Wednesday, November 16, 2011

গিরিব্রজ

জন্মনীড় ছেড়ে, চেনা মাঠ বন নদী পাহাড় ঝর্ণা সব কিছু ছেড়ে উড়াল দিয়েছিলাম, অচিন দেশের দিকে, জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা সেদিকে থাকে। জন্মজলের বিন্দুগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছিলো ডানা থেকে।

অনেকটা পথ ওড়া, নীচে কখনো ডাঙা কখনো জল। তারপরে পৌঁছাই, অচিনগাছে বাসা বাঁধি, ফল ঠোকরাই, খাই আর ভাবি কোথায় সেই জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা? চেনা-চেনা পাখিদের দেখি মাঝে মাঝে, ছোটো ছোটো দলবাঁধা ছাতারে, ওরা সবসময় দলবেঁধে থাকে আর খুনসুটি কি ঝগড়াঝাঁটি করে, ঠোকরায়। ওদের পালকে কেমন যেন দুঃখী ধূসর রঙ! আমি উড়ে পালাই অন্যদিকে।

তবু কেজানে কেন আর কিসের দায়ে বারে বারে ফিরে আসি উত্তরের পাহাড়ে! সব সুখদুখমন্থন করে সেই যে সুপ্রাচীন পাখি গেয়েছিলো নিদ্রাহারা গান, সেই গানের মায়াটানে। আমি সবকিছু এড়াই, তবু একে এড়াতে পারিনা কেন? দুঃখবালি মাখবো না বলে কত পথের আলাপ পথেই রেখে চলে গেছি, ভেতরের ওই অন্ধকার আমার চেনা বলে সেখানে যাই নি কখনো, সুকৌশলে এড়িয়ে গেছি আমন্ত্রণী হাসি। কিন্তু এই পাহাড় কেন ভুলতে পারিনা? কেন এখানে ফিরে আসি বারবার?

নিদ্রালু চোখে চুপ করে বসে থাকি নীলকদম্বের ডালে , বাতাসে ভেসে আসে সেই গান, প্রাচীন পাখি যে গান গেয়ে গিয়েছিলো কতযুগ আগে, কুলহারা সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান। আমি নড়তে চড়তে পারিনা, চুপ করে ঝিম হয়ে বসে থাকি যেন মহুয়াফুলের মধু পান করেছি আকন্ঠ।

বন্ধুরা বলে এই করেই নাকি আমি মরবো। ওই পাহাড় এক মস্ত ফাঁদ। ওই গানের মায়ায় ভুলিয়ে শিকারী বিঁধবে আমায় তীরে! আমি শুনি, বুঝি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনা, যেই না সেই গানের রেশ শুনি বাতাসে, অমনি প্রাণপণে ডানা নাড়তে নাড়তে এসে পৌঁছাই পাহাড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসি নীলকদমের ডালে, তারপরে বুঁদ হয়ে যাই সেই গানে। কোথা দিয়ে যে প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, কোনো হুঁশ থাকে না আমার।

বন্ধুরা বলে, "ওসব মনের ভুল। আসলে কোনো গান নেই। ও মায়া, ও শুধুই মায়া। বাঁচতে চাস তো যাসনে আর ওখানে।"

আমি ওদের কথা শুনিনা, আমি তবু যাই, আমি যে শুনতে পাই গান! অকুল সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান- কী করে বলি ও সত্য নয়, মায়া?

একদিন পাহাড় থেকে ফিরছি ঘরে, বেশ রাত, দখিনা হাওয়া ঝুরুঝুরু করছে জারুলের ডালে ডালে, রক্তকাঞ্চনের পাতায় পাতায়। আকাশে ফালি চাঁদ বেশ পুরুষ্টু হয়ে উঠেছে, নারিকেলের পাতায় পাতায় পিছলে পড়ছে রুপোগলা আলো। হঠাৎ দেখা হলো এক চেনা পাখির সঙ্গে, আমি অবাক হলাম- সে একা! ওরা তো কখনো একা থাকে না!

সে কুশল সংবাদ জানতে চায়, আমিও জানতে চাই তার কুশলসংবাদ। আমরা কথা বলি পাশাপাশি উড়ে চলতে চলতে, অনেকক্ষণ কথা কই, অনেকটা পথ উড়ি পাশে পাশে, একসময় সে বিদায় চায়, অন্যপথে উড়ে যায় একা একা--আমি আবার ভাবি এ কেন একা ছিলো আজ? ওরা তো কখনো একা থাকে না!

তারপরে ভাবনাচিন্তা মুছে ফেলে টলটলে জলের দিঘির উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখি জলের ভিতরে চাঁদ! আমার মতন আরেক পাখিও উড়ে যাচ্ছে জলের ভিতর দিয়ে। জলের ভিতরে কি আরেক দেশ আছে? চেনাজানা সবকিছুই কি সেখানে আছে উল্টা হয়ে?

কনকনে একটা হাওয়া কোথা থেকে এসে আমায় ছুঁয়ে যায়! এখন তো এই হাওয়ার সময় নয়! এ তো সেই নিঠুর হাওয়া যা ধারালো ক্ষুরের মতন বনের সব পাতা ঝরিয়ে দেয়! এখন এ হাওয়া এলো কোথা থেকে? সেই অদ্ভুত অকাল শীতবাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে নিয়ে ফিরে আসি বাসায়, কোমল আস্তরণের মাঝে সঁপে দিই নিজেকে, উষ্ণ পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজি। আধোঘুমে আধোজাগরণে ভাবি কোথায় থাকে সেই জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা?

কিন্তু ঘুম আসে না চট করে। চোখ মেলি। হাওয়া শন্‌শন্‌ করে বয়ে যায় বনের ভিতর দিয়ে, চাঁদের রূপালী আলো চিকমিক করে ঝোরার জলে, ঝুঁকে থাকা ফার্ণের পাতায় জলের বিন্দু লেগেছে, তাতেও ঝিকমিক করে জোছনা। আমার মনে পড়ে বহুদূর উষ্ণ দেশের বনকুঞ্জের কথা, তাতেও এমন জ্যোৎস্না পিছলে পড়তো শুক্লপক্ষ রাতে। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।

দেখি এক আশ্চর্য গাছ, পাহাড়ের উপরে। মস্ত বড়ো সেই গাছের মাথা যেন হারিয়ে গেছে আকাশে। মেঘ ফুঁড়ে, আকাশ ফুঁড়ে কোথায় যে চলে গেছে কত উপরে কিছুই বুঝতে পারিনা। শিকড় তার নেমে গেছে কত নীচে মাটির কত গভীরে- তাই বা কেজানে! হয়তো চলে গেছে পাতালে, ঝিমঝিমে দুপুরের ঘুমঘুম বাসায় মায়ের ঘুমপাড়ানি গল্পে যে পাতালের রাজ্যের কথা শোনা যেতো। কেজানে!

গাছের এক ডালে ছিমছাম এক ছোট্টো বাসা। হেলাফেলার খড়কুটোকাটার বাসা না, অচেনা উদ্ভিদতন্তু দিয়ে বহু যত্নে বোনা বাসা, সোনালী তার দিয়ে মজবুত করে বাঁধা, ভিতরে নরম তুলোর আস্তরণ। সেই বাসায় বসে তাকাই আকাশের দিকে, খোলা আকাশ ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক দূর, নীল আকাশে রোদ্দুর আর মেঘেরা লুকোচুরি খেলে। পাখির দল উড়ে যায় মাঝে মাঝে। ওদের কথাবার্তার টুকরো-টাকরা মাঝে সাঝে এসে পৌঁছায় আমার কাছে, কখনো বা বাতাসে উড়ে যায় অন্যদিকে।

উপরে তাকাই, গাছের শেষ মেলে না, নীচে তাকাই, গাছের শেষ মেলে না। এর মাঝখানে বসে থাকি সাধের বাসায় আমার, ভাবি এই বুঝি বাতাসে ডানা ভাসিয়ে ভাসিয়ে এলো জ্যোৎস্নাপালকের পাখি! ভাবতে না ভাবতেই মস্ত পুচ্ছে অজস্র ঝলমলে রঙ আর মস্ত দুই ডানায় রঙধনু ঝলকিয়ে উড়ে এসে নামলো এক অচিনপাখি! আকাশের বিদ্যুতের মতন তীব্রোজ্জ্বল তার রূপ, সমারোহ ধরে না।

সে পাশের ডালে বসে আমার দিকে চেয়ে হাসলো, বললো, "তুমি কোথাকার ? এখানে, এই গাছে আগে তো তোমায় দেখিনি!"

