Thursday, April 24, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৭)

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের কথা লিখতে লিখতে বাক্সের ভিতরে বাক্সের মতন নতুন নতুন স্মৃতি বার হয়ে আসছে, রঙীন সব ছবি আঁকা বাক্স। তখন জীবন ছিল বিস্ময়ে ভরা, প্রতিটা দিন ছিল অদ্ভুত রকমের আশ্চর্য, প্রতিটা সকাল যেন হাতের মুঠোয় লুকিয়ে আনতো অচেনা উপহার। তখন তো বেশীরভাগই অচেনা আমাদের। নিজেদের পাড়ার বাড়ীঘর মাঠ রাস্তাগুলো পার হয়ে গেলেই অচেনা রূপকথার রাজ্য। আমবাগান কুলবাগান জোড়া পুকুর গাছপালায় ঘেরা অদ্ভুত অদ্ভুত বাড়ীঘর-সব যেন রূপকথার রাজ্যের এক একটা টুকরো, ছোট্টোবেলার ইস্কুলটাও যেন সেই রূপকথার রাজ্যের মধ্যেই।

মনে পড়ছে একটা মজার ঘটনা, এও নিয়তি দিদিমণির ক্লাসের গল্প। মুখে মুখে বিবেকানন্দের ছোটোবেলার গল্প বলে বলে শোনাচ্ছেন দিদিমণি, তারপরে আবার প্রশ্নও করছেন। দিদিমণি বলছেন ছোট্টো বিলের কথা, বিবেকানন্দের ছোটোবেলার ডাক নাম ছিল বিলে, সে নানা দুষ্টুমী করে বেড়াতো, আবার পড়াশোনায় ছিল তুখোর। তার বাবা বিশ্বনাথ দত্ত আর মা ভুবনেশ্বরী দেবীর কথাও বলেছিলেন দিদিমণি।

গল্প আরো খানিক এগিয়ে যাবার পরে কী মনে করে দিদিমণি থামলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, "তোমাদের মধ্যে কেউ বলোতো দেখি বিলের মায়ের নাম কী ছিল? "

অমনি ছাত্রছাত্রীর দঙ্গল থেকে তমালী পড়ি কী মরি করে এগিয়ে গিয়ে বলেছে, "জানি জানি দিদিমণি, ভুবনেশ্বর।"

সব্বাই হেসে ফেলেছে, দিদিমণি সমেত। তারপরে দিদিমণি বুঝিয়ে দিলেন, "তমালী, তোমার উত্তর প্রায় ঠিক হয়েছে। কিন্তু ভুবনেশ্বর একটা জায়্গার নাম, তাছাড়া মেয়েদের নামও নয় ওটা, বিলের মায়ের নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী। "

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসে লেখাপড়া ছিল বেশ খেলাধূলা আর গল্পের সঙ্গে মেশানো। ভারী চমৎকার ছিল সব। বাংলা অংক এইসবের পাশাপাশি হতো গল্প বলার ক্লাস।

স্কুলের গেটের দুইপাশে দুই আমগাছ আর গেটে দাঁড়িয়ে থাকে খাকি রঙের পোশাক পরা দারোয়ানজী, তাকে রতনদা বলে ডাকে সবাই। রতনদা শুধু গেট কীপারই না, সে বাচ্চাদের দেখাশোনাও করে। যেসব বাচ্চারা নতুন নতুন স্কুলে গিয়ে খুব কাঁদে, রতনদা তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করে। বলে, "কান্দিস না, কলা দিমু।"

দুপুরের টিফিন খাওয়া আর খেলা শেষ হলেই ঘুমের ক্লাস, মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানায় সবাই ঘুমের ভান করে পড়ে পড়ে পাশের জনের সঙ্গে ফিসফিস করতাম আর দিদিমণিরা দুইজন গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে, "তোমরা সবাই ঘুমিয়েছো ও ও ও?" বলে প্রশ্ন করতেন।

আমরাও সবাই যারা ঘুমাই নি, সবাই দিব্যি বলতাম, "হ্যাঁ অ্যা অ্যা " আর দিদিমণিরাও আবার নিশ্চিন্ত হয়ে গল্প করতে থাকতেন। বাচ্চারা সত্যি করে ঘুমোচ্ছে না বটে কিন্তু ঘুমের আন্তরিক চেষ্টা তো করছে-এই ভাবতেন মনে হয়।

আমাদের কয়েকজনকে রিকশা চালিয়ে স্কুলে যে পৌঁছে দিত তার নাম ছিল বিশাল নস্কর। সে তেমন বিশাল চেহারার ছিল না, রোগাটে গড়নের সাধারণ মানুষের মতনই ছিল, আমরা তাঁকে ডাকতাম বিশালদা। ঐ ছোট্টো রিকশার মধ্যে এক এক ট্রিপে পাঁচ ছ'জন করে বাচ্চা নিয়ে যে কীভাবে রিকশা চালিয়ে নিত বিশালদা, ভাবতে গেলে অবাক লাগে। রাস্তাও তো ছিল অমসৃণ, খোয়া আর ইঁটে পাথরে ভরা।

সকাল সাড়ে দশটায় স্নানখাওয়া সেরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে হাতে টিনের সুটকেস আর কাঁধে জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা কয়েকজন। বিশালদা এলেই রিকশায় ওঠা। সীটে তিনজন আর উল্টোদিকে কাঠের বেঞ্চ বসানো, সেখানে তিনজন। সুটকেশগুলো সব বেঞ্চের নিচের খোপে। এখন ভেবে দেখলে অবাক লাগে, ঐ রিকশাও তো একরকম ম্যাজিকই ছিল, এতগুলো ছেলেমেয়ে ঐটুকু জায়্গায় ধরতো কেমন করে? তার উপরে বর্ষাকালে আবার ত্রিপল ঢাকা দেবার ব্যবস্থাও ছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য।

সকলে উঠে বসলে ঝক্কর ঝক্কর রিকশা চলতে থাকতো, বড়োমাঠের পাশ দিয়ে জোড়াপুকুরের পাশ দিয়ে আমবাগানের পাশ দিয়ে কচুরিপানায় ভর্তি একটা ছোটো ডোবার পাশ দিয়ে চলতে চলতে এসে যেত ইস্কুল। কচুরিপানার ফুলগুলো ভারী সুন্দর দেখতে লাগতো, কেমন সাদার মধ্যে অতি হাল্কা বেগুনী মেশানো রঙ! পরে অনেক চেষ্টা করেছি আঁকা ছবিতে ঐ রঙ আনতে, পারিনি। ও আসে না। প্রকৃতির প্যালেটে যে রঙের ছড়াছড়ি তার সঙ্গে তো আলোর গোপণ চুক্তি আছে, সে কি করে আনবো আমার শুকনো কাগজের উপরে কেমিক্যাল রঙ দিয়ে?

