Friday, October 3, 2014

Life Line

Once a little lovely smile
Brought me back home
From the horror of a stormy night
Towards the soft light of a rosy dawn.

Once a little white jacket
Dotted with tiny blue flowers-
Brought me back to my known world
From the depth of dark unknown.

As if it was a life-line,
I caught it when I was drowning
In the black sea of oblivion,
And swam to the ship.

Wings Of A Dragonfly

At the edge of the flowing river of golden sunshine
I saw the soft shadow of your lovely eyes-
Beyond the edge of your dark green scarf
I saw your silky hairs dancing in the air.

Wavy streams of events took me away
From all those little moments of joy
Now I am far away-
In a different world of strange lights and shades
Drowning into the sweet aroma of rain
Dreaming the translucent wings of a dragonfly.

The Beginning

It began.
Bright light, liquid and thick like honey-
Began to spread around into the darkness,
Into the pulsating heart of the unknown.
Fine arteries and veins of existence
Started to divide the reality
Into tangibles and intangibles.

Invisible shadows came together
To make indescribable patterns
Beautiful tunes arose to feel the void.
Then came the touch of life
It rose up like another light
And grew up with joy and love
Then came the touch of death
To give us the gift of immortality.

Eternal Sunshine

Under the ink-black sky of our battle-night
We stayed in tight embrace,
Around us the dark sea of desire
Danced with wild waves-
Its stormy hands tried to grab us
To pull to its blue depth of pain.
But we continued our battle -
We never gave up.

Finally we reached the shore
Flowery paths under the cool shade-trees
Welcomed us to the heart of a garden-
A garden of your heart
The garden of eternal sunshine.

Monday, August 25, 2014

নীল নক্ষত্রের কাছে

ছাদটা বেশ বড়। এখানে শুয়ে উপরে তাকালে অনেকখানি আকাশ ঝম করে ওঠে। ঋতি প্রায়ই রাতের খাবার পরে একবার ছাদে আসে। আর মাদুরটা পেতে শুয়ে পড়ে। চোখ মেলে দেখে আকাশভর্তি তারা কেমন ঝমঝম করে বাজছে! না, আসলে তারারা ঝিকঝিক করে জ্বলছে শুধু, কোনো শব্দ নেই। তবু ঋতির কানে আসে কেমন এক অপূর্ব সঙ্গীত যা আর কেউ শুনতে পায় না।

পুবের দিকে নারকেল বাগান। ওদিকে তাকালে গাছের মাথাগুলো দেখা যায়, সারি বেঁধে দিগন্তের আড়াল রচনা করেছে। সেই গাছের সারি ছাড়িয়ে ঝিকঝিক করে জ্বলে ওঠে নীল সেই তারা। অনেকদিন আগে ঋতির বাবা ওকে চিনিয়ে দিয়েছিলো ঐ তারার নাম অভিজিৎ। আস্তে আস্তে উঠে আসছে অভিজিৎ, এই তো কিছুক্ষণ আগেও ভালো করে দেখাই যাচ্ছিলো না গাছের জন্য, এখন গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে জ্বলজ্বল করছে খানিক উপরে। আরো উপরে উঠবে। একেবারে মাথার উপরে ঐখানে কখন আসবে? অনেক রাত হয়ে যাবে। একেকদিন ঋতির ইচ্ছে করে সারারাত ছাদে থাকতে, একেবারে তারাটার উদয় থেকে অস্ত অবধি। কিন্তু তা হবার নয়। এই তো মা ডাকতে শুরু করলো বলে!

কেন জীবন এভাবে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র দাবীতে? কেন কয়েকটা নির্জন মুহূর্তকে ধরা যায় না দু'হাতের অঞ্জলিতে? যা হারিয়ে যায় তা কি শুধুই হারিয়ে যায়, কখনো আর তাকে পাওয়া যায় না? সেই যে জনাই গাঁয়ের পাগলী মা অম্বা অপেক্ষায় থাকতো তার সুমনকে যে নিয়েছে সে ফিরিয়ে দেবে চুপি চুপি, গভীর রাত্রে? কখনো কি হারানো প্রিয়মুখ ফিরে আসে না জলের আয়নায়? কোনো অলৌকিক নীলপাখি ওড়া সকালে, কোনো অপার্থিব দ্যুতিময় সন্ধ্যায়?

বিলুপ্ত সেইসব শরৎসকাল মনে রাখিনি
ভুলে গেছি সেইসব আশাভঙ্গের দুঃখসন্ধ্যাও
সেইসব কথা না রাখার বিষাদ, সেইসব অকারণ কাটাকুটি-
টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতিরা-
কিছু মনে রাখিনি, মুছে নিয়েছি লবণজলের ওড়নায়।

সেইসব ছুটি-ঝিকমিক সকাল ছিলো আমাদের,
যাদুকরী রোদ্দুরে নামতা ভুলিয়ে দেওয়া সেইসব সকাল-
আকাশপৃথিবী জোড়া আশ্চর্যময়ী ভালোবাসা-উৎসব
সব হারিয়ে গেছে নি:শেষে, সে বিদায় মনে রাখিনি।

আমাদের গহীনের অরণ্য সব
থেকে যাক সবুজ থেকে সবুজতর হয়ে,
সেইসব মায়াময় নদীরা, মধুমন্তী নদীরা আমাদের-
আরো ছলছল হয়ে বয়ে যাক অলীক নীল সমুদ্রে।

সুপ্রাচীন শীতরাত্রির শনন শনন হাওয়া-
হাওয়া কাটিয়ে দক্ষিণের দিকে উড়ে চলা
কৃষ্ণপক্ষের নক্ষত্রবিলাসী পাখিরা-
ওরা ঠিকই রয়ে গেছে গোপণ আলো-অন্ধকারে।

জালের ফাঁসে বেঁধে রাখা ডানা খুলে একদিন
ওদের সাথী হয়ে আকাশে মিশে যাবার
একবুক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি
নীল নক্ষত্রের পায়ের কাছে।

নীলকলমীলতা

বহুদিন পরে কলম দিয়ে লিখতে গিয়ে চমকে উঠি, কলমটা নীল। আমার সেই কলমটাও নীল রঙের ছিলো। ঐ যে যেটা এক অপার্থিব হলুদ আলোয় ধুয়ে যাওয়া বিকালে অনেক চাঁদিয়াল ঘুড়ি ওড়া আকাশের নিচে আমাকে দিয়েছিলো শরণ্য। এইখানেই তো! এই পাথরেই তো বসেছিলাম আমরা।

কলমটা দিয়ে লিখতাম হাবিজাবি যা খুশি তাই। কাঁচামিঠে গল্প, আনকথা বানকথা গোঁজামিলের কবিতা --- সবকিছু তার শোনা চাই। একটা দিন বাদ যেতে পারতো না, বাদ গেলে তার কী অভিমান!

সে আমায় ডাকতো নীলকলমীলতা। কী যে ছিলো সেই ডাকে! কেমন একটা কাছে থাকার কোমল আনন্দের সঙ্গে সুদূরের গাঢ় বিষাদ অঙ্গাঙ্গী হয়ে জড়িয়ে থাকতো সেই ডাকে। ও কি জানতো আগে থেকেই ভবিষ্যতের কথা?

কেটে গেল কতগুলো বছর। বছরগুলো ঘন আঠালো সরের মতন, নজর চলে না বেশীদূর। বিচ্ছেদের সেই জ্বলন্ত তীব্রতা মিলিয়ে গেছে, রয়ে গেছে কেমন এক জ্বরো ক্লান্তি আর শিরশিরে কাঁপা-কাঁপা স্মৃতি।

আ:, এই হবার ছিলো? একদিন বিপুল বন্যার মতন যা মনপ্রাণকে আলোড়িত করেছিলো আজ তার স্মৃতিমাত্র সার? না এ হতে পারে না, আমাদের চেতনা অশূন্য অমৃতপাত্র, কিছুই হারাবে না, হারাবে না, হারাতে পারে না। শুধু লুকিয়ে আছে সে, একদিন প্রকাশিত হবেই।

শেষ বিকালের আলোয় আজও ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, একজোড়া টুনটুনি ওড়াউড়ি করছে শিমগাছে, থোকা থোকা রোদ লেগে আছে মস্ত মস্ত শাল মেহগিনি সেগুনের ডালে পাতায়। এমন সব বিকালেই তো আমার কত কিছু শোনানোর থাকতো ওকে!

নদীটা একই রকম আছে, এর স্রোত, তীরের পাথরবালির কারুকাজ, পাড় থেকে ঝুঁকে পড়া গাছগুলো, ঐ যে আলোছায়ার জাফরির মধ্য দিয়ে দৌড়চ্ছে জলধারা-সব, সব একই আছে। এর সুরেলা ছন্দবাঁধা শব্দ, কান পেতে শোনা গানের মতন, তবু ভাষা স্পস্ট হয় না কখনো। কোথায় যেন একজোড়া পাখি ডাকছে, টী হু টী হু টী হু। একটা ডাকে, ডাকে, চুপ করে আর তখন দূর থেকে অন্যটা সাড়া দিয়ে ওঠে। তখনও তো এরকমই পাখিরা ডাকতো সায় মেলানো ডাক। এরা কি সেই পাখিরাই নাকি তাদের নাতিনাতনিরা? কে জানে ক'বছর বাঁচে বনের এই সুরেলা পাখিরা!

নদীর আয়নায় ঝুঁকে পড়ি, আঁজলা ভরে তুলে নিই-
জীবন জীবন আহা জীবন---
দু'দিনের তৃষ্ণা, দু'দিনের ক্ষুধা
দু'দিনের ধূলাখেলা মেলামাঠ নাগরদোলার
দু'পাশে গভীর ঘুমের কবিতা।

এ মাটির কলসে পূর্ণ থেকে পূর্ণ তুলে নিই, পূর্ণ পূর্ণই থেকে যায়। এ যে সেই আশ্চর্য, একই সঙ্গে খুব কাছে আবার খুব দূরে, চলেও আবার চলেও না। সে একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন আবার অবিচ্ছিন্ন। সে চিরসংলগ্ন হয়ে আছে ঐ নীহারিকাপার দূরত্বের বাধা পার হয়ে। এই রহস্যরোমাঞ্চময় গভীর জটিল ধাঁধার মধ্যে জন্মে সামান্য নিজের চেনাটুকু হারানো নিয়ে অভিযোগ করা কি শোভা পায়?

রক্তসন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে, আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, আকাশভর্তি তারা ঝমঝম করে বেজে উঠছে। ঐ কোটি কোটি অর্বুদ অর্বুদ বছরের আদরের তারাগুলি আমার। আকাশের বাগানে থোকা থোকা নতুন মুকুলের মতন, কত পুরানো ওরা, তবু কত নতুন! "শান্ত হে মুক্ত হে হে অনন্ত পুণ্য / করুণাঘন ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য। "

টিয়ারোদ্দুর আর অতসী-হাওয়া

আমলকীবনে টিয়া রঙের রোদ্দুর, পাতারা সব কাঁপছে আর কাঁপছে অচেনা হাওয়ায়। এই হাওয়াটাই এই সময়ে আসে প্রত্যেকবার, তবু কখনো একে চেনা হয় না,এ যেন কাকজ্যোৎস্না মাঘরাত্তিরের অচিন পাগলের বাঁশির সুরের মতন। কিছুতেই বুঝে ওঠা যায় না অথচ কখন যেন সব খালি করে নিয়ে চলে যায়।

পথ হারিয়ে গেছে কতবার, তবু শেষ অবধি হারায় নি। সেই ঘরে ফিরে আসার তমাল গাছ, সেই কুটোকাটা ইঁটকাঠপাথরের ঘরগেরস্থি, সেই সব খুনসুটি ঝগড়াঝাঁটি এলোমেলো অর্থহীন দিনের পর দিন।

এর বাইরে থেকে নেই-নেই সেই হাওয়াটা ডাকে কিন্তু, টিয়ারোদ্দুরে হাতছানি দিয়ে দিয়ে। দুপুরজানালা কখন যেন ঘুমের কবিতা হয়ে যায়। তারা-ফুটফুট প্রতিপদের আকাশ-দেওয়ালি মনে পড়ে। কোথাও কোনো দরজা একটা আছে, আছেই। সেটা খোলে কেমন করে?

পথের ধারে ধারে এখানে ওখানে রেশমী নরম সরল গাছ। ওদের পাতাগুলো রোদ্দুরে ঝিলমিল করলে দূর থেকে দেখে ঠিক রেশমচুল সবজে- সবুজ মেয়ের কথা মনে পড়ে। তারই কি বেতের ফলের মতন চোখ? কেজানে! সেই পাগলা কবি হয়তো জানতো, কিন্তু সবাই তো তাকে কী সব আজেবাজে কথা বলে তার মন ভেঙে দিলো! অভিমান করে সে কোথায় যেন চলে গেছে, আর কোনোদিন ফেরে নি।

অতসী-হাওয়ায় গাছেরা কাঁপছে। আকাশ নীলকান্ত আজকে, মালার মতন উড়ছে একদল পায়রা। নাকি পায়রা না, অন্য কোনো পাখি ওরা? কেজানে! কাছের গাছে কিচিমিচি করে একদল নীল পাখি, কেজানে কী পখি!

শিলং পাহাড়ের ছোটোবেলা মনে পড়ে।সেখানে নীল নীল হাউস মার্টিন পাখি থাকতো। সেখানে লাল রঙের পুল ছিলো ছোট্টো ঝোরানদীর উপরে, সেই পুল পার হয়ে ছিলো রঙীন চীনে লন্ঠন ঝোলানো বাতাসবাড়ি। সেই বাড়িতেই থাকতো বুঝি মুন্নিরা? মনে পড়ে না। ভূমিকম্পের সময় সবাই ছুটে বেরিয়ে এলো, মুন্নি ও। কিন্তু তারপরে কী হলো? মুন্নি "মা কই, মাকে দেখতে পাচ্ছি না" বলে আবার বাড়ির ভিতর দৌড়ে গেল?

কচি কচি সরল গাছগুলো জড়িয়ে কেমন লাউডগাসবুজ লতা উঠেছে! তাতে এক দুই তিন চার পাঁচটা নীল ফুল ফুটেছে, নীল তারার মতন। এরা সকালে ফোটে, দুপুর হলে বুজে যায়। রাতে ফেরার পথে দেখি একদম লুকিয়ে গেছে। সরল গাছও তখন ঘুমায়?

লাল নীল সবুজ হলুদ ঘুড়িতে ঘুড়িতে আকাশ ঢেকে যাওয়া বিশ্বকর্মাবিকেল মনে পড়ে, সেটা অনেকদিন পরে। তখন পাহাড় মিলিয়ে গেছে অতীতে, তখন একটু বড়োবেলা।সেদিনও আকাশ এমন নীল ছিলো।

ধানের ক্ষেতে ধানগাছগুলো সবুজ তেজী, ঝিং ঝিং করে হাওয়া বয়ে যায় ধানের ধারালো পাতায় বাজনা তুলে তুলে। ভরা ক্ষেতের উপর দিয়ে ভেসে যায় কাটা ঘুড়িগুলো, ঐ দূরে মাটি যেখানে নত হয়ে পড়া আকাশে মিশে গেছে, সেই দিগন্তের দিকে। তারপরে? তারপরে ওরা কোথায় যায়?

হারিয়ে যায় কত কিছু। হারানো সেইসব পুঁতির মালা, লাল পুঁতি নীল পুঁতি পর পর সাজানো ছিলো যাতে-সন্ধ্যেবেলার মাঠে কোথায় পড়ে গেল ছিঁড়ে, সেই মাঝখানে গোল সোনালি সূর্য আঁকা নীল রেশমী রুমাল---কোথায় উড়ে গেল ঝড়ের হাওয়ায়, গাঢ় খয়েরী রঙের চকচকে প্রথম কলমটা-কোথায় পড়ে গেল, খুঁজে পাওয়া গেল না আর, রবিবারের দুপুরের রেডিওতে "আমার নাম টায়রা", কিছুই আর যার মনে রইলো না নামটুকু ছাড়া-এই সব, সব হারিয়ে গেলো। এইসব হারানো গুলো পালিয়ে যাওয়া নোটন নোটন পায়রাগুলোর মতন ঝোটন বেঁধে বসে আছে ময়ূরনদীর পারের সীতাহার গাছে,সে গাছ ঘিরে পালকের মতন ভাসছে জ্যোৎস্নাপরীরা। একদিন সেখানে যাবার জন্য রুমুদিদি রওনা হবে ভুলুকে নিয়ে, ওর যে পিঠে ডানার কুঁড়ি আছে!

দিন কাটে, রাত শনশন বয়ে যায়। মৌমাছির ডানার গুণগুণ যেন! কাছ থেকে সব কিছু বড় বেশী ঘন, অনেক দূরের স্মৃতিমাঠ থেকে দেখলে তবে বুঝি তবু খানিকটা বোঝা যায় তাকে। মস্ত একটা গোল চাঁদ ঝুলে থাকে, স্বপ্নবাতিঘরের জানালা থেকে দূরের পাহাড়চূড়ায় দেখা যায় কীসের আলো, জ্বলছে নিভছে জ্বলছে নিভছে .......

মহালয়া-ভোর

বহু বছর হলো মহালয়া ভোর দেখা হয় না। না, ভুল বললাম, দিনটা আসে ঠিকই। সেই দিনের ভোরও দেখা হয়, কিন্তু সেই শিউলি-উঠান, রাশি রাশি ফুল ঝরতো যেখানে, সেই শীত শীত আলো-আঁধারিতে ভোর চারটেয় বেজে ওঠা আশ্চর্য আকাশবাণীর কল, সেই গান, "বাজলো তোমার আলোর বেণু", আর সেই সব সুর আর কথার ঝর্ণার মধ্য দিয়ে আলো হয়ে ওঠা সেই শরতের স্বর্ণঝরা ভোর, সেই আশ্চর্য কন্ঠটি বলে যে কিনা বলে উঠতো "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর" অমনি ভিতরে বাহিরে ঘটে যেতো এক ম্যাজিক---সেই মহালয়া-ভোর আর আসে না। বহুকাল থাকি শিউলিবিহীন দেশে। কাশফুল আছে, নদীর তীর আছে, শুভ্র মেঘমালা আছে অপরাজিতানীল আকাশে, কিন্তু শিউলি নাই।

শিউলি নাই, অনুও নাই। আসলে আমিই নাই। মনে পড়ে মহালয়া ভোরে অনুহৃয়া আসতো নিয়ম করে, গেটের পাশে ছিলো সেই চেনা শিউলিগাছটা, আমাদের শিশুকাল থেকে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই যে বড়ো হয়ে উঠেছিলো। পুজোর ছুটির কত দুপুরখেলা ছিলো ওর ছায়ায়। কমলা বৃন্তের সেই কোমল সাদা ফুলগুলো, রাশি রাশি ঝরে পড়তো, হালকা নরম সৌরভ ছড়িয়ে যেতো বাতাসে। ওরা ফুটতে শুরু করলেই আমাদের সকলের মনে শারদীয়া আসতো। রোদ্দুরে শারদীয়া রঙ লাগতো, মাঠ ভরে যেতো কাশফুলে। " ঢ্যামকুড়কুড় বাদ্যি বাজে ঢাকে পড়লো কাঠি/ যা দিবি মা তাই হবে আজ পরমান্নের বাটি।"

সে শিউলিগাছ হয়তো আজো আছে, হয়তো নেই। আমরা দুজনেই আর সেখানে নেই, ছিটকে কোথায় চলে গেছি দেশকালের স্রোতে।

অন্ধকার বারান্দা পেরিয়ে শিউলি উঠান
সেখানে আবছা ছায়ামায়া-
উঠান পার হয়ে ঘাসে ঢাকা মাঠ,
রাত্রিবাতাসে ঘাসেরা ঘুমিয়ে গেছে।
সব পেরিয়ে আকাশ, তাতে নক্ষত্রের হীরাপান্না।

গত সূর্যাস্তবেলায় যে পাখি উড়ে গেল
তার প্রবাসের অরণ্যের দিকে-
তার চলে যাবার দিকে যেমন চেয়েছিলো
আমার তৃষিত দুইচোখ
এখন তেমনি চেয়ে আছে
অন্ধকারের উপরের ঐ তারাগুলির দিকে।

ছায়াপথের ওড়নার দিকে চেয়ে আমি প্রার্থনা করি
কমলা জ্যেষ্ঠা তারার দিকে চেয়ে আমি প্রার্থনা করি
নীল চিত্রা তারার দিকে চেয়ে আমি প্রার্থনা করি
রাজহংসের পাখা ছাড়িয়ে ছায়াগ্নির দিকে চেয়ে আমি
প্রার্থনা করি-

এ সীমা টুটে যাক-
ঊর্ধ্বে ঐ প্রজাপতিমন্ডলের
ধ্যানমগ্ন ব্রহ্মহৃদয়ে মিলে যাক
এই ক্ষণভঙ্গুর মৃত্তিকাহৃদয়।

Friday, August 15, 2014

সূর্যশিশির



সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির -মাঝে মাঝে কেমন যেন হয় আশমানির। এক একটা শব্দ সারাদিন রিনরিন করে মনের মধ্যে বাজতে থাকে। আজকে যেমন এই সূর্যশিশির! কী সুন্দর কথাটা। অথচ এর মানেটা তেমন কিছু ভালো নয়, একরকমের পতঙ্গভুক উদ্ভিদ, কলসপত্রীর মতন। কলসপত্রী নামটাও কী চমৎকার ! এইসব গাছেদের এরকম সুন্দর নাম দেওয়ার পিছনে মানুষের কি কোনো বিশেষ মানসিকতা আছে?

সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির-আশমানি হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলো পার্কিং লট, পলিমার-সায়েন্সের বিশাল সুন্দর বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে চলার সময় সারিবাঁধা পাইনের দিকে তাকালো, তারপরে পার হলো চওড়া লিংকন রোড-পুরো সময়টা মনের মধ্যে রিনরিন করে বাজছে সূর্যশিশির। আর মনে পড়ছে সূর্য নামটা, সবলে সেই নামটা সে মন থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে, কিন্তু ফিরে আসছে বার বার। কেন মনে পড়ে ঐ নাম? তাহলে আশমানি কি আজও অপেক্ষায় আছে মনে মনে?

অফিসঘরের চাবিটা বার করে সে দরজা খোলে, পিছনে করিডর থেকে পিটারের " গুডমর্নিং, অ্যাশমানি " শুনে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে চেয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে, " গুডমর্নিং পিটার।"

আগে আগে ওর অ্যাশমানি শুধরে আশমানি করে দিতে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পিটারের উচ্চারণ কিছুতেই ঠিক হয় না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে আশমানির, আর কিছু বলে না। প্রায় সকলেই ওকে অ্যাশমানি ডাকে, সে মানিয়ে নিয়েছে। তবু তো তাকে নাম বদলে ইংলিশ ধরনের নাম নিতে হয় নি, একরকম মন্দের ভালো। চাইনিজদের তো অনেককেই দেখেছে ইংলিশ নাম নিতে, এই তো শেহাই বলে মেয়েটি জেনি হয়ে গেছে, হুয়াংমিং হয়ে গেছে জোয়ানা। আশমানি অনায়াসে অ্যাশলি হয়ে যেতে পারতো, এখানের সবার সুবিধে হতো। কিন্তু নিজের নামটা পর্যন্ত ছাড়তে হলে আর কী রইলো?