উত্তেজনায় ধকধক করে হৃৎপিন্ড, কোনোরকমে আমি বলি, " আমি তো এই সেদিন এলাম। আগে এখানে ছিলাম না তো! দেখবে কেমন করে? তুমি কে? তুমিই কি জ্যোৎস্নাপালকের পাখি?"

সে হাসে, নির্মেঘ আকাশে যেন বিদ্যুতের সমারোহ জাগে সে হাসিতে--- হাসি থামলে সে বলে, " আমি এইখানে থাকতাম। বেড়াতে গেছিলাম দূরের দেশে, ফিরে এসে তোমার বাসা দেখে অবাক হয়েছি।"

আমি অবাক, বলি," তুমি এইখানে থাকতে? কই, তোমার বাসা তো দেখিনি!"

সে বলে, "আমার তো বাসা নেই। আমি বাসা গড়ি না। গাছের ডালে থাকি আর আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াই। বাসা গড়ে কী হবে?"

আমি বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকি, সেই অদ্ভুত কনকনে ঘুম ভেঙে যায়। আহ, সব স্বপ্ন! এত স্পষ্ট স্বপ্ন ? অফুরান সেই গাছ, ঝলমলে সেই পাখি, সব স্বপ্ন? যাঃ।

ছলছলে রূপালী জ্যোৎস্না আরো তীব্র এখন, এর মধ্যেও যেন স্বপ্নাভা লেগে আছে। একা জেগে বসে থাকি বাসায়। সর্বচরাচর ঘুমিয়ে আছে, কী অসীম নিতল রহস্যে ভিজে আছে সবকিছু!

***

পাশের ডালে একটা বাসা, সেখানে থাকে এক ভিনদেশী পাখি। সে কথা বলে না বিশেষ, কতটুকুই বা দেখা হয় আমাদের! আমি উড়ে বেড়াই, খাবার খুঁজে বেড়াই, ঝুপ করে জলে পড়ি মাছ ধরার জন্য-বেশ স্নানও হয়ে যায়! নয়তো পাহাড়ে যাই, সেই অলৌকিক গানের পাহাড়! শুধু ফিরে আসি রাত্রের ঘুমটুকুর জন্য।

পাশের বাসার পাখির সঙ্গেও তাই তেমন আলাপ-পরিচয় হয় নাই। সেতো বেশী কথাও বলে না, নইলে হয়তো নিজেই এসে একফাঁকে বন্ধু হয়ে যেতো! অবশ্য আমি নিজেও যেতে পারতাম বৈকি! কিন্তু সে কিনা ভিনদেশী, হয়তো তার কথাও সহজে বুঝবো না! কী দরকার বাপু ঝামেলার! তারচেয়ে যেমন আছি, তেমনই থাকি! এইসব ভেবে ভেবে আর আলাপ-পরিচয় তেমন হয় নি! আজকের স্বপ্নভাঙা রাতে হঠাৎ মনে হলো বন্ধুত্ব থাকলে মন্দ হতো না!

নেশাধরানো জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে সবদিক। আমি উপরে তাকাই, অফুরাণ আকাশে চাঁদের আলো ছাড়িয়ে আছে হাওয়াহাল্কা রুপোলী জরির ওড়নার মতন, ফুটকি ফুটকি কয়েকটা তারাও জ্বলছে। চাঁদনি রাতে বেশী তারা দেখা যায় না, যে রাতে চাঁদ থাকে না, সেই নেইচাঁদ রাতে আকাশে তারায় তারায় ঠাসাঠাসি লেগে যায়।

ভিনদেশী ডানা ঝাড়া দেয় ওর বাসায়, সেও জেগে গেছে। আমি ছোট্টো করে ডাক দিই।

"এই যে শুনছেন, আপনি কি জেগে আছেন?"

ঘুমঘুম গলায় সে বলে, "জেগে গেলাম, আপনিও জেগে যে!"

" আমি ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে অবশ্য লাভই হলো। এমন জ্যোৎস্না!!! আপনি আগে দেখেছেন এমন আশ্চর্য জ্যোৎস্না? " আমি আবিষ্ট গলায় বলি।

সে উদাসীন গলায় বলে, " কত দেখেছি, খোলা মাঠের ধারে গাছে বাসা বেঁধে থাকতাম, সে গাঁয়ের মাঠের দুধেল জ্যোৎস্না দিকদিগন্ত ভাসিয়ে দিতো। এ আর এমন কী জ্যোৎস্না!"

আমি একটু ক্ষুব্ধ হই, বলি, "তাই নাকি? কোথায় সে গাঁ?"

এবারে ওর উদাসীন স্বরে দু:খ মিশে যায়, দক্ষিণের দিকে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে সে বলে, "ওওওও ই দিকে। অনেক পাহাড়, বন, নদী, মাঠ, ঘাট, ঝর্ণা পার হয়ে ছিলো আমাদের গাঁ।"

" ছিলো? এখন আর নেই?"

" নাহ, সে গাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বনে আগুন লাগলো তো! বিরাট দাবানল। সবাই পালিয়ে গেলো। আমরাও।"

আস্তে করে বলি, " আমি জানতাম না, মাফ করে দিন। আপনার দু:খ হবে জানলে আমি কখনো জিগ্গেস করতাম না।"

"নাহ, মাফ চাইবার কী আছে? আর, এতদিন পরে আজ আর দু:খ কিসের? ছিলো সেদিন দু:খ, যেদিন আমাদের সদ্য ডিমফোটা চারটি অসহায় শিশু আগুনে পুড়ে গেলো। ওদের মা চাইছিলো না ওদের ছেড়ে আসতে, কিন্তু ওরাই বললো নিজের শক্তি থাকতে কেন পুড়ে মরবে মা? পালাও। আমরা পরের বছরেই আবার তোমাদের ঘরে ফিরে আসবো নতুন হয়ে। "

আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, চুপ করে চেয়ে থাকি ওর দিকে। সে একটুক্ষণ থেমে থাকে, তারপরে আস্তে আস্তে বলে, " ওদের মা পালিয়ে এসেছিলো আমার সঙ্গে, কিন্তু সন্তানশোক সইতে পারলো না, অসুখ হয়ে মরে গেলো। আমি বেঁচে রইলাম, একা একা। ভুলতে চেষ্টা করি, খাই দাই বেড়িয়ে বেড়াই, কিন্তু ভুলতে পারিনা। "

আমি কী বলবো বুঝতে পারিনা, এ কী ভয়ঙ্কর কাহিনী! আমার ইচ্ছে করে কিছু সান্ত্বনার কথা বলি ওকে, এমন কিছু যা ওই ভয়ানক দু:খের কিছুটা হলেও প্রশমন করে! কিন্তু কিছু বলতে পারিনা। বোবা হয়ে বসে থাকি। সব ভাষা যেন ভুলে গেছি, যেন কোনো বাক্য শব্দ কিছুই ছিলো না আমার কোনোদিন!

এমন সময়! ঠিক সেই মুহূর্তে! আকাশভরা জ্যোৎস্নাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন কাঁপিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো সেই অলৌকিক সঙ্গীত! সেই সব সুখদুখমন্থন করা গান! নিদ্রাহারা, কুলহারা গান! সুপ্রাচীন অলীক পাখির সেই গান!

