Saturday, January 30, 2010

আশ্চর্যময়ী(১)

সে কথা রেখেছে। দেশ বেড়ানোর চিঠি লিখেছে। চিঠির ভাঁজ না খুলে হাত বোলাই অনেকক্ষণ। সেই স্মৃতিস্বপ্নকল্পনা দিয়ে তৈরী ভূমি আমিও চিনতাম। কতবার চৈত্ররাতের ঘুমভাঙা জ্যোৎস্নায় সে দেশ আমি দেখেছি চাঁদের আয়নায়। সাবধানে ভাঁজ খুলি, পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমিও রওনা হই চিৎপুরের নতুন টার্মিনাস "কলকাতা" থেকে, সকাল ৭ টার রোদ তেরছা হয়ে পড়েছে কামরায়, ট্রেনের নাম মৈত্রী।

দেখতে দেখতে পার হয়ে যাই নৈহাটী রাণাঘাট গেদে দর্শনা। কখন সীমান্ত পার হয়ে গেছে ট্রেন, তাদের তো চেক করেছে কাস্টমস, আমাকে তো পারে নি, সীমান্ত বলতে আমার শুধু মনে পড়ে এক মেয়ের কথা, তার নাম আঁচল, তার দু'চোখ ভরা জল, সে যে গ্রামে থাকতো সেই গ্রামের নাম ছিলো বনসীমান্ত। দু'খানা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তার অবাক হয়ে যাওয়া মা তাকে বলেছিলো, "মা আঁচল, এতদিনে তুই আমার কাছে ফিরে এলি?"

দর্শনা পার হয়ে আমিও এসে পড়ি লালন ফকির রিসার্চ সেন্টারে। সেই লালন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখির ছটফটানির গান। কেমন করে সেই পাখি আসে? কেমন করে সে যায়? ধরতে পারলে তার পায়ে মনোবেড়ী দেবার বাসনা সবারই, কিন্তু ধরতে পারলে তো!

এবারে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন, আমি শুনতে পাচ্ছি বাঁশী! কু উ উ উ ঝিকঝিকঝিকঝিক। "কে না বাঁশি বায়ে বড়াই কালিনী নই কুলে/ কে না বাঁশি বায়ে বড়াই এ গোঠগোকূলে।" বড়াই গো, ও বড়াই, কে বাঁশি বাজায় কালিন্দীর কূলে? কে বাঁশি বাজায় এ গোঠগোকূলে? এ কালিন্দী নয়, পদ্মা। ট্রেনের হুইসিল পার হয়ে রাখালি বাঁশি শুনতে চেষ্টা করি কান পেতে। ঈশ্বরদি স্টেশন থেকে বোতলে পানীয় জল ভরে নিই আমিও, সিরাজগঞ্জ ঘাট পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে চলছে ট্রেন। নিচে যমুনা, এ যমুনা রাধাকৃষ্ণের সে যমুনা না, এ বাংলার যমুনা, ব্রহ্মপুত্র।

অনেক দূরের গাছ থেকে বাতাসে উড়ে চলে গুচ্ছ গুচ্ছ শিমূলতুলা, ভিতরে ক্ষুদ্র কয়েকটি বীজ। ওরা সীমান্ত মানে না, ওরা মুক্ত। সেই অঙ্কুরসম্ভব বীজপক্ষী দেশকাল পার হয়ে উড়তে উড়তে যদি গিয়ে কখনো সে প্রাচীন মাটিতে ফেরে, মাটি কি চিনতে পারে তাকে? স্নিগ্ধ আদরে জড়িয়ে ধরে? নাকি বিস্ময় আর বেদনা মেশানো চোখে চেয়ে কেবল বলে, কে কে কে তুমি?

সে ঘোমটা সরায়, আমি তাকে দেখি
দেখি তার প্রাচীন মুখের বলিরেখা-
দেখি তার গভীর কুয়োর মত চোখ।
আরেকটু কাছে গিয়ে উঁকি দিলেই
দেখা যাবে গভীরে জল টলটল।

আমাকে ঘিরে ধরে অজস্র মুখ
শিশুমুখ তরুণমুখ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ মুখ।
কাউকে চেনা-চেনা মনে হয়
কাউকে একদম অচেনা।
সবাই জানতে চায় আমি তাদের কে!
কে আমি? কোথায় ছিলাম আমি?
কোথা থেকে এসেছিলাম?

