Monday, March 31, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১২)

ক্লাস থ্রীতে শুরু হলো "হাতের কাজ" বলে একটা বিষয়ের ক্লাস। নানারকম কান্ড করতে হতো সেখানে, নারকেল দড়ি দিয়ে পাপোষ বানাতে হতো, রুমালে ফুল-লতা-পাতার সূচীকর্ম করতে হতো, রঙীন কাগজ বিশেষভাবে কুচি দিয়ে দিয়ে বাহারী মালা বানাতে হতো, মাটির আপেল কলা কমলালেবু আম--এইসব বানাতে হতো, সেগুলোর উপরে আবার রঙও লাগাতে হতো। কমলালেবুতে কমলা রঙ, সরলসোজা খানিকটা। কিন্তু সিঁদুরে আমে ঘন সবুজ আর বোঁটার কাছে লালের ছোঁয়া-এটা বেশ একটু জটিলরকম। আপেলে দিতে হতো কালচে লাল(তখন আমরা সবুজ আপেল বা হলুদ আপেলের নামও শুনি নি, দেখা তো দূরের কথা), পাকা কলায় হলুদ আর কাঁচকলায় সবুজ।

উলের কাজও করতে হতো, দুই কাঁটার সোজাসরল কাজ, ঘর তোলা আর উল্টো সোজা বুনতে পারলেই হতো, দুই ঘর সোজা দুই ঘর উল্টো এই প্যাটার্নে বুনে যেতে হতো, বেশ লম্বা হয়ে মাফলার হয়ে গেলেই ঘর মেরে দিতে হতো। এই মাফলারের দুই প্রান্তে ঝুলুর ঝুলুর উলের গুছি বেঁধে বেঁধে জিনিসটার মধ্যে একটা স্পেশাল এফেক্ট দেওয়া হতো।

এ ছাড়াও অন্যরকম কাজও করতে হতো, একবার মাটির ছোট্টো কুটির বানাতে হয়েছিলো, ঘরের চৌচালাটা পিচবোর্ড দিয়ে বানিয়ে ব্রাউন পেপার দিয়ে মুড়ে একটা বেশ খড়ের চালের এফেক্ট আনতে হয়েছিল। সেই কুটিরে ছিলো ছোট্টো দরজা আর ছোটো ছোটো দুই জানালা। দরজার ঠিক সামনে মাটিতে আল্পনা, সেটা করা হয়েছিলো সাদা কাগজ নকশা করে কেটে তারপরে আঠা দিয়ে মাটির উপরে জুড়ে। চালের উপরে সবুজ কাগজ দিয়ে বানানো হয়েছিলো লাউগাছ।

এই হাতের কাজের ক্লাস ছিলো একটা হুল্লোড়বিশেষ, দিদিমণি কেউ এই ক্লাসে বেশীরভাগ দিনই থাকতেন না, সবাই ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে উচ্চগ্রামে গল্প করতো। কে আর বসে বসে সেলাই করে কিংবা নারকোল দড়ি দিয়ে পাপোষ বানায় ক্লাসে? বিশেষ করে শিক্ষিকা যখন শেখাচ্ছেন না? আর, এসব সূক্ষ্ম জিনিস ক্লাসে বসে ঠিক হয়ও না, এগুলো তো বিরাট খোলা মেঝেতে বসে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে করতে হয়, তাই না? মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে বাঘের মতন হুংকার দিয়ে ঢুকে পড়তেন "হাতের কাজ" এর দিদিমণি, "এত গন্ডগোল কীসের? কই, দেখি কী হাতের কাজ করছো তোমরা?" বাঘের মতন গলায় জিজ্ঞেস করতেন। তখন সবাই চুপ, পিন পড়লে শোনা যায়। এমন সময় ঢং ঢং ঢং, ছুটির ঘন্টা। আর আমাদের পায় কে? ঐ ক্লাসটাই শেষ ক্লাস কিনা!

এই "হাতের কাজ" এর কোনো পরীক্ষা হতো না, শুধু কাজগুলো জমা দিতে হতো নির্দিষ্ট সময়ে। বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই এসব কারু না কারুকে দিয়ে করিয়ে আনতো, শুনেছিলাম সামান্য কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এসব করে দেবার মতন "প্রফেশনাল" লোকেরাও নাকি আছেন। তবে অনেকেই কিছু কিছু জিনিস নিজের আগ্রহে শিখতো, যেমন উলবোনা বা মাটির জিনিস বানানো--যা পরবর্তীকালে মাধ্যমিক পর্যায়ে খুব কাজে লেগেছিলো।

সেকালে মা-কাকীমারা উলবোনা নিয়ে কেন যেন খুব উৎসাহী ছিলেন। নানা জায়গা থেকে উলের নানা বিচিত্র ডিজাইন তুলে আনতেন, তারপর সেইসব ডিজাইন লাগিয়ে ফুলহাতা গলাবন্ধ সোয়েটার, ভি গলা হাতকাটা সোয়েটার, ভেস্ট, জাম্পার, জ্যাকেট এসব বুনতেন। বিকালের দিকে মাঠে আমরা যখন খেলতাম, মাঠের একধারে পাড়ার কাকীমাদের উলবোনার আসর বসতো, খোলা হাওয়ায় বসাও হলো, আবার উলবোনাও হলো।

উলবোনা জিনিসটার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিলো যে আমরা খুব ছোটোবেলাতেই নারকোল শলা নিয়ে উলের কাটা বানিয়ে সামান্য কিছু ফেলে দেওয়া উল নিয়ে ঘর তুলতে শিখতাম, কী করে সোজা বোনে কী করে উল্টো বোনে সেসব শিখতাম, তাই উলের কাজে আমাদের অনেকেরই সেরকম অসুবিধা হয় নি। মাঝে মাঝে ঘর পড়ে গেলে মুশকিল হতো, হয়তো খেয়াল না করে পরের পর বুনে গেছি অনেকবার, তারপরে ধরা পড়লো নিচে ঘর পড়ে গেছিলো, ওখানে ডেঞ্জারাস এক গ্যাপ ব্ল্যাক হোলের মতন রয়ে গেছে, যেটা থাকলে পুরো বোনাটাই বৃথা। সব খুলে যাবে। তখন হড়াশ করে কাঁটা খুলে ফেলে হড়হড় করে সবটা বোনা খুলে ফেলতে হতো ঐ পড়ে যাওয়া ঘর অবধি, তারপরে আবার নতুন করে বুনতে হতো। পরে, অনেক পরে বড় হয়ে শিখেছিলাম কী করে পড়ে যাওয়া ঘরও সামাল দেওয়া যায় উপরের বোনা সব না খুলে ফেলেও, কিন্তু সেসব অনেক পরের কথা।

প্রাইমারি স্কুলে যে সরলসোজা উল্টোসোজা উলবোনা শেখার শুরু সেটা মাধ্যমিক স্তরে অনেক বেড়ে গেছিলো, তখন নানা ধরনের ডিজাইন ও বুনতে হতো। ক্লাস সেভেনে লজেন্স প্যাটার্নের এক থ্রী কোয়ার্টার হাতা জ্যাকেট বুনতে হয়েছিলো। লজেন্স প্যাটার্ণ আমার দেওয়া নাম, কিন্তু জিনিসটা একেবারে সেই সেকালের লজেন্স মোড়ানো থাকতো যেই কায়্দায় সেরকম দেখতে। পরপর সারি সারি লজেন্স। প্রতিটা লজেন্সের উপরের আর নীচে ঐ লম্বা লম্বা তিন স্ট্রিং এদিকে আর তিনস্ট্রিং ওদিকে কীকরে যে ক্রস করবে সেটা শেখার আগে ভারী রহস্যময় লাগতো, শেখার পরে বড়ই আনন্দ হয়েছিলো। গণিতজ্ঞ দেখলে বলতেন তৃতীয় মাত্রার ব্যবহার।

যাইহোক যেজন্য এই "হাতের কাজ" ক্লাসটার কথা এত সাতকাহন করে বলা, সেটা হলো "সংগ্রহ পুস্তিকা", ক্লাস ফোরে হাতের কাজ এর ক্লাসে একেবারে শুরুতেই আমাদের বলে দেওয়া হলো যে আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের সারা বছর ধরে অন্যান্য রেগুলার হাতের কাজ এর পাশাপাশি একটি "সংগ্রহ পুস্তিকা" বানাতে হবে।

একটি মোটাসোটা খাতায় একেকপাতায় পাখির পালক, নানা গাছের পাতা, খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া আশ্চর্য কোনো কিছুর ছবি---এইসব আটকাতে হবে। বাঁদিকের পাতায় থাকবে জিনিসটা আর ডানদিকের সাদা পাতায় জিনিসটা সম্পর্কে লিখতে হবে, জিনিসটা কী, কোথায় পাওয়া গেল, এর গুরুত্বই বা কী, কোনো কাজে লাগে কিনা এইসব। ছোটোখাটো একটা পরিচয় আরকী। পরে, অনেক পরে জেনেছিলাম স্যাম্পল ওভাবে আটকায় আর পাশে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও ওভাবে দেয়। কিন্তু ক্লাস ফোরে ওসব জানতাম না। তখন ওটা ছিল ভারী অদ্ভুত আর অন্যরকম এক "হাতের কাজ" এর অ্যাসাইনমেন্ট যা কিনা সারাবছর চলবে, শেষে বার্ষিক পরীক্ষার আগে ওটা জমা দিতে হবে "হাতের কাজ" এর দিদিমণিকে।

বক, কাক, পায়রা, টিয়া, শালিক, ময়ূর--- এসব পাখির পালক তো সহজেই পেলাম, ময়ূরের পালক একটা শো-পীস থেকে পেয়েছিলাম, কিন্তু নীলকন্ঠ ইষ্টিকুটুম মৌটুসী বউকথাকও হরিয়াল মুনিয়া এদের পালক তো আর পাই না! এইসব পাখি এমনিতেই কালেভদ্রে দেখা যেত, তো আবার তার পালক! শেষে মুর্গীর পালক নীল হলুদ লাল এইসব নানা রঙে ডুবিয়ে নীলকন্ঠ ইত্যাদির বলে চালিয়ে দেবার একটা প্ল্যান করেছিলাম, কিন্তু শেষে আর করা হয় নি। গাছের পাতার সেকশনটা ভালোই উতরে গেল, আম জাম কাঁঠাল স্বরূপা আমলকী সজনে শিউলি রিঠা টগর বকুল দোপাটি গোলাপ জবা নয়নতারা কাঞ্চন তুলসী এইসব গাছের পাতা বেশ সুবিধাজনক সাইজের আর বিচিত্র আকারের বলে খাতার পাতায় বেশ ভালো করে ধরেও গেল আর বেশীরভাগ গাছই ছিলো বাড়ীর চারিপাশেই।

এসব তো বেশ চলছিল, হঠাৎ মনে হলো আরে একটা স্পেশাল সেকশন করলে কেমন হয়? অদ্ভুত প্রাণীদের সেকশন? তখন আবার চারিদিকে বেশ একটা আলোড়ন পড়েছে লকলেসের দৈত্য নেসি নিয়ে। তো, তাই করলাম, অদ্ভুত প্রাণীদের সেই সেকশনে কাগজে বেরোনো লকলেসের দৈত্যের লম্বা গলা ছবিটা দিলাম।(এখন সবাই জানেন যে ওটা ফেক ছবি ছিলো, যারা দাবীটা করেছিলো তারাই ওটা কায়দা করে বানিয়েছিলো ) যাইহোক সংগ্রহ পুস্তিকা জমা পড়ার পরে ঐ লকনেসের নেসি নিয়ে কী কেলেংকারি হয়েছিলো সেকথা পরে কখনো বলবো।

(চলবে)

Saturday, March 29, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১১)

আমাদের একদম ছোটোবেলার স্কুলটা মানে যে স্কুলে কেজি ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর অবধি পড়েছিলাম, সেটা ছিল বেশ বিচিত্র। তিনটি স্কুলের সমাহার বলা যায় সেটাকে।

একটা মস্ত চৌকো উঠানের পুবের দিকে ছোটো একতলা একটা দালানে ছিলো কিন্ডারগার্টেন স্কুল, সেখানে কেজি-ওয়ান আর কেজি-টু এর ক্লাস হতো। উঠানের পশ্চিমের দিকে দোতলা দালান, সেদিকে প্রাইমারি স্কুল, ক্লাস থ্রী, ফোর।

আর উঠানের উত্তর দিকে ছিল সেই বিচিত্র সমাহার, একটা বিশাল দোতলা বিল্ডিং এর একতলায় কয়েকটা ঘরে ক্লাস ওয়ান আর টুএর ক্লাস হতো, আর দোতলায় ছিল মাধ্যমিক ক্লাস, ফাইভ সিক্স ইত্যাদি। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ছিলো আমাদের অধরা, বিল্ডিং এর উত্তরদিকে, সেদিকে আমাদের যাওয়া হতো না। ওয়ানের ক্লাসঘরের উত্তরদিকের জানালা খুললেই দেখা যেত একটা মাঠ, সেটা মাধ্যমিক স্কুলের মাঠ। এই প্রাথমিক আর মাধ্যমিক অংশের শিক্ষকশিক্ষিকাগোষ্ঠী আর পরিচালনা-সমিতিও পৃথক ছিল।

কিন্ডারগার্টেন অংশটা প্রাথমিকেরই অংশ ছিল যদিও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকারা কেউ প্রাথমিক ক্লাসে পড়াতেন না, কিন্তু শিক্ষিকাদের বসার ঘরটি একই ছিল। মাধ্যমিক স্কুলটি কিন্তু একেবারেই আলাদা করা ছিল, ঐ অংশের শিক্ষক শিক্ষিকাদের বসার ব্যবস্থাও ছিলো ঐ উত্তরের অংশে যে দিকটায় আমরা যেতাম না কখনো। হয়তো গেলে কেউ আমাদের বারণ করতো না, কিন্তু অকারণে কেনই বা কেউ যাবে ওদিকে?মাঝে মাঝে কেউ কেউ যেত, হয়তো বা গন্ডী ভাঙার আনন্দ পেতে বা হয়তো নিতান্তই কৌতূহলে।

আমাদের পড়াশোনা সবই ছিলো এদিককার ঘরগুলোতে আর দুপুরের টিফিনের ছুটিতে খেলাধূলা সবই ছিলো এইদিকের মাঝের উঠানে। দক্ষিণের দিকে ছিল একজোড়া আমগাছ আর তারপরেই মস্ত গেট। পুব দক্ষিণের কোণার অংশে মস্ত স্লিপ আর লোহার দোলনা। ওখানেও খেলতাম আমরা একেবারে ছোটোবেলা, তবে ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কাকজোড়া জেলেমাছ কুমীরডাঙা এইসব দলগত খেলায়। টিফিনের আধঘন্টার ছুটিতে সেরকম আর তেমন খেলার সুযোগই বা কোথায়? সামান্য একটু ছোটাছুটি খেলতে না খেলতেই ঘন্টা পড়ে যায় টিফিন শেষের। ব্যস, দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে যে যার ক্লাসে।

ক্লাস ওয়ানের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ একটা দারুণ ব্যাপার হলো। শোনা গেল স্কুল ম্যাগাজিন বেরোবে, সেটা হবে কিন্ডারগার্টেন আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সম্মিলিত প্রয়াস। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকশিক্ষিকা সবাই নাকি লিখবেন। একসময়ে বেরোলো সেই ম্যাগাজিন, নাম "প্রত্যূষ।" আহা, সেই নামের ঝঙ্কার যে কানে বেজেছিলো, আর ফুরায় নি। পরের বছর থেকে "প্রত্যূষ" হয়ে গেল মাধ্যমিকের ম্যাগাজিন আর আমাদের নতুন স্কুল ম্যাগাজিন বেরোলো "অঙ্কুর" নামে। কারণ শিক্ষিকারা মনে করেছিলেন প্রাথমিকের ছেলেমেয়েরা তত বেশী লেখা টেখা দিতে পারে নি ওতে, আসলে খুবই অল্পই দিতে পেরেছিলো, ঠিকঠাক প্রতিনিধিত্ব হয় নি। তাই পরের বছর থেকে বেরোলো আমাদের "অঙ্কুর"। এতে শুধু লেখা না, তার সঙ্গে আঁকা ছবি, আল্পনা এসবও থাকতো।

কিন্তু সেই প্রথম "প্রত্যূষ" যে কী মায়া অঞ্জন টেনে দিয়েছিল আমার চোখে, কেজানে! গল্পগুলো, ক্লাস সেভেন এইট নাইনের ছেলেমেয়েদের লেখা ছোটো ছোটো সব গল্প, কী অদ্ভুত শিহরণ যে তুলেছিল আমার নতুন অবাক চোখের সামনে, সে আজও ভুলতে পারি না। খুব অদ্ভুত লাগে ভাবলে, আজো কোনো কোনো গল্পের কিছু কিছু অংশ মনে আছে। মনে আছে একটা গল্পে ছিলো এক কিশোরী মেয়ে পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হসপিটালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে তার দিদিমণির মুখে খবর শুনলো যে সে রেকর্ড নম্বর পেয়ে মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান পেয়েছে। আরেকটা গল্প ছিলো খনি অঞ্চলের এক দুঃখী গল্প, এক খনিশ্রমিকের ফুসফুসের অসুখ, যাতে সে মারা যাবে কয়েকমাস পরেই, বাড়ীর লোকেদের কিছু জানায় নি, শুধু ব্যবস্থা করেছে যাতে তার সমস্ত সঞ্চয় ও পাওনা টাকা তারা পায়। লেখকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে যখন সে একটি চিঠি লেখাতে এসেছে, সে ঐ চিঠিতেই নিজের লোকেদের সব জানাবে। এখন ফিরে ভাবলে অবাক লাগে, বেশ পরিণত ধরণের ছিলো ঐ কিশোর কিশোরীদের লেখা গল্পগুলো, কেজানে হয়তো তারা কোনোখান থেকে "অনুপ্রাণিত" হয়েছিলো ওগুলো লেখার সময় কিন্তু আমার কাছে তখন তা নিখাঁদ একেকটা বিস্ময়। এমনও হয়? মানুষে নিজেরাই লিখে ফেলতে পারে এমন সব গল্প?