আমি কানখাড়া করি, সেও করে। শুনতে পেয়েছে, সেও শুনতে পেয়েছে! মায়া নয়, মায়া নয়! সে আমার দিকে তাকায়, বলে, " গান? কোথায় হচ্ছে? আপনি শুনতে পাচ্ছেন?"

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। বলি, " আমার এখনই যেতে হবে, ওই পাহাড়ে, ওখান থেকে ভালো শোনা যায়।"

সে বলে," আমিও যেতে চাই, আমাকে সঙ্গে নিন।"

আমরা দুজনে উড়াল দেই, জ্যোৎস্নাভরা আকাশ দিয়ে ভেসে চলি গীতপাহাড়ের দিকে, দু:খজল শিশিরের মতন ঝরে যায় আমাদের ডানা থেকে। আমাদের চারিপাশে উপরে নীচে ছড়িয়ে যেতে থাকে অনন্ত রাত্রির পালক, সীমাসংখ্যা পেরোনো পালকেরা, তার নরম ওমের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করে দিয়ে বসি নীলকদমের ডালে। আকাশ ভরে, বাতাস ভরে, জলস্থলের হৃদয় ভরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেই অলৌকিক সুরের সুধা-- "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা/ জাগে অসীম নভোমাঝে অনাদি সুর ......"

( শেষ )

ইচ্ছে-জলফড়িং

হেমন্তের দিন গুলোকে বিষাদবিধুর বলেন জ্ঞানীগুণীরা অনেকে। দিন ছোটো হয়ে যায়, আলো পাওয়ার সময়টুকু কমতে কমতে কমতে কমতে কেমন একটা মনকেমন রেখে যায়, বিরাট বিরাট গাছেদের সব সবুজ পাতাগুলো দেখতে দেখতে বাদামী লাল কমলা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে যেতে থাকে, ন্যাড়া গাছেরা নাঙ্গা সন্ন্যাসীর মতন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে উদাসীন নীল আকাশের নিচে। এমন সব দিনে মানুষের মন ও নাকি কেমন বিষাদনীল হয়ে যায়।

দরজাবন্ধ হয়ে যাওয়া ঘরের মতন লাগে মনটা। তাই নিয়েই আসি যাই ঘুরে বেড়াই, দৈনন্দিনের দাবী তো না মিটালে চলে না। নতুন কোনো লেখা আসে না কলমে, আসে না মনে, অন্যদের লেখাপত্তর পড়ি- এখনকার মানুষের লেখা, অনেক বছর আগের মানুষের লেখা, আগে যেসব লেখা পড়ে ভালো লেগেছে, আনন্দ হয়েছে সেসব লেখা। কিন্তু কিছুই যেন যায় না ভিতরে, ঝরে যাওয়া পাতাদের মতন ঝরে যায়, উড়ে যাওয়া হাঁসেদের ডানা থেকে ঝরে যাওয়া জলবিন্দুর মতন ঝরে যায়।

সেই অলৌকিক ইচ্ছেরা কই? ওরাই তো টান দিয়ে বার করতো বাইরে, ওরাই তো দেখাতো আলো দেখাতো ছায়া দেখাতো মেঘেরোদে জড়াজড়ি খেলা। সেই মেঘ সেই রোদ তো আছে, সেই আকাশও তো একই, তবে ইচ্ছের সেই পক্ষীরাজ কোথায়? সে কি আসে আর যায়, ধরা দেবে না?

এই তো একটা ইচ্ছে কেমন আলোয় ছায়ায়
খাতার পাতায় দু'এক টুকরো আঁচড় কাটায়-
সময়বেড়া টপকে গেছে সফেদ ঘোড়া
ঐ ওপাশেই ঝিণুকবাগান বর্ণচোরা,
এই তো আবার চোখ ঢেকে যায় বৃষ্টিধারায়
ইচ্ছেগুলো জলফড়িং এর সঙ্গে পালায়।

আবার দেখি রোদ পড়েছে ছিন্নপাতায়
বৃষ্টিধোয়া ছবির মাঠের রঙীন ছাতায়,
ঐ তো আসে দু'পাক খেয়ে ঝিলিকভ্রমর
কানের গোড়ায় স্পষ্ট শুনি গুঞ্জনস্বর
এই তো আবার চোখ ঢেকে যায় ঝড়ের ধূলায়
স্বপ্নদুপুর দুদ্দাড়িয়ে দৌড়ে পালায়।

***

Friday, March 11, 2011

মণিদীপা(১)

সেটা ছিলো ২০০৮ এর মে মাস। গ্রীষ্ম এসেছে বেশ জাঁকিয়ে। তপতপে দুপুরগুলো। সোনাগলানো রোদ যে আসলেই কী জিনিস তা বোঝা যায় বাইরে বেরুতে হলে। রোদ একেবারে সারা গায়ে চিড়বিড়িয়ে লাগে যেন সত্যিই গলন্ত ধাতু। এমন সুন্দর নীলকান্তমণিপ্রভ আকাশকেও তখন মনে হয় শত্রু, মনে হয় মেঘেরা এসে দখল করে নিক আকাশের ঐ নীল খিলান। এখানের লোকে অবশ্য কেয়ার করে না, ফুরফুরে হালকা জামাকাপড়ে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে, ব্যস্ত সামার ক্যাম্পাস। রেগুলার স্টুডেন্টরা এসময় বেশী থাকেনা বলে স্পেশাল সামার স্টুডেন্টরা অনেক এসেছে।

লাইব্রেরীর ভিতরে চমৎকার ঠান্ডায় দেয়ালজোড়া ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একটা নিরিবিলি বেঞ্চি দখল করে বইপত্রের গোছা আর ল্যাপটপ রেখে গুছিয়ে বসি। বাইরে বড় বড় ওক গাছের ছায়া আর রোদ্দুরে মিলমিশ হয়ে দিব্যি জটিল নকশা হয়েছে। মানুষের দল চলেছে, বাইরের শব্দ কিছু আসে না বলে নি:শব্দ চলচ্চিত্র মনে হয়। বাইরে দেখি ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের তিনজনের দল চলেছে এখন, ক্লাসে যাচ্ছে নিশ্চয়। ওরা প্রত্যেক গ্রীষ্মে আসে। কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি ঝোলাঝালা সাদা পোষাক, মাথায় কালো সিল্কের লম্বা ভেল। ওদের দেখে সহসা মনে পড়লো মণিদীপাকে।

মণিদীপার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিলো এইরকমই এক গ্রীষ্মে, বাংলার এক ছোটো শহরে। অসংখ্য কাজুবাদামের গাছে ঘেরা ছোট্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সে ক্যাম্পাস তখন গ্রীষ্মকালীন ওয়ার্কশপের জন্য খোলা ছিলো কয়েক সপ্তাহ। তারপরেই গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। গরম পড়েছিলো খুবই। তার উপরে জায়গাটাও রুখু লালমাটির দেশ।

সেইখানের ওয়ার্কশপেই মণিদীপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রথমবারের দেখাতেই বাকীদের থেকে ওকে অন্যরকম লাগে। ওর স্বাভাবিক পোশাকের উপরে একটি ঘীয়া রঙের রেশমের হালকা চাদর উর্ধাঙ্গে জড়ানো। ওর চুলগুলোও কেমন অন্যরকমভাবে চূড়া করে বাঁধা। প্রথম পরিচয় হয়েই তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না কেন ঐ বিশেষ চাদর আর চুলবাঁধা, তাই অপেক্ষা করে রইলাম আলাপ আরো কিছুদূর গড়ানোর।

