Thursday, May 29, 2014

কাছে কাছে থাকি

নরম ফুরফুরে পালকের মতন উড়ে যায় না-পাঠানো চিঠিরা, অথবা টুকরো টুকরো হাল্কা মেঘের মতন। স্পর্শের মায়াটুকু শুধু রয়ে যায়, অকারণ বিষাদের মতন।
কত চিঠিই তো লেখা হয়েও পাঠানো হয় নি, কত চিঠি লেখাই হয় নি । শুধু স্বপ্নের ভিতরের শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে ভাঁজ ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা ওরা। সব না লেখা চিঠি, কবিতা, গল্প, না গাওয়া গানের কলি, না ফোটা ফুলেরা ---

তোকে ছেড়ে যাইনি কখনও
সবসময়েই কাছে কাছে থাকি,
একসাথেই কলাপাতায় সাজিয়ে দিই
চাট্টি গরম ভাত, এক হাতা মুসুর ডাল
একচিমটি লবণ, একটুকরো পাতিলেবু-
খেতে খেতে কত কথা হয়
হাসিকথা দুঃখকথা আনন্দকথা ব্যথাকথা
তবু তুই ভয় পাস আমি দূরে যাবো বলে?

সেই যে তোর বুকের মধ্যে লেবুপাতার গন্ধ ছিল-
আমি বলতাম তোর মধ্যে লেবুর বাগান বুঝি?
আছে সেই বাগান এখনও?
ঐ যে আমাদের সজনেগাছে থাকতো দুটি কাঠবেড়ালী?
সজনেতলায় দৌড়া-দৌড়ি খেলতো ঝিমদুপুরে?
ওরা কোথায় আজ?
ঐ যে টালির চালের ঘরে বাসা বানাতো দুই চড়াইপাখি?
আমরা ওদের নাম দিয়েছিলাম ইমন আর রূপসা?
ওরা কোথায় গেল?

আমি আজ পাহাড়ী নদীতীরে
তুই আজ দূর সমুদ্রের কিনারায়-
তবু কিন্তু কাছে কাছে থাকি আমরা।
ইমন রূপসা কাঠবেড়ালী লেবুর বাগান-
সবাই আছে আমাদের ঘিরে-
বাইরে নাই বা রইলো!
তোকে ছেড়ে যাইনি কখনও-
কাছে কাছেই আছি,
কাছে কাছেই থাকি।
চিরদিন।

Sunday, May 25, 2014

মেঘ-মানুষ

মনে পড়ে স্বপ্নের সেই মেঘমানুষকে, যে ভেদ মানতো না, বলতো পৃথিবী তার মা আর আকাশ তার পিতা, বলতো সে ভালোবাসে আলো, ভালোবাসে নদী যার মধ্যে কিনা পূর্বজ-পূর্বজাদের আশীর্বাদধারা বয়ে গেছে। বলতো, সে ভালোবাসে সবুজ গাছ, পশুপাখি। বলতো, সে ভালোবাসে অন্য মানুষদের। সে বলতো সে ঘৃণা করে নিষ্ঠুরতা আর ঘৃণাকে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- কে তাকে রক্ষা করে? সে বলেছিল, কেউ না, জলের মধ্যে জল হয়ে ঝরে যায় সে। তার কাছে আরো কত কথা ছিলো জানার, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল যে!

জেগে উঠে মনে পড়ে আরেক মানুষকে, একদিন তাকে যুবক দেখেছিলাম, আজকে সে বুড়া হয়ে গেছে। তখনই তার চুল খুব পাতলা হয়ে গেছিল, এখন মাথাজোড়া মস্ত টাক। আমি খুঁজে বার করেছিলাম তার ম্যাট্রিকের সময় তোলা সাদাকালো ছবি, এক উজল চোখের কিশোর, যার মাথা ভর্তি চুল। সেই অমলকান্তি কিশোর অত বদলে গেছে? সময়ের মধ্যে পিছন ফিরে গিয়ে পিছনবাগে সাঁতার দিতে দিতে আর ফিরে পাওয়া যায় না সেই কিশোরকে?

অথবা সেই যুবককে যে ছোট্টো মেয়েটার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে রবিবারের সকালের বাজারে? এক অদ্ভুত ফলের বাজার বসেছে রেললাইনের উপরে, বাচ্চা মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ট্রেন এলে কী হবে? ফলওয়ালা হা হা করে হেসে বলে," ট্রেন আইলে চাপা পইড়া সবাই মইরা যামু, আবার ট্রেন চইলা গেলেই বাঁইচ্যা উঠমু! এইরম কইরাই তো রোজ রোজ আমরা মইরা যাই আর বাঁইচ্যা উঠি।"

আশেপাশের সবাই গলা ছেড়ে হেসে উঠেছে আর ভীষণ রকম কনফিউজড হয়ে গিয়ে মেয়েটা পাশে বাবার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে, " তাই, বাবা?" হাঁটতে হাঁটতে ফলের বাজার পার হয়ে যায় তারা, মেয়েটাকে বাবা আশ্বস্ত করে, "এই লাইনে খুব ভোরে শুধু একবার মালগাড়ী যায়, সারাদিন আর কোনো গাড়ী যায় না।"

মেঘমানুষ বলে, "এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! আকাশ, মাটি এসবও কি কেনাবেচা করা যায়? আমরা বুঝিনা! এই যে বিশুদ্ধ বাতাস বইছে- প্রাণের দীপগুলি জ্বালিয়ে রাখছে-এই যে স্নিগ্ধ জল কুলকুল করে বয়ে যায় রোদপোহানো পাথরের পাশ দিয়ে, আমাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখে এই জল-এসব তো আমাদের সম্পত্তি না। এগুলো কী করে কিনবে বা বেচবে কেউ? পৃথিবীর প্রত্যেকটা জায়গাই পবিত্র, পাইনের ঝিরিঝিরি পাতাগুলো, সব বালুকাতীর, বনের কুয়াশা, সব তৃণভূমি, সব কীটপতঙ্গ! এরা সকলেই আমাদের স্মৃতি আর অভিজ্ঞতায় পবিত্র।"

ঝড় এসেছে তা তো ভাবিনি তবু
জানালাটি খুলে চেয়ে দেখেছি-
বুক ভরে টেনে নিয়েছি বৃষ্টিগন্ধী হাওয়া,
ঐ হাওয়ার গন্ধ তোকে মনে পড়ায়।
খোলা চুলে মেখেছি সেই হাওয়ার আদর
চুপি চুপি কথার মতন কানের
লতিতে ছুঁয়েছে হাওয়ার হাত।

খুব বৃষ্টি হয়ে গেল সারাটা দুপুর
সঙ্গে ঝিলিক দেওয়া বিদ্যুৎ আর কড়কড়াৎ বাজ-
অঝোর বরিষণ চললো ঝরোঝর।
এখন বিকেল, বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে-
খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসে জুইঁফুল-গন্ধী হাওয়া,
বাগানের কুঁড়িগুলো ফুটেছে বৃষ্টির ছোঁয়ায়।

মাঠে পথে উঠোনে জমে থাকা জলে
মুখ দেখছে আকাশ-
দেখছে তার দ্রুত বদলে যেতে থাকা চেহারা,
বৃষ্টিশেষ মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে,
আকাশ নীল হয়ে আসছে
আমার প্রিয় নীল রুমালটার মতন।
কবে হারিয়ে যাওয়া সেই রেশমী রুমাল-
শৈশবের কুসুম কুসুম গল্পগুলো জড়িয়ে নিয়ে
কোথায় চলে গিয়েছে নিরুদ্দেশের দেশে।
শুধু মনে আছে ওর রঙটা,
আকাশের মত নীল।
তোর মনে আছে কি
এইরকম বৃষ্টিশেষ বিকেলে
একদিন আমরা দেখেছিলাম ছোট্টো গর্তে
জমে থাকা জলে একজোড়া চড়াইয়ের কাকস্নান?
এখন আমি একাই দেখছি
উঠোনে জমা জলে স্নান করছে শুভ আর রূপসা
আমার টালির ঘরে বাসা বাঁধা চড়াই দুটির
ঐ দুটি নাম দিয়েছি।

*******

ভালোবাসার বাড়ী

ধূপছায়া রঙের পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ায় সে। তাই ওকে স্পষ্ট করে দেখতে পাই নি কোনোদিন। শুধু ওর সজল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে অস্তসূর্যের আলোয়। মুখের বাকীটা ভালো করে বোঝা যায় না। কেন জানি মনে হয় ওর অল্প-স্ফীত ঠোঁটে, এলোমেলো হাওয়াওড়া চুলে, করুণ হাতের ছন্দে অচেনা অভিমানের আভাস থাকে। কেজানে! বোঝা যায় না ভালো করে কিছুই। ও যে কে, তাও বুঝতে পারিনা।

দূর দিগন্তে হীরকধূলি ওড়ে, অস্ত-আভায় জ্বলজ্বল করে উঠে ডুবে যায় নীল বনরেখায়। ধূপছায়া পর্দার ওপারেও নামে আঁধারের নীলধারা। ওর চেহারা মিলিয়ে যায় ঝিল্লীর রাত্রিস্বরে। ও তো কথা বলে না, তাই বুঝি না কেন আসে, কী বলতে চায়! নীরবতার কারুণ্য দিয়ে গড়া হিরন্ময় ভাষা ভুলে গেছি সেই কবে!

আমাদের একখানি বাড়ী ছিলো, বড়ো ভালোবাসার বাড়ী। তিলতিল করে গড়ে উঠতে দেখেছিলাম তাকে। বাড়ীটায় ছিলো এক খোলা বারান্দা। বারান্দা ঘিরে ছিলো কনকচাঁপা, শিউলি, দোপাটি, টগর, বকুল, মাধবীলতা, জুঁই, বেলী, চামেলীরা । সারাবছর জুড়ে ঘুরে ঘুরে গানের আসর বসতো সেই বারান্দায়। সুখের গান দুখের গান উঠতো ভালোবাসার মানুষগুলির হৃদয় থেকে। বাড়ী ঘিরে ছিলো অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে ফল আর ফুলের গাছেরা বেড়ে উঠেছিলো নিজেদের মতন। বাড়ীর বড়দাদা কইতেন ফুলের কেয়ারী, লতার বাহারী দেওয়া সাজানো বাগান কৃত্রিম, তারচেয়ে গাছেরা বেড়ে উঠুক এমনি এমনি, পাখিরা উড়ে আসুক, উড়ে যাক। কথাটা সবার ভারী মনে ধরেছিলো।

তারপরে সময়ের ধারা বয়ে গেলো, দেখতে দেখতে কত চেনা অচেনা হয়ে গেল, কত পর হলো আপন, কত আপন সরে গেলো দূরে। বাড়ী ও বদলে গেলো কত! নিজের মতন বেড়ে ওঠা বাগানটাও বদলে গেলো। ক্ষুরের মতন ধারালো হাওয়া খসিয়ে দিলো কত নতুন ফোটা ফুলের পাপড়ি! বৃথা রক্তঝরানো যুদ্ধে হারিয়ে গেলো কত কাছেরজন। কত চেনামুখ একে একে হারিয়ে গেলো সেই হৃদয়নিংড়ানো সঙ্গীতসভা থেকে। অনেক বেদনাপ্রহর পার হয়ে একদিন আমারও পালা এলো, চলে যাবার পালা। একাকী স্টেশনে গিয়ে বিদায়ের ট্রেনে উঠে বসলাম। আর কি দেখা হবে? আর কি ফেরা হবে? এতদিনের এত টান কি সব মিথ্যা ছিলো? নাহলে কিছুই রইলো না কেন? সব ভোজবাজির মতন মিলিয়ে গেলো? নাকি মেলায় নি? কোথাও রয়ে গেছে গোপণে?

এলোমেলো ভাবনা জড়িয়ে যাচ্ছিলো রেশমী সুতার গোছার মতন। আশা-নিরাশার দোলা। কখনো জানালা আয়না হয়ে যায়, সরোবরতীরে নুয়ে পড়া মায়াবী নার্গিস ফুল দুলে ওঠে আয়নায়। চমকে উঠে মুখ ঢাকি--না না না না, এভাবে প্রতারিত কোরো না। আবার দেখি জানালা ফিরে এসেছে, বাইরে দূর দিগন্ত। কেউ সাথে নেই বলে মনে করেছিলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চললো সেই ধূপছায়ালীন অভিমানী। কে সে? কেন তাকে চিনতে পারি না?

"মৃদু বৃষ্টির ভিতর দিয়ে
এগিয়ে চলেছে পথ পাহাড় উপত্যকা-
পিছনে গতজন্মের বাড়ী কখন ঝাপসা হয়ে গেছে।
কোন্‌ দূর সন্ধ্যানামা মাঠে,
এলোমেলো জলরঙ মেখে-
দাঁড়িয়ে আছে হয়তো বা!
কেজানে!


অবিশ্রান্ত লবণাক্ত বৃষ্টি -
আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে,
দূরের আশ্চর্য সূর্যাস্ত দেখতে দেয় না।
ক্রমে অন্ধকারে ঢেকে যায় বিশ্বচরাচর
এখন শুধু চাকার একঘেয়ে আওয়াজ-
রক্তস্পন্দিত হৃৎপিন্ডের শব্দের মতন
ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ....

জানালা দিয়ে বাইরে চোখ ফেলি
বৃষ্টিমেঘজল‌ কখন পিছনে চলে গেছে
নি:সীম কালো আকাশে জ্বলছে
অগণন নক্ষত্রের অফুরাণ বিস্ময়।

তারাদের পাশ দিয়ে
উড়ে যেতে দেখি সেই পাখিকে-
ছায়াপথের হৃদয়ের দিকে উড়ে যায়
সেই শুভ্রডানার অলীক পাখি।
যেতে যেতে একবার ফিরে তাকায়।

আবার বৃষ্টি নামে ঝরঝর-
এবারে ভিতরের আকাশে।

***

অন্তর্লীন

মেঘগুলো একটু আগে গোলাপী ছিলো,এখন সোনালী কমলা। ওই দূরে নীল জলরেখার থেকে লাফ দিয়ে ওঠে ঝকমকে সূর্য। ফেনামাখা ঢেউগুলো আসছে আর আসছে,ভেঙে পড়ছে পায়ের কাছে। দুধসাদা ফেনার রঙ লালচেসোনালী লাগে। আকাশটা পালিশ করা নীলাপাথরের মতন নীল!

আজকে কী ঝকমকে দিন! বেশ গরম হবে দুপুরটা। আমার চিকনবেলার দেশে এমন দিন আসতো শুধু শরতের সকালে, কাশফুল দোলা ভরা মাঠের উপর দিয়ে ভেসে আসতো ঢাকের বোল-ঢ্যাম কুড়কুড় বাদ বাজে ঢাকে পড়লো কাঠি/যা দিবি মা তাই হবে আজ পরমান্নের বাটি..... কে বলতো এই ছড়া? কোথায় পড়েছিলাম ?