ছোটোবেলার ঐ স্কুলে নানারকম নিয়ম টিয়ম ছিল, তারমধ্যে একটা হলো স্কুলের ব্যাজ লাগাতে হতো শার্টের বাঁদিকে, কাঁধের কাছে। কেন জানিনা একটা রুমালকে তেকোনা করে ভাঁজ করে ঐ ব্যাজের সঙ্গে আটকে দিতে হতো। বাড়ী থেকেই করে দিতো। দুপুরে স্কুল থেকে দেওয়া টিফিন খেয়ে হাত ধুয়ে ঐ রুমালে মুছতে হতো।

আর স্কুল থেকে একটা স্কুল ডাইরি দিতো, সেটার মধ্যে স্কুলের নিয়মাবলি, সারা বছরের ছুটির তালিকা ইত্যাদি সব জিনিস থাকতো। তখন আমরা বুঝতাম না অত, শুধু জানতাম ঐ ডাইরি প্রত্যেকদিন সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। কারণ দিদিমণি যেকোনোদিন ঐ ডাইরি চাইতে পারেন আর কিছু লিখে দিতে পারেন। সেরকম হলে বাড়ীতে দেখিয়ে বাবার থেকে বা মায়ের থেকে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেরকমও বলে দিয়েছিলেন দিদিমণিরা। আসলে ডাইরিটা মনে হয় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের যোগাযোগের একটা উপায় ছিল।

(চলবে)

Saturday, April 5, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৬)

তখন আমরা নতুন উঠেছি ক্লাস নাইনে। তখন রাজ্যের শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষাবর্ষ একটু বদলে গেছে, বার্ষিক পরীক্ষা আর নভেম্বরে হয় না, হয় মার্চ-এপ্রিলে, রেজাল্ট বেরোয় মে মাসে। তারপরে নতুন ক্লাসে ওঠা।

ভরা গরমের দিনে নতুন ক্লাস, আগেকার দিনের সেই জানুয়ারীর নরম শীতে নতুন ক্লাসে ওঠার মজা আর নেই। নতুন ক্লাসে কিছুদিন পড়াশোনা হয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লো। ছুটি ফুরালে যখন স্কুল খুললো তখন ক্লাসে এসে দেখা গেল বোর্ডে বড় বড় করে লেখা "গবিস্‌"।

গবিস্‌!!!! এর মানে কী? কে লিখলো এটা? এটা কি বাংলাভাষার কোনো শব্দ? আমাদের রসিক বন্ধু শ্রীতমা বললো এটা হলো গবেটের বহুবচন। সম্মিলিত হাসাহাসির পরে দ্রুত ঝোলানো বোর্ডটা উল্টে দেওয়া হলো। বোর্ডের পিছনের দিকে গবিস রয়ে গেল, সামনের দিকে দিদিমণিদের বোর্ডওয়ার্ক (অথবা কখনো ছাত্রীদের বোর্ডওয়ার্ক) চলতে থাকলো।

ক্লাস নাইন ছিল আমাদের বহু-আকাঙ্ক্ষিত ক্লাস, কারণ ঐ ক্লাসে ক্লাস-টিচার ছিলেন বনবাণীদি। এই দিদিমণির কাছে পড়ার জন্য আমরা অল্পবিস্তর সকলেই আগ্রহী ছিলাম। বনবাণীদি ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী আর বাংলাসাহিত্যের নানাদিকে বেশ ভালোরকম পড়াশোনা ছিল ওঁর। পড়াতেনও চমৎকার। শুধু ক্লাস নাইনেই তো না, ক্লাস সিক্সে যখন প্রথম ইংরেজী পড়া শুরু হলো আমাদের, সেই ক্লাসেও বনবাণীদি ইংরেজীর ক্লাস নিতেন আমাদের সেকশনে।

আমাদের সময়ে রাজ্যের শিক্ষানীতি অনুসারে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজীর কোনো পাট ছিল না সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বাংলামাধ্যমের স্কুলে স্কুলে। অবশ্য অনেক ইংরেজী-মাধ্যম প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল ছিল, সেখানে যারা পড়েছে তারা ইংরেজীতেই পড়েছে বটে। কিন্তু সে আবার ছিল আরেক মেরু। সেখানে সব বিষয়ই ইংরেজীতে পড়ানো হতো, শুধু বাংলার একটা ক্লাসে বাংলা। এ থেকে যারা পরে এসে সেকেন্ডারি স্কুলে ঢুকলো তাদের মানসিক অবস্থা কী হলো সে আমরাই বা বুঝবো কী করে?

আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের, তারা প্রথম ইংরেজী বই পেলাম ক্লাস সিক্সে, বইয়ের নাম লার্নিং ইংলিশ। কিন্ডারগার্টেনে শেষ ইংরেজী পড়ে আসার পরে এই প্রথম। কী অদ্ভুত প্রহসনের মতন ব্যাপার! এই লার্নিং ইংলিশ বইয়ে গ্রামার টামার কিছুই ছিল না, কিছু কিছু ইংরেজী গল্পের অংশ আর কথোপকথন এইসব ছিল। বহুলোকে খুব খাপ্পা হয়ে গেছিলেন, এইভাবে আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে বলে। ঐ বইকে তারা বলতেন বার্নিং ইংলিশ। এইভাবে আমরা কিছুতেই ঐ নতুন ভাষা শিখতে পারবো না ভালো করে লিখতে পারবো না-এই আশংকা ছিল। আশংকার কারণ ও ছিল, সত্যিই আমাদের ইংরেজী তেমন কিছুই শেখা হচ্ছিল না। আসলে যে পদ্ধতিতে শেখানোর কথা ছিল, সেটা অনুসরণ করা হচ্ছিল না প্রায় কোথাওই। শিক্ষিকারা সবাই আগের ব্যাকরণ-নির্ভর ভাষাশিক্ষার আমলের মানুষ, তাই এই নতুন পদ্ধতি তাঁদেরও বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছিল না।

আসলে ঐ বইয়ের নেপথ্যে ধারণা ছিল সরাসরি কথা শোনা আর বলার মধ্য দিয়ে ভাষাটা শেখা, শুকনো ব্যাকরণ পড়ে পড়ে নয়, বা শুধু লিখিত গদ্য পড়ে পড়ে নয়। ক্লাস সিক্সেই এটা আমাদের বনবাণীদি বুঝিয়েছিলেন, ক্লাসে ছোটো ছোটো গ্রুপ তৈরী করে ইংরেজী বলানোর চেষ্টাও উনি করিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি আর ঐ সৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয় নি। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা আর পরীক্ষার তাড়নার মধ্যে সমস্ত নতুন ধরণের চেষ্টাই বন্যায় ভেসে যায়।

তাই নাইনে উঠে আমরা দেখতে পাই ঐ নোট নিয়ে নিয়ে মুখস্থ করা টাইপ জিনিসই চলছে, এমনকি গোটা রচনা অবধি মুখস্থ করানোর ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে। নিজে নিজে কিছু লেখার চেষ্টা একেবারে নো নো। কারণ ঐ করতে গিয়ে যদি নম্বর কম হয় মাধ্যমিকে? তখন তো টিউটরদের ঘাড়ে দোষ পড়বে।

