Tuesday, July 22, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২১)

জীবনের উৎপত্তি বা ওরিজিন অব লাইফ ব্যাপারটা বেশ জটিল। সৌরজগতে এতগুলো গ্রহ,উপগ্রহ-তার মধ্যে শুধুমাত্র এই পৃথিবী গ্রহটাতেই(কেউ কেউ যুক্তিনির্ভর অনুমান করে বলেন মঙ্গল গ্রহে বা বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় অথবা শনির উপগ্রহ টাইটানে প্রাণ থাকলেও থাকতে পারে, তবে সেসব প্রমাণিত নয় এখনও, এখনও অবধি কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় নি ) এত রকমের প্রাণ, জলে স্থলে বাতাসে প্রাণে প্রাণে ছয়লাপ, আণুবীক্ষণিক জীব থেকে শুরু করে বিরাট বিরাট সব মহামহীরুহ ধরনের জীব, সবই এইখানে।

কিন্তু শুরুতে তো এরকম ছিল না। প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরী হয়েছে সৌরজগতের আর সবকিছুর সঙ্গে, তখন পরিবেশ ছিল একেবারেই অন্যরকম। শুরুর থেকে প্রথম একশো কোটি বছর কোনো প্রাণের চিহ্ন ছিল না দুনিয়ায়, সবচেয়ে পুরানো যে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে ফসিল রেকর্ডে, সে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি বছরের পুরানো। সরল প্রোক্যারিওটিক ধরণের জীবকোষের ফসিল সেসব। কিন্তু সেও পরম আশ্চর্য ব্যাপার, কী করে জড় পাথর জল গ্যাস ধূলা থেকে তৈরী হলো এমন জিনিস যা কিনা নিজের প্রতিলিপি তৈরী করতে পরে? তারপরে ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর জীবকোষের চিহ্ন পাওয়া যায়, জীবজগৎ বিবর্তনের পথে এগিয়ে গিয়েছে জটিলতার দিকে, একসময় তৈরী হয়েছে ইউক্যারিওটিক জীবকোষ, যা দিয়ে আমরা তৈরী।

কিন্তু শুরুটা হলো কেমন করে? এই নিয়ে বহু তত্ত্ব আছে, কেউ বলেন পৃথিবীতেই হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া,মিথেন, জলীয় বাষ্প এইসবের সংযোগে নানারকম জৈব বস্তু তৈরী হয়েছে, তারপরে তার থেকে ক্রমে জীবকোষ। কেউ বলেন জৈববস্তু সরল প্রাণকোষ সবই অন্যত্র তৈরী হয়েছে, উল্কাখন্ডের মাধ্যমে এসে পড়েছে আদিম পৃথিবীতে, তারপরে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নানাভাবে বিবর্তিত হতে হতে জৈববৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

এইসব কিছু তথ্য এখন পাওয়া যত সহজ তখন সেই নেট-পূর্ব সময়ে কম্পিউটার পর্যন্ত না চেনা আমাদের পক্ষে পাওয়া চিন্তারও বাইরে ছিল। তথ্যসূত্র বলতে জীববিদ্যার উঁচু ক্লাসের কিছু বই, কিছু ম্যাগাজিনের কিছু প্রবন্ধ ইত্যাদি। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরীও ছিল বলতে গেলে প্রায় বন্ধই। বইয়ের সংগ্রহও সেখানে খুবই সীমিত ছিল।

যাই হোক, এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অন্বেষা তৈরী হতে শুরু করলো, ওর আগ্রহ দেখে আমাদের এক দিদিমণি , অরুণিমাদি- উনি মাধ্যমিক স্তরে পড়াতেন ফিজিকাল সায়েন্স আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কেমিস্ট্রি, তিনি উৎসাহিত হয়ে ওকে কিছু কিছু সাহায্য করতে লাগলেন। সেও যৎসামান্যই। আলাদা করে এসব করানোর মতন ব্যবস্থা বা সময় কিছুই আমাদের স্কুলে ছিল না।

নির্দিষ্ট দিনে অরুণিমাদি আর আমাদের স্কুলে নতুন শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেওয়া বিপাশাদি অন্বেষাকে আর ক্লাস টেনের তিথিকে(সেও অংশগ্রহণ করবে স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনারে) নিয়ে রওনা হলেন যে স্কুলে প্রতিযোগিতা হবে সেইদিকে। দুটো মাত্র পিরিয়ড ক্লাস হয়েই সেদিন স্কুল ছুটি কী কারণে যেন, তাই ওদের সুবিধেই হলো। সেমিনার শুরু হবে দুপুর দুটোর পরে।