সূর্যের উপর মেঘ ভেসে এসে হাল্কা ছায়া পড়ে, আমার আধো স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ভেসে আসে তার মুখ। চিলেকোঠার পাশে ছাদের উপরে আমরা দুটিতে খেলছি-পুজোর ছুটির প্রথম দিন-এমনই ছায়া পড়ে এলো আমাদের উপরে, ওর মুখ মেঘলা হয়ে গেলো-যা:,বৃষ্টি হবে নাকি রে সুমী?ও শরতের দিনে বৃষ্টি ভালোবাসতো না একদম। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি হেসে উঠলাম-না:, এতো আবছায়া! জোর হাওয়ায় মেঘ উড়ে গেল, আমাদের মুখে আবার আলো! সে কবেকার পুজোর ছুটির কথা? মনে হয় যেন এই সেদিন!

লাউমাচায় ফুল ফুটেছে। আমরা নরম নরম লাউপাতা তুলছি, মা বলেছে তুলতে, কিজানি রাঁধতে লাগবে। মাচায় একপাশে ডালপালায় লুকানো একটা ছোট্টো বাসা। কী পাখির বাসা রে? টুনটুনির নাকি? আরেকটু কাছে গিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি চকচকে পুঁতির মতন চোখ মেলে আমাদের দেখছে মা-পাখি। আমরা সরে আসি, ওদের ভয় পাইয়ে দেবো কেন শুধু শুধু? কবের কথা? বহুদিন হয়ে গেলো?তারপরে কি সবুজহলুদনীললাল সেইসব ওম-ওম দিনগুলো চলে গেলো ওই উড়ে যাওয়া মেঘেদের মতন? এ কোথায় আমি? এখানে কি আমার থাকার কথা ছিলো?

লাল হয়ে যাওয়া ওর শার্ট, চোখ বন্ধ! চুলগুলোতে ওই লাল জমাট বেঁধে গেছে। না না না, আমি মনে করতে চাই না। তবু ভুলে যাওয়া সন্ধ্যার আকাশে একটা কাটা ঘুড়ি ভেসে যায়, আস্তে আস্তে আরো আরো দূরে, ওই অনেক দূরের সাঁঝতারার দিকে। আমিও আসছি শরণ্য, ফাঁকি দিয়ে কতদূরে যাবি তুই?দেখি, কখন ধরতে পারি।

চোখ মেলি, একঝাঁক সমুদ্রপাখি উড়ছে, ঢেউয়ের উপরে উপরে। একবার এক সমুদ্রতীরের শহরে দেখেছিলাম দলবেঁধে ওড়ার সময় ওরা কেমন প্যাটার্ন তৈরী করে। অজস্র পাখি ঝাঁক বেধে উড়ছে-কখনো গোল ছাতার মতন হয়ে যাচ্ছে, কখনো মস্ত বাটির মতন, কখনো অচেনা কোনো আকার! সেইবা কবেকার কথা?

পায়ের কাছে গড়িয়ে আসে একটা লাল বল, কার বল? হাতে তুলে নিয়ে তাকাই এদিক ওদিক, একটা ছোট্টো মেয়ে,কুঁচি দেওয়া ফ্রকের ঝালর উড়ছে হাওয়ায়, দৌড়ে এসে সে আমার কাছে দাঁড়ায়, বলটা চায়, বলটা ওর। পুতুল-পুতুল মুখের মেয়েটা, মাথার ঝামর-ঝামর বাদামী চুলে লালনীল পুঁতির সাজ। ওর দিকে বলটা বাড়িয়ে দিই, জিজ্ঞেস করি, "তোমার নাম কী?" সে বলে,"রিমা।" গলা শুনে কাকে যেন মনে পড়ে। বল নিয়ে চলে যাবার আগে সে বলে সে মায়ের সঙ্গে এখানে এসেছে, ওই কটেজে আছে। সুন্দর একটা ঝিনুকের খোলা সে দেখায় আমায়, কুড়িয়ে পেয়েছে।

মাত্র এই মাসটাই বাইরে আসার অবস্থা থাকবে, পরের মাসে কী হয় কেজানে। তাই প্রত্যেকটা দিনকে নিংড়ে নিতে চাই সবটুকু আলো, হাওয়া,জল, আগুন সমেত। ওই আকাশের নীলটুকু মায়া-অঞ্জনের মতন পরে নিতে পারলে কেমন হতো? আহা জীবন, জীবন, জীবন-কী মধুর এই বেঁচে থাকার স্বল্প সময়টুকু! আহা শরণ্য , আমি স্বার্থপর, তোর সময় আরো কত কম ছিলো! তুই কি জানতে পেরেছিলি?তাই অমন সবসময়ে অস্থির হয়ে থাকতিস? আর দেরি নেই, আমাকে নিয়ে যাবে যে জাহাজ, তার পাল ও দেখা দিয়েছে দিগন্তরেখার উপরে। এসো, এসো, তাড়াতাড়ি এসো।

আহা শরণ্য, তুই এখনো সেই কিশোরটিই তো আছিস, আমার চুলে ধূসরতা, আমার মুখে সময়ের কাটাকুটি! সব খসে যাবে, আর সময় আমাকে ধরতে পারবে না। সাগরবেলায় ঢেউ আসে ঢেউ যায়। অবিস্মরণীয় সূক্ষ কারুকাজ বুনে যায় বালিতে-কে বা তাদের দ্যাখে? হয়তো কেউ দ্যাখে!

একলা ঘুড়িটা ভেসে যাচ্ছে সন্ধ্যাতারার দিকে, নিচে কত শত শঙ্খ বেজে উঠেছে, শঙ্খধ্বনি ঘরে ডেকে বলছে-" ফেরার সাথীর সঙ্গ নে।" হ্যাঁ, আসছি,আসছি তো! এই তো এলাম বলে। আর একটুখানি শুধু। "হে মোর সন্ধ্যা, যাহা কিছু ছিলো সাথে/রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি/আঁধারের সাথী, তোমার করুণ হাতে/ বাঁধিয়া দিলেম আমার হাতের রাখী।"

(শেষ)

রণজয়

আকাশটা কী তীব্র নীল! সাদা কাপড় ঘষা দিলে যেন নীল রঙ উঠে আসবে! একটুকরো মেঘ কোথাও নেই। হেমন্তের আকাশে শিরশিরে শীত, পুরানো পাতারা ঝরে যাচ্ছে। এমনই অভিমানী হেমন্তের দিন ছিলো সেদিন। রণোর চলে যাবার দিন।

প্রিয়তোষ চুপ করে বসে থাকে বারান্দায়, সে এরকমই বসে থাকতো ও দেরি করে এলে যাতে হাতে নাতে ধরতে পারে। পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য, বেলা ফুরিয়ে এলো। চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে, সে চশমা খুলে মুছতে থাকে। নির্মলা চা নিয়ে আসে, প্রিয়তোষ চেয়ে থাকে ফাঁকা চোখে। আরো কার যেন আসার কথা ছিলো?

"চলো ভিতরে চলো, এখানে ঠান্ডায় আর থেকো না। চলো।" কে বলছে? নির্মলা? হ্যাঁ নির্মলাই তো! প্রিয়তোষ আর কার গলা শোনার জন্য কান খাড়া করে ছিলো?সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাঝে মাঝে সে কেন রণোর গলা শুনতে পায়?

রণো কুন্ঠিত গলায় আস্তে আস্তে বলছে,"ফিরতে দেরি হয়ে গেলো বাবা। মাফ করে দাও। সারাদিন কিছু খাই নি, খুব ক্লান্ত। আজকে কিছু বোলো না।"

ঠোঁট নড়ে প্রিয়তোষের, "আয় খোকা, তোর জন্য মিষ্টি এনেছি। কিছু বলবো নারে, আয়। তোর মা মিষ্টি বেড়ে দেবে আমাদের, একসাথে খাবো, আয়।"

রণজয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, একপাও এগিয়ে আসে না। প্রিয়তোষ এগিয়ে যায়, বলে,"কীরে কী হলো? সত্যি সত্যি দিচ্ছি। আর তোকে কখনো কিছু বলবো না খোকা। তুই কাছে আয়। ভয় পাস না। কিছু বলবো না তোকে।"

রণজয় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,বলে,"আমি চলে যাচ্ছি বাবা, মাকে বোলো আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসতাম। ভাইকে আর বোনকেও বোলো। তোমাদের সাথে থাকতে আমার খুব ইচ্ছে ছিলো। যদি আমায় ওরকম না করতে! তোমরা তো আমায় দেখতে পারোনা, ভাইবোনদের সাথে আমায় খেলতে দাও না। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো।"

মিলিয়ে গেল রণজয়, প্রিয়তোষ চিৎকার করে উঠতে চায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। তারপরে শোনে,"কী হলো তোমার? স্বপ্ন দেখেছ? বোবায় ধরেছে? উঠে বসো, উঠে বসো।" নির্মলার গলা। ও:, স্বপ্ন! সব স্বপ্ন! স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়?

প্রিয়তোষ উঠে বসে, গলা শুকিয়ে কাঠ। জল চায়। জল এনে দেয় নির্মলা। জল খেয়ে সে বলে,"স্পষ্ট দেখলাম খোকাকে। আমি মিষ্টি খাওয়াতে চাই, ও আসে না, ভয় পায়। তারপরে চলে গেল।"

প্রিয়তোষের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে, সে বলে,"আমাকে এত স্বপ্নে দেখা দেয় কেন বলোতো? আমি কত কষ্ট দিয়েছি বেচারাকে। তোমার ওকে মনে পড়ে না? তুমি ওকে স্বপ্নে দেখোনা? তুমি যদি ছোটো দুটোর মত ওকেও একটু আগলে রাখতে .....তাহলে হয়তো আমি ওকে বোকার মতন ওভাবে.... তুমি ওর নামে কত নালিশ করতে, আর আমিও ওকে ...ওহ, কীভাবে মারতাম..আহ, কিছু বলতো না শেষদিকে, আমার সামনে কাঁদতোও না। ওর ভাইবোনে কত আবদার করতো পুজোর সময় জামাটামার জন্য, ও কিছু চাইতো না। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিছু বিশেষ জামাটামা ওর চাই কিনা, কেমন আস্তে আস্তে বলেছিলো -"তোমার যা ইচ্ছা তাই দিও।" কেমন করে প্রণাম করতো দশমীর দিন, পায়ের পাতায় মাথা ছুঁয়ে। আমরা ওকে বুঝতে পারিনি নির্মলা...."

নির্মলা কেঁদে বলে, "তুমি এমন কোরোনা। কেন শুধু নিজের উপরে সব নিচ্ছ? আমার দোষও তো কিছু কম না। মা হয়ে ওকে কষ্টের দিকে ঠেলে দিতাম। ছোটন আর মিতিনকে একবার নাকি বলেছিলো ওর কেউ নেই। আমরা নাকি ওকে অনাথ-আশ্রম থেকে এনেছিলাম। যেইসব সন্ধ্যেবেলা শাস্তি দিতে, সেইসব রাতে খেতে দিতে তুমি বারণ করতে বলে কত রাতে ওকে খেতে দেই নি। কিছু বলতো না, চাইতোও না খেতে। মিতিন নাকি একবার লুকিয়ে খাবার নিয়ে দিয়েছিলো, ও নেয় নি, বলেছিলো বাবা তোকে বকবে বোন।" নির্মলা চোখে আঁচল দেয়।

প্রিয়তোষ বলে,"মনটা শান্তি পায় না। চলো রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি আমরা।"

নির্মলা বলে,"দিও। এখন ঘুমাও। যদি ছোটন মিতিন শোনে তুমি ঘুমাতে পারোনা, ওরা দু:খ পাবে। মিতিন বলছিলো রণো ওকে ছবি এঁকে দিতো আর ছোটনকেও দিতো। তুমি ওদের সঙ্গে খেলতে বারণ করেছিলে বলে খেলতো না ও। তারপরে তো ..... মিতিন বলছিলো, ওর সঙ্গে খেলা করতে ওদের খুব ইচ্ছে করতো। বলছিলো দাদা একা বলেই তো আমরা এসেছিলাম মা, ওর খেলার সাথী কেউ ছিলো না কিনা! এবারে আমরাও চলে যাই তাহলে?"

প্রিয়তোষ চমকে ওঠে, "এইসব বলে ওরা? তুমি ওদের বুঝিয়ে বোলো। ওদের তো কোনোদিন আমরা কিছু কষ্ট দেই নি! কোনোদিন ওদের কিছু বলবো না। চলো সবাই মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই, রণোর নামে কোথাও কিছু দিয়ে আসি।"

"আচ্ছা, তাই হবে। এখন তুমি ঘুমাও তো দেখি।"

প্রিয়তোষ শুয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করতেই নীল আকাশভরা সোনালী আলো, তার মধ্যে রণজয়ের অভিমানী মুখ ফুটে ওঠে, কী যেন সে বলে।

প্রিয়তোষ বিড়বিড় করে,"আহা তুই আলোর ছেলে, ভালোবেসে এসেছিলি আমার ঘরে, রাখতে পারলাম না হতভাগ্য আমি। কষ্ট পেয়ে ফিরে গেলি। মাফও চাইতে সময় পেলাম না। একদিন তো দেখা হবে, সেদিন মাফ চাইবো। মাফ করে দিস খোকা সেদিন। করবি না? "

আকাশভরা আলোয় বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ওঠে দুটি অভিমানী চোখ, তাতে শিশিরের মতন অশ্রু, টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে প্রিয়তোষের বন্ধ চোখের পাতার উপরে। কানে আসে সেই শেষ মন্ত্র, "মধুবাতা ঋতায়তে/ মধুক্ষরন্তি সিন্ধব:/ মাধ্বীর্ণ সন্তোষধী...."

ওই মধুময় বাতাসের সঙ্গে সে মিশে গেছে। সে আলোর ঘরে ফিরে গেছে।

(শেষ)

Thursday, May 22, 2014

সাদা পাখি হয়ে উড়ে এসে ঈশ্বরী

নদীর একেবারে ধারেই গাছটা। পাড় থেকে জলের উপরে ঝুলে থাকা শিকড় কাঁপে ঢেউ লেগে লেগে। মাঝে মাঝে জলের জোর ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় ওদের। ঝাপটা শেষ হলে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর মতন জলবিন্দু ঝরতে থাকে। স্নান-অবশেষ জলকণা। অনেক উপরে রোদ্দুরে কাঁপে ওর নতুন পাতারা। নরম সবুজ রঙ তাদের। ওরা জন্মেছে এই বসন্তদিনে।

যেখানে ক্লান্ত, আহত ঈশ্বর বসে আছে নতমুখে-

সাদা পাখি হয়ে উড়ে এসে ঈশ্বরী

ডানার হাওয়ায় জুড়িয়ে দেয় সব তাপ-

যত্নে মুছিয়ে দেয় অশ্রুকণা।



এখন অসংখ্য ভ্রমরের গুঞ্জন তাদের বাগানে

পাখিরাও সঙ্গীতমুখর।

দীর্ঘ অন্ধকার মৃত্যুবিষাদদীর্ণ শীতশেষে

আবার এসেছে সোনালী ভালোবাসার সকাল।

সেইসব দিন-কোলাহল ম্লান হলে সন্ধ্যাতারাটির মতন

ধীরপায়ে জলছাপ রেখে রেখে আসে যে,

তার মুখ স্পষ্ট করে দেখিনি কখনো।

তার ধূপছায়া রঙের শাড়ী, পাড়ে সবুজ কল্কা-

বিষন্ন চোখ, শঙ্খের মতন সাদা কপাল

চূর্ণকুন্তলে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু জল-

সন্ধ্যাস্নানের অবশেষ।



ওকে কোনোদিন কথা বলতে শুনিনি

কোনোদিন গান করতে শুনিনি-

জানি না ওর কন্ঠস্বর কেমন।

শুধু স্বপ্নের ভিতরে সেই অশ্রুত স্বর

কচি পাখির ডানার মতন কাঁপে।

ও ই কি সেই সাদা পাখি হয়ে উড়ে আসা ঈশ্বরী?