যান্ত্রিক দক্ষতায় ইমেলগুলো চেক করে আশমানি। বেশ কিছু দরকারি ফাইল ডাউনলোড করে, কিছু প্রিন্টআউট নেয়। আগের রাতে যে প্রোগ্রামটা রান করতে দেওয়া ছিলো, সেটার প্রোগ্রেস চেক করে। এখনো প্রায় সিকিভাগ বাকি। লাঞ্চের পরে পাওয়া যাবে ভ্যালুগুলো। একদিকে ভালোই, ততক্ষণে ল্যাবে নতুন ডেটা নেওয়া যাবে। কাজগুলো হয়ে গেলে লগাউট করে ল্যাবের দিকে রওনা দেয় সে। এতক্ষণে ডোয়ানা, সারা, রুহান, অব্রিরা নিশ্চয় কাজ শুরু করে দিয়েছে।

ল্যাবে ঢুকে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্যাম্পল বানানো আর অসিলোস্কোপ নিয়ে। একটানা কাজ করে চলে বেশ ক' ঘন্টা। এক এক করে অন্যরা লাঞ্চে গেল, আশমানির খিদে পাচ্ছিলো না।

লাঞ্চ থেকে ফিরে এসে ডোয়ানা বললো, "অ্যাশমানি, আমি ডেটা নিই, তুমি এবারে লাঞ্চে যাও।" ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আশমানি বললো, "আমি মিনিট কুড়ির মধ্যেই চলে আসছি। "

ল্যাব থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে কাফেটেরিয়ার দিকে আশমানি। চলে আশমানি, কেমন যেন ক্লান্তি সর্বাঙ্গে, সে কী এতক্ষণ না খেয়ে আছে বলে?

কাফেতে দেখা হিন্দোলের সঙ্গে, সে এসেছে লাঞ্চ করতে। আশমানি তো অবাক-খুশি। স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর স্প্রাইট নিয়ে কাফের একপাশের টেবিলে বসে দু'জন। এত বেলায় কাফে প্রায় ফাঁকাই বলা যায়, দুপুরের খাওয়া আর বাকী নেই কারুর।

হিন্দোল জিজ্ঞেস করে কাজকর্ম কেমন চলছে। আশমানি একটা আধাক্লান্ত হাসি হেসে স্যান্ডউইচে কামড় বসায় আর ঝালের চোটে স্প্রাইটে চুমুক দেয়। সে নিজেই বেশী করে হ্যালোপিনো দিতে বলে আর নিজেই ঝালে হুশহাশ করে। তারপরে সংক্ষেপে বলে নিজের কাজকর্মের কথা। হিন্দোলকেও জিজ্ঞাসা করে তার খবর।

হিন্দোলের সঙ্গে দেশে থাকতেই পরিচয় ছিলো আশমানির। শুধু পরিচয়ই না, ভালোরকম বন্ধুত্ব ও ছিলো। একই কলেজে আশমানি, সুর্য, হিন্দোল- সবাই পড়তো। আলাদা আলাদা বিষয়ে পড়লেও ওদের ক্লোজ গ্রুপ ছিলো একটা। সেই গ্রুপে ছিলো হিয়া, তিষান, আশমানি, সূর্য, হিন্দোল আর উপমা। স্বভাবে কারুর সঙ্গে কারুর মিল ছিলো না, অথচ বন্ধুত্ব গাঢ় ছিলো সেইসময়।

পরবর্তী জীবনে যে যার পথে চলে গেছে, সেই সময়ের পরিকল্পনা কিছুই পরে আর টেঁকে নি। হিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে ওর বাড়ী থেকে ঠিক করে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে, অথচ হিয়া চাকরিবাকরি করে স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। হিয়ার সঙ্গে প্রেম ছিলো তিষানের। অভিমানী তিষান একটা কথাও না বলে ফরেস্ট সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে চলে গেছে হিমালয়ের পায়ের কাছে, সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছে।

সূর্য চাকরি নিয়ে থিতু হয়ে গেলো, নিজের শহরেই চাকরি পেয়ে যাওয়ায় বেশ খুশীই ছিলো সে। বাবামায়ের কাছে থাকা জরুরী মনে হয়েছিলো ওর। অথচ কলেজজীবনে সূর্যকেই সবচেয়ে সুদূরের পিয়াসী মনে হতো, সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ মনে হতো। সময় মানুষকে কতই না বদলে দেয়! নইলে--থাক। মনে করতে চায় না আশমানি।

হিন্দোল কিছুদিন ভালো চাকরি করেছে বহুজাতিকে। এখন আবার সে পথ পালটিয়ে নেমে পড়েছে ব্যবসায়, এখানে সেই ব্যাপারেই নাকি এসেছে একটা কাজে। হিন্দোলের মধ্যে একটা অস্থিরতা আশমানি লক্ষ করেছে একেবারে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে। কোনো কিছু নিয়েই বেশীদিন আটকে থাকা যেন ওর ধাতে ছিলো না।

আশমানির হঠাৎ খেয়াল হয় সে নিজেও কত বদলে গেছে! তার ক্লোজ গ্রুপের একজন এতদূরে এতদিন পরে এসেছে জেনেও তার তেমন কোনো হেলদোল নেই। অভিমান কি এত তীব্র হয়? হয়তো শুধু অভিমান না, হয়তো বিষাদ, ক্ষোভ, যন্ত্রণাও।

লাঞ্চ সেরে দু'জনে দু'পথে চলে যাবার আগে তুলে নিলো দু'জনের ফোননম্বর। বিদায় জানিয়ে ল্যাবের দিকে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ আশমানির মনে পড়ে পুরানো দিনে হিন্দোল খুব হাসাতো নানারকম জোকস বলে আর মজার অভিনয় করে। এখন সেই হিন্দোল কত সিরিয়াস হয়ে গেছে! সব মানুষই ক্রমাগত বদলায়, পরিস্থিতি মানুষকে দিনেরাতে সকালেসন্ধ্যায় কেবলই বদলে দিতে থাকে।

তবু কি কিছু থেকে যায় যা অপরিবর্তনীয়? যা অজর, অমর, অক্ষয়? তেমন কিছু কি সে কোনোদিন অনুভব করে কোনো বিরল অবসর-প্রহরে?

দিনের বাকী সময়টা টানা কাজ করছিলো আশমানি, বিকেল পৌনে পাঁচটায় ডোয়ানা এসে বললো তার কাজ আজকের মতন শেষ, আগে আগে চলে যাবে। ডোয়ানার মুখে লেগে আছে লাজুক হাসি, তাতে উত্তেজনার রঙ। তার বয়ফ্রেন্ড আজকে দেখা করতে আসবে, সপ্তাহের এইদিনটাতেই সন্ধ্যাবেলা তারা দেখা করে।

আশমানির খেয়াল হলো দিনটা শুক্রবার, এই সন্ধ্যা মানুষের আনন্দ করার সন্ধ্যা। পরের দু'দিন ছুটি কিনা! হাসিমুখে ডোয়ানাকে বিদায় জানিয়ে সেও কাগজপত্র গোছাতে শুরু করে। যদিও আজকে সন্ধ্যায় তার বিশেষ কোনো প্ল্যান কিছু নেই, কারুর সঙ্গে দেখা করারও নেই, তবু তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে একা কিছুটা সময় বিশ্রাম করতে ইচ্ছে করছে, শুয়ে শুয়ে কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চারওয়ালা গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করছে সেই কিশোরীবেলায় যেমন পড়তো।

ঘরে পৌঁছে ব্যাগ ট্যাগ সব রেখে আগে তার দীর্ঘ স্নানবিলাস, তারপরে কফি বানানো, টোস্ট বানানো, কফির সঙ্গে মাখন লাগানো টোস্ট খেতে খেতে টিভি দেখা- এই প্ল্যান। খুব নতুন কিছু না, আগের শুক্রসন্ধ্যায়ও তো প্রায় এই করেছে।

স্নান আর খাবার বানানো হয়ে গেলে সে চিঠির বাক্সো দেখতে যায়। খোলে রুটিন কাজের মতন। ভিতরে একটা খাম, উপরে ঠিকানা লেখা। ইংরেজী ক্যাপিটাল লেটারে লেখা ঠিকানা, হাতের লেখাটা পরিচিত ঠেকে। খুব পরিচিত। স্মৃতির ভিতর থেকে উকি দেয় কী যেন একটা, সেটা কি অভিমান? নাকি অন্য কিছু? কোনো স্পন্দিত অপেক্ষা?

খামটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আশমানি। তারপরে চিঠির খাম না ছিঁড়েই রেখে দেয়। বসার ঘরে সোফার উপরে খাম রেখে কিচেনে যায়, কফি টোস্ট আনতে। অবাক হয়ে লক্ষ করে তার হাত মাঝে মাঝে কাঁপছে।

খাবার নিয়ে গিয়ে বসে বসার ঘরে সোফায়, সামনের নিচু টেবিলে রাখে ওসব। পাশেই খামটা, টোস্টে কামড় দিতে দিতে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে খামটার দিকে, আস্তে আস্তে খাওয়া সারে, আয়েশ করে কফিতে চুমুক দেয়। একসময় সে বুঝতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে আজ সময় নিচ্ছে বেশী। নিজের অজান্তেই প্লেট সরিয়ে রেখে খামটা ছেঁড়ে আশমানি, চিঠির ভাঁজ খোলে।

সূর্য চিরকাল বড় চিঠি লেখে, এই চিঠিও বেশ বড়। তবে আগে অনেক কবিতা টবিতার কোটেশন দিয়ে দিয়ে লিখতো, এই চিঠিতে তা নেই। ওর নিজের বক্তব্যই শুধু। আশমানির কাছে ক্ষমা চেয়েছে সে, সে লিখেছে আশমানির মতন আকাশের উচ্চতার মানুষকে সে মাটির মানুষ হয়ে একদিন চেয়েছিল, আশমানিও রাজী ছিল- সেই নাকি পরম সৌভাগ্য। কিন্তু যা হবার নয়, তা কেমন করে হবে?

আশমানি যদি এই ভুল ভালোবাসায় দু:খ পেয়ে থাকে তাহলে সে যেন এটুকু অন্তত বোঝে যে সূর্যও কম দু:খ পায় নি। মনে মনে সে আশমানিরই রইলো, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় তো তাকে বাঁচতে হবে, তাই সে বাবামায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করতে চলেছে কিছুদিন পরে। মেয়েটি ভালো, ঘরোয়া, শান্ত। আশমানি যেন ভুল না বোঝে তাকে। আশমানির জন্য তার অনেক শুভকামনা রইল। সাহসী ও হৃদয়বান কোনো মানুষের সঙ্গে একদিন আশমানির মিল হবে, হবেই। সুখী হবে সে, তখন আর তার পুরানোদিনের দু:খ মনে থাকবে না।

চিঠিটা ডানহাতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে আশমানি, তারপরে নির্জন ঘরের একাকীত্বে খোলাখুলি কান্নায় ডুবে যায় নিশ্চিন্তে। এখানে তাকে দেখে ফেলার কেউ নেই, কারুর সামনে অপ্রস্তুত হবার ভয়ে সমুদ্রসমান কান্না গিলে ফেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেদিনের মতন ফিরতে হবে না তার।

সূর্য সেদিন ভীরু কাপুরুষের মতন পিছিয়ে গেছিল আশমানিকে তীব্র একলা করে দিয়ে। আশমানির তবু স্বপ্নভঙ্গ হয় নি, সমস্ত অপমানের আঁচড় নিজের উপরে নিয়েও তার ভালোবাসা বেঁচে ছিলো, সে ভেবেছিলো কোনো না কোনোদিন সূর্য তার কাছে আসবেই, সত্য সে বুঝতে পারবেই, অন্ধকারের বেড়া ভেঙে সে আসবেই তার ভালোবাসার কাছে। মানুষের বানানো ধর্ম ও তার ভুল বিভেদবোধ কি কোনোদিন মানবধর্মের চেয়ে বড়ো হয়?

একা ঘরে হৃদয় উজার করে কাঁদছে আশমানি, এ কান্না খানিকটা মুক্তির কান্নাও। আর তার কোনো দায় রইলো না অপেক্ষার, সূর্য নামের মানুষটাকে ভুলে গেলেও কিছু আর আসে যায় না তার।

একসময় কান্না ফুরিয়ে যায়। গভীর এক ক্লান্তির ঘোর নেমে আসে সর্বাঙ্গ জুড়ে। দু'চোখের পাতা আঠার মতন জুড়ে যায় ঘুমে। আহ, এসো ঘুম, এসো সর্বতাপহরণ ঘুম, তুমি এসো।



মুঠাফোনটা বাজছে, ঘুমের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শিথিল হাত বাড়ায় আশমানি। বালিশের পাশেই ফোন, ঘুমঝাপসা চোখ খুলে দেখে হিন্দোলের নম্বর। স্বপ্নভাঙা এলোমেলো মাথার মধ্যে সূর্য, সূযের চিঠি, হিন্দোল সব তালগোল পাকিয়ে যায়।

মুঠাফোন হাতে নিয়ে উঠে বসে আশমানি, দেয়ালে ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যায়, না বেশী রাত না, মাত্র সাড়ে নয়। আরো একবার রিংটোন বাজা শেষ হলে ফোন কানে দিয়ে আশমানি সাড়া দেয়।

ওপাশে হিন্দোলের ছটফটে গলা, "কতক্ষণ ধরে করছি, কী করছিলে?"

আশমানি আলগা গলায় বলে, "আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"

"সরি, সরি। তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। নিশ্চয় খুব ক্লান্ত ছিলে।"

"তা একটু ছিলাম। কোনো দরকার?"

"আগামীকাল কি তোমার কোনো বিশেষ প্রোগ্রাম আছে?"

"কেন বলো তো?"

"আমি ভাবছিলাম যদি কোথাও যাওয়া যায় কাছেপিঠে। মাত্র ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভেই তো চমৎকার সিবীচ। যাবে, আশমানি?"

"এমন হঠাৎ করে বললে হয় নাকি? কালকে সকালে আমার অন্য কাজ আছে।"

হিন্দোলের গলা একটু মুষড়ে গেছে ওদিকে, কিন্তু সে এমন অল্পে ছেড়ে দেবার বান্দা যে নয় আশমানি ভালো জানে। হিন্দোল বলে, " দুপুরের পরে বা বিকালের দিকে রওনা হলে কেমন হয়? রাতের সমুদ্র দিনের চেয়ে বেশী চমৎকার। "

আশমানি হেসে ফেলে, "তুমি যা মানুষ, হয়তো বলবে সারারাত সমুদ্রের পারে ঘোরা আরো চমৎকার।"

খোলা গলায় হিন্দোল হাসছে। একেবারে সেই কলেজবেলার মতন। আশমানির ভিতরে কেমন যেন শিরশির করে উঠছে। মাঝে মাঝে সে ভাবে সেইসব দিনে আসলে কি সে হিন্দোলকেও ....

" আশমানি, না বোলো না, বলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।"

ওর বলার ভঙ্গীতে আবারও হেসে ফেলে আশমানি, পাগলাটাকে থামানো যাবে না জেনে বলে, "ঠিক আছে, যাবো। "

ফোন রেখে দিয়ে উঠে বসে আশমানি, ঘুমটা কেটে গেছে, ক্লান্তিও। হঠাৎ কিসের যেন একটা অস্বস্তি, কোথায় আশমানি বোঝে না। সে দরজা খুলে করিডরে দাঁড়ায়, দোতলার এই করিডরে অনেক খোলা হাওয়া। এখান থেকে আকাশের অনেকখানি দেখা যায়।

হঠাৎ জলে ভরে যায় তার চোখ, মুছে নেয় জামার হাতায়। ভাবে, কী হবে সেসব পুরানো কথা ভেবে? যে আসছিলো, সে তো ফিরে গেছে। সেদিনের দুর্বল ভীতু আশমানি তাকে আসতে দিতে পারে নি। কোল জুড়ে এলে সে কেমন হতো, সেকথা ভেবে আজ আর কী লাভ? মনে পড়ে সূর্যের সঙ্গে সেইসব মুহূর্তগুলো, নিবিড় ভালোবাসায় বাকী পৃথিবী যখন মিলিয়ে গেছিলো দু'জনের মাঝ থেকে। গেছিলো কি? তাহলে কীকরে পারলো সূর্য ওভাবে সরে যেতে?

সূর্য যদি সেদিন পাশে দাঁড়াতো...যদি আরেকটু সাহস সে করতে পারতো সেদিন ... থাক, যা হয়ে গেছে তাতো হয়েই গেছে! আর তাকে সংশোধনের কোনো উপায় নেই। রাতের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিয়ে আশমানি ঘরে ফিরে আসে।



সন্ধ্যার আকাশ ভরে তারারা জেগে উঠছে। নির্জন দ্বীপের বাতিঘরে আলো জ্বলছে। আশমানি জলের ধারের পাথরে বসে আছে চুপ করে। সমুদ্রের ধারে কী প্রবল হাওয়া! ঐ যে দূরে জলদিগন্ত, পশ্চিমের সেই জলরেখার উপরে আকাশ, সেখানে আশ্চর্য রঙীন সূর্যাস্তের রেশ রয়ে গেছে এখনো।

দিনের আলো যতক্ষণ ছিলো আশমানি কথা বলেছে অনেক। ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে রেখেছে রুমালে জড়িয়ে। এখন সে চুপ, পাথরের উপরে বসে আছে একেবারে পাথরটারই মতন স্তব্ধ। সমব্যথীর মতন হিন্দোল আশমানির হাত ধরে চুপ করে থাকে।

কতক্ষণ তারা চুপ করে বসে ছিলো হাতে হাত রেখে তা বুঝি জানে শুধু সমুদ্রের হাওয়া, ফিসফিস করে হাওয়া কানে কানে কী সব বলে যায় তারা অনবরত। আকাশের তারারা নির্বিকার, এমন হাসিকান্না আসা যাওয়া হারানো পাওয়া কত দেখেছে ওরা, কতকাল ধরে দেখছে! মানুষের কত আনন্দবেদনার ইতিহাসের পাশ দিয়ে নিজের মতন করে চলে গেছে তাদের অপলক আলো।

আশমানি বলে, " জানো হিন্দোল, সূর্যের চিঠি পেলাম কাল। সে বিয়ে করতে চলেছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। হিন্দোল, ঠিক মানুষকে আমরা চিনতে পারি না কেন? আমরা কেন ভুল মানুষকে ভালোবাসি আর সে ভুলের খেসারত দিতে দিতে জীবনটাই কেটে যায় ? "

হিন্দোলের হাতটা শক্ত করে চাপ দেয় আশমানির হাতে, স্পর্শের বৈদ্যুতি ভাষায় সাহস দিতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায়। আরো কিছু বলতে চায় কিনা কেজানে! আরো একটা ভুলের জালে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না আশমানির। তার চেয়ে এই তো সে বেশ ভালো আছে, ঝাড়া হাতপা। বিদেশে বিভুঁইয়ে চেনাজানা মানুষদের হাজারো প্রশ্ন থেকে অনেক দূরে-

আশমানি উঠে পড়ে, পোশাক থেকে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে," চলো, কাছের কোনো মোটেলে উঠি, এত রাতে এতটা লম্বা ড্রাইভ করে না ফিরে কালকে সকালে ফিরবো না হয়। "

হিন্দোল বলে, " চলো। "

মোটেলটা কাছেই ছিলো, ব্রীজ পার হয়ে দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডে ঢোকার পরেই খানিক এগিয়ে সুন্দর মোটেল। তারা চেক ইন করলো রাতের জন্য। দুই বেডের ঘর। ছিমছাম সাজানো।

খুব ঘুম পায়, দু'চোখের পাতা জড়িয়ে আসে, সোফা থেকে কোনোরকমে বিছানায় কাছে এসে বালিশে মাথা ঢেলে দেয় আশমানি।



দূরে আকাশ যেখানে নত হয়ে পড়েছে জলে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে লাল সূর্য, লাল হৃৎপিন্ডের মত, স্পন্দিত আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। কোথা থেকে ভোরের সমুদ্রতীরে এসে পড়ে একলা একটা মেয়ে, আবরণমুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় জলের দিকে, অবগাহণপ্রত্যাশায়।

ওর খোলা চুলের ঢালে জড়িয়ে যায় সাদা ফেনা, চিকচিক করে ওঠে ভোরের আলো। স্নান করতে করতে সে হাসছে, দু'হাতের মুঠায় নোনাপানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে চেঁচিয়ে বলে, "শোনো, শোনো, আমি আমার নাম দিলাম আকাশ।" একটা চমৎকার নীল মেঘ উড়ে আসে তার মাথার উপরে, টুপটাপ ঝরতে শুরু করে নীল বৃষ্টিকণা।

ঘুম ভাঙে আশমানির, স্নিগ্ধ শান্তি। এই স্বপ্ন তার চেনা, অনেকবার দেখেছে সে। এইটা তার খুব সুন্দর একটা হালকা পালকের মতন স্বপ্ন, একটা অলৌকিক মুক্তির স্বাদ। স্বপ্নের ভিতরের মেয়েটাকে কখনো মনে হয় খুব চেনা, আবার কখনো একদম অচেনা। কখনো মেয়েটা সে নিজেই, আবার কখনো বা তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়মুখ।

ভোর হয়ে গেছে, পুবের জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায় আশমানি। টলটলে জলের ভিতর দিয়ে দেখে উঠে আসছে লাল সূর্য, মেঘগুলো সব কমলা। হিন্দোল গভীর ঘুমে, ওর ঘুমন্ত মুখটা শিশুর মতন, মায়ায় ভরে যায় আশমানির বুকের ভিতরটা। বহুদিনের শুখা জমিনের উপরে সেখানে তখন নেমেছে বৃষ্টি, নীল রঙের বৃষ্টি, ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন।

******

দক্ষিণের ঐ জানালা

বিরাট এক স্পন্দনশীল অন্ধকার আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে, চারিদিকে কালো জল ছলছল করছে। ওর মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বেরিয়ে আসতে চাইছি আলোয়। তখনও কালো বা আলোর কথা ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু একটা অদ্ভুত তাড়না আমায় ঠেলা মারে, আমার সদ্য তৈরী হওয়া মগজে কোটি কোটি বছর আগের যে স্মৃতি খোদাই হয়ে আছে, সেই স্মৃতিই আমার পূর্বসংস্কার, সেই আমাকে জানায় আলো আর কালোর গল্প।

কিন্তু কোথায় আলো? অন্ধকারের জরায়ু কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? কোথায় ঝিকমিক করছে জোরালো আলো? আমি প্রাণপণে সাঁতরাই, ডাইনে বাধা বাঁয়ে বাধা, ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে যেতে থাকি প্যাঁচালো সর্পিল পথ ধরে। ঠিক দিকে যাচ্ছি কি? কেজানে!

ঘুম ভেঙে যায়, ঘামে ভিজে গেছে সারা গা। সেই স্বপ্নটা! আবার!!! কেন দেখি এটা বারে বারে?