স্কুল ছুটিই যখন হয়ে গেল, তখন আমার হঠাৎ মাথায় খেলে গেল, আরে, আমিও তো যেতে পারি ওদের সঙ্গে! ওরা রিক্শায় গিয়েছে, কিন্তু আমার তো সাইকেল রয়েছেই, আর ঐ হোস্ট স্কুলও চিনি তো! আমাদের পাড়া থেকে ঐ স্কুলই বরং কাছে। যা ভাবা সেই কাজ, আমিও রওনা দিলাম সেইদিকে। না ঢুকতে দিলে সোজা নাহয় বাড়ী চলে যাবো, আর তো কিছু না! আর দেখতে দিলে দেখবো, সেমিনার হয়ে গেলে সরাসরি বাড়ী চলে যাবো।

যেতে যেতেই ওদের রিক্শাকে দেখতে পেলাম, ওরা পৌঁছনোর কয়েক মিনিটের মধ্যে আমিও পৌঁছে গেলাম। অরুণিমাদি আর বিপাশাদি অন্বেষা আর তিথিদির আমাকেও সঙ্গে নিলেন ঢোকার সময়। আয়োজকদের একজন আমাদের পথ দেখিয়ে দোতলায় একটা ঘরে নিয়ে বসালেন, চমৎকার সুন্দর ঘর, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মেঘেভরা আকাশ, তখন ঘোর বর্ষা, শরৎ আসতে সামান্য বাকী। ঐ ঘরে তখন পর্দা টানানো টেবিলক্লথ পাতা ফুলদানি সাজানো এইসব চলছিল, আমরা এতই তাড়াতাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি!

তিথিদি এই স্কুলে এক পুরনো বন্ধুকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলতে সামনের করিডরে চলে গেল। বিপাশাদি আর অরুণিমাদি জানালার পাশে দুই চেয়ার টেনে বসলেন। আমি আর অন্বেষা পাশাপাশি বসলাম একপাশের এক বেঞ্চে। অন্বেষার মুখ একটু ফ্যাকাশে, একটু একটু নার্ভাস মনে হয়। পাব্লিক স্পিকিং ব্যাপারটাই একটা কেমন যেন ইয়ে ব্যাপার, ভয় তো হবেই। আমি ওকে সাহস দেবার জন্য নানা ভুজুং ভাজাং বলতে বলতে ওকে হাসাতে লাগলাম।

(চলবে)

Wednesday, July 16, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২০)

ক্লাস এইটে বদলি হয়ে বড় শহর থেকে একজন এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো। চন্দ্রাণী চট্টরাজ। খুব নামডাক তার, পড়াশোনায় নাকি দারুণ সে। বড় শহরের পালিশ তার, সবাই বলতে লাগলো, আমাদের মতন গাঁ-মফস্বলের মেয়েদের সে তুড়ি মেরে হারিয়ে দেবে। আমাদের সেকশানে এসে বিশেষ করে আমাদের সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ব্যতিক্রমহীন ভাবে ফার্স্ট হয়ে আসা অন্বেষাকে কায়দা করে শুনিয়ে যেতে লাগলো অন্য সেকশনের মেয়েরা। চন্দ্রাণী বদলি হয়ে ভর্তি হয়েছিল বলে এ সেকশনেই প্রথমবার পারে নি আসতে, ক্লাস এইটে ও ছিল বি সেকশনে।

প্রথমবার চন্দ্রাণীকে দেখে তো আমরা অবাক! ছোট্টোখাট্টো ফর্সা গোলগাল মেয়েটি, মাথায় লম্বা চুল পিঠ ছাপিয়ে, সেই বিশাল চুলের রাশি মোটা একটা বেণীতে বাঁধা। অমরা তো ভেবেছিলাম শহরের মেয়ে, খুব চোখেমুখে কথা বলা টাইপ বুঝি হবে, চুল ছোটো করে ছাঁটা হবে, ছেনিকাটা চোখমুখ হবে। এ তো একেবারে ধ্রুপদী বঙ্গবালা টাইপ শান্ত নরম একটা মেয়ে।

আমাদের অন্বেষা, শুভাশ্রী, শ্রীতমা, চন্দ্রিমা, সুগোপারা তো স্বস্তির শ্বাস ফেললো ওকে দেখে। বন্ধুত্ব হতেও খুব একটা দেরি হলো না।

ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় চন্দ্রাণী ভালো করেছিল ঠিকই, তবে প্রথম তিনজনের মধ্যে আসতে পারে নি। অন্বেষা তো একইরকম প্রায় সব সাবজেক্টে হায়েস্ট পাওয়াই রয়ে গেল, সে ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়েছিল মনে হয় শ্রীতমা আর থার্ড হয়েছিল সম্ভবত শুভাশ্রী। তার পরে চন্দ্রাণী।