রবীন্দ্রনাথ নজরুল বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র ---এইসব যে বড় বড় লেখক কবিদের কথা তখন শুনেছিলাম তারা তো ছবির মানুষ, তাঁদের মস্ত মস্ত ছবি ঝোলে দেওয়ালে, তাঁদের জন্মতিথি পালিত হয় প্যান্ডেল বেঁধে অনুষ্ঠান করে, তখন তাঁদের ছবিতে ফুলের মালা ঝোলে। ওঁদের খুব দূরের, খুব অন্যরকম, অসাধারণ ও অতি-মানুষ মনে হতো, সেই তাঁরা গল্প কবিতা লিখতে পারেন, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু এই চোখের সামনে চলে ফিরে বেড়ানো উঁচু ক্লাসের দিদি দাদারা, এরা তো আমার মতন মানুষই, সেই তারা এরকম সব গল্প লিখতে পারে?

লেখালিখি সম্পর্কে ক্লাস ওয়ানের সেই শিরশিরে অনুভূতিটা রয়ে গেল অনেক অনেক বছর, লেখালিখি যেন একটা ম্যাজিক জগৎ, একটা নিষিদ্ধ ফলের বাগান, ঐখানে আনন্দের পসরা আছে কিন্তু তার সঙ্গে আছে বাধা, আছে নানা বিপদ, কিন্তু একদিন হয়তো ওখানে পৌঁছতে পারবো। তখনই এইসব ভাবনা জাগে নি বটে, কিন্তু ওর সূচনা হয়েছিল সেই সামান্য স্কুল ম্যাগাজিনটি পড়েই, সেই প্রথম "প্রত্যূষ"।

পরের বছর থেকে আর প্রত্যূষ পেলাম না, হয়তো ওটা বেরোতো মাধ্যমিক স্কুলের অংশে, বা হয়তো বেরোতো না, তার কোনো খবর আমাদের দিকে আসতো না। আমাদের দিক থেকে বেরোলো "অঙ্কুর", আমার কোনো লেখা ওখানে কোনো বছর বেরোয় নি। লেখা দিতাম, কিন্তু নির্বাচিত হতো না। হয়তো লেখাগুলো ভালো হতো না বা হয়তো মাপসই হতো না, কেজানে! কিংবা হয়তো অন্য কোনো কারণ।

শুধু প্রথমবারের "অঙ্কুর" এ আমার একটা ন্যালাখ্যাপা টাইপের আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রথাগত আঁকা শিখতাম না তখন, তাই আঁকাটা ছিলো বাচ্চাদের কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাংএর মতন আনাড়ী আঁকা, একটা কুটির, তার পাশে বাঁশঝাড় আর একটা ঝুপসি গাছ, পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে, কাগজের উপরের থেকে নিচে মোটা রাস্তা নেমে গেছে, যেন মোটা একটা দড়ি ঝুলছে। পারস্পেক্টিভ বোঝানোর কৌশল জানা ছিলো না, আরে ঐ বাচ্চা বয়সে জানবো বা কী করে দ্বিমাত্রিক ছবির মধ্যে কেমন করে কাছে আর দূরে বোঝাতে হয়? তৃতীয় মাত্রা কি সোজা কথা নাকি? পরে বড় হয়ে ঐ ছবি দেখে খুব হাসতাম সবার সঙ্গে, ছবিতে সব কিছু কেমন ল্যাপ্টানো দুই মাত্রার।

পরে, অনেক পরে, প্রথাগত আঁকা শিখতে শুরু করে প্রথম কায়দা শিখেছিলাম ছবির মধ্যে দূরত্ব বোঝানোর, আকার আকৃতির বড় ছোটো আর গোল গোল আঁকাবাঁকা রেখার কৌশলে দেখানো এই বাড়ীটা কাছে আর ঐ দূরে অনুভূমিক লাইনটানা দিগন্ত, আকাবাঁকা ঢেউ খেলানো রেখায় দিগন্তের বৃক্ষরাজি একসাথে মিলেমিশে একাকার, তার মধ্য থেকে খাড়া খাড়া ছোটো ছোটো সরু সরু সব রেখা, মাথায় গুণচিহ্নের মতন, সেগুলো হলো দূরের দিগন্তের লম্বা গাছেরা, "তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে"। তাদের সামনে পুরোটা জুড়ে নদী, সেই জলে সূর্যাস্তের আভা, সূর্য ডুবে যাচ্ছে দিগন্তে। একেবারে কাছে নদীর এপারে একটা কুটির, পাশে গাছ। তো, এসব অনেক পরের কথা। প্রাইমারির অনেকদিন পরের।

"প্রত্যূষ" ছিল বড় সড় এ-ফোর সাইজের মতন বই, কিন্তু "অঙ্কুর" ছোটো, ডাইরির মতন। প্রথম ছাপা অঙ্কুর যেবার হাতে পেলাম যেটায় ঐ ছবিটা ছিলো, সেই দিনটাও মনে আছে, হঠাৎ সেদিন দুটো ক্লাসের পরেই ছুটি হয়ে গেল, কারণ হঠাৎ সংবাদ এসেছে রাজধানী শহরে প্রধানমন্ত্রী নিজের দেহরক্ষীদের হাতে খুন হয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, নিজের দেহরক্ষীরাই কি কখনো----ওসব বোঝার বয়স তখনো হয় নি আমাদের, শুধু মনে পড়ে আমি আর ভাই ফিরে আসছি বাড়ীতে, ভাই সেই বছর কেজি-ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলো। হঠাৎ ছুটি হয়ে গেল বলে মা বা অন্য কেউ আমাদের আনতে যায় নি, তখন ফোন টোন ও ছিলো না কারুর বাড়ীতে, দ্রুত খবর টবর দেবার ও নেবার একমাত্র উপায় ছিলো লোক পাঠানো। অনেক ছেলেমেয়ে ইস্কুলেই অপেক্ষা করে রইলো তাই। যাদের বাড়ী স্কুলের খুব কাছে, তারা ফিরে গেল বাড়ীতে।

আমি বাড়ী ফেরার রাস্তা চিনতাম, তাই ভাইকে নিয়ে ফিরে এলাম বাড়ীতে। সেদিন দুইজনের টিনের সুটকেসে দুটো "অঙ্কুর",আর একটা নতুন গন্ধ, নতুন বইয়ের একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে না? বাড়ী ফিরে আসার পরে মা আর ঠাকুমা তো অবাক, "সে কী রে, তোরা? স্কুল ছুটি হয়ে গেল? কী করে এলি?" আমার বেশ অবাক লাগলো, মা আমাদের স্কুলে দিয়ে আসে নিয়ে আসে বটে, কিন্তু এতদিন যাই আসি, রাস্তা চিনতে তো শিখে গেছি, নাকি?

ক্লাস ফোর অবধি আমরা টিনের সুটকেসে বইপত্র নিয়ে স্কুলে যেতাম, সবাই। পরে নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়ে সব বদলে গেছিল, সেখানে ব্যাগে করে বই নিতে হতো। আর যোগ হয়েছিলো টিফিন বাক্স। বাড়ী থেকে টিফিন নিয়ে যেতে হতো তখন। বাড়ী থেকে টিফিন নিয়ে যাবার ব্যাপারটাও বেশ নতুন ছিল আমার কাছে।

কিন্ডারগার্টেনে আর প্রাইমারিতে আমাদের স্কুল থেকে দুপুরে টিফিন দিতো। এসব মিড-ডে মীল স্কীম চালু হবার অনেক আগের কথা, এটা স্কুল নিজেই ব্যবস্থা করতো। অভিভাবকদের থেকে মাইনের সঙ্গে এই দুপুরের খাবার খরচটাও নিয়ে নিতো স্কুল কর্তৃপক্ষ। কী কারণে এই ব্যবস্থা, কেজানে! হয়তো ওঁদের যুক্তি ছিলো একসাথে লেখাপড়া আর খেলাধূলা করে বড় হচ্ছে যে কুচোকাঁচারা, তারা একসঙ্গে একরকম খাবার খেলে নিজেদের মধ্যে একাত্মতা তৈরী হবে। ছোটো ছোটো গোল গোল কানা উঁচু বাটিতে দিতো টিফিন, কোনোদিন মুড়ি আর চীনাবাদামভাজা, কোনোদিন মাখনচিনি মাখানো দুই স্লাইস পাউরুটী, কোনোদিন খই আর পাটালিগুড়, কোনোদিন বা আর কিছু। খইগুলোতে কোণায় কোণায় ধানের শক্ত খোসা লেগে থাকতো, আর হেসে হেসে আমাদের নিধিরদা( স্কুলের কর্মচারী ) বলতেন," ধান থেকেই তো খই হয়, জানো না তোমরা? " কী আশ্চর্য, ধান থেকে খই হয় ভালো কথা, ধানের খোসাগুলো ছাড়িয়ে বেছে দেবে তো? কিন্তু ঠেলার নাম বাবাজী, আমরা নিজেরাই খই থেকে ধান বাছতে শিখে ফেলি ঐ ধান্যখচিত খই টিফিন পেয়ে পেয়ে। দুপুরে স্কুল থেকে টিফিন দেওয়া আরো একটা উপকার করেছিল, অনেক ছেলেমেয়ে বাড়ীতে নিজের হাতে খেতে পারতো না, মা-দিদিমারা গরস পাকিয়ে পাকিয়ে মুখে দিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিতেন, কিন্তু ইস্কুলের টিফিনের ঠেলায় পড়ে সবাই নিজের হাতে খাওয়া শিখে ফেললো।

ক্লাস থ্রীতে উঠেই শুনি সাংঘাতিক এক ব্যাপার নাকি আসন্ন। চার বছরের আটকে থাকা পুরস্কার বিতরণী আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাকি অনুষ্ঠিত হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভালো ভালো গান আর নাচ জানা ছেলেমেয়েদের নির্বাচন করা শুরু হবে খুব শীগগীর।

ক্লাস থ্রীর ক্লাসরুম ছিল দোতলায়, ভারী অন্যরকম আর রহস্যময় সেই তলা। খোলা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে লোহার গেট, তার নিচে খুব বিপজ্জনক একটা ঢালু মেঝে, সেই মেঝের উপর দিয়ে ওঠার সময় পায়ের তলা শিরশির করে এই বুঝি হড়কে গেলাম। বৃষ্টি হলে আরো বেশি পিছলে পড়ার ভয় বেড়ে যায়। সেই অংশ পার হয়েই ক্লাস থ্রীর ঘর। সেই ঘরের পরেই একটা রহস্যময় বন্ধ ঘর, পরে জেনেছিলাম ওটা নাকি আমাদের লাইব্রেরী। ওখান থেকে কস্মিনকালেও বই দিতো না যদিও, তবে ক্লাস ফোরে একবার কী এক মহাশুভক্ষণে এক শনিবারে কয়েকঘন্টার জন্য কিছু গল্পের বই ওখান থেকে পড়তে দিয়েছিলো আমাদের। সে গল্প পরে কখনো হবে। গল্পের বই ছাড়াও ঐ ঘরে হাতের কাজের জিনিসপত্রও জমা রাখা হতো, সেও জেনেছিলাম পরে। সেই ঘর পার হয়ে একটা ছোটো ঢাকা বারান্দার ডাইনে ও বাঁয়ে ক্লাস ফোরের দুটো সেকশানের ক্লাসঘর।

ক্লাস থ্রীতে ওঠার কয়েকদিনের মধ্যেই শিল্পী নির্বাচন হয়ে গেল দিদিমণিদের। আমরা যারা নাচগান কিছু শিখতাম না তারা অবাক হয়ে দেখতাম কী জোর কদমেই না রিহার্সাল চলছে। তখন বছর শুরুর দিক, পড়াশুনো নামেমাত্র হয়ে টিফিনের পর থেকেই শুরু হতো রিহার্সাল। দিদিমণিদের নাচ ও গানের ব্যাপারে উৎসাহ দেখলে নির্ঘাৎ বাইরের লোকেরা মনে করতেন ওটা নাচ-গানেরই স্কুল!

সুদীপা সুগোপা পিউলী চন্দ্রাণী অলিপ্রিয়া শিবাণী মৌপিয়া সবাই নাচের ও গানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ওরা আলাদা করে নাচের ও গানের স্কুলে ও যেত বাড়ী থেকে। খুব সাংস্কৃতিক কিনা! মৌপিয়া আবার ছিলো একজন দিদিমণির মেয়ে, তাকে তো ক্লাসের মধ্যেই এক দিদিমণি গান তোলাতেন "আমি যার নূপুরের ছন্দ / কে সেই সুন্দর কে এ এ এ এ"

আমরা যারা কিনা অ-সুর ও ছন্দোহীন, তারা টিফিনের পর রিহার্সাল দেখতে যেতাম। একটা রূপকথার গল্পকে নাচগানওয়ালা নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে, সেখানে পরীদের নাচ হবে, লাল পরী নীল পরী সবুজ পরী হলুদ পরী আর সাদা পরী রাজকুমারীর চারধারে সিমেট্রি রেখে নাচবে গানের সঙ্গে সঙ্গে, রাজকুমারী হলো সেই পারুলকন্যা, যে কিনা সাতটি ভাইকে উদ্ধার করবে চাঁপা ফুল অবস্থা থেকে। এই রাজকুমারীর নাচ সবচেয়ে বেশী, এই রোল পেয়েছিলো অলিপ্রিয়া। সে খুব ভালো নাচতো। গর্বে তো তার আর পা মাটিতে পড়ে না। সে আবার সেই বছরই ভর্তি হয়েছিলো আমাদের স্কুলে, আগে ঐ স্কুলে পড়তো না, অন্য ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো, সেখানে নাকি সবকিছুতে "এক্সেলেন্ট" পেতো। সবাই নাকি তাকে ব্রাইটেস্ট গার্ল অব এশিয়া বলতো। সাংঘাতিক অবস্থা!

দারুণ জোরকদমে রিহার্সাল চলছে একদিকে, রিহার্সাল হতো একতলায়, দিদিমণিদের বসার কমনরুমের সামনে ছিলো অনেকখানি খোলা জায়্গা, সেখানে। সেই দিকে নাচ ও গানে পটীয়সী পাঞ্চালী, শিউলি আর দেবীকা দিদিমণি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কমনরুমের আরেকদিকে অন্যকিছু দিদিমণি মিলে আর্কাইভ থেকে উদ্ধার করছেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীদের নাকি পুরস্কার দেওয়ার প্রথা। আমাদের ব্যাচের তো কেজি ওয়ান থেকে সেই পর্যন্ত সব পুরস্কারই পেন্ডিং, সেই প্রথম অনুষ্ঠান হতে চলেছে।

দিনের পরে দিন যত যায়, ততই ব্যাপার আরো বেশী উত্তেজক হয়ে ওঠে। যেন এক অলিম্পিক টাইপ কিছু আসন্ন। হু হু বাবা, আমরা ছোটো হলে কী হবে, তখন ছোটো ছোটো সাদা কালো টিভি এসে গেছে পাড়ায় কারু কারু বাড়ীতে, ওসব অলিম্পিক এশিয়াড বিশ্বকাপ এইধরণের জিনিসগুলোর বিষয়ে আমরাও কিছু কিছু জেনে গেছি, একেবারে অজপাড়াগেঁয়ে আর তখন না আমরা! নিজেরা জল্পনা করি পুরস্কার দেবার সময় মঞ্চে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডের মতন কিছু থাকবে কিনা যেখানে ফার্স্ট, সেকেন্ড আর থার্ড দাঁড়াবে? কেউ কেউ বলে ওরকম কিছু থাকবে না, এটা তো অলিম্পিক বা এশিয়াড না, আবার কেউ কেউ বলে থাকবে, কেন থাকবে না?