নিজেকে সামলে নিতে নিতে উঠে বসি সাবধানে, পাশে শেষরাতের অঘোর ঘুমে অচেতন হিন্দোল। ঘরের মধ্যে অদ্ভুতুড়ে নীল আলো, ফ্যানের হাওয়া মশারির চালে হালকা ঢেউ তুলছে। বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনির দিকের দরজাটা আলতো করে খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। আহ, বাইরে কী হাওয়া! সেই কতদূর দক্ষিণ সমুদ্র থেকে আসছে। খোলা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতে নিতে চোখ তুলে তাকাই উপরে, আকাশে তারা আর তারা, সেই কোন পুরাকাল থেকে একইভাবে চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। কত যুগের কত মানুষের কত আনন্দ কত যন্ত্রণার নীরব সাক্ষী ওরা।

ঘাম শুকিয়ে গেলে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়ি, ঘুমের মধ্যে ডুব দিতেই দৃশ্য বদলে যায়। দেখি, হামাগুঁড়ি দিয়ে অন্ধকার গুহা থেকে বার হচ্ছি। বাইরে এসে দেখি উপরে আকাশ আর পায়ের নিচে রুখু বাদামী পাহাড়ের গা। পাহাড় বেয়ে বেয়ে নেমে আসি, এখানে ওখানে পাথরের খাঁজে পা রেখে, এখানে ওখানে গাছ গাছড়া আঁকড়ে বা শক্ত লতা ধরে ধরে। পথ তো নেই এই পাহাড়ে।

নামতে নামতে নীল সমুদ্রের কথা মনে পড়ে, এই তো মাত্র কয়েকদিন আগেই ছিলাম সমুদ্রে, ভেজা বালির উপরে ঝাঁক ঝাঁক সীগাল আর তাদের অদ্ভুত সুন্দর ডাক। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে করতে করতে হাঁপ ধরে যায়। দেখি পৌঁছেছি পাথরের একটা চাতালের মতন জায়গায়। লাল ফুলওয়ালা একটা লতা দুলছে হাওয়ায়। হাঁপ ধরা শরীরটা নিয়ে কোনোরকমে লতাটার কাছে গিয়ে বসে পড়ি, তারপরে শুয়ে পড়ি। ক্লান্তি, বড্ড ক্লান্তি। আয় ঘুম, আয়।

এইখানে স্বপ্নের ঘুম আর সত্যিকারের ঘুম মিশে যায়, শান্তি শান্তি শান্তি। যখন পরদিন যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি সকালের রোদে ভেসে যায় দুনিয়া। হিন্দোল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আগেই, খুলে দিয়েছে দক্ষিণের ঐ বড় জানালা-

দক্ষিণের ঐ জানালা খুলে দিলেই
একটা ম্যাজিক হয়।
মেঝেতে আছড়ে পড়ে
এক-জানালা আকাশ-
এক-আকাশ রোদ্দুর
আর এক-চুমুক সমুদ্দুর।
আলো এসে ছুঁয়ে দেয়
ছায়ার মায়াবী আঁচল।

দক্ষিণের ঐ খোলা জানালা দিয়ে আমি
উড়িয়ে দিই আমার এই গৃহবদ্ধ পোষা দৃষ্টি,
চলতে ফিরতে ফণীমনসার কাঁটায় রক্তাক্ত
সেই দৃষ্টি হঠাৎ যেন পেয়ে যায়
দু'খানা সবল উজ্জ্বল সোনালী ডানা।

সে অনায়াসে পার হয়ে যায়
চিবোনো চিবোনো সব বাঁকা বাঁকা কথা,
ক্ষুরের মতন ধারালো সব বাধা আর নিষেধ-
পার হয়ে যায় শত শত মাঠ, বন, নদী, গ্রাম, শহর
যেতে যেতে আলতো ছুঁয়ে দেয় পাহাড়ের চূড়া,
একটুখানি খেলে নেয় নীল আকাশের
তুলো-তুলো মেঘেদের সঙ্গে-
আর অক্লান্ত উড়তে থাকে ঐ
আদিগন্ত ছলাৎছল নীল সমুদ্রের দিকে।

আনন্দপুরে

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই, দেখি নারকেল গাছের সারি। কান্ড বেয়ে গোলমরিচের লতা উঠেছে। বৃষ্টির কণারা লেগে আছে লতার গায়ে আর পাতাগুলোর উপরে। রোদ্দুর পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে কেমন! ভিজা হাওয়ায় নারকেল গাছগুলো মস্ত মস্ত পাতা নাড়িয়ে খুব আহ্লাদ করছে। ঠিক যেমন বলে দিয়েছিলো প্রীতি।

ছোট্টো হাসি শুনে চমকে তাকাই, দেখি পাশের জঙ্গল থেকে প্রণতি বেরিয়ে আসছে, হাতে নীল রঙের ফুল। আমি বললাম, "আনন্দপুরে যাবে?"

ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে আরো হাসলো। বললো, "সেখানে গিয়ে রাজেনের রেখে দেয়া রঙতুলি দিয়ে শূন্য কাগজে অনেক ছবি আঁকবো। সে নাকি আজকাল আর ছবি আঁকতে পারে না! এটা কোনো কথা হোলো? সে আবারও আঁকবে। আমিও আঁকবো।আরো নতুন নতুন রঙ বানাবো। নীল রঙ, লাল রঙ, সবুজ-সবই বন থেকে পাওয়া যাবে, কী বলো?"

ওর চোখের মধ্যেই মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টির ছবি এমনিতেই চিকচিক করছিলো, ছবি না এঁকে ও থাকতে পারবে কেন?

আরো খানিক এগোতেই দেখি মস্ত লম্বা একজন মানুষ মৃদু গান গাইতে গাইতে উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছে। চিনলাম, ও তো সুমন্ত।

সুমন্ত বললো, " চন্দ্রাবতী নদী পার হবার সময় কই মাছ ধরবো।"

আমি কইলাম "আরে, কীকরে ধরবে? তোমার জাল কই? নয়তো ছিপ? বা নিদেন ছাঁকা দিয়ে মাছ ধরার গামছা?"

ও কইলো, "দেখতেই পাবে। আমি শুধু হাতেই মাছ ধরতে জানি।"

এসে গেল চন্দ্রাবতী। জল এখন গভীর যদিও তবু এই জায়্‌গায় নদীটা বইছে উঁচু পাথুরে ডাঙার উপর দিয়ে, কিছু কিছু পাথরের মাথা জলের উপর দেখা যাচ্ছে। এখানে জল বড়ো জোর একমানুষ গভীর। হেঁটে পার হওয়া যাবে ঠিকই। ডুবে গেলে সুমন্ত হাত বাড়িয়ে ঠেলে দেবে নাহয় কোনো পাথরের দিকে।

না তেমন ডুবজল ছিলো না, দিব্যি নদী পার হতে গিয়ে আমাদের ভালো করে স্নানও হয়ে গেলো।

পার হয়ে এসে দেখি সুমন্তের পাঞ্জাবির দু'পকেট ভর্তি কইমাছ!!!

কী মোটাসোটা কুস্তীগীরের মতন কইমাছ সে কী বলবো! সত্যি মানুষটা শুধু হাতে কই ধরে ফেলেছে?

সুমন্ত খুব হাসছে আর কবিতা বলছে, বলছে, "ক্যালেন্ডারের পাতা ওড়ে, দোলে এলোমেলো ধোঁয়ার কুন্ডলী" আরো অনেক কিছু বলছিলো, ব্যাপারটা বেশ ধোঁয়াটে বলে কিছুই বিশেষ আর বুঝলাম না। ধোঁয়া দোলে কীকরে সেও এক কূট প্রশ্ন! কিন্তু কবিদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের জবাব আশা করতে নেই। কবির জবাব বড় ভয়ানক!

নদী পার হয়ে টিলা, এখন গভীর সবুজ। তার উপরে পড়ে আছে ছড়ানো ছিটানো বড়ো বড়ো নুড়ি, এই ভরা বর্ষায় সবুজ শ্যাওলা আর লতায় ঢেকে গেছে।

টিলার উপরে স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন অচ্যুতচরণ, লম্বা সাদা দাড়ি বর্ষার ভিজা হাওয়ায় উড়ছে। উনি মন্ত্রের মতন করে বলছেন, "অখন্ডমন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচর ... " আমাদের দেখে থেমে গিয়ে হেসে অভিনন্দন জানালেন," এই যে উষসী দেখছি। অনেকদিন পরে এবার। তা সঙ্গে এনারা কারা?"

আমি বললাম, "নমস্কার অচ্যুতদা। এনারা আমার দুই বন্ধু-প্রণতি আর সুমন্ত।"

সুমন্ত ততক্ষণে ওর কবিতা বলতে শুরু করে দিয়েছে আর অচ্যুতদা অবাক খুশী হয়ে মুহূর্তের মধ্যে বন্ধুত্ব পাতিয়ে আলোচনায় জমে গেছেন সুমন্তের সঙ্গে। এখন আমরা কথা কইতে কইতে হাঁটছি অনন্তিকার বাড়ীর দিকে। আর একটু পরেই সে আমাদের দেখতে পাবে।

সুমন্তের ধরা কইমাছ দিয়ে কিছু একটা রান্না করা হবে নিশ্চয়। কাঁচা মরিচ দেওয়া ঝোলও বেশ ভালোই হতে পারে নয়তো শুধু ভাজা।

অচ্যুতদা হঠাৎ কইলেন, "সবচেয়ে বড়ো জাদুকরী কে জানো সুমন্ত? এই বিশ্বপ্রকৃতি। কোনো কথা না বলেই কত আশ্চর্য্য কথা তৈরী করে যাচ্ছে। ঐ যে দ্যাখো পুবের আকাশটা, এই ছিলো রোদ্দুর, এই এখনি মেঘলা হয়ে গেলো, আবার কখন একটু মেঘ ফাঁক হয়ে যাবে, আলো চলকে নামবে। এইরকম করে আমরা কি কোনোদিন কথা কইতে পারি?"

****

সেইসব পথেরা

আমাদের সাথে সাথে আমাদের পথেরাও বহুদূর হেঁটে গেছে, পিছনে বিস্মৃতিধূলি, দিগন্তে মেঘ, রঙীন মেঘমালা।

কেউ ঢুকেছে গলির গলি তস্য গলিতে যেখান থেকে আকাশটাকেই মনে হয় ঐ উপরের কোনো সরু নীল গলি। কেবল পাশের বাড়ির তেতলার ব্যালকনিতে যখন এসে পড়ে আশ্বিনের রোদ্দুর,তখন চমকে ওঠে পথের মন- মনে পড়ে এইসময়ে ক্ষেতের আল থেকে সে দেখতো আর শুনতো দিগন্তলীন মাঠ ভরা সবুজ ধানের নাচ আর গান, বাতাসের সঙ্গে যুগলবন্দী। সে কবেকার কথা?

কেউ গেছে চওড়া রাজপথে, যেখানে সাঁ সাঁ করে ছুটছে কেবল হাওয়াই গাড়ি। দিন রাত ছুটছে ওরা, একের পর এক-ওরা কোথায় যায়? কোনো সন্ধ্যাবেলা, যখন কলাবতীফুলের মতন মেঘে সারা আকাশ লাল-তখন সেই রক্তসন্ধ্যার নিচে সে চিৎকার করে ওঠে, এত রক্ত কেন?

কেউ গেছে পাহাড়ে, পর্বতশীর্ষে উঠবার জন্য ঘুরে ঘুরে সর্পিলাকারে চলছে পাকদন্ডীর মতন। পাশ দিয়ে হয়তো পাগলাঝোরা নামছে, হয়তো হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে নাম না জানা ফুলেরা, হয়তো পাখিরা গান গাইছে, সে শুনছে না, সে শুধু উঠছে আর উঠছে। ঐ যে চূড়া মাঝে মাঝে দেখা যায় মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চলে যায়, সেইদিকে মন রেখে সে শুধু উঠছে আর উঠছে।

কত সূর্য ঝলকানো দিন কত মিহিন চাঁদের রাত চলে যায়, সে থামে না। একদিন হয়তো কোনো বাঁকে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সে নিচে চেয়ে দেখতে পায় ঝম করে উঠেছে কী বিশাল এক সূর্যধোয়া উপত্যকা! অপার্থিব মন্ত্রের মত কী আশ্চর্য সুন্দর! ওখান থেকেই চলতে শুরু করেছিলো নাকি সে? আগে কেন তবে ঐ সৌন্দর্য সে দেখতে পায় নি? এখন তো আর ওখানে ফেরার উপায় নেই!

কেউ নেমেছে আঁধার পাতালে, সেখানে দমবন্ধ অন্ধকার। তারই মধ্যে মধ্যে কোথাও ঝলকে ওঠে আলো। ও কি আলো নাকি আলেয়া? ও কি মণিরত্নের দীপ্তি নাকি ছুরির ঝলক? বোঝার উপায় নেই। পথে ঘুরে ঘুরে চলে আর চলে, দেয়ালে ঠেকে যাবে নাকি সূর্যের নিচে গিয়ে পৌঁছতে পারবে? সে জানে না, সে বুকের মধ্যে এক আকাশ আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে রেখে চলে আর চলে। শেষ কোথায়?

তারপরে কখনো কোনো অলৌকিক মোড় ঘুরে দূরে চলে যাওয়া সেইসব পথেদের দেখা হয়ে যায়।

রাত-যাদুকর

একটুকরো কাগজ উড়ে যাচ্ছে,
তাতে ছিলো না জন্মানো কবিতার কয়েকটা পংক্তি,
সেই মৃত ভ্রূণটিকে বুকে নিয়ে চলে
যাচ্ছে ধাত্রী, ওদের পিছনে সূর্যাস্তের লাল আকাশ।
সেদিকে চেয়ে থাকি জ্বরঝাপসা চোখে,
অন্য এক পৃথিবীর স্বাদ লাগে জিভে।

ফিরোজানীল আকাশে ডানা মেলে দেয় সোনালি ঈগল, ধীর গতিতে ভেসে যায় পাহাড় চূড়ার দিকে। নিচে নদীর তীরে শরবনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ বক, চেয়ে আছে স্রোতের দিকে, চঞ্চল স্রোতের অশেষ ধারার দিকে। জন্ম-উৎস থেকে মৃত্যুমোহনার দিকে স্রোতের অবিরাম ছুটে চলার দিকে স্থির চেয়ে আছে সে। কালপুরুষের মৃগশীর্ষ সারমেয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাহারা দিতে দিতে দেখেছিলো দুটো রঙীন প্রজাপতি উড়তে উড়তে খেলছে, খেলাটার নাম " আমায় ধরতে পারে না"।

চুমুক দিলাম পানীয়ে, টকমিষ্টি স্বাদের অদ্ভুত পানীয়-আরেক চুমুক দিলাম, আরেক চুমুক। তারপরে কিছু মনে নেই। কেন আমার পানীয়ে ঘুম মিশিয়ে দিয়েছিলি তুই?

তিন দিন তিন রাত্রি অন্ধকারে ভাসছি-জন্ম মৃত্যু পুনর্জন্ম পুনর্মৃত্যু---স্বপ্নের ভিতরে সব গোল্লা পাকিয়ে যায়, বিশাল এক ভুলভুলাইয়া--- সমস্ত পার্থিব অসন্তোষ ঝরে যাচ্ছে হেমন্তের লালবাদামী পাতাদের মত, রাশি রাশি পাতা, কোটি কোটি পাতা, গাছের শরীর থেকে ঝরে যাচ্ছে কী নির্বিকার বেদনাহীনতায়! মনে পড়ে এক বিপন্ন স্বপ্নের ঋতু, ছিন্ন পালকে রক্তমাখা দিনরাত, তৃণাঞ্চলে ঝরে পড়া টপটপে স্বেদ-স্মৃতি। মরিচগন্ধী গ্রীষ্মের দুপুরের বালি বালি জলতেষ্টা, কপালে গালে শুকিয়ে যাওয়া লবণ। তামাটে আকাশে গলন্ত ধাতুর মতন রৌদ্র, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে কংক্রীটের বিস্তৃত জঙ্গল-যেখানে লুকোবার কোনো জায়্গা নেই। তবু সেও ঝরে যায়, ঝরাপাতা অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে মনে পড়ে তোদের বাড়ীটার কথা।

সবুজ রঙ ছিলো তোদের বাড়ীটার। সবুজ মাঠ পেরিয়ে সবুজ গাছগাছালির জটলা, তার ভিতর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতো তোদের সবুজ বাড়ীর দেওয়াল, জানালা আবার কখনো বা দোতলার একটা গ্রিলমোড়া বারান্দা। রহস্যময় দোতলার বারান্দা। ওখানে তোর নয়নাপিসি বসে থাকতো। চুপ করে চেয়ারে বসে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে দুলতো, দুর্বোধ্য কথা বলতো, ওঁর পিঠের উপরে ছড়িয়ে থাকতো জটা পড়া চুল, গায়ের কাপড় থাকতো অবিন্যস্ত। নয়নাপিসি পাগল ছিলো, সবাই জানতো। কিন্তু আমার মনে হতো সে যেন রয়ে গেছে অন্য একটা জগতের ভিতরে, যা আমরা কেউ দেখতে পাই না।

রাত্রিবেলার যাদুকর এসে দাঁড়ায় আমার অগ্নিকুন্ডের পাশে-
ওর এক হাতে পাহাড়, আরেক হাতে সমুদ্র-
রক্তলাল পশ্চিমের আকাশের উপরে ওর সিলুয়েট,
মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে চেয়ে দেখি এক এক করে
নক্ষত্র ফুটে উঠছে ওর মাথার চুলে, উত্তরীয়ে, বাহুতে, বুকে-

স্পন্দন

মনে করো তুমি চলেছ নদীর উপর দিয়ে, তোমার নৌকা আস্তে আস্তে হেলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে। তুমি দেখছ নদীর পাড়ে বসে আছে একটা অদ্ভুতদর্শন দীর্ঘচঞ্চু পাখি, চুপ করে দেখছে তোমায়। তুমি এগিয়ে চলেছ দু'পাড়ে সবুজ দেখতে দেখতে, এ নদীতে জোয়ার ভাঁটা খেলে, মোহনার খুব কাছে কিনা! তুমি শুনছ বাতাসের শব্দ, এখন শান্ত, কিন্তু কেজানে কখন ঝড় আসে? তুমি চলেছ সমুদ্রের দিকে।

একটা জটিল গ্রন্থি, যেটাকে খুলতে পারলেই সহস্র বছরের যবনিকা উঠবে। বছরগুলো যেন শক্ত হয়ে জমে আছে, গিঁট খোলার মন্ত্রটা উচ্চারিত হলেই সব গলে যেতে থাকবে বসন্তের সূর্যের তাপে গলে যাওয়া বরফের মতন। গলে গিয়ে তখন সব স্বচ্ছ, যার ভিতরে দেখা যাবে নদীর তলদেশের নুড়ি পাথর বালি, জলজ আগাছা, এঁকে বেঁকে স্রোতের মতন সাঁতার কাটতে থাকা রুপোলি মাছের ঝাঁক।

অন্ধকার। রাত্রি নেমে গেছে অনেকক্ষণ। সমুদ্রতীর এখন নির্জন। বালির উপরে অবিরাম আছড়ে পড়ার ঢেউয়ের শব্দ শুধু। ঝাউবনের মধ্যে শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।এগিয়ে আসা ঢেউগুলো কেমন জ্বলজ্বল করে, রাত্রির সৈকতে কেমন একটা চাপা আলো। সমুদ্র থেকে বা আকাশ থেকে আসে ঐ আলো।

বিকেলে তুমি দেখেছিলে বালির উপরে পদচিহ্ন, মানুষের, পাখির, কাঁকড়ার। এসব চিহ্ন মুছে যায় একেকটা বড়সড় ঢেউ আসলেই। কিন্তু তোমার মনে পড়ে পাথরের মধ্যে অক্ষয় হয়ে থাকা মিলিয়ন বছরের পদচিহ্ন, বিপুল সরীসৃপরা যা রেখে গেছে। চিহ্ন রয়ে গেছে, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সবাই। হয়তো তারা ফিরে এসেছে অন্যরূপে, কেজানে! পৃথিবীর ভাঙা গড়া চলছিল তখন। কী বিপুল ধ্বংস! তার পরে জেগে ওঠে কী বিপুল সৃষ্টি। ঠিকই ভোর হয়, দীর্ঘ রাত্রি শেষে ভোর হয়। জীবন থেমে থাকে না।

তুমি বসেছ এখন আগুনের সামনে, বন্ধুদের সঙ্গে। আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসেছ তোমরা সবাই। এখন কালপুরুষ আকাশের প্রায় মাঝখানে, তাকে অনুসরণ করছে তার হরিণমাথা কুকুর, লুব্ধক। তুমি তুলে নাও তোমার পানীয়, চুমুক দাও, একবার, দুইবার। অনুভব করো উষ্ণতা, তোমার ভিতরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা। তুমি মাছভাজায় কামড় বসাও, অনুভব করো স্বাদ গন্ধ আর তারও বেশী কিছু। তোমার মনে পড়ে একটা দিন, বহুদিন আগের এক ডুবসাঁতার। নদীটার নাম যেন কী ছিল? চন্দ্রাবতী না?

রাত্রি বহে যায় শান্ত নদীর মত
আকাশে ভেসে থাকা ঘুমেলা চাঁদ
স্বপ্নের ঘোরে এলোমেলো কথা বলে,
জ্যোৎস্নারঙের কথা সব।
এই কি অমরত্বের টুকরোটাকরা?
অনন্তের বৃষ্টিবিন্দু?

সোনালী অগ্নিশিখা লাফিয়ে ওঠে অজস্র সোনালী ফুলের মতন
আলো আর ছায়া হাত ধরাধরি করে নাচছে-
শত শত নীল পদ্মের পাপড়ি খুলে যায় কোথায় যেন
দরজা খোলার শব্দ হয়-
দূর আকাশের প্রান্ত থেকে এসে পৌঁছায় প্রথম সূর্যের আলো-
ভোর হয়ে যায়।
এই কি অমরত্বের স্পর্শ?
এই কি অনন্তের তুষারকণা?

তোমার উষ্ণতা আমাকে ঘিরে ধরে তুলোর পোশাকের মতন,
আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি-
দেখতে দেখতে তলিয়ে যাই গভীরে,
সেখানে দেখতে পাই তোমার রক্তিম হৃদয়,
তার মধ্যে জ্বলছে উজ্জ্বল লাল আগুন
সৃষ্টির শুরু থেকে জ্বলছে অনির্বাণ।
এই কি অমরত্বের স্পন্দন?
এই কি অনন্তের কথামালা?
*******

Tuesday, August 12, 2014

The Tree

The day dawned with the color of pearl-
One little bird began her long flight
After kissing on the brown heart
Of her beloved tree.

The tree remained silent
He knew he'll have to wait for a long time
For her to return.
He'll have to endure many snowy days of
Cold, harsh, unforgiving winter.

Then, his beloved little bird will come back
In a golden morning of spring
With the message of new life-
The tree will bloom with flowers of pure joy.

When?

To save from the merciless fire
I buried my heart deep down
Many feet under the stony ground.
I buried it into the sunless, moonless, airless darkness
Where the all destroying fire couldn’t touch it.

Years passed and the fire died down
I wanted to get my heart back
I reached for it into that dark depth
But I didn’t find that living, breathing heart.

It became a hard stone in those long years-
I washed it with my tears to soften it
Still it remained a dead weight.
When will she wake up?

You Who ...

I never fully understood you
You were always surrounded by a great mystery,
I looked at your eyes-
The mysterious deep blue eyes where
All of my appeals and offerings disappeared-
As if they fell into a black hole passing the event horizon.

You embraced me like lovely sunshine-
And I felt the nice warmth all over me
But I couldn’t understand the secret of you.

Was the answer something very simple?
Did I miss it all the time?
Was the answer hidden inside my own heart?

অফুরাণ আকাশে যে নক্ষত্রের ঘর

আজকে বিকালে মেঘ সরে গিয়ে দেখা দিয়েছে রোদ। আকাশ কোমল নীল, রোদ্দুরে সোনারঙ। সূর্যপিয়াসী প্রাণগুলি আজ হারানো সুর খুঁজে খুঁজে বের করে তোড়া বাঁধে, বেসুরো শুকনোপাতা ফেলে দিয়ে। ভুলে যাওয়া শরতের মতন কাশফুলী মেঘেরা ভাসে আকাশে, ডানামেলা পাখির মতন উড়ে যায় সবুজ অরণ্যের দিকে, ওদের দিগন্তপ্রিয় ডানার নীচে তরল জলের ধারার মতন গলে পড়ে দূরত্বের কাঠিন্য।

খুব ঈর্ষা হয় ওদেরকে। কেমন দিগন্ত থেকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে উড়ে যায় ওরা, শীত ছেড়ে বসন্তের দিকে! আবার ছায়া পড়ে আসে, সূর্যের মুখ ঢেকে দিয়ে ঝুঁকে পড়ে চুম্বননত মেঘমুখ, পৃথিবীর মুখের দিকে। সাঁঝ নামে।

হঠাৎ‌ খুঁজে পাওয়া প্রিয় গল্পটা খুলি, গল্পটার নাম "জ্যোৎ‌স্নাপৃথিবী"। প্রথম পড়ার মতই আবার চমকে উঠি। এত সুন্দর কাহিনি লেখা যায়? এত আকুতি ধরা পড়ে মানুষের কঠিন ভাষার আখরে? এই গল্পটা পড়ার আগে আমার দুনিয়া অন্যরকম ছিলো, এখন অনেক অন্যরকম। যিনি লিখেছেন অন্তর নিংড়ে, তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর ছিলো, কৃতজ্ঞতাও, কিন্তু কোথায় পাবো তাঁকে? এমন কত ঋণ রয়ে যায় এ মাটির জীবনে, কেজানে! আলোর মুখ ঢেকে দিয়ে আবার আবছায়া নেমে আসে। জলের আবরণকেই কি কুয়াশা বলে?