ক্লাস নাইন থেকেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে যাওয়া প্রায় মাস্ট হয়ে গেল, অন্য বিষয়ে না হলেও ইংরেজী আর অংকের জন্য প্রায় স্বতঃসিদ্ধের মতন হয়ে গেল। অনেকে স্কুল ছুটির পরে স্কুল থেকেই সোজা প্রাইভেট পড়তে চলে যেত দল বেঁধে। কাছাকাছি বাংলা বয়েজ স্কুলের একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানো ছিল খুবই বিখ্যাত, তাঁর নোট আর সাজেশন নাকি একেবারে মোক্ষম, তাই বহু ছেলেমেয়ে ওঁর কাছে পড়তে যেত।

"অন্বেষা, তোর মনে আছে সেই বিকেলের ব্যাচে আমাদের ঐ বায়োলজি স্যর এর কাছে পড়তে যাওয়ার কথা? তুই অবশ্য ওঁর কাছে পড়তিস না। তেমাথা মোড়ে তুই সাইকেল চালিয়ে তোর বাড়ীর দিকে চলে যেতিস আর আমরা সব ঐ স্যরের বাড়ীর দিকে।" আমি পকোড়ায় কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে বলি।

অন্বেষার ওখানে সেদিনের গেট-টুগেদারের পরে আবার এই দেখা, আজ অবশ্য আমি একাই। পুরানো স্কুলের জন্য সেই ফান্ড রেইজিং এর ব্যাপারটা আর খুব বেশী এগোয় নি এখন অবধি। তবে ভবিষ্যতে হতেও পারে, আশা ছাড়া কখনোই উচিত না।

আজকে সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে এমনিই দেখা করতে নেমন্তন্ন করেছিল অন্বেষা। আসলে সামনেই আমাদের একটা ছোটো ট্রিপ নেবার পরিকল্পনা আছে কিনা! ওর বানানো পকোড়া আর গরম চা খেতে খেতে গল্প করতে করতে অবধারিতভাবে উঠেছে স্কুলবেলার কথা, দুইজনেই আবার ডুবে গেছি স্মৃতিচারণে। পরদিন আর তারপরদিনও ছুটি, আজ অনেক রাত অবধি আড্ডা দিলেও ক্ষতি নেই। সেই কলেজের দিনগুলোর আড্ডাস্মৃতি মনে পড়ে, অবশ্য তখন অন্বেষাকে পাই নি।

অন্বেষা এখনো আগের মতনই আছে প্রায়, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, কিশোরীর মতন মুখ। ওর কথা যখন শুনি, তখন সেই ইস্কুলবেলার কন্ঠস্বর মনে পড়ে। অন্বেষা বলছিল, "মুখস্থ করে করে রচনা লেখার ব্যাপার বিপজ্জনক, কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভয়ের ব্যাপার কোন্‌টা জানিস তুলি? ঐ মুখস্থ করার যে সংস্কৃতিটা তৈরী হয়ে গিয়েছিল, সেটা গ্রাস করে ফেলেছিলো আমাদের ভাষাশিক্ষা আর সাহিত্যকেই শুধু না, গ্রাস করে ফেলেছিল গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ণ, জীববিজ্ঞানকেও। অথচ এইসব বিষয়গুলো হলো বিজ্ঞান, যাচাই করে দেখার বিদ্যা, চিন্তাকে মুক্ত করতে শেখার বিদ্যা, নতুন প্রশ্ন করতে শেখার বিদ্যা। বইয়ে যা পড়লাম সেসব সত্যি সত্যি হয় কিনা তা যাচিয়ে বাজিয়ে দেখার বিদ্যা। এটাই ছিল না আমাদের কোথাও। গোটা সমাজে এক অদ্ভুত বাধ্যতার সংস্কৃতি-মেনে নাও মেনে নাও,প্রশ্ন নয়, কোনো প্রশ্ন নয়।" অথচ তাহলে তো এইগুলো শেখার কোনো অর্থই আর থাকে না! তোতাপাখির মতন বুলি তুলে যাওয়া শুধু!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও হেসে ফেলি, বলি, "তুই আগের মতই আছিস।আগেও এইসব আদর্শবাদী কথাবার্তা বলতিস আর বাকীসব বুদ্ধিমতী চৌকোশ মেয়েরা রেগে যেত শুনে। ওরা বলতো অত যাচাই বাছই করে দেখে কোন ডঙ্কাটা বাজবে আমার কেরিয়ারে? আরে বাবা মুখস্থ করে উগরে দিয়ে যদি কোনোক্রমে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বেড়াটা টপকাতে পারি, তাহলেই কাফি। একবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়ে গেলে মার দিয়া কেল্লা, ও একেবারে শিওর শট লাইন। ক্যাম্পাস থেকেই রিক্রুট করে নিয়ে যায় বড়ো বড়ো কোম্পানি। তারপরেই লাখ বেলাখ মাইনে। "

অন্বেষা হাসতে থাকে, বলে, "ঐ লাখ বেলাখই ছিল মূল আকর্ষণ। কী কাজ যে করতে হবে, কী ধরণের স্কিল যে শিখতে হবে, সেই ব্যাপারে কারুর তেমন হেলদোল দেখিনি, যেন সেটা নিতান্ত বাইরের ব্যাপার। যেন কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা বা নতুন কিছু উদ্ভাবন সব করবে "অন্য কেউ বা কারা" আর আমরা শুধু লাখ বেলাখ কামাবো। এরকম হয় কখনো? হয়েছে জগতের কোথাও? "

আমি নিমতেতো মুখে বলি, "সেই লাখ বেলাখ প্রত্যাশিনীরা এখন অনেকেই গৃহবধূ, এখন অবশ্য নতুন শব্দ আছে একটা এর জন্য, "হোম মেকার ", ওদের স্বামীরা চাকরি করে, ওরা সংসার সামলায়, বাচ্চা মানুষ করে। আমাদের মা কাকীমা বা তারও আগের ঠাকুমাদিদিমাদের আমলের থেকে তাহলে কোথায়ই বা তেমন তফাৎ হলো?"