বাঁশ টাঁশ আসতে শুরু করে স্কুলের উঠানে, প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হবে। আমাদের কী আনন্দ, টিফিনে খেলার সময় ঐ বাঁশের পাঁজায় গিয়ে খেলি আর দিদিমণিদের বকুনি খাই। তাতে কী? এইরকম সুযোগ তো আর বেশী আসে না? একবার ওখানে হুটোপাটি করতে করতে নামকরা দুরন্ত ছেলে প্রসূন পড়ে গিয়ে হাঁটু ছড়ে ফেললো, কিন্তু তাতেও সে দমে নি।

অনুষ্ঠানের দিনের কয়েকদিন আগে ক্লাস ফোরের একটা সেকশানের গোটা ক্লাসটাই হয়ে গেল গ্রীনরুম, পড়াশুনো একেবারে বন্ধ সেইসময়। পুরো সময় ধরে রিহার্সাল চলছে, যারা করছে তাদের তো উত্তেজিত ব্যস্ততায়, আনন্দে ও ঠিকমত পারফর্ম করতে পারবে কিনা এই টেনশনে একেবারে প্রায় দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য অবস্থা। আর আমরা যারা এই নাট্যোৎসবের দর্শক, তারাও উত্তেজনার আগুন পোহাচ্ছি। ঐ ঘরে তো আমাদের যেতে দিচ্ছে না, বাইরে থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছি। ক্লাসে তো কোনো দিদিমণি নেই, গল্পগাছা গন্ডগোলে ক্লাসঘর একেবারে গুলজার যাকে বলে।

পরীর নাচে সুদীপা হয়েছিল শ্বেতপরী, কিন্তু মূল অনুষ্ঠানের আগে আগে তার হলো মাম্পস, গলার অবস্থা খারাপ এদিকে জ্বরও। কিন্তু সে দমেনি, ওষুধের জোরে অবস্থা আয়ত্ত্বের মধ্যেই ছিল, ঐ অবস্থাতেই সে নেচেছিলো সাদা রেশমী রুপোজরিওয়ালা চুড়িদার আর ওড়নায় নিয়মমতন সেজে। প্রত্যেক রঙের পরীকে সেই রঙের জরিদার সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরে সাজতে হয়েছিল, রাজকুমারীর দুইধারে একজোড়া করে একই রঙের পরী ছিলো।

স্টেজ বাঁধা হয়ে গেল, প্যান্ডেলে ছেয়ে গেল গোটা উঠান। অন্যরকম হয়ে গেল চেনা স্কুলটা, যেন রূপকথার মায়াপুরী। অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যেবেলা, প্রথমে তো সভাপতি প্রধান অতিথি--এঁদের বক্তৃতা ইত্যাদি, তারপরে পুরস্কার বিতরণী।

কেজি-ওয়ানের জন্য প্রায় সবাইকেই সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিলো একটা ভারী মজার ছবিওয়ালা বই, "ছড়ার দেশে টুলটুলি"। বিভিন্ন ছড়ার অংশ ব্যবহার করে করে একটা বড় গল্প, টুলটুলি নামের এক ছোট্টো মেয়ের আশ্চর্য ছড়ার দেশে হারিয়ে যাওয়া আর সেখান থেকে ফিরে আসা নিয়ে। অনেকটা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতন, কিন্তু ঠিক তাও নয়। শৈল চক্রবর্তীর অসাধারণ আঁকা আর লেখা। একেকটা জায়্গা আজও মনে আছে, একজায়্গায় নদীর ধারে একটা গাছে অনেক নোটন নোটন পায়রা দেখে ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায় বলছেন "দেখেছ, আমার পোষা পায়রাগুলো পালিয়ে পালিয়ে সব এইখানে এসে পড়েছে!" আরেক জায়্গায় কমলাফুলির বাড়ী গিয়ে টুলটুলি অতিথি, সেখানে ওকে খেতে দিয়েছে মধুমাখা সবরিকলা। শেষে রাণীহাঁসের পিঠে চড়ে টুলটুলি ফিরে এলো আপনদেশে। সবটা মিলিয়ে খুব সুন্দর বই।

নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে তারপরে, তখন নেমে গিয়ে বসেছি মা-বাবার সঙ্গে, ঐ অনুষ্ঠানে সব অভিভাবকেরা দর্শক হিসাবে নিমন্ত্রিত ছিলেন।একেবারে শেষে সেই নৃত্যসঙ্গীতবহুল নাটক। কী আশ্চর্য সুন্দর লাগছিল সবাইকে, সত্যিই যেন আর একসাথে পড়া সামান্য মানুষ আর নয় তারা, সত্যি যেন রূপকথারাজ্যের লাল পরী নীল পরী সবুজ পরী হয়ে তারা বেষ্টন করেছে রাজকুমারীকে, ঝলমলে জরিপাড়ের উজ্জ্বল বাসন্তী রেশমী শাড়ীতে অলিপ্রিয়াকে দেখাচ্ছিল সত্যিই যেন সেই রাজকন্যা পারুল, অভিশপ্ত সাতভাইকে যে উদ্ধার করে মানুষরূপে ফিরিয়ে আনে।

তখন ডিজিটাল ক্যামেরার নামও শোনেনি কেউ, সাধারণত ফোটো তোলা হতো স্টুডিওতে গিয়ে। কোনো কোনো করিতকর্মা লোক বড়ো বড়ো কালো কালো ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে ফোটো তুলতেন, পরে সেগুলো ওয়াশ করে তবে ফোটো দ্যাখা যেতো। অলিপ্রিয়ার বাবা একটা সেইরকমই বড়ো ক্যামেরা হাতে উত্তেজিত অবস্থায় একবার প্যান্ডেলের এক কোণ থেকে, আরেকবার আরেক কোণ থেকে ছবি তুলছিলেন। হয়তো ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রেকর্ড করে রাখতে চাইছিলেন মেয়ের অক্ষয় কীর্তি।

অনুষ্ঠান শেষ হলো একসময়ে, ক্লান্ত ও পরিতৃপ্ত মনে ছড়ার দেশে টুলটুলি বুকে নিয়ে ফিরে চললাম বাড়ীর দিকে, আকাশে তখন ফুটকি ফুটকি তারা আর গাছে গাছে জ্বলছে নিভছে হাজারে হাজারে জোনাকি।

(চলবে)

Friday, March 28, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(১০)

মাঠের মধ্যে চৌকোনা একটা বড় জায়গায় খানিকটা মাটি তুলে ফেলে সাদা বালি দিয়ে ভরাট করা, সেই বালিটুকুর একটু আগে চুন দিয়ে একটা সাদা মোটা দাগ দিলেন সুচরিতাদি, উনি ছিলেন আমাদের স্পোর্টসের দিদিমণি। বললেন, ঐ দূর থেকে দৌড়ে এসে এই দাগের আগে থেকে লাফ দিয়ে উঠে উড়ে গিয়ে পড়তে হবে ঐ বালিতে।

তখন আমরা ক্লাস সেভেনে, যারা যারা ট্রায়াল দিতে ইচ্ছুক, চলে গেলাম দূরে। তারপরে একে একে দৌড়ে দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে পড়ছে মেয়েরা, সুচরিতাদি আর আরো দু'জন দিদিমণি কে কতটা লাফালো মেপে দেখে দেখে নির্বাচন করছেন ফাইনালের জন্য। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে গেছে বলে দিদিমণিরা তাড়া দিতে থাকায় আমরা করলাম কেলেঙ্কারি, দুর্গা বেশ ভালো লাফিয়েছিলো, কিন্তু ও ওঠার আগেই আমি গিয়ে লাফিয়ে পড়েছি প্রায় ওর ঘাড়েই বলা যায়, আর দেখতে না দেখতে আমার ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়েছে সুশোভনা ! তিনজনকেই অবশ্য সিলেক্ট করলেন সুচরিতাদি। আর আমাদের তিনজনকে কী বকুনি, এভাবে ঘাড়ে ঘাড়ে লাফানোর জন্য!

তখন শীতকালে হতো স্কুল-স্পোর্টস। জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীর মধ্যেই করে ফেলতে চেষ্টা করতেন দিদিমণিরা, কারণ তার পরেই চড়া হয়ে উঠতো রোদ। ঐ সুবাদে কয়েকদিন বেশ খোলা মাঠে অন্যরকম দিন কাটতো আমাদের। ট্রায়ালের দিনগুলোতে সার বেঁধে সবাই সেই বড়মাঠের দিকে যাওয়া, সেখানে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড় বা সাইকেল রেস বা হাই জাম্প লং জাম্পের ট্রায়াল আর যারা যারা সিলেক্টেড হলো তাদের নাম তুলে নিতেন সুচরিতাদি তাঁর বড় খাতায়।

ওসব দিনগুলো বেশ মজার, শুরুর একটা ক্লাস হয়েই দিদিমণিদের সঙ্গে মাঠে যাওয়া, বেশ কয়েকঘন্টা খোলা আকাশের নিচে ঝকমকে শীতের রোদে মাঠে কাটতো। বেশ চনচনে ফূর্তির দিন। ভূগোলের ক্লাসে দাঁড় করিয়ে দিদিমণি কোথাকার কোন গ্রেট বেরিয়ার রীফের প্রশ্ন ধরছেন না, ইতিহাসের ক্লাসে কোথায় কোন বিম্বিসার অজাতশত্রু চন্দ্রগুপ্ত বখতিয়ার খিলজী বাবর আকবর কে কী করেছিলেন বলতে হচ্ছে না, বেশ খোলামাঠে দৌড়োদৌড়ি আর সুযোগ পেলে মাঠের পাশের দিকে গিয়ে ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে ফুচকা খাওয়া হচ্ছে। এমনিতে ফুচকা আলুকাবলিওয়ালারা স্কুলের সামনের রাস্তায় ফুচকা-আলুকাবলি নিয়ে দাঁড়াতো, কিন্তু ট্রায়ালের দিনগুলোতে ওরাও মাঠের পাশে।

কাছের বয়েজ স্কুলের বেশ কিছু ছেলে কেমন করে জানি ক্লাস কেটে মাঠে এসে আমাদের ট্রায়ালগুলো দেখতো। তা দ্যাখ বাপু, দিদিমণিরাও কিছু বলতেন না। এমনিতে ফাইনাল তো রবিবারে হয়, সেদিন তো জনসাধারণ সকলেই দেখতে আসতে পারে, ক্লাস পালানোরও কোনো দরকার হয় না। কিন্তু ওরা ট্রায়াল ও ছাড়তে রাজি না, সেসব দিনেও দেখতে আসতো।

তারপর এক রবিবারে ফাইনাল, সেই বড়মাঠেই। সকাল থেকে সেদিন হৈ চৈ, মাঠের একপাশে প্যান্ডেল, প্যান্ডেলের উপরে লাল নীল কাগজের টুকরোর সাজ, শীতের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, সেখানে দিদিমণিরা সব মাড় দিয়ে ইস্ত্রী করা ফরমাল পোশাকে, ওঁদের পোশাক ছিলো লালপাড় সাদা শাড়ী। কারুর কারুর কাঁধে ভাঁজ করা শাল। প্যান্ডেলে মাইক-টাইকের ব্যবস্থাও থাকতো। ইভেন্ট ঘোষণা, নামঘোষণার ব্যাপার ছিলো তো! তারপরে বিজয়ীরা ভিকটরি স্ট্যান্ডে উঠলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর ব্যাপারও ও ছিলো।

সকালসকাল মার্চ পাস্ট, তারপরে প্রতিযোগীরা লাইন করে এসে ব্যাজ লাগিয়ে নিতো বাঁ-কাঁধের সামনের দিকে। কারণ দুপুরের প্যাকেট লা‌ঞ্চ তো কেবল অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরাই পাবে, সেটা নেবার সময় ব্যাজটা থাকতে হবে। একে একে স্পোর্টস ইভেন্টগুলো হতে থাকতো, আর প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় এই বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। ওরা তিনজনে দাঁড়াতো ভিকটরি স্ট্যান্ডে, আর মাইকে তখন গান বাজতো, জাতীয় সংগীত।

তখন ফটোর এত চল ছিলো না, প্রি-ডিজিটাল যুগ, ফটো তখন অনেক হ্যাপা হাঙ্গামার ব্যাপার। আহা কত বন্ধুদের ঘামে ভেজা ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত বিজয়োল্লাসভরা মুখ মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল, ফটোতে বাঁধা রইলো না। আমাদের ছোটো সেই গাঁ-মফস্বলে সেই সামান্য স্পোর্টসই তো যেন টিভিতে দেখা অলিম্পিকের স্বপ্নরাজ্য। আসল জিনিস তো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু যা পাওয়া যায় তাই না কম কী? আর সেই কৈশোরকালের স্পিরিট, সেই তো সমস্ত বাস্তবতাকে পার হয়ে স্বপ্ন দেখতে শক্তি দেয়, তাই না?

স্কুল স্পোর্টসের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে হাসিকে। প্রাণবন্ত সতেজ কিশোরী ছিলো হাসি, খুব ভালো দৌড়তো ও। ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড়ে ওর ফার্স্ট প্রাইজ নিশ্চিত ছিলো। সারাবছর ক্লাসের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতো যে মেয়ে, অঙ্কের ব্যাপারে যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো, পড়ার যেকোনো বিষয়ই যার কাছে ভীতিকর ছিলো, তার ঝকঝকে উজ্জ্বলতা ফেটে পড়তো এই স্পোর্টসের দিনগুলোতে। স্কুল স্পোর্টসের বাইরেও সিরিয়াসলি খেলাধূলা করতো হাসি, জেলাস্তরের প্রতিনিধিত্ব করতে শুনেছি নানা প্রতিযোগিতায় যেত। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলো না, ক্লাস এইটেই পড়াটড়া ছাড়িয়ে ওর বাড়ীর লোক ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললো। তারপরে খেলাধূলার কথা ভাবা তো স্বপ্নেরও অগোচর। অথচ এইসব মেয়ে সুযোগ পেলে হয়তো একদিন অলিম্পিক অবধি পৌঁছতে পারতো।

আজ ফিরে দেখলে তাই বারে বারে আমাদের ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইচ্ছে হয়, এই যে খেলায় ভালো মেয়েটি, ওকে খেলার জন্যই তো আলাদা করে সুযোগ করে দিয়ে রাজ্যস্তরে নির্বাচিত হবার ব্যবস্থা করতে পারতো স্কুল লেভেল থেকেই, যদি স্পোর্টস ব্যাপারটা শুধু কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে সারাবছরের ব্যাপার হতো। কিংবা যদি সাধারণ স্কুল থেকে খেলায় ভালো এইসব মেয়েদের বেছে নিয়ে স্পোর্টস স্কুলে ঢোকানোর ব্যবস্থা থাকতো। সেরকম স্কুলই বা কোথায় ছিলো তেমন? "কোনি" সিনেমাটা যতবার দেখি ততবার মনে পড়ে হাসিকে। দেখি খাঁ খাঁ ধূ ধূ অলিম্পিক রেকর্ড আমাদের, আর মনে পড়ে হাসিকে, শুকনো মুখে স্কুল ছেড়ে খেলাধূলো ছেড়ে ঘোমটা মাথায় সংসারে ঢুকে পড়ছে চোদ্দো পনেরো বছর বয়সে। হয়তো এরকম হবার ছিলো না। বাস্তববাদীরা ধমক দিয়ে বলে, আরে আগে তো পড়াশুনো, যাতে একটা চাকরিবাকরি জোটে, থাকা খাওয়ার সুসার হয়, তারপরে না খেলা! ওসব লাটসাহেবী কি আমাদের চলে!

তারপরে তো আমাদের খেলাধূলাও বন্ধই হয়ে গেল প্রায়, নাইনে টেনে স্কুল স্পোর্টসেও অংশ নেওয়া বিলাসিতা, তখন তো মাধ্যমিকের রেস শুরু হয়ে গেছে কিনা! এখন ফিরে দেখলে সেই সিক্স সেভেন এইটের সেই সব ক্লান্ত পরিতৃপ্ত রবিবারের বিকেল মনে পড়ে, স্পোর্টস ফাইনালের শেষের দিক, গো অ্যাজ ইউ লাইক হচ্ছে, নানারাকম সেজে গেছে প্রতিযোগীরা, কেউ পা হারিয়ে ফেলা সৈনিক, কেউ পাগল ভিখারি, কেউ মেলার যাদুকর। শেষ মুহূর্তের আনন্দ। চেনা মানুষেরা কেমন অচেনা হয়ে গেছে! সেই ইভেন্টের বিচার হয়ে গেলেই ফাইনাল শেষ সেই বছরের মতন। তারপরে সারাদিনের সব ইভেন্টের প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে, পরদিন ছুটি ঘোষণা হয়ে গেছে। কেমন আশ্চর্য একটা শীতের বিকেল, খোলা আকাশের নিচে একটি দিনের কার্নিভাল যেন আমাদের। সেই তখন, যখন আমরা জীবন্ত ছিলাম!