"এই ছায়ামায়াভূমি এই জলস্থল
সুগভীর ও দু'চোখে আলো টলটল-
কিছুই তো যায়না ছোঁয়া
কুশিকুশি ধোঁয়া ধোঁয়া -
সে মায়াবী দেশ শুধু অনুভবময়,
নীলছায়া এ জীবন, নীলাভ সময়।

ছায়ামায়া পার হয়ে আরো আরো দূরে-
সোনালী আলোর দেশে অচেনা নূপুরে,
স্বপ্ন-পালক লেগে ব্যথা জেগে ওঠে
হাসি ও কান্না আঁকা স্ফটিকের ঠোঁটে।
পাহাড়ের পথ বেয়ে নেমে আসে ঝোরা
সারাদিন রিনরিন বইছে অঝোরা।
কে যেন হারিয়ে গেছে কোন্‌ ছায়াদেশে,
কে যেন বিদায় নিলো অমলীন হেসে-
আবার হবে কি দেখা মায়াবী বিকালে
সূর্যকাঁ‌পন জাগা নীলহ্রদ-শেষে?

চলে গেছো, ফিরে এসো,ফিরে এসো তুমি-
জলের নূপুরে বেজে ওঠো,কথা বলো-
অফুরাণ আকাশে যে নক্ষত্রের ঘর
সেঘরের জানালায় দীপ হয়ে জ্বলো....

জ্যোৎ‌স্নায় বালিহাঁস ওড়ে

কাকজ্যোৎ‌স্নায় বালিহাঁস ওড়ে, সাগরতীর গর্ভিণী নৈ:শব্দ নিয়ে পড়ে থাকে চুপ। চুপ করে পড়ে পড়ে ভিজতে থাকে গহন রাতের অলীক আলোয়। মিশরী ওড়নার মতন নেমে আসে শিরশিরে শিশিরকণা, বুঝি বা ঐ নীল চিত্রা তারার কাছ থেকে। ওরই জন্যে বুঝি সমুদ্রঝিনুকেরা ডানা মেলে রাখে? বুকের ভিতর শিরশিরে ব্যথাকে মুক্তা করে ফলাবে বলে?

তীররেখা বরাবর হেঁটে যাই একা একা আধোঘুমে আধো জাগরণে। মগ্ন চেতনায় জেগে থাকে অশ্রুলবণ। আর জেগে থাকে কবেকার একটা ভুলে যাওয়া মুখ, টুলটুলে দুটি গাল, রেশমকোমল ফুরফুরে চুলের গোছা, চকচকে একজোড়া নবীন চোখ, টুকটুকে ঠোঁটে দুধমাখা হাসি।

হেঁটে যাই চেনা থেকে অচেনায়। নাকি চেনাজানাই ছিলো এইসব একদিন ?

কোনোদিন জানা ছিলো এই বালি?
চেনা ছিলো ও গহীন জল?
চেনা ছিলো ঐ মায়াচাঁদ ?
শোনা ছিলো ওই পাখিদের
দিগন্তপ্রিয় ডানার ধ্বনি?

মনে পড়ে না, কিছু মনে পড়ে না-
জানালায় উড়ে আসা পাখি,
নরম পালকে ভোররঙ-
সে যে কবে, কিছু মনে পড়ে না।

কাকজ্যোৎ‌স্নায় বালিহাঁস ওড়ে,
ঝর্ণা-পাহাড়-নদী-মাঠ-ঘাট পার হয়ে
ওড়ে,ওড়ে ওড়ে-

স্মৃতির বাক্স খুলে বসি-
ভুলের পালক ছুঁয়ে দেখি
মনে পড়ে না, কিছু মনে পড়ে না-

কাকজ্যোৎত্স্নায় বালিহাঁস ওড়ে,
দিগন্তপ্রিয়েরা ওড়ে, ওড়ে, ওড়ে .............

কথামালামেঘ

"কথামালামেঘ কথামালামেঘ, কোথায় তোমার বাড়ি?"
-আমার বাড়ি অনেক দূরে, অনেক দিনের পাড়ি।
-"সেই যে শুনি সূর্যপ্রাসাদ পুব সাগরের তীরে-
সেই প্রাসাদেই থাকো বুঝি শঙ্খলতায় ঘিরে?"
কথামালামেঘ মুচকি হাসে পুবালী বাতাসে-
ঝরঝরিয়ে মুক্তোদানা ঝরতে থাকে ঘাসে।

"কথামালামেঘ কথামালামেঘ, আসবে আমার ঘরে?"
-কী করে যাই, কথারা তোর পুড়ছে বিষম জ্বরে!
"জ্বর তো বটেই, কিন্তু তুমি রাখবে বৃষ্টিহাত
জলঝরা সেই হাতের ছোঁয়ায় জুড়িয়ে যাবে তাত!"

টাপুর টুপুর বৃষ্টিনূপুর মেঘ এলো সেই ঘরে
উঠলো ডেকে গানের পাখি তানপুরাটির তারে!
নীলরঙা ওর ওড়না ঘিরে চিকমিকে বৈদ্যুতি
বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা আকাশপারের স্মৃতি।

কবিতাজলে ভরিয়ে দিয়ে শূন্য মাটির ঘট
কথামালামেঘ উড়ে গেলো পেরিয়ে ঝুরিবট ।
সাঁঝ-আকাশে ভাসছে এখন অলকপুরীর ঘাটে
জাগনরাতি নামবে যখন তেপান্তরের মাঠে,
সেইখানে সে চুপি চুপি জ্বালিয়ে তারার দীপ
সেই অপরূপ পরণকথায় আঁকবে আলোর টিপ।

আর্শিতে বৃষ্টিবিন্দু

আর্শিতে বৃষ্টিবিন্দু দুলে ওঠে, খুলে যায় ভিতর দরজা। হালকা শব্দ-প্রথমে স্বচ্ছ,বাষ্পময়, তারপরে আস্তে আস্তে ফিরোজা। ভিতরে অল্প আলো শিরশিরে, সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনির মতো টলমল, ঠান্ডা ঠান্ডা ভয়, আর তীব্র লালচে কমলা কৌতূহল।

মোহরের গড়িয়ে যওয়ার শব্দ-
সোনালী রুপোলী তামারঙ শব্দ,
চন্দনের গন্ধের মতন স্বাদ
জোছনাগন্ধী বন চুপচাপ,
স্তব্ধ।

বৃষ্টিবিন্দুতে শব্দেরা টলমল
খুলে যায় বর্ষাদিগন্তের সবুজ দরোজা-
স্বর্ণ ঝরোখা তুলে উঁকি দেয়
ভুলে যাওয়া প্রিয়মুখ,
ওই চোখের মণিতে ফিরোজা।

আর্শিতে রাশি রাশি বৃষ্টিবিন্দু
প্রথমে স্থির স্ফটিক,
তারপরে দুলে ওঠে, কেঁপে ওঠে,গড়িয়ে নামে-
এদিকে গড়িয়ে যায়
ঘড়িতে অবিরাম সময়ের টিকটিক।

Wednesday, August 6, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২২)

দেখতে দেখতে লোকজনে ঘর ভরে উঠতে লাগলো, গোল করে পাকানো ডায়াগ্রামের তাড়া নিয়ে সেমিনার দেনেওয়ালারা, সঙ্গে তাদের গাইড শিক্ষকরা বা শিক্ষিকারা, তাছাড়া এমনি দর্শক শ্রোতা ছাত্রছাত্রীরাও আসছে। জাজেরাও শোনা গেল এসে গিয়েছেন, তবে তাঁরা তখন অন্য ঘরে বিশ্রাম করছেন আর টিফিন খাচ্ছেন।

অন্বেষার মুখ আরো খানিক ভয়-ভয় হয়ে গিয়েছে, আমি কিছু জোকস বলে খানিকটা হাসি হাসি করে দিলাম ওকে।

ঘরে লোক আরো বাড়ছে, ঘরের একদিকে একটা উঁচু জায়গা, হয়তো ডায়াসের মতন কিছু ওটা। ঐখানেই ফুলদিয়ে সাজানো টেবিলে আর চেয়ার, ঐগুলোতে জাজেরা বসবেন। মঞ্চের একপাশে একটা তিনপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের মতন, ঐখানে ছবি ঝুলিয়ে মনে হয় বলতে হবে।

বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপার, আমাদের মেয়েদের স্কুল, এখানে মেয়েদের স্কুল ছেলেদের স্কুল সহশিক্ষা স্কুল সব থেকেই এসেছে প্রতিযোগী ছাত্রছাত্রীরা। হঠাৎ মনে হলো আমাদের স্কুলটা সহশিক্ষার হলে মন্দ হতো না ।

টাউনের এক নামকরা স্কুল থেকে এসেছে দুই ছাত্রী, তাদের সঙ্গে তাদের দুই শিক্ষিকা। ওদের হাবভাব আর সাজপোশাক সবই দারুণ আত্মবিশ্বাসী। দেখে মনে হয় আহ, এইরকমই বুঝি হয় তাহলে বড় শহরের ছেলেপুলেরা!

যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ে তো শুরু হয়ে গেল সেমিনার। একে একে নাম ডাকা হচ্ছে আর ছাত্র বা ছাত্রী মঞ্চে গিয়ে উঠছে আর বক্তৃতা দিচ্ছে ছবি টবি লেখা টেখা দেখিয়ে, মাত্র পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ প্রত্যেকের। ভেবেছিলাম প্রত্যেক পরিবেশনের পরে হয়তো ছোট্টো প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকবে, সেসব দেখলাম কিছুই থাকলো না।

অন্বেষার পালা এলে সে গিয়ে বললো আর ঝোলানো ছবির পাতা উল্টে উল্টে দেখালো ডায়াগ্রামগুলো। ভালোই বলেছিল সে, বেশ গোছানো পরিবেশন, মিলারের পরীক্ষার সেই মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন আর জলীয় বাষ্প থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী হওয়ার জায়্গাটা বেশ দারুণ বুঝিয়ে বললো, কিন্তু ডায়াগ্রাম ছিল হাতে আঁকা, জাস্ট চলনসই।

সেই টাউনের নামকরা স্কুলের ছাত্রী দুজনের বক্তব্য ইত্যাদি আর বলার কায়্দাও মোটামুটি একইরকম গোছানো ছিলো কিন্তু ওদের ডায়াগ্রামগুলো ছিল অতি চমৎকার, একেবারে প্রফেশনাল। ওরাই ফার্স্ট আর সেকেন্ড হলো সঙ্গত কারণেই। অন্বেষা হয়েছিল থার্ড।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পুরো ব্যাপার সমাপ্ত হয়ে একেবারে প্রাইজ ইত্যাদিও দেওয়া হয়ে গেল, তারপরে সবাই বাড়ীর দিকে রওনা হলো।

আমাদের এক দিদিমণি পরে সব শুনে বলেছিলেন ঐ নামকরা স্কুলের ছাত্রীরা এইসব ব্যাপারে ট্রেনিং অনেক ভালো পায়, ওদের সঙ্গে এইসব ব্যাপারে তৈরী করে দেবার জন্য ডেডিকেটেড টিচার থাকেন। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যে আমাদের গাঁ-মফস্বলের স্কুলে সেই কালচারই তৈরী হয়নি যা এইসব এক্স্ট্রা ব্যাপার স্পেশাল ব্যাপারগুলোতে আমাদের ট্রেনিং দিয়ে যুগোপযোগী করে তুলবে। তাছাড়া ভালো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তো এইসব জিনিসের আগ্রহ নেই, উটকো উৎপাত এইসব। কারণ তারা ছকে দেওয়া পথে চার পাঁচজন প্রাইভেট টিউটর এর কাছে তালিম নিয়ে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেয়ে গেলেই খুশি। জয়েন্টের উত্তীর্ণতালিকায় ভালো জায়্গায় থাকতে পারলেই তাদের পাথরে পাঁচ কিল, কোনো না কোনো শিওর শট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকে পড়তে পারলে মার দিয়া কেল্লা, পড়ার শেষেই লাখবেলাখের চাকরি।

তো সে আর কে না জানে! খুব বেশী বিকল্প রাস্তাও তো চোখে দেখতে পেতাম না আমরা। সব কিছুই যেন বিশাল উঁচু একটা পাঁচিলের অন্যপারে, আমরা শুধু তার ভাসা ভাসা আওয়াজ শুনি মাত্র, এই আবিষ্কার হয়ে গেল টপ কোয়ার্ক, এই এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে কোয়ান্টাম এনট্যাংগলমেন্ট নিয়ে, এই হিউম্যান জিনোম সিকোয়েন্স বার করার জন্য বিশাল প্রোজেক্ট শুরু হচ্ছে, সেই সব কিছুই আমাদের কাছে যেন এক কল্পনার জগৎ, কিছুতেই সেই জগৎটা আমাদের কাছে সত্যি হয়ে আসতো না।

আমরা সেই সকালে উঠে প্রাইভেট কোচিং যাত্রা, ফিরেই তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে স্কুল, স্কুল থেকে ফিরেই আবার আরেক প্রস্থ প্রাইভেট কোচিং যাত্রা কোনো কোনো দিন, নয়তো হয়তো পরেরদিনের কোনো ইউনিট টেস্টের পড়া-এইসব চক্করে পড়ে থাকতাম। পড়াশোনার প্রায় সবটাই একধরণের ব্লাইন্ড মুখস্থবিদ্যা- প্রশ্ন নেই, নিজে নিজে ভাবার স্পেস নেই, নতুন প্রশ্নের উদয় নেই, সেই প্রশ্নের সমাধানের অভিযান নেই, ভুল করার কোনো স্বাধীনতা নেই বলে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও এক্সপেরিমেন্টের কোনো অবকাশ নেই। থোড় বড়ি খাড়ার এক অদ্ভুত অসহায় অন্ধকার চক্র।

তবু তার মধ্যেও কেউ কেউ বুকের ভিতর আলোর স্বপ্ন লালন করতো ঠিকই।

(চলবে)

Friday, August 1, 2014

জলছবির জ্যোৎস্না

১।

রুপোলী জরির মতন ফিনফিনে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে আমার রাত্রি বাগানে, আকাশে ঝমঝম করে তারারা। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ঝিঁঝিঁদের সম্মিলিত অর্কেস্ট্রা। অদ্ভুত নেশা ধরানো এই সঙ্গীতসভা।

এমন রুপোজরি জ্যোৎস্নারাতেই চলে গিয়েছিল টিপু, শেষবারের মতন দেখা করে গিয়েছিল এইরকম এক রাতেই। জ্যোৎস্নারাতে বাগানে বসে থাকলেই টিপুর কথা মনে পড়ে।

"ভালোকাকীমা, আমি আজ চলে যাচ্ছি। ফিরে এলে আবার আসবো তোমার কাছে। " প্রণাম করেছিল।

আমি নিচু হয়ে ওকে তুলে ধরে দেখেছিলাম ওর চোখে জলের ফোঁটা, জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছিল। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে গেল তারপরেই।

টিপু থাকতো আমাদের পাশের বাড়ীতে। ফুটফুটে ছোট্টো বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন ওর মা সুলতা হসপিটাল থেকে বাড়ীতে ফিরলো তখনই দৌড়ে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখার সময় থেকেই কেমন মায়া পড়ে গেল বাচ্চাটার উপর। আর পড়বেই তো, অমন কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুলের গোছা, ফুলো ফুলো গোলাপী গাল, টুকটুকে ঠোঁটজোড়া--

ওর ঠাকুমার কী আনন্দ- নাতি হয়েছে। মিষ্টি দিচ্ছিলেন প্রতিবেশীদের। কত বছর আগের কথা-তখন পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিল, সুখে দুঃখে সবাই সবার কাছে কাছে থাকতো।

আমাদের টোনাটুনীর সংসারে ঝামেলা বলতে কিছুই ছিল না। সুজয়-আমার স্বামী, সে সকাল বেলায় খেয়েদেয়ে অফিসে বেড়িয়ে গেলে আমার অখন্ড অবসর। তখন টিভির বালাইও ছিল না, কেবল টেবলের নামও শোনেনি কেউ। রেডিও শুনত লোকেরা।

বাড়ীতে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না কেউ। শ্বশুর শাশুড়ী সবাই বেঁচে ছিলেন, তাঁরা কেউ তাঁদের গ্রামের বাড়ী ছেড়ে, বিশাল পরিবার পরিজন ছেড়ে, জমি জমা চাষ আবাদের সদাব্যস্ত জীবন ছেড়ে ছেলের কাছে এসে বাস করতে রাজী হতেন না।

সুজয়ের চাকরিসূত্রে আমাদের থাকতে হতো শহরঘেঁষা সেই মফস্বলে। গ্রাম থেকে আত্মীয়স্বজনেরা মাঝে মাঝে আসতেন, তবে দুই একদিন থেকেই চলে যেতেন।

সুজয়ের লম্বা ছুটিতে আমরা মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ীতে যেতাম, তবে কেমন যেন একটা সম্মানিত অতিথি-অতিথি ভাবে আমাদের দেখতো সেখানের সবাই যে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম। দুই তিনদিন থেকেই আমরা ফিরে আসতাম। পরের দিকে সুজয় নিজেও আর তেমন আগ্রহী হতো না, ছুটিতে আমরা তখন দিল্লি আগ্রা কি কুলু মানালি কি মাদ্রাজ কন্যাকুমারী এসব জায়্গায় ঘুরতে যেতাম।

কিন্তু ওর চাকরির সময়গুলোতে আমার দুপুরবেলা আর বিকেলবেলা অখন্ড অবসর। সুজয় সন্তানের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না, নিজেদের হবে না জেনে যখন আমি একবার অনাথ আশ্রম থেকে সন্তান দত্তক নেবার প্রস্তাব তুলেছিলাম, সুজয় একেবারেই আগ্রহ দেখায় নি। আমিও অনাগ্রহ বুঝে আর চাপাচাপি করিনি, বরং নিজের শখ টখ নিয়ে অবসর ভরাট করার খেলায় মেতে গেলাম।

আমার ছিল বাগান করার শখ- ফুল ফল তরিতরকারি-সব কিছু ফলাতেই দারুণ উৎসাহ। বাড়ীর চারপাশটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল আমার বাগান- সন্তানের মতন যত্নে তৈরী বাগান। বই পড়ে, বাগান করে, রেডিও শুনে সময় ঠিকই কেটে যেত- তবু কোথায় যেন একটা অধরা ফাঁক থেকে যেত, ধরা যায় না বলা যায় না, তবু বোঝা যায়।

মাঝে মাঝে গোপণে দীর্ঘশ্বাস পড়তো আমার, নিজের মানুষটার উপরে অদ্ভুত অচেনা একটা অনুভূতিতে মনটা ভরে যেত। বুঝতাম না সেটা ঠিক কী, অভিমান, রাগ নাকি নিরাসক্তি? কেন যেন মনে হতো পাশাপাশি আছি আমরা সংসারে, কিন্তু দু'জনের মাঝে যেন অলঙ্ঘ্য পাঁচিল, কেউ কারুর অন্তরের কথা জানি না। অভ্যাসবশে মিলিত হই মাত্র, কিন্তু সে যেন শুধুই দেহের চাহিদা মেটাতে, আমাদের মন থেকে যায় অধরা।

রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়তো সুজয়, আমি সন্তর্পণে উঠে বিছানা ছেড়ে বাইরের ঘরে চলে যেতাম, চুপিচুপি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতাম রাত্রির বাগান, কখনো টলটলে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়তো গাছের পাতায় পাতায় আবার কখনো নিকষকালো অন্ধকারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকিরা জ্বলতো আর নিভতো।

২।

টিপুকে নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে বেরোতো সুলতা। ছেলেটা দিব্যি আমার কোলে আসতো হাত বাড়ালেই, একটুও কাঁদতো না। ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে দিব্যি লাগতো আমার।

আমাদের বাড়ীর চারপাশ ঘিরে বাগান আর বাগান ঘিরে বেড়ালতার বেড়া। ঘন কালচে সবুজ রঙের শক্ত গুল্মজাতীয় গাছ এই বেড়ালতা।পাতা ছিঁড়লে সাদা আঠালো তরুক্ষীর বেরোয়, পাতার মাঝখানটা ছিঁড়ে ঐ ছেঁড়ার দু'ধারে চাপ দিয়ে চোখের মতো প্রসারিত করলে সুন্দর সূক্ষ্ম জলীয় পর্দা তৈরী হয়- তাতে রামধনুর রঙ ঝলমল করে। কিন্তু বেড়ালতার রস এমনিতে ভালো না, চোখে গেলে চোখ জ্বালা করে।

বাগানের সীমানা পেরিয়ে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা নরম মাঠ- সে মাঠে গোটা কয়েক খেজুর গাছ। তারপরেই টিপুদের বাড়ী। ওদের বাড়ীর চারপাশের খালি জায়গাটুকুতে কয়েকটা নারকেল, সুপুরি আর হিমসাগর আমের গাছ। তবে ওদের বাগান নেই।

টিপু যখন হাঁটতে শিখেছে- একটা দুটো আধো আধো কথা বলে-তখনি টলমল করতে করতে চলে আসতো মাঠটায়। সুলতাও ছুটতো ওর পেছনে। দুরন্ত ছেলেকে সামলাতে ওর প্রাণান্ত। ততক্ষণে টিপু হলদে ইষ্টিকুটুম পাখীর সঙ্গে ভাব জমাতে ব্যস্ত।

কী ভেবে মাঠের ঘাসের উপরে শুয়ে পড়ে আর ছোট্টো ছোট্টো দুধে দাঁত ঝিকমিকিয়ে হাসে। "ওরে কানে পিঁপড়ে ঢুকবে,কানে পিঁপড়ে ঢুকবে- দ্যাখো দস্যি ছেলের কান্ড দ্যাখো।" সুলতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ওকে কোলে নিতো।

বাগানে জলের ঝারি নিয়ে জল দিতে দিতে দেখতুম ওদের মা ছেলের কান্ড।

   আর একটু বড়ো হলে ও স্কুলে যেতে শুরু করলো। পিঠে ব্যাগ আর কাঁধে জলের বোতল-স্কুলবাসে তুলে দিতে সুলতা যেত সঙ্গে বড়ো রাস্তা অবধি।

স্কুল থেকে ফিরতো দুপুর পার করে। একটু কিছু খেয়েই সোজা মাঠটায়-তারপরে আমাদের বাগানে। ছোট্টো ছোট্টো প্রজাপতি, পিঁপড়ে, পাখী, কাঠবেড়ালী-সবার সঙ্গেই ওর ভাব। হয়তো শেষ দুপুরে শুয়ে শুয়ে কোনো গল্পের বই পড়ছি, ওর ডাকে বাইরে এসে দেখি ছেলে ঘাসের উপরে কান রেখে বলছে " ভালোকাকীমা, দ্যাখো দ্যাখো, ঘাসেরা কথা বলছে!"

আমি তো হাঁ হাঁ করে উঠি সুলতারই মতো, কানে পিঁপড়ে-টিপড়ে ঢুকে না জানি কী কেলেঙ্কারী বাধায়। কিন্তু টিপু হেসে লুটোপুটি- বলে "পিঁপড়েরা আমার বন্ধু হয়। ওরা আমায় কিচ্ছু করবে না।"

ছবি আঁকার দিকে ওর খুব ঝোঁক ছিল খুব ছোটোবেলা থেকেই। মোটে যখন তিনবছর বয়স তখন থেকেই পাখী প্রজাপতি গাছ ফুল এইসব আঁকতো। বিকেলে আমাদের বারান্দাতে বসে বসে এঁকেছে কতদিন!

