Sunday, August 23, 2009

আকাশ

1.

সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির -মাঝে মাঝে কেমন হয় যেন হয় আশমানির। এক একটা শব্দ সারাদিন রিনরিন করে মনের মধ্যে বাজতে থাকে। আজকে যেমন এই সূর্যশিশির! কি সুন্দর কথাটা। অথচ এর মানেটা তেমন কিছু ভালো নয়, একরকমের পতঙ্গভুক উদ্ভিদ, কলসপত্রীর মতন। কলসপত্রী নামটাও কী চমৎকার ! এইসব গাছেদের এরকম সুন্দর নাম দেওয়ার পিছনে মানুষের কি কোনো বিশেষ মানসিকতা আছে?
সূর্যশিশির, সূর্যশিশির, সূর্যশিশির-আশমানি হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলো পার্কিং লট, পলিমার-সায়েন্সের বিশাল সুন্দর বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে চলার সময় সারিবাঁধা পাইনের দিকে চাইলো , তারপরে ক্রস করলো চওড়া লিংকন রোড-পুরো সময়টা মনের মধ্যে রিনরিন করে বাজছে সূর্যশিশির। গ্রীন হাউসের সামনে এসে হঠাৎ ওর মনে হলো, "আরে ফোন করার কথা ছিলো তো! এখন কি পাওয়া যাবে?"
মুঠাফোন বের করে ফোন করতে করতেই কুয়াশা কেটে একঝলক রোদ পায়ের কাছে, হালকা একটু হাওয়া, আকাশে এক ফালি নীলও। রিং হচ্ছে, কেউ একজন ধরেছে, কথা বলছে। আশমানি অল্প কেঁপে যাওয়া গলায় বললো," হ্যালো, সূর্য আছে? ”

2.
সবাই যখন ব্যস্ত থাকে নানা কাজে, তখনই কি কুঁড়িরা ফুল হয়ে ফুটে যায়? টুপ টুপ করে তারাগুলো কি তখন নেমে পড়ে সমুদ্দুরে?কেউ যখন দ্যাখে না ওদের? ছোট্টো মিমি চুপ করে ভাবে করবীগাছের তলায় দাঁড়িয়ে, এখান থেকে কতদূর দেখা যায়!
ঝুরিনামা বটের পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা, একটু এগোলেই রমাদিদের বাড়ি, তারপরে জোড়া মাঠ পেরিয়ে জোড়া পুকুর, তারপরে ঝুনিদিদের বাড়ী। ঝুনিদিদের পাশেই অনুদের বাড়ী, ওর ভালোনাম অনুব্রতা।
ঐ তো ওরা গানের ক্লাসে চলে যাচ্ছে খাতা নিয়ে, শনিবারের বিকেলমাঠ একলা পড়ে আছে চুপ, কেউ খেলবে না চু-কিৎকিৎ, বুড়ী বসন্তী, কাকজোড়া, নামপাতাপাতি বা বানানো কোনো খেলা আজ এখানে। তাই বুঝি মাঠের মনখারাপ? মিমির চোখে শিশির জমে ওঠে, সে একা একা খেলতে যেতে পারে না। সে দাঁড়িয়ে থাকে করবীতলায়, কেউ যদি ফিরে আসে? কারুর যদি গানের ক্লাস আজ না হয়?

3.
"কালপুরুষ চেনা খুব সোজা। ওই যে দ্যাখ তিনখানা তারা জ্বলজ্বল করছে একলাইনে, কালপুরুষের কোমরবন্ধ ওটা।" বসন্তের সন্ধ্যা, বাতাস বইছে ধীরে। ভারী মধুর এইসময়টা। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আশমানিকে তারা চেনায় হিন্দোল।
অবাক হয়ে জ্বলজ্বলে কালপুরুষের দিকে চেয়ে থাকে আশমানি, সামনে অন্তহীন ঢেউ আসে ঢেউ যায়। অতলান্তিক মহাসাগরের ঢেউ। নতুন খইয়ের মতন অগনন তারা ছড়ানো নির্মল বাসন্তী সন্ধ্যায় কী এক তরঙ্গ এসে লাগে তার প্রাণের গভীর গোপণ নিশীথবীণায়, সেখানে মঞ্জরিত স্বর্ণপলাশের নিচে কে যেন বসে আছে স্তব্ধ অপেক্ষায় তার জন্য।
কে সে? অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না। এই কি সেই গানের মানুষ-"ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন/তলাতল খুঁজলে পাতাল পাবিরে সেই কৃষ্ণধন" ? সেই? আশমানি ঠিক বুঝতে পারে না। দু'চোখ জলে ভরে ওঠে তার! কেন সে এমন? সাথীদের সাথে থেকেও এত একা? তীব্র দলছুট হৃদয় তার নির্জন বনে অশ্বত্থগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখুনি কোথা থেকে উড়ে আসবে লোককথার সেই অলৌকিক নীলপাখি, একটি পালক এসে পড়বে তার সামনে।