(চলবে)

ইস্কুলবেলার গল্প(৯)

টেবিলজুড়ে ছড়ানো এলোমেলো বইপত্তরের উপরে ঝিঁ ঝিঁর কাঁপন। তুলে নিই মুঠাফোনটা, ওপারে অন্বেষা। " কী রে তুলি, এই উইকেন্ডে ফ্রী আছিস? একজায়গায় যেতাম তাহলে।"

" প্রথমদিন ফ্রী, সেদিন হলে যেতে পারি।"

"ঠিক আছে। আমি তাহলে সকালে এসে তোকে পিকাপ করে নেবো। এই নটা নাগাদ। রেডি থাকবি।"

"কোথায় নিয়ে যাবি রে? "

"সে দেখবি তখন, এখন বলবো না। " ওর হাসি শুনতে পাই।

শনিবারে ও এসে পড়ে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নটায়। আকাশ ভরে রোদ ঝলমল করছে তখন। আমি তৈরী ছিলাম, ওর কল পেয়েই বেরিয়ে এসে উঠে পড়ি ওর বাহনে। টলটলে নীল আকাশ, সোনালি চুমকি লাগানো ওড়নার মতন রোদ। এইরকম দিন আসলে বেড়ানোর জন্যই আসে। এই রোদ কি ঘরে থাকতে দেয়? হাত বাড়িয়ে ডাকে।

ঘন্টা দুই পরেই আমরা পৌঁছে যাই, সত্যিই অপূর্ব। একপাশে নদী, তার পারে বিরাট বাগান। সেখানে একটু পরে পরেই লতাগৃহের মতন। লতাগৃহ মানে আটকোণা পাথরের বেদী, উপরে ঢালু গোল ছাদ, কিন্তু চারিপাশে দেয়াল নেই, কয়েকটা থাম। থামগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে পল্লবিত লতা, কোনো কোনো লতায় ফুল ও ফুটেছে। এরকম ঘরের স্বপ্ন দেখতাম অবুঝবেলায়।

বিরাট বিরাট সব মহীরুহ চারিদিকে, পাতায় পাতায় লাল হলুদ কমলা রঙ সবে ধরতে শুরু করেছে। হেমন্তে ঝরে পড়ার আগে সব একেবারে লালে লাল হয়ে যাবে। আমরা দু'জনেই একমত হই যে তখন আবার একবার আসতে হবে।

সারাদিন এখানে থাকবো, আসার পথে দোকান থেকে খাবার আর পানীয় কিনে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং সেদিক দিয়েও নিশ্চিন্ত।

"দেশে আমরা প্রকৃতির এই দিকটা দেখতে পাই নি, নারে টেঁপি? এভাবে এমন তুমুল ফল কালার ধরে এত এত গাছ পাতাহারা হয়ে যায় আবার অফুরাণ শক্তি নিয়ে সব পাতা ফিরে আসে মার্চের শেষাশেষি বা এপ্রিলের শুরুতে , এ জিনিস দেখিনি। সেখানে তো প্রায় সবই চিরহরিৎ গাছ। "

"আবার টেঁপি? এই নামটা এমন করে তোকে চেপে ধরলো? " অন্বেষা রাগ-রাগ গলায় বলতে চেষ্টা করেও হেসে ফেললো।

আমরা বাগান থেকে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়ে একেবারে নদীর কাছে গিয়ে পাথরের উপরে বসি। ঝুঁকে নদীকে ছুঁই, নদীর জল স্বচ্ছ আর ঠান্ডা। এত স্বচ্ছ যে নিচে নুড়িপাথর আর বালি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

অন্বেষা বলে, " তুলি, ভাবতেও অবাক লাগে, এত বছর পরে এই সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আবার আমাদের দেখা হলো আর আবার বন্ধুত্ব হলো। আসলে এখনকারটাই মনে হয় বেশি সত্যি, এত বছর স্কুলে পাশাপাশি পড়েছি বটে কিন্তু তখন মনে হয় তোরা কেউ আমার খুব কাছের ছিলি না কোনোদিনই। ছিলি কি? "

জিনস-জ্যাকেট পরা ববছাঁট চুলের অন্বেষা মিলিয়ে গিয়ে আমার সামনে ম্যাজিকের মতন ফুটে ওঠে সেই ক্লাস সিক্স সেভেনের অন্বেষা, দুইবেণী করা চুল, বেণীর ডগায় সাদা রেশমী ফিতে ফুলের মতন করে বাঁধা। সাদা শার্টের উপরে সবুজ টিউনিক পরা অন্বেষা। আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম ছিলো ওরকম ক্লাস এইট পর্যন্ত মেয়েদের জন্য, তার পরে নাইনে টেনে পরতে হতো সবুজ পাড় সাদা শাড়ী। শাড়ী পরা একবেণীর অন্বেষাকেও মনে পড়ে, তবে বেশী গাঢ় হয়ে মনে আসে সেই সাদা শার্ট সবুজ টিউনিক পরা কিশোরীই।

ক্লাস ফাইভে-সিক্সে সে ছিলো আমাদের রাইজিং স্টার, প্রাইমারি স্কুলে যাকে চোখেই পড়তো না, সে কিনা এরকম আউট অব দ্য ব্লু ফার্স্ট হয়ে জ্বলে উঠলো নতুন স্কুলে এসে? পুরনো স্কুলে যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হতো, তারা তো রীতিমত আহত, তারপরে ঈর্ষান্বিত। প্রথমে মনে হয়েছিলো অঘটন ঘটে গেছে ক্লাস ফাইভের ষান্মাসিকের আর বাৎসরিকের রেজাল্টে, পরে আর এরকম হবে না। কিন্তু তা না, এরপরে প্রতিটা পরীক্ষায় অন্বেষা প্রথম, শুধু তাই না, প্রতিটা সাবজেক্টে ওরই নম্বর সর্বোচ্চ। ক্লাসের যেসব মেয়েরা পরীক্ষাগুলোর পরে পরেই থ্রিলিং প্রেডিকশান করতো কার কী স্থান হবে তা নিয়ে, তারা হতাশ হয়ে সেকেন্ড থেকে শুরু করতে লাগলো।

সেভেন পর্যন্ত তবু একটা কী-হয় কী-হয় ভাব ছিলো, সেভেনের পরের ক্লাসগুলোতে মনে হয় ব্যাপারটা গৃহীত সত্যের মতন বোরিং হয়ে গেল। তাছাড়া তখন নানা রকম প্রাইভেট কোচিং, এই স্যরের গ্রুপ ওই স্যরের গ্রুপ--এইসব নানা অতিরিক্ত জটিলতাও দেখা দিতে লাগলো। অন্বেষা অবশ্য ঐ বিখ্যাত টিউটরদের কারুর কাছেই পড়তো না, তবু তাতেও ওর রেজাল্টে কোনো পরিবর্তন আসে নি, সেই বোরিং হায়েস্ট স্কোর।

আমি ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলি, " সেই সময় স্কুলে কেউই আমরা কারুর খুব কাছের বন্ধু ছিলাম না। প্রতিযোগিতার আবহাওয়ার মধ্যে, রেষারেষির আবহাওয়ার মধ্যে কি আসলেই কোনো সত্যিকার বন্ধুত্ব হয়? অভিভাবকেরাও তো তেমন, "দেখেছিস ও কত ভালো পড়াশোনায়, ওর পা ধোয়া জল খাওয়া উচিত", এরকম সব বাক্য হরহামেশা বাচ্চাদের বলে আমাদের দেশগুলোতে। এসব তো রীতিমতন বেআইনি হওয়া উচিত সভ্যদেশে। নিজেরা বাবামা হয়ে নিজের বাচ্চাদের মনকে দমিয়ে দেওয়া!"

ও নদীর দিকে চোখ মেলে কেমন বেদনাবিহীন অথচ বিষন্ন গলায় বলে, " আমাদেরই দুর্ভাগ্য, আমাদের মূল্যায়ণব্যবস্থা এত সংকীর্ণ! যেন মুখস্থ করে উগরে দেয়া পরীক্ষায় ভালো করা মানেই ভালো মেয়ে বা ভালো ছেলে আর তা না হলে একেবারেই এলেবেলে। কী ভুল ব্যবস্থা! আমার বন্ধু পাবার ক্ষেত্র তো ছিলো আরো কন্টকাকীর্ণ। কেবল স্থানাধিকারের জন্যই কারুর প্রত্যক্ষ ক্ষতি না করেও সকলের কমন শত্রু। " এখানে এসে অন্বেষা হেসে ফেলে।

"তোকে তখন ক্লাসের ভালো মেয়েরা সবাই ঈর্ষা করতো, কারণ সবাই তো পোটেনশিয়াল টপার! যে মেয়ে প্রত্যেক পরীক্ষায় তাদের সবার আশা নস্যাৎ করে দেয় তাকে ঈর্ষা না করে থাকবে কী করে কেউ? অনেকে তো "শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু" এই যুক্তিতে বন্ধু হতো পরস্পরের! তারপরে আবার পরীক্ষার সময় উত্তর দেখানো বা ফিসফিস করে বলে দেওয়া এসব নিয়ে ঝগড়া বেঁধে সেই বন্ধুতাও চটকে যেতে দেরি হতো না। এক বিষময় অলাতচক্র। তোর সীট তো পড়তো সামনের বেঞ্চে, অর্জুনের মতন পাখির চোখের দিকে মানে প্রশ্নপত্রের দিকে তাকিয়ে লিখতে শুরু করে দিতিস, বাকী দুনিয়া মুছে যেতো। পিছনের দিকের হল-কালেকশান আর বলাবলি-দেখাদেখির রাজনীতি তো তুই জানতিস না।" এখানে এসে আমিও হেসে ফেলি এবারে।

ও বলে, " ভাবলে অবাক লাগে, এতগুলো বছরের স্কুলজীবন আমাদের, কিন্তু সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, টীম এফোর্ট, কমন প্রোজেক্ট এইসবের মানেই শিখতে পারলাম না আমরা। সেরকম সদর্থক কিছু তো ছিলোই না আমাদের কোর্সের মধ্যে যেখানে অনেকে মিলে একটা অজানা সমস্যাকে সমাধান করার জন্য নানাভাবে নানাদিক দিয়ে চিন্তা করতে হবে, তারপরে সবার চিন্তাগুলো মিলিয়ে উপযোগীগুলো নিয়ে আবার সেটাকে রূপায়িত করার জন্য একসাথে কাজ করতে হবে। এরকম কিছু থাকলে কত ভালো হতো। জীবনের সবচেয়ে সক্রিয় সবচেয়ে আনন্দময় সবচেয়ে ফ্লেক্সিবল সময়টা কেটে গেল নীরব রেষারেষিতে। তাও ক্লাস এইট পর্যন্ত যখন বেশীরভাগকে প্রাইভেট টিউটরদের গোয়ালে ঢুকে পড়তে হয় নি, তখন তবু কিছু কিছু খাঁটি মনোভাব, স্বাধীন স্পিরিট বেঁচে ছিলো, টিউটররাজ শুরু হবার পরে তো তাও খতম। একেবারে হরিঘোষের গোয়ালের মতন অবস্থা হয়ে গেল। কোনো কিছু ভালোভাবে শিখবারই আর উপায় রইলো না, সব নোটের স্রোতে ঝাঁপ। টিউটররা নোট দ্যান, গাঁতিয়ে সেই নোট মুখস্থ করে খাতায় উগড়ানো, কারণ সামনে মাধ্যমিক, মাধ্যমিকে ভালো করতে হলে ঐ ছাড়া গতি নেই। আমাদের মধ্যে যে উৎসুক অনুসন্ধিৎসু মন বেঁচে ছিলো সামান্য, সেটুকুও বিনাশ করার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।"

টলটলে নীল আকাশের দিকে চেয়ে আমি ফিসফিস করে বলি " তবু কিন্তু সবটুকু মেরে ফেলা যায় না, কিছু রয়েই যায় খুব ভিতরে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বেরিয়ে আসে যেমন তুষারঢাকা শীত চলে গিয়ে বসন্ত এলে জেগে ওঠে কিশলয়।"

( চলবে )

Wednesday, March 26, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৮)

নিয়তি দিদিমণি গল্প শোনাচ্ছেন, "এক দেশে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজা একদিন এক সাধুর কাছে এক বর পেলেন। রাজা যা ধরবেন তাই সোনা হয়ে যাবে। রাজা তো আনন্দে এক লাফ দিয়ে প্রথমেই দু'হাতে চেপে ধরলেন রাজসভার থাম। থাম সোনার হয়ে গেল। তারপরে ধরলেন ছত্রচামর, তাও সোনার হয়ে গেল। রাজার আনন্দ ধরে না। এরপরে রাজা স্নান করতে যাবেন, যেই না তেল মাখতে গেছেন, তেল হয়ে গেল সোনার তাল। আর তেল মাখা হলো না। বিমর্ষ হয়ে তেল ছাড়াই স্নানে যাবেন ভেবে যেই না গামছা নিতে গেছেন, গামছা হয়ে গেল সোনার পাত। ....."

আমরা জনা কুড়ি ছোটো ছেলেমেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে চোখ বড় বড় করে শুনছি এই কাহিনী। সে কী ঘোর কৌতূহল। কী হবে এর পরে?

পরে বড় হয়ে রাজা মিডাসের কাহিনী প্রথাগত আঙ্গিকে যখন শুনেছি তখন কিন্তু সেই ছোট্টোবেলার রোমাঞ্চ আর ছিলো না। সেই তেল মেখে স্নান করতে যাওয়া বাঙালী মিডাস বরং মনে রয়ে গেছে সেই রোমাঞ্চময় শৈশবের রঙটুকু নিয়ে। তখন যেন সব অনেক বেশী সবুজ ছিলো।

কেজি-ওয়ানে আর কেজি-টুতে পড়াশোনা ছিলো খেলাধূলা গল্পটল্প এইসবের সঙ্গে মেশানো। পরে বুঝেছি খুবই ভালো ছিলো ঐ টেকনিক। দিদিমণিরাও অপ্রত্যাশিত ভালো ছিলেন। পরে জেনেছি অনেক হায়ার ডিগ্রী ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো ওনারা বেছে নিয়েছিলেন কারণ এটা ছিলো ওনাদের একধরনের ব্রত। নিয়তি দিদিমণি তো তৎকালীন সোভিয়েত দেশে গিয়ে সেখানে বাচ্চাদের কীভাবে পড়ানো হয় সেও দেখে এসেছিলেন শুনেছি পরে। আমাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন একগোছা বই, সবাইকে দিয়েছিলেন একটা করে, বইয়ের নাম ছিলো "বছরের কিবা মানে", সুন্দর সুন্দর ছবি দেওয়া ছড়ার বই, অনুবাদ। তখন এতশত জানতাম না, বই পেয়েই খুশি।

সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হতো ক্লাস। তার আগে বাইরে উঠানে সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে হাতজোড় করে দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকতে হতো, তারপরে শুরু হতো প্রার্থনাসঙ্গীত, একজন বড় ক্লাসের দিদি লীড করতো, আমরা তার সঙ্গে কোরাস ধরতাম। আমাদের সময়ে গাইতে হতো "ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।" পরে মানে বশ কয়েক বছর পরে সরকারী নির্দেশে সেই গান বন্ধ হয়ে গেল, তার বদলে গাইতে হতো জাতীয় সঙ্গীত, "জনগণমন অধিনায়ক জয় হে "

একেবারে প্রথমদিন তো আর গানের কিছুই জানি না, মানে গান যে শুরু হবে তাই তো জানি না! হাতজোড় করে চোখ বন্ধ করতে বললো নীলিমা দিদিমণি, ব্যস, তাই করলাম। সেদিন চারিপাশে কত বাচ্চা, কাউকে চিনি না, সব নতুন, তারস্বরে কেউ কেউ চিৎকার করছে, কেউ হাপুস নয়নে কাঁদছে, কেউ কেউ চুপ করে এসব দেখছে। সেদিন প্রথম কিনা মাকে ছেড়ে এসেছে সবাই, তাই। প্রথম অভিজ্ঞতা বাইরের জগতের। নীলিমা দিদিমণি এক হাপুস-কাঁদা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বলছে, "এত কাঁদলে হবে কী করে? তাহলে যে ভগবান আসবে না।"

একসময় গান শুরু হলো, আমি চোখ আর মুখ কিছুই খুললাম না। কান খোলা রইলো। গান শেষ হলে একেবারে চোখ মেললাম। তারপরে প্রথম ক্লাসে ঢোকা।