বিয়ের আগে আমারও আঁকায় খুব শখ ছিল। ছাত্রী থাকার সময় আঁকা শিখেওছি আঁকার স্কুলে গিয়ে। সবাই বলতো হাত বেশ ভালই। কিন্তু বিয়ের পরে আর হয়ে ওঠেনি আঁকা সংসারের হাজারো ঝামেলায়। রঙ, তুলি, প্যালেট, ক্যানভাস-  সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল যদিও, কিন্তু ইচ্ছেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে ছোট্টো ছেলেটা এসে বহুদিন আগে চাপা পড়ে যাওয়া ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুললো আবার।

আমার হাতের তুলিও কথা বলে উঠতে থাকলো কাগজের উপরে। এক একটা টানে চাপা পড়া স্বপ্নগুলো আবার মুখ জাগাতে থাকলো। পাখীর বাসায় ছোট্টো ছোট্টো তিনটে ছানা- মা পাখী উড়ে এসেছে কিসব মুখে নিয়ে আর ছানারা উৎসাহে কলকল করে উঠেছে-- অথবা ধানমাঠের শেষে দিগন্তরেখায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে,তার আবীর রাঙা আভায় ভরে গেছে সমস্ত আকাশ--- রাতের নদীর পাশে একলা একটা গাছ,যার ডালে ডালে চাঁদের আলোর রুপোলী কারুকাজ-- এইসব অর্ধবাস্তব- অর্ধকল্পনা রূপ নিতে লাগলো কাগজের উপরে।

টিপু মস্ত চোখ মেলে বলতো-"ভালোকাকীমা, তুমি কী সুন্দর আঁকো!"

আমি ওর গালে নরম করে হাত বুলিয়ে বলতুম,"তুই বড়ো হলে এর থেকে অনেক বেশী সুন্দর আঁকবি।"

টিপুর যখন বয়স সাত তখন ওর ঠাকুমা স্বর্গে গেলেন। এবার ওদের বাড়ীতে মোটে তিনজন- বাবা মা আর ছেলে। কালেভদ্রে ওর জ্যেঠারা আসতো বেড়াতে তাদের পরিবার নিয়ে।

টিপুর বাবা ওর কেরিয়ার নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। বাংলা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ওকে ভর্তি করলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। নইলে নাকি ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাঁর দাদাদের ছেলেমেয়েরা সবাই নাকি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।

পাড়াও বদলাচ্ছিল, অনেক নতুন লোকেরা এলো। নতুন নতুন বাড়ী হলো অনেক, কিন্তু মানুষে মানুষে আর সেই নিকটত্ব ছিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে বড়ো বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

প্রত্যেকের জীবন থেকে সময় কমে গেল অনেক। টিভি এসে সবার বিকেলগুলো গ্রাস করে ফেলেলো। এখান আর লোকেরা বিকেলে একে অন্যের বাড়ী বেড়াতে যায় না, এমনকি দুর্গপুজোর পরে বিজয়াদশমীতে যে প্রায় আবশ্যিক দেখা করার রেওয়াজ ছিল তাও আস্তে আস্তে উঠে গেল।

৩।

কিন্তু টিপু অনেকদিন পর্যন্ত একই রকম ছিল। এত পড়ার চাপ, এত সময়ের অভাব, তবু এরই মধ্যে সময় করে সে ছুটে আসতো আমাদের বাড়ীতে। বাগানে বসে দেখতো কাঠবেড়ালীদের দৌড়োদৌড়ি, আমগাছের ছায়ায় বসে কাঠবেড়ালীরা কাটুর কুটুর করে কিসব খেতো, আর আমাদের টিপুন মুগ্ধ হয়ে তাই দেখতো।

এক একদিন বলতো, "কাকীমা, তুমি কাঠবেড়ালী আঁকো?"

আমি ওকে রং-তুলি আর ড্রইং শীট দিতাম,ও শান্ত হয়ে বসে আঁকতো। একবার এঁকেছিল মস্ত একটা পাহাড়ের পাশে ছোট্টো একটা কাঠবেড়ালী, কাটুর কুটুর করে বাদাম খাচ্ছে। পাহাড়টার রাগী রাগী চোখ মুখ এঁকে দিয়ে টিপু বলতো "জানো কাকীমা, ঐ মস্তবড়ো পাহাড়টা আর ছোট্টো কাঠবেড়ালীটা ঝগড়া করছে।" আমি ওর ছবি আর কল্পনা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতাম।

ওর ছবিগুলো দিনদিন প্রানবন্ত হয়ে উঠছিল। দেখে বুঝতে পারতাম সুযোগ পেলে খুব বড়ো শিল্পী হবে ও একদিন।

কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল একদিন। একবার ওর পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলো বেশ। ওর বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। ওকে ঘরে বন্ধ করে কী করেছিলেন ঠিক জানি না, তবে এর পর থেকে ও আর আঁকলো ও না কোনোদিন।

সুলতা পরে আমায় বলেছিল ওর বাবা সেদিন ওর সব ছবি ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। খুব বকেছিলেন ওকে, মেরেওছিলেন। বলেছিলেন এরপরে পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছুতে সময় নষ্ট করলে মেরে ওর ছালচামড়া তুলে ফেলবেন। ছবি ছিঁড়ে ফেলায় ও নাকি খুব মুষড়ে গেছিল, সেই রাত্রে খায় নি।

কিন্তু তারপর থেকে ও আর ছবি আঁকে নি। মনোযোগী ছাত্র হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনাই করতো, আর কোনো হবিটবিও আর ছিল না। বেশ ভালো ছাত্র হয়ে গিয়েছিল ও। বাবামা দুজনেই খুশী হয়েছিলেন।

বছর দুয়েকের মধ্যেই ওর চোখে উঠলো মোটা ফ্রেমের চশমা। খুব গম্ভীর আর চুপচাপ। ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে দেখতাম ওর পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে ও। অথবা লিখছে। জানালার গ্রিলের ওপাশের চশমা চোখে বিরসবদন কিশোরটিকে দেখে আমার সেই চকচকে চোখের ঝলমলে শিশুটিকে মনে পড়তো। কেন জানিনা মনটা মেঘলা হয়ে যেত।

যদিও টিপু আর আসতো না, তবু আমার ছবি আঁকা থামলো না। সবার অলক্ষ্যে নির্জন দুপুর আর বিকেল ভরে চলতে লাগলো আমার ছবি ছবি খেলা। ছোট্টো টিপু ছবিগুলোর মধ্যে বারে বারে ফিরে আসতো।

মাধ্যমিকে বেশ ভালো হয়েছিল ওর রেজাল্ট। কিন্তু ওর বাবা তাতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আরও ভালো চেয়েছিলেন। উচ্চামাধ্যমিকে তিনি ওকে টার্গেট ঠিক করে দিলেন-প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে হবে আর জয়েন্টে খুব ভালো করতে হবে। নইলে নাকি আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁর মানসম্মান বলে কিছু থাকবে না।

উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের পরে ও যখন দিনরাত নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়াশোনা করতে শুরু করলো তখন সুলতা বিচলিত হয়ে পড়লো। সত্যি খুব রোগা হয়ে গেছিল টিপু, মাঝে মাঝে নাকি অল্প অল্প জ্বর হতো। ডাক্তার ভালো করে পরীক্ষা করে নাকি বলেছিলেন প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকেই এইরকম হচ্ছে।

পরীক্ষার দুদিন আগে ঘটলো বিপর্যয়। টিপু মাথা ঘুরে পড়ে গেল, অজ্ঞান হয়ে গেল। ওদের বাড়ীতে হুলুস্থূলু কান্ড। ডাক্তার এলেন, তাঁর চেষ্টায় যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বোঝা গেল কোথাও একটা খুব গন্ডগোল হয়েছে, টিপু স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে, কিছুতেই আর কিছু মনে করতে পারছে না।

সেই বছর পরীক্ষা দেওয়ার তো আর প্রশ্নই ওঠে না। টিপুর মন তখন সম্পূর্ণ ব্ল্যাংক। তার কিছুদিন পরেই একটা রিহ্যাবে নিয়ে যাওয়া হয় টিপুকে। আশ্চর্যের কথা, রিহ্যাবে যাবার আগে ও কেমন করে যেন আমাকে মনে করতে পেরেছিল, যাবার রাতে ওর মায়ের সঙ্গে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলে গেল, " ভালোকাকীমা, ফিরে এলে আবার আসবো তোমার কাছে। "

ওর ফিরে আসা হয় নি, রিহ্যাবেই মারা যায় ছ'মাস পরে। সুলতারা বাড়ী বিক্রি করে পন্ডিচেরী চলে গেল। টিপুর বাবা স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন সময়ের অনেক আগেই।

আমার ছবিতে কিন্তু এখনো লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে ছোট্টো টিপু। ঘাসের উপরে কান রেখে কচি গলায় বলছে "ভালোকাকীমা, দ্যাখো, ঘাসেরা কথা বলছে।"

দেখতে পাই গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে আমগাছের ছায়ায় বসে বিভোর হয়ে আঁকছে টিপু। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে সূর্য ঢলে পড়ছে মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমে, টিপুর হুঁশ নেই।

সুলতা আসছে ডাকতে ডাকতে, "টিপু উ উ উ ", টিপু শুনতে পাচ্ছে না। ওর কাছে এসে সুলতা বলছে, "হ্যাঁরে তোর কি খিদে তেষ্টাও পায় না? এত বেলা হয়ে গেল, কখন স্নান করবি, কখন খাবি?"

স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ তুলে টিপু বলছে, "অ্যাঁ? কী বলছো?"

পুরু লেন্সের পিছন থেকে এক কিশোরের দুঃখী চোখও আমার দিকে চেয়ে থাকে,তার ছবিও ফুটে ওঠে তুলির টানে - জানালার গ্রিলের ওপাশ থেকে কিশোর ছোটনের শান্ত-গম্ভীর মুখ। পড়ার টেবিলে টিপু, মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবার পরের হাসিমুখ টিপু।

সে আমাকে ভোলে নি। আমি যখন আঁকি, একা একা নির্জন দুপুর, আমার রং তুলি প্যালেট ছড়িয়ে, তখন সেই পলাতক বালক এসে আমার পাশে দাঁড়ায়, আমার হাত দিয়ে আঁকতে থাকে সে, আমার চোখে তার দৃষ্টি বুনে দিতে থাকে। দেখতে দেখতে আমার আঁকা গুলো অন্যরকম হয়ে যেতে থাকে- অনেক আশ্চর্য কল্পনা মিশে সেগুলোকে পাল্টে দিতে থাকে ।

৪।

বহুকাল পরে আমার স্কুলবেলার বান্ধবী মধুচ্ছন্দার ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যাই। ও নাকি বহুকাল দিল্লিতে ছিল, এত বছর পরে কলকাতায় ফিরেছে। আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর পেয়েছে আমার বোনের কাছ থেকে। একদিন ওর বাড়ীতে যেতে নেমন্তন্ন করলো। ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিল কোন রুট কত নম্বর বাস সব কিছু।

তবু সেসব ভুলেই গেছিলাম। মধুচ্ছন্দা আবার ফোন করলো। এতবার করে যেতে বলছে- যে শেষ পর্যন্ত মন ঠিক করতেই হলো আমার। একদিন সকাল সকাল তৈরী হয়ে গেলাম ওর বাড়ীতে।

"রূপন, রূপন, একবার এঘরে এসো। তোমার আন্টি এসেছেন।"

পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক শান্ত কিশোর, কিন্তু তার চশমার আড়ালে চোখ দুটো রাগী-রাগী।

আমি চমকে উঠি, ঠিক যেন টিপু!! শুধু টিপুর চোখে এত রাগ ছিল না।

আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি বলে "গ্ল্যাড টু মিট ইউ আন্টি। হাউ আ' ইউ ডুইং ?"

আমি হেসে ফেলি,"আমিও খুশী হয়েছি রূপণ।"

রূপণ একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে। তারপরে বলে,"এক্সকুইজ মী আন্টি,আ' ম ভেরি বিজি।" এই বলে চলে যায়। 

  আমি  মধুচ্ছন্দার দিকে তাকিয়ে বলি," সে কিরে ছন্দা,তোর ছেলে একেবারেই বাংলা বলতে পারে না?"

আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে আমি থেমে যাই। ওর চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছে , ঠোঁট দুটো কাঁপছে।

ও আস্তে আস্তে থেমে থেমে আমাকে বললো সব কিছু। রূপণ ওদের একমাত্র ছেলে, পড়াশোনাতে ভালই ছিল-উপরন্তু খুব ভালো আঁকতো ও। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে ওর বাবা ওর আঁকা কঠোর ভাবে নিষেধ করে দিলেন একদিন।

তারপর থেকে ও আর কোনোদিন রঙতুলি ছোঁয় নি, কিন্তু স্বভাব পাল্টে যেতে থাকলো ওর। আগে ছিল হাসিখুশী ছেলে, এখন হয়ে গেল রাগী। একদিন ভয়ানক রেগে জিনিসপত্র ছুঁড়তে থাকে ও, সবাই মিলে ধরে বেঁধে মনোরোগবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে বেশ কিছুদিন থাকার পর কিছুটা ভালো হয় ও। এখন অনেক ভালো, তবু একেবারেই বাংলা বলে না, সারাদিন অংক খাতায় হিজিবিজি টানে। ডাক্তার ওকে কোনোরকম মানসিক চাপ দিতে বারণ করেছেন। কিছুদিনের জন্য জায়গা বদল করতে পারলে ভালো হয়। সেই ভেবেই ওরা দিল্লি ছেড়ে কলকাতা এসেছে, কিন্তু এখানেও কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।

৫।

আমার বাগানে আমগাছের ছায়ায় নির্জন দুপুর নেমেছে। নরম ঘাসের উপরে এলিয়ে বসে রূপন ড্রইং শীটের উপরে তুলি টানছে। পাশে আমি, আমার ড্রইং শীটে তুলির টানে টানে ফুটে উঠছে সেই পক্ষীনীড়, মা পাখী আর তার তিন ছানা।

রূপন বেশ কিছুদিন আছে আমার এখানে। প্রথমে আসতে রাজী হয় নি কিছুতেই, আমি বলেছিলাম যে আমার অনেক ছবি দেখাবো ওকে-সব আমার নিজের হাতে আঁকা।

এখন রূপন দিব্যি বাংলা বলে, এক একদিন হাসেও। মাঝে মাঝে আমি চমকে উঠি, ঠিক যেন টিপুর হাসি!

একটু একটু করে রাগী কিশোরের মধ্য থেকে সেই পলাতক বালকটি দেখা দিতে থাকে, আমি আমার সবটুকু ক্ষমতা জড়ো করে ওকে শেখাতে থাকি। যা এতদিন ওর জন্যে জমিয়ে ছিলাম, সবটুকু উজার করে ওকে দিয়ে দিতে থাকি।

*****

Tuesday, July 22, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২১)

জীবনের উৎপত্তি বা ওরিজিন অব লাইফ ব্যাপারটা বেশ জটিল। সৌরজগতে এতগুলো গ্রহ,উপগ্রহ-তার মধ্যে শুধুমাত্র এই পৃথিবী গ্রহটাতেই(কেউ কেউ যুক্তিনির্ভর অনুমান করে বলেন মঙ্গল গ্রহে বা বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় অথবা শনির উপগ্রহ টাইটানে প্রাণ থাকলেও থাকতে পারে, তবে সেসব প্রমাণিত নয় এখনও, এখনও অবধি কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় নি ) এত রকমের প্রাণ, জলে স্থলে বাতাসে প্রাণে প্রাণে ছয়লাপ, আণুবীক্ষণিক জীব থেকে শুরু করে বিরাট বিরাট সব মহামহীরুহ ধরনের জীব, সবই এইখানে।

কিন্তু শুরুতে তো এরকম ছিল না। প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরী হয়েছে সৌরজগতের আর সবকিছুর সঙ্গে, তখন পরিবেশ ছিল একেবারেই অন্যরকম। শুরুর থেকে প্রথম একশো কোটি বছর কোনো প্রাণের চিহ্ন ছিল না দুনিয়ায়, সবচেয়ে পুরানো যে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে ফসিল রেকর্ডে, সে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি বছরের পুরানো। সরল প্রোক্যারিওটিক ধরণের জীবকোষের ফসিল সেসব। কিন্তু সেও পরম আশ্চর্য ব্যাপার, কী করে জড় পাথর জল গ্যাস ধূলা থেকে তৈরী হলো এমন জিনিস যা কিনা নিজের প্রতিলিপি তৈরী করতে পরে? তারপরে ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর জীবকোষের চিহ্ন পাওয়া যায়, জীবজগৎ বিবর্তনের পথে এগিয়ে গিয়েছে জটিলতার দিকে, একসময় তৈরী হয়েছে ইউক্যারিওটিক জীবকোষ, যা দিয়ে আমরা তৈরী।

কিন্তু শুরুটা হলো কেমন করে? এই নিয়ে বহু তত্ত্ব আছে, কেউ বলেন পৃথিবীতেই হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া,মিথেন, জলীয় বাষ্প এইসবের সংযোগে নানারকম জৈব বস্তু তৈরী হয়েছে, তারপরে তার থেকে ক্রমে জীবকোষ। কেউ বলেন জৈববস্তু সরল প্রাণকোষ সবই অন্যত্র তৈরী হয়েছে, উল্কাখন্ডের মাধ্যমে এসে পড়েছে আদিম পৃথিবীতে, তারপরে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নানাভাবে বিবর্তিত হতে হতে জৈববৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

এইসব কিছু তথ্য এখন পাওয়া যত সহজ তখন সেই নেট-পূর্ব সময়ে কম্পিউটার পর্যন্ত না চেনা আমাদের পক্ষে পাওয়া চিন্তারও বাইরে ছিল। তথ্যসূত্র বলতে জীববিদ্যার উঁচু ক্লাসের কিছু বই, কিছু ম্যাগাজিনের কিছু প্রবন্ধ ইত্যাদি। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরীও ছিল বলতে গেলে প্রায় বন্ধই। বইয়ের সংগ্রহও সেখানে খুবই সীমিত ছিল।

যাই হোক, এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অন্বেষা তৈরী হতে শুরু করলো, ওর আগ্রহ দেখে আমাদের এক দিদিমণি , অরুণিমাদি- উনি মাধ্যমিক স্তরে পড়াতেন ফিজিকাল সায়েন্স আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কেমিস্ট্রি, তিনি উৎসাহিত হয়ে ওকে কিছু কিছু সাহায্য করতে লাগলেন। সেও যৎসামান্যই। আলাদা করে এসব করানোর মতন ব্যবস্থা বা সময় কিছুই আমাদের স্কুলে ছিল না।

নির্দিষ্ট দিনে অরুণিমাদি আর আমাদের স্কুলে নতুন শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেওয়া বিপাশাদি অন্বেষাকে আর ক্লাস টেনের তিথিকে(সেও অংশগ্রহণ করবে স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনারে) নিয়ে রওনা হলেন যে স্কুলে প্রতিযোগিতা হবে সেইদিকে। দুটো মাত্র পিরিয়ড ক্লাস হয়েই সেদিন স্কুল ছুটি কী কারণে যেন, তাই ওদের সুবিধেই হলো। সেমিনার শুরু হবে দুপুর দুটোর পরে।

স্কুল ছুটিই যখন হয়ে গেল, তখন আমার হঠাৎ মাথায় খেলে গেল, আরে, আমিও তো যেতে পারি ওদের সঙ্গে! ওরা রিক্শায় গিয়েছে, কিন্তু আমার তো সাইকেল রয়েছেই, আর ঐ হোস্ট স্কুলও চিনি তো! আমাদের পাড়া থেকে ঐ স্কুলই বরং কাছে। যা ভাবা সেই কাজ, আমিও রওনা দিলাম সেইদিকে। না ঢুকতে দিলে সোজা নাহয় বাড়ী চলে যাবো, আর তো কিছু না! আর দেখতে দিলে দেখবো, সেমিনার হয়ে গেলে সরাসরি বাড়ী চলে যাবো।

যেতে যেতেই ওদের রিক্শাকে দেখতে পেলাম, ওরা পৌঁছনোর কয়েক মিনিটের মধ্যে আমিও পৌঁছে গেলাম। অরুণিমাদি আর বিপাশাদি অন্বেষা আর তিথিদির আমাকেও সঙ্গে নিলেন ঢোকার সময়। আয়োজকদের একজন আমাদের পথ দেখিয়ে দোতলায় একটা ঘরে নিয়ে বসালেন, চমৎকার সুন্দর ঘর, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মেঘেভরা আকাশ, তখন ঘোর বর্ষা, শরৎ আসতে সামান্য বাকী। ঐ ঘরে তখন পর্দা টানানো টেবিলক্লথ পাতা ফুলদানি সাজানো এইসব চলছিল, আমরা এতই তাড়াতাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি!

তিথিদি এই স্কুলে এক পুরনো বন্ধুকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলতে সামনের করিডরে চলে গেল। বিপাশাদি আর অরুণিমাদি জানালার পাশে দুই চেয়ার টেনে বসলেন। আমি আর অন্বেষা পাশাপাশি বসলাম একপাশের এক বেঞ্চে। অন্বেষার মুখ একটু ফ্যাকাশে, একটু একটু নার্ভাস মনে হয়। পাব্লিক স্পিকিং ব্যাপারটাই একটা কেমন যেন ইয়ে ব্যাপার, ভয় তো হবেই। আমি ওকে সাহস দেবার জন্য নানা ভুজুং ভাজাং বলতে বলতে ওকে হাসাতে লাগলাম।

(চলবে)

Wednesday, July 16, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২০)

ক্লাস এইটে বদলি হয়ে বড় শহর থেকে একজন এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো। চন্দ্রাণী চট্টরাজ। খুব নামডাক তার, পড়াশোনায় নাকি দারুণ সে। বড় শহরের পালিশ তার, সবাই বলতে লাগলো, আমাদের মতন গাঁ-মফস্বলের মেয়েদের সে তুড়ি মেরে হারিয়ে দেবে। আমাদের সেকশানে এসে বিশেষ করে আমাদের সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ব্যতিক্রমহীন ভাবে ফার্স্ট হয়ে আসা অন্বেষাকে কায়দা করে শুনিয়ে যেতে লাগলো অন্য সেকশনের মেয়েরা। চন্দ্রাণী বদলি হয়ে ভর্তি হয়েছিল বলে এ সেকশনেই প্রথমবার পারে নি আসতে, ক্লাস এইটে ও ছিল বি সেকশনে।

প্রথমবার চন্দ্রাণীকে দেখে তো আমরা অবাক! ছোট্টোখাট্টো ফর্সা গোলগাল মেয়েটি, মাথায় লম্বা চুল পিঠ ছাপিয়ে, সেই বিশাল চুলের রাশি মোটা একটা বেণীতে বাঁধা। অমরা তো ভেবেছিলাম শহরের মেয়ে, খুব চোখেমুখে কথা বলা টাইপ বুঝি হবে, চুল ছোটো করে ছাঁটা হবে, ছেনিকাটা চোখমুখ হবে। এ তো একেবারে ধ্রুপদী বঙ্গবালা টাইপ শান্ত নরম একটা মেয়ে।

আমাদের অন্বেষা, শুভাশ্রী, শ্রীতমা, চন্দ্রিমা, সুগোপারা তো স্বস্তির শ্বাস ফেললো ওকে দেখে। বন্ধুত্ব হতেও খুব একটা দেরি হলো না।

ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় চন্দ্রাণী ভালো করেছিল ঠিকই, তবে প্রথম তিনজনের মধ্যে আসতে পারে নি। অন্বেষা তো একইরকম প্রায় সব সাবজেক্টে হায়েস্ট পাওয়াই রয়ে গেল, সে ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়েছিল মনে হয় শ্রীতমা আর থার্ড হয়েছিল সম্ভবত শুভাশ্রী। তার পরে চন্দ্রাণী।

অনেক পরে, মাধ্যমিকেরও পরে যখন চন্দ্রাণী আবার ওর বড় শহরে ফিরে গেল, তখন শ্রীতমা বলেছিল, "আমাদের গাঁ-মফস্বলেও কিন্তু চট্টরাজ ভালো কম্পিটিশনই পেয়েছিল, বলতে পারবে না যে একেবারেই কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে পায় নি।" কেন জানি শ্রীতমা ওর নাম না ধরে পদবী ধরে উল্লেখ করতো সবসময়, হয়তো পদবীটা বেশ আনকমন ছিলো বলে।

এখন ভেবে দেখলে মনে হয় চন্দ্রাণীরও কতটাই না মানিয়ে নিতে হয়েছিল হঠাৎ করে নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে উপড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় উপস্থিত হয়ে।

বহুকাল আর যোগ নেই ওর সঙ্গে, এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে কোথায় আছে ও, কেমন আছে ও? এইট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা অবধি ঐ তিনটে বছরের কথা মনে আছে কি ওর?

