত্র জ্বলিয়াছে নূতন! পৃথিবীর প্রেমনত চক্ষে দূর দূরান্তের আলো এসে লাগে, ক্রমশ আরো আরো কল্পপূর্বের আলো, যখন পৃথিবী ছিলো না, সূর্য ছিলো না, বিপুলা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ স্বপ্নবৎ লুকাইয়া ছিলো কোন্ জটিল গণিতের গোলোকধাঁধায়, সেই আদিযুগের আলো এসে পরশ করিয়া যায় পৃথিবীকে। সেই আদি অগ্নির তাপ ফুরাইয়া যায় নাই, রহিয়া গিয়াছে আজও।

হে পাবক, হে পবিত্র অগ্নি, জাতবেদা হুতাশন, আমার জন্মমরণ চরিতার্থ করিয়া বাজিয়া ওঠো,ঐ ফুলের আগুন যে নীল দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে, ঐ তীব্র আকাংক্ষার সন্তানেরা যে প্রশান্ত সমুদ্রের কিনারে নামিয়া গিয়াছে তটপঙ্ক অতিক্রম করিতে করিতে, সেইখানে একই বিন্দুতে যখন তুমি আমি ও এই মহাজগৎ একীভূত হইয়া ছিলো, সেইখানে, ঠিক সেইখানে। এতটুকুও কি সরিয়াছে সেই ব্রাহ্মবিন্দু ও সেই অনাদ্যন্ত ব্রাহ্মমুহূর্ত? অনি:শেষ ও অনবরত অনাবৃত অথচ চিরকাল দূরে সরিয়া যায়?

জ্বলুক জ্বলুক তোমার দীপ্তিঢালা সুধা, ঐ শিখায় ধন্য হৌক এই নশ্বরতার সমস্ত আর্তি বেদনা দু:খ ও সুখ। এসো, সর্বাঙ্গ লেহন করো, চির চরিতার্থ হৌক এই পৃথিবীবদ্ধ হিয়া।

আমারা একে অপরে নিহিত ছিলাম আদি অগ্নির স্বপ্নে, তখনো সে তাপ তীব্রভাবে অস্তিত্ববান, প্রথম তিন মিনিটের সমস্ত আলোড়ন বিদারণ শরণ ও বিশরণ এর পরে সৃষ্টিমুখী মথিত সমুদ্রের মতন শান্ত ও পরিপ্লুত।

সুবোধ্য দুর্বোধ্যতার সীমা পেরিয়ে যাও ধ্যানের মধ্যে, হে শুদ্ধশীল। দেখতে পাচ্ছ কি নীল স্নিগ্ধতা? বুঝতে পারছ কি সীমাহীন অন্তহীন রাত্রির গভীর প্রসন্ন মণিময় আহ্বান? পদ্মের পাপড়িগুলি অদৃশ্য, নিহিত মণিগুলি ঝলমল করছে জ্যোতিকণিকার মতন। "ওম্ মণিপদ্মে হুম।"

গভীর স্বরে বেজে উঠছে সুরেলা ঘন্টা, পার্বত্য বিহারটির হৃদয়োত্সারিত মন্ত্রাঞ্জলির মতন। শুদ্ধশীল, এসো আমরা ওখানে যাই। এখন ঊষালগ্ন, ভারী পবিত্র এখন সবকিছু, প্রকৃতি এখন গায়ত্রীগান গাইছে।

ঐ দ্যাখো উচ্চশীর্ষ সরল গাছগুলি পর্বতগাত্রে, উর্ধমুখ মৌন। গভীর ধ্যানরাত্রির শেষে চক্ষু মেলে উদয়দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে। ভূলোক ভূবলোক ও স্বর্লোকে আলোর শঙ্খ বাজছে, শুনতে পাচ্ছ কি?

হে বরেণ্য সবিতা, সেই আলোর রথ আসুক এইখানে এইখানে এইখানে। ঠিক এই হৃদয়ের মাঝখানটিতে, এই চেতনার পদ্মকোষে, এই মর্মরিত মন-অরণ্যের লুক্কায়িত বৃক্ষবাটিকায়।