অন্বেষা বলে, " অনেকে তো রীতিমতন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়েছিল, চাকরি শুরুও করেছিল। তারপরে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা নাকি চান না। আর ব্যস, অমনি ওরাও ছেড়ে দিল। অবাক লাগে! তাহলে এতকিছুর কী প্রয়োজন ছিল বা? "

আমি বলি, "আর সেইসব প্রমিসিং ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছেলেরাও তো সেই কোনো বড়ো বা ছোটো কোম্পানীর কর্মচারী। তাদের অনেকেই তো শুনি নিজের কাজে নিজেই সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু নিরুপায়, একটা উপার্জনের পথ তো চাই।"

অন্বেষা বলে, "জানিস, অনেকের মধ্যে নানারকম ন্যাচেরাল ট্যালেন্ট ছিল। এই তো আমি যাদের চিনতাম, তাদের মধ্যেই আশিস, সুনন্দা, ঋভু, তাপসী ভালো ছবি আঁকতো, হয়তো আর্ট কলেজে ভর্তি হলে এর সেখানে শাইন করতে পারতো, কাজেও শান্তি পেত। হাজার হোক মানুষ তো শুধু টাকা কামানোর যন্ত্র না, একটা মনের শান্তিও তো চাই। কিন্তু তখন এই পড়াশোনায় ভালো ছেলেমেয়েরা যদি বলে বসতো আর্ট কলেজে ভর্তি হবো, শিল্পী হতে চাই-তাহলে হয়তো বাড়ীতে কুরুক্ষেত্র লঙ্কাকান্ড টাইপ কিছু বেঁধে যেত। মারধোর কান্নাকাটি দরজা বন্ধ করে রেখে দেওয়া, সবই হতে পারতো। ভেবে দ্যাখ, কী প্রচন্ড সামাজিক চাপ ছিল এইসব ছেলেমেয়েদের উপরে। "

আমার মনে পড়ে যায় গৌরব বলে ছেলেটির কথা, আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়তো, পড়াশোনায় ভালো বলে এমন চাপেই তাকে রাখলো তার অভিভাবকরা যে ওর আসল যে আকর্ষণ ছিল সাহিত্য, সেটার কথা কাউকে বলতেই পারলো না ও। এখন মানসিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে, চাকরি ছেড়ে এখন বাড়ীতেই আছে, মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি হলে রিহ্যাবে নিয়ে যান ওর বাবা।

অন্বেষাকে ওর কথা বলতে সে বলে, "আমাদের ঐ এগারো বারো ক্লাসে যখন আমাদের নিজস্বতা, সৃজনশীলতা, মৌলিক ক্ষমতা এগুলোর গুরুত্ব পাবার কথা, ঠিক তখনই ওগুলোকে একটা বিরাট গ্রাইন্ডিং মেশিনে গুঁড়িয়ে দিয়ে বাছা বাছা সব ছেলেপুলেকে ডাক্তারি আর ইনজিনিয়ারিং এর লাইনে জোর করে ঠেলে দিয়ে কী মারাত্মক ক্ষতি যে করেছে সমাজ, সে আর বলার না। তুলনায় যারা সো-কলড মাঝারি মানের ছাত্রছাত্রী ছিল, তারা কেউ কেউ বেঁচে গিয়েছিল ঐ চাপ থেকে। যদিও ওদের অনেকভাবেই আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতো চারপাশের লোকেরা, "ওরে তোর আর কিছু হবে না" বলে বলে, কিন্তু তবু কেউ কেউ সেসব পার হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পেরেছে। আমাদের ক্লাসের সঞ্চিতাকে মনে আছে কি তোর? হয়তো মনে নেই, ও তো একেবারে সাধারণ মানের ছাত্রী ছিল। কিন্তু ও ভালো ছবি আঁকতো, পরে তো আর্ট কলেজে পড়েছে, এখন ওর নিজের আঁকার স্কুল আছে একটা , ছোটো বাচ্চাদের আঁকা শেখায়। নিজেও ছবি আঁকে আগের মতন। নানা জায়গায় নিজের ছবির প্রদর্শনী করে। খুব ভালো লাগে আমার।"

আমার মনে পড়লো সঞ্চিতাকে, কিশোরীবেলার সঞ্চিতা। গোলগাল মুখ, চশমা পরা, ফরসা মেয়েটা চুপ করে বসে থাকতো পিছনের দিকের বেঞ্চিতে। ও ছবি আঁকতো ? কখনো জানতে পারিনি তখন।

(চলবে)

Thursday, April 3, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৫)

তখন আমরা ক্লাস সেভেনে। সেইবার পুজোর ছুটি পড়ার আগে আগে একটা সাংস্কৃতিক সংস্থা থেকে ছাত্রীদের মধ্যে যারা ছবি ভালো আঁকে তাদের কাছে আঁকার প্রস্তাব এলো। সেগুলো থেকে নির্বাচিত ছবিগুলো প্রদর্শনীরও নাকি ব্যবস্থা হবে স্কুলে, পুজোর ছুটির সময়। দর্শকেরা সেই ছবি কিনতে চাইলে তাদের সেই ছবি বিক্রি করে শিল্পীকে সেই অর্থের তিন-চতুর্থাংশ দেওয়া হবে। আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ, এরকম আগে কখনো দেখিনি বা শুনিনি আমরা। ছবির বিষয়বস্তু বলে দেওয়া হলো ঐ সংস্থার তরফ থেকেই, বিষয় ছিল "ভবিষ্যতের পৃথিবী"।

আমাদের ক্লাসের ইমা ভালো ছবি আঁকতো, ফর্মালি আঁকা শিখতোও ও, ঐ বয়সেই বেশ পাকা হাত ছিলো, একবার এমন সুন্দর এক মা-পাখি আর ছানা-পাখি এঁকেছিল যে আমাদের চোখ গোল্লা গোল্লা। মা-পাখি শিশির টুপটুপে লতা পা দিয়ে ঝাঁকিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল খাওয়াচ্ছিল মুখ হাঁ করে বসে থাকা ছানাকে, আর ওদের দুইজনের উপরে পড়েছিল কেমন এক সোনালি আলো, নতুন সকালের। "মা ও শিশু" শিরোনামে ছিল ওই ছবি। ও জিনিস ভুলতে পারিনি, এত সুন্দর ছিল।

তো এই "ভবিষ্যতের পৃথিবী" থীমে ছবি আঁকার বরাত এসেছে শুনে আমি আর শুভমিতা গিয়ে ইমাকে খোঁচাচ্ছি, "ইমা, তুই এই টপিকে দারুণ একটা ছবি আঁক। আচ্ছা, কী আঁকবি? আকাশে ভাসা শহর, সবাই ছোট্টো ছোট্টো উড়নযানে করে যাচ্ছে-এরকম?"

ইমা হেসে বললো, "না, ওসব না, আমি আঁকবো তিনটে কঙ্কাল হাত ধরাধরি করে নাচছে, এক পাশে তুলির, মাঝে শুভমিতার আর তৃতীয়টা হলো এই আমার কঙ্কাল।"

এই জবাব শুনে আমাদের সম্মিলিত হি হি হো হো শুনে আশপাশ থেকে অন্যরা এসে যোগ দিল আলোচনায়। আহা, সত্যিই তো বলেছে ইমা, অনেক দূর ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আমরা তো আর থাকবো না, তখন আমরা কঙ্কালমাত্র, তাও যদি দাহ না করে এমনি কফিনে পুরে সমাধি দেয় তাহলেই ! নাহলে পুড়িয়ে দিলে তো ছাই হয়ে জলে মাটিতে আগুনে আকাশে বাতাসে মিশে একেবারে একাকার হয়ে যাবো।