ক্লাস এইটে আরেকটা বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আমাদের। হঠাৎ শোনা গেল একটা ইন্টার-স্কুল স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনার হবে, তাতে হোস্ট আমাদের স্কুল। ক্লাস নাইন আর টেনের ছাত্র- ছাত্রীরাই অংশগ্রহণ করবে, তবে ক্লাস এইটের কেউ যদি আগ্রহী হয় আর আত্মবিশ্বাসী হয়, তবে সে বা তারাও অংশগ্রহণ করতে পারে।

আরে অংশগ্রহণ তো পরের কথা, জিনিসটা কী সেটাই তো তখন আমরা জানি না। সেমিনার আবার কী? এটা কি কোনোরকম প্রতিযোগিতা? তার আগে কোনোদিন আমরা সেমিনার বলে কোনো ব্যাপারের নামও শুনি নি। বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা-এসব ব্যাপার তবু ভাসা ভাসা কিছু কিছু জানতাম, কিন্তু সেমিনার কী জিনিস?

অল্পবয়সী দিদিমণিরা যারা নতুন নতুন ব্যাপারের অনেক খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা এসে আমাদের এই ব্যাপারে ধারণা দিতে চেষ্টা করলেন।

জেলাসদরের একটি সংস্থা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। সেখান থেকে একটি বিষয়বস্তু দেওয়া হয়েছে আর নির্দেশাবলিও দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে বক্তৃতার মতন করে বলতে হবে আর সঙ্গে স্লাইডে ডায়াগ্রাম চার্ট ইত্যাদিও দেখানো যেতে পারে, দেখালেই সুবিধে। সময় পাঁচ মিনিট।

এই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের যুগে দাঁড়িয়ে সেই আমাদের প্রথম স্টুডেন্ট্স সায়েন্স সেমিনারকে অদ্ভুত আদিযুগের জিনিস মনে হয়। তখন তো কম্পিউটার কী জিনিস তাই জানতাম না আমরা কেউ, দেখা তো দূরের কথা। কেউ কেউ টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছিল কম্পিউটার, বলেছিল টিভি আর টাইপ রাইটারকে একসাথে জুড়লে যেমন হয় সেরকম জিনিস ওটা।

তো আমাদের সেই প্রি-কম্পিউটার সেমিনারে চার্ট ডায়াগ্রাম ইত্যাদি দেখানোর জন্য দিদিমণিরা সাজেশন দিলেন অনেকপাতার ক্যালেন্ডারের মতন করে বানানো একটা বস্তু, তার পাতায় পাতায় ডায়গ্রাম চার্ট ইত্যাদি। সেমিনারে বলতে বলতে পাতা উল্টে উল্টে দেখাতে হবে।

আমরা সব বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগলাম। ক্লাস এইটের আমরা দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম নাইনের দিদিরা কীভাবে সব বানাচ্ছে। যদিও আসল প্রতিযোগিতার দিন ভালো ভালো স্কুল থেকে তুখোর তুখোর সব সেমিনার দেনেওয়ালারা এসে বলে টলে একেবারে মাতিয়ে দিল, জাজরা ওদের মধ্য থেকেই ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড বেছে নিলেন। তখনই আমরা বেশ স্পষ্ট করে বুঝেছিলাম ভালো স্কুলের ব্যাপার স্যাপার আমাদের নিতান্ত সাধারণ মধ্যমানের স্কুলের থেকে কতটাই আলাদা।

পরের বছর অন্য একটা স্কুল হোস্ট করলো এই কম্পিটিশন। আর আমাদের মধ্য থেকে অন্বেষা তৈরী হলো অংশ নেবার জন্য। অন্য কারুর তেমন আগ্রহ ছিল না অথবা হয়তো মনে করেছিল সময় নষ্ট করে লাভ কী? এসব করে তো পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো পজিটিভ এফেক্ট পড়বে না!

সেই বছরের টপিক ছিল ওরিজিন অব লাইফ, জীবনের উৎপত্তি।

(চলবে)

Thursday, July 3, 2014

সবুজঘরের ছাদে

১।

সবুজঘরের ছাদভর্তি সোনালি রোদ্দুরে আচার শুকোতে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় রচনা। ভেজা চুল মেলে দিয়েছে পিঠে, ছাদে আচার শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুলও শুকায়। লালশাড়ীর আঁচলের প্রান্তটি হাওয়া লেগে ওড়ে, কার্ণিশে চিবুক রেখে দূরের মাঠের দিকে চেয়ে থাকে রচনা। কবেকার ভুলে যাওয়া গানের কলি তার মনে মনে গুণ্‌গুণ্‌ করে ওঠে পথভোলা ভোমরার মত।

শীতের দুপুর হালকা আলস্যে গড়িয়ে যেতে থাকে ফ্যাকাশে বিকালের দিকে, তারও পরে কুয়াশাসন্ধ্যা-যখন কুয়াশার মাঠ পেরিয়ে ঘরে ফিরে আসবে ক্লান্ত সব কাজের মানুষেরা।

২।

গাড়ী চালাতে চালাতে ক্লান্তি ছেয়ে আসে সর্বাঙ্গে অর্চিষ্মানের। নির্জন রাস্তা মরুভূমি চিরে চলে গেছে দূর থেকে দূরে। রিফ্লেকটরগুলো ঝকমক করে গাড়ীর আলোতে, পাশের নি:সীম মরুভূমিতে নক্ষত্রালোকে দেখা যায় আঁকাবাঁকা ক্যাকটাসের দীর্ঘ শীর্ণ দেহগুলো।

মাঝে মাঝে মরুহ্রদ, তাতে টলটলে নক্ষত্রছবি। এরকম স্মৃতি আগে ছিলো না অর্চিষ্মানের। এইভাবে সারারাত গাড়ী চালিয়ে মরু পার হয় নি সে কোনোদিন আগে। ঘুমঘুম মন নিয়ে শান্তভাবে গাড়ী চালাতে চালাতে মনটা অজানা কিসের একটা ভাবনায় ছেয়ে যায় অর্চির।

মনে হয় সে যদি শত শত কিংবা সহস্র বছর আগে অন্য কোনো জন্মে এই মরুর কোনো গাঁয়ে জীবন কাটিয়ে থাকে,তাহলে কি এখন গেলে চিনতে পারবে সেই গাঁ, সেই পাহাড়ের গুহায় আঁকা পূর্বপুরুষের স্মরণচিহ্ন, সেইসব অদ্ভুত ছবি, সেই আশ্চর্য ভাষা, আশ্চর্য বিশ্বাস!

৩।

বৃতি কথা বলে খুব কম, কিসে যেন সবসময় মগ্ন হয়ে থাকে। কেউ ওকে বেশী ঘাঁটায় না, বন্ধুরা জানে বৃতি আত্মমগ্ন শিল্পী। মেয়ে আদিরা একেবারে ওর মায়ের মতন দেখতে, কিন্তু সে খুব কথা বলে। রায়ান মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে মা এত কম কথা বলে আর মেয়ে এত টরটরি হলো কিকরে?

রায়ান যখন বৃতিকে বিয়ে করে তখন আদিরা মাত্র একবছরের, রায়ানের কি যে মিষ্টি লাগতো ওকে দেখতে! অতটুকু বয়সের শিশুর মধ্যে কি আশ্চর্য টান থাকে! রায়ানের নিজের ছেলেটার কথা মনে পড়তো, ওর নাম ছিলো নিকোলাস। মনে পড়তো ওর মা ক্যাথেরিনের কথা। নিকোলাস আর ক্যাথেরিন, নিক আর ক্যাথি। জোর করে সে সরিয়ে দিতে চাইতো মন থেকে--কিন্তু বারান্দার শূন্য দোলনাটা কেবল ভেসে উঠতো স্মৃতিতে-সব ঘর ঘুরে ঘুরে যেখানে এসে বসতো সে বারবার, বুঝতেও পারতো না যে সেখানে সে আসছে!

ডাইরিটা খোলা পড়ে থাকতো কোলের উপরে, নিকোলাসের জন্য লিখছিলো ক্যথেরিন--সে কোনোদিন একপাতার বেশী পড়তে পারে নি, জলে ঝাপসা সব, সে কিছু দেখতে পেতো না। ওভাবেই কি চলে যেতে হয়? সবচেয়ে সুখের সময়ে এভাবে রায়ানকে সর্বহারা করে? পুলিশ ওদের দুজনের দেহ উদ্ধার করেছিলো নদী থেকে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ীসমেত তারা পড়ে গেছিলো। কতবার ভেবেছে রায়ান সে যদি থাকতো! সে যদি ক্যাথেরিনকে বাচ্চা নিয়ে একা না যেতে দিতো! কেন সে সঙ্গে যায় নি, কেন?

৪।

হাল্কা নীল ভোর, খুব মৃদু একটা আভা শুধু দেখা দিয়েছে। এখনও সূর্য উঠতে অনেক দেরি, পুবের আকাশে এখনো লাল রঙই লাগে নি। হাওয়ায় হাল্কা শীত-শীত ভাব। একটা ভোরজাগা পাখি সুরেলা গলায় ডেকে উঠলো, গানের প্রথম আখরটির মতন বাধো-বাধো ডাক।

সুজাতা জেগে গেছিল আগেই, অনেককাল ধরেই শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। সেই স্কুলে থাকার সময় সে রাত জাগতে পারতো না বলে শেষরাতে মা ডেকে দিতো, সে উঠে পড়তে বসতো, সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। এখন যদিও আর দরকার নেই অত তাড়াতাড়ি ওঠার, কিন্তু সুজাতার ভালোই লাগে। মনে হয় এই শেষরাত বা প্রথম ভোর, যখন বেশীরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে আছে, চারিদিক খুব নির্জন আর শান্তিময়, এই সময়টা তার কাছে একটা গোপন উপহারের মতো, সেই ছোটোবেলার জন্মদিনের সময়কার বালিকা সুজাতা হয়ে সে মোড়ক একটুখানি খুলে চুপিচুপি দেখে নেয় কি আশ্চর্য জিনিস আছে ভিতরে। আরেকটু বেলা বাড়লে যখন একে একে সবাই উঠে পড়ে, আওয়াজ আর তাপ বাড়তে থাকে, তখন সেই লুকিয়ে উপহার দেখে নেবার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চকর আনন্দ সে আর পায় না।

এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুজাতা চুপ করে দেখছে একটু একটু করে আকাশের গায়ে আলোর তুলি বুলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য শিল্পী, ঐ অনেক উপরের মেঘগুলোয় কেমন আশ্চর্য রঙ! সেই পাখিটা এখন কেমন ছন্দবাঁধা ধ্বনিতে সুরেলা গান গেয়ে যাচ্ছে-সুজাতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। হঠাৎ আরেকটা পাখি সাড়া দিয়ে ডাক দেয়। দু'জনে মিলে এখন যুগলবন্দী গাইছে তারা। নিজের অজান্তে একটা ছোট্টো শ্বাস পড়ে সুজাতার। আর একেবারে হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় ইমনের মুখ।

৫।

কেউ কি হেমন্তের মধ্যরাত্রির গন্ধ পেয়েছে? ধানের গন্ধ, ক্ষীরের গন্ধ, পিঠার গন্ধ মিলেমিশে থাকতো সেটায়। কুয়াশার গন্ধ পেয়েছে কেউ মাঘপঞ্চমীর সকালে? নিমপাতা আর হলুদের গন্ধ ছিলো তাতে। কেউ কি জৈষ্ঠ্যের মধ্যাহ্নের গন্ধ অনুভব করেছে? আমি শুকনো লঙ্কার গন্ধ পেতাম ওসব দুপুরের রোদে। আষাঢ়ের মেঘমেদুর হয়ে আসা আকাশের গন্ধ নিয়েছে কেউ? কেমন লেগেছে ?

রুমন, শোনো, চন্দনকাঠের যে বাক্সটায় তোমার সব চিঠিগুলো রেখেছি, সেই বাক্সটার গন্ধ অপূর্ব! তোমার চিঠির কাগজেও সুন্দর গন্ধ থাকতো! হাল্কা গোলাপী পাতায় গোলাপের গন্ধ! হাল্কা কমলা ছোপ দেওয়া সাদা রঙের পাতায় শিউলির গন্ধ! সব এখনো আছে। পাতাগুলো পুরানো হয়ে এসেছে, লেখাগুলো ম্লান হয়ে এসেছে, গন্ধ ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু আছে।

রুমন, যেখানে তুমি চলে গেছ, সেখানে বকুলগাছ আছে? বকুলফুলের গন্ধ পাও আজো তুমি? ফুলের সময়ে বকুলফুল রুমালে জড়িয়ে রেখে দিতাম ছোট্টো ব্যাগটার মধ্যে, মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সুরভিসার আজো বুঝি রয়ে গেছে সেখানে।

পৃথিবী ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে নতুন নতুন আতর মাখে, প্রত্যেকদিন নতুন, কত আছে কেজানে ...

নীল বৃষ্টির ভিতরে

১।

নীলমেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিকণারা নেমে আসছিল, একের পর এক। টুপ টাপ টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছিল রাধাশ্যামের মন্দিরের বাগানের গভীর দিঘির কালো জলে। মস্ত মস্ত নীল মুক্তোর মতন জলবিন্দু। কালো জলে ডুবে যাচ্ছিলো। ওরা কোথায় যায়?

ওই দিঘি কত গভীর কেউ জানে না, ঘাট থেকে জলে নেমে একটু এগোলেই আর থই পাওয়া যায় না, তখন সাঁতার দিতে হয়। আমি সাঁতার জানি না, তাই পাথরের ঘাটের কাছ থেকে বেশী দূরে যাই নি। লোকে গল্প বলে নাকি দিঘির গভীর তলদেশে আছে মণিমুক্তাসাজানো জলগুহা, তা হলো পাতালের দরজা। ঐ গুহাপথে পাতালে পৌঁছলে নাকি দেখা যাবে পাতালের রাজ্য, তাতে হীরা, মুক্তা, মণি, মাণিক্য ছড়াছড়ি যায়।

আহা, পাতালে পৌঁছতে পারলে বেশ হতো! তাহলে এই ছেঁড়া কালো জামা পরতে হতো না আর, পেট ভরে খেতেও পেতাম দু'বেলা। যেখানে এত ধনদৌলত ছড়াছড়ি যায়, সেখানে ভালো ভালো খাবারও নিশ্চয় অনেক। মা ও এত মারতো না তাহলে, পেতই বা কোথায় আমাকে? আমি তো তখন সে-এ-এ-এ-ই পাতালের রাজ্যে! বা:, বেশ মজা হতো!

" টুনি, ও টুনি, কই গেলি তুই? " মা ডাকে, আমি দিবাস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি। কোথায় বৃষ্টি? খটখট করছে দুপুর। ঘাটলার অশ্বত্থছায়া থেকে উঠে পড়ি। মা বেরোবে বিকালের কাজে, আমায় ঘরে থাকতে হবে। যাই, দেরি হলে মা আবার চুলের মুঠি ধরে এমন চড় দেবে যে গালে দাগ পড়ে যাবে। একদিন দিয়েছিল ওরকম, ঘুরে পড়ে গেছিলাম মেঝেতে।

যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলি, "যাই দিঘি, কালকে আবার আসবো। "

দিঘি কী বললো শোনা হলো না। আচ্ছা, সত্যি কি পাতালরাজ্য আছে? জলমানুষেরা আছে? থাকলে বেশ হতো কিন্তু! মা পেট ভরে খেতে দেয় না, দেবেই বা কোত্থেকে? একা একা খেটে আমাকে আর দুটো ভাইকে খেতে পরতে দেওয়া আবার নিজের জন্য ও তো লাগে, এ কি সহজ? আরেকটু বড় হলে আমিও কাজ করতে শুরু করলে তখন বেশ ভালো হবে। পেট ভরে খেতে পাবো, আস্ত কাপড় পরতে পাবো। সে কবে?

হয়তো আর কিছুদিন পরেই মা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কোনো বাসায় কাজ ঢুকিয়ে দেবে। এই তো পাশের ঝুপড়ির মালতিকে গত মাসে স্টেশনের কাছের ঐ উঁচু বিল্ডিং এর এক বাসাবাড়ীতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মা। মালতি তো আমার বয়সীই প্রায়, একটু বড়ো। সেরকম হলেও ভালো হয়, বাসাবাড়ীতে ফ্যান আছে, হাওয়া খাওয়া যায়, টিভি আছে দেখা যায়। সবসময় তো আর কাজ না, কাজ ফুরালে টিভি দ্যাখা যায়। তাছাড়া মালিকেরা জামাকাপড়ও দেয় অনেক, ওদের ছেলেমেয়েদের একটু পুরানো হয়ে যাওয়া জামা দিয়ে দেয় কাজের লোকেদের।খাবারদাবারও ভালো পায় সেখানে মালতি। বেশ মজাতেই আছে। মালতি মাঝে মাঝে আসে, ওর মাসমাইনের টাকা ওর মাকে দিয়ে যায়।

পৌঁছে গেছি, মা যথারীতি রেগে আছে। আমার দিকে তেড়ে এসে বলে, "কোন্‌খানে ছিলি এতক্ষণ?এত বড় বুড়োধাড়ি মেয়ে রাতদিন টইটই করে বেড়ানো? ঘরের কাজগুলো তো খানিক করে রাখলে পারিস, তা করার নাম নেই! তাহলে যে মা'র সুবিধা হয়! ছোটো ভাই দুটোকে দেখে রাখলেও তো কিছু কাজের কাজ হয়। তা না, ইনি পাড়া বেড়িয়ে বেড়াবেন! দাঁড়া আজকে এমন মজা দেখাবো যে আর ভুলবি না। "

বলতে না বলতেই চুলে টান আর ঠাস করে ডান গালে এক প্রচন্ড জোরে চড়, পড়ে যেতে যেতে সামলাই, চোখে অন্ধকার। সেটা সামলাতে না সামলাতেই বাঁ গালে আরেক চড়। আ:, কেন মা এত মারে! এইবারে মালতি আসলে ওকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবো ওর চেনা কোনো বাসাবাড়ীতে কাজের লোক রাখবে কিনা কেউ। ও যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে ওর সঙ্গে চলে যাবো মাকে না জানিয়ে।

লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে মাকে বলি, ""আমি ছোটন আর বুড়নকে দেখে রাখছি। তুমি কাজে যাও। "

ঘুমিয়ে থাকা ভাইদের পাশে গিয়ে বসি, তালপাতার আধাভাঙা পাখাটা দিয়ে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে থাকি। মা কিন্তু তখুনি যায় না, আমাকে একটা রুটি আর অল্প কাঁচকলাভর্তা এনে দিয়ে বলে,""খিদে পায়নি তোর? সেই তো কোন সকালে দুটি পান্তা খেয়েছিলি, তারপরে তো আর কিছু খাস নি। "

আমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলি, "আমার খিদে পায় নি। তুলে রেখে দাও, রাত্তিরে দিও। " আমার মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ে, ছেঁড়া ফ্রকের হাতায় মুছি। মা যাতে না দেখতে পায় সেই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মা দেখতে পেল।

মা খুব কেমন রকম গলায় বলে, "কী রে তোর মুখে রক্ত! এত লাগলো? "

কাছে এসে আমাকে আলতো করে ধরে, আমি চোখ বন্ধ করি, হাতের পাখাটা পড়ে যায়। নীল মেঘ ভেঙে নীল বৃষ্টিরা নেমে আসছে, অনেক অনেক নীল বৃষ্টিকণা। টুপ্‌ টুপ্‌ করে ডুবে যাচ্ছে দিঘির কালো জলে। আমিও ডুবে যাচ্ছি ওদের সঙ্গে, আমার সারা শরীরে ঠান্ডা জলের ছোঁয়া লাগছে, দেখতে পাচ্ছি চারপাশে মাছেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় সব মাছ।

নীল রঙের একটা মস্তবড় মাছ আমার কাছে এসে কথা বলে উঠলো, বললো, " পাতালের প্রাসাদে যাবে? এসো আমার সঙ্গে।" সে ডানা নেড়ে নেড়ে সাঁতরে চলে পথ দেখিয়ে, আমি পিছু পিছু চলি। কিন্তু আমি তো ভালো সাঁতরাতে পারি না, আমার হাত-পা সব ভারী হয়ে আসে, খুব কাশি পায়, কাশি চাপতে পারি না, কাশতে কাশতে ঝলক ঝলক রক্ত উঠে আসে, জল লাল হয়ে যায়।

আহ, আর যাওয়া হলো না প্রাসাদে। সেই যেখানে ধনরত্ন মণিমুক্তা ছড়াছড়ি, যেখানে কোনো কষ্ট নেই, যেখানে খিদে পেলেই খেতে পাওয়া যায়। যেখানে একজন খুব সুন্দর মা আছে। কেউ সেখানে মারে না। আহ, যাওয়া হলো না। মাছকে বলি, "ও মাছ, মাছ, শোনো, একটু থামবে? আমি যে পারিনা আর এগোতে। "

মাছটা পিছন ফেরে, ওর হাসিহাসি মুখটা বদলে যায়, বদলে যায় আরো। চেনা কার মুখের মতন হয়ে যায়।

আমি চোখ মেলি, চোখে মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল, মা ঝুঁকে পড়েছে আমার মুখের দিকে। জলের ঝাপটা দিচ্ছিলো বোধহয়। আমার চেতন হয়েছে দেখে সোজা হয়ে বসে। আমি উঠে বসতে গেলে মা বলে, " শুয়ে থাক, শুয়ে থাক, উঠতে হবে না। "

আমি তবু উঠে বসি, কোনোরকমে বলি, "আহ, আ-আমাকে একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা। "

মা গেলাসে করে জল এনে গেলাস আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।

আমি মাকে জিগ্গেস করি , "কাজে যাও নি? "

"তোকে এই অবস্থায় রেখে যাবো? এখন একটু ভালো লাগে রে টুনি? "

"এখন ভালো। তুমি কাজে যাও। আমি ভাইদের কাছে শুয়ে শুয়ে হাওয়া করি। "

মা কাছে এসে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, "বুঝতে পারিনি টুনি, তোর এত লাগবে। আমি তোকে রুটিভর্তা খাইয়ে দিই? তারপরে কাজে যাবো। "

রুটি-ভর্তা মা খাওয়ায়, আমি নিজেই খেতে পারতাম, কিন্তু মা নিজে হাতে করে খাওয়ায়, আমি খেয়ে যাই। মুখের ভিতরে কোথাও কেটে গেছে হয়তো, জ্বালাজ্বালা করে, কিছু বলি না। কী হবে বলে? দু'দিন গেলে সেরে যাবে।

মা কেমন কোমল গলায় বলে, " আমার কথা শুনে চললেই তো আমার রাগ হয় না। একা একা ঘুরে বেড়াস, জানিস কত বিপদ আপদ চারপাশে? কথা না শুনলেই আমার রাগ ওঠে। আমার কথা শুনবি তো টুনি? আর এমন ঘুরবি না তো? "

আমি মাথা কাত করে জানাই শুনবো। মা বিপদ-আপদের কথা বলে প্রায়ই, কিসের বিপদ? কিজানি হয়তো ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যেতে পারে, সেই বিপদ।

(চলবে)

ডানার কুঁড়ি

ছোট্টো সেই খাতা, প্রত্যেকটা পাতা হাতের পাতায় ধরে যায়, এত ছোটো। আর সেই কলমটি, ছিপছিপে পাতলা গাঢ় নীল রঙের কলম, গলার কাছে এক চিলতে সোনালীর ঝিকমিক।

কমলালেবুগন্ধী শীত-দুপুরের রোদে পা মেলে দিয়ে সাবধানে খুলি খাতা । পাতাগুলো জীর্ণ, পুরানো, ঝুরঝুরে। কতকাল কেটে গেল ঐ শৈশবের খেলাখেলা লেখাগুলোর পরে? কতবার সূর্যপ্রদক্ষিণ করে এলো পৃথিবী তার অন্তহীন পরিব্রজনের পথে?