আদিগন্ত করুণা-ছলছল চোখে চেয়ে

আপন ডানায় মুছে নেয় আহত ঈশ্বরের বেদনা?



পালিয়ে যাবার মাঠ

ছোটোবেলা ভাবতাম একদিন পঞ্চাশ টাকা চুরি করে পালিয়ে যাবো। তখন এই সাত-আট বছর বয়স আমার, কেন জানি কেবলই বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করতো। বাড়ীতে সেরকম যে কোনো ঝামেলা ছিল বা অত্যাচার টত্যাচার হতো, তা কিন্তু না। তবু কেবলই মনে হতো পালানোর কথা। হয়তো মনে হতো বাইরে অনেক মজা, অনেক স্বাধীনতা। কোনো নিয়মের বাঁধাবাধি নাই, পদে পদে নানা নিষেধ নাই, শাসন টাসন নাই। কিংবা হয়তো অন্য কিছু ভাবতাম, আজ আর সেইসব মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে পালিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষাটাকে ।

ভাবা যায়, মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বাকী জীবন নির্বাহ হয়ে যাবে ভেবেছিলাম ছোটোবেলা ! যেন শের শাহের আমল! তবে আমাদের ছোটোবেলা জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল, দশ পয়সা কি কুড়ি পয়সাতে বেশ অনেকটা চানাচুর কি বেশ কয়েকটা লজেন্স পাওয়া যেত। একটা সিঙ্গারার দাম ছিল পঁচিশ পয়সা। দুই টাকায় এক বাক্স সন্দেশ মিলতো। একটা ডিমের দাম ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ পয়সা। চড়ুইভাতি করার সময় নিজেদের বাজার করতে হতো কিনা, সেইজন্য জানতাম। তাই হয়তো ভেবেছিলাম, পঞ্চাশটাকা! বাপরে সে যে অনেক টাকা। বাকী জীবন হেসে খেলে কেটে যাবে।

কোথায় থাকবো সেও ঠিক করে রেখেছিলাম, দেখতাম রাস্তা তৈরীর কাজ করতে আসতো লোকেরা, তারা থাকতো বাঁশবাগানের কাছে অস্থায়ী কুটিরে। ইস্কুলে আসতে যেতে ওদের নির্জনে ঐসব কুটিরগুলো দেখে কলপনাপ্রবণ হয়ে উঠতাম। কল্পনায় দেখতে পেতাম অনেক দূরের কোনো জায়্গায় ওরকম ঘরে থাকবো, রাস্তা তৈরীর কাজের শেষে ওরা যখন ফিরবে তখন ওদের সঙ্গে বসে সন্ধ্যেবেলা আগুন-ঝাল তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাবো। ওরকম তরকারি নাকি ওরা রান্না করে কার কাছে যেন শুনেছিলাম।

কিন্তু তখন পঞ্চাশ টাকা মানে আমাদের কাছে ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। অত টাকা কীভাবে চুরি করবো, খেপে খেপে চুরি করে করে একজায়্গায় জমাবো কিনা, জমানোর মাঝরাস্তায় ধরা পড়ে গেলে কী হবে এইসব জটিল চিন্তায় আর এগোলো না ঐ চুরি প্রোজেক্ট।

নেহাৎ ঘটলো না, নাহলে তখন আমার মধ্যে বেশ কাব্যভাবনাও ছিল। ঐ যে বাঁশবাগানের কাছে কুটির, ওখানে তো দুপুরে কেউ থাকে না, কাজ করতে চলে যায় সবাই। দূরের দেশে ওরকম নির্জন কুটিরে যখন থাকবো তখন কবিতা লিখব, এইও ভেবে রেখেছিলাম। মধুর দখিনা হাওয়া বইবে, বাঁশবনে সরসর করে আওয়াজ হবে, একটা সবুজ মাঠের ধারে গিয়ে বসবো আমগাছের ছায়ায়। আকাশটা হবে চমৎকার নীল, একটা একলা চিল চক্কর কাটবে, সেখানে স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে কবিতা লিখবো, "আকাশে চিল/ বাতাসে নীল/ রোদ ঝিলমিল/ রোদ ঝিলমিল।"

কেন জানি সাজানোর একটা চাকরির কথাও ভাবতাম। পাড়া থেকে একটু দূরে এক খুব বড়োলোকের বাড়ী ছিল, সেইকালেই দোতলা। সেই বাড়ীতে একটা ছোটো মেয়ে ছিল, আমার থেকে এই বছর দুই কি তিন এর ছোটো। ওকে কখনো বাইরে দেখিনি, খেলতে বা স্থানীয় স্কুলে যেতে। ও দূরের কনভেন্ট স্কুলে পড়তে চলে যেত গাড়ী করে। ভেবেছিলাম বাড়ী থেকে পালিয়ে কিছুদিন ওকে সাজানোর চাকরি নেবো। ওরা অত বড়লোক যখন, নিশ্চয় মেয়েকে সাজানোর জন্য লোক রাখে! মুখে ক্রীম মাখিয়ে দিতে, চোখে কাজল দিতে, রুজ টুজ দিতে! চুলে ফিতে টিতে লাগিয়ে দিতে। কেন যে ঐ কাজ কল্পনা করতাম কেজানে, হয়তো অন্যান্য সম্ভাব্য সব কায়িক পরিশ্রমের কাজের মধ্যে ওটাই সবচেয়ে কম ঝামেলার আর বেশ শৌখীন শৌখীন, তাই।

তবে না চুরি করেও পঞ্চাশ টাকা পাবার একটা উপায় আমার এক বন্ধুর ছিল, ওর জন্মদিন হতো বেশ নিয়ম মেনে। সেখানে পরিচিত কাকা বা মামাস্থানীয়রা দেখতাম নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। ওঁরা ওকে গিফট দিতেন, দশ টাকা কিংবা কুড়ি টাকা এরকম। ভাবতাম, আহা, ওর তো এগুলো জমিয়েই পঞ্চাশ টাকা হয়ে যাবে, নিজের টাকা নিয়েই এবারে ও পালাতে পারবে। কিন্তু ও পালাতো না।

তারপরে সেই বন্ধুই একদিন আমাকে চাঁদমামার কথা বললো। ছোটোদের পত্রিকা। সেখানে দুটো ছবি থাকে, সেই ছবি দুটোর জন্য অন্ত্যমিলওয়ালা দুটো লাইন লিখে পাঠিয়ে দিলেই ওরা নাকি পঞ্চাশ টাকা প্রাইজ দেয়। কিন্তু ও আর এটা বলে নি যে সেটা একটা কম্পিটিশান, তাতে জিতলে তবে দেবে। এদিকে খাম লাগবে, স্ট্যাম্প লাগবে, ঠিক করে ঠিকানা লিখতে হবে, ভিতরে কাগজে ঐ লাইন দুটোর সঙ্গে আরো নানাবিধ ইনফো দিতে হবে---এইসব হ্যাপায় পড়ে আর পাঠানো হলো না। তাছাড়া ওরা পঞ্চাশ টাকা দিলেও তো সেটা বাড়ীর লোকে জেনে ফেলবে।

এইভাবে নানাবিধ চৌর ও অচৌর সম্ভাব্য পঞ্চাশ টাকা চারিপাশ দিয়ে ভেসে গেল, কিন্তু ঐ নিষিদ্ধ ফল আর আমার দাঁতের নাগালে এলো না। তারপরে কবে যেন মনের অনেক অনেক পরতের তলায় চাপা পড়ে গেল পালিয়ে যাবার সেই বাসনা। কঠোর বাস্তব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। ডাইনে বাঁয়ে নানারকম লড়াই লড়তে লড়তে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল।

পরত পরত স্মৃতি সরিয়ে দেখি পালিয়ে যাবার সেই মাঠখানা আজও খুঁজছি।

শঙ্খনদীর তীরে

মাঝে মাঝে মনে হয় বাড়ী ফেরার পথ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না, এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার দিকদিগন্ত আচ্ছন্ন করে নেমে আসছে ঘুম-আসা চোখের পাতার মত। পথ খুঁজে আর কী করে পাবো, আলো থাকতে থাকতেই পেলাম না, এখন এত অন্ধকারে কী করে আর....

একেকসময় মনে হয় হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ি গাছতলায়, বৃথা পথ না খুঁজে অপেক্ষা করি বরং। যার দরকার সেই আসবে আমাকে খুঁজতে, "পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়বো তরী সেই শুধু মোর দায়....."

কিন্তু পারি কই? এত সহজ না ভরসা করা, এত সহজ না চুপ করে বসা, অপেক্ষা খুব কঠিন পরীক্ষা। তবু মানুষকে এত অপেক্ষা করতে হয় কেন? ভালোবাসার অপেক্ষা, আরোগ্যের অপেক্ষা, শান্তির অপেক্ষা, পরিত্রাণের অপেক্ষা.....

জীবনের পরীক্ষাগুলি চিরকালই কি এইরকম? এত নিরাসক্ত নির্বিকার! যন্ত্রের মতন পাথরে ঘষা দিয়ে দিয়ে দেখে যাচ্ছে শুধু কী রেখা পড়লো নিকষের গায়ে? আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে দেখছে কতটা খাদ? ঘূর্ণীজলে ছুঁড়ে দিয়ে দেখছে ডোবে কি ডোবে না? কেন? আমরা কি তার হৃদয়ের কেউ নই? তাই কি সে হৃদয়ের কাছে নিয়ে,খুব কাছে নিয়ে দেখে না দপদপ করে জ্বলে ওঠে কিনা চোখের মণিদীপ, রিনরিন করে বেজে ওঠে কিনা না-দেখা চিকন তারগুলি? সে কি শুধু এক্সপেরিমেন্ট করে চলে বিনা ভালোবাসায়? সে কি শুধু পর্যবেক্ষক, সে কি নিজে সুখে মর্মরিত হয় না বাসন্তী বনের মতন, সে কি অশ্রুতে ঝলোমলো হয় না শ্রাবণের মেঘপরিপূর্ণ আকাশের মতন? তাহলে এত আলো এত রঙ এত সব অপরূপ সূক্ষ কারুকাজ এত হাসি এত নিবিড় বেদনার পরম পুলক সবই কি বৃথা? কিছুই তাকে ছুঁতেও পারে না?

তাহলে জ্যোৎস্নায় আকুল নির্জন বনভূমির মধ্যে একলা মানুষটির কানে কানে কে বলে,"আরেকটু এগিয়ে যাও, আরেকটু এগিয়ে যাও ঐদিকে, পথ পাবে।"

তাহলে মৃত্যুসিন্ধু পার হতে হতে জীবনের এক এবং একমাত্র পরমাকে হারিয়ে ফেলা তরুণের কানে কানে সঞ্জীবনীর মতন কে বলে,"আশা হারিও না ছেলে, ক্ষণিকের জন্য যাকে হারিয়েছ, অনন্তকালের জন্য তাকে ফিরে পাবে। এতো বাঁকটুকু মাত্র পার হওয়া,বেয়াল্লিশ বছর আর এমন কি? " দশকের পর দশক অশ্রু গোপণ করতে করতে ক্লান্ত কঠোর অবিশ্বাসী ছেলেটি হঠাত্‌ হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাহলে কেন বলে,"আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।"

তবে? তবে কেন হিসাব মিলতে চায় না? কেন তবে সূর্যপিয়াসী তরুণ গাছেদের মতন সেইসব মানুষের কথা মনে পড়ে যারা আর কোনোদিন পৌছাতে পারলো না তাদের যৌবনের উপবনে? বারুদে, ধোঁয়ায় সব কালো হয়ে গেলো? আকাশ ঢেকে গেল ভস্মে? কী ভয়ানক অভিমানে?

তবু শঙ্খনদীর তীরে তাদের প্রিয়তমেরা প্রিয়তমারা একদিন হয়তো ঠিকই গিয়ে দাঁড়াবে মোমজ্যোৎস্নায়,সব বিরহ-অনল মুছে যাবে চিরমিলনের আকুল বর্ষায়। আলোর দরিয়া পার হয়ে আরো আরো আলোর মধ্যে।

ঝিনুকজীবন

১ স্মৃতিলিখন

অনেকদিনের অনেক পুরানো সব লেখা, হলদে হয়ে গেছে খাতার পাতাগুলো, কেমন জীর্ণ ও হয়ে গেছে। কোণাগুলো ভেঙে ভেঙে গেছে, কাগজের গুঁড়ো জমা হয়েছে মধ্যের ভাঁজে ভাঁজে। খুব সাবধানে হাত বোলাই, আরো যেন ভেঙে না যায়। কাঁচা হাতের লেখা সব, এলোমেলো, বাঁধুনী নেই, কত বানানভুলও আছে, একদম প্রথমের দিকে অক্ষরগুলোও কেমন আঁকবাঁকা...

হাত বোলাই আস্তে আস্তে ওগুলোর উপরে। আমার চলে যাওয়া ছোটোবেলা, কিশোরবেলা, ধানগন্ধী পুজোবেলা, লঙ্কাগন্ধী গ্রীষ্মদুপুরবেলা, ইলিশগন্ধী বৃষ্টিবেলা...সব রয়ে গেছে ঐ জীর্ণপাতা খাতার মধ্যে, ঐসব কাঁচাহাতের যাখুশীতাই লেখার মধ্যে... যে দিন চলে যায়, আর তো তাকে ফিরে পাওয়া যায় না! আজ এই খাতার আর কোনো মূল্যও নেই শুধু আমার নিজের কাছে ছাড়া, স্মৃতির রেশমডুরি দিয়ে আমি এর সঙ্গে বাঁধা বলে...অন্যের কাছে এসব লেখা নিতান্ত ছেলেমানুষী।

তবু, কী করে এইসব রয়ে গেলো আজও? ধূলা ভরা ঐ বান্ডিলের মধ্যে কেন মীরা আগলে রেখেছিলো এসব? একদিন এসে খুঁজবো বলে? নাকি অন্য কেউ, অন্য তরুণ বয়সী কেউ, এই বয়সী বটের কচিবেলার সুখদুঃখের গল্পগুলো পড়বে বলে? কি জানি! কেমন করে সময়ের সাক্ষ্য রয়ে যায় এই নিরাসক্ত বালুচরে, কেজানে কিকরে! কেনই বা?