দরজার পাশে জুতা রাখার জায়গা, সেখানে জুতা খুলে সুটকেস আর জলের বোতল হাতে ক্লাসঘরে ঢোকা। ঘরটা বেশ বড়ো, কোনো বেঞ্চ নেই। ঘর জুড়ে চাদর পাতা। সামনের দিকে দিদিমণির চেয়ার, কোনো টেবিল নেই, পাশে একটা কাঠের ‌স্ট্যান্ডে ছোটো একটা কালো বোর্ড। ঘরের দেয়ালগুলোর কাছে বড় বড় আলমারি, সেই আলমারির সামনের কাচের ঢাকনার মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে কত কত রঙীন খেলনা, পুতুল, হাতীঘোড়া, কাপপ্লেট এইসব। আহা আমাদের নিশ্চয় খেলতে দেবে কখনো।

চাদরে বসতে হয় আর সুটকেস সামনে রাখতে হয়। জলের বোতল গুলো সব দিদিমণি একপাশে নিয়ে রেখে দেন। সকাল থেকে টিফিনের আগে পর্যন্ত পড়াশোনা। অ আ ক খ এ বি সি ডি এক দুই তিন চার এসব শিখতে হয় আরকি। তারপরে ছড়া গল্প এসবও হয়। কোনো কোনোদিন খেলনাগুলো বার করে দেন দিদিমণি, আমরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে খেলি। তারপরে বেলা দেড়টায় ঢং ঢং ঢং করে টিফিনের ঘন্টা পড়ে গেলেই পড়াশোনা গোটানো। টিফিন ইস্কুল থেকেই দিতো, ইস্কুলেরই বাটিতে, কোনোদিন মুড়ি-বাদাম, কোনোদিন খই-পাটালি, কোনোদিন মাখনচিনিপাউরুটি, কোনোদিন বা অন্যকিছু।

খাওয়ার পরেই বাটি জমা দিয়ে যে যার জলের বোতল থেকে জল খেয়ে খানিকটা খেলা বাইরের উঠানে। একপাশে দোলনা আর স্লিপও ছিলো। তারপরেই একটা ঘন্টা পড়লে ঘরে ঢোকা আবার, তখন আবশ্যিক ঘুমের ক্লাস। সুটকেস গুলো একপাশে সরিয়ে রাখা হতো আর চাদরে শুয়ে পড়তে হতো টানটান হয়ে। ঘুমের চেষ্টা করতে হতো, ঘর প্রায় অন্ধকার, শুধু বন্ধ জানালার ছোটো ছোটো ফোকড় দিয়ে আসা আলোর বাতাসা। ঘরখানা হয়ে যেতো মায়াপুরী। এর মধ্যে কি ঘুম আসে? আমরা ফিসফিস করে পাশের জনের সাথে গল্প করতাম। তবে কেউ কেউ কোনো কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়তো সত্যি করে। আমি নিজে হয়তো দুই বছরে দিন তিনেক ঘুমিয়েছি।

এইভাবে বেলা সাড়ে তিনটে অবধি ঘুমের ক্লাস চলতো, তারপরে আবার ঘন্টা ঢং ঢং ঢং, ছুটি ছুটি। যে যার সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে জুতো পরে রিকশা করে বাড়ী। আহা বাড়ী বাড়ী। তারপরে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে দেয়েই মাঠে। সেখানে একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলা, খেলা, খেলা। খোলা মাঠে খোলা আকাশের নিচে চারিদিকে কোনো বাধাহীন খেলা।

কিন্ডারগার্টেনের দুটো বছর কেমন ফুরফুর করে কেটে গেল। কত গল্প কত খেলা আর আর তার সাথে কিছু লেখা আর পড়া। কিন্ডারগার্টেনে দিব্যি আমরা বাংলা অঙ্কের সঙ্গে ইংরেজীও শিখতাম । কী সুন্দর বাংলা- ইংরেজী মেশানো মজার ছড়া আর ছবিওয়ালা বই ছিলো, মজা করে করে শেখা হতো কাকে কী বলে।

একটা ছবি মনে পড়ে, এক চালাক বানর বসে আছে ঘোড়ার পিঠে, সামনে এক গাধা, বানর তাকে বলছে সে বনে যাচ্ছে মধু খেতে, গাধাও যেন যায়।

"Donkey কে কহিছে Monkey

এসো মোর সনে,

Pony চেপে Honey খেতে

যাবো আমি বনে।"

সুন্দর সব রঙীন পরিপাটী ছবিওয়ালা বই, যত্ন করে পড়ান দিদিমণিরা, ধৈর্য ধরে শেখান মায়ের মতন স্নেহে ও যত্নে। শিশুদের শিখতে আর কী লাগে?

তারপরে ক্লাস ওয়ান থেকে সব বদলে গেল, ক্লাসে কেঠো কেঠো বেঞ্চ পাতা, ইংরেজী বাদ। বাকী যা সব পড়া হবে তার জন্য সরকারী বই আসে, সেই বই সেলাই খুলে লড়লড় করছে, কোনো কোনোটা ময়লা আর ছেড়া, সবচেয়ে খারাপ হলো বই ভর্তি পেন্সিলের লেখা, আগেকার ছাত্রগণের শূন্যস্থান পূরণ বা প্রশ্নের উত্তর এইসব। সেগুলো ইরেজার দিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে হয়। সারা ক্লাসে শুরুর দিকে কেবল বই মোছাই হয়। আর সবচেয়ে দুঃখদায়ক হলো দিদিমণিরা একেবারেই সেই কেজি ক্লাসের শিক্ষাব্রতী দিদিমণিদের মতন না। দায়সারা পড়ানো। কিন্ডারগার্টেনের পরে ঠিক যেন গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে একেবারে মিলিটারি সরকারে এসে পড়লাম আমরা।

বইগুলোও সব কেমন যেন, ছবি নেই রঙ নেই। সহজপাঠ বলে যে বাংলা বই সেই বইয়ে অদ্ভুত হিজিবিজি টাইপ ছবি সব, একটুও মন টানে না, ইচ্ছেই করে না একবারের বেশী দু'বার ওগুলো খুলতে। গল্প ছড়া সবই কেমন একটা অচেনারকমের আড়ষ্ট। সরকারী অঙ্কের বই নবগণিত মুকুল, সেও ভালো লাগে না। এইসবই হয়তো ভালো লাগতে পারতো যদি শিক্ষিকারা একটু কল্পনা একটু সৃষ্টিশীলতা দিয়ে ক্লাসগুলো উপভোগ্য করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দুঃখের কথা সেরকম কিছুই দেখা গেল না।

এদিকে আবার ওদিক নেই সেদিক আছে দিদিমণিদের, একেক জন দিদিমণির ছেলে বা মেয়ে ও সেসময় পড়ত আমাদের সাথে, তারা তো দিব্যি বাকী দিদিমণিদের ফেভারিট। নিজের মায়ের কাছে পরীক্ষা দিলে তো অবশ্যই পঞ্চাশে পঞ্চাশ বা একশোতে একশো। সে নাহয় হলো, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই নিজের বাবার কাছে ( যদিও যুধিষ্ঠির জানতো না যে প্রশ্নকারী ওর বাবা, যক্ষ বা বক রূপে ধর্ম ছিলেন হ্রদের তীরে ) মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ১০০ তে ১০০ পেয়ে গেল, আর আমরা তো সামান্য মনুষ্য। হাসি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ট্রীটমেন্টটাই খারাপ লাগতো, ছোটোরা এসব বুঝতে পারে না তা তো না, বরং ছোটোবেলা এসব জিনিস আরো বেশী ভালো করে বোঝা যায়।

এভাবে গেল আরো দুটো বছর, তারপরে ক্লাস থ্রীতে দেখা পেলাম আশ্চর্য সেই মায়াভরা চোখের দিদিমণির। মানুষই যে ম্যাজিক করতে পারে, যন্ত্রপাতি বইপত্তর টাকাকড়ি এসব যে বস্তুমাত্র, সেই ধারণা সারাজীবনের মত আমার হলো ক্লাস থ্রীর ক্লাস-টিচার এই দিদিমণির জন্য। মানুষের প্রেরণাই জাগিয়ে তুলতে পারে স্ফুটনোন্মুখ মনের কলিগুলিকে। ওনার হয়তো আজ সেসব কিছুই মনে নেই। উনি জানতেনও না ছোট্টো একটা মেয়ে প্রত্যেকটা দিন সকালে চোখ মেলেই মনে করতো তার মুখ, ইস্কুলে গেলেই তার দেখা পাবে সেটা ভেবেই খুশি খুশি লাগতো সেই মেয়ের।

তখন সহজপাঠের ঝামেলাও আর ছিলো না, কিশলয়ের বাংলা গল্প আর ছড়া/কবিতা, নবগণিতমুকুলের অঙ্ক, আর বাকী বাড়তি যা কিছু, সব তার ভালো লাগতে থাকলো কেবল দিদিমণির পড়ানো ভেবেই, এমন সুন্দর ছিলো তার পড়ানো। সেই দিদিমণিই তার প্রথম গুরু। যিনি জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দিয়ে মনের চোখ খুলে দেন তিনিই তো গুরু।

অল্পবয়সী দিদিমণি, ওনার নিজের মেয়েটি তখন মাত্র এক বছর বয়সের। প্রতিদিন ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়লে নাম ডাকার খাতা আর কলম হাতে দিদিমণি আসতেন। আগের দু'বছরের ক্লাসে যে মুহূর্তটা সবচেয়ে বিশ্রী লাগতো, এই দিদিমণির যাদুমন্ত্রবলে সেই মুহূর্তটাই হয়ে উঠেছিলো আমার সারাদিনের মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত। "আসছে, সে আসছে। "

সাধারণ হালকা রঙের সুতীর শাড়ী পরা, স্নান করার পরে ভেজা চুলগুলো একটা আলগা গেরো দিয়ে আটকিয়ে পিঠের দিকে মেলা। কোনো অলঙ্কার নেই, কপালে লাল টিপও না। খুব নরম, কিছুটা বিষাদমাখা মুখ। নরম গলায় কথা বলতেন, কোনোদিন খুব বিরক্তির মুহূর্তেও গলা তুলে জোরে ধমক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। অথচ ক্লাসের মধ্যে একসাথে প্রায় ত্রিশ / পয়ত্রিশটি বাচ্চা, কোনো কোনোটা তো রীতিমত বিচ্ছু। দিদিমণির কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি দেখি নি কখনো। ওনাকে দেখলেই কেন যেন কোনো এক মায়ের কথা মনে হতো, কারুর একার মা না, অনেকের মা, যেমন মা সারদা, যেমন মা টেরেসা। এমন একজন, যাকে ভরসা করা যায়, যার কথা শুনতে আর মানতে ইচ্ছে করে। মানতে হবে বলে নয়, মানতে ভালো লাগে বলে।

পরে জেনেছিলাম এরই কিছুদিন আগে এই দিদিমণির স্বামী অকালে মারা গেছিলেন ভুল চিকিৎসায়। সেই ভদ্রলোক কাছের এক হাইস্কুলে টিচার ছিলেন, খুব ভালো শিক্ষক বলে নামডাক হতে শুরু করেছিলো। কিন্তু সেই সময়েই এই বিপর্যয়। দিদিমণি তখন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই চাকরিটি পান অস্থায়ী শিক্ষিকা হিসাবে, প্রথম কয়েক বছর প্রাইমারিতে পড়িয়ে পরে বদলি হয়ে যান দূরের এক হাইস্কুলে। সারাজীবন একলাই কাটালেন, সন্তানটিকে মানুষ করলেন একলাই।

এর বেশ কয়েক বছর পরে যখন প্রথম জানতে পারলাম মাদাম কুরী আর পিয়ের কুরীর কথা, দেখলাম তাদের ছবি, বর্ণনা পড়লাম পিয়ের কুরীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর, বর্ণনা পড়লাম মাদাম পড়াচ্ছেন ফরাসীদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন আশ্চর্যভাবে সেই অচেনা বিদেশী পরিমন্ডল মুছে গিয়ে মাদামের মুখের জায়গায় ফুটে উঠলো আমার সেই দিদিমণির বিষাদকোমল মুখটি। এইভাবেই দেশকালে আবদ্ধ আমরা হয়তো আমরা স্পর্শ করে থাকি দেশকালের বাইরের কোনো ব্যপ্ত সত্যকে। কে বলতে পারে?

সেই সময়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো জানুয়ারী মাসের দুই তারিখ থেকে। মানে ইংরেজী বছর শুরু হবার সাথে সাথেই। ক্লাস থ্রীর ক্লাস শুরু হবার কিছুদিন পরেই শুরু হয়ে গেল আরেক সাজো-সাজো রব, বিরাট পুরস্কার বিতরণী উৎসব হবে, সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগের চার বছর হয় নি, সব পেন্ডিং পুরস্কারগুলো একসাথে দেওয়া হবে, তার জন্য দিদিমণিরা সব পুরানো আর্কাইভ উল্টেপাল্টে সন্ধান করছেন, তালিকা তৈরী করছেন, স্কুলের পরে অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে।

তার চেয়েও বেশী সক্রিয় কর্মকান্ড চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। সেই যে প্রাইমারি সেকশনের বেশীরভাগ শিক্ষিকার কথা বলছিলাম, তাদের নাচে আর গানে উৎসাহ বিরাট। তারা তো রীতিমত নাচের দল বানিয়ে ফেললেন প্রাথমিক স্ক্রিনিং টেস্ট নিয়ে, আর গানের জন্য আরেকদল নির্বাচিত হলো। কোরাসের জন্য একরকম স্ক্রিনিং টেস্ট, প্রধান গানগুলোর জন্য যাদের একলা কন্ঠদান, তাদের নির্বাচনের টেস্ট আলাদা, খুব চৌখোশ গাইয়ে চাই।

প্রধান অনুষ্ঠান পরীদের নাচ, সেই পরীরা আবার নানা রঙের, দু'জন দু'জন করে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আর সাদা পরীরা। সিমেট্রিকালি নাচবে রাজকুমারীর দুইপাশে। আহা আগে জানলে তো সেইখানেই খানিকটা শিখে ফেলতে পারতাম স্পেকট্রাম অ্যানালিসিস।

সে এক এলাহী কান্ড, কী রিহার্সালের ধূম। আমরা যারা কিনা নাচগান শিখতাম না, তারা দর্শক, বড় বড় চোখ করে দেখতাম ক্লাসের পরে। এসব আগে তো দেখিনি কিনা!

(চলবে)

ইস্কুলবেলার গল্প(৭)

ভর্তি হওয়াগুলো কেমন মিলেমিশে গিট্টু পাকিয়ে যায়। সেই কবে প্রথম বাড়ীর বাইরে পাড়ার বাইরে বেরোনো ইস্কুলে ভর্তির জন্য, সঙ্গে করে নিয়ে গেল অভিভাবকরা, বেরিয়ে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি, তারপরে সেই স্কুল থেকে বার হয়ে হাইস্কুলের ক্লাস ফাইভে ভর্তি, তারপরে কলেজ, তারপরে অনেক দূরে অচেনা বিদেশে গ্র্যাড স্কুল--সব অ্যাডমিশনগুলো মিলেজুলে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যেন সব কিছু একটা বিরাট মালার মতন, আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না বীডগুলো। আরে এ কী কান্ড! তাহলে মালার প্রথম কোনটা‌ শেষ কোনটা চিনবো কী করে? প্রথম ঘুরে আসে শেষের সাথে মিলে যেতে, আলো দৌড়ে এসে ছায়ার সাথে মিলে যায়।

মনে পড়ে মস্ত একটা গেট, গেট পার হয়েই মস্ত মস্ত দু'খানা আমগাছের ছায়ায় সিমেন্টের দু'খানা গোল গোল বেদী। পরে জেনেছিলাম ওখানে ছেলেমেয়েদের নিতে আসা লোকেরা বসে বিকেলবেলা। মনে পড়ে সকাল, শীতকালের ঝকঝকে রোদের সকাল। হাওয়ায় আমগাছের পাতা নড়ছে, গাছ নড়ছে, নিচে বেদীর উপরে ছায়াজাল ফেলা রোদ নাচছে। সেই প্রথম সেখানে ঢোকা, আমার ইন্টারভ্যু, কেজি ওয়ানে ভর্তির। সেদিনই আবার আরেক জায়গাতেও যেতে হবে এখানে হয়ে গেলেই, সেই ইস্কুলের ইন্টারভ্যুর দিনও একই দিনে পড়েছে। গেটের বাইরের চেনা রিকশাওয়ালা অপেক্ষায় রইলো, হয়ে গেলেই বাবা আমায় নিয়ে যাবে সেই আরেকটা ইস্কুলে।

পরে কতকাল সেই আমগাছের আলোছায়ার তলা দিয়ে এসেছি গেছি, দুপুরের টিফিনের পরে বন্ধুদের খেলেওছি কত, চু কিতকিত, কুমীরডাঙা, আর কত কী! কিন্তু প্রথম দিনের মতন লাগে নি আর কখনো। পরে অনেক বড় হয়ে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পরে যখন গেছি আবার, দেখেছি আসলে অত মস্ত বড় তো না গাছগুলো বা বেদীগুলো! কিন্তু সেই প্রথম আলোছায়ার ঘোর ভাঙে নি, সে যে স্মৃতির দেশ, স্বপ্নের দেশ, সেখানের জিনিসপত্র এখানের চেনাজানা জিনিসের মতন হতে যাবে কেন?