পাতায় পাতায় হিজিবিজি ছবি আর লেখা। প্রথমদিকেরগুলো একদম ছোটো ছোটো,একটা দুটো শব্দ, কখনো একটা গোটা বাক্য-কখনো আবার অদ্ভুত কোনো কথা। সেইসব আঁকিবুকি পড়তে পড়তে দুপুরজাগা চোখের মধ্যে ঘনিয়ে আসে অদ্ভুত রাত্রি, সেই রাত্রির বুক ভরে ছড়িয়ে আছে উদাসী নীলজ্যোৎস্না, যে কেবলই হাত বাড়িয়ে ডাকে। কিন্তু ছুঁতে গেলেই আর পাওয়া যায় না।

নীল কলমটি নীলজ্যোৎস্নার ভিতর
একাকী এক ঘোড়ার মতন দাঁড়ায়-
কিশোর পক্ষীরাজ, পিঠে ডানার কুঁড়ি-
সেই কুঁড়িতে বহুদিন শুধু ফুটি-ফুটি ভাব
আর আনচান করানো চিনচিনে ব্যথার ধার,
কিন্তু ডানা ফোটে নি।

একদিন এক অকালবৈশাখীর
তুমুল বজ্রবিদ্যুত-প্রহরের শেষে
সেই কুঁড়ি থেকে ডানা ফুটলো।
অমনি শিকল খুলে গেল পায়ের
ধারালো বাতাসে অস্থির টান।

সেই তখন থেকে হাওয়ার ভিতর দিয়ে
ওর নীলাভ এই একাকী উড়ান-
শুভ্র মেঘেদের পাশ দিয়ে,
দীর্ঘযাত্রার পরিযায়ী পাখিদলের পাশ দিয়ে-
কখনো দিগন্ত গোলাপী হয়ে ওঠে ভোরের স্পর্শে
সেই তখনই আবার কোথাও রক্তসন্ধ্যা আকুল।
বহু নিচে মহাসমুদ্রের আভাস পাওয়া যায়
মাঝে মাঝে মেঘের মিনারে ঝিকমিক করে ওঠে
সূর্যের উৎসবলগ্নের কিছু সঙ্কেত।

দূরে, অনেক দূরে, ঐদিকে রাত্রি
সেইদিকে উদাসীন উড়ে যেতে যেতে
সে ভাবে, সঙ্কেতের অর্থ কি পাওয়া যাবে?
ঐ অনাবিল রাত্রির মণিময় গর্ভের ভিতরে?

Friday, June 27, 2014

ক্ষমা

আমার ছোট্টো নদীটা হারিয়ে গিয়েছিল
হারানোর আগে ওর নাম ছিল ক্ষমা-
মধ্যগ্রীষ্মের প্রচন্ড বালিঝড়ে একদিন
নদীটা নেই হয়ে গেল ।

শুধু রয়ে গেল একটা আঁকাবাঁকা রেখা,
ঐখান দিয়ে একদিন ক্ষমা বইতো,
এখন সেখানে মরুবাতাস ঝিং ঝিং
করে বয়ে যায় বালির ছররা ছড়িয়ে।

শীর্ণ কাঁটাঝোপের পাশে
জীর্ণ পাথর-ঘরে
আমি অপেক্ষায় থাকি তবু।
যদি সে ফেরে কোনোদিন।
সে ফেরে না।
দিন যায় মাস যায় বর্ষ ফুরায় কত
হারানো নদী আর ফেরে না।

তারপর একদিন-
দুপুরের সূর্যের জ্বলন্ত মুখ ঢেকে দিয়ে
আকাশ ভরে এলো বর্ষণসম্ভবা মেঘেরা-
বৃষ্টির করুণাধারা ঝরতে থাকলো
ঝরতে থাকলো ঝরতে থাকলো -
সমস্ত বিকেল, সন্ধ্যে, রাত্রি।

সকালে উঠে দেখি
ফিরে এসেছে হারানো নদী,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভোরের আলোর ঝিলিক-
আকুল কলরোলে গাথাসপ্তশতী।

শুধু-
ওর বুকে একখানি ক্ষত-
এক চিলতে লাল স্রোত,
তাকে ঘিরে দুটি নীল ধারা,
নীল ব্যথার মত।

তবু সে ক্ষমা, ক্ষমা, ক্ষমা-
সীমানাহারা সমুদ্রসমা ক্ষমা-
গহীনের আরক্ত ক্ষত ও নীল বেদনা ঢেকে
আদিগন্ত বইছে অনন্ত প্রিয়তমা ।

Tuesday, June 24, 2014

অনন্ত বাতিঘর

1

এই ঘরগুলো আশ্চর্য, ভারী অদ্ভুত। এরা নিজেদের আকার বদলায়, রঙ বদলায়। গোটা বাড়ীটাই নিজের আকার আকৃতি বদলায়। কখনো মুহুর্মুহু বদলায়, কখনো ধীরে। গতকাল আমার ঘরটা ছিলো চৌকো, ছাদটা ছিলো বর্গাকার। এখন ঘরটা চতু:স্তলকীয়, ত্রিভূজাকার দেয়ালগুলো ঐ উপরে একটা বিন্দুতে মিশে গেছে, কোনো ছাদের প্রয়োজন হয়নি আর। দেয়ালগুলোর রঙও বদলে গেছে, গতকাল ছিলো হালকা সবুজ, ভিতর থেকে স্বচ্ছ আর বাইরে থেকে অস্বচ্ছ। আজ তারা নীলকান্তমণির মতন নীল, দুপাশ থেকেই অস্বচ্ছ।

সবকিছু নিজেদের বদলে ফেলে এখানে, ভারী অবাক লাগে আমার। হয়তো অবাক হওয়া উচিত না। আমার অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই, আমার মাঝে মাঝে মজারই লাগে। এত বৈচিত্র!

শুধু দেয়ালের রঙ বা আকারই তো না, জানালা দরোজাও বদলায়। কোনো কোনো দিন কোনো দরোজাজানালাই দেখতে পাই না, ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, ক্লসট্রোফোবিক লাগে। তখুনি ছোট্টো একটা দরোজা দেখা দেখা দেয় কোনো এক দেয়ালে, আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি। হালকা সুগন্ধী হাওয়া বয়ে যায় আমার মুখচুল ছুঁয়ে, বেলীফুলের গন্ধ হাওয়ায়। আমার মন হালকা হয়ে যায়, আনন্দের বৈদ্যুতি বয়ে যায় আমার ভিতর দিয়ে।

যেন ঘরগুলো বুঝতে পারে আমার মন, আমার সাথে খেলতে চায়। কখনো কখনো আমার ভালোই লাগে খেলতে, কখনো কখনো চাপা টেনশনে কিছুই ভালো লাগে না। তখুনি এরা খেলা বন্ধ করে দেয়, আমার মন শান্ত করে দেবার কিছু একটা করে। এরা কি আমার জন্য ভাবে?

আজকের নেপথ্যসুর ভারী নরম একটা সুর, বুঝতে পারিনা কি বাজনার সুর, ভারী ভালো লাগে। কখনো মনে হয় বেহালা, কখনো বাঁশী, কখনো জলতরঙ্গ। বাতাসে আজ জুঁই ফুলের গন্ধ।

এখানে অনেক সার্ভিস রোবট, এরা আমার সমস্ত প্রয়োজনের সময় সক্রিয়। মায়াও এদের মাধমেই আমার সাথে যোগাযোগ করেন। রোবটদের কেউ কেউ দেখতে একেবারে মানুষের মতন, কেউ কেউ আবার খুব যান্ত্রিক চেহারার। ধাতব চেহারার রোবট আছে, ক্রিস্টালাইন রোবট আছে।

মায়ার বার্তা নিয়ে আজকে এলো কিরা, কিরা দেখতে মানুষের মতন, মিষ্টি নরম চেহারার একটি মেয়ে, হালকা বাদামী চুলগুলো এলোমেলো, মুখে একটা নরম হাসি। কিরার হাসিটা কেন জানি খুব চেনা লাগে। কোথায় দেখেছিলাম এই হাসি? মনে পড়ে না, আগের অনেক কথাই ভুলে গেছি। তবু মনেও তো আছে অনেক কথা! যা ভুলতে চাই তা ভুলতে পারিনা, অথচ যা ভুলতে চাই না তা গেছি ভুলে।

কিরা আমাকে মায়ার বার্তা জানালো। মায়া আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, ঠিক ন'টার সময় আমার যেতে হবে মায়ার কাছে। মায়ার সামনে কেন জানি সবসময় আমি কেমন অস্বস্তি বোধ করি। আমি জানি না কেন এমন হয়। মায়া খুব স্নিগ্ধ, শান্ত চেহারার, যতবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রত্যেকবার ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছুতেই আমি মায়ার সামনে সহজ হতে পারিনা, অদ্ভুত এক টেনশন আমার মনটাকে পেঁচিয়ে ধরে।

মায়ার উপস্থিতির তাপ আবছাভবে আমাকে মনে করিয়ে দেয় কোনো একজনের কথা, একজন যাকে আমি খুব ভয় পেতাম, যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম, যাকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করতাম, যাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতাম, যাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আবার যাকে একমুহূর্ত সহ্য করতে পারতাম না। এইসব বিপরীত আবেগের অসম মিশ্রণ আমার মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠে, আমার মাথা ঘুরায়, সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগে। মায়ার কাছে যেতে ইচ্ছে করেনা, কিন্তু তবু তৈরী হতে থাকি। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু এসে যায় না, মায়ার যেকোনো নির্দেশই এখানে শেষকথা।



তৈরী হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমার ভাবনা বুঝতে পেরে স্বচ্ছ হয়ে যায় জানালা। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুরে হাসছে লাল পাতাওয়ালা গাছের বাগান।  পৃথিবীর হেমন্তের কথা মনে পড়ে, যদিও এইসব গাছের পাতারা সবসময়েই লাল।

 রাতে অজস্র তারাওয়ালা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রথম যেদিন আমাদের সূর্যকে দেখেছিলাম ক্ষুদ্র টিমটিমে একটি আলোকবিন্দুর মত, সেদিন কেমন একটা আশ্চর্য অনুভব হয়েছিলো! বুঝতে পারিনি সেটা কী। সে কি অভিমান, সে কি দুঃখ, নাকি সে অনাসক্তি?

পৃথিবীতে আমরা সংগ্রাম করেছিলাম স্বৈরতন্ত্রের বিরূদ্ধে, টোটালিটারিয়ান সমাজব্যবস্থা আমরা চাই নি। আমরা জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত দিতে তৈরী ছিলাম সে সংগ্রামে। সমান অধিকার আর চিন্তার স্বাধীনতা ছিলো আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস।

এখানে সবকিছু অন্যরকম লাগে, মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা শীতে ভেতর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। মানুষ এখানে প্রযুক্তিতে এত অগ্রসর আর এত দ্রুত আরো আরো অগ্রসর হয়ে চলেছে যে আমার পক্ষে বুঝতে পারাও সম্ভব না সবটা। আমি সবটা বুঝতে চেষ্টাও করি না। শুধু একটা জিনিস কাঁটার মতন খচখচ করে ভিতরে। কিছুতেই বুঝতে পারিনা, কেন এই মানুষেরা এত শান্ত, এত বাধ্য, এত নি:শব্দ আজ্ঞাবাহী? কেন তারা একটাও প্রশ্ন করে না, কেন তারা একটাও নতুন সাজেশান দেয় না?

যত পার্টিতে সভাসমিতিতে আনন্দোৎসবে গেলাম, সর্বত্র একই জিনিস দেখলাম। ঠান্ডা বাধ্যতা, শান্ত আনুগত্য। বিদ্রোহের একটা ছোট্টো ঝিলিক কারুর চোখের ভিতরে দেখার জন্য কী যে তৃষার্ত হয়ে থাকে আমার সারাদেহমন! একটা ছোট্টো সোনালি ঝিলিক শুধু যা এই নীরব মাথাকাত করা আনুগত্যের শৈত্য দূর করে দেবে। কোথাও দেখিনি। শুধু আরো আরো আরো শীতে কেপে উঠেছে আমার মেরুশিরা।

মায়ার কাছে যাবার সময় এগিয়ে আসছে, সেই অদ্ভুত শীত আবার আমার ভিতরে ফিরে আসছে। একটা নাম না জানা অস্বস্তি, ভয়। যেতে ইচ্ছে করে না, একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে। মায়ার কথার নড়চড় হয় না এখানে, হবে না কখনো। আহ, কতদিন আমিই বা মায়ার মায়াজালের বাইরে থাকতে পারবো? একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে।

এবারে ঘরে মায়া একাই ছিলেন। অন্য যেসব দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, সেসব সময়ে সবসময়েই আরো লোক ছিলো ঘরে। এবারে মায়া একা আর আমি তার সামনে। দু'জন একা, মুখোমুখি।

মায়ার ঘর আমার কাছে সবসময়ই ম্যাজিকম্যাজিক লাগে। কখনোই ও ঘরে কোনো দেয়াল দরজা জানালা কিছু চোখে পড়ে নি, শূন্যতার অনুভুতিও হয় নি কিন্তু। একধরনের আশ্চর্য আলো আর সঙ্গীতে পূর্ণ সে ঘর। বুঝতে পারিনা দাঁড়িয়ে আছি না ভেসে আছি। যেন ভিন্ন মাত্রা, যেন চেনা জগতের কিছু না সে, যেন একটা ভিন্ন বাস্তবতা যার সঙ্গে আমার সীমাবদ্ধ ত্রিমাত্রিক অনুভূতি পাল্লা দিতে পারে না।

সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ভালোবাসা-ঘৃণা তিতিক্ষা-জিঘাংসার বন্যায় ডুবে যাবার আগে কুটোর মতন হাত বাড়িয়ে ধরি স্মৃতি। কী হয়েছিলো মায়ার কাছে আসার আগের পথটুকু? হাসিমুখ কিরা আমাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলছিলো, একটা সবুজ দরজা খুলে গেল, আমরা একটা আলোছায়া ঝিলমিল করিডর ধরে যাচ্ছিলাম। চারিপাশে কী ছিলো, সবুজ দেওয়াল নাকি খোলা আকাশ?

আমি শিউলির গন্ধ পাচ্ছিলাম, অনেককাল আগের এক ভুলে যাওয়া শরতের ভোরের হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি যেন অনন্তকাল পথ চলছি, চলছি, চলছি। দিন আসছে, রাত আসছে, বাঁকা চাঁদ পূর্ণ থালার মতন গোল হয়ে উঠছে, আবার ক্ষইতে ক্ষইতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।

একটা বাঁক ঘুরে দৃশ্য বদলে যায়। এগিয়ে আসে ইলক আর সেডিনা- ওদের চিনি। ওরা ক্রিস্টালাইন চেহারার রোবট। ইলক পুরুষ, সেডিনা মহিলা, মানে সেরকম দেখতে। মূর্তির মতন চেহারা হলেও দুজনেই হাসিখুশী, ভারী আন্তরিক মনে হয় ওদের। এখানে কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা যে অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারিনা। ইলক আর সেডিনার হাতে আমাকে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল কিরা।

(To Be Continued)

The Great Cycle

There were six chairs around the neat circular table at the center of the room. The room was strange, a shiny tetrahedron. Aron, Ena, Lamex, Geia, Tamaril and Talisa entered and took their seats.

Each of them had stony face, lips tightly shut, eyes half closed. They were in half-trance state. Everybody kept their right hand on the table, one on another, six hands made a little column on the table.

Everyone now fully opened their eyes, bright shiny eyes focused to the center of the table where their right hands met. Then six voices arose to sing in harmony, they sang a mysterious ancient hymn together. Then they said , “Let it be done, let it be done, let it done.” After that, all of them fell back to a deep trance of meditation.

After an hour or so, they rose from the meditation and removed their hands from the table. One by one they stood up.

Aron looked at Talisa and gently said, "We’ll meet again. Isn’t it Talisa?"

Talisa held Aron in her soft, lovely eyes and smiled. She said, “ Sure. We’ll meet again."

Aron said, " Do you remember Talisa, long ago, we just talked like that? Just before I left for planet Alpha?"

Talisa said quietly, "Yes, I remember. It was after the convocation. You got a job on planet Alpha. That day you just told the same thing, we’ll meet again, isn’t it? "

Talisa and Aron laughed together.

Aron said, "You were so gloomy that day, when I departed. But next year you came to Alpha to join the same job."

Talisa smiled and said, "I tried my best to find a job on planet Alpha. But I was not hopeful at all. There were so many uncertainties! But you know that I finally managed to get a job there. It was a result of some unexpected chain of events, I guess. But this time, I’m sure, absolutely sure."

Tamaril looked at Geia, he wanted to say something, but didn’t say anything finally. Tamaril was very shy from the beginning. For a long time he was a close friend of Geia, but never could say anything more than just friendly words. But Geia knew that Tamaril loved her.

Geia smiled and held Tamaril in her deep, black eyes. Love-light made them so beautiful! She thought, will Tamaril be so shy in new life, too?

All six of them walked quietly towards the room reserved for them. There each of them lied down on assigned bed and sank into deep sleep. Their neuronic information were mapped in details. All of those recorded information went to the Central Bureau of Information. Everything were stored into the sub-atomic machines with great care.

All six of them died just after this recording and their dead bodies were cremated. But that death was not the end for these people since their minds were securely stored into the machines. When those information will be restored, they will rise again in the new world, in a new life.

Their universe was old, very old, about a trillion years old. It was going towards the absolute zero temperature at the end of its life. In that cool, darkened universe, there will be no usable energy and all life-forms, intelligent or not, will surely die. All civilizations will end.

Those six people were selected to contribute their minds and intelligence to the ultimate restoration project. Their civilization, however high it might be, will be destroyed along with their universe. But these stored data might survive if it could be transmitted elsewhere. Eventually that could begin a new civilization in new universe.

They had very advanced technology available, their civilization itself was many billion years old. All the accumulated knowledge and technology of millions of years enabled them to make the project a reality.

The data was stored inside subatomic machines. Those machines were successfully transmitted through the wormhole to enter a new, young, warm universe.

In the new Universe those machines found habitable planets with good natural resources to be utilized. Those machines used those raw materials to prepare organic molecules including DNA. Then they used the stored information to clone those six beings. New Aron, Ena, Lamex, Geia, Tamaril and Talisa were created again to begin a civilization again.



(Cont)

Saturday, June 21, 2014

উশীরস্রোতা

১।

সৃঞ্জয় বললো, " কী, কেমন লাগছে এখন ? "

ভোরের হাওয়া ঠান্ডা বেশ, আমি স্কার্ফটা গলায় ভালো করে জড়াতে জড়াতে হেসে বলি, " ভালো লাগছে। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসলে কালকে একটু বেশী আবেগের পাল্লায় পড়ে গেছিলাম। এখানে আসা যেন একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার, কে জানতো এভাবে এখানে আসা হবে? "

সৃঞ্জয় হাসে, আমি আরো চওড়া করে হাসি। কী আর করার আছে এখন? বিস্ময় এত বেশী যে কোনো কথা দিয়েই তা প্রকাশ করা সম্ভব না।নিজের বাচ্চাবয়সের কথা মনে হয়, তখন প্রত্যেকটা দিন এমন অমলীন বিস্ময়ে ভরে থাকতো, কী পালকের মতন হাল্কা ছিলো সেই জীবন!

এখানে দুপুরবেলাগুলো খুব গরম। তাই খুব ভোরবেলাতেই আমরা সেতু পার হয়ে এসেছি নদীর পশ্চিমে। এই নদীর বর্তমান নাম উশীত্থা। সুপ্রাচীনকালে এর নাম ছিল উশীরস্রোতা। সুগন্ধি উশীর তৃণ জন্মাতো এর তীরে। এখন নদীটা প্রায় শুকনো, বালি-বালি খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে সরু একটা জলস্রোত ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষায় উত্তরে ঢল নামলে নাকি জল অনেক বাড়ে, তখন গোটা নদীখাতটাই ভরে ওঠে। নদীর উপরে পাকাপোক্ত ব্রীজ, গাড়ী চলতে পারে। ও পথেই এসেছি আমরা। আমাদের সারথী এখানকার স্থানীয় একজন লোক, হোটেল থেকেই আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছে এই গাড়ী আর ড্রাইভারকে।

এখন আমরা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি নদীর পশ্চিমপারে। সামনেই নীল আকাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বাদামী, কালো, ধূসর বা বালিরঙ পাহাড়। ঋজু, উদ্ধত, কঠিন, শিলাময়, বৃক্ষবিরল পাহাড়ের সারি। এখানে জমিও খুব শুকনো, গাছপালা প্রায় নেই, মাঝে মাঝে একরকম কর্কশ ঘাস আর কন্টকগুল্ম দেখতে পাই।

কাছেই একটা ছোটো বাজারমতন, সেখানে পথের পাশের চায়ের দোকানে সবে উনুনে আগুন দিয়েছে। চা আর কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসি আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই এসে যায় চা, খাবার। সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছিল, চা খেতে খেতেই দেখি পাহাড়ের চূড়াগুলো সকালের আবীরলাল আলোয় রঙীন হয়ে উঠে উঠে তারপরে গোলাপী থেকে সোনালী হয়ে উঠলো।

খাওয়া শেষ হলে আমরা রওনা হই সমাধি-পাহাড়ের দিকে। সম্রাজ্ঞীর খোঁজে যেতে হলে ঐখানেই তো যেতে হবে। সমাধি পাহাড়েই পরজীবনের প্রাসাদ। কয়েক হাজার বছর আগে রাণী সপ্তাশ্বসুতা তৈরী করিয়েছিলেন নিজের আর প্রিয়জনেদের জন্য। পার্থিব জীবনের সামান্য সময়টুকুর পরে বিস্তৃত যে অনন্ত জীবনকে তাঁরা জানতেন, সেই জীবনের জন্য।

সেখানে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সেই সুপ্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সামনে। সপ্তাশ্বসুতা! মহারাণী, সম্রাজ্ঞী! সম্রাজ্ঞী নিজেকে বলতেন সূর্যসম্ভূতা। স্বয়ং সূর্যদেব নাকি নেমে এসে তাঁর পিতার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর জননীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে সৃজন করেছিলেন। প্রাচীরের চিত্রমালায় সেই মহাপবিত্র ঘটনার কিছু কিছু ব্যাপার নাকি খোদাই করে রাখা হয়েছে।

আসলে কেমন ছিল সে? কেমন করে সে ভাবতো, হাঁটতো, সাজতো, কথা বলতো? কেমন করে কাটতো তার গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত? কোনোদিন, সেই হাজার বছর আগে, তার কিশোরী বয়সে এইরকম কোনো সকালে সে কি তার কোনো চাহনেওয়ালার কথা ভাবছিলো? পুরানো পাথরের টুকরোয় কিংবা প্রাচীরে বা মেঝেয় আঁকা ছবিতে অথবা লেখা কাহিনিতে কি সময় আটকে থাকতে পারে? ধরা দিতে পারে পূর্ণ, সজীব, স্পন্দিত সেই হারানো জীবন?

সেই মেয়েটিকে দেখতে চাই, সেই সূর্যসম্ভূতাকে। খুবই কি আশ্চর্য আর অন্যরকম ছিলো সে? একদম শৈশব থেকে ? নাকি সেই শৈশবে কৈশোরে আর পাঁচটা মেয়ের মতই সাধারণ ছিলো, পরে রাজত্বের দায়িত্ব আর রাজনৈতিক কূটকৌশল তাকে বদলে দিলো?