4.
"সময় আমাদের ঘিরে রাখে মৃদু বৃষ্টির মতন
অশেষ সময়
সুখদুখমন্থন সময়
মেঘপালকের মতন ঘরের মতন উড়ে যায় জীবন----"

কথাগুলো গুণ গুণ করতে করতে আশমানি মনে করতে চেষ্টা করে কার লেখা লাইনগুলো। মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। ছাদের উপরে স্নিগ্ধ ঠান্ডা রাত, ঘুমেলা চোখে এসে লাগে তারাদের বিস্ময়, কতকাল হয়ে গেলো সে দেখছে ওদের, অথচ পুরানো হয় না, একই প্রথমদিনের ঝিমঝিম শিরশিরানি চারিয়ে যায় ওর চোখের ভিতর দিয়ে আরো ঘন গহণে।
"বাণী নাহি তবু কানে কানে/কী যে শুনি----" কে গাইতো? আশমানির গলায় সুর নেই, ওকে গেয়ে শোনাতো অন্য কেউ। কে সে? কোথায় সে? কবে গাইতো? তাকে মনে পড়ে না কেন আশমানির? কী অদ্ভুত! সে স্পষ্ট শুনছে সে গাইছে, সুন্দর সুরময় কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেঘপালকের ঘর পর্যন্ত-
"আকাশ জুড়ে শুনিনু ঐ বাজে
তোমারি নাম সকল তারার মাঝে
সে নামখানি নেমে এলো ভুঁয়ে
কখন আমার ললাট গেলো ছুঁয়ে---",
অথচ মুখ মনে পড়ে না, চোখ মনে পড়ে না, নাম মনে পড়ে না!সে যেন শুধু সুর, শুধু গান। তারাগুলি যেন ঘিরে এসেছে গান শুনতে।

5.
চারিদিকে জল, ছলছল জল। এই দ্বীপ খুব ছোটো। যেকোনো দিকে একটুখানি গেলেই নীল সমুদ্র। অথৈ সমুদ্র। গোলমরিচের লতাজড়ানো নারিকেলকান্ডে ঠেস দিয়ে বসে থাকে সে। তার কী যেন একটা করার ছিলো, কিছুতেই মনে পড়ে না। কী তার নাম সেও মনে নেই। সে কোথা থেকে এলো এখানে সেও সে জানে না। আনমনে সে লতায় হাত রাখে, ভাবে কী যেন একটা করার ছিলো! মনে পড়ে না কেন?
সে ভাবে কী নাম না খুঁজে নিজেই নিজেকে একটা নাম দিয়ে দিলে কেমন হয়? মনে হতেই উঠে দাঁড়ায় সে, চলতে থাকে, জলরেখার একদম কাছে এসে থামে। হেসে ওঠে অকারণে।
দূরে আকাশ যেখানে নত হয়ে পড়েছে জলে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে লাল সূর্য, লাল হৃৎপিন্ডের মত, স্পন্দিত আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। প্রথম মানবীর মতন একলা মেয়েটি আবার হেসে ওঠে, আবরণমুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় জলের দিকে, অবগাহণপ্রত্যাশায়।
ওর খোলা চুলের ঢালে জড়িয়ে যায় সাদা ফেনা, চিকচিক করে ওঠে ভোরের আলো। স্নান করতে করতে সে হাসছে, তার কিচ্ছু মনে নেই সে কে, অথচ মনে আছে আকাশ, জল, সূর্য, আগুন, মাটি, বালি, ঝিনুক। দু'হাতের মুঠায় নোনাপানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে চেঁচিয়ে বলে, "শোনো শোনো তোমরা শোনো, আমি আমার নাম দিলাম আকাশ।"