অনেক পরে, মাধ্যমিকেরও পরে যখন চন্দ্রাণী আবার ওর বড় শহরে ফিরে গেল, তখন শ্রীতমা বলেছিল, "আমাদের গাঁ-মফস্বলেও কিন্তু চট্টরাজ ভালো কম্পিটিশনই পেয়েছিল, বলতে পারবে না যে একেবারেই কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে পায় নি।" কেন জানি শ্রীতমা ওর নাম না ধরে পদবী ধরে উল্লেখ করতো সবসময়, হয়তো পদবীটা বেশ আনকমন ছিলো বলে।

এখন ভেবে দেখলে মনে হয় চন্দ্রাণীরও কতটাই না মানিয়ে নিতে হয়েছিল হঠাৎ করে নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে উপড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় উপস্থিত হয়ে।

বহুকাল আর যোগ নেই ওর সঙ্গে, এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে কোথায় আছে ও, কেমন আছে ও? এইট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা অবধি ঐ তিনটে বছরের কথা মনে আছে কি ওর?

ক্লাস এইটে আরেকটা বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আমাদের। হঠাৎ শোনা গেল একটা ইন্টার-স্কুল স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনার হবে, তাতে হোস্ট আমাদের স্কুল। ক্লাস নাইন আর টেনের ছাত্র- ছাত্রীরাই অংশগ্রহণ করবে, তবে ক্লাস এইটের কেউ যদি আগ্রহী হয় আর আত্মবিশ্বাসী হয়, তবে সে বা তারাও অংশগ্রহণ করতে পারে।

আরে অংশগ্রহণ তো পরের কথা, জিনিসটা কী সেটাই তো তখন আমরা জানি না। সেমিনার আবার কী? এটা কি কোনোরকম প্রতিযোগিতা? তার আগে কোনোদিন আমরা সেমিনার বলে কোনো ব্যাপারের নামও শুনি নি। বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা-এসব ব্যাপার তবু ভাসা ভাসা কিছু কিছু জানতাম, কিন্তু সেমিনার কী জিনিস?

অল্পবয়সী দিদিমণিরা যারা নতুন নতুন ব্যাপারের অনেক খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা এসে আমাদের এই ব্যাপারে ধারণা দিতে চেষ্টা করলেন।

জেলাসদরের একটি সংস্থা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। সেখান থেকে একটি বিষয়বস্তু দেওয়া হয়েছে আর নির্দেশাবলিও দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে বক্তৃতার মতন করে বলতে হবে আর সঙ্গে স্লাইডে ডায়াগ্রাম চার্ট ইত্যাদিও দেখানো যেতে পারে, দেখালেই সুবিধে। সময় পাঁচ মিনিট।

এই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের যুগে দাঁড়িয়ে সেই আমাদের প্রথম স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনারকে অদ্ভুত আদিযুগের জিনিস মনে হয়। তখন তো কম্পিউটার কী জিনিস তাই জানতাম না আমরা কেউ, দেখা তো দূরের কথা। কেউ কেউ টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছিল কম্পিউটার, বলেছিল টিভি আর টাইপ রাইটারকে একসাথে জুড়লে যেমন হয় সেরকম জিনিস ওটা।

তো আমাদের সেই প্রি-কম্পিউটার সেমিনারে চার্ট ডায়াগ্রাম ইত্যাদি দেখানোর জন্য দিদিমণিরা সাজেশন দিলেন অনেকপাতার ক্যালেন্ডারের মতন করে বানানো একটা বস্তু, তার পাতায় পাতায় ডায়গ্রাম চার্ট ইত্যাদি। সেমিনারে বলতে বলতে পাতা উল্টে উল্টে দেখাতে হবে।

আমরা সব বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগলাম। ক্লাস এইটের আমরা দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম নাইনের দিদিরা কীভাবে সব বানাচ্ছে। যদিও আসল প্রতিযোগিতার দিন ভালো ভালো স্কুল থেকে তুখোর তুখোর সব সেমিনার দেনেওয়ালারা এসে বলে টলে একেবারে মাতিয়ে দিল, জাজরা ওদের মধ্য থেকেই ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড বেছে নিলেন। তখনই আমরা বেশ স্পষ্ট করে বুঝেছিলাম ভালো স্কুলের ব্যাপার স্যাপার আমাদের নিতান্ত সাধারণ মধ্যমানের স্কুলের থেকে কতটাই আলাদা।

পরের বছর অন্য একটা স্কুল হোস্ট করলো এই কম্পিটিশন। আর আমাদের মধ্য থেকে অন্বেষা তৈরী হলো অংশ নেবার জন্য। অন্য কারুর তেমন আগ্রহ ছিল না অথবা হয়তো মনে করেছিল সময় নষ্ট করে লাভ কী? এসব করে তো পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো পজিটিভ এফেক্ট পড়বে না!