"শ্রমণা, কী হোলো? এতক্ষণ ধরে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছ না যে! " মনের ভুলভুলাইয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসি সৃঞ্জয়ের ডাকে।

বলি, "ডাকছিলে নাকি? আরে আমিও যেমন! কী যেন ভাবতে ভাবতে..... ডাকছিলে কেন? "

সৃঞ্জয় আমার হাত ধরে নিয়ে যায় পাথরের সিঁড়ির দিকে, প্রাসাদে ঢুকতে গেলে আমাদের উঠতে হবে সেদিক দিয়েই।

সৃঞ্জয় বলতে থাকে, " কেন এরকম বারে বারে বেসামাল হয়ে যাও? তুমি নিজে ইতিহাসের ছাত্রী, তোমার গাইড ডঃ প্রসাদ কতবার বলেছেন আবেগ মিশিয়ে ফেললে আর নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয় না? তুমি তবু কেন এরকম হয়ে যাও? এখানে এসে এইসব এলাহী কান্ড দেখে বেসামাল হবার কথা তো আমার! আমি তো ইতিহাসে পোড়খাওয়া লোক না। " সৃঞ্জয় হাসে, ওর হাসির সঙ্গে তাল দিতে আমিও হেসে উঠি।

সিঁড়ির কাছে এসে অদ্ভুত একটা ভয়ে আমার ভিতর-বাহির শিরশির করতে থাকে, অসহায় জ্বরগ্রস্তের মতন সৃঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলি, " আজ থাক। আমার শরীর কেমন করছে, মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো। "

সৃঞ্জয় আমাকে সাবধানে ধরে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে সিঁড়ির কাছ থেকে, বলে, "থাক তবে। কী হোলো তোমার? মুখচোখ একদম ছাইয়ের মতন দেখাচ্ছে। চলো, আজ ফিরেই যাই।"

আমরা এ শহরে এসেছি গতকাল। এখানে তিনদিন, তারপরে অন্য শহরে যাত্রা। পুরো ঘোরাঘুরির জন্য হাতে মোট পনেরোদিন আছে । অথচ কী তীব্র অস্থিরতা আমার ভিতরে ঘূর্ণী তুলছে ! মনে হচ্ছে যথেষ্ট সময় নেই। কোনোদিন আগে যে দেশ দেখিনি, কেন সেখানে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হয়?

কেন পথের এক-একটা বাঁকে এসে চমকে উঠি, এ যেন চেনা! কিন্তু তাতো হতে পারে না! সৃঞ্জয় বলে যে আমি খুব বেশীরকম কল্পনাপ্রবণ। ছোটোবেলা থেকে গল্প আর ইতিহাস পড়ে পড়ে সব মিলিয়েমিশিয়ে নাকি ঘেঁটে ফেলেছি! এরকম হলেই নাকি এরকম অচেনা জায়গা চেনাচেনা ঠেকে !

ফিরে আসি নদীর অন্য পাড়ে, ছোটো একটা দোকানে ঢুকে ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে জুড়াতে থাকি ক্লান্ত শরীর আর আলোড়িত অনুভবকে গুছিয়ে আনতে থাকি যথাসম্ভব। তারপরে মিউজিয়ামে যাই, আমাদের পরিচিত বন্ধু একজন আছেন সেখানে।

সন্ধ্যাবেলা রওনা হই সরাইয়ে ফেরার জন্য, তখন অন্ধকার বেশ গাঢ়। আকাশের দিকে চেয়ে আবার কেমন হয়ে যাই। মরুভূমির রাত্রি অপরূপ! একসাথে এত তারা, এত তারা! একেবারে ঝকঝক করছে! হাল্কা ওড়নার মতন দেখা যাচ্ছে ছায়াপথ। এরকম কবে দেখেছিলাম, কোনোদিন দেখেছিলাম কি? হয়তো দেখেছিলাম কোনোদিন।

হয়তো সে এ জন্মে নয়, হয়তো বহুজন্ম আগে যখন এই বালির টিলাগুলোর পাশ দিয়ে যে পথ চলে গেছে পাথরের সীমানা দেওয়া গাঁয়ের দিকে, সেই পথে হাঁটতাম। রঙীন ঘাঘরা-চোলি থাকতো আমার অঙ্গে, কাঁখে থাকতো কলস, সখীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে জল নিয়ে ফিরতাম ঘরে। মরুগোলাপের ঘ্রাণ আমাদের মনকে উচাটন করতো!

সৃঞ্জয়কে এসব বলা বৃথা, আমি নিজের ডাইরিতে এইসব লিখে রাখবো। বহু হাজার বছরের যবনিকা কি খুলবে? জ্ঞান উন্মেষের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষটাকে খুঁজছি আমি, তাকে কি পাবো?

বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে, একটা ছোট্টো বাড়ী, তার ছাদে উঠে চেয়ে আছি পশ্চিমের দিকে, পশ্চিমে খোলা ধানক্ষেত, আদিগন্ত আকাশ তার উপরে উপুড় হয়ে পড়েছে, সূর্যাস্তকালের রঙীন মেঘেরা চারিদিক রঙীন করে দিয়েছে, সন্ধ্যাতারাটি সবে চোখ মেলেছে। সেইসব সময়ে আমার মনে আসতো এক আশ্চর্য মানুষের কথা, কত হাজার মাইল ব্যবধান আর কত হাজার বছরের দূরত্ব থেকে আমার দিকে চেয়ে থাকতো তার দুটি গভীর কালো চোখ। রাতের স্বপ্নেও ফিরে ফিরে আসতো সে। কাউকে বলতে পারিনি তার কথা, কাউকে না। কী করে বলবো, আমিই কি জানতাম সে আসলে কে?

সৃঞ্জয় এসব বুঝবে না বা হয়তো ভুল বুঝবে, সেই আশঙ্কায় ওকে কিছু বলতেও পারছি না। সে এমনিতে আমার খুব ভালো বন্ধু, বন্ধুরও বেশি কি? বুঝতে পারি না। সে নিজে কী মনে করে আমাকে? বন্ধু? নাকি তার অনেক বেশী?

২।

রাতে হোটেলে ফিরে সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত সৃঞ্জয় অঘোরে ঘুমোচ্ছিলো। আমি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে ভাবছিলাম! ভাবনাগুলো যেন শত শত রঙীন সুতো, একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে ভয়ানক জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।

তারপরে নিজেও শুয়ে পড়লাম । ঘুম আসে না। মনে পড়ে সৃঞ্জয়ের পাগলের মতন ভালোবাসার মুহূর্তগুলো। কিন্তু সেইসব মুহূর্তেও কেন আমার মন আলগা হয়ে যায়? কেন অজানা বিষাদ এসে জমে বুকের খুব ভিতরে?

আমার জীবনটা আর পাঁচজন মানুষের মতন সহজ সরল হলে কত ভালো হতো! কিন্তু তা নয় কেন? কেন ভিতরে বারে বারে জেগে ওঠে সেই রহস্যময় সত্তা? ভিতর থেকে ফিসফিস করে কী যেন বলে। একটা কী যেন সমাধান হওয়া বাকী আছে, সেটা সমাধান না হলে কিছুই হবে না।

নাইট ল্যাম্পের নরম হাল্কা আলো ঘরে, রুম ফ্রেশনারের মৃদু সুগন্ধ ভেসে বেড়ায় ঘরের বাতাসে। এইসবের মধ্যে চুপ করে চোখে চেয়ে শুয়ে থাকি, মনের ভিতরে কে যেন ডাকতে থাকে, আয় আয়। কে সে? কে ডাকে? কোথায় যেতে ডাকে? সপ্তাশ্বসুতার পরজীবনের প্রাসাদে? ক্লান্তি একসময় জয়ী হয়, দু'চোখ লেগে আসে।

চার ঘোড়ার রথে বসে আছেন এক তেজদীপ্তা মধ্যবয়সিনী নারী, সুশোভন বেশ তার, কিন্তু বস্ত্র রঙীন নয়, শুভ্র। দীর্ঘ গ্রীবায় মহার্ঘ্য রত্নহার। দুই কান থেকে দুলছে হীরকখচিত কর্ণাভরণ। মাথার দীর্ঘ কেশ জড়িয়ে তুলে চূড়া করে মাথার উপরে বাঁধা, চূড়া ঘিরে রত্নমুকুট। চোখে দীর্ঘ করে টানা কাজলরেখা। কিন্তু এইসব সাজসজ্জা অলংকার সব ছাপিয়ে উপচে পড়ছে সেই আশ্চর্য নারীর অকুন্ঠিত তেজের দীপ্তি, বোঝা যায় অনেক ক্ষমতার অধিকারিনী।

রথে এঁর পাশে বসে আছে এক কিশোরী, অদ্ভুত মায়া-মায়া মুখ তার, চোখে স্বপ্ন। এর বস্ত্রালঙ্কারের তত বাহুল্য নেই, শ্বেত বসন আর নীলাভ সাদা উত্তরীয়। গলায় ফুলের মালা। চুলগুলি জড়িয়ে তুলে ফুলের মালা দিয়ে বেষ্টন করে রাখা। এর হাতে পূজার থালি, সম্ভবত কোনো মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন এঁরা।

রথ চালাচ্ছে এক তরুণ, এর পরনে শ্বেতবসন, উর্ধাঙ্গে শুভ্র উত্তরীয়। এর মাথার চুলগুলো ক্ষুদ্র, সারা গায়ে কোনো অলংকার নেই দেখে মনে হয় বুঝি খুব সাধারণ সামান্য অবস্থার মানুষ। কিন্তু মুখচোখ দেখে তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধার মতন মনে হয়। এর চোখের মণি গভীর, যেন কীসের রহস্য সেখানে। এরই দিকে কেমন অদ্ভুত কোমল চোখে চেয়ে আছে কিশোরী মেয়েটি।

ভোরের নরম হাওয়া এসে লাগে গালে কপালে, ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নেদেখা কিশোরী মেয়েটি আর রথচালক তরুণ কিন্তু স্মৃতিতে তাজা হয়ে থাকে তখনো। কে ঐ মেয়েটি আর ছেলেটি? ওদের কেন চিনি চিনি মনে হয়? ওদেরই খোঁজে কি আসলে এসেছি এখানে? যা আমার সচেতন মন জানে না কিন্তু ভিতরের মন জানে? কোথায় পাবো ওদের? এই হাজার হাজার বছরের বিস্মৃতির ধূলা সরিয়ে কেমন করে বার করবো ওদের? আর বার করেই বা কী হবে? কোনো সার্থকতা কি আর থাকতে পারে এই এত হাজার বছর পরে?

৩।

আজ সপ্তাশ্বসুতার প্রাসাদ ঘুরে দেখে এসেছি সৃঞ্জয় আর আমি। এখনো আমাদের বিস্ময়ের রেশ ফুরায় নি। ফেরার পথে পুরোটা সময় ধরেই কেবল সেই হাজার বছর আগের মানুষের অতিমানুষিক কীর্তির কথাই বলাবলি করছিলাম দু'জনে। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সাহায্য ছাড়া ঐসব বিশাল বিশাল স্থাপত্য আর অতি উঁচুদরের ভাস্কর্য কী করে তারা করলো? এ আজও এক রহস্য আমাদের কাছে। আমাদের অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে যেন এক অনতিক্রম্য শূন্যতা, কোথায় যেন যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

বেলা তখনো ছিল অনেক। হোটেলে ফিরতে ভালো লাগলো না, বসলাম গিয়ে নদীর পাশে গাছের ছায়ায়। অনেক কথা বলার পরে আর অনেক বিস্ময়ের ঝলসানির পরে যেন ছায়ার নিচে একটুকরো শান্তি। ওপারে দেখা যাচ্ছিল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, মাঝে মাঝে টিলা। আমরা আর কথা বলছিলাম না, নদীর কলধ্বনি শুনছিলাম, নদীটা যেন আমাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছিল। সেই গানের মধ্যে করুণ এক সুপ্রাচীন কাহিনি শুনছিলাম আমি। নিজের অজান্তে কখন চোখ ভরে উঠলো জলে।

গাছের ছায়ায় ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো সৃঞ্জয়, মাথার নিচে নিজের ব্যাগখানা বালিশের মতন করে দিয়েছে। দিব্যি চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমি নিজেও গাছের কান্ডে মাথা হেলিয়ে দিলাম।

হঠাৎ শুনি মধ্যরাত্রির প্রহর বাজলো কোথায় যেন, আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ উঠবে একেবারে শেষরাত্রে। অন্ধকারের ভিতর থেকে শুনি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, তার সঙ্গে মাটির উপরে কাঠের চাকার ঘর্ষণের শব্দ। একটা অশ্ববাহিত রথ আসছে, বেশ আস্তে আস্তে, চুপিচুপি। নদীর কিনারে ঝুপসি একটা গাছের নিচে এসে থামলো রথ, রথারোহী ও চালক বলতে একজনই ছিল।

সে নামলো। নিবিড় নীল উত্তরীয়ে মাথা থেকে পা অবধি আবৃত তার। ঘোড়াটাকে রথ থেকে খুলে ঘোড়ার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে কী যেন বললো, মুক্ত ঘোড়াটা নদীতীরের তৃণভূমিতে নেমে গেল।

নিবিড় নীল উত্তরীয়ে আবৃত মানুষটি এইবার নদীতীর বরাবর চলতে শুরু করলো। বাদামী পাহাড়ের পায়ের কাছে নদী যেখানে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর-পূর্বে, সেইখানে এসে সে থামলো। পাহাড়ের গায়ের খাঁজগুলো সিঁড়ির মতন, খাঁজে খাঁজে সাবধানে পা রেখে সে উঠলো খানিকটা, এসে পৌঁছলো একটা পাথুরে চাতালে। চাতাল পেরোলেই একটা গুহামুখ, আলগা একটা পাথর গড়িয়ে এনে গুহামুখ বন্ধ করা হয়েছে।

মুখ ও মাথা থেকে উত্তরীয়ের আবরণ সরালো মানুষটা। এইবারে তাকে চিনতে পারলাম, সে ঐ কিশোরী মেয়েটি, আগে যাকে পূজা দিতে যেতে দেখেছিলাম। মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে সে এক অদ্ভুত শব্দ করলো, রাতপাখির ডাকের মতন সে আওয়াজ কিন্তু তার মধ্যে যেন মিশে আছে সাংকেতিক আহ্বান। একবার, দুইবার, তিনবার ডাক দিল সে। তিনবারের পর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ।

উত্তর এলো তখন। ঠিক ওরকম আওয়াজ। পাহাড়ের অন্যদিক থেকে উঠে এলো আরেক মানুষ, মুখের ঢাকা সরাতেই চিনতে পারলাম, আগেরবারে দেখা সেই রথচালক তরুণ। কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটিকে, তাদের সম্মিলিত মিষ্টি হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল রাত্রির বাতাসে। তারা গুহামুখের পাথর ঠেলে সরিয়ে গুহায় ঢুকে গেল।

অন্ধকারে তারা দেখতে পায় নি শ্বাপদের মতন তীক্ষ্ণ দুটি চোখ তাদের লক্ষ করেছে, রাজার নিয়োগ করা গুপ্তচর। অন্ধকারে মিশে থেকে সে অনুসরণ করেছে একদম শুরু থেকে। নিঃশব্দ দ্রুতগতিতে পাহাড়ের কাছ থেকে রাজবাড়ীর দিকে দৌড়ে চলে গেল সেই গুপ্তচর।

" শ্রমণা, শ্রমণা! " – কে যেন কাঁধে নাড়া দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখি সৃঞ্জয়, সে জেগে গেছে। আমায় জাগাচ্ছে। সবটাই স্বপ্ন ছিল। মাথা তুলে দেখি বেলা পড়ে আসছে, ছায়া দীর্ঘ হয়েছে। এবারে হোটেলে ফিরতে হবে আমাদের।

উশীরস্রোতার দিকে এগিয়ে গেলাম, জলে হাত ডুবিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, "আসি।" নদী কলস্বরে কী বললো কেজানে! এমন কত মানুষ এসেছে, কত গেছে, নদী কাকেই বা মনে রেখেছে !

আমরা ফিরে চললাম পান্থনিবাসের দিকে। আগামীকাল দুপুরে আমাদের অন্য শহরের দিকে যাত্রা। নদীটাকে হয়তো আর ছোঁয়া হবে না। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালাম, কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ ডাকছিল। মনের ভুল নিশ্চয়। সেই রহস্যময় মানুষটাকে কোথাও কি খুঁজে পাবো কোনোদিন? নাকি সে আমার নিজের মনের বানানো গল্প একটা? সবটাই কল্পনা?

৪।

হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছিল কিন্তু আমার একটুও খিদে ছিল না। খানিকক্ষণ সাধাসাধি করে সৃঞ্জয় একাই গেল ডিনার খেতে। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম এক গেলাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে।

আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন। ওদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে দু'চোখ। আবার দেখি সেই কিশোরীকে, আজকে সে সাদাসিধে পোশাকে না, আজকে তার জমকালো রাজকীয় পোশাক, সর্বাঙ্গে হীরামণিমুক্তার অলঙ্কার ঝলকাচ্ছে।

আজ তার রাজ্যাভিষেক। তার নাম ছিল হেমা, কিন্তু আজ থেকে সে আর হেমা নয়, তার পূর্বজীবন মুছে গেছে, আজ থেকে সে সূর্যসম্ভূতা সপ্তাশ্বসুতা। কিন্তু ওর দীপ্ত কালো চোখের মণির গভীরে দেখি টলটলে জল, যেন উশীরস্রোতা বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সেখানে আগুনও জ্বলে ওঠে।

স্বপ্নের মধ্যে ছুঁতে পারি হেমার বেদনাস্পন্দিত হৃদয়, সেখানে থেমে আছে আছে সেই তরুণের নিথর মুখ, বুকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। হেমা সেই রাত্রে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরে নিজের শয্যায় ঘুমিয়েছিল। সকালে পরিচারিকা ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিল। রথচালক সুষীম নিহত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ পৌঁছালো রাজবাড়ীতে, রাজ আদেশে আর সকলের সঙ্গে হেমাকেও দেখতে হলো সুষীমের মৃত মুখ।

হেমা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু, কাউকে কিছু বলতে পারলো না, কাঁদতে পারলো না, কোনোরকম শোকপ্রকাশ করতে পারলো না। সামান্য রথচালকের মৃত্যুর জন্য রাজকুমারীর শোকপ্রকাশ কীসের? শুধু তার বুকের ভিতর সব ভেঙে পড়ছিল, সে বুঝেছিল রাজা নিজেই লোক লাগিয়ে হত্যা করেছেন সুষীমকে, হয়তো রাজকুমারীর সঙ্গে ওর গুপ্তপ্রণয় জানতে পেরে গেছিলেন। কিন্তু কন্যাকে কেন অব্যাহতি দিলেন? কেন তাকেও হত্যা করলেন না?

তারপরে রাজকীয় মর্যাদায় অন্তেষ্ট্যিও হয়ে গেল সুষীমের। সুষীমের শোকাহত বাবা-মা চলে গেলেন তীর্থযাত্রায়, রাজকোষ থেকেই নাকি খরচ দেওয়া হয়েছিল।

সেইসব এই অভিষেকের আটদিন আগের কথা। আজ সপ্তাশ্বসুতা যৌবরাজ্যে অভিষিক্তা হচ্ছে। কিন্তু সে জানে হেমা এখানে নেই। হেমাকে এরা স্বর্ণশিকলে বাঁধতে পারে নি। সে একা একা একা চলে গেছে, দূর থেকে আরো দূরে, জন্মজন্মান্তর ধরে সে সুষীমকেই খুঁজবে। "সুষীম, সুষী-ঈ -ঈ ম!"

কলিং বেল বাজছে, আচ্ছন্ন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। শ্লথ পায়ে এগিয়ে যাই দরজা খুলতে, সৃঞ্জয় ফিরলো বুঝি।

৫।

হাতে একটা ছোট্টো আলো, চাবির রিঙ এ আটকানো আলো। সুইচ অন করতে উৎস থেকে আলো বেরিয়ে পাথুরে দেয়ালে একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছে, আলোকবৃত্তটি ঘিরে ছায়াবৃত্ত, তাকে ঘিরে আবার একটা হাল্কা আভার বৃত্ত, এইভাবে পর পর কয়েকটা আলো আর ছায়ার রিঙ এর পরে আবারো নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।

অদ্ভুত একটা পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, চারিদিকে পাথরের রুক্ষ দেয়াল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরের পৃথিবীতে এখন দিন না রাত্রি? কেজানে! কখন এসেছি এখানে? তাও মনে নেই। আর কত পথ বাকী? কেজানে!

শুধু মনে পড়ে শেষরাত্রির ঠান্ডা বাতাসের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি নদীর দিকে, তারাগুলো দপদপ করছে মাথার উপরে। চলতে চলতে একসময় নদী পেলাম, নদীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলাম, কে যেন ফিসফিস করে আমায় পথনির্দেশ দিচ্ছিল। আমার কোনো ভয় ছিল না, কোনো দ্বিধা ছিল না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব শেষ হবার পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

বেরিয়ে পড়ার আগে একটা ছোটো চিঠিতে সৃঞ্জয়কে জানিয়েছি যে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় সজ্ঞানে নিরুদ্দেশে যাচ্ছি, সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। চিঠিটা টেবিলে রেখেছি গেলাস চাপা দিয়ে। সকালে উঠেই দেখতে পাবে ও।

মনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো ক্লান্ত হয়ে এলো, তারপরে দেখি নদীটা একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে আর সামনে সেই পাহাড়, ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম। পাহাড়ের গায়ের খাঁজে হাত পা রেখে রেখে উঠলাম চাতালে, সত্যিই একটা পাথুরে চাতাল ছিল আর তার সামনে ছিল সেই গুহা। গুহামুখে পাথর চাপা ছিল না।

মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করে আলোটি জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখলাম ধাপে ধাপে সিঁড়ি চলে গেছে, কখনো নামছে কখনো উঠছে। কখনো ঘুরে ঘুরে চলছে পাথুরে সিঁড়ি আর সিঁড়ি। চারিপাশে পাথরের দেওয়ালে কোথাও আর্দ্র জলধারা কোথাও রঙীন ক্রিস্টাল জ্বলজ্বল করে উঠছে আলো পড়ে, কোথাও অদ্ভুত সব নীল লাল সবুজ চিত্রমালা।

কোথা থেকে কে যেন ডাকে আমায়, ভাষাহীন, শব্দহীন সেই অমোঘ আহ্বান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার। আমি চলতে থাকি, চলতে থাকি। হাজার হাজার বছরের বিরাট শূন্যতা, অতলস্পর্শী বিরহ-হাহাকার আমার পায়ের নিচে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে। সময়হীন এক অমৃতলোকে দাঁড়িয়ে আছে জরাহীন, মৃত্যুহীন, বেদনাহীন এক তরুণ, অপূর্ব বিভা ঘিরে আছে তাকে।

চলতে চলতে নির্মোকের মতন খসে পড়ে যায় আমার সমস্ত বসন-ভূষণ-পরিচয়-ভাবনা-ঘরদুয়ারস্মৃতি। অদ্ভুত ফুলের গন্ধ এসে লাগে নাকে, অনুভব করি আমার অভূতপূর্ব কুন্ডলিত কেশভার বিচিত্র কবরীতে বাঁধা, তার উপরে জড়িয়ে আছে সুগন্ধী পুষ্পমালা। আমার পরনে সুবর্ণখচিত বস্ত্র, উর্ধাঙ্গে কঞ্চুলী ও উত্তরীয়। সেই সহস্র বৎসর আগে যেমন ছিল।

হাতের আলো কখন খসে গেছে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, সব দেখতে পাচ্ছি বিচিত্র এক আলোতে। অক্লান্ত চরণে চলতে থাকি, চলতে থাকি, মনে মনে বলি, " আমি আসছি, আমি আসছি, সুষীম, আমি আসছি। "



(The End)