আমাদের আলোচনা হাসাহাসি থেকে যখন এরকম গুরুগম্ভীর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তখন ঢং ঢং ঢং পাগলাঘন্টি টাইপের ঘন্টা, ছুটির ঘন্টা। কী ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি কেন? শোনা গেল আজ দুই পিরিয়্ড আগেই ছুটি হয়ে যাচ্ছে, কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মীটিং নাকি আছে দিদিমণিদের।

আমাদের আর পায় কে! ছুটি মানেই মজা। ভূগোলের একটা ক্লাস ছিল পরের দিকে, বাতিল হয়ে গেল, বাঁচা গেল। ভূগোলের দিদিমণি সিরিয়াস টাইপের, ক্লাসে এসে জনে জনে দাঁড় করিয়ে পড়া ধরেন, অনেকেই তার জন্য এই ক্লাসটা বিষয়ে একধরণের ভয় বিরক্তিমিশ্রিত মনোভাব পোষণ করে।

পুজোর ছুটির আগের ক্লাসগুলো করতে এমনিতেই ইচ্ছে করে না আমাদের, আর ক'টাদিন পরেই বড় উৎসব, দিন গোণা শুরু হয়ে যায়। বাইরে তখন পুজো পুজো গন্ধের রোদ্দুর, ঝুম বর্ষা শেষ, মাঝে মাঝেই সাদা মেঘ সরে সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশের চাঁদোয়া, সবুজ মাঠ জুড়ে খুশিয়াল মাথা নাড়াচ্ছে কাশফুলেরা। এরকম সময়ে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে নাকি কারুর?

পুজোর ছুটির পরে স্কুল খুলেই বার্ষিক পরীক্ষা হতো সেইসব দিনে, সেইটা ছিল একটা উদ্বেগের বিষয় বটেই। তবে উৎসবের মধ্যে সেই নিয়ে মাথা ঘামাতে কেউ রাজী ছিল না। অনেকের সারাবছরে এই সময়্টাই কেবল নতুন জামাকাপড় হতো, সেই জামা গায়ে দিয়ে সেজেগুজে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বিকেল থেকে সন্ধ্যে পার করে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা আর মোগলাই বা এগরোল খাওয়া আর তারপরে কোল্ড ড্রিংক খাওয়া।

চারিদিকে আলোয় আলো, লোকে লোকারণ্য, মাইকে মাইকে নন-স্টপ নানা গান বাজছে অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাণ কিছু হচ্ছে বা কোনো ঘোষণা হচ্ছে। তিনটে দিন, সপ্তমী অষ্টমী আর নবমী। এই তো। তারপরেই দশমীতে সব সমাপ্ত। বই নিয়ে পড়তে বসা, পরীক্ষার পড়া তৈরী, আগের রুটিন। মাঝে মাঝে অবশ্য লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, ভাইফোঁটা উৎসব থাকে, তবে সেসব ঐ তিনদিনের মতন না। এই ছুটি ফুরালে স্কুল খুলেই বার্ষিক পরীক্ষা, এই ব্যাপারটা পরে অবশ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছিল। পরবর্তীকালে বার্ষিক পরীক্ষা সরে গেছিল মার্চ-এপ্রিল মাসে। তবে আমাদের ততদিনে আমরা বড় হয়ে গেছিলাম, মাধ্যমিক পরীক্ষা কাছিয়ে এসেছিল।

স্মৃতি থেকে জোর করে ছিঁড়ে এসে সামনে বসা এখনকার ইমার দিকে চেয়ে থাকি, কত বদলে গেছে সে। গিন্নিবান্নি চেহারার মহিলা হয়ে গেছে সেইদিনের পালকের মতন হালকা সেই কিশোরী। এখন নাকি আঁকাআঁকি একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। কাজকর্ম সামলাতে, সংসার সামলাতে আর দুরন্ত বাচ্চা সামলাতে একেবারে যাকে বলে সদাই শশব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়।

অন্বেষার বাড়ীর গেট টুগেদারে গিয়ে সেদিন একেবারে সারপ্রাইজড হয়ে গেছিলাম। দেখলাম ইমা এসেছে। ওর এদেশে আসার কথা কিছুই জানতাম না, অন্বেষাও কিছু জানায় নি। মাত্র নাকি মাসখানেক হলো এসেছে ওরা। ইমা, ওর স্বামী সায়ন আর দুই বছরের ছেলে প্লাবন। সে নাকি এত দুরন্ত যে ইমার একদন্ড শান্তিতে বসার উপায় নেই। এখন মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য স্বামীর হেফাজতে ছেলেকে দিয়ে বন্ধুর বাড়ী নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছে।

গেট-টুগেদার অনেক বদল হয়ে গেছিল, বিদিশা আসে নি, কাবেরী আসে নি। যাদের আসার কথা ছিলো তাদের মধ্যে কেবল তিয়াসা আর মনামী এসেছিল। আর সারপ্রাইজের মতন এই ইমা। শেষ অবধি ঐ পুরানো স্কুলের জন্য ফান্ড রেইজিং প্রোজেক্ট এর আলোচনা না হয়ে এমনি সাধারণ সামাজিক পুনর্মিলন পার্টিতে দাঁড়ালো সেটা। তবে মন্দ লাগছিলো না, এটা ওটা নানারকম সুস্বাদু স্ন্যাকসের সঙ্গে গরম কফি খেতে খেতে পুরানোদিনের স্মৃতি রোমন্থন। আয়োজন ভালোই ছিলো অন্বেষার।

এর মধ্যেই তিয়াসার গানও শোনা হলো। ভারী সুন্দর গলা তিয়াসার, এত সুর গলায়! কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় ও গাইছিল "নিবিড় অমা তিমির হতে বাহির হলো/বাহির হলো জোয়ারস্রোতে/ শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী"। ওর গান শুনতে শুনতে আবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম অতীতে, তখন এই গান ছিল আমাদের আরেক ক্লাসমেট রুমেলির গলায়, সেই কিশোরীবেলাতেই রুমেলি গানে নাম করেছিল। টিভির অনুষ্ঠানে গেয়েছিল কয়েকবার, তখন আমরা মোটে ক্লাস সিক্সে। কী উৎসাহ উদ্দীপনা ওকে নিয়ে তখন ওর অভিভাবকদের ! কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারের হাজারো সমস্যার যাঁতাকলে কত সহজেই চাপা পড়ে যায় স্বপ্নেরা! কতদিন থাকে ফুলের ঋতু? ক্ষুরধার শীতবাতাস এসে সব খসিয়ে দিয়ে যায়।

রুমেলি তবু পড়াশোনার পাশাপাশি গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। হয়তো ভিতরে ভিতরে স্বপ্নটাকে লালন করতো। একদিন খুব বড় গায়িকা হবার স্বপ্ন। উচ্চমাধ্যমিকের পরেই রুমেলির বিয়ে হয়ে যায়, ওর শ্বশুরবাড়ী থেকে নাকি এর পরে বলা হয় ঘরের বৌ গান করবে বাইরে জলসা ইত্যাদিতে, এ তাঁরা চান না। রুমেলি গান ছেড়ে দেয়। হয়তো স্বেচ্ছায়, হয়তো অনিচ্ছায়, কেজানে! কার কথাই বা বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায়?