মণিদীপার সঙ্গে ওর বাবামা ও এসেছিলেন সে শহরে, ওরা সকলে উঠেছিল শহরের মাঝের যে বাজার তার পুবের দিকে এক হোটেলে। আমার হোটেলও ঐদিকেই ছিলো। সারাদিন চলতো ওয়ার্কশপ, সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল অবধি, গোটাদিন। সেভাবেই তৈরী হয়ে আসতাম আমরা। কিন্তু একদিন ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে হঠাৎ শুনি সেদিনের ওয়ার্কশপ বাতিল।

একটা রিকশা ঠিক করে আমি আর মণিদীপা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে। দীর্ঘ পথ, ঐ দুপুর রোদে আরো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। পথের পাশে পাশে কোথাও ছায়ামেলা গাছের সারি, কোথাও ধূ ধূ মাঠ।

রিকশা চলছে, আমরা দু'জনে টুকটাক কথা বলছি। তখন আমাদের বেশ ভালোরকম আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞেস করি ওর বিশেষ পোশাকের কারণ। মণিদীপা বলে যে ও এক বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে ঐ চাদর পরতে হয় আর চুল চূড়া করে বাঁধতে হয়। এখনও ও বাড়ীতেই থাকে বাবামায়ের সঙ্গে, আর কিছুদিন পরে আশ্রমে চলে যাবে। আশ্রম নাকি ওদের পাড়াতেই। এখন ও স্কুলে চাকরি করছে, আশ্রমে গিয়ে থাকলেও সেই চাকরি করতে পারবে কিন্তু সংসারধর্ম আর করতে পারবে না। ও বলে, সংসার যাতে করতে না হয় তার জন্যই তো মনে ঈশ্বরপ্রীতি জেগেছে, সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছা জেগেছে, বাবামা যে এই সামান্য কথাটা কেন বুঝতে চান না ও বোঝে না।

আমি চুপ করে শুনি। ধর্মের এত সবল রূপ আমি নিজেদের চেনা-পরিচিতের মধ্যে দেখিনি। ধর্মচর্চা প্রায় ব্যক্তিগত ছিল সেখানে। পরিচিত জনের মধ্যে বড়োজোর দেখেছি কোনো গুরুর কাছে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দীক্ষা নেওয়া আর গৃহী উপাসক হিসাবে তা পালন করা। একেবারে সংসার ছেড়ে আশ্রমে চলে যাবার মতন উচ্চকিত ধর্মচর্চা দেখিনি। শুনেছি কারুর কারুর বৈরাগ্য জাগার গল্প, সেও পুরানো কালের গল্প। কোনো বিশেষ কারণ নেই তবু কেন জানি মণিদীপার দিকে তাকিয়ে মনে হয় বৈরাগ্য নয়, কোনো গভীর অভিমান ওকে সংসার থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। কী সেই অভিমান? কোনোদিন কি জানা যাবে? সামান্য সময়ের মধ্যে ওকে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছে মেয়েটা খুব চাপা, অন্তর্মুখী। ওর গভীর অভিমানের কথা উজার করার মতন উদার মন না পেলে ও কখনোই কাউকে বলবে না।

আমাদের কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে যায় এবারে, মণিদীপার দাদা বিদেশে থাকে, সেখানেই স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে। বিদেশেই তাদের নাকি সেটল করার ইচ্ছে, কিন্তু পরে কি হয় বলা যায় না। চাকরির উপরে নির্ভর, কোম্পানি যদি দেশে ফিরিয়ে আনে, তবে ফিরে আসতে হতেও পারে।

" দাদাবৌদি ফিরে এলেই ভালো, বাবামার তো বয়স হচ্ছে! আমি আশ্রমে চলে গেলে আর তো বেশী দেখাশোনা করতেও আসতে পারবো না। " মণিদীপা কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলে।

" তোমার বাবামা তোমার সন্ন্যাস নেওয়ার ব্যাপারে কি খুশীমনে মত দিয়েছেন?" আমি আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলি।

" না। ওরা প্রথমে মত দিতেই চায় নি। পরে যখন বুঝতে পারলো আমার আর অন্য কোনো পথ নেই, আমার মন একেবারে প্রস্তুত, বাধা দিলে আমার মৃত্যু ছাড়া অন্য পরিণতি নেই, তখন বাধ্য হয়ে মত দিয়েছে। এখনো ওরা আশা করে কোনোদিন আমার মতি ফিরবে, আমি বিয়ে থা করে সংসার করবো। মানুষের আশা যে কী অদ্ভুত!"

"কিছু যদি মনে না করো মণিদীপা, সংসার করতে বাধা কি? সন্ন্যাস তো রইলোই, যখনই মনে হবে সংসারধর্ম কর্তব্যকর্ম শেষ হয়েছে, তখন যাবে সন্ন্যাসে। এখন মাবাবাকে দু:খ দিয়ে আশ্রমে চলে যাবে কেন? "

"বিয়ে? সংসার? না, কখনো না, কখনো না। " অদ্ভুত কাঠিন্যে শক্ত হয়ে উঠেছে শান্ত, কোমল মেয়েটির চোয়াল দু'খানা, হঠাৎ যেন কথাগুলো ধাতব হয়ে গেছে, চোখের মণিতে অন্যরকম আলো, মুখ পাঁশুটে হয়ে গেছে। মনে হয় আমার অনুমান সত্যি, হয়তো খুব জটিল কারণ আছে এসবের নেপথ্যে।

আমার খুব অপ্রস্তুত লাগে, দ্রুত কথা ঘুরিয়ে আমাদের ওয়ার্কশপের প্রসঙ্গে চলে আসি। ঘটমান বর্তমান আমাদের আর্ত অতীত আর অজানা ভবিষ্যৎ থেকে মুক্ত করে চেনা মাটিতে পা রাখতে সাহায্য করে।

পরেরদিন আমার চলে আসতে হয়েছিলো, আর কথা হয় নি। জানাও হয় নি কি ছিলো ওর ঐ তীব্র বিতৃষ্ণার নেপথ্যে। নানা কাজের ব্যস্ততায় আস্তে আস্তে ঘটনার স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। মণিদীপার কথা কিন্তু ভুলি নি।

Tuesday, March 8, 2011

দেশবিদেশের উপকথা-মালয়েশিয়া

সে এক ধনধান্যে ভরা দেশ, দুধমধুর দেশ। দেশের নদীতে নদীতে হ্রদে সরোবরে মিঠাজল, মাঠে মাঠে সোনার ফসল। বিশাল জমকালো রাজপ্রাসাদে লোকলশকর নিয়ে থাকেন রাজারাণী। তাদের একটিমাত্র সন্তান, একটি ছেলে।

সেই রাজপুত্র একদিন এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে বসলো, ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। সে দেখলো সে মাটিতে পড়ে আছে, তার বুক চিরে হাঁ হয়ে আছে, সেখান থেকে তার জ্যান্ত হৃৎপিন্ডটা ছিঁড়ে তুলে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পরমাসুন্দরী তরুণী, হৃৎপিন্ডটা তখনো দপদপ করছে আর তা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা তার গায়ের উপরে।

বাকী রাত আর ঘুম হলো না রাজপুত্রের। জানালার কাছে এসে বাইরে জ্যোৎস্নাশিহরিত উদ্যানের দিকে চেয়ে সে চুপ করে রইলো। মণিমাণিক্য ছড়ানো এই সুখপ্রাসাদের বুকের ভিতর থেকে অশ্রুত যে আর্তনাদ উপরে তারাদের দেশের দিকে চলে যাচ্ছে সে যেন চুপ করে শুনতে লাগলো সেই কান্না।

খুব ছোটোবেলার কথা রাজপুত্রের মনে নেই ভালো, আবছা মনে পড়ে অনেক দূরের এক অন্যরকম দেখতে দেশে ছিলো তারা। তারপরে বাবা এ দেশ জয় করে এই প্রাসাদে এসে উঠলেন। মাঝে মাঝে তার মনে হয় আগে এ প্রাসাদে যারা থাকতো তারা কোথায় গেল? কেমন ছিলো তারা? তারা কি কেউ আজও বেঁচে আছে? সে বুঝতো এসব জিগ্গেস করা মানা, কেউ কিছু বলবে না।

প্রথাগত নীতিতে শস্ত্র আর শাস্ত্রশিক্ষা করতো রাজপুত্র। কৈশোর পেরিয়ে মাত্র প্রথম যৌবনে পড়েছে সে এখন। আর কিছুদিন পরে তার যৌবরাজ্যে অভিষেক হবে। তারপরে বিবাহ। বাবামা সব ব্যবস্থা করছেন নিয়মনীতি মেনে।

রাজপুত্রকে শাস্ত্রশিক্ষা দিতেন যে বৃদ্ধ পুরোহিত, তাকে পরদিন সকালে সব খুলে বললো রাজপুত্র। পুরোহিত শুনে অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন তরুণ রাজপুত্রের মুখের দিকে, এরকমও হয়?