সেই বছরের টপিক ছিল ওরিজিন অব লাইফ, জীবনের উৎপত্তি।

(চলবে)

Thursday, July 3, 2014

সবুজঘরের ছাদে

১।

সবুজঘরের ছাদভর্তি সোনালি রোদ্দুরে আচার শুকোতে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় রচনা। ভেজা চুল মেলে দিয়েছে পিঠে, ছাদে আচার শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুলও শুকায়। লালশাড়ীর আঁচলের প্রান্তটি হাওয়া লেগে ওড়ে, কার্ণিশে চিবুক রেখে দূরের মাঠের দিকে চেয়ে থাকে রচনা। কবেকার ভুলে যাওয়া গানের কলি তার মনে মনে গুণ্‌গুণ্‌ করে ওঠে পথভোলা ভোমরার মত।

শীতের দুপুর হালকা আলস্যে গড়িয়ে যেতে থাকে ফ্যাকাশে বিকালের দিকে, তারও পরে কুয়াশাসন্ধ্যা-যখন কুয়াশার মাঠ পেরিয়ে ঘরে ফিরে আসবে ক্লান্ত সব কাজের মানুষেরা।

২।

গাড়ী চালাতে চালাতে ক্লান্তি ছেয়ে আসে সর্বাঙ্গে অর্চিষ্মানের। নির্জন রাস্তা মরুভূমি চিরে চলে গেছে দূর থেকে দূরে। রিফ্লেকটরগুলো ঝকমক করে গাড়ীর আলোতে, পাশের নি:সীম মরুভূমিতে নক্ষত্রালোকে দেখা যায় আঁকাবাঁকা ক্যাকটাসের দীর্ঘ শীর্ণ দেহগুলো।

মাঝে মাঝে মরুহ্রদ, তাতে টলটলে নক্ষত্রছবি। এরকম স্মৃতি আগে ছিলো না অর্চিষ্মানের। এইভাবে সারারাত গাড়ী চালিয়ে মরু পার হয় নি সে কোনোদিন আগে। ঘুমঘুম মন নিয়ে শান্তভাবে গাড়ী চালাতে চালাতে মনটা অজানা কিসের একটা ভাবনায় ছেয়ে যায় অর্চির।

মনে হয় সে যদি শত শত কিংবা সহস্র বছর আগে অন্য কোনো জন্মে এই মরুর কোনো গাঁয়ে জীবন কাটিয়ে থাকে,তাহলে কি এখন গেলে চিনতে পারবে সেই গাঁ, সেই পাহাড়ের গুহায় আঁকা পূর্বপুরুষের স্মরণচিহ্ন, সেইসব অদ্ভুত ছবি, সেই আশ্চর্য ভাষা, আশ্চর্য বিশ্বাস!

৩।

বৃতি কথা বলে খুব কম, কিসে যেন সবসময় মগ্ন হয়ে থাকে। কেউ ওকে বেশী ঘাঁটায় না, বন্ধুরা জানে বৃতি আত্মমগ্ন শিল্পী। মেয়ে আদিরা একেবারে ওর মায়ের মতন দেখতে, কিন্তু সে খুব কথা বলে। রায়ান মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে মা এত কম কথা বলে আর মেয়ে এত টরটরি হলো কিকরে?

রায়ান যখন বৃতিকে বিয়ে করে তখন আদিরা মাত্র একবছরের, রায়ানের কি যে মিষ্টি লাগতো ওকে দেখতে! অতটুকু বয়সের শিশুর মধ্যে কি আশ্চর্য টান থাকে! রায়ানের নিজের ছেলেটার কথা মনে পড়তো, ওর নাম ছিলো নিকোলাস। মনে পড়তো ওর মা ক্যাথেরিনের কথা। নিকোলাস আর ক্যাথেরিন, নিক আর ক্যাথি। জোর করে সে সরিয়ে দিতে চাইতো মন থেকে--কিন্তু বারান্দার শূন্য দোলনাটা কেবল ভেসে উঠতো স্মৃতিতে-সব ঘর ঘুরে ঘুরে যেখানে এসে বসতো সে বারবার, বুঝতেও পারতো না যে সেখানে সে আসছে!