বারান্দা ভর্তি খুদে খুদে ছেলেমেয়ে, সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। নাম ডাকছে, এগিয়ে ঘরে ঢুকে যাই। একটা ঘর, সে ঘরে দু'জন মহিলা, ওনাদের দিদিমণি বলতে হয়, আমি জানতাম। আগেই যারা ইস্কুলে যেতে শুরু করেছে তারাই তো বলে দিয়েছে। কত কিছু জিজ্ঞেস করে দিদিমণি দু'জন, নাম ঠিকানা এইসব, তারপরে একের পর এক কাঠের আ ঈ ক খ এইসব দেখায়, এগুলো চেনাই তো, একটা ছড়া বলতে বলে, মায়ের শেখানো একটা ছড়া বলি, একটা ক্যালেন্ডারে হরিণের ছবি, দেখিয়ে জানতে চায় কীসের ছবি--এইসব। হয়ে গেলে একটা লজেন্স আর দুটো বিস্কুট দিয়ে হাসিমুখে বিদায় দেয়। বা:, বেশ তো! এরই নাম ইন্টারভ্যু? এরই জন্য এত ভয়টয় দেখাচ্ছিলো?

তারপরে আরেক ইস্কুলে ইন্টারভ্যু, সেখানে আবার ঘরবারান্দা সব আলাদারকম, সেখানে গেটের পাশে আমগাছ নেই, কিন্তু ঝকমকে রোদ্দুর, সেখানে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুনী নন্দিতা পড়ে। ও আগের বছর থেকে পড়ে। আহা এখানে হয়ে গেলে ভালো হয়। এখানেও নাম ডাকলো, ঘরে রাগী-রাগী চেহারার এক দিদিমণি, কিন্তু এই তো হাসছে, আর তো রাগী না! এখানেও নানা কিছু জিজ্ঞেস করে, কিন্তু এখানে ছবি নেই, ছড়া শুনতে চায় না, এখানে শুধু কাঠের অ আ ক খ দেখিয়ে দেখিয়ে জানতে চেয়েই হয়ে যায় ইন্টারভ্যু, এখানে শুধু হাসিমুখে বিদায় দেয়, লজেন্স বিস্কুট তো দেয় না!

তারপরে তো সেই গেটের পাশের জোড়া আমগাছের ইস্কুলেই ভর্তি হওয়া, পাশের বাড়ীর ছেলেমেয়েরা সব ওখানে যায়, তাই আমার বাড়ীর লোক মনে করলো সেটাই ভালো হবে। ওদের সাথে এক রিকশায় করে তাহলে প্রতিদিন যাওয়ার সুবিধা হবে। সেই ইস্কুলের মুড়ির টিনের মতন গাড়ী ছিলো বাচ্চাদের আনতে নিতে, কিন্তু আমাদের পাড়াটা কিনা বেশ দূরে, তাই ঐ গাড়ী আসতো না ওখানে। ওখানের বাচ্চাদের অভিভাবকেরা নিজেরা একজন রিকশাওয়ালাকে ঠিক করে তার রিকশায় বাচ্চাদের পাঠাতো।

সেই ব্যবস্থাই হলো। শুধু নন্দিতার মা একটু দুঃখিত হয়ে বলেছিলো, "কেন রে তুলি তোকে ওখানে ভর্তি করলো? আমার মেয়ের ইস্কুলেও তো তোর নাম উঠেছিলো, সেখানে দিলো না কেন?" তা এর আর আমি কী বলবো? বড়দের কান্ডকারখানার ঠিকঠিকানা থাকে কোনোদিন?

নন্দিতা ওর দাদার সঙ্গে যেত, ওদের বাড়ীর পাশের আরো ক'জনও যেত। ওদের ইস্কুলটা অন্যদিকে ছিলো, শর্টকাটে যাওয়া যেতো পাড়ার ভিতর দিয়ে দিয়ে। ও অবশ্য কোনোদিনই আমার সাথে এক সাথে পড়তে পারতো না, ও তো এক ক্লাস উপরে পড়তো। পরে প্রাইমারী ছেড়ে যে হাইস্কুলে আমরা ভর্তি হলাম, সেটা একই স্কুল ছিলো, কিন্তু ক্লাস তো চিরকালই আলাদা ছিলো।

আমার অবশ্য এখন মনে হয় এ ভালোই হয়েছিলো, বাড়ীর বন্ধুদের সাথে একই স্কুলে একই ক্লাসে না পড়াই একদিকে ভালো। নিঃশর্ত বন্ধুত্বের সাথে প্রতিযোগীভাব একসাথে থাকতে পারে না, এই দুই জিনিস মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ।

ওর সাথে তাই মনে রয়ে গেল ছুটির দুপুরের লাউমাচায় পায়রার বাসা দেখা, মনে রয়ে গেল কসমস টিভি সিরিজের কাহিনি শোনা, আমাদের টিভি ছিলো না বলে ও আমায় বলতো টিভিতে দেখে এসে, মনে রয়ে গেল বিকেলবেলার সবুজ মাঠে হরেক রকমের খেলা, মনে রয়ে গেল আমাদের অজস্র রবীন্দ্রজয়ন্তীর গান, কবিতা, নাটক। ক্লাস, পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা আর রেজাল্টের চারদেয়ালের মধ্যে হারিয়ে গেল না কিছু।

বিশাল খোলা মাঠের শেষে কখনো আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে, কখনো মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে, কখনো পালক মেঘে মেঘে আলোর ছবি রেখে সূর্য ডুবে যাওয়া গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরত-হেমন্ত-শীত-বসন্ত বিকেলগুলো হয়ে রইলো আমাদের মুক্ত বিদ্যালয়, বাজি রেখে বলতে পারি নিজেরা নিজেরা কথা কইতে কইতে শুনতে শুনতে খেলতে খেলতে হাসতে হাসতে রাগ করতে করতে খুশি হতে হতে যা শিখেছি, তার এক শতাংশও কোনো প্রথাগত শিক্ষার জায়গা আমাদের দিতে পারে নি।

পরের পর্বে আবার হয়তো ফিরে আসবো সেই প্রথম ইস্কুলে, কেজি ওয়ানের নিয়তি দিদিমণির গল্পে। ভাবা যায়, প্রথম শিক্ষিকার নাম ছিলো নিয়তি! একেবারে নিয়তির লিখন যাকে বলে!

Tuesday, March 25, 2014

অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(২)

উল্টোদিক থেকে আবার আরেক গেরো বাঁধিয়ে বসলেন কয়েকজন এক্সপেরিমেন্টালিস্ট৷ তাঁরা ইলেকট্রনের এমন এক ডিফ্রাকশন প্যাটার্ণ পেলেন যে লোকে তাজ্জব! ইলেকট্রনকে এতকাল কণা বলেই বোঝা যাচ্ছিলো, অথচ কিনা শেষে তার এই চিত্র! ডিফ্রাকশন শুধু তরঙ্গের হতে পারে, কণার ক্ষেত্রে হয় না৷ কণা একই সময়ে একটিমাত্র বিন্দুতেই থাকতে পারে, তাই তার বিন্দুচিত্রই পাবার কথা, কিন্তু তরঙ্গ স্পেসে ছড়িয়ে থাকে, তার ডিফ্রাকশন পাওয়া যায়৷যেমন আলোর বা এক্সরের ডিফ্রাকশন হয়৷ কিন্তু ইলেকট্রনের পাওয়া গেলো, পরে অন্য কোয়ান্টাম পার্টিকলেরও৷

তখন লুই দ্য ব্রগলী এক হাইপোথিসিস দিলেন, বললেন সমস্ত ভরবেগসম্পন্ন পার্টিকলের মধ্যেই আছে তরঙ্গধর্মীতা, নেহাত বড়ো বড়ো পার্টিকলের ক্ষেত্রে এটা বুঝতে পারা যায় না,কারণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য খু-উ-উব কম৷ তিনি সমীকরনও দিলেন,ওয়েভলেংথ = প্লাংক ধ্রুবক/ মোমেন্টাম৷

আস্তে আস্তে নানা পরীক্ষায় ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেলো৷ বোঝা গেলো ক্ষুদ্র জগত্টা আমাদের দেখা জগতের মতন নয়, সেখানে কণা ও তরঙ্গ আলাদা করে সুসংজ্ঞিত করা যায় না৷ ডুয়ালিটি ধারনাটা তখনি এলো৷ সমস্ত ইলেক্টোম্যাগ্নেটিক ওয়েভ যেমন তরঙ্গ তেমনি কণাও৷ তেমনি প্রতিটি কোয়ান্টাম পার্টিকল একাধারে কণা ও তরঙ্গ৷

পরে এই ব্যাপারটা হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিংগার আরো ভালো করে গণিতের ফ্রেমে বসান৷হাইজেনবার্গ আবিষ্কার করেন অনিশ্চয়তা তত্ব৷ কোনো একটি কোয়ান্টাম পার্টিকলের ভরবেগ যত নিখুঁত জানতে চেষ্টা করা হবে,তত তার অবস্থান সম্পর্কে ধারনা কমবে৷ যত নিখুঁত মাপতে চেষ্টা করা হবে একটি প্রপার্টি, তার কনজুগেটটি সম্পর্কে ততই কম নিখুঁত হবে মাপ৷ দুটোর গুণফল হবে একটি নির্দিষ্ট মানের বেশী, সেই মানটি প্লাংক ধ্রুবকের সঙ্গে তুলনীয়৷

আর এই মাপা বা পর্যবেক্ষণ কোয়ান্টামে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ যতক্ষণ না মাপা হচ্ছে বা কোনোরকম পর্যবক্ষণের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে কি তার এনার্জী বা মোমেন্টাম বা পোজিশন, ততক্ষণ পর্যন্ত নাকি সেই সেই অবস্থাগুলো নির্দিষ্ট থাকে না,থাকে অনেকগুলো সম্ভাবনার সমষ্টি হয়ে যাকে কিনা এরা বলেন সুপারপোজিশন অব স্টেটস৷

এই ধারনা জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা প্রচন্ড চ্যালেঞ্জের ব্যাপার৷ আমাদের মাপার বা পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতাটাকেই একটা নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তার উপরে একটা হার্ডকোর জ্ঞানের ক্ষেত্র তৈরী, রীতিমতো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার৷ কিন্তু মজা হলো সব পরীক্ষায় সমর্থন পাওয়া যেতে লাগলো৷ আরো আরো সূক্ষ্ম যন্ত্র আরো আরো সূক্ষ্ম পরীক্ষা, আরো আরো সমর্থন৷ না মেনে উপায়? কাজে লেগে যেতে লাগলো যে! আইনস্টাইন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অদ্ভুত্ বিজ্ঞানকে মেনে নিতে পারেন নি৷ তিনি চিরকাল বলেছেন এ সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নয়, একটা অসম্পূর্ণ তত্ত্ব৷ এটা আরো গভীরতর সত্যের বাইরের ঢাকনা শুধু৷ কিন্তু পরীক্ষায় যদি ক্রমাগত সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে কি আর করা যাবে?

আইনস্টাইন ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্টের ব্যাখার জন্য নোবেল পান বটে,কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী চমকে দিয়েছিলেন রিলেটিভিটি দিয়ে৷ এখন প্রায় শতখানেক বছর হয়ে গেলো তিনি আবিষ্কার করেন প্রথমে বিশেষ আপেক্ষিকতা পরে সাধারণ আপেক্ষিকতা৷ এই দুটো আমাদের জানার জগত্টাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলো প্রচন্ড৷

ম্যাক্সোয়েলের ইলেকট্রিসিটি আর ম্যাগনেটিজমকে মিলিয়ে দেয়া চারটে সূত্র জানা যাবার পর থেকেই জানা ছিলো ইলেক্টোম্যাগনেটিক ওয়েভেরা সব কোনো মিডিয়া ছাড়াই ভেক্টর ফিল্ডের ওঠানামার তরঙ্গ হিসাবে স্পেসে ছড়িয়ে পড়ে৷ আর শূন্যে এদের গতিবেগ সবসময় সমান,সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, আলোর বেগ৷ সর্বদা এই গতি৷

আইনস্টাইন তরুণ বয়স থেকে এই নিয়ে ভাবতেন৷ তিনি ভাবতেন যদি তিনি একটা গাড়ীতে চড়ে অন্য গাড়ীর পাশাপাশি চলেন তাহলে নিজের সাপেক্ষে অন্য গাড়ীটার গতি কমতে বা বাড়তে দেখেন৷ আলোর ক্ষেত্রেও কি তাই দেখবেন? উনি যদি আলোর সঙ্গে তুলনীয় প্রচন্ড গতিতে ছুটতে থাকেন, তাহলে কি হবে? নিজের সাপেক্ষে আলোর বেগ কি অনেক অনেক কম দেখবেন? এটা আবার ম্যাক্স-ওয়েলের ধারনার বিরোধী, ইএম ওয়েভের গতিবেগ একই থাকবে বলছে ম্যাক্সোয়েলের সূত্র৷

এই পাজল থেকে দুনিয়া উদ্ধার করতে বহুলোকে চেষ্টা করেছেন,তাত্বিকভাবে যারা চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে লোরেঞ্জ আর ফিটজেরাল্ড প্রথম সারির৷ লোরেঞ্জ কতগুলো সঠিক ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন, স্পেসের তিনখানা কো-অরডিনেট আর টাইমের একখানা -এই চারটের ট্রান্সফর্মেশন দিয়েছিলেন৷ সেগুলো পরে আইনস্টাইন ব্যবহার করেন সঠিক ধারনার ফ্রেমের উপরে৷ মাইকেলসন আর মর্লির পরীক্ষাতেও প্রমান হয় আলোর গতি সর্বদা একই থাকে,আমরা তার দিকে ছুটে যেতে যেতেও তার বেগ ঐ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইলই দেখি৷ বেশী দেখি না৷

এই পাজলকে বিশেষ আপেক্ষিকতা দিয়ে সলভ করেন আইনস্টাইন৷ তিনি উলটোদিক থেকে আসতে শুরু করেন, ঐ থিওরি শুরুই করেন দুখানা স্বত:সিদ্ধ নিয়ে, ১ হলো আলোর বেগ সবসময় সেকেন্ডে তিন লাখ কিমিই থাকবে, কোন রেফারেন্স ফ্রেম থেকে দেখা হচ্ছে তার উপরে কোনোভাবেই নির্ভর করবে না৷ ২ হলো সমস্ত ত্বরনহীন রেফারেন্স ফ্রেমে ফিজিক্সের সূত্রসমূহ একই থাকবে৷

মাত্র এই দুখানা সরলসহজ ধারনা দিয়ে শুরু হয়ে গড়ে উঠলো স্পেশাল রিলেটিভিটি৷ এই তত্বে ভর করে জানা গেলো সময়ের মাপ অন্যরকম হয়ে যাওয়া, যাকে বলে টাইম ডাইলেশন, গতির সমান্তরালে রাখা দন্ড বেঁটে হয়ে যাওয়া যাকে বলে লেংথ কন্ট্রাকশন৷ তাই থেকে সেই যমজ ধাঁধার ব্যাপার এলো, আমার ঘড়ির এক সেকেন্ড যদি আমার মহাকাশযাত্রী যমজ ভায়ের ঘড়ির আধা সেকেন্ড মাত্র হয়, তাহলে আমার যখন চল্লিশ বছর কেটেছে,ওর মাত্র কুড়ি৷ সে ফিরে এলো আমার ষাট বছর বয়সে, নিজে মাত্র চল্লিশ!!! ওদিকে আবার ব্যাপারটা আপেক্ষিক! মানে সেই ভাইও মনে করেছে আমার ঘড়ি আস্তে চলেছে ওর তুলনায়৷ জবর ধাঁধা! পরে স্পেশালের বছর দশেক বাদে জেনারেল রিলেটিভিটি দিয়ে সমাধান করা হলো এর৷ সেই গলপ পরের কিস্তিতে।

অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(১)

এই গল্পের শুরু হলো আগুনের রঙ ফলানো থেকে৷ বুনসেন আর কির্চফের কাজকর্মের গল্প। দূরের আলোক-উত্সের আলো যেতে দেয়া হলো প্রিজমের (বা গ্রেটিংএর) মধ্য দিয়ে৷ আলোর স্পেকট্রাম পাওয়া গেলো, মানে নানারঙ৷ বাঁদিকে বেগুনী থেকে ডাইনে লাল পর্যন্ত৷ বেগুনী নীল আশমানী সবুজ হলুদ কমলা লাল৷ বাঁদিক মানে কম ওয়েভলেংথ আর ডানদিক বেশী ওয়েভলেংথ৷ আজকালের হ্যান্ড হেল্ড স্পেকট্রোস্কোপে দেখেছি একেবারে স্কেলকাটা থাকে, ন্যানোমিটার ইউনিটে৷ কঠিন উত্স হলে বা ঘন গ্যাস হলে পাওয়া যায় কন্টিনুয়াস, রঙের চওড়া চওড়া ব্যন্ডগুলো পাশাপাশি মিশেমিশে থাকে, রামধনুটি ঝলমলে,লাইনটাইন কিছু থাকে না৷

গ্যাসীয় মৌলকে খুব পাতলা করে অল্প চাপে টিউবে রেখে উপরে নীচে ইলেকট্রোড জুড়ে স্পার্ক মেরে জ্বালানো হলো৷ সেই আলোর স্পেক্ট্রাম ফলিয়ে তো লোকে তাজ্জব! সরু সরু লাইন দেখা যায়৷ বিশেষ বিশেষ ওয়েভলেংথে লাইন! লাল লাইন৷ বেগুনী লাইন!