তবু গান রয়ে গেছে, এখন এই যেমন তিয়াসার গলায় ফুটে ওঠেছে সেই গান, আরো সমৃদ্ধ, আরো সুরেলা হয়ে। হয়তো আমাদের স্বপ্নগুলো ও মরে না, এইভাবে কোথাও না কোথাও থেকে যায়। হয়তো অবিনাশী ফিনিক্স পাখির মতন বারে বারে পুনর্জাত হয়ে উঠে আসে মৃত্যু-অগ্নি থেকে।

(চলবে)

ইস্কুলবেলার গল্প(১৪)

"হ্যালো, তুলি?" ফোনের ওপাশ থেকে অন্বেষার গলা।

হেসে বলি, "হ্যাঁ রে টেঁপি, আমি। বল।"

অন্বেষা বেশ অনেকদিন টেঁপিতে আপত্তি করতো না, ভেবেছিলাম বুঝি ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু আজকে ওপাশে সে রেগে ফায়ার, বলে, "তোকে বলেছিলাম টেঁপি বলে না ডাকতে। বন্ধুর একটা কথা রাখতে পারিস না?"

আমি হি হি করে হেসে বলি, "টেঁপি নামটা আমার বেশ ভালো লাগে রে। কেন এই নামে ডাকতে বারণ করিস? তোর নাম তো আর ভন্তুরি না? আমার ছোটোবেলার আঁকার ক্লাসের এক বন্ধুনি ছিল, ওর ডাক নাম ছিল ভন্তুরি। কেমন করে জানি নামটা জানাজানি হয়ে যায় ক্লাসে, আর যায় কোথা? সবাই ঐ নামে ডেকে ওকে ক্ষ্যাপাতো। সেই তুলনায় তোর ডাকনাম তো দারুণ চমৎকার।"

ওপাশে অন্বেষার রাগী মুখ না দেখেও বুঝতে পারি, হয়তো মুখ ভ্যাঙাচ্ছে, কেজানে! রাগ ভাঙানোর জন্য নানা ভুজুং ভাজাং দিলাম খানিকক্ষণ। কিন্তু ও ওপাশে চুপ। হয়তো বেশী রেগে গেছে।

যাইহোক খানিক পরে ওর গলা এলো আবার, এবারে সিরিয়াস। বললো, "শোন তুলি, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় আমার এখানে আমাদের পুরানো স্কুলের কয়েকজন বন্ধু আসছে, স্কুলের ব্যাপারে ফান্ড-রেইজিং এর একটা প্ল্যান হবে। তুই আসতে পারবি?"

টকটক করে মাথার ভিতর হিসেব চালু হয়, আগামীকাল বিকেল পাঁচটা? তার মানে সাড়ে চারটের মধ্যে কাজকর্ম গুটিয়ে যেতে হবে। বিকেল পাঁচটায় বন্ধুদের পুনর্মিলন উৎসব চালু হলে কত রাত গড়াবে ঠিক নেই। সেসব সেরে-

"কী রে, পারবি আসতে?" ওপাশ থেকে অন্বেষা আবার প্রশ্ন করে।

আমি নরম গলায় বলি, "আগামীকাল বিকেল ছটায় শুরু করতে পারিস? তখন হলে নিশ্চিন্তে যেতে পারি। নইলে একটু হাঁসফাঁস হয়ে যায় আরকি।"

"ঠিক আছে, তুই ছটায় আসিস। বাকীরা যারা পারবে পাঁচটায় আসবে, এক ঘন্টার জন্য আর তেমন কী?"

"থ্যাংক ইউ। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো ঐ সময়ে। পট লাক পার্টি করছিস নাকি? তাহলে একটা কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে পারি।"

" আরে না না, পটলাক না। তোর কিছু আনতে হবে না। মাত্র তো তুই আমি আর আরো পাঁচজন মত। চায়ের পার্টি। "

"ঠিক আছে, আমি যাবো। আর কে আসছে রে? বিদিশা, কাবেরী আসছে?"

"বিদিশার থেকেই তো এইসব প্ল্যান শুরু। ও আসবে তো বটেই। কাবেরী আসতে পারে, তবে ওর মেয়েটার নাকি জ্বর, ভালোর দিকে গেলে আসবে। আর আসছে তিয়াসা, মনামী আর মৌপিয়া।"

"আচ্ছা, দারুণ। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। এখন রাখি, হ্যাঁ?"

ফোন বন্ধ করে জানালার কাছে যাই। বাইরে ঝকঝকে মধ্যগ্রীষ্মের বিকেল। ছায়ামেলা বিরাট বিরাট গাছ, ঘন সবুজ পাতায় ভর্তি। বৃষ্টি এলে এরা কী উল্লসিত হয়ে ওঠে! দেশে এখন ভরা বর্ষা, বৃষ্টি নাকি হয়েই চলেছে প্রতিদিন। এক বেলা শুকনো থাকে তো পরের বেলাতেই ঢালে।

রোদভরা দুপুরটা মিলিয়ে গিয়ে অনেক আগের সেই ইস্কুলবেলার বর্ষা মনে পড়ে। মনে পড়ে অন্বেষা, মনামী, কাবেরী, বিদিশার কিশোরীবেলার মুখগুলো।

বৃষ্টি নামার সময়গুলো কখনো স্কুলে আসার সময়ের সঙ্গে মিলে যেত সেসব দিনে। সবাই স্কুলে আসতাম বেশ দূর দূর থেকে, সাইকেল চালিয়ে। ছাতা নিয়ে সাইকেল চালানো বেশ কৌশলের ব্যাপার, সবাই পারতো না। তাই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে কেউ কেউ পৌঁছতো। মাঝে মাঝে অবশ্য রেনি ডে হয়ে ছুটিও হয়ে যেত।

একবার অন্বেষা খুব ভিজেছিল। ওর সেদিনের বৃষ্টিভেজা চুপ্পুস মুখ মনে পড়ে, চুলগুলোর প্রান্ত বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল, হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্ছো করে এমন হাঁচি দিচ্ছে যে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বড়দি (তখন বড়দি ছিলেন ভাস্বতীদি) ছুটি দিয়ে দিলেন। সেইবার বেশ ভুগেছিল অন্বেষা, সপ্তাহখানেক ইস্কুলে আসতে পারে নি। তখন ক্লাসে কী হলো, কদ্দুর পড়া এগোলো সেসব ওকে দেখিয়ে দিয়ে আসতো ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু লীনা।

লীনা এখন কোথায়? অন্বেষাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই লীনার বিয়ে হয়ে গেছিল ওর পরিবারের ঠিক করে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে, লীনার ইচ্ছে ছিল না, ও আরো পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু ওর উপায় ছিল না। ওদের পরিবার বেশ দরিদ্র ছিল, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েকে পড়াতেই নাকি অনেক কষ্ট গেছে, আর সাধ্য নেই। যদিও লীনা ক্লাস নাইন থেকেই ছাত্র-ছাত্রী পড়াতো, কিন্তু সেই ভরসায় ভালো পাত্র হাতছাড়া করে মেয়েকে কলেজে পড়ানোর ইচ্ছা নাকি ছিল না ওর বাবামায়ের।