4

সেই মাতৃস্বরূপা স্তন্যদায়িনী তটিনী। তীরবর্তী হলুদ বালুচরে, সেই পর্বত কন্দরবাসী মানবের ত্রস্ত অস্তিত্বের সম্মুখে তিনি এসেছিলেন। আজও যেমন আসেন, মুহূর্তে মুহূর্তে। অনভিজ্ঞ অপ্রস্তুত প্রায়মানবের সম্মুখে অতর্কিতে এসেছিলেন তিনি।
বজ্রপাতে জ্বলে উঠলো শুষ্কমৃত বৃক্ষ। অট্টহাস্যে আকাশ কাঁপিয়ে দিলো তীব্র রক্তরঙ অনল। লেলিহজিহ্বা পাবক আকাশ লেহন করতে উঠলো। শুদ্ধশীল, আমরা এগিয়ে গেলাম। অগণিত সময়খন্ডকে পার হতে হতে। উত্তপ্ত হলকা আমাদের ললাট নেত্র নাসা মুখ বাহু হদৃয় উদর জননেন্দ্রিয় উরু ও চরণ স্পর্শ করে করে থামতে বললো, সহজাত ভয়ানুভূতি আমাদের পায়ে পায়ে বাধার মত জড়িয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু আমরা তথাপি থামলাম না। অগণিত অতীত-আত্মা কানফাটানো অভিশাপে জর্জরিত করতে লাগলো আমাদের শ্রবণাতীত শ্রবনেন্দ্রিয়, কিন্তু তাও আমরা থামলাম না। ঐ পাবকশিখা হয় আমাদের দগ্ধ করে দিক, নাহয় আমরা ওকে নিয়ে আসি আমাদের প্রাণের দক্ষিণ বাতায়নে। অগণিত দৈত্যদানব বাধা দিলো, অসংখ্য আমরা মরে মরে ছাই হয়ে যেতে লাগলাম। ভস্মসাৎ হয়ে যেতে লাগলাম । ফের জন্ম নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাদের হাতের শুদ্ধ বৃক্ষশাখায় তাকে আনবোই আনবোই আনবোই আমরা।

সে এলো, দক্ষিণাগ্নি হয়ে জ্বলে উঠলো অগ্নিমন্দিরে, যজ্ঞস্থলীতে। আমরা সমিধ ও ঘৃত দ্বারা উপাসনা অব্যহত রাখলাম। সে প্রদীপ হয়ে দূর করে দিলো অন্ধকার, প্রথমে বাইরের, ক্রমে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরের।

কিন্তু শুদ্ধশীল, শেষ পর্যন্ত এ কোথায় এলাম? মঞ্জরিত বোধি দেখতে প্রার্থনা করেছিলাম আমরা,আলোর তরু, পরম আলো।
তাই কি দেখলাম? হে আলোর ঈশ্বর, এ কি দেখলাম?

দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত মহা বালুরাশি। মহাবিস্তৃত মরুভূ। এই মরুতে শ্বেতবালুকা। এই নির্জন মরুতেই আমাদের অগ্নিবৃক্ষ পাতাল ও গভীর অতল হইতে উত্থিত হইয়া সপ্তস্বর্গ লেহিতে জিহ্বা প্রসারিত করিল। রোষরক্তিম প্রলয়মেঘের ছত্রাককুন্ডলী দেখিয়া আমাদের চেতনা স্থবির হইয়া গেলো। অসহনীয় উত্তপে মরুবালুকা স্ফটিক হইয়া গেলো।

সুদূর অতীতের সেই প্রথমাগ্নির পবিত্রলগ্নে যে অন্ধকার জলীয় দানব আমাদের অগ্নিসম্মুখে ভয়হীন হইতে দেখিয়া অভিশাপ দিয়াছিলো, প্রচন্ড নিষ্ঠুর বাধা দিয়াছিলো, সে উচ্চন্ড হাসিতে হাসিতে সহসা কান্নায় শতধা হইয়া গেলো। মিহিন বৃষ্টি নামিলো আকাশ হইতে।

জ্বলিয়া উঠিলো প্রলয় অগ্নিবৃক্ষ বারে বারে,উত্তরে দক্ষিণে, পুবে পশ্চিমে। অসংখ্য সমুদ্রবেলা স্ফটিক হইয়া গেলো। অসংখ্য মরু অপেক্ষা করিতে লাগিলো স্ফটিক হইবে বলিয়া।

অনন্ত জীবনের ঝর্ণার রক্তিম উত্স আবিষ্কার করিতে চাহিয়াছিলো যে ধীবরী, তাহার পথ নির্দেশক নক্ষত্র শত টুকরায় ভাঙিয়া জলরাশির নিম্নে ডুবিয়া গেলো। অগ্নিবৃক্ষ থামিলো না, ক্রমশ আরো আরো সবুজ গ্রাস করিতে লাগিলো ক্ষুধার্ত ব্যয়ত আননে। বারে বারে তাহার নির্মম করোটিচিহ্নিত পতাকা জ্বলিয়া উঠিলো সাগরে ভূধরে দ্বীপে দ্বীপান্তরে।

5
শুদ্ধশীল, সুদূর কপোতকূট গিরিবাস হইতে কবে অসিবে সেই শ্বেতপক্ষী, ডানায় নতুন আলো লইয়া? আমাদের মুক্ত করিবে অন্তহীন মৃত্যু হইতে?

পর্বতারোহণে ক্লান্তি আমার দু'পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শৈবালের মতন। শুদ্ধশীল হাত বাড়িয়ে আমার হাতটি ধরলেন। ঘন্টার শব্দ শান্ত হয়ে গিয়েছে, পর্বতে নতুন সূর্যের অলো ঝলমল করছে। একটি অফুরান চুম্বনের মধ্যে মিলে যেতে যেতে আমরা অনুভব করলাম, অগ্নি, জল, মৃত্তিকা,শিলারাশি, অনিল ও ব্যোম, বিঘূর্নিত মথিত আলোড়িত হতে হতেও এক এক একই।

অভ্যন্তরে সেই শুদ্ধ অগ্নির তাপ অনুভবই আমাদের শেষ সসংজ্ঞ স্মৃতি।