ডাইরিটা খোলা পড়ে থাকতো কোলের উপরে, নিকোলাসের জন্য লিখছিলো ক্যথেরিন--সে কোনোদিন একপাতার বেশী পড়তে পারে নি, জলে ঝাপসা সব, সে কিছু দেখতে পেতো না। ওভাবেই কি চলে যেতে হয়? সবচেয়ে সুখের সময়ে এভাবে রায়ানকে সর্বহারা করে? পুলিশ ওদের দুজনের দেহ উদ্ধার করেছিলো নদী থেকে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ীসমেত তারা পড়ে গেছিলো। কতবার ভেবেছে রায়ান সে যদি থাকতো! সে যদি ক্যাথেরিনকে বাচ্চা নিয়ে একা না যেতে দিতো! কেন সে সঙ্গে যায় নি, কেন?

৪।

হাল্কা নীল ভোর, খুব মৃদু একটা আভা শুধু দেখা দিয়েছে। এখনও সূর্য উঠতে অনেক দেরি, পুবের আকাশে এখনো লাল রঙই লাগে নি। হাওয়ায় হাল্কা শীত-শীত ভাব। একটা ভোরজাগা পাখি সুরেলা গলায় ডেকে উঠলো, গানের প্রথম আখরটির মতন বাধো-বাধো ডাক।

সুজাতা জেগে গেছিল আগেই, অনেককাল ধরেই শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। সেই স্কুলে থাকার সময় সে রাত জাগতে পারতো না বলে শেষরাতে মা ডেকে দিতো, সে উঠে পড়তে বসতো, সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। এখন যদিও আর দরকার নেই অত তাড়াতাড়ি ওঠার, কিন্তু সুজাতার ভালোই লাগে। মনে হয় এই শেষরাত বা প্রথম ভোর, যখন বেশীরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে আছে, চারিদিক খুব নির্জন আর শান্তিময়, এই সময়টা তার কাছে একটা গোপন উপহারের মতো, সেই ছোটোবেলার জন্মদিনের সময়কার বালিকা সুজাতা হয়ে সে মোড়ক একটুখানি খুলে চুপিচুপি দেখে নেয় কি আশ্চর্য জিনিস আছে ভিতরে। আরেকটু বেলা বাড়লে যখন একে একে সবাই উঠে পড়ে, আওয়াজ আর তাপ বাড়তে থাকে, তখন সেই লুকিয়ে উপহার দেখে নেবার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চকর আনন্দ সে আর পায় না।

এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুজাতা চুপ করে দেখছে একটু একটু করে আকাশের গায়ে আলোর তুলি বুলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য শিল্পী, ঐ অনেক উপরের মেঘগুলোয় কেমন আশ্চর্য রঙ! সেই পাখিটা এখন কেমন ছন্দবাঁধা ধ্বনিতে সুরেলা গান গেয়ে যাচ্ছে-সুজাতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। হঠাৎ আরেকটা পাখি সাড়া দিয়ে ডাক দেয়। দু'জনে মিলে এখন যুগলবন্দী গাইছে তারা। নিজের অজান্তে একটা ছোট্টো শ্বাস পড়ে সুজাতার। আর একেবারে হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় ইমনের মুখ।

৫।

কেউ কি হেমন্তের মধ্যরাত্রির গন্ধ পেয়েছে? ধানের গন্ধ, ক্ষীরের গন্ধ, পিঠার গন্ধ মিলেমিশে থাকতো সেটায়। কুয়াশার গন্ধ পেয়েছে কেউ মাঘপঞ্চমীর সকালে? নিমপাতা আর হলুদের গন্ধ ছিলো তাতে। কেউ কি জৈষ্ঠ্যের মধ্যাহ্নের গন্ধ অনুভব করেছে? আমি শুকনো লঙ্কার গন্ধ পেতাম ওসব দুপুরের রোদে। আষাঢ়ের মেঘমেদুর হয়ে আসা আকাশের গন্ধ নিয়েছে কেউ? কেমন লেগেছে ?

রুমন, শোনো, চন্দনকাঠের যে বাক্সটায় তোমার সব চিঠিগুলো রেখেছি, সেই বাক্সটার গন্ধ অপূর্ব! তোমার চিঠির কাগজেও সুন্দর গন্ধ থাকতো! হাল্কা গোলাপী পাতায় গোলাপের গন্ধ! হাল্কা কমলা ছোপ দেওয়া সাদা রঙের পাতায় শিউলির গন্ধ! সব এখনো আছে। পাতাগুলো পুরানো হয়ে এসেছে, লেখাগুলো ম্লান হয়ে এসেছে, গন্ধ ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু আছে।

রুমন, যেখানে তুমি চলে গেছ, সেখানে বকুলগাছ আছে? বকুলফুলের গন্ধ পাও আজো তুমি? ফুলের সময়ে বকুলফুল রুমালে জড়িয়ে রেখে দিতাম ছোট্টো ব্যাগটার মধ্যে, মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সুরভিসার আজো বুঝি রয়ে গেছে সেখানে।

পৃথিবী ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে নতুন নতুন আতর মাখে, প্রত্যেকদিন নতুন, কত আছে কেজানে ...

