Saturday, January 29, 2011

ফিরে আসা

ফেরারী কথারা সেদিন ঘরে ফিরছিলো। অনেকদিনের পরে। সেই যে ঝরাপাতা অরণ্যের ভিতর দিয়ে, পথহীন পথে তারা পালিয়ে গেছিলো, দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলো কুয়াশাভরা অন্ধকারে, পিছনে গুলির শব্দ ছিলো, সঙ্গীরা আসতে পারলো না পড়ে রইলো দেখার সময় ছিলো না-সেই সময়টা এখন স্‍মৃতিমাত্র। অতীত, মৃত অতীত।

মৃত কি? ঠিক বর্তমানমুহূর্তের আগে প্রত্যেকটা মুহূর্তই তো মৃত, ওষধি গাছের মতন নতুন মুহূর্তের জন্ম দিয়েই মরে যায়। নতুন সময়ের টুকরোগুলো কি কখনো পুরানো সময়খন্ডের জন্য স্মৃতিকাতর হয়? জন্মাতে জন্মাতে আর মরে যেতে যেতেই তো ওদের সময় চলে যায়!

আজ ভোরে ফেরারী কথারা ফিরছে। তাদের পথ জুড়ে আজ শালমঞ্জরী ঝরে পড়ছে, মহুয়াফুলের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। অপরাজিতা আকাশের কপাল লাল থেকে কমলা, কমলা থেকে সোনালী। তারপরে সূর্য। আহ, কতদিন পরে। কোথা থেকে যেন একটা চেনা সুগন্ধ আসে একঝলক, নিমন্ত্রণের বাঁশির সুরের মত।

ছোট্টো একটা কচি হাসি
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো
অচেনা ঝড়ের বিভীষিকা-রাত থেকে
চেনা ভোরের অশ্রু টলমল আলোয়।

বুটি বুটি নকশা তোলা
আকাশগন্ধী নীল তাঁত শাড়ীখানা
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো-
ধূসর চিরবিস্মরণ থেকে
প্রতিদিনের হাসিকান্নার ঢেউয়ে।

শিরতোলা দু'টি ঝিনুকের খোলা সাজানো ছিলো
দেখনবাক্সের কাচের ঢাকনার ভিতরে,
কেজানে কোনোদিন হয়তো ইচ্ছেমুক্তো ছিলো
ওদের কবেকার ভুলে যাওয়া শরীরে!

একদিন ওদের দিকে তাকিয়েই
ফিরে এসেছিলাম ক্ষণভঙ্গুর সংসারে আবার
ঝড়ের আকুল সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে
বৃথাবেদনার অশ্রু-অর্ঘ্যে।

মেঘবন্তী

অনেকদিনের অনেক পুরানো সব লেখা, হলদে হয়ে গেছে খাতার পাতাগুলো, কেমন যেন জীর্ণও হয়ে গেছে। কোণাগুলো ভেঙে ভেঙে গেছে, কাগজের গুঁড়ো জমা হয়েছে মধ্যের ভাঁজে ভাঁজে। ইচ্ছে করে হাত দিয়ে ছুঁতে, খুব সাবধানে হাত রাখি, হাত বোলাই। পাছে আরো ভেঙে ঝুরো ঝুরো হয়ে যায়, তাই এই সাবধানতা।

যে দিন গেছে চলে---। জীর্ণপাতার ওই খাতার মধ্যে রয়ে গেছে তার পায়ের চিহ্ন, ধানগন্ধী হেমন্তবেলা, মরিচগন্ধের গ্রীষ্মদুপুর, ইলিশগন্ধী বৃষ্টিবেলা ..... সবার চলে যাবার শব্দ রয়ে গেছে।

ধূলাভরা বান্ডিলের মধ্যে কেন মীরা আগলে রেখেছিলো এইসব এতদিন? একদিন এসে খুঁজবো বলে? নাকি অন্য কেউ, অন্য কোন তরুণ বয়সী কেউ এই বয়সী বটের কচিবেলার সুখদু:খ চিনবে বলে?