অন্বেষার সঙ্গে সেই সময়েই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় আমার, শুধু ও একাই না, বাকী আরো অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তাই বহু কথাই অজানা রয়ে গেছে। ওর সঙ্গে মনে হয় কারুর কারুর যোগাযোগ রয়েই গেছিল, তাই এতদিন পরে ঐ পুরানো ইস্কুলের জন্য কিছু করার একটা প্রোজেক্ট হাতে নিতে চাইছে ওরা।

এই ব্যাপারের শুরুটা হয়েছিল কয়েকমাস আগে। তখন বিদিশা দেশে গেছিল, নানা ব্যস্ততার মধ্যে সময় বার করে আমাদের পুরানো স্কুলে গেছিল ও। এখন স্কুলের শিক্ষিকারা প্রায় সবাই নতুন, আমাদের আমলেররা দুই চারজন ছাড়া প্রায় সকলেই অবসরে। নতুন প্রধানা শিক্ষিকা লাবণ্যপ্রভাদির সঙ্গে দেখা করে বিদিশা অনেক কথা আলোচনা করে। ওর প্রধান আগ্রহ ছিল ছাত্রীদের কেরিয়ার কাউন্সেলিং এর ব্যাপারে সাহায্য করার যদি কোনো আয়োজন করা যায়, এইটার খুব অভাব ওখানে আজও।

আমাদের সময়ে তো চিহ্নমাত্র ছিল না এর, যে ক'জন হিসেব নিকেশ করে ভালো কেরিয়ার বানাতে পেরেছে, সবই ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা নিজের পরিবারের সহায়তায়। কিন্তু বহু মেয়ে যারা নানা ধরনের স্কিলে সমৃদ্ধ ছিল, ভাবনাচিন্তায় সমর্থ ছিল, জীবনে ভালো পেশাগত কাজ করতেও ইচ্ছুক ছিল, স্রেফ সাহায্য না পেয়ে, গাইডেন্সের অভাবে সেসব করতে পারে নি। সমাজ এমনিতেই মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়াকে মান্যতা দেয় না, নানাভাবে আটকাবার চেষ্টা করে, তার উপরে আমাদের গাঁয়ে মফস্বলে তো মেয়ের কোনোরকমে আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলেই ঘটকালি করে সম্বন্ধ-বিয়ে দিয়ে দেয়। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে তারপরে পেশাগত জীবনে আসা একরকম আকাশকুসুম কল্পনা।

সেইজন্যেই বিদিশার একটা প্ল্যান ছিল স্কুলের লাইব্রেরীটাকে একটু সম্প্রসারিত করে সেখানে হাই স্পিড ইন্টারনেট ওয়ালা কিছু কম্পুটার বসিয়ে দিলে আর এর সুপারভিশনে কোনো অল্পবয়সী দিদিমণি থাকলে, যিনি নানাধরনের চাকরির খোঁজ খবর রাখেন, তিনি আগ্রহী ছাত্রীদের দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে পারবেন স্কুলের পরে কী ধরনের কাজের জন্য কী ধরনের ট্রেনিং নিতে হয়---এইসব। এখন, এই আন্তর্জালের যুগে তথ্য পাওয়া খুব অসুবিধের হওয়ার কথা তো না। সেই নিয়েই নাকি আলোচনা হয় লাবণ্যপ্রভার সঙ্গে, ও অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্রীদের থেকে আর্থিক সাহায্য যোগ করে একটা ফান্ড তৈরীর প্রাথমিক প্রস্তাব দেয়।

বিদিশা দেশ থেকে ফেরার পরে তখনও অন্বেষার বাড়ীতেই একটা গেট টুগেদার হয়েছিল, সেখানেই এইসব নিয়ে একটা ছোটোখাটো আলোচনা হয়, তবে চূড়ান্ত কিছু স্থির হয় নি। তারপরে এতদিন আর সাড়াশব্দ পাইনি ওদের। এখন অন্বেষার ফোন আগামীকালের পার্টির। দেখা যাক কী হয়।

(চলবে)

ইস্কুলবেলার গল্প(১৩)

"টেঁপি, অরুণিমাকে মনে আছে তোর? " অন্বেষাকে জিজ্ঞেস করি।

এখন আর টেঁপি নামের জন্য বিশেষ রাগ দেখায় না অন্বেষা, মনে হয় এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

সে বলে, "কোন অরুণিমা? জীবনানন্দের? সেই যে, "মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ?"

"না রে, অরুণিমা দত্ত, আমাদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তো স্কুলে। মনে আছে? "

অন্বেষা আমার দিকে তাকায়, মনে করার চেষ্টা করে। তারপরেই মনে পড়ে যায় মনে হয়, সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে, ওর চোখের উপরে জলের পর্দা। আমাকে দেখাতে চায় না।

গতকাল একটা পুরানো গল্পের বই খুঁজে পেয়েছি, অরুণিমা দিয়েছিল আমাকে, তখন আমরা ক্লাস নাইনে। উপহারের পাতায় অরুণিমার হাতের লেখা কয়েকটা কথা, তারপরে নাম সই। কবেকার কথা সব। তারপর থেকেই ভীড় করে আসছে স্মৃতিরা।

অরুণিমা আমাদের সঙ্গে পড়তো, একইসঙ্গে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাধ্যমিকের কিছু আগে, তখন টেস্ট পরীক্ষাও হয়ে গেছে, মূল পরীক্ষা মাস দুই পরে, তখন অরুণিমা মারা যায় জন্ডিসে। সাধারণ একটা অসুখ কীভাবে জটিলে দাঁড়িয়ে গেল কেজানে! একেবারে হঠাৎই চলে গেল সে। ষোলো বছরের কিশোরী, মাথা ভরা দীর্ঘ, পিঠ ছাপিয়ে পড়া চুল, মুখখানা বৃষ্টিধোয়া স্থলপদ্মের মতন, মালিন্যহীন অথচ কেমন কারুণ্যমাখা। আজও সে সেই বয়সেই দাঁড়িয়ে আছে, সময় তাকে আর ধরতে পারে নি।

অরুণিমার কথা ভাবতে গেলেই স্পষ্ট হয়ে মনে পড়ে ক্লাস সেভেনে এক অতিথি শিক্ষিকার ক্লাস, বিটি টিচার বিপাশা দিদিমণি, তিনি ব্যাকরণের ক্লাস নিচ্ছেন, আগেরদিনের পড়ানোর থেকে জিজ্ঞেস করছেন একে এক ছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে। "মধুর" কথাটা একটা বিশেষণ, এর বিশেষ্য কী হবে? কেউ বলতে পারে না, কেউ বলতে পারে না, শেষে অরুণিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললো "মাধুর্য"। এতগুলো বছরের এত এত স্মৃতির মধ্যে এই ক্ষণটা কেন যে এত স্পষ্ট হয়ে ধরা রইলো আমার মনের মধ্যে কেজানে! "মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হলো শেষ"---প্রহর এত তাড়াতাড়ি কেন শেষ হয়ে যায়?