তারপরে তিনি বললেন রহস্যময় সেই কাহিনি, যে কাহিনি কানাকানি করে বেড়ায় দেশের আনাচেকানাচে। আগেকার রাজারাণীর সাতটি ফুলের মতন সাতটি শিশুকন্যা ছিলো। শত্রুর আক্রমণে যখন দেশ লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে তখন এক ডাকিনী যাদুবলে মেয়ে সাতটিকে সাতটি ময়ূরী করে দেয়। তারা গহন বনে উড়ে চলে যায়। তাদের বাবা যুদ্ধে মারা যায়, মা স্বামীর সঙ্গে মরণ বরণ করে স্বেচ্ছায়। সাতটি রাজকন্যা আজো ময়ূরী হয়ে আছে বনে, তাদের শাপমুক্তি বড় কঠিন। যদি সাতময়ূরীর মধ্যে একজন এক ঠোক্করে বুক চিরে ছিঁড়ে তুলে আনতে পারে নতুন রাজপুত্তুরের হৃৎপিন্ড তবে তারা শাপমুক্ত হয়ে আবার মানুষ হতে পারবে। তবে এসব বিশ্বাস না করাই ভালো, গল্পকথার কি আর কোনো মাথামুন্ডু থাকে?

সব শুনে তরুণ রাজপুত্রের হৃদয় কেমন যে করতে থাকে তা বলে বোঝানো যাবে না। সে কিছুই কিন্তু তখন বলে না বুড়ো পুরোহিতকে। শুধু চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে বসে থাকে।

তারপরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "ঠিকই তো, গল্পকথার কি কোনো মাথামুন্ডু থাকে? আর স্বপ্ন ও তো আসলে ছায়ার মতন, মায়া-মরীচিকার মতন, সত্যি করে তো কিছুই থাকে না তাতে। আসুন, শুরু করি আজকের পাঠ। "

সারাদিনমান নানা কাজে ব্যস্ত রাজপুত্র, সকালে শাস্ত্রশিক্ষার পরে মল্লযুদ্ধের আখড়ায় দুপুর পর্যন্ত। তারপরে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। তারপরে বিকালে আবার তীরন্দাজি।

সামনেই যৌবরাজ্যে অভিষেক, সেই আয়োজন চলছে পুরাদমে। রাজা নিজে তদারকি করছেন সেসবের। তীরন্দাজির খেলা থেকে ফিরে রাজপুত্র দেখলো তার জন্য পোশাকের মাপ নিতে এসেছে পোশাকনির্মাতারা, একধারে আবার মণিমুক্তা নিয়ে বসে আছে মণিকারেরা, অলঙ্কার তৈরীর আগে রত্ন পছন্দ করে দিতে হবে। রাণীমা নিজে তলব করে এনেছেন তাদের।

এতসব করে টরে বড়ই ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যাস্নান করে রাতের আহার করেই শয্যায় এসে ঘুমে এলিয়ে পড়লো সে। মনে মনে সে বুঝি বলছিলো --- আহা এসো, আমার মায়াময়ী এসো, "দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়, তোমার আপন হাতের দোলে।"

শেষরাতে আবার সেই স্বপ্ন, সেই ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত স্বপ্নের মধ্যেও রাজপুত্র দেখতে চেষ্টা করে মেয়েটার মুখ, সে মুখে কি উল্লাস না বিষাদ? কেমন ও চোখ, চোখের তারা? সে চোখে কি জল না হাসি? কে তুমি রাজকন্যা বনের ভিতর ময়ূরী হয়ে আছো তোমার বোনেদের সঙ্গে? এ জীবন্ত হৃৎপিন্ড উৎপাটিত করে না দিলে হবে না তোমাদের শাপমুক্তি? এ তুচ্ছ জীবনের বিনিময়ে যদি তোমরা সাতজনে বাঁচো, তাহলে---- কিন্তু কোথায় তোমরা, কেমন করে খোঁজ পাবো তোমাদের?

কিছু দেখা যায় না, সবকিছু নীল কুয়াশায় ঢাকা, ছায়া এসে ঢেকে দেয় রাজপুত্রের দৃষ্টি। স্বপ্ন ভেঙে যায়, বিছানা ছেড়ে উঠে রাজপুত্র বাগানে নেমে পড়ে। আকাশে অপার্থিব হাসি নিয়ে ভেসে আছে কৃষ্ণা প্রতিপদের চাঁদ।

পরদিন সকালে রাজপুত্র বললো সে অভিষেকের আগে সঙ্গীসাথী নিয়ে মৃগয়ায় যেতে যায়। অভিষেক হয়ে গেলে রাজ্যশাসনের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে তখন আর এভাবে তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

রাজা অনুমতি দিলেন, বন্ধুবান্ধবেরা উত্তেজিত, চারিদিকে মৃগয়ার সাজোসাজো আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আজ রাতেই জঙ্গলমহল কেল্লায় যাওয়া হবে, সেখানে রাত্রিবাস। পরদিন সকালে সেখান থেকে মৃগয়া শুরু হবে।

শিকারের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিজের নিজের প্রিয় ঘোড়ায় উঠে রাজপুত্তুর আর তার সঙ্গীসাথীরা রওনা দিলো, অন্যান্য মালপত্র নিয়ে লোকলশকর ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে কেল্লার দিকে।

সেই রাতে সঙ্গীসাথীরা সবাই মিলে একসাথে রাত কাটাচ্ছে কেল্লায়। কথা কি আর শেষ হয়? খানাপিনা কথাবার্তা হচ্ছে আর রাজপুত্তুর উসখুশ করছে আর ভাবছে আর বুঝি ঘুমানোই হলো না। না ঘুমালে মায়াময়ী তোমায় কোথায় পাবো? "ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে / বাঁশির ডাকে সকল বাধা খোলাও খোলাও খোলাও ---"

পরদিন সকালেই মৃগয়া শুরু। শিকারীবেশে রাজপুত্র তার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে, শিকারের পিছনে তাড়া করতে করতে ঘোড়া তাকে নিয়ে গভীর অরণ্যের দিকে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দলছাড়া হয়ে গেল তারা।

এখন শুধু অশ্বারোহী রাজপুত্র আর তাকে ঘিরে আদিম অরণ্যানী ফিসফিস করে কীযেন কইছে। আহা সুখপ্রাসাদের রাজপুত্র, কেন তুই ও ভাষা বুঝিস না? ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে, তার পায়ের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে দূরত্বের বাধা। রাজপুত্র মনে মনে বলে, স্বপ্নের মৃত্যুদেবতা আমার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?