ঐ যে শীতের মাঝদুপুরে আকাশের উত্তরখিলানে উড়ছে বিন্দুর মতন চিল দুটো, এরাই কি উড়তো কুড়ি তিরিশ চল্লিশ বছর কি তারো আগে? কোথায় ছিলাম তখন আমি? এখানে না, ওখানে না, এমনকি কারুর স্বপ্নেও নয়! এই চিলেরা হয়তো তাদের নাতিপুতিদের নাতিপুতি, সেই একই দৃশ্য রচনা করে চলেছে, রচনা করে চলেছে কালের বক্ষপটে? কেনই বা? জানিনা, কিছুই জানিনা। কত বদলে গেছে দুনিয়া, কত কাছের মানুষ কত দূরে চলে গেছে, কত অচেনা দূরের মানুষ কাছের হয়েছে...

কত পাওয়া, কত হারানো, কত চাওয়া, কত চেয়ে না পাওয়া, কত না চাইতে পাওয়া... কত অশ্রু, কত হাসি...

ঐ যে আজো দেখা যায় সোমাদের চিলেকোঠা, সোমা আমাকে জিগাতো চিলেকোঠাকে চিলেকোঠা কেন বলে, ওখানে কি চিলেরা থাকে? আমরা হাসতাম। কোথায় সোমা আজকে? দুটি ছেলেমেয়ে রেখে সে চলে গেছে অচিনদেশে...চলে গেলেই কি কেউ ফুরিয়ে যায়? আজও সে অফুরাণ মধুর উৎস হয়ে আছে আমার কাছে।

সোমা রেখে দিতো সব পুরানো চিঠি, পুরানো লেখা, পুরানো জীর্ণ সব ছবি...কি হয়েছে ওসবের আজ? ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের দেখভাল কে করবে এই যুক্তিতে ওর স্বামী আরেকবার বিয়ে করে, সেই নতুন বৌ হয়ে আসা মেয়েটি কি সোমার জিনিস রেখেছিলো যত্ন করে, ওর ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে দেখবে বলে? নাকি সব জঞ্জাল ভেবে দূর করে ফেলে দিয়েছিলো? অল্পবয়সে চলে যাওয়া বন্ধুরা ছোটোবেলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় অমরত্বের দিকে, আর তো ধূলিমলীন হয়নি তারা প্রতিদিনের ব্যবহারে,আশা ও আশাভঙ্গে, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের তীব্র কষ্টে তো ওরা আর ধূসর হয় নি...

সোমাদের বাড়ীতে এখন ওর দাদাবৌদিরা থাকে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে, সোমার ছেলেমেয়েরা থাকে অনেকটা দূরে, অন্য এক শহরে, ওদের বাবা আর নতুন মায়ের সঙ্গে। ওদের নতুন মা, কিজানি কেমন চোখে দ্যাখে ওদের! বাচ্চা দুটো, ছোটোটা মেয়ে-এখন ছয় বছরের আর বড়োটা ছেলে-নয় বছরের।ওরা ওদের মাকে কতদিন দেখতে পেলো? শৈশব ও তো তখন পার হয় নি ওদের! ওদের নতুন মায়ের যদি আপন সন্তান হয়, তখনও সে কি এই অকালমৃতা সপত্নীর সন্তানদের যত্ন করতে পারবে?

সোমার ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে খুব যত্ন করে গান শেখাবে! মেয়েটা জন্মাবার পরে পরেই দেখা হয়েছিলো একবার ওর সঙ্গে, ও বাপের বাড়ী এসেছিলো, আমিও তখন দেশে এসেছি, তখন বলেছিলো ওর খুকী একটু বড়ো হলেই গান শেখাবে। সোমা খুব ভালো গান গাইতো। পরে গান নিয়ে হায়ার স্টাডিও করেছিলো, তারপরে বিয়ে হয়ে চলে গেলো দূরে, অনেক দূরে।অবাংলাভাষী এক শহরে। তবু সেখানেও নাকি নিয়মিত গানচর্চা চালু রেখেছিলো, একটা গানের স্কুলে কিছুদিন কাজও করেছিলো ছেলেপুলে হবার আগে। তারপরে সংসারে জড়িয়ে গেলো, ছেলেমেয়ে, স্বামী,আত্মীয়স্বজন, লোকলৌকিকতা ...

আর তো উপায় নেই, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, হারিয়ে যাওয়া গানের জন্য ওর কি মনকেমন করতো? চিল পাক খাওয়া শীতদুপুরের আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে আবার জীর্ণ পাতায় হাত বোলাই।বুঝতে পারি অনেকক্ষণ ধরে শুধু সোমার কথাই ভেবে চলেছি। এইসব পুরানো লেখা থেকে কখন চলে গেলাম সোমার গল্পে?

ঐ যে চেনা অচেনা জায়গায় জীবনের ঘূর্ণী আমাকে নিয়ে গেছে,কর্মসূচীতে ঠাসা সময়গুলো, কোনো ফাঁক থাকতো না, অবিচ্ছিন্ন জলপ্রবাহের মতন রুটিন, তবু কোনো কোনো বিরল রাত্রিতে আধোঘুমে অদ্ভুত অতৃপ্তি আর বালি বালি তৃষ্ণা। জলে বা অন্য পানীয়ে ও তৃষ্ণা দূর হতো না। কিসের অতৃপ্তি জিভে জড়িয়ে থাকতো তেতো-তেতো জ্বরস্বাদের মতন, আমি বুঝতে পারিনি। তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করার সময় ও ছিলো না। এখন অঢেল সময়, এখন অপেক্ষা শুধু, শান্ত অপেক্ষা। আঙুলে সতর্ক আদর মিশিয়ে আবার ছুঁই জীর্ণ খাতার পাতা,আমার চলে যাওয়া বেলা। এতকাল একবারো এদের মনে পড়ে নি কেন?



২ মীরা

এতকাল পরে সে বেদনা কি আর ফিরতে পারে? যে জাগিয়ে দেবে তাকে মৃত্যুঘুম থেকে? পনেরো বছরের সেই কিশোরীকে, যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেই সন্ধ্যায়?

নিরাসক্ত চেয়ে থাকি স্মৃতির সেই বালুকাবেলার দিকে, ও মেয়ের সঙ্গে কোনো লিংক খুঁজে পাই না, চৈত্ররাতের বাতাস এসে সে লিংক ছিঁড়ে দিয়েছে কবে! যে দগ্ধ ক্ষত সেদিন মনে হয়েছিলো সারবে না কোনোদিন, সে কোথায় লুকিয়ে গেছে সময়ের গোপণ ভাঁজে, আর অনেক ডুব দিয়েও সন্ধান পাই না। যে বহ্ন্যুৎসবের সোনালী অগ্নিশিখা তাকে ভিতরে বাহিরে পুড়িয়ে ভস্মসাৎ করেছিলো, আজ তার কোনো চিহ্ন কোথাও নেই! অন্ধকার শুধু। গভীর অন্ধকারের প্রলেপ দিয়ে সে বেদনা ঢাকা। আসলে আমি তো তার কেউ নই সত্যিই, অত অত বছর আগের সেই বোকা ভীতু মেয়েটা, সে তো কেউ না আমার!

মীরা আমার মুখে চুলে হাতে হাত বোলায়, স্পর্শের বৈদ্যুতিভাষায় আমায় কী যেন বলে, আমি বুঝতে পারিনা। কিংবা হয়তো পারি, বুঝতে চাই না। তাড়াতাড়ি তাই বলি,"মীরু, মীরু, তুই কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি এসব? ওরা সন্ধান পায় নি?"

মীরা হাসে, মুক্তোদানা হাসি, ওর চোখও হাসে, দিঘির জলে সূর্যের ঝিকিমিকির মতন হাসি। মীরার সব কিছু বড়ো স্নিগ্ধ, শান্তিময়।

আমাদের সব কিছু প্রায় বিপরীত, আমরা দেখতে আলাদা, স্বভাবেচরিত্রে আলাদা,আমাদের পছন্দ অপছন্দ ভালোলাগা মন্দলাগা সব প্রায় বিপরীত। শুধু আমরা জন্মসুতোর ডোরে এক হয়ে আছি,আমি আর মীরা যমজ। আইডেন্টিকাল টুইন না, আমরা সবেতেই আলাদা, অথচ কোথায় যেন জন্মান্তরের মতন বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত।

মাঝে মাঝে নীরব দুপুরে মীরার কোলে মাথা দিয়ে যখন শুয়ে থাকতাম, ও আমার চুলে বিলি কেটে দিতো, আমরা ভাবতাম, পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার ও আগে অন্য এক অচিন্ত্যনীয় গর্ভবিশ্বে আমরা অত কাছাকাছি ছিলাম, একইসঙ্গে বেড়ে উঠেছি, কী অদ্ভুত ব্যাপার! মীরা আমার মনের কথা বুঝতে পারতো, আমিও ওর-আমাদের সব আলাদা, অথচ মনদুটো জুড়ে রাখা ছিলো এন্ট্যাংগলড কণাদের মতন। তারপরে আমি আর মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে দূরে কত দূরে চলে গেছি...

ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্ত থেকেই তো বিচ্ছেদের শুরু, তারপরে আরো আরো ছোটোবড়ো চিড়,কত কত দূরে চলে গেছি আমরা..., কিন্তু আমরা যে এন্ট্যাঙ্গলড, অজ্ঞাত রেশমসুতোর মতন কিছু আমাদের জুড়ে রেখেছে এক পৃথিবী ব্যবধানেও।

আমি দূরে চলে গেছিলাম, মধ্যাহ্নের খরতাপে কোন্‌ দূর দূরান্তে দৌড়ে বেরিয়েছি...আর আমার ছায়া পড়ে ছিলো এইখানে এই শান্ত গাঁয়ের আমকাঁঠালের গাছের নীচে, শ্বেতজারুলের ফুলে, কলাপাতায় ভোরের শিশিরের গড়িয়ে পড়ায়, বসন্তের রাঙা শিমূলের ফুলে,গ্রীষ্মের যূথীগন্ধে, বর্ষার সবুজ ধানের উপরে বয়ে যাওয়া হাওয়ায়, শরতের শিউলি আর তুলোমেঘে দুর্গাপুজোর ঢাকের বাজনায়, হেমন্তের মনকেমনিয়া রিক্ততায়, শীতের দুপুররোদে নীল আকাশে চক্র দেওয়া ঐ চিলেদের ডানায় ...

আমি ওদের ভুলে গেছিলাম, তাই মীরা আমার হয়ে সব সঞ্চয় করে রেখেছিলো... অথচ মীরাকে ও আমি ভুলে যেতাম আমার সেই হুল্লুড়ে ছোটোবেলা, তখন সোমা, পম্পা, পিংকি, টুপাই, তানি, মৌ, মান্তু... কত বন্ধু তখন আমার, আমরা তখন খুব খেলতাম মাঠে। কত রকম খেলা ছিলো-কাকজোড়া, জেলেমাছ, নামপাতাপাতি, ছোঁয়াছুঁয়ি, বুড়ীবসন্তী, ভাইবোন... এসব ছাড়া ও মাঝে মাঝে ক্রিকেট ভলিবল ও। আবার আমাদের খেলার প্রতিযোগিতাও হতো কখনো কখনো জানুয়ারিতে, সেখানে হতো গুলিচামচ, অংকরেস, স্কিপিংদৌড় ... সেই মাঠশুদ্ধ হারিয়ে গেছে, এখন সেখানে অনেক অনেক বাড়ী আর বাড়ী।

মীরু খেলতো না, ও খেলতে পারতো না, ওর ডান পা আর বাঁ পা অসমান ছিলো, খুঁড়িয়ে হাঁটতো। তাই ও বেরুতো না বিশেষ বাড়ী থেকে, মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতো, ঘরে বসে খেলতো নিজের মনে। তখন থেকেই খুব ঠান্ডা মেয়ে ছিলো মীরু, আপনমনে প্লাস্টিকের পুতুল আর পোড়ামাটির হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে খেলতো,কোনো কোনো দিন ছুটির দুপুরে সোমাকে নিয়ে আমি এসে ওর সঙ্গে খেলায় যোগ দিতাম। আমার কেবল ভয় হতো পাছে মীরাকে কেউ কিছু বলে ওর পায়ের জন্য, তাই সোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে পারতাম না, কে কী বলে ফেলে তার ঠিক কী? একমাত্র সোমা কিছু বলতো না, অনেক ছোটো থেকেই সোমা খুব বুঝদার ছিলো।

মীরার স্কুল আর আমার স্কুল আলাদা ছিলো, তাতো হবেই। অথচ প্রথমদিকে সেই আলাদা ব্যাপারটা মেনে নিতে দুজনেরই কষ্ট হতো। আমাদের ক্লাসে দুজন যমজ মেয়ে ছিলো-সুনীতা আর সুতীর্থা। ওরা আইডেনটিকাল টুইন। কেমন দুজনে একই ক্লাসে পাশাপাশি বসে,এক টিফিনবাক্স থেকে ভাগ করে খায়,কেউ একজন কিছু আনতে ভুলে গেলে অন্য বোনে তার ব্যাগ থেকে বার করে দেয়। আমার ভারী মনকেমন করতো মীরার জন্যে। তারপরে আস্তে আস্তে সয়ে গেলো, মনে হলো একদিকে ভালোই, নইলে সবাই হয়তো মীরার পায়ের জন্য প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে দিতো!

আস্তে আস্তে বিচ্ছেদরেখা গাঢ়তর হতে থাকে, ভোর থেকে যতই বেলা গড়াতে থাকে। আমাদের সকলের জীবনেই কি তাই? যমজ হোক বা না হোক? এইভাবে আমরা দুজনেই বড়ো হতে থাকি, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, নানা ঘটনার তরঙ্গ আমাদের উপরে আছড়ে পড়ে, কখনো ভাসিয়ে নেয় খানিকটা, কখনো ডুবিয়ে দেয় আপাদমস্তক-কিন্তু আমরা আবার মাথা জাগাই।

আগেই তো বলেছি আমি আর মীরা ভিন্ন প্রকৃতি, মীরা অনেক শান্ত, ঠান্ডা। একদম ছোটো থেকেই বোধহয় সে কেমন করে বুঝতে পেরেছিলো ওর জেদী হতে নেই, ওর একগুঁয়ে হতে নেই, ওর দুরন্ত হতে নেই। ওর সবই মেনে নিতে হবে, ওকে চিরকালই মানিয়ে নিতে হবে। ওর পক্ষে দুষ্টু মেয়ে হওয়া অসম্ভব, ওকে লক্ষ্মী মেয়ে হতে হবে। ও তাই হয়েছিলো, ঘরের কাজে মাকে হাতে হাতে সাহায্য করতো খুব ছোটো থেকেই। ওর পড়াশোনা নিয়ে তেমন টেন্শন কোনোদিন করতো না মাবাবা, যেন ভালো হয়েই বা কি হবে, সেই তো প্রতিবন্ধী!