আমাদের তখন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো জানুয়ারি মাসের দুই তারিখে, শেষ হতো ডিসেম্বরে। বাৎসরিক পরীক্ষা হতো পুজোর ছুটির পরে ইস্কুল খুললেই, বেশ অনেকদিন ধরে চলতো পরীক্ষা। তারপরে বেশ কিছুদিন ছুটি থাকতো, তখন দিদিমণিরা খাতা দেখতেন। রেজাল্ট বেরোতো ডিসেম্বরের শেষাশেষি। রেজাল্ট বেরোনোর দিন সবার চাপা টেনশান। যতক্ষণ না ফলাফল নিশ্চিত জানা যাচ্ছে ততক্ষণ টেনশন কমে না কারুর। বেলা বারোটার আগেই অবশ্য সব ফয়সালা হয়ে যায়। যে যার রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তারপরে জানুয়ারীতে নতুন ক্লাস। নতুন বইয়ের গন্ধ। শীতের নরম রোদ্দুরের দিন।

ক্লাস ফাইভে সিক্সে সেভেনে জানুয়ারীটা হালকা হালকা সব ক্লাস, বেশীরভাগ দিনই ছুটি হয়ে যেতো নির্ধারিত সময়ের আগেই, কোনো কোনোদিন টিফিনের আগেই। দিদিমণিদের মিটিং ‌ইত্যাদি থাকলে এরকম সব হঠাৎ ছুটি পাওয়া যেতো। সেসব দিনে মজাও হতো, স্কুলের পুবের দিকের নির্মীয়মান ঘরগুলোর কোনো একটা ক'জন বন্ধু মিলে কিছুটা গল্প টল্প করে তারপরে বাড়ি।

ক্লাস ফাইভে সিক্সে কয়েকদিনের জন্য পড়াতে আসতেন বিটি টিচাররা। আসলে এঁরা ছিলেন বি এড এর ছাত্রী, শিক্ষিকা হবার জন্য ট্রেনিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতেন, যার একটা অংশ হলো স্কুলে সত্যিকারের ক্লাসে পড়ানো। তারপরে পরীক্ষায় পাশ করে এঁরা নিশ্চয় কোনো স্কুলে চাকরি পেতেন। আমাদের সাদামাঠা স্কুলদিনের মধ্যে এঁদের নতুন মুখগুলো বেশ একটা সুন্দর নতুনত্ব তৈরী করতো। যদিও কেউ কেউ অভিযোগ করতো এদের জন্য সময় নষ্ট হচ্ছে, আমাদের রেগুলার সিলেবাস শেষ হতে দেরি হবে বা হয়তো সেটা ঠিকমতন শেষ হবেই না। আবার কেউ কেউ বলতো মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য খুব এমন কিছু ক্ষতি হবে না। আমাদের রেগুলার টিচাররা ঠিকই এই ফাঁকটুকু পুরণ করে ফেলতে পারবেন। আর হতোও তাই।

ইস্কুলের পড়াশোনা তো ছিল একটা সূত্র মাত্র, বেশীটাই তো করতে হতো বাড়িতে হয় নিজেরা নিজেরাই নয় অভিভাবকের কিছু সাহায্য নিয়ে নয়তো প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নিয়ে। পরে ক্লাস নাইনে টেনে তো প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া প্রায় একরকম আবশ্যিকই হয়ে গেল। একধরনের সামাজিক শর্ত যেন!

এইসব প্রাইভেট টিউটররা বেশিরভাগই স্থানীয় বয়েজ স্কুলের বা গার্লস স্কুলের টিচার ছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বিশেষ নামজাদা। এঁরা প্রধানতঃ হয় অঙ্ক করাতেন নয়তো ইংরেজী পড়াতেন। আমাদের সময় জীববিদ্যার একজন শিক্ষকও বিশেষ সফল হয়ে উঠেছিলেন। খুবই চাহিদা ছিল এঁরও। এঁদের বাড়ীতে ব্যাচে ব্যাচে ছাত্র ছাত্রী পড়তো। একেক ব্যাচে প্রায় দশ বারোজন কিংবা তারো বেশী। ছোটোখাটো একেকটা ক্লাস বলা যায়। কেউ কেউ গ্যালারির মতন বসার ব্যবস্থা করে পড়াতেন। এসব ছিলো রীতিমতন সমান্তরাল ব্যবসা।

স্কুলগুলোতে নিয়মিত যেসব পড়াশোনা হওয়ার কথা ছিল, সেসব কিছুই হতো না। বা হলেও নামেমাত্র হতো। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী ভালো শিক্ষিকা ছিলেন, তাঁরা কিছুটা যত্ন সহকারে পড়াতেন আর তার বাইরেও ছাত্রীদের সাহায্য করতেন। কিন্তু তাঁরা বিরল। বাকীরা কেউ বিশেষ কেয়ার করতেন না ছাত্রীরা কেউ আদৌ কিছু শিখলো কি শিখলো না তাই নিয়ে।

পাশাপাশি রমরমা হয়ে উঠেছিল এইসব প্রাইভেট টুইশনের ব্যবস্থাগুলো। এর মধ্যে যে একটা নৈতিকতার অভাব আছে সূক্ষ্ম হলেও, সেটা অভিভাবকরা কেউ কেউ লক্ষ্য করলেও না দেখার ভান করতেন। আর ছাত্রছাত্রীদের তো কথাই নেই। স্কুলে ঠিকঠাক পড়াশোনা হবার আশা প্রায় কেউই করতো না। না ছাত্রছাত্রী না তাদের অভিভাবক।

আর এইসব প্রাইভেট টিউটরদের নিজেদের মধ্যেও সূক্ষ্ম রেষারেষি চলতো, কার কাছে বেশী ছাত্রছাত্রী যায়, কার কাছে তত বেশী যায় না, কার ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় কত ভালো করে---এইসব নিয়ে রেষারেষি। আর ছাত্র ছাত্রীরাও ঐসব প্রাইভেট পড়ার সূত্রেই আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে যায়। অমুক স্যর এর স্টুডেন্ট বা তমুক দিদিমণির স্টুডেন্ট ---এইরকম। কে ভালো সাজেশন দেন, কে ভালো নোটস দেন, এই সব সংবাদ ছড়িয়ে পড়তো ছাত্রছাত্রীদের মুখ মুখে।

তারপরে তো উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আরো সাংঘাতিক বেড়ে ওঠে এইসব প্রাইভেট কোচিং এর ব্যাপার, তখন অনেকেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য এক এক সাবজেক্টের জন্য দুই বা তিনজন করে প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে থাকে। এক পরিচিত মাষ্টারমশায় এর নাম দিয়েছিলেন বুস্টার ডোজ! সে এক ঘোর রমরমা কান্ড।

(চলবে)