নীল বৃষ্টির ভিতরে

১।

নীলমেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিকণারা নেমে আসছিল, একের পর এক। টুপ টাপ টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছিল রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানের গভীর দিঘির কালো জলে। মস্ত মস্ত নীল মুক্তোর মতন জলবিন্দু। কালো জলে ডুবে যাচ্ছিলো। ওরা কোথায় যায়?

ওই দিঘি কত গভীর কেউ জানে না, ঘাট থেকে জলে নেমে একটু এগোলেই আর থই পাওয়া যায় না, তখন সাঁতার দিতে হয়। আমি সাঁতার জানি না, তাই পাথরের ঘাটের কাছ থেকে বেশী দূরে যাই নি। লোকে গল্প বলে নাকি দিঘির গভীর তলদেশে আছে মণিমুক্তাসাজানো জলগুহা, তা হলো পাতালের দরজা। ঐ গুহাপথে পাতালে পৌঁছলে নাকি দেখা যাবে পাতালের রাজ্য, তাতে হীরা, মুক্তা, মণি, মাণিক্য ছড়াছড়ি যায়।

আহা, পাতালে পৌঁছতে পারলে বেশ হতো! তাহলে এই ছেঁড়া কালো জামা পরতে হতো না আর, পেট ভরে খেতেও পেতাম দু'বেলা। যেখানে এত ধনদৌলত ছড়াছড়ি যায়, সেখানে ভালো ভালো খাবারও নিশ্চয় অনেক। মা ও এত মারতো না তাহলে, পেতই বা কোথায় আমাকে? আমি তো তখন সে-এ-এ-এ-ই পাতালের রাজ্যে! বা:, বেশ মজা হতো!

" টুনি, ও টুনি, কই গেলি তুই? " মা ডাকে, আমি দিবাস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি। কোথায় বৃষ্টি? খটখট করছে দুপুর। ঘাটলার অশ্বত্থছায়া থেকে উঠে পড়ি। মা বেরোবে বিকালের কাজে, আমায় ঘরে থাকতে হবে। যাই, দেরি হলে মা আবার চুলের মুঠি ধরে এমন চড় দেবে যে গালে দাগ পড়ে যাবে। একদিন দিয়েছিল ওরকম, ঘুরে পড়ে গেছিলাম মেঝেতে।

যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলি, "যাই দিঘি, কালকে আবার আসবো। "

দিঘি কী বললো শোনা হলো না। আচ্ছা, সত্যি কি পাতালরাজ্য আছে? জলমানুষেরা আছে? থাকলে বেশ হতো কিন্তু! মা পেট ভরে খেতে দেয় না, দেবেই বা কোত্থেকে? একা একা খেটে আমাকে আর দুটো ভাইকে খেতে পরতে দেওয়া আবার নিজের জন্য ও তো লাগে, এ কি সহজ? আরেকটু বড় হলে আমিও কাজ করতে শুরু করলে তখন বেশ ভালো হবে। পেট ভরে খেতে পাবো, আস্ত কাপড় পরতে পাবো। সে কবে?

হয়তো আর কিছুদিন পরেই মা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কোনো বাসায় কাজ ঢুকিয়ে দেবে। এই তো পাশের ঝুপড়ির মালতিকে গত মাসে স্টেশনের কাছের ঐ উঁচু বিল্ডিং এর এক বাসাবাড়ীতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মা। মালতি তো আমার বয়সীই প্রায়, একটু বড়ো। সেরকম হলেও ভালো হয়, বাসাবাড়ীতে ফ্যান আছে, হাওয়া খাওয়া যায়, টিভি আছে দেখা যায়। সবসময় তো আর কাজ না, কাজ ফুরালে টিভি দ্যাখা যায়। তাছাড়া মালিকেরা জামাকাপড়ও দেয় অনেক, ওদের ছেলেমেয়েদের একটু পুরানো হয়ে যাওয়া জামা দিয়ে দেয় কাজের লোকেদের।খাবারদাবারও ভালো পায় সেখানে মালতি। বেশ মজাতেই আছে। মালতি মাঝে মাঝে আসে, ওর মাসমাইনের টাকা ওর মাকে দিয়ে যায়।