অন্য দিকে আমি জেদী, দুরন্ত। কিছুই মেনে নিতে চাই না। কিছুতেই মানিয়ে নিতে চাই না। ঘরের কাজ আমাকে দিয়ে করানো অসম্ভব বলে কখনো মা বলতোও না করতে। শুধু পড়াশোনার ভালোত্বটাই হয়তো এইসব ত্রুটি সত্বেও আমাকে তেমন কঠিন সমস্যায় ফেলেনি। মাবাবা খুব সিরিয়াস ছিলো আমার পড়াশোনা নিয়ে। বহুকাল পরে যখন বুঝতে পারলাম আমি ওদের একমাত্র বাজি ধরার মতন রেসের ঘোড়া, ততদিনে বেলা কেটে গেছে অনেক, আর ফিরে আসার পথ নেই। যাতে মীরার কোনো ছায়াও আমার উপরে না পড়ে তাই আমার নীরা নাম বদলে রাখা হলো শিখা, যাতে নামের কোনো শাব্দিক বা ছন্দগত মিলও না থাকে। শুধু নীরা লুকিয়ে রয়ে গেলো মীরার শান্ত দিঘির মতন হৃদয়ে, খুব একান্ত মুহূর্তে সে আমাকে মাঝে মাঝে নীরা বা নীরু বলে ডাকতো।আমার আগুনপোড়া জীবনের উপরে একপশলা বৃষ্টির মতন ছিলো সেই নামের ছোঁয়া। আমরা দুই বোন ছাড়া কেউ সে খবর জানতো না।

৩ নীরা

মীরা জিজ্ঞেস করে," কিরে নীরু, একটু ঘুমিয়ে নিবি না? একটু বিকেল হলেই তো আবার ছাদে যেতে চাইবি। এইবেলা একটু ঘুমিয়ে নে।"

হাল্কা ঝাঁকুনি খেয়ে বর্তমানে ফিরে আসি। মীরার গলার স্বরের এই মাতৃভাব আমার কানে চিরকাল সুধাবর্ষণ করেছে, সেই মরুভূমির দিনগুলো নইলে পারই বা হতাম কিকরে? সেই একলা জীবনে আর তো কেউ ছিলো না মনের কাছে, বিপন্ন মুহূর্তে যে পাশে দাঁড়ায়, শক্ত কাঁধ এগিয়ে দেয় ভর দেবার জন্য, গোপণ কান্না মুছে নেয় শান্ত আঁচলে।

বাবামায়ের কাছে তো সেই আশ্রয় পাওয়ার আশা ছিলো না, ওদের রেসের ঘোড়া আমি, সেই ডিসাইসিভ সন্ধ্যায় যাকে বনে পালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত করে শৃঙ্খলিত করা হয়েছিলো। তাছাড়া কৃতজ্ঞতার বন্ধন ও তো আছে, জন্মঋণ আছে...

হয়েছে কি শোধ, ঐ পিতৃমাতৃঋণ? গোটা জীবনটি বাজি ধরে? কেজানে! কেউ বলতে পারে না, কিংবা হয়তো কেউ পারে, এ পৃথিবীতে যাকে কোনোদিন দেখা যায় না অথচ মানুষের সমস্ত জীবন লাভ ক্ষতি দেওয়া নেওয়া চাওয়াপাওয়া পাপ পুণ্য ভুল ঠিকের হিসেব যার কাছে থাকে। দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, তার আর তো বেশী দেরি নেই...

মীরা আমায় শুইয়ে দেয় আলতো করে, আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়ে আমার চুলে বিলি দেয়, ওর চোখের অঝোর অশ্রু আমার চুলে ঝরে পড়ে। আমি বলি, "মীরু, কেন কাঁদছিস? বোকা মেয়ে কোথাকার! আমি চলে গেলেও আমায় ফিরে পাঠাবে, জানিস? এই জীবনব্যাপী আকুল মাতৃস্নেহাকাঙ্ক্ষা, এই শুকনো হৃদয়ের উপরে বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা, এই ভালোবাসার তৃষ্ণা...এত চাওয়া নিয়ে কেউ কি চলে যাবার অনুমতি পায়? আমায় ফিরে পাঠাবেই, তখন বলবো তোর ঘরে যেন আমাকে... হয়তো অনেক অনেক বছর পরে, অন্য সময়ে, অন্যরকম পৃথিবীতে... তোর ঘরে মেয়ে হয়ে আমি আসবো।"

মীরা আমার মুখের উপরে হাত চেপে ধরে, আর বলতে দিতে চায় না, কান্নায় মীরা ভেসে যাচ্ছে।আমি হাত বাড়িয়ে ওর চোখ মোছাই, ও এত কাঁদবে জানলে আমি আগেই থেমে যেতাম।

চোখ বুজি, ঘুমোবার ইচ্ছে হয় না, ছোটোবেলার সেই দুপুরগুলো মনে পড়ে, তখনো ঘুমাতে ইচ্ছে করতো না। ঠিক দুপুরবেলা যখন সব চুপচাপ হয়ে যায়, শুধু কোথায় যেন ঘুমেলাস্বরে ঘুঘু ডাকে ঘুগ্‌ঘু-উ-উ-উ, তখন চেনা পৃথিবী কেমন ম্যাজিকদুনিয়া হয়ে যায়, সে না দেখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় নষ্টের মানে হয় কোনো? কিন্তু তখন মা জোর করে শুইয়ে রাখতো, আমাকেও মীরাকেও,মীরা ঘুমিয়ে পড়তো, আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম আর ভাবতাম মা ঘুমিয়ে পড়লেই আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলে যাবো পুবের বারান্দায়, সেখানে গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে নীল অপরাজিতা ফুটেছে, সেগুলোর উপরে হাত বোলাবো আর খুঁজবো সেই ম্যাজিক দরজাটা ঠিক কোথায়? যেটা পার হতে পারলে আর মজার অন্ত নেই?

কিন্তু কোনোদিন সেই পরিকল্পনা রূপায়িত হতো না, মার ঘুম খুব পাতলা, আমি উঠে পড়লেই হাত বাড়িয়ে টেনে শুইয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাতচাপড়ি দিতো কাঁধের কাছটায় অথবা বালিশটার কোনা ধরে আস্তে আস্তে ঝাঁকাতো,সেই দোলদোল দুলুনির ম্যাজিক আমায় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে দিতো। যখন চোখ মেলতাম তখন বিকেল, জেগে ওঠা মানুষদের গলা শোনা যাচ্ছে, দুপুরবেলার যাদু কোথায় মিলিয়ে গেছে। উঠে মুখহাত ধুয়ে খেলতে চলে যেতাম মাঠে, সেখানে তো তখন সোমা, পম্পা, বিল্লু, বাবুন, পিংকি, মৌ, তানি সবাই জুটে গেছে। স্মৃতি কখনো কখনো কত মধুর...

ফিরে আসে সেইসব অমলীন কচিমুখের বালকবালিকারা, স্মৃতির দেশে তারা একই রয়ে গেছে, কঠিন রুক্ষ দুনিয়া ঘষে ঘষে শক্ত করতে পারে নি তাদের...

এতকাল পরে এই আসন্ন সন্ধ্যায় আবার সেই জীবনের কচিবেলার দিনগুলোর ছায়া এসে পড়েছে, এখনো দুপুরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। আর মীরা, ঠিক সেই সময়ের মায়ের মতন বালিশে দুলুনির মতন ঝাঁকুনি দিয়ে আমায় ঘুম পাড়ায়। অদ্ভুত একটা ঘুমপাড়ানি সুরের গানও ও গায়, অর্থোদ্ধার করতে পারিনা, এলিয়ে পড়ি ঘুমের মধ্যে।

বিকেলে ঠিক তেমনি উঠে মনে হয় দুপুরম্যাজিক হারিয়ে গেলো, ঈশ! এখন আর দৌড়ে খেলার মাঠে যাওয়া নেই অবশ্য,ভাবতে গিয়ে হাসি পায়, মধ্যবয়সী কেউ কি খেলার মাঠে গিয়ে কচি বাচ্চাদের মতন খেলতে পারে? অবশ্য সেই খেলার মাঠ শুধু স্মৃতির মধ্যেই রয়ে গেছে, বাড়ীর জঙ্গলে মাঠ সব হারিয়ে গেছে। রোদের তেজ কমে এসেছে, আকাশে নরম সাদা মেঘেরা সন্ধ্যারঙ মাখার জন্য তৈরী হচ্ছে, ছাদে রঙীন ছাতার নীচে বসে থাকি, মীরা চা আর পকোড়া নিয়ে এসে বসেছে।

আমরা কথা বলছিলাম, এলোমেলো পুরানো কথা, নতুন কথা,হাসির কথা,এমনি সাধারণ কথা।এইসব কথায় কথায় উঠে এলো বিদ্যুতের কথা। মেয়ের কথা বলতে বলতে কেমন করুণ হয়ে এলো মীরার মুখ,আমি ওর হাতের উপরে হাত রেখে চুপ করে রইলাম। চিরকাল আমি আমার ইমোশনাল নীডের সময় মীরার কাছে অঞ্জলি পেতেছি, ওর নিজের সুখদুঃখ চিরকাল ও গোপণ করেছে, কোনোদিন খুলে দেখায় নি। ঐ নির্জন দুপুরের রহস্যপুরীর মতন ওর মন, যা কোনোদিন আমার চোখে ধরা পড়ে নি।

বিদ্যুৎপর্ণা হোস্টেলে থাকে, মীরার প্রথমদিকে আপত্তি ছিলো, একমাত্র সন্তান এভাবে বাড়ী থেকে দূরে থাকবে! কিন্তু তাপস অনেক বুঝিয়ে ওকে রাজী করেছিলো। বলেছিলো, বাইরে থাকলে বিদ্যুৎ অনেক ভালোভাবে তৈরী হবে, ভালো শিক্ষা পাবে,ভালো সুযোগ পাবে। এখানে এই গাঁ মফস্বলে থাকলে কিকরে সে জীবনে উন্নতি করবে? মীরা মেনে নিয়েছিলো, সে চিরকাল মেনেই তো নিয়েছে,কোনো আপত্তি তো কোনোকিছুতেই সে করে নি!ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কিছুই তো সে জোর করে প্রকাশ করে নি কোনোদিন! চিরকাল শুধু মানিয়ে নিয়েছে! তাপসের কাছেও সে কেমন ঋণীর মতন, প্রতিবন্ধী তাকে বিয়ে করে সে যেন বিরাট মহত্ব দেখিয়েছে!

আমার কাছেও মীরার সঙ্কোচের শেষ নেই, আমার সমস্ত জীবন নাকি ওর জন্যেই এত রিক্ত রয়ে গেল, ওরই কারণে নাকি আমাকে অত পুশ করেছিলো বাবামা, আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপরেই নাকি নির্ভর করছিলো ওর চিকিৎসা চলতে পারবে কিনা, ওর দায়িত্ব নেবার কাউকে পাওয়া যাবে কিনা যে বাড়ীঘর ও সঞ্চিত সম্পত্তির নিরঙ্কুশ দখল পাবার বিনিময়ে পঙ্গু মীরাকে ঘাড়ে নিতে রাজী হবে। আমি যদি নিঃশর্তে সব সম্পত্তি ছেড়ে না দিতাম, যদি আমার চাকরিবাকরি না থাকতো, যদি প্রচুর পণ দিয়ে আমাকে বিয়ে দিতে হতো আর তারপরেও শ্বশুরবাড়ীর থেকে দাবীদাওয়া লেগেই থাকতো-এইসব অজস্র যদির বেড়া চাপা পড়ে মীরার হিল্লে হবার নাকি কোনো উপায়ই আর থাকতো না। ওর সুখশান্তির ঘরসংসার নাকি হয়েছে আমার প্রাপ্য আমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ায়।

আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি যে এগুলো সত্য নয়, আমাকে কেউ বাধ্য করেনি, আমার ভালোর জন্যেই বাবামা চেষ্টা করেছিলো, ওদের স্বার্থ ছিলো না অন্য কোনো-কিন্তু ও হাসে দুঃখের হাসি।ও মানে না। বলে,"নীরু, তাহলে কেন তুই সংসার করলি না চাকরিবাকরি ভালো পেয়ে যাবার পরেও?"

আমি আর কী বলবো ওকে, আর সকলের কাছ থেকে লুকাতে পারি, কিন্তু সাংঘাতিক সন্ধ্যার নীরব প্রত্যক্ষদর্শী মীরা,তার কাছে কী দিয়ে ভুজুংভাজাং দেবো? সেও তো একই বয়সের এক সংবেদনশীল ভীতু কিশোরী ছিলো, প্রেমের মৃত্যু তার কাছেও তো সমান সাংঘাতিকই ছিলো, হোক না সে প্রেম তার নিজের নয়, যমজ বোনের।

আমি জোর করে হাসি, বলি,"দূর পাগলি, আমি বিয়ে করে ঘরসংসার করলে আজ কী হতো? কার কাছে তাদের রেখে যেতাম? তোর কাছে রেখে যেতে পারতাম, কিন্তু সে যে বড়ো ভার মীরু, সে যে বড় ভার।"

দুইবোনে এইবারে একইসঙ্গে পরস্পরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকি, এ আজকের কান্না নয়, অনেক অনেকদিন আগে যে কান্না কাঁদা হয়নি, তীব্র তাপে যে কান্না শুকিয়ে গেছিলো,তা আজকে এই গোধূলিবেলায় ফিরে এসেছে। হাতধরাধরি করে আমরা ফিরে যেতে চাই সেই জলজ অন্ধকারে, সেই প্রতারণাহীন বিশ্বাসের জগতে,সেখানে আঘাত নেই অশান্তি নেই পীড়ন নেই-শুধুই চরাচরব্যাপী দুলতে থাকা জলরাশির মতন অবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা সেখানে।

৪ কথামালামেঘ

প্রিয় মীরু,

অনেক চিঠি পেয়েছি তোর কাছ থেকে, লম্বা লম্বা চিঠি, খুব সুন্দর স্নিগ্ধ চিঠি, কিন্তু আমার দিক থেকে সেভাবে বড়ো চিঠি লেখা হয় নি কেন জানি। এক দুলাইনের দায়সারা উত্তর বা তিনলাইনের শুভেচ্ছাবার্তা বা কার্ড বা ফোনকল করে সেরে ফেলেছি। আজকে ভাবছি এত এত বছর ধরে কেন একবারো দীর্ঘ চিঠি লেখার ইচ্ছে হলো না। প্রথমেই মনে পড়ছে সময়ের অভাব, কিন্তু তলিয়ে ভেবে দেখছি সেটা সত্য নয়। সময় ছিলো,সময় করে নিলেই সময় হতো চিঠি লেখার। সপ্তাহান্তের হুল্লোড় বা পার্টির কোনো একটা দুটো বাদ দিয়ে দিলেই নিটোল অনেকগুলো ঘন্টা হাতে এসে যেতো, কিন্তু কেন জানি করা হয়ে ওঠেনি। ভাবতাম যা বলার ফোনেই তো বলে দিই, অসুবিধে তো কিছু নেই। কিন্তু চিঠির আকাশে যে কথামালামেঘ উড়ে যায়, ফোনের কঠিন আর সরু কৃপণ তারে কি তা দেখা দিতে পারে?