কী অদ্ভুত! মনে রাখতে হবে তখনো কিন্তু শক্তির কোয়ান্টাম চরিত্র সম্পর্কে লোকের কোনো ভালো ধারনা ছিলো না৷ শক্তি যদি অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, কন্টিনুয়াস হয়, তাইলে এমন লাইন হওয়ার কথাই নয়!

পরে প্লাংক বোর আইনস্টাইন সবাই মিলে লড়ে টড়ে খাড়া করলেন শক্তির বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব৷ শক্তি বিকিরিত হয় কোয়ান্টামে৷ অ্যাটমের নানা নির্দিষ্ট এনার্জী স্টেট থাকে, একটা থেকে আরেকটায় যখন যায় তখন সেই পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে৷ কন্টিনুয়াস যায় না, সাডেন চেঞ্জ হয়৷ এটাকে ইলেকট্রনের কক্ষ থেকে কক্ষে ঝাঁপমারার ছবি দিয়ে বোঝা যায় ভালো যদিও ও ছবিতে লুপহোল আছে৷ (মানে ঝাঁপ দেয় কোথা দিয়ে? দুইকক্ষের মাঝে তো থাকতে পারেনা ইলেকট্রন! তাইলে এক কক্ষে অদৃশ্য হয়ে কি অন্য কক্ষে ভুস করে ওঠে?) তবে মোটের উপর বোঝা গেলো শক্তির এই কোয়ান্টা আইডিয়া দিয়ে লাইনগুলো ব্যখা করা যাবে৷

শুধু এই স্পেকট্রাল লাইন না, আরেকটা জিনিসও খুব বিপদে ফেলে দিয়েছিলো লোকেদের৷ সেটা হলো ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট৷কোনো কোনো মৌলের পাতে আলো বা অন্য কোনো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পড়লে ফটাশ ফটাশ করে ইলেকট্রন ছিটকে ছিটকে বেরোয়৷ দেখা গেলো একেবারে ইন্সট্যান্টলি বেরোয়, একটুও টাইম ল্যাগ থাকে না৷কিন্তু ওয়েভলেংথ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এক একটা নির্দিষ্ট ওয়েভলেংথের আলো পড়লেই শুধু ইলেকট্রন বেরোয়, নাহলে বেরোয় না,ঘন্টা ধরে আলো ফেল্লেও বেরোয় না৷ দেখেশুনে লোকে বিরক্ত৷শক্তি কন্টিনিউয়াস হলে এরকম মোটেই হোতো না৷

তো, আইনস্টাইন করলেন কি, প্লাংকের কোয়ান্টাম আইডিয়াটাকে নিয়ে ফটাফট এখানে লাগিয়ে দিলেন৷ ছোটোখাটো কতগুলো ইকোয়েশন E=h*frequency, h হলো প্লাংক ধ্রুবক, এই ধরনের সহজ সহজ সমীকরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে আলো বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন নির্দিষ্ট মানে এলে এইরকম হতে পারবে৷ এই কাজের জন্য তিনি বেশ কবছর পরে নোবেল পেলেন৷

Thursday, March 20, 2014

নীলা

1.

আমাদের ছোট্টো নদীটার চরে চখাচখীর মেলা বসতো। শুনেছি তারা নাকি প্রেমের পাখি। নদীতটের মাখনরঙের বালিতে রূপোরঙের ভোর থেকে কমলা সাঁঝ অবধি দিনজুড়ে ঠোঁট ঠোঁট মেলানো সখ্য! সাঁঝের তারা উঠলে তারা আলাদা হয়ে উড়ে যায় বিরহের রাত জুড়ে প্রেমের কঠিন তপস্যায়। কেজানে, এসব সত্যি না গল্পকথা!

তপতপে রোদ্দুরের চৈত্রদিনের শেষে মনকেমনিয়া দখিণা হাওয়া বয় শান্ত স্নিগ্ধ সন্ধ্যায়, ক্লান্ত শরীর এলিয়ে ছাদে বসে থাকি। থাম বেয়ে বেয়ে ছাদের পাঁচিলে উঠে আসা জুঁইফুলের লতায় ফুটেছে একটা দুটো তিনটে ফুল, হাওয়া তার সৌরভ চুরি করে নিতে নিতে ফেলে যায় কিছু। আকাশে তাকিয়ে দেখি শ্যামলী কিশোরীর টলটলে অশ্রুর মতন ফুটে উঠেছে সাঁঝের একলা তারাটি। মনে পড়ে, তখনই মনে পড়ে তোর কথা।

সেদিনও এমন চৈত্রসন্ধ্যা ছিলো। তুই আমাকে বলেছিলি " নীলা, নীলা, সেই কোন ছোটোবেলা থেকে একসাথে খেলাধূলা করে বড় হচ্ছিলাম আমরা! তুই, আমি কত কাছে কাছে ছিলাম। তারপরে....তারপরে কখন আমরা দূরে চলে গেলাম নীলা? কাছে থেকেও কত দূরে!" তোর গলায় অপার্থিব বিষাদ এসে জড়ো হয়েছিলো। আমি শুধু চেয়ে দেখছিলাম তোর মাথার পিছনে দূরে গাছের মাথায় জ্বলছে নিভছে একঝাঁক জোনাকি।

আমি জানতাম সৌম্যকে তুই মিথ্যা কথা বলে বিষিয়ে দিয়েছিলি আমার সম্পর্কে! তুই পাগলের মতন প্রেমে পড়েছিলি, কিছুতেই ভাবতে পারছিলি না সৌম্য অন্য কাউকে ভালোবাসবে। তুই দিশাহারা উন্মাদিনী হয়ে গেছিলি সেই সময়। সব জেনেও আমি তোকে ক্ষমা করেছিলাম, সৌম্যর ভুল ভাঙাই নি।

সে যখন সর্বস্বান্তের মতন এসে আমার কাছে বললো, "তুমি একবার বলো নীলা, একবার শুধু বলো ওকথা ভুল, তুমি ও কাজ করো নি, করতে পারো না।" আমি একটি কথাও বলিনি তখন, না। পাথরের বাঁধ দিয়ে আটকে ফেললাম আমার অশ্রুসমুদ্র। তুই যে আমার বড় প্রিয় ছিলি রে শুক্তি, নিজের বোন থাকলেও সে বুঝি আমার এত প্রিয় হতো না। তাই তোকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে তোর ভালোবাসাকে চূর্ণ করা আমার স্বপ্নের অগোচর ছিলো। আমি চেয়েছিলাম তুই সুখী হ, তাতে আমার যা হয় হোক। এমনিতেও তো জীবনের কাছে আমার পাবার কিছু ছিলো না।

আজ কি বুঝতে পারিস শুক্তি? তোরা বাইরে চলে যাবার আগে সেই সন্ধ্যায় যখন আমার কাছে বিদায় নিতে এসেছিলি সেদিনও কি বুঝতে পেরেছিলি? তাই কি আকাশভরা বিষাদ ছিলো তোর গলায়? আমিই কি তাহলে ভুল ছিলাম? মিথ্যার ভিতের উপরে ভালোবাসার প্রাসাদ যে গড়া যায় না সেকথা কি জানিয়ে দেওয়াই উচিত ছিলো? তিন তিনটে জীবন কি তাহলে এমন নিরর্থক হয়ে যেতো না?

টলটলে সন্ধ্যাতারা ঝাপসা হয়ে যায় জলে, সব মুছে দিয়ে জেগে ওঠে তোর নীল হয়ে যাওয়া মুখ, ঠোঁট, চোখের পাতা। কেন কেন কেন শুক্তি? এমন কী ভাঙাচোরা কাটাছেঁড়া হয়েছিলো ভালোবাসার মলম দিয়ে যা জুড়ে দেওয়া যেতো না? নাকি তুই বুঝতে পেরেছিলি যাকে ভালোবাসা ভেবেছিলি তা ছিলো উন্মাদ মোহ?

না, সৌম্য আসে নি আমার কাছে। হয়তো সে বুঝেছে, হয়তো বা বোঝে নি। কী আসে যায়! আমিও তো তাকে সত্যি করে চাই নি! চাইলে কি অত নির্বিকারে সরিয়ে দিতে পারতাম? নির্বিকারেই কি? কেজানে!

দিনের পরে দিন যাবে, রাতের পরে রাত। এমনি করে মোহনা আসবে একদিন আমারও। আবার একদিন দেখা হবে রে শুক্তি, সেদিন তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। জানি, সেদিন তুই ঠিক উত্তর দিতে পারবি। আমারও যে ক্ষমা চাইবার আছে তোর কাছে! জানি তুই করবি, পৃথিবীর ছোট্টো পাথরঘরে যে ক্ষমা ধরে না, আকাশের ওপারে আকাশ সেই ক্ষমায় ভরে আছে। রাত হলো, আসি এবার। ভালো থাকিস রে।

2. এই পথ পাকদন্ডীর মত, ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়কে বেড় দিয়ে চূড়ার দিকে উঠছে। সেখানে কী আছে? সেই গল্পের মিনার, সেই অলৌকিক জ্যোৎস্নাপক্ষী, লৌকিক গল্পে যার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা উত্তাল হয়ে উঠেছে? জানি না।

ঘুর ঘুর ঘূরণপথে চলতে চলতে কুয়াশা সরে গিয়ে চমকে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ গাঢ় কমলা ফুল! সেই ফুল ছোঁয়ার আর্তি আঙুলের ডগায় নিয়ে বাতাস মাখা। কবে যেন এমন ফুলেদের দেখেছিলাম? সে কি কোনো শরতে নাকি বসন্তে? মনের কথাগুলো কি গুণগুণি পাখি হয়ে যায়, ছটরফটর করতে করতে পাখা ঝাপটে আকাশে পাড়ি দেয়? "পাগল বসন্তদিন এসেছিলো আমার আঙিনায় ....." সে কেমন পাগল? যে পাগল কেবল পাগল করে বেড়ায়?

ক্লান্তি জড়িয়ে ধরে নরম আদরে। চিকরিচিকরি পাতাওয়ালা গাছটার ছায়ায় বসি। ঐ একটু দূরের ঝর্ণাটা এখানে এক উচ্ছল কিশোরী নদী হয়েছে, পাথরে পাথরে খুশি খুশি ফেনা মাখিয়ে মাখিয়ে খেলতে খেলতে এগিয়ে যাচ্ছে নিচের মাঠের দিকে। শত শত মাইল পার হয়ে ও কি সমুদ্রে পৌঁছাতে পেরেছিলো? নাকি মাঝপথেই কোনো আশ্চর্য নীলনদ তাকে বুকে টেনে নিয়ে বিলুপ্ত করে দিয়েছিলো গভীর একাকারতায়? নাকি কোনো মরুভূমি শুষে নিয়েছিলো ওর সুধা? কেজানে! কিন্তু সব নদীই আসলে সাগরে পৌঁছায় ঠিকই। জলের সাগর বা আকাশের অদেখা সাগর! নইলে নতুন হবে কিকরে সে? আমার এই ব্যবহৃত জীর্ণ জীবনও যেমন একদিন মরণতীর্থে পৌঁছাবে।

নাহ, আর বিশ্রামে কাজ নেই, উঠে দাঁড়াই, ধুলাবালি কুটোকাটা ঝেড়ে ফেলি পোশাক থেকে। উপরে তাকাতেই রোদ্দুরের এক টুকরো সোনালী বাতাসা এসে পড়ে চিবুকে। চিরল-চিরল পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে সূর্য বলছে টুকি টুকি টুকি!

রুমী হাসছে, বলছে, " হয়ে গেল বিশ্রাম? চল তবে আবার রওনা হই।"

আমার গলায় আগ্রহ, "রুমী, কী আছে ওখানে?"

রুমীর চোখে দুষ্টু হাসির একটা ঝিলিক খেলে যায়, জবাব না দিয়ে সে গান শুরু করে, " কী ঈ ঈ আছে পথের শেষে"।

রাগ করে একটা ধাক্কা দেবার জন্য হাত তুলি, হাত শুধু ছুঁয়ে যায় একমুঠো বাতাস। আস্তে আস্তে আলগা মুঠো থেকে উড়ে যায় চিরকুটটা! রুমীর লেখা প্রথম চিঠি, কত বছর আগের সেই বসন্তোৎসবের সন্ধ্যা-উড়ে গেল সেই সব আকাশ রাঙানো পলাশ শিমূল অমলতাস, মনকেমনিয়া হাওয়ায় ভেসে আসা কুহু কুহু, সেই লাল সবুজ গোলাপী নীল আবীর, উড়ছে উড়ছে ঐ তো আমাদের কৈশোর উড়ে গেল চিরকুটের ডানায়। এ চিরকুটের কথা জানতো শুধু দু'টি মানুষ, আজ জানলো বাতাস, আকাশ, বনের ছায়াসবুজ।

রুমীর গানের গলা চমৎকার ছিলো, সে ছবিও আঁকতো খুব সুন্দর। কিন্তু ওর বাবামা তাকে চালচুলোহীন গায়ক বা ভবঘুরে চিত্রশিল্পী হিসাবে দেখতে চাইলো না। রুমী ও অভিমান করে ছেড়ে দিলো সব। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, এমনকি কবিতা পড়াও। কারিগরী বিদ্যা শিখতে যখন সে গেল দেশের অন্য প্রান্তে তখন তার পরিবারের সবার খুশি আর গর্ব দ্যাখে কে! ছেলে পড়েশুনে পাশ করে বড় চাকরি করবে, টাকাপয়সায় থৈ থৈ করবে তার দুনিয়া।

আরো একপাক ঘুরে গেছি এখন। রুমীর সঙ্গে তাল রাখতে পারি না। এরা এত তাড়াতাড়ি হাঁটে কেমন করে আর কেনই বা? আরেকটু আস্তেধীরে চললে কী এমন মহাশাস্ত্র অশুদ্ধ হয়? হাওয়া এখন হালকা, রোদ আরেকটু কড়া। আকাশ আরো নীল লাগে। হাতের মুঠো আলগা করে বাতাসে ভাসাই ওর দ্বিতীয় আর শেষ চিঠিটা। দূরের শহর থেকে লিখেছিলো আমাকে, অনেক কায়দা করে ওর বোনকে লেখা চিঠির খামের মধ্যে আরেকটা ছোটো খামে ভরে দিয়েছিলো। ওর বোন আমাকে লুকিয়ে এনে দিয়েছিলো চিঠিটা। চিঠির সমস্তটা জুড়ে বন্দী পাখির ডানা ঝাপটানি। সেই চিঠি কানের কাছে নিয়ে চুপটি শুয়ে শুয়ে সেই ডানার আর্তি শুনেছিলাম সারারাত। আমার আর কী করার ছিলো? কিছু কী করতে পারতাম? আজ এতদিন পরে সেই পাখি খাঁচা খুলে উড়ে গেল।

পৌঁছে গেছি চূড়ায়, একদিকে ভয় ধরানো খাদ, অনেক নিচে চিকচিক করে নদীটা। কিন্তু উপরে শুধু নীল, নীল, আরো নীল। অপরাজিতার মত নীল। আকাশ ছড়ায়ে গেছে কোথায় আকাশে....পালকের মতন সাদা মেঘেরা ভাসে ঐ নীল সমুদ্রে। আহ, কী সুন্দর!

রুমী, রুমীঈঈঈই, আমি বুঝতে পেরেছি, আমি দেখতে পেয়েছি সেই ম্যাজিক দরজাটা। খুলে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে দরজাটা। পালকের মতন হালকা লাগছে। চিঠি দু'খানা পেলি তুই? ও দুটোর মতন এবার আমিও...