পৌঁছে গেছি, মা যথারীতি রেগে আছে। আমার দিকে তেড়ে এসে বলে, "কোন্‌খানে ছিলি এতক্ষণ?এত বড় বুড়োধাড়ি মেয়ে রাতদিন টইটই করে বেড়ানো? ঘরের কাজগুলো তো খানিক করে রাখলে পারিস, তা করার নাম নেই! তাহলে যে মা'র সুবিধা হয়! ছোটো ভাই দুটোকে দেখে রাখলেও তো কিছু কাজের কাজ হয়। তা না, ইনি পাড়া বেড়িয়ে বেড়াবেন! দাঁড়া আজকে এমন মজা দেখাবো যে আর ভুলবি না। "

বলতে না বলতেই চুলে টান আর ঠাস করে ডান গালে এক প্রচন্ড জোরে চড়, পড়ে যেতে যেতে সামলাই, চোখে অন্ধকার। সেটা সামলাতে না সামলাতেই বাঁ গালে আরেক চড়। আ:, কেন মা এত মারে! এইবারে মালতি আসলে ওকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবো ওর চেনা কোনো বাসাবাড়ীতে কাজের লোক রাখবে কিনা কেউ। ও যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে ওর সঙ্গে চলে যাবো মাকে না জানিয়ে।

লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে মাকে বলি, ""আমি ছোটন আর বুড়নকে দেখে রাখছি। তুমি কাজে যাও। "

ঘুমিয়ে থাকা ভাইদের পাশে গিয়ে বসি, তালপাতার আধাভাঙা পাখাটা দিয়ে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে থাকি। মা কিন্তু তখুনি যায় না, আমাকে একটা রুটি আর অল্প কাঁচকলাভর্তা এনে দিয়ে বলে,""খিদে পায়নি তোর? সেই তো কোন সকালে দুটি পান্তা খেয়েছিলি, তারপরে তো আর কিছু খাস নি। "

আমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলি, "আমার খিদে পায় নি। তুলে রেখে দাও, রাত্তিরে দিও। " আমার মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ে, ছেঁড়া ফ্রকের হাতায় মুছি। মা যাতে না দেখতে পায় সেই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মা দেখতে পেল।

মা খুব কেমন রকম গলায় বলে, "কী রে তোর মুখে রক্ত! এত লাগলো? "

কাছে এসে আমাকে আলতো করে ধরে, আমি চোখ বন্ধ করি, হাতের পাখাটা পড়ে যায়। নীল মেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিরা নেমে আসছে, অনেক অনেক নীল বৃষ্টিকণা। টুপ্‌ টুপ্‌ করে ডুবে যাচ্ছে দিঘির কালো জলে। আমিও ডুবে যাচ্ছি ওদের সঙ্গে, আমার সারা শরীরে ঠান্ডা জলের ছোঁয়া লাগছে, দেখতে পাচ্ছি চারপাশে মাছেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় সব মাছ।

নীল রঙের একটা মস্তবড় মাছ আমার কাছে এসে কথা বলে উঠলো, বললো, " পাতালের প্রাসাদে যাবে? এসো আমার সঙ্গে।" সে ডানা নেড়ে নেড়ে সাঁতরে চলে পথ দেখিয়ে, আমি পিছু পিছু চলি। কিন্তু আমি তো ভালো সাঁতরাতে পারি না, আমার হাত-পা সব ভারী হয়ে আসে, খুব কাশি পায়, কাশি চাপতে পারি না, কাশতে কাশতে ঝলক ঝলক রক্ত উঠে আসে, জল লাল হয়ে যায়।

আহ, আর যাওয়া হলো না প্রাসাদে। সেই যেখানে ধনরত্ন মণিমুক্তা ছড়াছড়ি, যেখানে কোনো কষ্ট নেই, যেখানে খিদে পেলেই খেতে পাওয়া যায়। যেখানে একজন খুব সুন্দর মা আছে। কেউ সেখানে মারে না। আহ, যাওয়া হলো না। মাছকে বলি, "ও মাছ, মাছ, শোনো, একটু থামবে? আমি যে পারিনা আর এগোতে। "

মাছটা পিছন ফেরে, ওর হাসিহাসি মুখটা বদলে যায়, বদলে যায় আরো। চেনা কার মুখের মতন হয়ে যায়।

আমি চোখ মেলি, চোখে মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল, মা ঝুঁকে পড়েছে আমার মুখের দিকে। জলের ঝাপটা দিচ্ছিলো বোধহয়। আমার চেতন হয়েছে দেখে সোজা হয়ে বসে। আমি উঠে বসতে গেলে মা বলে, " শুয়ে থাক, শুয়ে থাক, উঠতে হবে না। "

আমি তবু উঠে বসি, কোনোরকমে বলি, "আহ, আ-আমাকে একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা। "

মা গেলাসে করে জল এনে গেলাস আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।

আমি মাকে জিগ্গেস করি , "কাজে যাও নি? "

"তোকে এই অবস্থায় রেখে যাবো? এখন একটু ভালো লাগে রে টুনি? "