তুই এ চিঠি পেয়ে হাসবি,ভাববি কেজো মেয়ে শিখা এত কাব্যি করতেও পারে? আমিও হাসছি, এ চিঠি শিখার লেখা নয়, এ নীরার লেখা। নীরা মরে গিয়েছিলো বলে মনে করেছিলাম দেখি সে হতভাগী মরে নি পুরোপুরি।

মীরু, তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে,অনেকদিন ধরে, অনেক মাস ধরে, আস্তে আস্তে বয়ে যাবে সকাল দুপুর সন্ধ্যে-তোর ঘরকন্নার মধ্যে তোকে দেখবো-স্নানের পরে ভেজা চুলের রাশি পিঠে মেলে তুই ছাদে চুল শুকাতে শুকাতে আমলকী মুখশুদ্ধি মুখে দিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করবি...

এত বছর বেশ অনেকবারই তো তোকে দেখেছি, কিন্তু তখন শুধু গেছি আর এসেছি, দৌড়ের মধ্যে তেমন শান্তিতে কি দেখা করা হয়? সেও ফোনে কার্ডে যোগাযোগের দায় মিটিয়ে ফেলার মতন ব্যাপার। ও নামেমাত্র দেখা। ওরকম না, অফুরাণ ছুটির মধ্যে অনেকদিন ধরে তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

জানি এ অন্যায় আবদার। আমার ছুটির খবর এসে গেছে বলে তো সকলের ছুটি হয় নি! সংসারের হাজারো কর্তব্য আছে তাদের, অনেক দায়দায়িত্ব আছে, অনেক কাজ করার আছে তাদের-এর মধ্যে উটকো ঝামেলার মতন আমার এই আবদার হয়তো তোর ভালো নাও লাগতে পারে। তবু তোকে জানি বলেই এ চিঠি লিখছি ভরসা করে, তোর কাছে প্রার্থনা জানাই,কয়েক সপ্তাহের জন্য যদি থাকতে চাই তোদের কাছে, তোদের কি খুব অসুবিধে হবে? যদি অসুবিধে হয়, নিঃসঙ্কোচে জানাস, আমি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেবো।

এখানে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার সৌজন্যে আমার অবস্থা এমনিতে ভালোই। শেষ কটা মাস অসুবিধে কিছু হবে না। তারপরের ব্যবস্থাও ভালোভাবেই করা আছে। সেই ব্যাপারে তোদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। শুধু মাঝে মাঝেই কেন জানি মনে হয় কিযেন আমার একটা করার ছিলো, কি যেন অসম্পুর্ণ রয়ে গেলো, কার সঙ্গে যেন দেখা করার কথা ছিলো...

এইসব ভাবনা স্বপ্নের মধ্যে দেখা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিতো।মাঝে মাঝে মনে হতো কে যেন আমায় ডাকছে! এখানের মনোবিদ আমায় অনেকভাবে পরীক্ষা করে বললেন আমার দেশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে হয়তো কিছুকাল কাটাতে ইচ্ছে করছে। তারপরেই ভালো করে ভেবে দেখলাম। এ চিঠি লেখার আগেও অনেক ভেবেছি। তারপরে লিখেই ফেললাম।

মীরু, তুই তো জানিস, গোড়া থেকেই আমি একটু স্বার্থপর ধরনের। একটু বেহায়াও। দেখেছিস, এখনো তাই আছি, কেমন এতকাল কিছু না, এখন দরকার হতেই কেমন এক সাতপাতা চিঠি ফেঁদে বসেছি। হী হী হী। দ্যাখ কী কান্ড, তুই কেমন আছিস সেটাই জিজ্ঞেস করিনি। আমি জানি ভালো আছিস, তুই সবসময়ে সবাইকে বলতিস ভালো আছিস। নিজের দুঃখবিষদ তুই কখনো কারুর সঙ্গে ভাগ করিস নি, এমনকি আমার সঙ্গেও নয়...

আমি চিঠি পাঠিয়েছিলাম নিদাগ, এখন চোখের জলের দাগে অনেক শব্দ মুছে গেছে চিঠির থেকে, আমি আসার কদিন পরে মীরা আমাকে ঐ চিঠি দেখিয়ে কান্নায় বিবশা হয়ে বলছিলো এরকম চিঠি কিকরে বোনকে লিখতে পারলাম, কিকরে নিজের উপরে মানুষে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? এতটাই যে এ যে কাছের জনকেও আঘাত করবে সেটুকুও বুঝতে পারে না?

ঐ চিঠি পাওয়ার পরে ফোনে মীরার গলা কান্নায় ডুবে গেছিলো, প্রথমে আমি বুঝতেই পারছিলাম না ও কী বলছে, পরে একটু সুস্থির হয়ে ও বলছিলো, "এক্ষুনি আয় নীরু এক্ষুনি আয়। তোকে আর যেতে দেবো না আর যেতে দেবো না...." তারপরে আরো অনেক কথা, যার অর্থোদ্ধার করতে পারিনি।

স্মৃতির জলধারা বয়ে যায়, পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যারক্তরাগ জেগে উঠেছে, মেঘগুলো এত রঙীন, এত রঙীন! মনে পড়ে সেইসব বিকেলসন্ধ্যেগুলোর কথা যখন আমি আর সোমা, তখন আমাদের সাত কি আট বছর, দিগন্তবিস্তৃত মাঠের উপর দিয়ে পশ্চিমের ডুবন্ত সূর্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছি আমরা দুটি বালিকা, কল্পনায় আমরা তখন সূর্যাভিযাত্রী। কোথায় চলে গেছে সোমা আজ,সাধের সংসারসন্তান সব পিছনে ফেলে...

ঐ নীল আকাশের গভীর থেকে ডাক আসলে কি সবই তুচ্ছ করা যায়?

মীরা নীচে নেমে গেছে, এখন সে জলখাবার তৈরী করবে, তাপস ফিরতে ফিরতে রাত আট কি সাড়ে আট হয়ে যায়। তাপস এসে অলখাবার খেতে খেতে টিভি দেখে মীরার সঙ্গে। ওদের রাতের ডিনার এগারোটায় কি সাড়ে এগারোটায়। বহুকালের অভ্যাসে আমি অত রাতে খেতে পারিনা, আটটার আগেই দুধ খই খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙে যায় শেষরাত্রে, তখন ছাদে উঠে এসে তারাদের দিকে চোখ মেলে বসে থাকি।

এখনও তারা ফুটে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছি ছাদেই,শুনতে পাচ্ছি সোমার গান, স্মৃতি থেকে উঠে আসছে,"নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে/আঁধার কেশভার দিয়েছে বিছায়ে..."- আমি কোনোদিন গান গাইতে পারতাম না,গানের ইস্কুলেও কখনো যাই নি, সোমা বড়ো হয়ে যখন খুব সুন্দর গাইতে পারতো, তখন তারা ফুটতে থাকা সন্ধ্যায় এই ছাদেই সে আমায় গেয়ে শোনাতো,"আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ/তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান...",

সেই গান শেষ হয়ে গেলে আরেকটা শোনাতো, "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।"

উত্তর আকাশে ফুটে উঠতো সপ্তর্ষির অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন। এই তো, সেই চেনা সপ্তর্ষি আজও তো ফুটে উঠছে, ধোঁয়াধুলোয় একটু ঝাপসা,কিন্তু সেই চিরচেনা সপ্তর্ষি। ঐ তো স্বাতী জ্বলজ্বল করছে, ঐ তো চিত্রা। সোমাকে তারা চেনাতাম আমি আর ও গান শোনাতো আরো। সে কি অনেকদিন নাকি অল্পদিন? সুন্দর সময়গুলো এত তাড়াতাড়ি চলে যায় কেন? বিরহ এত দীর্ঘ আর মিলন এত ক্ষণিকের কেন?

বিদ্যুৎপর্ণাকে দিয়ে যেতে চাই আমার সমস্ত সঞ্চয়, কিন্তু বিদ্যুৎ এখনও নাবালিকা। মীরাকে দিয়ে গেলে সে পরে মেয়েকে দিতে পারে অবশ্য, কোনো অসুবিধা নেই। তাপসও খুব ভালো ছেলে, মীরা অবশ্যই খুব ভালোমানুষকে পাবারই যোগ্য। এমন টলটলে জলের মতন হৃদয় আর কটা মেয়ের আছে?

তাপসের বাবামা ওর ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন, মামার বাড়ীতে অবহেলায় মানুষ হয়েছে,নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে নানা ছুটকোছাটকা অস্থায়ী কাজ করছিলো, আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো ভালো কিছু একটা করার, ছোটো একটা ব্যবসা বা একটা কোনো স্থায়ী চাকরি...

সেই সময়েই কুরিয়ার সার্ভিসের অস্থায়ী কাজ করার সময় অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয় আমাদের পরিবারের সঙ্গে। তারপরেই আস্তে আস্তে যোগাযোগ গাঢ় হয়, বাবামা ওকে সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে একটা দোকান করে দেবে বলে আর বাড়ীটাও দিয়ে দেবে বলে, মীরার সঙ্গে বিয়ে হবার আর বাবামাকেও দেখাশোনা করার শর্তে। আত্মীয়স্বজনেরা ও বন্ধুরা অনেকেই এইরকম হঠকারিতার বিরোধীতা করার চেষ্টা করেছিলো,বলেছিলো এইভাবে বিশ্বাস করার ফল ভালো নাও হতে পারে।

মীরার চিকিৎসার প্রয়োজন ও খরচও দিনদিন বাড়ছিলো,আমি যথাসাধ্য টাকা পাঠাতাম কিন্তু ওদের একজন সার্বক্ষণিক কাছে থাকা মানুষের প্রয়োজন ছিলো যে শক্ত কাঁধে আগলে ধরবে দুর্বল প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে ও তার প্রৌঢ় বাবামাকে। আত্মীয়স্বজনেরা কাছে দূরে অনেকেই ছিলো, কিন্তু কেউই সেরকমভাবে আগ্রহী ছিলো না সাহায্য করতে শুধু শুকনো উপদেশ দেওয়া ছাড়া। জানিনা, হয়তো কিছু ঈর্ষাও ছিলো। অথবা হয়তো আজকালকার দিনে আত্মীয়তার বন্ধন সর্বত্রই দুর্বল হয়ে গেছে, প্রায় সবাই হয়তো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে,পরের জন্য ভাবার, পাশে দাঁড়াবার ও সাহায্যের হাত বাড়াবার মানুষ হয়তো বিরল প্রজাতি হয়ে গেছে। কেজানে!

তাপস দায়িত্ব নিতে রাজী হলো, সমস্ত শর্ত ও পূরণ হলো। তারপরে বাবামা আরো সাত আট বছর ছিলেন, ওদের ঐকটা বছর খুব নিশ্চিন্ত শান্তিতে কেটেছে। তাপসের ছোটো ব্যাবসাটিও ভালো চলছিলো, আস্তে আস্তে উন্নতিও হচ্ছিলো। চিকিৎসায় মীরারও উন্নতি হচ্ছিলো, দুর্বলতা কমছিলো, ক্লান্তি কমছিলো, উৎসাহ বাড়ছিলো। সেইসব বছরে যে তিন-চারবার বেড়াতে এসেছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য, দেখে ভালো লাগতো সুখী ওদের। শুধু মীরাতাপসের ঘর আলো করে একটি সন্তানের আগমণের জন্য অপেক্ষা ছিলো ওদের। সাত বছর কেটে গেলো। বাবামা চোখ বুজলো একবছর এদিক ওদিক। বিয়ের দশ বছর পরে জন্মায় বিদ্যুৎপর্ণা। ওদের আলোর রাজকন্যা।

বিদ্যুৎপর্ণার জন্য সঞ্চয় দিয়ে যাবার কথা মীরাকে বলাই সবচেয়ে কঠিন, সে শুনলে কি করবে কেজানে! সামান্য চিঠিতেই যে ওভাবে কেঁদেকেটে...

কিন্তু কাউকে দিতেও তো হবে, যে ভবিষ্যতে আশার স্বপন ফলাতে পারবে সোনার ফলে, নইলে সব অর্থই তো অর্থহীন।

শেষরাত্রির অদ্ভুত আঁধারে তারাগুলো পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েছে, সন্ধ্যায় ওদের পুবের আকাশে ফুটে উঠতে দেখেছি। চন্দ্রাস্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন শুক্লপক্ষের শুরুর দিক। শেষরাত্রির বাতাসে কেঁপে উঠি, সঙ্গে আনা হাল্কা চাদরটা জড়িয়ে নিই। ঐ পশ্চিমদিগন্তের কুহেলিতে টুপ করে ডুবে গেলো একটা তারা, ওর আলোর ঝলকে মনে পড়ে গেলো হারানো একটা কথা। পুবের দিকে তাকালাম, হাল্কা একটা আলোর আভাস ফুটে উঠেছে, সকাল হতে আর দেরি নেই। সামনের যা কিছু পথ এখনো বাকী, সে পথে কিভাবে চলবো,হঠাৎ দেখতে পেয়েছি যেন।

৫ সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজা

এখানে সাদা বালি ভোরের সোনালী আলোয় সোনার বরণ লাগে, রঙীন ছাতার নীচে এলানো চেয়ারে বসে থাকি, হাতে পাতলা সাদা কাগজের ডাইরি, হাল্কা একটা ডটপেন দিয়ে লিখে যাই সাদা পাতায়। মীরার এই শর্ত। প্রত্যেকদিন লিখতে হবে ওকে। যা খুশী। আমি শর্ত মেনে প্রত্যেকদিন লিখে পাঠাই মীরাকে।

সকাল থেকে লিখি,দুপুরে ফিরে যাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার জন্য নির্ধারিত ঘরে, স্নানখাওয়া করে আবার আসি বিকেলে। আসার আগে লেখা পোস্ট করে দিই। এখানে এসব ব্যবস্থা খুব চমৎকার রকম সুবিধাজনক। বিকেলেও লিখি যতক্ষণ না আলো একেবারে কমে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত। গ্রীষ্মের সন্ধ্যাগুলো খুব দীর্ঘ, রাত সাড়ে আটটা/নটা পর্যন্ত আলো থাকে।

ক্রিসও ঘটনাচক্রে এখানে,সে বিকালে আসে সমুদ্রতীরে। সে আমার পুরানো জীবনের খুব ভালো বন্ধু। এখন সেও এখানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছে। মাস দুই পরে সে ফিরে যাবে ওর কর্মস্থানে। ক্রিসের পুরো নাম ক্রিস্টোফার। কিন্তু ওকে কোনোদিন কেউ ক্রিস্টোফার ডাকে নি, সবাইকে নিজের পরিচয় দিতে ও সবসময় বলে হ্যালো,আমি ক্রিস। প্রথম প্রথম আমার অবাক লাগতো। তারপরে দেখি অনেকেই ছোট্টো নামে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করে। আমার নামটাই এত ছোটো যে আর ছোটো করতে হতো না। ক্রিস জানে না আমার ছুটির নোটিশ আসার কথা, আমিও তো জানতাম না ওর ছুটির কথাও...