সূর্য যখন প্রায় মধ্যাকাশে তখন ক্লান্ত ঘোড়া রাজপুত্রকে নিয়ে এলো এক পাহাড়ের পায়ের কাছে মস্ত এক সরোবরের তীরে। ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো রাজপুত্র, অঞ্জলি পুরে সরোবরের জল পান করে তৃষ্ণা দূর করলো।তার ঘোড়া ততক্ষণে কোমল ঘাসে মুখ নামিয়েছে।

সরোবরতীরে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ঝুরির পর ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। তারই উচ্চ সাতটি শাখায় বাস করে সাতটি ময়ূরী। প্রতিদিন ঠিক যখন সূর্য মাথার উপরে আসে তখন ময়ূরীরা কিছুক্ষণের জন্য মানুষমন ফিরে পায়। তারা সকলে যে যেখানে ছিলো সেখান থেকে উড়ে এসে বটের নিচের ডালে বসে, তাদের আর্ত মন সন্ধান করে সেই মানুষটির যার মৃত্যু তাদের শাপমুক্তি ঘটাবে। প্রতিদিন তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় কিন্তু তারা জানে একদিন সে আসবেই।

আজ সেই দিন এসেছে। জলপানে স্নিগ্ধ হয়ে বটের ছায়ায় এলিয়ে শুয়েছে রাজপুত্র, কোমরবন্ধ তরবারি ছুরি তীরধনুক সব খুলে রেখেছে বেশ দূরে। ঘুমের ভান করে রাজপুত্র দেখছে সাতময়ূরী নিচের ডালে এসে বসেছে। ঘুমের ঘোরের ভান করে সে বুকের উত্তরীয় সরিয়ে দেয়, তাহলে ঠোক্কর দিতে সুবিধা হবে ওদের। মনে মনে সে অস্থির হয়ে বলে, আরে তাড়াতাড়ি নামো না, দেখছো কী?

প্রথমে বড় বোন নামলো, কিন্তু ঠোক্কর দিতে পারলো না, চোখের জলে ভেসে গেল। ঘুমন্ত নিষ্পাপ তরুণের জীবনদীপ নিভিয়ে দিতে সে পারবে না। ফিরে গিয়ে সে পালকে ঠোঁট গুঁজে বসে রইলো।

একে একে দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া নামলো, দুজনেরই এক অবস্থা। পারবে না ওর বুকে তীক্ষ্ণ চঞ্চু বসিয়ে হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে আনতে, ও যে নিরপরাধ! এভাবে ওকে মারতে তারা পারবে না। তবে শাপমুক্তি? সে কি হবে না?

এবারে চতুর্থীর পালা। তার দিকে আশা নিয়ে চেয়ে আছে বাকীরা। সে আগে থেকেই কান্নায় একেবারে ঢেকে আছে, ডাল ছেড়ে এক পা নামবে না। কিছুক্ষণ তাকে সাধ্যসাধনা করে একে একে গেল পঞ্চম ষষ্ঠ সপ্তম ময়ূরী। কেউই পারলো না কাজ সমাধা করতে।

এবারে বারে বারে চোখ মুছে মন শক্ত করে চতুর্থী নামছে, এই শেষ আশা। ও না পারলে চিরকালের মতন শাপমুক্তির আশা শেষ। সকলের জন্য তাকেই নিষ্পাপের রক্তে কলুষিত করতে হবে নিজেকে।

নামতে নামতে সে নিজেকে বলে, তাই হোক। তাই হোক। হতভাগিনী, পারতেই হবে তোকে। অন্য উপায় নেই। দিদিরা বোনেরা অভিশাপ দিয়ে বলবে ওহ পাষাণী ওহ ডাইনী, কী করে পারলি তুই? তার আগে তুই মরলিনে কেন? চিন্তা নেই, মরা তো হাতেই রইলো। নিষ্পাপের জীবন শেষ করে এই কলুষিত জীবনের কী আর প্রয়োজন থাকবে? থাক, সকলে ভালো থাক।

ঠোক্কর দেবার আগে সে ভালো করে দেখে নেয়, স্বপ্নে কতবার এই তরুণ রাজকুমারকে সে দেখেছে, কোনোবার ভালো করে দেখতে পায় নি। এখনো দেখতে পায় না ভালো, চোখের জলে চোখ ঢাকা।

একটু দূরে রাজপুত্রের খুলে রাখা অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ধারালো ছুরিখানা রোদ পড়ে চকচক করছে। সেদিকে চেয়ে মনে মনে একটু হাসে মানুষমন পাওয়া ময়ূরী, মৃত্যুলোকের ওপারে দেখবো তোমায় রাজপুত্র, প্রাণ ভরে দেখবো, সেখানে অভিশাপ নেই প্রতিশোধ নেই বিরহ নেই প্রিয়বিচ্ছেদ নেই।

এক ঠোক্করে রাজপুত্রের বুক চিরে ফেললো সে, তীক্ষ্ণ চঞ্চু বসিয়ে হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে আনলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘটলো শাপমুক্তি সকলের, ময়ূরী চেহারা ছেড়ে তারা সাত রাজকন্যা হয়ে গেলো।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি, মৃত্যুছায়ায় চোখ ঢেকে যাবার আগে রাজপুত্র দেখলো অরণ্যজ্যোৎস্নার মতন অলৌকিক সুন্দরী রাজকন্যা, চোখের তারা মধ্যরাত্রির আকাশের মত নীল, চুল যেন তার রাতের মহাসমুদ্র, সেই পরমার হাতে দুলছে তার জীবন্ত হৃদয়। প্রায়শ্চিত্ত তবে হলো কি? আহা তুমি কেন কাঁদো রাজকুমারী, পিতার করা ঋণ তো পুত্রকেই পরিশোধ করতে হয়।

সাত রাজকুমারী অঝোরে কাঁদছে, রক্তে মুখ হাত ঢাকা মেয়েটি ছুটে গিয়ে রাজপুত্রের ছুরি তুলে নিয়ে নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিয়ে ঘ্যাঁচ করে টেনে দিলো খানিকটা। ওর হৃৎপিন্ডও ছিঁড়ে পড়লো বাইরে। নাও, এবারে শোধবোধ। খুনি হয়ে আমারও আর বেঁচে থাকতে হলো না আর বাকীদেরও শাপমুক্তি ঘটলো। এখন রাজকুমার আর রাজকুমারীর দেহ পাশাপাশি পড়ে আছে, আর ঘাসের উপরে পাশাপাশি পড়ে আছে দু'খানা দেহবিছিন্ন হৃৎপিন্ড, তখনও দপদপ করছে।

জীবনদেবতা সব দেখছিলেন, তিনি এই আশ্চর্য ছেলেময়ে দুটিকে দেখে একেবারে অবাক! তার সব হিসাবনিকাশ ওলোটপালোট করে দিলো এরা! মানবজাতির তবে তো এখনো আশা আছে!

তিনি এসে এদের পুনর্জীবন দিলেন, তবে বাঁচাবার সময় একটা ওলোটপালোট হয়ে গেল। রাজকুমারীর হৃৎপিন্ড রাজপুত্রের বুকে আর রাজপুত্রেরটা রাজকুমারীর বুকে বসিয়ে দিলেন জীবনদেবতা।

তারপরে আর কী? শুভদিনে শুভক্ষণে এই আক্ষরিক অর্থেই হৃদয়বদল হওয়া রাজপুত্তুর রাজকন্যায় বিয়ে হয়ে গেল, বাকী ছয় রাজকুমারীরও পাশের পাশের রাজ্যের ভালো ভালো রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।

সকলে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।

(শেষ)

Friday, February 25, 2011

শঙ্খপৃথিবী

ডানহাতের পিঠের কালচে বাদামী দাগটার উপরে হাত রেখে তুই জিজ্ঞেস করলি, "এটা কীসের দাগ রে তুরাইন?"

আমি হাত টেনে নিতে গিয়ে টের পেলাম তোর মুঠি ঘিরে ধরেছে হাত, ছাড়াতে পারি না। কিন্তু কী বলবো তোকে?