মনসুন্দর, তুমি কোথায়-
তুমি কি আজো বেঁচে আছো?
আশ্চর্যময়ী, এসো, আমাকে ছোঁও
স্পন্দনে স্পন্দন মিলিয়ে বলে দাও
আমিও বেঁচে আছি।

স্মৃতির নীলখাম

ট্রেন চলেছে কুউ উ উ ঝিকঝিকঝিক করে। শীতের কাবেরী নদীর স্বল্পতোয়া দেহ, রেললাইনের দুইপাশে যেমন হয়- অজস্র মাঠ, ধানক্ষেত। শীতে সোনালী ফসল তোলার মরশুম, মাঠে মাঠে স্তুপ করে রাখা কাটা ধানের গোছা। দেখতে দেখতে একেবারে দক্ষিণতম অংশে চলে এসেছি। অন্তরীপে। সম্মুখে শুধু মহাসমুদ্র। সাগরবেলায় তিনরঙা বালি, হলদেটে সাদা, লাল, কালো--পায়ে পায়ে শিরশিরে জলবালি পেরিয়ে জলের দিকে এগিয়ে যাওয়া, মহাসমুদ্রের হাওয়া চুলগুলি ওড়ায়, সমুদ্র কী গভীর নীল, ঢেউয়ের মাথায় ফেনারা কী দুধেল!

কী আশ্চর্য এই দুনিয়া! কী অপূর্ব এইসব গাছেরা, ঐ মহাসমুদ্র, ঐ রঙীন বালুবেলা, ঐ সমুদ্রদিগন্তে ভোরের বেলা গোল একটা লাল বলের মতন সূর্যের লাফিয়ে ওঠা!!!

ঢেউ আসে, ঢেউ যায়, বালিতে ঝিনুক পড়ে থাকে। বালিতে অদ্ভুত নকশা তৈরী হয় জলের টানে, দেখতে দেখতে অবাক আর খুশী হয়ে ওঠে নতুন কিশোরী, যার আকাশী ফ্রকে সমুদ্র আর আকাশ জেগে থাকে একই সঙ্গে। ঐ তো দেখতে পাচ্ছি সে নীচু হয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে নেয়, ঝিনুকের গায়ে চিত্রবিচিত্র নকশা!!!

একটি দুটি শিলায় বহির্সমুদ্রের ঢেউআটকানো ছোটো অংশে ভোরেরবেলা স্নান করতে এসেছি। জলে লাল-সবুজ ছোট্টো ছোট্টো মাছ সাঁতরে বেড়ায়। এত বোকা মাছগুলো, ওদের গামছায় ছাঁকা দিয়ে ধরে ফেলা যায়। ভাই সমুদ্রের মাছ পুষতে চায় বাড়ীতে, বাবা হাসে, বলে পাগল নাকি? কিন্তু ভাই কাঁদে, সে ছোটো প্লাসটিকের কৌটায় জল ভরে তাতে করে মাছ নিয়ে যেতে চায় বাড়ীতে। জলের মগে নেওয়া হয় দু'খানা মাছ। নিয়ে আসা হয় গেস্ট হাউসে। কিন্তু দুপুরে মাছগুলো মরে যায়, ভাইয়ের কান্না থামাতে বাবা কিনে আনে ক্যালাইডোস্কোপ!

চোখের সামনে সেই ম্যাজিক নল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাজার হাজার নক্সা দেখি ভাইবোনে! চৌকো গোল ছয়কোণা আটকোণা সোজা বাঁকা লাল নীল সবুজ জ্বলজ্বলে চকমকে ম্যাড়মেড়ে কত কত অজস্ররকমের প্যাটার্ণ! কান্না ভুলে গিয়ে মস্ত মস্ত চোখ করে দেখে ভাই। ছোট্টো ভাইটা, সুন্দর নরম ওর শিশুমুখ, মাত্র নার্সারিতে পড়ে ও। ওর গালে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মা যদি বকে? দেওয়া হয় না, ক্যালাইডোস্কোপ ওর হাতে দিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই নিচে ছোটো ছোটো নারকেল গছের বাগানে, বিকেলে এখানে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হয়।

নারকেলকুঞ্জে একা একা জলের মতন ঘুরে ঘুরে কথা কইতে ইচ্ছে করে, রোদ্দুরে ছায়ায় হাল্কা মেঘের ওড়াউড়ির খেলায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে! আচ্ছা, কেমন হয় আমি যদি একলা একলা কোথাও হারিয়ে যাই? কেউ আর না খুঁজে পায় আমায় কোনোদিন? খুব মনে পড়ে অনিকে, অনিলিখা- ছোট্টো থেকে আমার খেলার সাথী সে। মনে পড়ে উলের ডিজাইনের মতন কুঁচকানো গালের, পাকা চুলের এক প্রিয় মানুষকে, জ্ঞান হওয়া থেকে যার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘোরাফেরা- আমার ঠাকুমা। আচ্ছা, আমি যদি না থাকি, ওদের কি মনে পড়বে আমায়?

মনে পড়ে একটা দুপুর, সে কবেকার দুপুরবেলা....

নম্র ধূপকাঠি জ্বলেছে সে দুপুরে বাইরে ছিলো রোদ ঝিলমিল
স্মৃতির নীলখাম- সেখানে গান ছিলো, সঙ্গে ছিলো হাসি খিল্‌ ‌খিল্‌।
হিজল বনে ছিলো লুকানো ডাহুকেরা, শিমূল ডেকেছিলো বুলবুল-
হঠাৎ জলপরীর একমুঠো হাসি পেয়ে খুশীতে মাথা নাড়ে ঘাসফুল।