আমার এই পুরানো স্টাইলে লেখা দেখে ক্রিস হাসে, বলে আজকাল কেউ আবার এভাবে চিঠি লেখে নাকি, প্রায় সবাই তো ইমেল করে, কত তাড়াতাড়ি হয়। ওকে কিভাবে বোঝাই সেই চিঠির আকাশে ভেসে যাওয়া কথামালামেঘের কথা? নিজেই ভালো বুঝি না আর ওকে বোঝাবো!

মাত্র এই মাসটাই হয়তো বাইরে আসার অনুমতি পাবো, পরের মাসে হয়তো আসার মতন অবস্থাই থাকবে না। তাই প্রত্যেকটা দিনকে নিংড়ে নিতে চাই সমস্ত সূর্যালোক, নীল আকাশ, ভেসে যাওয়া মেঘমালা,সমুদ্রচিল, নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের উপরে ঐ যে বিন্দুর মতন জেলেডিঙি দেখা যায়-সব সমেত। বহুদিন পরে মনে হচ্ছে আহা জীবন জীবন জীবন কী মধুর! আহা বেঁচে থাকা কত সুন্দর!

এরকম আগে কখনো মনে হয়নি,মনে হতো কষ্টের ভারী বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জীবননামক এই মরুর মধ্য দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুট, কী ক্রীতদাসত্ব! কোন্‌ মন্ত্রবলে মরু উধাও,কোন্‌ মন্ত্রবলে বোঝা উধাও-এখন সবুজ উদ্যানে পাখির গান, জলের শব্দ,স্বপ্নের মতন জলতরঙ্গ বাজনা ভেসে আসে কোন্‌ অলক্ষ্য বাতায়ন থেকে। কী অসম্ভবের সম্ভাবনা অপেক্ষা করে ছিলো এই বাঁকে, তার বিন্দুমাত্র আভাস আগে ছিলোনা আমার কাছে!

ছোটোবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম "দিগন্তপ্রিয়"। এক পাখির গল্প। সে পাখি থাকে উত্তর মেরুতে, এক আর্কটিক টার্ন। সেই ছোট্টো পাখি প্রতি বছর শীতের সময় উড়ে যায় সোজা দক্ষিণ মেরুতে। আবার উত্তরে যখন গ্রীষ্ম আসে তখন তারা উড়তে উড়তে ফিরে আসে উত্তর মেরুঘেঁষা ওদের ঘর-গেরস্থালীতে। এই গোষ্ঠীর একটি ছোট্টো পাখিকে নিয়ে গল্প ফেঁদেছিলেন লেখক। সে পাখি বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে যখন উড়ে আসছিল তার বাবামায়ের সঙ্গে, তখন একটি দুর্ঘটনায় সে আটকে পড়ে বিদ্যুতবাহী তারের মধ্যে,কিন্তু শুধু পা আটকে গেছিলো আর অন্য তারটা ছোঁয় নি বলে সে মরে নি। সেখন থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়, প্রধানত জিম বলে একটি ছেলের উদ্যোগে। তারপর আহত পক্ষীশাবকের যথাসাধ্য সেবাশুশ্রুষা করে জিম আর ওর মা মিলে। সুস্থ হয়ে উঠলে পাখিটিকে ছেড়ে দেয় তারা, জিম পাখিটার নাম দিয়েছিল দিগন্তপ্রিয়। ছেড়ে দেবার আগে দিগন্তপ্রিয়ের পায়ে পরিয়ে দেয় চিহ্নিত আংটি। যাতে ফিরে আসার পথে যদি আবার সে আসে তবে সেই আংটি খুলে স্মারক হিসেবে রেখে দিতে পারবে। কী সুন্দর লেগেছিল যে নামটা! দিগন্তপ্রিয়! মেরু থেকে মেরুতে অবিশ্রাম উড়ে চলার কল্পনা মনকে যে কী এক আশ্চর্য দোলায় দুলিয়ে দিত!

তখন কি জানতাম যে আমাকেও অমনি করে চেনা অচেনা দেশে ঘুরে বেড়াতে হবে সারাজীবন? তারপরে আরো অনেক দূরের এক যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এক সমুদ্রের তীরে?

দূরে বালির উপরে একদম জলরেখার কাছটিতে একটি ছোট্টো মেয়ে খেলা করে বেড়ায়,রঙীন ফ্রক পরা মেয়ে,একমাথা ঝামর ঝামর কালো চুলে রঙীন ফিতে। ওকে এতদিন লক্ষ করিনি,হয়তো বেশ কিছুদিন ধরেই আসে। ঐ জলের কাছে বালিতে ছোটো ছোটো পা ফেলে দৌড়ে বেড়ানো ছোট্টো মেয়েটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় অন্য কারুর কথা,কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না আসলে কার কথা সেটা।

ডায়েরির পাতায় কলম চলতে থাকে, আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে থাকে হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন,রাত, সকাল, সন্ধ্যা-হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা আর তাদের চলে যাওয়া শৈশব কৈশোর। সেই অনেক অনেক আগের এক বিষন্ন হেমন্ত সন্ধ্যায় যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিলো মৃত্যুঘুমে সে জেগে উঠতে থাকে, আস্তে আস্তে নরম ভীরু ভীরু পা ফেলে সে আসতে থাকে বালি পার হয়ে,বাতাস তার খোলা চুল ওড়ায়,ওড়ায়-ওড়ায় তার নীল চুড়িদারের প্রান্ত,সাদা ওড়না...

মীরা শেষপর্যন্ত রাজী হয়েছিলো নিতে,ওদের ওখান থেকে ফিরেই সেই সব ব্যবস্থা করে তারপরে এখানে এসেছি। সেই ধূসর হয়ে যাওয়া লেখাগুলো যত্ন করে ফাইলে মুড়ে আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলো মীরা আর কড়ার করিয়ে নিয়েছিলো প্রতিদিন যেন ওকে লিখি।

এই পেনগুলো চমৎকার,আলতো ছোঁয়াতেই সুন্দর লেখা হয়। কতকাল পরে আবার এইভাবে কাগজকলমে লেখা, ভাবতেই কেমন শিরশির করে। ভেবেছিলাম সব ভুলে গেছি,কিন্তু দেখি মনের তলার স্তরে সবই সঞ্চিত হয়ে ছিলো,আস্তে আস্তে জল সরিয়ে ডলফিনের উঠে আসার মতন সব উঠে আসছে।

ঐ তো লাবণিকে দেখতে পাচ্ছি-লাবণি বসে আছে তেতলার বারান্দায়। তিনতলায় একটাই ঘর আর সামনে বারান্দা, বাকীটা ছাদ। এই ঘর লাবণির পড়ার ঘর, শোয়ার ঘর, বসে বসে ভাবার ঘর--সব। ছাদের চারপাশ ঘিরে গাছেদের মাথা শুধু, আর উপরে বিরাট একটা আকাশ। চেনা কবিতার লাইন একটু বদলে ও বলতো "অনন্ত এ আকাশের কোলে/টলটল নীলের মাঝার/ এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর/তোর তরে তারা রে আমার।"

লাবণি তারাদের চিনতো, সে সারারাত তারা দেখতো। একদিন ঐ ঘর থেকেই লাবণি তারাদের দেশে চলে গেল...

লিখতে লিখতে ডুবে গেছিলাম, পায়ে কি যেন লাগলো-একটা বল গড়িয়ে এসেছে পায়ের কাছে,লাল বলটা। ডাইরি রেখে উঠে দাঁড়াই, বলটা তুলে নিই, কার বল এটা? ওমা, এতো সেই ঝামরঝামর চুল ফ্রকপরা মেয়ে, দৌড়ে আসছে-ওর বল নাকি? হেসে ছুঁড়ে দিই, লুফে নিলো মেয়েটা, বাহ, দারুণ তো! সে থ্যাংস দেয়, আমি ওকে কাছে ডাকি, জিজ্ঞাসা করি, কী নাম তোমার? সে বলে রিটা। আমার মনে হয় বলছে রীতা। ওর সঙ্গে আরো একটু গল্প হয়, ও থ্রীতে পড়ে, এখানে মায়ের সঙ্গে এসেছে, ওর মা ঐ কটেজে আছে, একটু পরেই ওকে নিতে আসবে।

ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো সেদিনই, অবাক হলাম। রিটার মা মানসী, সে আমার দেশের মেয়ে,আমাদের নিজের ভাষাও এক। আর তেমন লেখা হলো না, মানসীর সঙ্গে গল্প হলো। রিটার বাবা ডেভ আসেনি, সে নিজের শহরে ব্যস্ত। মানসী স্কুলে পড়ায়, এখন সামার ভ্যাকেশান চলছে, মেয়েকে নিয়ে একাই এসেছে মানসী,ডেভ ডিভোর্স চাইছে, রিটাকে মানসীই রাখতে পারবে কাছে-কত কথা কত কথাই জানা হয়ে যায়।

মানসী কথা কইতে ভালোবাসে, নিজের ভাষার তো কাউকে পায় না! রিটার ছুটির নোটিশের খবর কিন্তু পাইনি, পেয়েছিলাম আরো বেশ কয়েকদিন পরে...

সবাই সাগরবেলায় বসে আছি, কবে নৌকা আসবে! কারুর নৌকা এই এলো বলে, কারুর অনেক বাকী...

ঢেউ আসে, ঢেউ যায়, বালিতে বুনে যায় আশ্চর্য প্যাটার্ণ। ফেলে যায় শতশত আধমরা মাছ। এক পাগল ওদের তুলে তুলে ছুঁড়ে দেয় দূরের জলে। অবিরাম।

ঢেউ সরে যাওয়া বালিতে পড়ে থাকে শত শত ঝিনুকের খোলা। ছোট্টো রিটা ছুটে ছুটে সেইগুলো কুড়ায়...আমার পাশে বসে থাকে মানসী... আমি লিখে চলি,লিখে চলি...অনন্ত বালুকণার গল্প,ছোট্টো ছোট্টো বালির কণা,জ্যান্ত ঝিনুকের ফাঁক করা খোলার মধ্যে ঢুকে গেছিলো যারা, নরম ঝিনুকের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নিটোল নীল মুক্তো হতে চেয়েছিলো যারা...

Saturday, May 17, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প (১৯)

ছোট্টোবেলার বন্ধুত্বের স্মৃতি ভারী মধুর। দুনিয়ার নানা জটিলতা তখনও জানা থাকে না বলে প্রথম বন্ধুত্বগুলো একেবারে অমলীন, শরতের শিশিরবিন্দুর মতন টলটলে, নির্মল। ঠিক যেন সবুজ পাতার উপরে মুক্তোবিন্দুর মতন জমে আছে, নতুন ওঠা সূর্য ঝলমল করছে তার ছোট্টো দেহে।

ছোটোবেলার বন্ধুবিদায়ের স্মৃতিও ভারী করুণ। অনেকে ভাবেন ছোটোরা বুঝি ভালোবাসা ব্যাপারটা সেভাবে বোঝে না, আরেকটু বড়ো হয়ে কৈশোরে পৌঁছে তবে বুঝতে পারে। কিন্তু তা নয়। অদ্ভুত অসহায় ভালোবাসায় ভরা থাকে ছোটোদের মন, তাই বন্ধুজনকে হারানোর বেদনা ছোটোরা যেমন করে বোঝে, তেমন আর কেউ বোঝে না। বড় হয়ে উঠলে ডাইনে বামে নানা ফ্যাক্টর জানা হয়ে যায়, তখনকার বন্ধুত্বে নানারকম টানাপড়েন, ব্যক্তিস্বার্থ ইত্যাদি এসে পড়ে অনিবার্যভাবে, কিন্তু একদম শিশুবেলার ভালোবাসা একেবারে বিশুদ্ধ।

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের স্মৃতি মনে করতে করতে মনে পড়ছে দুটো নাম-রাজদীপ আর মধুছন্দা। এই দুই বন্ধু কেজি -টুতে উঠেই বিদায় নিয়ে চলে গেল, ওদের বাবারা চাকরিতে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন কিনা, তাই ওদেরও চলে যেতে হলো।

আজকে স্মৃতির সমুদ্রের শত শত হাত জলের তলে ডুবে দেখি সেই শিশুবেলার মুখ দুটো, টুলটুলে সুন্দর দুটো মুখ, মধুছন্দা আর রাজদীপ। সেই যে কেজি-টু থেকে ওরা চলে যাচ্ছে, সেইটাই শেষ দেখা, আর দেখা হয় নি। কেজানে এখন কোথায় ওরা। এখন দেখলে আর হয়তো চিনতে পারবো না, সেদিনের শিশুরা আজ পূর্ণবয়স্ক মানুষ, কতই হয়তো বদলে গিয়েছে তাদের মুখ, চোখ, কপাল, চিবুক, মুখের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারিকুরি যা দেখে মানুষকে আলাদা আলাদা করে চেনা যায়, সেই সবকিছু । কিন্তু তবু কি কোথাও সেই অমলীন শিশুমুখের কিছুই নেই? সেই বিস্ময়ভরা শিশুচোখের কিছু? নিশ্চয় কিছু আছে, সব মানুষের মধ্যেই তো শৈশবের সেই "আমি" টা লুকিয়ে থাকে বিশুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে।

কেজি ওয়ানের সময়ের মধুছন্দাকে মনে পড়ে, ওর নামটা জানার পর আমাদের কেমন অবাক-খুশি, ওরকম নাম আগে তো শুনিনি! তারপরে আরেকদিনের কথা মনে পড়ে, দীপাঞ্জন হাসতে হাসতে জয়াকে বলছে, মধু খাবি? জয়া বলছে হ্যাঁ। দীপাঞ্জন বলছে, ছন্দা খাবি? জয়া একটু থমকে ভাবছে ছন্দা খাওয়া যায় কিনা। তারপরে হয়তো ভাবলো ওটা চপ বা বেগুনীর মতন কিছু, মাথা হেলিয়ে বললো হ্যাঁ। দীপাঞ্জন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে বললো তাহলে তো মধুছন্দাকেই খেয়ে নিবি!

সেই মুহূর্তে মধুছন্দা এসে হাজির ওদের সামনে, বললো, কী বলছিস রে তোরা?