আমরা আগুন নিয়ে যখন প্রথম খেলতে শিখলাম, সেই সময়ের পোড়া দাগ এটা? তোর তো কিছু মনে নেই চিরল। তুই সব ভুলে গেছিস। ভালোই তো, ভালোই হয়েছে।

ঝাঁক ঝাঁক পাখি বাড়ি ফিরছিলো সেই সন্ধ্যায়, ভাগ হয়ে যাওয়া মালার মতন উড়ে যাওয়া পাখির দল, উড়তে থাকা মালা। আরেক ঝাঁক আসে একরাশি তীর যেন। আরেক ঝাঁক, আরেক ঝাঁক, আরো এক ঝাঁক। এত পাখি কোথা থেকে আসে?

আকাশটা কমলা হয়ে ছিলো অচেনা আলোয়। আমরাও কমলা হয়ে গেছিলাম নিশ্চয়। সেই কমলাপরীর মায়ায় ভুলেই কি পথ ভুল হয়ে গেল আমাদের?

আকাশে একটা ঘুড়িও ছিলো, কেটে যাওয়া ঘুড়ি, বাতাসে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাচ্ছিলো নিরুদ্দেশে।

নিশিডাকা রাতে ছায়াপথ জ্বলজ্বলে
মায়াছবি পড়ে চোখপুকুরের জলে
ওম ছুঁয়ে গেছে শঙ্খপৃথিবী ত্বকে
মেঘমোহনার খাতে?

কোথাও ছিলো কি খোলা সাগরের হাওয়া
কোথাও ছিলো কি বারেবারে আসা যাওয়া?
কোথাও ছিলো কি খাপখোলা তরোয়াল
তারা-শনশন রাতে?

সাগর থেকে কি ফিরেছিলো সে নাবিক?
চাঁদছলছল ঢেউকথাদের পথে?
নাকি ডুবে গেল কালিগোলা কালীদহে
ভুল আলেয়ার হাতে?

নিশিডাকা রাতে আজও ছায়াপথ জ্বলে
মায়াছবি নেই অথৈ গহনজলে
লোহা গেঁথে আছে দুগ্ধপৃথিবী ত্বকে
মৃত্যুমোহনা খাতে।

কোথায় যেন কে গাইছে, জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে---- এ গান কে গাইছে এত রাতে? জীয়নকাঠি মরণকাঠির গান, উদাসীন ধ্রুবতারাও এ গান শোনে কান পেতে।

বালিতে এলিয়ে শুয়ে মাথা নামিয়ে দেই বালির বালিশে, আকাশটা তারায় তারায় ঝমঝম, ঠাসাঠাসি তারা। ধরছে না যেন, নীল বাটিটা ছাপিয়ে উপচে পড়বে যেন এখনি। নক্ষত্রসুরা পান করতে করতে পাশাপাশি ঘুমিয়ে যাই আমরা।

শারদবেলা-ভবন

আমার একটা খুব চেনা সবুজ রেলগাড়ি ছিলো, শালুকফুল ফুটে আলো হয়ে থাকা জলাভূমির পাশ দিয়ে চলে যেতো কুঊঊ ঝিকঝিকঝিক করতে করতে। একজোড়া ফড়িং উড়তে উড়তে জটিল পাক খেয়ে ফিরে আসতো পাড়ের কাছের সতেজ ফুলটির কাছে। তারপরে গাড়ী চলতে চলতে হঠাৎ কাশফুল ভরা মাঠ, দূরে দূরে কতদূরে ছড়িয়ে গেছে, ছোটোবেলার মজার ছড়ার লাইনটা মনে পড়ে- "উলুখেতের ফুলু যেন তুলু থুরুথুরু"---শরতের হাওয়ায় কাশফুল সাদা চুল ভরা মাথা দোলায়, ঢাকের শব্দ আসে জলস্থল পার হয়ে।

সেইসব দিনে এমন আশ্চর্য রোদ উঠতো, মনে হতো খুলে গেছে কোন লুকানো রোদ্দুরমহলের দরোজা! আকাশ এত নীল ছিলো যে মনে হতো সাদা কাপড় ঘষা দিলে নীল হয়ে যাবে। সেইসব দিনে সরোবর সড়কের পাশের শারদবেলা ভবন থেকে আমি তোকে চিঠি লিখতাম নীল। শুধু নীল তখন তুই, এখনকার অনেক দূরের খুব রাশভারী ডক্টর রুদ্রনীল শর্মা না।

সেই চিঠিগুলো উড়ে গেছে হালকা তুলোর ফুলের মতন শরত মেঘেদের সাথে। সেই শারদবেলা-ভবনটাও নেই, পুরানো সব বাড়ীগুলোই ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে। সেই সরোবর সড়ক বদলে গেছে। লেক বুজিয়ে ফেলে ওখানে এখন পাঁচিলঘেরা ময়ূখ আবাসন হয়ে গেছে, মস্ত মস্ত বহুতল বাড়ী, খোপে খোপে লোকেরা থাকে। খুব উপরের ঘরগুলোর নিশ্চয় অনেক দাম, আকাশের মেঘেদের কাছাকাছি থাকা!

নীল, তুই ঐ সমুদ্রটা পার হয়ে চলে গেলি, তখন আমার সবে স্কুলবেলা শেষ, কলেজে ভর্তির তখনও ক'মাস দেরি। তুই বললি চিঠি দিবি সবসময়। এসেছিলো কয়েকটা চিঠি, উত্তরও গিয়েছিলো, সেগুলো কি এখনো তোর কাছে আছে নীল? নাকি আমার সব চিঠিগুলোর মতন ওগুলো ও সব উড়ে গেছে প্রজাপতিডানার রেণুর মতন?

যতবার ছুটে যাওয়া সমুদ্রবিভ্রমে,
ঘোলা বালিয়াড়ি আটকে দেয় পথ-
পায়ের তলায় ভাঙা শঙ্খেরা
বিঁধে যায় কাচের মতন।

অনেককাল আগের ভাঙাকাচবেঁধা পায়ের
এক মূক বালিকাকে চিনতাম-
পায়ের কাচ তুলতে সে ফিরে এসেছিলো
বোরোলীনমাখা বেলকাঁটার কাছে।

সমুদ্র পিছনে রেখে ফিরে আসি
সংসারের বালিযুদ্ধের দিকে।
উপকথার ঢেউয়েরা পিছু ডাকে
সে ভাষার মর্মোদ্ধার করতে পারি না।

নিবিড় রাত্রিমগ্না জীবনের
গভীর কোণে কোণে জোনাকিরা
জ্বলে নেভে, জ্বলে নেভে, জ্বলে নেভে
ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

মৌরীজন্ম

ভুলজন্মের শিকড়বাকড় ছুঁয়ে কলকল বহে যায় অন্ধকারের নদী। আঁধার সে যমুনাপুলিনে বাজে কি আজও কোনো আকুল বাঁশির ডাক? যে ডাকে ভুল হয় ঘর ও বাহির? রাইমানিনীর ছক কাটা উঠানেবাথানে যে ডাক এনে দেয় উতলধারা বাদল? যে ডাকে উচাটন মন ঘরে রহে না?