শুভ্র দেবদূত, দ্যুতিময় পলাতক
স্বপ্ন ভেঙে চলে যায়
পড়ে থাকে হংসপালক।

কুচি ঘাস ঢেকে রাখে তোমার শরীর
মিহি মিহি অভ্রকণা-
ঝরা পালকের মত নীলাভ ঘড়ির।

বিশ্বাস কথাটার রঙ কি সবুজ?
পড়ে আছে একফালি-
বাকী সব কৃতঘ্ন ইঁটগম্বুজ।

নদী চলে গেছে মরুপার
বালিতে উলঙ্গ ক্ষুধা
স্ফটিকের ফণা সারসার।

খান্ডবদাহনে পোড়া এ জন্মজমিন
এবারে ওড়াও ছাই
আসুক কৃষ্ণিকামেঘ পারাপারহীন।

Thursday, January 27, 2011

কৃষ্ণিকা

1.
আজ বসন্ত, গাছে নতুন কুঁড়ি
শিসমহলে সূর্য-দীঘল পালা
তলব করে এনেছে কিষণকলি
জলঝরানো নাগকেশরী মালা।

তমালবনে চলছে রেলের গাড়ি
চিকনঝিকন রোদ্দুরজাল ছিঁড়ে
গ্রামযমুনায় আজকে বাজে বাঁশি
পাখিরা আজ ব্যস্ত নতুন নীড়ে।

কথকতায় ভরা পাথর সিঁড়ি
অনেক দূরে বরুণাজল পারে-
কথা এসে ছুঁয়েছে তার চোখ
বাষ্পলেখা চোখপুকুরের ধারে।

2.
সেখানে কৃষ্ণিকামন পোড়ে না-দেখা আগুনে
সেখানে ফাগুন হাওয়া এলোমেলো
সে হাওয়ায় ভুল হয় ঘর ও বাহির
সেখানে অচেনা মুখ স্বপ্নে ওঠে হেসে।

সেখানে বাগান ভরে দূরদেশী ফুল
সেখানে রাখালি বাঁশি কেবলই বেদন
জাগিয়ে তোলে স্বপ্নভাঙা ঘরে ,
সেখানে কৃষ্ণিকামন পোড়ে অচেনা আগুনে।

3.
ভুলমুখ ভুলচোখ কৃষ্ণিকার চোখে
চোখ রাখে, ঈশারায় কথা বলে-
উত্তর ভেবে ভেবে বেলা যায় চলে
পাখা মেলে উড়ে যায় অবাক তিয়াশা।

ঝিঁঝিঁডাকা সাঁঝ এসে সেই অবসরে
চুপি চুপি বলে তার কানকলি ছুঁয়ে-
কৃষ্ণিকা, আমিও তোমার মত কালো
আমাকেও বোঝে নাই দিনের মণীষা।

4.
আপাতসুখের নেশা এখন দু'চোখে
নিঁখুত রৌদ্রভরা পথে এখন গোল্লাছুট
এখন সন্ধ্যারাও বেশ জমকালো
সাজানো সভাঘর, হাসির দাগ-
পানপাত্রে আলোর ঝিলিক।

না, এখানে দুঃখ নেই,
নেই বিকেলী বিষাদ দাগ
দিগন্তের সূর্যের গায়ে-
নেই কোনো বিচ্ছেদীগান
ঘুমানো শুয়াচান পাখি-
কুলহারা জ্যোৎস্না-সাগরে
একলা একলা ভাসা নৌকার কথা-
না:, এইসব নেই এইখানে।

5.
বন্ধ জানালায় কল্পবাস্তব,
দেওয়াল ঘেরা ঘরে সান্ত্বনা-
চুপটি বসে গেছে আলতো ছবিটিতে
রূপউজানী ভুল আল্পনা।

চৌকো বাকসেতে কিষণকলি রাখে
বাহারি আলপিন, নকশা গান-
পেয়ালা ভরে দিলো কুহেলী চোখ দুটি
লুকানো আছে বাকি মেঘবাথান?