আহ, টুকরো একটা মিষ্টি ছবির মতন ফিরে এলো ঘটনাটা। কেজানে মধুছন্দার মনে আছে কিনা, অথবা জয়া বা দীপাঞ্জনের মনে আছে কিনা। ওদেরও তো ক্লাস ফোরের পরে আর দেখিনি, ওরা আমি যে হাইস্কুলে গিয়েছিলাম সেখানে তো পড়েনি! অন্য স্কুলে পড়তো।

আর রাজদীপকেও মনে পড়ছে, গোটা গোটা মুক্তোর মতন হাতের লেখা ছিল রাজদীপের। অসাধারণ সুন্দর সেই হাতের লেখা। কেজি টুয়ের দিদিমণি একেবারে মুগ্ধ ছিলেন ঐ সুন্দর হাতের লেখা দেখে। ও যখন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে তখন দিদিমণি আরেক সহকর্মীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন, আহা আমাদের ভালো হাতের লেখার ছাত্রই চলে যাচ্ছে।

এই যে ছোট্টোবেলার শেষ দেখাগুলো, মনের অনেক অনেক পরতের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল, আজ ইস্কুলবেলার কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ছে সব, মনে হচ্ছে যেন গতকালের কথা। অথচ এতদিন নিজেরই কোনো ধারণা ছিল না এইসব স্মৃতি যে আছে সেই সম্পর্কে। ঠিক যেন সেই গানের মতন, "ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি/ মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিও আনি।" হয়তো ছোটোবেলার সেই বিদায় নিয়ে দূরে চলে যাওয়া বন্ধুরা কোনোদিন ফিরে আসবে উজ্জ্বল হাসিমুখে, খুশিভরা চোখে কোনো মিলনের উৎসবের আলোকোজ্জ্বল লগ্নে।

এক বন্ধু কিন্তু ফিরে এসেছিল স্কুলজীবনেই। চন্দ্রিমা। ক্লাস ওয়ানে বিদায় নিয়ে সে চলে গিয়েছিল অনেক দূরের কোনো রাজ্যে, সেখানে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা। সেইখানে নাকি ভারী সুন্দর এক জলপ্রপাত ছিল, মার্বেল পাথরের উপরে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে জলধারা, ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ চূর্ণ জলকণা ধোঁয়ার মতন উপরে উঠে আসে। সেই বিখ্যাত জলপ্রপাতের কথা পরে আমরা ভূগোলে পড়েছি।

ক্লাস সিক্সে ফিরে এসে চন্দ্রিমা ভর্তি হয়েছিল আমাদেরই হাইস্কুলে, আমাদেরই সেকশনে। খুব অবাক-খুশি হয়েছিলাম আমরা, পুরনো প্রাইমারি স্কুলের অনেকেই তখন আমরা ঐ হাইস্কুলে পড়তাম। চন্দ্রিমার ফিরে আসা খুব আনন্দের ছিল আমাদের কাছে, অপ্রত্যাশিত খুশির। দুই ক্লাসের মাঝের অবসরে অথবা টিফিনের ছুটিতে আমরা প্রায়ই ওর কাছে সেই দূর রাজ্যের গল্প শুনতাম, সেখানের স্কুল কেমন ছিল, মানুষজন কেমন ছিল, মাঠঘাটরাস্তাবনজঙ্গল কেমন ছিল-সেসব শুনতাম খুব আগ্রহ নিয়ে। যেন এক রূপকথার রাজ্য থেকে অভিযান সেরে ফিরেছে আমাদের বন্ধু।

(চলবে)

Thursday, May 8, 2014

কথামালা

কিছু কথা আগুনের কাছে বলি। ওরা কিছু বা নিঃশেষে পুড়ে যায়, কিছু বা মিশে যায় লকলকে শিখায়, কিছু বা ধোঁয়া হয়ে যায়। ওদের আর দেখতে পাই না।

কিছু কথা নদীর কাছে বলি, নদীর পাশে ঝুঁকে পড়া অশ্বত্থের মূলে চুপ করে বসে বসে বলি নদীকে। স্রোতের টানে ফেনিয়ে ফেনিয়ে ওঠে নদী, কলকল কুলকুল করে নিজেও কত কথা বলে। আমার বলা কথা ঘূর্ণীতে ঘোরাতে ঘোরাতে কেজানে কোথায় নিয়ে যায়, হয়তো বা দূরের সমুদ্রে, যে সমুদ্র নাকি নীল।

কিছু কথা বাতাসকে বলি। গ্রীষ্মের বিকেলের মধুর দক্ষিণা হাওয়াকে, অথবা হেমন্ত গোধূলির শিরশিরে বিষন্ন হাওয়াকে অথবা বর্ষার বৃষ্টিমগ্ন দুপুরের মৌসুমী হাওয়াকে। সেইসব কথাও উড়ে চলে যায়, কেজানে কোন্‌ দূর শহরে বন্দরে পথেঘাটে অথবা অজানা উপত্যকায়।

কিছু কথা মাটিকে বলি। মাটি খুঁড়ে সমাধি দিই তাদের। সর্বংসহা মৃত্তিকা নিশ্চুপে গ্রহণ করে সব। হয়তো একদিন কোনো কথাবীজ থেকে বার হয়ে আসবে কোমল সবুজ একটি ভীরু অঙ্কুর, যুগলপত্র মেলে দেবে আকাশে, উজ্জ্বল রোদ্দুরের আশীর্বাদে হয়তো ফনফনিয়ে উঠবে। কেজানে!

কিছু কথা কারুকে বলা হয় না

বুকের ভিতর-কুঠুরিতে যেখানে গহীণ অন্ধকার-

সেখানে ওরা বন্দী হয়ে আছে।

মাঝে মাঝে ওদের অস্থির

ডানার ঝাপটানি শুনি।



একদিন চৈত্রশেষের রাতে

আকাশ যখন তারায় তারায় ঝমঝম করছে-

তখন শাণিত একটি ফলা দিয়ে

খুলে দেবো ঐ অন্ধকার কুঠুরির দরজা।

ঢেউতোলা লোহিত সমুদ্র পিছনে ফেলে

ওরা উড়ে চলে যাবে তারাভরা আকাশে-

আর ফিরবে না।

Monday, May 5, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১৮)

এমনিতে ঘুমের ক্লাসে মোটেই ঘুমাতাম না, একদিন কীজানি কী হলো ঘুমের ক্লাসে খুব ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের আগে শেষ যেটা মনে আছে, চিত্রালী আর আমি পাশাপাশি শুয়ে ফিসফিস করে গাইছিলাম, "আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই/ ঠাকমা গেল গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।" বারে বারে ঘুরিয়েফিরিয়ে এই লাইন দুটো গাইছিলাম আর ফিরফির করে হাসছিলাম। তারপরে আর কিছু মনে নেই।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি নিধিরামদা(আমাদের নার্শারী বিভাগের স্কুল কর্মচারী) ডাকছে, "এই ওঠ, ওঠ। ছুটি হয়ে গেছে।" উঠে দেখি আরে হ্যাঁ, তাই তো। ঘর প্রায় ফাঁকা, একদুইজন ছাড়া সবাই চলে গেছে।

আমি তো ঘাবড়ে গেলাম, তাহলে কি বিশালদা আমাকে রেখেই অন্যদের নিয়ে রিকশা চালিয়ে চলে গেল? সেটা যে হতে পারে না, তা তো আর সেই ছোটোবেলা বুঝতাম না।

যাই হোক, চোখ টোখ ডলে ঘুম তাড়িয়ে সুটকেশ জলের বোতল নিয়ে বাইরে এলাম, জুতোর তাক থেকে জুতো নিয়ে পরে বারান্দা থেকে নেমে একেবারে খোলা রোদে আসতেই যেন চোখ জ্বলে গেল। রোদ এরকম তেতো লাগে নাকি দুপুরে ঘুমিয়ে উঠলে?

দেখি বাইরে বিশালদার রিক্শায় বাকী সবাই উঠে পড়েছে, খালি আমি বাকী। সবাই বেশ চটে আছে মনে হলো এত দেরি হয়েছে বলে। আমি তো উঠে পড়লাম, একপাশে গুঁজেমুজে বসেও পড়লাম। রিকশাও চলতে চলতে পরিচিত সব দৃশ্যের পাশ দিয়ে বাড়ীর দিকে চললো।

গন্তব্যে পৌঁছে নেমে পড়ে আরেক কেলো করলাম। দিব্যি জলের বোতল নিয়ে বাড়ী চলে গেলাম, সুটকেস রয়ে গেল বিশালদার রিকশাতেই। ঘুমিয়ে পড়ার ফলেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, কোনোকিছুই ঠিকঠাক খেয়াল ছিল না। সুটকেস ফেলে যাবার ব্যাপারটা ধরা পড়লো যখন হাতমুখ ধুয়ে স্কুলের পোশাক বদলে খেতে বসেছি তখন।

আরে সর্বনাশ! পরের দিন আবার কীসের যেন ছুটি! এদিকে সুটকেসে বইপত্র তো আছেই, স্কুল ডাইরিটাও যে আছে! সেটা খোয়া গেলে কেলেংকারী। তারপরে খানিক কান্নাকাটির পর রফা হলো বিশালদার বাড়ীতে যাবো আমি আর ঠাকুমা।

আমাদের পাড়া থেকে একটা বড়ো মাঠ আর তারপরে একটা ছোট্টো খোলা সব্জিবাজার পার হলেই নাকি বিশালদাদের পাড়া, কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাড়ী দেখিয়ে দেবে। ঠাকুমা কোমরের ব্যথার জন্য হাঁটতে পারবে না তো বেশী, সব্জিবাজারের এই পারে ঠাকুমা দাঁড়াবে, আমি দৌড়ে গিয়ে সুটকেস উদ্ধার করে আনবো-এই রকম ঠিক হলো।

এরপরে শুরু হলো আমার জীবনের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার। সেই বিকেলে এক কচি আর এক বৃদ্ধা মিলে হাঁটতে হাঁটতে চললাম মাঠ পেরিয়ে। সব্জিবাজারের কাছে চলে এলাম। তখন সব্জিবাজার ফাঁকা, চালাগুলো খালি পড়ে আছে, বাজার বসে সকালে, দুপুর অবধি চলে, তারপরে সবাই পশরা গুটিয়ে চলে যায়। তো, সেখানে এসে আমরা একটু দাঁড়ালাম। একজন লোক হেঁটে আসছিল পাশের রাস্তা দিয়ে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো বিশালদাদের বাড়ীর হদিশ। সে চিনতো। আমাদের দেখিয়ে দিল বাড়ীটা। ঐ যে মাটির রাস্তার ঐপাশে রাংচিতার বেড়ায় ঘেরা টালির চালের বাড়ীটা, ঐটা।

ঠাকুমার কোমরে ব্যথা তো, আর হাঁটতে পারছিল না। তাই ঠাকুমা দাঁড়ালো একটা দোকানের চালার ছায়ায় আর আমি এগিয়ে গেলাম বিশালদাদের পাড়ার দিকে।

রাংচিতা গাছের বেড়া বেশ উঁচু, প্রয় দেড়মানুষ প্রমাণ। সেই বেড়ায় বাঁশের কঞ্চির গেট, নারকোলের দড়ির ফাঁসে গেটের একটা দিক বেড়ায় আটকানো। আস্তে আস্তে সেটা খুলে ঠেলা দিতেই গেট খুলে গেল। আমি ঢুকে পড়ে একেবারে অবাক আর মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

মাটিলেপা একটা উঠোন, নারকেল গাছের ছায়া তাতে। সেই ছায়ায় পুরানো একটা মাদুর পেতে বসে বিশালদা এক বছরখানেক বয়সের ছোট্টো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চামচে করে সুজিদুধ খাওয়াচ্ছে। মনে হয় গরম দুধে সুজি ফুটিয়ে বানানো, কারণ বাটি থেকে চামচ দিয়ে তুলে ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে জুড়িয়ে বাচ্চাটার মুখে দিচ্ছে। আর বাচ্চাটার ঠোঁট মুখ গাল সুজিতে মাখামাখি কিন্তু ও খুব খুশি হয়ে হাত পা নাড়াতে নাড়াতে নানা খুশির আওয়াজ করছে।

আমি এত অবাক আর এত খুশি যে চুপ করে চেয়ে শুধু দেখছি আর দেখছি। আসলে আমার পাড়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যে অথবা এমনিতে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও দেখেছি একেবারে ছোটো বাচ্চাদের কোলে নিয়ে খাওয়ানো দাওয়ানো এসব মা কাকীমা জ্যেঠিমা ঠাকুমা দিদিমারা করেন, বাবাকাকাজ্যেঠাদাদুদের কখনোই দেখিনি করতে। তাই এত অবাক।

এদিকে বিশালদাও মুখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছে। আমি কেন ওখানে কীসের জন্যই বা? বিশালদার এতখানি বড়ো বড়ো হয়ে যাওয়া চোখেই মনে হয় ও প্রশ্ন লেখা ছিল।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, "আমার সুটকেসটা তোমার রিকশাতে ফেলে গেছি। ওটা নিতে এসেছি।"

"ও তাই নাকি? " বলে বাচ্চাটাকে কোল থেকে মাদুরে যেই না নামিয়েছে বিশালদা, অমনি সে চিৎকার করে কান্না। এখন ওকে কোলের থেকে নামানো চলবে না।

বিশালদা বিব্রতভাবে বলে, " ওর মা কাজে গেছে তো, আর এখন ওর খিদে পেয়ে গেছে। ঐ যে রিকশা ঐখানে, তোমার সুটকেস রিকশাতেই আছে যদি থাকে, আমি এসে ঐখানে রিকশা রেখেছি।"

উঠানের অন্য কিনারে রিকশাটা রাখা, সেখানে গিয়ে দেখি, হ্যাঁ, এই তো আমার সেই হারানিধি, কাঠের বেঞ্চির তলায়, এই তো উপরে পিন খুদে খুদে লেখা আমার নাম, যেমন বাবা করে দিয়েছিল। খুলে দেখলাম ভিতরে বইপত্তর ডাইরি সব যেমন যেমন থাকার সব আছে।

সুটকেসটা বার করে নিলাম, বিশালদার কাছ এসে দেখালাম এটা আমার সুটকেস, উপরে নাম লেখা, ভিতরে সব ঠিক আছে।

বিশালদা হাসলো, বললো, "তুমি কোথা থেকে এলে এখানে? আমার বাড়ী চিনলে কী করে? একাই এসেছ?"

আমি সব বললাম, তারপরে সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এলাম। গেটের কাছে এসে পিছন ফিরে দেখলাম বিশালদা যত্ন করে খাওয়াচ্ছে বাচ্চাকে।

পিতৃত্বের এই আশ্চর্য কোমল ছবিটি মনে রয়ে গেল। আজ স্মৃতির ভিতরে এইটি দেখলে মন অবাক সুখে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এক জীর্ণবসন দরিদ্র পিতা পরম যত্নে সন্তানকে কোলে নিয়ে সুজিদুধ খাওয়াচ্ছেন। বিপুল ধনীর রত্নখচিত খাবার টেবিলের অজস্র দামী খাদ্য পানীয় তুচ্ছ হয়ে মিলিয়ে যায়। বিদুরের খুদ কি ঐ দুধসুজির চেয়ে বেশী মহান ছিল?

আজ যখনই কোনো কষ্টের দুঃখের সংবাদ শুনি-অভাবের তাড়নায় পিতামাতা সন্তানকে অত্যাচার করেছে , ভালোবাসার মানুষকে মানুষ অত্যাচার করে মেরেছে-এইসব দুখঃকথার বিপরীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাচ্চা কোলে সেই রিকশাচালক বিশালদা,ঐখানে সে আর সামান্য মানুষ নয়, সে বিরাট বিশাল হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে আকাশ ভরে, বিশ্বপিতার সঙ্গে একাকার।

(চলবে)