ঘাসজন্ম বীজজন্ম পক্ষীজন্ম ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেছে না-দেখা নৈরঞ্জনা। তাকে জানা হয় নি, তাকে বুঝে ওঠা হয় নি কখনো। বালুতে হাত থেমে গেছে, জীবনের কলধারায় পৌঁছনো হয় নি। তার তীরে বোধিমূলে বসা হয় নি কখনো। মৌরীজন্ম খুঁজে খুঁজে ফুরালো সুদিন।

এবারে ঢলেছে বেলা, ডেকেছ শঙ্খবেদনা? এবারে খুঁজবো তবে জ্যোৎস্নাপথে নক্ষত্রজন্মমূল। আহা নিরাকার নৈরঞ্জনা, এবারে পাতবো এই শূন্য অঞ্জলি, ভরে দিও লক্ষ লক্ষ অলখ ঢেউয়ে।

Saturday, January 29, 2011

ফিরে আসা

ফেরারী কথারা সেদিন ঘরে ফিরছিলো। অনেকদিনের পরে। সেই যে ঝরাপাতা অরণ্যের ভিতর দিয়ে, পথহীন পথে তারা পালিয়ে গেছিলো, দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলো কুয়াশাভরা অন্ধকারে, পিছনে গুলির শব্দ ছিলো, সঙ্গীরা আসতে পারলো না পড়ে রইলো দেখার সময় ছিলো না-সেই সময়টা এখন স্‍মৃতিমাত্র। অতীত, মৃত অতীত।

মৃত কি? ঠিক বর্তমানমুহূর্তের আগে প্রত্যেকটা মুহূর্তই তো মৃত, ওষধি গাছের মতন নতুন মুহূর্তের জন্ম দিয়েই মরে যায়। নতুন সময়ের টুকরোগুলো কি কখনো পুরানো সময়খন্ডের জন্য স্মৃতিকাতর হয়? জন্মাতে জন্মাতে আর মরে যেতে যেতেই তো ওদের সময় চলে যায়!

আজ ভোরে ফেরারী কথারা ফিরছে। তাদের পথ জুড়ে আজ শালমঞ্জরী ঝরে পড়ছে, মহুয়াফুলের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। অপরাজিতা আকাশের কপাল লাল থেকে কমলা, কমলা থেকে সোনালী। তারপরে সূর্য। আহ, কতদিন পরে। কোথা থেকে যেন একটা চেনা সুগন্ধ আসে একঝলক, নিমন্ত্রণের বাঁশির সুরের মত।

ছোট্টো একটা কচি হাসি
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো
অচেনা ঝড়ের বিভীষিকা-রাত থেকে
চেনা ভোরের অশ্রু টলমল আলোয়।

বুটি বুটি নকশা তোলা
আকাশগন্ধী নীল তাঁত শাড়ীখানা
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো-
ধূসর চিরবিস্মরণ থেকে
প্রতিদিনের হাসিকান্নার ঢেউয়ে।

শিরতোলা দু'টি ঝিনুকের খোলা সাজানো ছিলো
দেখনবাক্সের কাচের ঢাকনার ভিতরে,
কেজানে কোনোদিন হয়তো ইচ্ছেমুক্তো ছিলো
ওদের কবেকার ভুলে যাওয়া শরীরে!

একদিন ওদের দিকে তাকিয়েই
ফিরে এসেছিলাম ক্ষণভঙ্গুর সংসারে আবার
ঝড়ের আকুল সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে
বৃথাবেদনার অশ্রু-অর্ঘ্যে।

মেঘবন্তী

অনেকদিনের অনেক পুরানো সব লেখা, হলদে হয়ে গেছে খাতার পাতাগুলো, কেমন যেন জীর্ণও হয়ে গেছে। কোণাগুলো ভেঙে ভেঙে গেছে, কাগজের গুঁড়ো জমা হয়েছে মধ্যের ভাঁজে ভাঁজে। ইচ্ছে করে হাত দিয়ে ছুঁতে, খুব সাবধানে হাত রাখি, হাত বোলাই। পাছে আরো ভেঙে ঝুরো ঝুরো হয়ে যায়, তাই এই সাবধানতা।

যে দিন গেছে চলে---। জীর্ণপাতার ওই খাতার মধ্যে রয়ে গেছে তার পায়ের চিহ্ন, ধানগন্ধী হেমন্তবেলা, মরিচগন্ধের গ্রীষ্মদুপুর, ইলিশগন্ধী বৃষ্টিবেলা ..... সবার চলে যাবার শব্দ রয়ে গেছে।

ধূলাভরা বান্ডিলের মধ্যে কেন মীরা আগলে রেখেছিলো এইসব এতদিন? একদিন এসে খুঁজবো বলে? নাকি অন্য কেউ, অন্য কোন তরুণ বয়সী কেউ এই বয়সী বটের কচিবেলার সুখদু:খ চিনবে বলে?

শুভ্র দেবদূত, দ্যুতিময় পলাতক
স্বপ্ন ভেঙে চলে যায়
পড়ে থাকে হংসপালক।

কুচি ঘাস ঢেকে রাখে তোমার শরীর
মিহি মিহি অভ্রকণা-
ঝরা পালকের মত নীলাভ ঘড়ির।

বিশ্বাস কথাটার রঙ কি সবুজ?
পড়ে আছে একফালি-
বাকী সব কৃতঘ্ন ইঁটগম্বুজ।

নদী চলে গেছে মরুপার
বালিতে উলঙ্গ ক্ষুধা
স্ফটিকের ফণা সারসার।

খান্ডবদাহনে পোড়া এ জন্মজমিন
এবারে ওড়াও ছাই
আসুক কৃষ্ণিকামেঘ পারাপারহীন।

Thursday, January 27, 2011

কৃষ্ণিকা

1.
আজ বসন্ত, গাছে নতুন কুঁড়ি
শিসমহলে সূর্য-দীঘল পালা
তলব করে এনেছে কিষণকলি
জলঝরানো নাগকেশরী মালা।

তমালবনে চলছে রেলের গাড়ি
চিকনঝিকন রোদ্দুরজাল ছিঁড়ে
গ্রামযমুনায় আজকে বাজে বাঁশি
পাখিরা আজ ব্যস্ত নতুন নীড়ে।

কথকতায় ভরা পাথর সিঁড়ি
অনেক দূরে বরুণাজল পারে-
কথা এসে ছুঁয়েছে তার চোখ
বাষ্পলেখা চোখপুকুরের ধারে।

2.
সেখানে কৃষ্ণিকামন পোড়ে না-দেখা আগুনে
সেখানে ফাগুন হাওয়া এলোমেলো
সে হাওয়ায় ভুল হয় ঘর ও বাহির
সেখানে অচেনা মুখ স্বপ্নে ওঠে হেসে।

সেখানে বাগান ভরে দূরদেশী ফুল
সেখানে রাখালি বাঁশি কেবলই বেদন
জাগিয়ে তোলে স্বপ্নভাঙা ঘরে ,
সেখানে কৃষ্ণিকামন পোড়ে অচেনা আগুনে।

3.
ভুলমুখ ভুলচোখ কৃষ্ণিকার চোখে
চোখ রাখে, ঈশারায় কথা বলে-
উত্তর ভেবে ভেবে বেলা যায় চলে
পাখা মেলে উড়ে যায় অবাক তিয়াশা।

ঝিঁঝিঁডাকা সাঁঝ এসে সেই অবসরে
চুপি চুপি বলে তার কানকলি ছুঁয়ে-
কৃষ্ণিকা, আমিও তোমার মত কালো
আমাকেও বোঝে নাই দিনের মণীষা।

4.
আপাতসুখের নেশা এখন দু'চোখে
নিঁখুত রৌদ্রভরা পথে এখন গোল্লাছুট
এখন সন্ধ্যারাও বেশ জমকালো
সাজানো সভাঘর, হাসির দাগ-
পানপাত্রে আলোর ঝিলিক।

না, এখানে দুঃখ নেই,
নেই বিকেলী বিষাদ দাগ
দিগন্তের সূর্যের গায়ে-
নেই কোনো বিচ্ছেদীগান
ঘুমানো শুয়াচান পাখি-
কুলহারা জ্যোৎস্না-সাগরে
একলা একলা ভাসা নৌকার কথা-
না:, এইসব নেই এইখানে।

5.
বন্ধ জানালায় কল্পবাস্তব,
দেওয়াল ঘেরা ঘরে সান্ত্বনা-
চুপটি বসে গেছে আলতো ছবিটিতে
রূপউজানী ভুল আল্পনা।

চৌকো বাকসেতে কিষণকলি রাখে
বাহারি আলপিন, নকশা গান-
পেয়ালা ভরে দিলো কুহেলী চোখ দুটি
লুকানো আছে বাকি মেঘবাথান?