"এখন ভালো। তুমি কাজে যাও। আমি ভাইদের কাছে শুয়ে শুয়ে হাওয়া করি। "

মা কাছে এসে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, "বুঝতে পারিনি টুনি, তোর এত লাগবে। আমি তোকে রুটিভর্তা খাইয়ে দিই? তারপরে কাজে যাবো। "

রুটি-ভর্তা মা খাওয়ায়, আমি নিজেই খেতে পারতাম, কিন্তু মা নিজে হাতে করে খাওয়ায়, আমি খেয়ে যাই। মুখের ভিতরে কোথাও কেটে গেছে হয়তো, জ্বালাজ্বালা করে, কিছু বলি না। কী হবে বলে? দু'দিন গেলে সেরে যাবে।

মা কেমন কোমল গলায় বলে, " আমার কথা শুনে চললেই তো আমার রাগ হয় না। একা একা ঘুরে বেড়াস, জানিস কত বিপদ আপদ চারপাশে? কথা না শুনলেই আমার রাগ ওঠে। আমার কথা শুনবি তো টুনি? আর এমন ঘুরবি না তো? "

আমি মাথা কাত করে জানাই শুনবো। মা বিপদ-আপদের কথা বলে প্রায়ই, কিসের বিপদ? কিজানি হয়তো ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যেতে পারে, সেই বিপদ।

(চলবে)

ডানার কুঁড়ি

ছোট্টো সেই খাতা, প্রত্যেকটা পাতা হাতের পাতায় ধরে যায়, এত ছোটো। আর সেই কলমটি, ছিপছিপে পাতলা গাঢ় নীল রঙের কলম, গলার কাছে এক চিলতে সোনালীর ঝিকমিক।

কমলালেবুগন্ধী শীত-দুপুরের রোদে পা মেলে দিয়ে সাবধানে খুলি খাতা । পাতাগুলো জীর্ণ, পুরানো, ঝুরঝুরে। কতকাল কেটে গেল ঐ শৈশবের খেলাখেলা লেখাগুলোর পরে? কতবার সূর্যপ্রদক্ষিণ করে এলো পৃথিবী তার অন্তহীন পরিব্রজনের পথে?

পাতায় পাতায় হিজিবিজি ছবি আর লেখা। প্রথমদিকেরগুলো একদম ছোটো ছোটো,একটা দুটো শব্দ, কখনো একটা গোটা বাক্য-কখনো আবার অদ্ভুত কোনো কথা। সেইসব আঁকিবুকি পড়তে পড়তে দুপুরজাগা চোখের মধ্যে ঘনিয়ে আসে অদ্ভুত রাত্রি, সেই রাত্রির বুক ভরে ছড়িয়ে আছে উদাসী নীলজ্যোৎস্না, যে কেবলই হাত বাড়িয়ে ডাকে। কিন্তু ছুঁতে গেলেই আর পাওয়া যায় না।

নীল কলমটি নীলজ্যোৎস্নার ভিতর
একাকী এক ঘোড়ার মতন দাঁড়ায়-
কিশোর পক্ষীরাজ, পিঠে ডানার কুঁড়ি-
সেই কুঁড়িতে বহুদিন শুধু ফুটি-ফুটি ভাব
আর আনচান করানো চিনচিনে ব্যথার ধার,
কিন্তু ডানা ফোটে নি।

একদিন এক অকালবৈশাখীর
তুমুল বজ্রবিদ্যুত-প্রহরের শেষে
সেই কুঁড়ি থেকে ডানা ফুটলো।
অমনি শিকল খুলে গেল পায়ের
ধারালো বাতাসে অস্থির টান।

সেই তখন থেকে হাওয়ার ভিতর দিয়ে
ওর নীলাভ এই একাকী উড়ান-
শুভ্র মেঘেদের পাশ দিয়ে,
দীর্ঘযাত্রার পরিযায়ী পাখিদলের পাশ দিয়ে-
কখনো দিগন্ত গোলাপী হয়ে ওঠে ভোরের স্পর্শে
সেই তখনই আবার কোথাও রক্তসন্ধ্যা আকুল।
বহু নিচে মহাসমুদ্রের আভাস পাওয়া যায়
মাঝে মাঝে মেঘের মিনারে ঝিকমিক করে ওঠে
সূর্যের উৎসবলগ্নের কিছু সঙ্কেত।

দূরে, অনেক দূরে, ঐদিকে রাত্রি
সেইদিকে উদাসীন উড়ে যেতে যেতে
সে ভাবে, সঙ্কেতের অর্থ কি পাওয়া যাবে?
ঐ অনাবিল রাত্রির মণিময় গর্ভের ভিতরে?