Monday, March 3, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৬)

বাইরে আলোছায়ার খেলা চলছে আর হাত ধরাধরি করে আমরা দু'জন পরিপার্শ্ববিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে গেছি আমাদের কিশোরীবেলায়। সেই তখন, যখন আমাদের বিশ্বাস ছিলো কাঁচা আর বিশুদ্ধ, যখন আমাদের মনের মোড়কটা কচ্ছপের খোলার মতন হয়ে যায় নি।

বৃষ্টি ঝরানো মেঘের মতন আমরা হালকা হয়ে যেতে থাকি। কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। কতটা? হয়তো মিনিট কুড়ি পঁচিশ কি তারো কম। আমাদের মনে হয় যেন যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। সেই আঠেরোর খোলসের মধ্যে সময়ের স্রোত এড়িয়ে পিউপার মতন যে দু:খ বন্দী হয়ে ছিলো, তা আস্তে আস্তে সময়জলের ছোঁয়ায় মুক্ত হয়ে উড়ে গেল বাতাসে। আমরা শান্ত হয়ে আসি দু'জনেই, এখন আবার হয়তো নিরাসক্ত পর্যবেক্ষকের মতন কথা বলতে পারবো সেই ঘটনা নিয়ে।

হ্যাঁ, সেই উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট। সে জিনিস যা হয়েছিলো তা ছিলো একেবারেই আমাদের সব হিসাবের বাইরে। আসলে হয়তো চারপাশের মানুষদের আর শিক্ষিকাদের এত এক্সপেক্টেশান আমাদের নিজেদের সম্পর্কেও ও লার্জার দ্যান লাইফ একটা ধারণার জন্ম দিয়েছিলো। আমরা ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম "কেন হবে না? এখান থেকে, এই অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল থেকেও সম্ভব হবে রেকর্ড নম্বর তোলা। মাধ্যমিকে সম্ভব হলে কেন উচ্চমাধ্যমিকে হবে না? "

আমাদের ধারণা আর অনুমানে মারাত্মক ভুল ছিলো। ক্যানিউটের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতার কেউ ঠিকই আমাদের সীমা নির্দেশ করে দিলো, "দাস ফার অ্যান্ড নো ফারদার।"

সব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, সব হিসেব ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে সঙ্গে যারা জয়েন্ট দিয়েছিলো তারাও পেল না কেউ। পরবর্তীকালে যে বিষয় নিয়ে যেভাবে লেখাপড়া করবে ভেবে রেখেছিলো এক একজন, সব বদলে গেল। কেউ কেউ দুনিয়া থেকেই পালালো জীবন ঠিক করে শুরু হতে না হতেই।

"অন্বেষা, আমি তখন তোর সাথে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম নানা ঘটনার আবর্তে। এতকাল পরে সাগরপাড়ে ফের তোর সঙ্গে দেখা হবার আগের কথা তো তেমন জানি না। সেই দিনগুলো কেমন করে কেটেছে তোর?"

অন্বেষা নিজের কপালের আর চোখের উপরে হাত বোলাতে থাকে কিছুক্ষণ। তারপরে হেসে উঠে বলে, " আরে তখন তো অনেকের ঘোর উল্লাস। সুদে আসলে পুরিয়ে শুনিয়ে দিয়ে যেতো কেমন করে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল, কেমন করে আর কোনো প্যানাশিয়া দিয়েই এ রোগ আরোগ্য করা যাবে না। মানুষ এককালে যাকে মেটাফরিকালি কাঁধে তুলেছে সে যখন আছড়ে পড়েছে, সেটা সেলিব্রেট করবে না? রাজনীতিতে নামতে চাইলে নামতে পারি মনে হয়, একটা ভালো ট্রেনিং হয়ে গেছে তখন।"

এবারে আমিও হেসে ফেলি, সত্যি আমাদের লোকেদের সব কিছুই এত তীব্র আবেগে জরজর। কেউ জিতলো তো তাকে নিয়ে লাগামছাড়া লোফালুফি শুরু হলো। আবার কিছু বছর পরে সে যখন হারলো তখন " আরে তুই মরলি নে কেন? " টাইপের এক্সট্রীম সমালোচনা।

অন্বেষার মুখের উপরে একটা হালকা ছায়া, ও বলে, "শুধু আজও কষ্ট হয় শক্তিস্যরের আচরণের কথা ভেবে। ভদ্রলোক আমাকে ফিজিক্স পড়াতেন এগারো বারোয়, ওনার বাড়ীতে প্রাইভেট ব্যাচ ছিলো, তবে আমাদের কয়েকজনকে আলাদা করে ছোটো ব্যাচে পড়াতেন শনি-রবিবার। কত উৎসাহভরে হাইজেনবার্গ বোর শ্রোডিংগার এদের গল্প করতেন। সেই লোক রেজাল্টের পরে বাড়ী বয়ে এসে আমাকে বলে গেলেন আমার কিছুই নাকি আর হবে না, কিছুই আর হবার নেই। কোনো ওষুধেই এ রোগ সারবে না। এবারে বিয়ে থা করে আমাকে সংসার টংসার করতে হবে।"

আমি হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরি আবার, "মানুষ চেনা শক্ত রে। মাফ করে দে, উনি জানতেন না কাকে কী বলছেন।"

অন্বেষা হাসে, বলে, "সেদিন আমারও সেইরকমই মনে হচ্ছিলো রে। মনে হচ্ছিলো সামনে অন্ধকার একটা লবণসমুদ্র, কোথাও কোনো আশার আলো নেই। হাতেপায়ে জোর নেই, দু'চোখে ঘুম নেমে আসছে। মনে হচ্ছিলো অনেক তো হলো, আর কেন, এখন সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়া যাক। আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো হয়তো কোথাও কিছু ভুল হয়েছে, স্ক্রুটিনি করতে দিলেই হয়তো ধরা পড়বে। এরকম সব এলোমেলো ভাবনা, কী অদ্ভুত আমাদের ব্যবস্থা, কী আলগা জিনিসকে ধ্রুব বলে বিশ্বাস করতে শেখায়। স্কিল না, নলেজ না, কতগুলো নম্বরকে মোক্ষ বলে ধরে নিতে হয়, সেইগুলো ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই, প্রমাণ দেবারও উপায় নেই।"

আমি আস্তে আস্তে বলি, "তারপরে? মরণগুহা থেকে কী করে তুই বেরিয়ে এলি জ্যান্ত? "

অন্বেষা বলে, " বেরুলাম কি? কেজানে? হয়তো সেখানেই মরে গেছি, বেরিয়ে এসেছে আমার পাথরমূর্তি, সিমুলেশন। এখন মনে হয় সেদিন যখন সব আশা ভরসা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, তখন তার সঙ্গে গেল আমার মিথ্যা অহঙ্কারও। ভালোই হয়েছিলো একদিকে। সব আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলো। সব আবার নতুন করে ঢেলে সাজাতে হলো। তবুও ভাবি সেসময় ওভাবে সব না ভেঙে গেলে সেই পুরানো ধ্যানধারণা থেকেও তো বেরুতে পারতাম না। এক ভিশাস সাইকল থেকে আরেক ভিশাস সাইকলে ঢুকে যেতাম। এখন মনে হয় সেই বিপর্যয় শাপে বর হয়েছিলো।"

আমি বলি, "আমারও তাই মনে হয়। ঐ নম্বরের জন্য বড় শহরের কলেজে পড়া হোলো না তখন, ছোটো টাউনের কলেজেই পড়তে হোলো বটে কিন্তু পরে মনে হলো আশা-আকাঙ্ক্ষার বড় কলেজে গিয়েও যদি দেখা যেতো সেখানেও একইরকম মিনিংলেস মুখস্থবিদ্যা আর জীবনের সাথে যোগাযোগহীন সব পাহাড়প্রমাণ সিলেবাস, কেউ কোনো কিছু বোঝানোর বা বোঝারও চেষ্টা করে না, মুখস্থ করিয়ে বৈতরণী উতরে দিতে চায় শুধু, তাহলে মন আরো ভেঙে যেতো। "

অন্বেষা হেসে বলে, "ঠিকই বলেছিস রে তুলি। আমি কলেজের ঐ বছরগুলো কাটালাম সিডেটিভ দেওয়া রোগীর মতন, কেবল প্রার্থনা করতাম "ভোর কখন হবে? হয় আমার জীবনরাত্রি ভোর হোক না হয় এ অসহনীয় সময় শেষ হোক। কিছুটা জ্যান্ত মন অনুসন্ধিৎসু মন যেন বেঁচে থাকে, সবটা যেন না ক্ষয় হয় এই গ্রাইন্ডিং মেশিনে।"

আমি বলি, "প্রার্থনা তোর পুরেছে। টানেলের অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিস। অনেকে পারে নি রে। চন্দ্রার কথা মনে আছে? স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলো, ভালো গানও গাইতো। অঙ্ক অনার্স নিয়ে পড়ছিলো, সেকেন্ড ইয়ারে নিজেকে শেষ করে দিলো। সবকিছু নাকি তেতো লাগছিলো। আর পারমিতা, সেও বায়োলজি অনার্স নিয়ে পড়ছিলো, মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করলো। আমায় বলেছিলো যা মন থেকে চাই তা যখন করতেই পারবো না অ্যাকাডেমিয়ায়, তখন মিছে দেয়ালে মাথা ঠুকে লাভ কী? তার চেয়ে সম্মানজনক রিট্রীট ভালো। মন দিয়ে সংসার করলে হয়তো কিছু ভালো পেতেও পারি। হয়তো তিরিশ বছর পরে আমার সন্তানের ক্ষেত্রে দেখতে পারবো জগদ্দল পাথর সরেছে, অচলায়তন ভেঙেছে। সত্যিকারের অনুসন্ধানী গবেষণা তারা করতে পারছে।"

অন্বেষার ঠোঁট নড়ে, আস্তে আস্তে প্রার্থনার মতন করে বলে, " সত্যিকারের শিক্ষাদীক্ষার দিন আসবে একদিন আসবেই, কিন্তু সে কবে? "





*****

বেলা পড়ে আসে, সূর্যের আলোয় নরম ভাব। যদিও এখনই আমাদের ফিরতে হবে না, কালও তো ছুটি, রবিবার। এখানের পিকনিক স্পটে দেওয়ালহীন কাঠের ছাদওয়ালা ঘরগুলো বেশ, রোদ বৃষ্টি থেকেও বাঁচায় আবার ঘরের ভিতর আছি বলেও মনে হয় না।

আমরা সে ঘর থেকে বার হয়ে লেকের কাছে গিয়ে বসি, পাড় থেকে ঝুঁকে পড়ে জলে হাত ছোঁয়ায় অন্বেষা, আমি যেন হঠাৎ লাইভ ইলেকট্রিক তার ছুঁয়েছি এমনভাবে ভিতরে ভিতরে চমকে উঠি, ওর হাত ছাড়া সবকিছু আউট অব ফোকাস হয়ে যায়, মনে পড়ে সায়ন্তনীর কথা। এটা আগের স্কুলের কথা, প্রাইমারির। ওখানে কিন্ডারগার্টেন ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর অবধি ছিলো। ওটা ছিলো সহশিক্ষার স্কুল, ছেলেরা মেয়েরা একই স্কুলে পড়াশোনা।

"অন্বেষা, তোর সাথে একই স্কুলে পড়লাম গোটা প্রাইমারি, সেখানের তোর কথা মনে পড়ে না কেন রে? এর কারণ কী? আমার দুর্বল স্মৃতি নাকি অন্য কিছু? "

অন্বেষা হাসে, সে আবার পুরানো মুডে ফিরে গেছে। বলে, "তুলি, শরদিন্দুর গৌড়মল্লার পড়েছিস? সেখানে রাজা শশাঙ্কের ছেলে মানব কী বলছিলো? পরাজিতকে কেউ মনে রাখে না। সেখানে আমি ছিলাম ভীড়ের মানুষ, প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়ের ভিক্টরি বেদীতে আমাকে দেখতে পাস নি, তাছাড়া নাচ-গান জানতাম না, ফাংশানে পরীর নাচে দেখিস নি, মনে থাকে কী করে বল? মনে রাখার কিছু একটা উপলক্ষ্য তো লাগবে!"

"সে আমিও তো সেখানে ভীড়ের মানুষই ছিলাম, নাচগান আমিও পারতাম না, মেধাতালিকায়ও উপরের দিকে ছিলাম না। তোরও নিশ্চয় সেখানের আমাকে মনে নেই?"

অন্বেষা কিন্তু অবাক করে দিয়ে বলে, " না, তোর একটা স্মৃতি আমার আছে। ক্লাস থ্রীতে তুই আর সায়ন্তনী একবার যুগ্মভাবে একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিলি একটা হঠাৎ হওয়া ফাংশানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজারিণী কবিতাটা। অত বড় কবিতা মাত্র কয়েকবার রিহার্সাল দিয়ে তোরা দু'জনে এমন সুন্দর পারফর্ম করেছিলি একসাথে, টিচাররাও অবাক! এখনো যেন শুনতে পাচ্ছি প্রথম স্তবক বললি তুই,

"সেদিন শারদ দিবা অবসান

শ্রীমতী নামে সে দাসী

পুণ্য শীতল সলিলে নাহিয়া

পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া

রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া

নীরবে দাঁড়ালো আসি।"

তুই শেষ করতেই সায়ন্তনী ধরে নিলো একদম পুরো সঠিক টোনে,

"শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা

একথা নাহি কি মনে?

অজাতশত্রু করেছে রটনা

স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা

শূলের উপরে মরিবে সে জনা

নতুবা নির্বাসনে।"

তারপরের স্তবক আবার তুই। এরকম তো আগে হয় নি ওখানে, সবার চমক লেগেছিলো। "

ঐ ফাংশানের কথা আমারও মনে ছিলো না, অন্বেষার কথায় আবার মনে পড়লো ছায়া-ছায়া। আর আবার এই কথার সূত্রেও মনে পড়লো সায়ন্তনীকে। সে আজ তার ভাগটুকু না নিয়ে যাবে না।

দীঘা যাচ্ছিলাম আমরা স্কুল থেকে, ক্লাস ফোরের চল্লিশজন ছাত্রছাত্রী আর সঙ্গে আমাদের ক্লাস টিচার পরমাদিমণি আর আরেকজন দিদিমণি যিনি প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়াতেন সেই সোমাদিমণি। আলাদা বাসভাড়া করে আমাদের যাওয়া, খুব ভোরে স্কুলের সামনে থেকেই ছাড়লো বাস। সেদিন যাওয়া, পরদিন থাকা, তারপরদিন ফেরা। আমাদের উৎসাহের শেষ নেই, এই প্রথম স্কুল থেকে এক্সকার্শানে যাওয়া। আগে তো এরকম হতোই না, নেহাত আমাদের ক্লাস টীচার নতুন যোগ দিয়েছেন কাজে, নতুন আদর্শবাদ তার ভিতরে টগবগ করছে। আমাদের সমুদ্র দেখাবেন, চারপাশের পরিবেশ বোঝাবেন, আরো কত কী করবেন। আমরাও টগবগ করছি সেই নয়/দশ বছরের নতুন কৈশোর টগবগেরই তো সময়।

গোটা পথে আনন্দ করতে করতে আমরা গেলাম, সমুদ্র দেখলাম, কিন্তু ফেরার পথে সবাই চুপ, পাথরের মতন ভারী হয়ে রইলো বাতাস। সবাই ফিরছে সায়ন্তনী বাদে। স্নান করতে নেমেছিলাম আমরা সবাই। কখন সায়ন্তনী ঢেউয়ের ধাক্কায় ডুবজলে চলে যায়। তারপরে আরো আরো গভীরে। সমুদ্র তাকে টান দিয়ে নিয়ে গেল, দেহটা ফিরে এলো পরে।

"অন্বেষা, তোর মনে পড়ে সেই দীঘা যাওয়া? সায়ন্তনী---- "

ও মাথা হেলিয়ে জানায় মনে পড়ে, আস্তে আস্তে বলে, "সেই মেয়ে দশ বছরেই থেমে রইলো, চিরদিনের কিশোরী। বড় হতে হতে মানুষের সংসারের শঠতা ক্রুরতা বিশ্বাস ভাঙা এসব আর দেখতে হলো না ওকে।"

নিশ্চুপ হয়ে যাই আবার আমরা, বাতাসও যেন চুপ। গর্ভবতী নিস্তব্ধতা। বহুযুগের ওপারের একটা বাচ্চা মেয়ে কাজলকালো চোখ দুটো মেলে আমাদের দিকে চেয়ে থাকে যেন। ওর ঠোঁটে অভিমানের রেখাগুলো পড়তে পারি, সে যেন বলছে, আমার যে আর বড়ো হওয়া হলো না!

সত্যি কি সে নেই? হয়তো ছড়িয়ে গেছে আমাদের সবার মধ্যে, বড় হয়েছে আমাদেরই নকশিকাঁথার মতন বিচিত্র জীবনে। আজকের এই স্মৃতিকথা, আগামীকালের অন্য কারুর আরো কোনো অন্য স্মৃতিকথা, এসব তো সেই তাদের জন্যও, চিরকিশোর-চিরকিশোরী সেইসব চলে যাওয়া বন্ধুরা, আমাদের জীবন্ত হৃদয়গুলোর প্রতি স্পন্দনে যারা রয়ে গেছে লীন হয়ে।

এখন একেবারে আলো কমে গেছে, একটা দুটো তারা ফুটছে। আমরা ফেরার পথ ধরি।

(চলবে )